Ad Code

মানুষ কাঁদছে

লেখকঃ ইমদাদুল হক মিলন

 হাতের তাস ছুঁড়ে ফেলে রহিম বলল, কাইলা, সাফল দে।

কালু সবগুলো তাস একত্র করে ফরফর করে সাফল দিল। হাতে সিগারেট ছিল, কায়দা করে ঠোঁটে গুঁজে দ্রুত নটা করে তাস বেটে দিল।

রহিম তিনটা তিনটা করে তাস তোলে। প্রথম তিনটা তুলে রহিম বেশ খুশি। চার পাঁচ ছয়, রান। পরের তিনটা তুলে দেখে দুটো গোলাম। সবশেষের তিনটা তোলার সময় রহিম মনে মনে একটু আল্লাহ খোদার নাম নেয়। এই দান না পেলে পকেট একদম ফাঁকা হয়ে যাবে। সকালবেলা নাস্তা খাওয়া হবে না, খেলাও হবে না। আর যদি আল্লাহ আল্লাহ করে পেয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। চার হাত খেলছে। কিট্টি। একটাকা বোর্ড। একবার পেলেই তো তিন টাকা। তিন চারটা দান পেলে দিনের খরচা ওঠে যাবে। তার ওপর আজ আবার মঙ্গলবার। নটা দশটার দিকে গোডাউন খুলবে। কন্ট্রাকটররা ট্রাক নিয়ে, ঠেলাগাড়ি নিয়ে আসবে সিমেন্ট নিতে। বখশিশ তো পাঁচ টাকা-পাওয়া যাবেই। আর যদি আশরাফ মিয়ারে একটা পাট্টি ধরাইয়া দেওন যায়।

Facebook

এসব ভাবতে ভাবতে শেষ তিনটা তাস খোলে রহিম। না কিছু হয়নি। নটা তাস একত্র করে তবুও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাজানোর চেষ্টা করে রহিম। ওই। চার পাঁচ ছয় রান। তারপর গোলামের জোড়া। শেষবার, কিচ্ছু না। বিবি টপ।

তবুও খেলাটা চালিয়ে যায় রহিম।

 প্রথমে তাস ফেলে নোয়ব। তিনের ট্রায়ো। দেখেই হয়ে যায় রহিমের। নিজের তাসগুলো সব ফেলে দেয়। বোর্ডে চারটে একটাকার নোট। একপলক টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে খালপাড় থেকে উড়ে আসে রহিম। নোয়ব, কালু আর লাটমিয়া খেলবে। সারাদিন। কারবারই এটা। এলাকার পুলিশের সঙ্গে লাইন করা আছে। ধরবে না। এসব। ভাবতে ভাবতে স্টেক দেয়া ইটের ফাঁকফোকর দিয়ে বটতলায় আসে রহিম।

বটতলায় একটা চায়ের দোকান। সামনে দুখান বেঞ্চ পাতা, ভেতরে চেয়ার টেবিল। লোকজন বাইরে বসে চা খায়, ভেতরে বসে খায়। বেশির ভাগই লেবার, রিকশাঅলা। কিছু আছে ট্রাক ড্রাইভার। কখনও দুচারজন কন্ট্রাকটরও বসে। চা খায়, সিগারেট খায়, তারপর চলে যায়।

 রহিম আশায় আশায় চায়ের দোকানটায় যায়, যদি কোনও কন্ট্রাকটরের সঙ্গে দেখা হয়, স্যার নাশতা করান।

YouTube

কেউ খেতে থাকলে তার সামনে গিয়ে খাওয়ান বললে লোকে না খাওয়ায় কেমন করে। এই কথাটা ভেবে রহিম বেশ খুশি। ভাবে, মাথায় কম বুদ্ধি না আমার!

তো রহিমের বরাত ভালো। দোকানের ভেতর বসে আছে তিনজন। শওকত সাবের ম্যানেজার, আরিফ সাব আর আশরাফ মিয়া। আশরাফ মিয়া তার সাইকেলটা রেখেছে। বটগাছটার সঙ্গে ঠেস দিয়ে। সেখানকার মাটিতে দুটো কাক চরছে। আর গাছটার ওপর কা কা করছে কতগুলো। চারদিকে রোদ, কড়া রোদ। রহিম টের পায় একটু হেঁটেই তার গাটা চিরবির করছে ঘামে।

চায়ের দোকানটার সামেন দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস টানে রহিম। খালপাড়ের মাটিতে বসে খেলেছে, পাছার কাছে লেপটে আছে সাদা মাটি। রহিম খেয়াল করেনি। দোকানের ভেতর থেকে আশরাফ মিয়া বলল, ও রহিম বাদশা তোমার পাছায় কি?

শুনে চায়ের দোকানের যে ছেলেটা কড়াইয়ে টুপটুপ করে ডালপুরি ছাড়ছিল সে গলা খুলে হেসে ওঠে। হাসে রহিমও। অন্য সময় হলে হয়তো রেগে যেত। এখন রাগ করা যায় না। আশরাফ মিয়াকে পটিয়ে নাশতাটা খেতে হবে।

 রহিম দোকানে ঢোকে। নাশতা খাওয়ান বাই।

আশরাফ মিয়া চা খাচ্ছিল। বলল, একটা পাটি দর।

ধরুমনে। বলে রহিম আশরাফ মিয়ার পাশে বসে। তারপর নিজেই চায়ের দোকানের ছেলেটাকে বলে, চাইরডা ডাইল পুরি দে। আর এককাপ চা।

শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজার বলল, কি রে রহিম, খবর কি?

রহিম ডালপুরি খেতে খেতে বলল, ভালাই।

তর বাড়ির ভাড়া পাছ না?

রহিম কথা বলে না। হাসে।

TikTok

রহিমের চারটে বাড়ির গল্প সবাই জানে। এই নিয়ে রহিমকে টিটকিরিও মারে, হাসাহাসি করে। রহিমের তাতে কিছু যায় আসে না। রহিম জানে সে চারটে বাড়ির মালিক। থাক না তাতে অন্য লোক, মালিক তো রহিম।

চা খেতে খেতে রহিম তারপর বাড়িগুলোর কথা ভাবে।

সামনের রাস্তা দিয়ে ঠিক তক্ষুনি লাল হোন্ডা চালিয়ে ওভারসিয়ার কেরামত যায়। পেছনে দুটোট্রাক, গোটাকয় ঠেলাগাড়ি। কন্ট্রাকটররা আসছে। কেরামত ওভারসিয়ার এক্ষুনি গোডাউন খুলবে। তারপর শুরু হয়ে যাবে সিমেন্ট দেয়া।

হোন্ডার শব্দ পেয়ে চায়ের দোকান থেকে বেরোয় শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজার, আরিফ সাব। সবশেষে আশরাফ মিয়া। রহিম ততক্ষণে আশরাফ মিয়াকে পটিয়ে একটা স্টার সিগারেটও যোগাড় করে ফেলেছে। এখন বেদমসে টানছে। চেহারায় বেশ ফূর্তি ফূর্তি একটা ভাব তার।

 খানিক আগে সামনের রাস্তা দিয়ে যে ট্রাকগুলো গেছে তার চিহ্ন এখন রোদে হাওয়ায় ভাসছে। রহিম সে উড়ন্ত ধুলোবালির দিকে তাকিয়ে কী জানি কী কারণে সিগারেট টানতে টানতে গভীর করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আরিফ সাহেব আর আশরাফ মিয়া অদূরে খুব নিচু গলায় কী কী সব আলাপ করছে। সেদিক তাকিয়েই রহিম বুঝে গেল মাল কেনার লাইন করছে আশরাফ। আশরাফকে ধরতে হয়। দশ টাকার একটা নোট খসাতে হয়।

Threads

কিন্তু ওভারসিয়ার সাব এসে গেছে, রহিমকে একবার গোডাউনের দিকে যেতে হয়, চেহারাটা একবার দেখাতে হয়। চাকরি না!

 যখন যাওয়ার কথা ভাবছে ঠিক তখুনি আশরাফ মিয়া ডাকল, হোন রহিম।

রহিম দৌড়ে যায়। পয়সাপাতির লাইন অইব মনে অয়।

আশরাফ মিয়া বলল, দুইডা ঠেলা লইয়া আয় রহিম।

কই যাইব?

 খিলগাঁও।

ভাড়া?

আবে তোর মাথায় ঘিলু নাই? দরদাম কইরা আনবি।

আইচ্ছা!

তাড়াতাড়ি যা।

রহিম একটু মাথা চুলকায়। পরনের খাকি শার্টটার খুঁট নাড়ে। তারপর বলে, যাওন লাগব তো টিকাটুলির মোড়ে। রিকশা ভাড়া দাও।

আমার সাইকেলডা লইয়া যা।

রহিম ভালো সাইকেল চালাতে পারে না। কোন ছেলেবেলায় ধুপখোলা মাঠে কয়েকদিন শিখেছিল। তারপর সারাজীবনে বার চারেক। রহিম কি পারবে!

কিন্তু আশরাফ মিয়া রিকশা ভাড়া দেবে না। হেঁটে গেলে যেতে আসতে আধঘণ্টা। ওভারসিয়ার সাব রেগে যাবে। আর না গেলে আশরাফ মিয়ার কাছ থেকে লাল দশ টাকার নোটটা আদায় করা যাবে না।

রহিম আল্লাহর নাম নিয়ে বটতলা থেকে আশরাফ মিয়ার ঝরঝরে সাইকেলটা নেয়। বার দুয়েক চেষ্টা করে চড়তে যাবে, ডাকলো শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজার। কই। যাইতাছ রহিম বাদশা?

টিকাটুলি যামু।

Instagram

হোন। বলে ম্যানেজার সাহেব তিনটা কড়কড়া দশ টাকার নোট বের করে। টাকাগুলো দেখেই রহিমের বুড়ো চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। কিছু আনতে দিলেই অয়, একটা টেকার কাম অইব।

ম্যানেজার সাহেব বলল, এক প্যাকেট ফাঁইভ ফিফটি ফাইভ আনবি।

রহিম হাসে। কার লেইগা? আইজকাল ফিফটি ফাইব খান নি?

না বে। একজনরে দেওন লাগব। বলেই হাসে। সঙ্গে সঙ্গে রহিম বুঝে নেয় ম্যানেজার সাব ঘুষ দিব।

টাকাটা পকেটে পুরে সাইকেলে চড়ে রহিম। কয়েকবার চেষ্টা করে চড়ে। দেখে আশরাফ মিয়া, ম্যানেজার আর আরিফ সাহেব খুব হাসে। রহিম গা করে না। টালমাটাল ভাবে সাইকেলটা চালিয়ে যায়। চালাতে চালাতে নিজের ওপর বেশ খুশিও হয়ে ওঠে একসময়। বা বা, কতদিন বাদে সাইকেল চালাইতেছি, ভালাই তো পারতাছি।

এসফল্ট প্লান্টের মিকচার মেশিনটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে রহিম বোটকা একটা গন্ধ পায়। দুনিয়ার পচাচা মাল আইনা ফেলায় এখানে। এইডা ঠিক কুত্তাপচা গন্ধ। টাউনের হগল কুত্তাডি মারতাছে সুই দিয়া। মাইরা গাড়ি ভইরা ফালাইয়া যায় এহেনে।

সাইকেলে বসে টালমাটাল অবস্থায়ও সামনের.পচা ডোবাটার দিকে তাকায় রহিম। হ, যা কইছিলাম। দেহো কতডি মাইরা হালাইছে। পইচ্চা ফুইল্লা এহেকখান দারোগা অইয়া গেছে। কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই সাইকেল নিয়ে কাত হয়ে পড়ে রহিম। একটু আনমনা হয়ে গেছিল। সামনে উঁচু ঢিবি ছিল, টাল সামলাতে পারে না। পড়ে একদম গড়াগড়ি খায়।

 হলে হবে কী পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার লাফিয়ে ওঠে রহিম। জামাটা লুঙ্গিটা ঝাড়তে ঝাড়তে চারদিকে চায়। কেউ দেখে ফেলেনি তো! দেখলে আবার হাসাহাসি করবে। টিটকিরি মারবে। দুয়ো রহিম বাদশা সাইকেল চালাতে পারে না। পোলাপানে দেখলে আরো খারাপ। ইটা মারব।

WhatsApp

রহিম আবার সাইকেলে চড়ে। পঁচা গন্ধ পেছনে ফেলে, রোদের ভেতর দিয়ে চালিয়ে যায়। ঠেলা ঠিক করতে পারলে নগদ দশ টাকার কাম। আর ম্যানেজার সাবের সিগারেট থেকে একটাকা, তার ওপর ম্যানেজার সাহেবকে ধরে আর একটা টাকা বখশিশ। মোট বার টাকার কাম। জুয়ায় হেরেছে ছটাকা আর এখুনি কামিয়ে নিচ্ছে বার টাকা। আবার আশরাফ মিয়ারে একটা পাট্টি ধইরা দিতে পারলে বিশ ত্রিশ টেকার কাম। এই গোটা পঞ্চাশেক টেকা কামাইয়া হালাইতে পারলে, এই অব্দি ভেবে সুখে বিভোর হয়ে যায় রহিম। তাইলে আইজ রাইতে মেথরপট্টিতে যামু ভরপেট মাল খামু। তখন রহিমের সাইকেল পাকা রাস্তায় পড়েছে। দুদিক থেকে শাঁ শাঁ করে আসছে বাস ট্রাক রিকশা বেবিট্যাক্সি। খুব সাবধানে, নরম পায়ে ধীরে সাইকেলটা টেনে নেয় রহিম। আর মনে মনে বিশাল এক সুখে বিভোর হয়ে থাকে।

খানিক দূর এসে রাস্তার মাঝখান দিয়ে যে রেললাইন চলে গেছে, কষ্টেসিষ্টে তার ওপর চড়ে রহিম। টের পায় ঘামে চিরবির করছে শরীর। বুড়ো বয়সে সাইকেল টানার কষ্ট কি কম! তবুও এসব কষ্ট গায়ে লাগে না রহিমের। বিশ পঞ্চাশ টাকার কাম হয়ে যাবে আজ। আহা রাতের বেলা পুরো একটা বোতল।

এসব ভাবতে ভাবতে ঢালে নামে রহিম। ঢালে নামার সঙ্গে সঙ্গে টের পায় সাইকেলটা তার আওতায় থাকছে না, পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। কী করে, রহিম এখন কী করে। প্রাণপণে দাঁত মুখ খিচে ব্রেক চাপার চেষ্টা করে। কাজ হয় না।

তখনি উল্টোদিক থেকে দুপাশের বাতাস তীব্র বেগে ছিটকে দিয়ে ছুটে আসে মাল বোঝাই পাঁচটনি একটা ট্রাক। মুহূর্তে হা করা বিশাল অজগরের মতো টুপ করে গিলে নেয় রহিমকে, রহিমের সাইকেলটাকে। দুমড়েমুচড়ে দিয়ে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো পৃথিবী জেনে যায় আজ থেকে তার সঙ্গে মিউনিসিপ্যালিটির পিয়ন, চারখান বাড়ির মালিক রহিম বাদশার কোনও সম্পর্ক নেই।

.Facebook

আমাদের ট্রাকটা এসেছে বেশ সকালে। দুশো ব্যাগ সিমেন্ট যাবে। কাজ চলছে। রায়েরবাজার। বেশ বড় কাজ। চার লাখ আশি হাজার টাকার একটা ডিপ ড্রেন আর ফুটপাত। ছ ইঞ্চি ঢালাই। কুচি পাথর নেয়া শেষ হয়েছে দশ দিন আগে। ড্রেনের বেড় আর সাইড ওয়ালের জন্যে ইট নেয়া বাকি আছে কিছু। হাজার আটেক নিতে হবে আরো। সাইটে রাখার জায়গা নেই বলে আপাতত নিচ্ছি না। কিন্তু প্রায় সবকিছু রেডি থাকার পরও কাজটা শুরু করা যাচ্ছে না। সিমেন্ট ছিল না গোডাউনে। সিমেন্ট ওঠেছে পরশুদিন। সাড়ে ছহাজার ব্যাগ। তিন দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সিমেন্টের অভাবে কন্ট্রাকটররা সাইট বন্ধ করে বসে আছে। ইনডেন্ট পকেটে নিয়ে ঘুরছে।

এবার তাই সিমেন্ট ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লাইন দিয়েছে সবাই। আমরা সিমেন্ট পাব অনেক। পাঁচ সাতশো ব্যাগের মতো। কিন্তু পুরোটা একবারে দিচ্ছে না। দুচার দিনের মধ্যে আরো সিমেন্ট উঠবে। তখন পুরোটা দিয়ে দেবে। এবার দুশো ব্যাগ দিয়েছে শুনে আমার স্যার ভীষণ রেগে গেছেন। কাজটা ঢিলে হয়ে গেল। একটা কাজ নিয়ে বসে থাকলে তো আর শওকত কন্ট্রাকটরের চলে না। একটার পর একটা কাজ করার অভ্যেস তাঁর। কাজহীন থাকতে চান না লোকটা। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে বলছিলেন, আপনি অর্ডার দিন স্যার, বাইরে থেকে সিমেন্ট কিনে কাজটা শেষ করে ফেলি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অর্ডার দিলেন না। স্যার আর কী করেন, নেংড়া ঘোড়ার মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই কাজটা চলবে।

স্যার বলে কাজে ডিলে হলে লস। খরচা বেড়ে যায়। ধুমধাম করে কাজ শেষ করে ফেল, লাভ আছে।

এসব কথার কথা। শওকত কন্ট্রাকটরের সব কাজেই লাভ। মাস্টার লোক। এই বাজারেও ফরটি পার্সেন্ট লাভ তুলে নেবে যে কোনও কাজ থেকে। নিজে সাইটে থাকবে, কাজের দেখাশোনা সব আমি করি আর ওস্তাগার আছে কাদির। শওকত কন্ট্রাকটরের বাঁধা। এই একজনের কাজ করেই কূল পায় না কাদির।

বছর ভর স্যারের সঙ্গে লেগে আছে। মাসে দুমাসে পাঁচসাত দিন ছুটি পায়। কখনও নাগাড়ে ছমাস পায় না। সাইটে ইটের স্টেক দিয়ে তার ওপর ঢেউটিন ফেলে লোকজন। নিয়ে থাকে।

রহিম আসুক।

YouTube

এনায়েত চলে যেতে আমি একটা সিগারেট ধরাই।

চায়ের দোকানের সামনে বসে আছে আরিফ সাহেব আর আশরাফ মিয়া। দুজনের চেহারাতেই উৎকণ্ঠা। বুঝতে পারি রহিমের ওপর আস্তে ধীরে রেগে যাচ্ছে ওরা। রহিম এত দেরি করছে কেন?

কিন্তু রহিমের ব্যাপারে আমার তেমন মাথাব্যথা নেই। যখন ইচ্ছে ফিরুক। আমাদের মাল সন্ধ্যায় গেলেই বা কী! লস হলে এনায়েতের হবে। সেটা দেখবে আমার স্যার। এনায়েতের জন্য আমার এক প্যাকেট সিগারেট ব্যয়, সেটা আমি এনায়েতের নামে খাতায় লিখে রাখব। তখন দুশো টাকা থেকে সিগারেটের দামটা বাদ যাবে কি যাবে। না সেটা স্যারের ব্যাপার, এনায়েতের ব্যাপার।

সিগারেট টানতে টানতে আমি বটতলা ছাড়িয়ে দূরে স্কুল বাড়ির মাঠটার দিকে হেঁটে যাই। সবুজ উদাস মাঠখানা চিরবিরে রোদে বোকার মতো পড়ে আছে। দূর থেকে গাঢ় সবুজ ঘাস দেখে আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে গ্রামের কথা মনে পড়ে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। আর মনে ওড়ে বৈচির কথা। আমি বৈচিকে বড় ভালোবাসতাম। আর ভালোবাসতাম শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমার নাম মানিক। পিতা মরহুম গফুর খা। পৈতৃক নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। থানা লৌহজং গ্রাম মাইজগাঁও। শিক্ষাগত যোগ্যতা ম্যাট্রিকুলেট। পেশা শওকত কন্ট্রাকটরের একমাত্র ম্যানেজার। মাস মাইনে সাড়ে চারশো।

TikTok

আমার বাবা ছিলেন সামান্য কৃষক। চার বোন এক ভাইয়ের সংসার আমাদের। চার কানি জমি ছিল মাইজগাঁওয়ের বিলে। আউশ আমনে সারা বছর ম ম করত আমাদের বাড়ি। বাবা লেখাপড়া জানতেন না। তবুও আমাকে কৃষিকাজে না দিয়ে ব্রাহ্মণগাঁও হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে ছিলেন। কটোমটো করে ম্যাট্রিক পাশটা আমি করে ফেলি। তখনই শুরু হল দুর্দিন। দুটো মেয়ে বিয়ে দিতে বিলের দুকানি জমি গেল বাবার। আমার কলেজে পড়া হল না। সংসারে দেখা দিল অনটন। আমি তখন বেকার। ক্ষেতখোলা দেখাশোনা করব, পারি না। বাবা আমাকে শেখায়নি। ঘুরেফিরে দিন কাটে। সে সময় একদিন পূর্বপাড়ার তরফদারের মেয়ে বৈচির সঙ্গে দেখা। বয়স খারাপ, দেখতে দেখতে বৈচির সঙ্গে হয়ে গেল প্রেম। রূপ ছিল বৈচির। অন্ধকার রাতে সাপের মণি যেমন। আমি রাতবিরাতে বৈচির সঙ্গে দেখা করি। একদিন দেখা না হলে সারাদিন মন খারাপ। ভাতপানি খেতে ভাল্লাগে না। দেখেশুনে বাবা মা আমার বিয়ের কথা ভাবতে বসে। কোথায় কোথায় কনে দেখে বেড়ায়। কিন্তু আমার মন বলে বৈচি। আমি কার কাছে যাব।

 সেই বৈচির সঙ্গে আমার বিয়ে হল না। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বৈচির বিয়ে হয়ে গেল ধাই ধার ব্যাপারি বাড়ি। ব্যাপারিরা পয়সাঅলা, তরফদাররাও পয়সাঅলা। বৈচিকে সোনায় মুড়ে নিয়ে গেল। বিয়ের দুদিন আগে, একরাতে বৈচি আমার গলা জড়িয়ে কী কান্নাটা যে কাঁদল! বলল, চল আমরা পালিয়ে যাই।

আমি কাপুরুষ, পালাতে পারিনি। তরফদাররা দেশ গেরামের মাতব্বর, পয়সাঅলা। তাদের বংশের মেয়ে নিয়ে ভাগলে আমাদের বংশ নির্বংশ করে ফেলবে।

বংশের ভয়ে আমি বৈচিকে ছাড়লাম। বৈচির বিয়ে হয়ে গেল। বৈচির স্মৃতি বুকে নিয়ে আমার দিন কাটে।

তারপর কতদিন কেটে গেল। আমার বাপ মরল। বোনগুলো পুরোনো সংসার ছেড়ে গেল নতুন সংসারে। এখন বুড়ি মা অন্ধকার বাড়ি আগলায়। আমি মাসকাবারি টাকা পাঠাই। দিন চলে যায়।

Threads

আমি কাপুরুষ, কথাটা সত্য। বৈচি চলে যাওয়ার পর আমি আর একজনকে ভালোবাসি, তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আমি রাজনীতি করতাম না, রাজনীতি বুঝিও না। তবুও মানুষটাকে ভালোবাসি।

 শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা লৌহজং মাঠে। দেখা মানে দূর থেকে দেখা। তিনি ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে পাজামা পরে, শীতকাল ছিল, পাঞ্জাবির ওপর পরেছিলেন মুজিব কোট, ডান হাত তুলে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমার বুক জুড়ে বৈচিকে হারানোর দুঃখ। হলে হবে কী, সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যায় শেখ মুজিবকে দেখে আমি বৈচির দুঃখ ভুলে যাই। মুহূর্তে বুঝতে পারি শেখ মুজিবের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হলে আমি বৈচিকে একেবারে ভুলে যেতে পারব। কী করি, কী করি!

 চলে আসি শহরে। তারপর শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজারি। সে সময় আর একবার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার দেখা। আমি রিকশা করে কাজে যাচ্ছি, হঠাৎ সামনে বেজে ওঠল সাইরেন, প্রথমে একটা ছাদ খোলা জিপ, তাতে আর্মড পুলিশ, তারপর কতগুলো হোন্ডার মাঝখানে শেখ মুজিবের গাড়ি। তিনি বসেছিলেন জানালার ধারে। আমি রিকশায় বসে স্পষ্ট দেখি শেখ মুজিবের চেহারায় খানিকটা বিষণ্ণতা। দেখে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছে, শেখ মুজিব তুমি কেমন আছ?

তার কয়েক দিন পর শেখ মুজিব নিহত হন। সেই আমার দুঃখের শুরু। আমার সব গেল, বৈচি, শেখ মুজিব দুজনেই। আমি কাপুরুষ, দুজনের একজনকেও ধরে রাখতে পারলাম না।

তারপর থেকে আমি গোপনে শেখ মুজিবের একটা ছবি আমার মানিব্যাগের ভেতর রেখে দেই। রাতে ঘুমোনোর আগে একবার দেখি। ছবিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বড় অপরাধী লাগে। কাপুরুষ মনে হয়। শেখ মুজিব, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

Instagram

হঠাৎ খেয়াল হয় এসব ভাবতে ভাবতে কাজের কথা ভুলে গেছি। আমি এসেছি সিমেন্ট নিতে। এনায়েত ট্রাক নিয়ে বসে আছে। রহিমকে পাঠিয়েছি সিগারেট আনতে। ইনডেন্টটা আমার পকেটে। দুপুর হয়ে গেল, খিদে পেয়েছে। গেটপাস করিয়ে এনায়েতের হাতে দিয়ে চলে যাব।

 আমি গোডাউনের দিকে হাঁটতে থাকি।

ফেরার পথে রিকশায় বসে আমার একবার রহিমের কথা মনে পড়ে। ত্রিশটা টাকা নিয়ে ভাগল! নিশ্চয় কোথাও জুয়া খেলতে বসে গেছে। পেয়ে নিই হারামজাদাকে।

কিন্তু স্যারকে হিসেব দেব কেমন করে! ঝামেলা হয়ে গেল। খানিক পর সব ঝেড়ে-ঝড়ে ফেলে দিই, যা হয় হবে। এখন ওসব ভেবে মন খারাপ করার মানে নেই। স্যারকে বলব, ত্রিশ টাকা আমি খরচা করেছি।

রিকশাটা তখন আউটফল থেকে বেরিয়ে পুরোনো রেললাইন পেরিয়েছে। হঠাৎ দেখি সামনে অনেক লোকজনের ভিড়। রিকশাঅলা বলল, কে একজন ট্রাক চাপা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে শেষ। শুনে আমার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে। নেমে একবার দেখে যাব। তখুনি শুনি ভিড়ের ভেতর মেয়ে মানুষের কান্না। বুক চাপড়ে কাঁদছে কেউ। মনে পড়ে আমি শেখ মুজিবের জন্য এখন কাঁদিনি। আজ রাতে কাঁদব, মন ভরে কাঁদব। কাঁদলে অপরাধবোধ খানিকটা কমবে।

আমার রিকশা তখন দ্রুত ভিড় পেরিয়ে যাচ্ছে।

.WhatsApp

আশরাফ মিয়া বসেছিল বটতলায়। এখন রোদ হেলে গেছে বটগাছের পশ্চিমে। তলায় পড়েছে দীর্ঘ ছায়া। গাছে ছিল রাজ্যের কাক। সকাল থেকে টানা চিৎকার করছিল। এখন ক্লান্তিতে ঝিমুচ্ছে সব। চারদিকের পৃথিবী চুপচাপ হয়ে আসছে। এবার গরমটা পড়েছে খুব।

আশরাফ মিয়ার ঝিমুনি ধরছিল। এক জায়গায় তিন ঘণ্টা বসে। ঝিমুনি তো ধরবেই। তা ছাড়া আশরাফ মিয়া ওঠে খুব সকালে। প্রায় রাত থাকতে। অনেক দিনের অভ্যেস। ভোররাতে শুলেও ঘুম ভেঙে যাবে ঠিক আযানের সঙ্গে সঙ্গে। তারপর ওঠে প্রস্রাব ও পায়খানা, হাতমুখ ধোয়া, নাশতা করা। এসব করতে করতেও বেলা ওঠে না। তবুও আশরাফ মিয়া বারান্দা থেকে ত্রিশ বছরের সাইকেলটা নিয়ে বেরোয়। বেরিয়ে কত জায়গায় যে যায়। কত রকমের কাজ থাকে মানুষটার। ম্যালা লোকজনের কাছে টাকা পয়সা পাওনা, ম্যালা লোকজনকে আগাম টাকা দিতে হয়। আশরাফের পার্টিরা সব কন্ট্রাক্টর। কিছু আছে দোকানদার, সিমেন্ট রডের কারবার। আবার কিছু আছে দালাল। আশরাফের কাছ থেকে মাল কিনে অল্প লাভে বেহাত করে। এইসব লোকজনের কাছে। সকাল থেকেই যাতায়াত শুরু হয় আশরাফের। পুরোনো সাইকেলটা আস্তে ধীরে, মাঝ বয়েসী শরীরে টেনে টেনে লোকজনের কাছে যায়। দুধারের বুক পকেটে জাম থাকে টাকা। আশরাফের ভাগ্য বটে, যেখানে হাত দেয় সেখান থেকেই ওঠে আসে কড়কড়ে নোট।

 আশরাফ এত টাকা দিয়ে কী করে?

Email

সংসারে বউটা ছাড়া আর কেউ নেই আশরাফের। বিয়ে করেছে পঁচিশ বছর, ছেলেপান হয়নি। বাপের কালের বস্তিবাড়ি শিংটোলায়। একটা ঘরে আশরাফ আর আশরাফের বউ। বাকি চৌদ্দ পনেরটা ঘরে ভাড়াটে। সব রিকশাঅলা পান দোকানদার ওস্তাগার লেবার ধরনের মানুষ। মাসকাবারি পয়সা। ভাড়ার পয়সায়ই চলে যায় আশরাফের। তবুও দালালিটা সে করে। ছেলেপান নেই, কার জন্যে করে কে জানে!

সকাল থেকে আজ আশরাফের মনটা খারাপ হয়েছিল। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ফরাশগঞ্জের এক পার্টিকে দিয়েছিল দশ হাজার টাকা। গতকাল মাল দেবার কথা। সারাদিন বসে থেকে লোকটার কাল পাত্তা পাওয়া গেল না। শালা টাকাটা নিয়ে ভাগল! বলা যায় না, দশ হাজার টাকার ব্যাপার। এই চিন্তায় রাতে ঘুম আসেনি। কারবারে নামা ইস্তক লোকসান করেনি আশরাফ। ভারি হিসেবি মানুষ। হিসেবি মানুষ না হলে এত টাকা-পয়সার মালিক হতে পারত না। বাপে তো টাকা-পয়সা কিছু দিয়ে যায়নি। শিখিয়েছিল ওস্তাগারি। মরে যাওয়ার আগে বাড়িটা আর বউটা দিয়ে গেল। তারপর পঁচিশ ত্রিশ বছর। বউটার ছেলেপান হল না। আশরাফের টাকা-পয়সার খরচা বাড়ল না। এ জন্য আশরাফের কী কোন গোপন দুঃখ আছে।

প্রথম কিছুকাল ওস্তাগারি করেছে আশরাফ। বাড়িভাড়ার পয়সা তখন ছিল কম। তবুও দুজন মানুষের সংসার চলে যেত ভালোই। এ সবের ফাঁকে ফাঁকেও আশরাফ টাকা পয়সা কিছু জমিয়ে ফেলল। তারপর শুরু করল দালালি। প্রথম কিছুদিন পার্টনার ছিল ফরাশগঞ্জের এক সিমেন্ট দোকানদার। লোকটা লাইনটা বুঝত। বছর দুয়েক করার পর আশরাফ নিজেও লাইনটা বুঝে গেল। তারপর পার্টনারশিপ দিল ছেড়ে।

সেই শুরু। দিনে দিনে পয়সা আসতে লাগল। লস নেই, ব্যবসায় লস নেই আশরাফের। টাকা লাগাতেই টাকা। কিন্তু এত দিয়ে আশরাফ কী করবে। তার কোন ছেলেপান নেই। খাবে কে? বউটা মরল, আশরাফ মরলে সব তো কাক চিলে খাবে।

তো আশরাফের ভিতরে ভিতরে একটা ইচ্ছে আছে। বস্তিটা তুলে চারতলা একটা বাড়ি বানাবে। ওস্তাগারিটা তো জানেই। নিজেই করবে কাজটা। তারপর মরে যাবার আগে বউর গলা ধরে, ছেলেপানের দুঃখে একদিন খুব কাঁদবে।

Facebook

 কিন্তু চারতলা বিল্ডিং তুলতে কত টাকা লাগে আশরাফ জানে না। আন্দাজ করে আরও বছর পাঁচেক দালালিটা করতে হবে। তারপর! কিন্তু পাঁচ বছর আশরাফ বাঁচবে তো। বুকের ভেতর সময়ে অসময়ে আজকাল কেমন করে। রাতেরবেলা ঘুম হয় না। সাইকেল চালিয়ে শিংটোলা থেকে ফরাশগঞ্জ যেতে ক্লান্তি লাগে। শুনেছে মরার আগে মানুষের এরকম হয়। তাহলে আশরাফ কি আর বেশিদিন বাঁচবে না। শেষ ইচ্ছেটা কী—এইট্টুকু ভাবতে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। ফরাশগঞ্জের দোকানদারটার কথা মনে পড়ে। দশ হাজার টাকা আগাম দিয়েছে। মাল দেয়ার কথা ছিল কাল। দেয়নি। দিলে হাজার আড়াই টাকা লাভ। পার্টিও ঠিক করে রেখেছে আশরাফ। কিন্তু লোকটাকে কাল পাওয়া যায়নি। হায় হায়, দশ হাজার টাকা না মেরে দেয় শালা। তাহলে সময় যে আর বেড়ে যাবে। পাঁচ বছরে কুলাবে না।

আজ একবার লোকটার কাছে যাবে, আশরাফ কাল রাতেই ভেবে রেখেছে। কিন্তু সকালে ওঠেই মনে হয়েছে আজ মঙ্গলবার। মিউনিসিপালিটির গোডাউন থেকে আজ সিমেন্ট সাপ্লাই দেবে। দুএকটা পার্টি ধরতে পারলে টাকা-পয়সার কাজ হবে। সকালবেলা তাই আশরাফ অন্য কাজে না গিয়ে এখানে চলে এসেছে। পার্টি অবশ্য একটা সকালবেলা এসেই জুটিয়েছে আশরাফ। আরিফ কন্ট্রাক্টর। মাল পাবে চল্লিশ ব্যাগ, বিশটাই ছেড়ে দেবে। খরচাপাতি বাদ দিয়ে আশরাফের কাজ হবে টাকা পঞ্চাশেকের। তার ওপর রহিম বলেছে এক আধটা পার্টি ধরে দেবে। কিন্তু হারামজাদার পাত্তা নেই। তিন ঘণ্টা আগে গেছে ঠেলাগাড়ি আনতে। সঙ্গে নিয়ে গেছে আশরাফের সাইকেলটা। এত দেরি করছে কেন!

YouTube

আরিফ সাহেবকে তিনটা ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রেখেছে আশরাফ। একটু আগে মানুষটা বিরক্ত হয়ে ওঠে গেছে গোডাউনের দিকে। বিরক্ত হোক আর যাই হোক আশরাফ ছাড়া উপায় নেই। আছে চল্লিশ ব্যাগ সিমেন্টের ইনডেন্ট। ওই দিয়েই কাজ চালিয়ে নেবে।

কিন্তু রহিমটা এতক্ষণ কী করছে। দুপুর শেষ হয়ে এল, ঠেলাগাড়ি আনতে এতক্ষণ লাগে! না, আশরাফের খুব লোকসান হয়ে যাচ্ছে। গোডাউনের কাছে থাকলে এতক্ষণে –আর দুএকটা পার্টি ধরে ফেলতে পারত। আর কিছু টাকা আসত।

কিন্তু রহিম না এলে এখান থেকে যায় কেমন করে। হারামির বাচ্চায় সাইকেলটা নিয়ে গেছে। বাপের আমলের সাইকেল, ত্রিশ বছর ধরে চলছে, দুটো পয়সা খরচ করতে হয়নি। হারামির বাচ্চায় সাইকেলটা নিয়ে ভাগল। ঠিক বেচে দিয়ে জুয়ো খেলতে বসে যাবে, রাতের বেলা খাবে মাল। দশ দিন ওর আর পাত্তা পাওয়া যাবে না!

এই অব্দি ভেবে রাগে বুকের ভেতরটা জ্বলতে থাকে আশরাফের। মামদার পুতে হগল সাইডে লস করাইল। পাইয়া লই চুতমারানির পুতেরে।

মুখে ঘাম জবজব করছিল, সাদা ফুল হাতা জামার খুঁটে মুখটা ভালো করে মোছে আশরাফ। তারপর চায়ের দোকানের ছেলেটাকে বলে, রহিম আইলে বাইন্দা থুইবি হালারে। আর আরিফ সাবে আইলে কবি আমি ঠেলা আনতে গেছি। থাকতে কবি।

এরপর আশরাফ আর দাঁড়ায় না। আউটলের রোদ আর ধূলিবালি ভেঙে হেঁটে যায়। রহিমের ওপর রাগে গড়গড় করছে ভেতরটা। এখন রিকশা ভাড়া লাগবে। পারতে রিকশা চড়ে না আশরাফ। নগদ পয়সা লাগে। হাঁটার অভ্যেস তো নেই। ত্রিশ বছর হাঁটেনি আশরাফ। সাইকেল চালিয়েছে। আজ এতটা দূর হাঁটতে আশরাফের পা টলমল করে।

TikTok

তবুও হাঁটে আশরাফ। পয়সা লস করা যাবে না। লস করলে আশরাফের শেষ ইচ্ছেটা

 রেললাইনের কাছাকাছি এসে একটু ছায়া দেখে দাঁড়ায় আশরাফ। হাঁ করে শ্বাস টানে। বুকের ভেতরটা আইঢাই করছে। আশরাফ কি আর পাঁচ বছর বাঁচবে না। শেষ ইচ্ছেটা…আশরাফ আবার হাঁটতে থাকে। দ্রুত, সবকিছু করতে হবে আশরাফকে। পাঁচ বছর সময় নেয়া যাবে না। জীবনে ওই একটাই ইচ্ছে। ইচ্ছেটা পূরণ করতে হবে।

রেললাইনটা পেরিয়ে আসতেই, সামনে একদল লোক, সবাই হুতাশ করছে। দেখে আশরাফ একটু দাঁড়ায়। একজন লোক খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছিল জায়গাটা। আশরাফ তার ডান হাতটা চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, কি অইছে ভাই?

লোকটা ব্যস্তভাবে বলল, অ্যাকসিডেন্ট।

তারপর চলে গেল।

আশরাফ ভিড় ঠেলে ততক্ষণে লাশটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কে একজন কাঁদছিল, প্রথম তার দিকে তাকায় পরে লাশটার দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর। হৃৎপিণ্ডটা গলাকাটা মুরগির মতো লাফঝাঁপ শুরু করে। চোখ ফেরানোর আগে তার ত্রিশ বছরের পুরোনো সাইকেলটার দিকে তাকায় আশরাফ। দুমড়ে মুচড়ে জিলিপি হয়ে। গেছে সাইকেলটা। ইচ্ছে করে সাইকেলটার গায়ে একবার হাত বুলায়। তখুনি ভয়টা চেপে ধরে। কেউ যদি জেনে ফেলে রহিমকে আশরাফই পাঠিয়েছিল, সাইকেলটা। আশরাফের, এটা তো সবাই জানে।

আশরাফ তখন কী করবে?

Threads

ভিড় থেকে বেরিয়ে আশরাফ লাফিয়ে একটা রিকশায় চড়ে। কোনও রকমে রিকশাঅলাকে বলে, শিংটোলা যাও। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। আশরাফের মনে। হয় সে আর বাঁচবে না। পুলিশে ধরলে টাকা-পয়সা সব যাবে। জেল। জেলে গেলে পাঁচ দিনও বাচবে না আশরাফ। এসব ভেবে রিকশায় বসে কান্না পেতে থাকে আশরাফের। দুহাতে বুক পকেট দুটো চেপে রাখে সে। টাকা-পয়সা বড় প্রিয় আশরাফের। এই টাকাগুলো নিয়ে পাঁচ বছর বাঁচতে চায় আশরাফ। তার একটা শেষ ইচ্ছে আছে। ইচ্ছেটা আশরাফ পূরণ করবে।

গোডাউনটা বন্ধ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ওভারসিয়ার সাহেবও এই মাত্র অফিসরুম বন্ধ করে চলে গেলেন। তার হিসেব মেলানোর ব্যাপার থাকে। কন্ট্রাক্টররা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ খাতাপত্র লেখা শেষ করে এই মাত্র লাল হোন্ডাটা চালিয়ে চলে গেলেন।

আরিফের যাওয়া হয়নি। সে বসে আছে অফিসরুমটার সামনে, ঘাসের ওপর। এখন আউটফলে লোকজন নেই। চারদিক নিঝুম হয়ে আছে। বিকেল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। দুএকজন পাহারাদার ছাড়া আউটফলে এখন আর কেউ নেই।

আরিফ বসে আছে আশরাফ মিয়ার জন্যে। দিনটা আজ মিস হয়ে গেল। কাল থেকে কাজ ধরার কথা। ওস্তাগার ঠিক করা আছে। কিন্তু পয়সা নেই হাতে।

Instagram

ছোটখাটো কাজ করে আরিফ। তার ওপর দুটো বিল আটকানো। ছাড়াতে কিছু পয়সা টয়সা লাগবে। পয়সাটা ম্যানেজ হচ্ছে না। আবার কাজ। কাল থেকে না ধরলে ওভারসিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার রেগে যাবেন। রিপোর্ট যাবে একজিকিউটিভের কাছে। শো কজ নোটিশ হবে। মহা ঝামেলা। এমনিতেই রিপোর্ট খারাপ হয়ে আছে আরিফের। কোটেশানের ছোট ছোট কাজ তাও টাইমলি শেষ করতে পারে না। আগের দুতিনটি কাজে টাইম এক্সটেনশান করাতে হয়েছে। ওভারসিয়ার সাব এবার আগেই বলে দিয়েছেন, আর্জেন্ট ওয়ার্ক। টাইম দেয়া যাবে না। যদিও কাজ শেষ করার ডেট চলে গেছে তিন দিন আগে। কিন্তু তার জন্যে আরিফ কনস্ট্রাকশন দায়ী নয়। স্টকে সিমেন্ট ছিল না কজ দেখিয়ে এক্সটেনশনের চিঠি দেয়া যাবে। তা হলেই বা। আজ সিমেন্ট দেয়া হচ্ছে ওভারসিয়ার সাব জানেন। ইনডেন্ট দিয়ে রেখেছেন অনেকদিন আগে। তাছাড়া তাকে ইনফর্মা করা হয়েছে কাল থেকে কাজ ধরবে। আজ সকালেই অরফ জানিয়ে এসেছে। কিছু টাকা পাওয়ার কথা ছিল। রাজ্জাক বলেছিল শপাঁচেক টাকার কাজ চালাবে। আজ সকালেই দেয়ার কথা। আরিফ সেই আশায় ছিল। রাজ্জাকের কাছ থেকে আগেও বেশ কয়েকবার টাকা-পয়সা নিয়েছে। কমিট করে রাজ্জাক ফেল করে না। কিন্তু এবার কেমন উলট-পালট হয়ে গেল। রাজ্জাক মন খারাপ করে বলল, দোস্ত পারলাম না।

WhatsApp

এরপর আর কী কথা আছে। আরিফ রিকশা নিয়ে আউটফল চলে এসেছে। পকেটে গোটা পনের টাকা আছে। ঠেলাগাড়ি ভাড়া দিয়ে সিমেন্টটা নিয়ে যে বাসায় রাখবে, উপায় নেই। আউটফল আসতে আসতে রিকশায় বসে একটা প্লান করেছে। আশরাফ মিয়ার কাছে বিশ ব্যাগ মাল বেচে দেবে। নগদ পয়সা দেবে আশরাফ মিয়া। পয়সা পেলে প্রবলেম সলভড। কাজটা কাল শুরু করা যাবে। অল্পকিছু পয়সা খরচ করে আগের বিল দুটো ছাড়ানো যাবে। অবশ্য আর একটা প্রবলেম দেখা দেবে। কাজটায় লাভ হবে না। সিমেন্ট বাঁচানো যাবে না দু ব্যাগও। চল্লিশটাই লাগবে, কী আর করা যাবে, পরে বিশ বস্তা ব্লাকে কিনে নেবে। আশরাফকে ধরলেই ম্যানেজ করে দেবে। পয়সা বেশি যাবে। যাক, কী করা।

সকালবেলা আউটফলে এসেই আশরাফকে পেয়েছে। চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। আরিফকেও খাওয়াল এককাপ। তখন দোকানে আর কেউ ছিল না। চা খেতে খেতে আরিফ কথাটা বলল। আশরাফের তো কারবারই এটা। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। দরদাম ঠিক করে মনে মনে বিশ ব্যাগের দাম বের করে আরিফ। এক হাজার আশি। আশি টাকার চল্লিশ টাকা যাবে ঠেলাগাড়ি ভাড়া। দুপাঁচ টাকা পিয়নদের বখশিশ। পুরো এক হাজার টাকা হাতে রাখতে পারবে। ঐ টাকায় কাজটা অর্ধাঅর্ধি শেষ করা যাবে। শুধু তো লেবার আর কেরিং চার্জ। এক ট্রাক ভিটি বালি কিনতে হবে। আর সব মালামাল তো অফিস সাপ্লাই।

সবকিছু ভেবে আরিফ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিল। বাকি বিশ ব্যাগ সিমেন্ট কেনার আগেই বিল দুটো পাওয়া যাবে। হাজার চব্বিশেক টাকা। তখন আর আরিফকে পায় কে। চার মাসের সংসার খরচা দিয়ে মনোযোগ দিয়ে কাজটা করা যাবে।

কিন্তু ঘাপলা বাধাল রহিম।

Email

আশরাফ মিয়া রহিমকে পাঠাল ঠেলাগাড়ি আনতে। তাড়াতাড়ির জন্যে সঙ্গে দিল নিজের সাইকেলটা আর শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজার দিল সিগারেট আনতে ত্রিশ টাকা। সব নিয়ে রহিম যে গেল আর ফিরল না। আড়াইটা পর্যন্ত ঠায় বসে রইল আশরাফ। আরিফ এর মধ্যে বার কয়েক বটতলা আর গোডাউন করল। রহিমের পাত্তা নেই।

রহিমের একটু চুরিচামারির অভ্যাস আছে আরিফ শুনেছে। কিন্তু আশরাফ মিয়ার সাইকেল আর শওকত কন্ট্রাক্টরের ম্যানেজারের ত্রিশ টাকা নিয়ে ভেগে যাওয়ার সাহস পেল কই। ওকি মিউনিসিপালিটিতে চাকরি করবে না কী?

তিনটার দিকে শওকত কন্ট্রাক্টরেরা সব ট্রাক ভরে সিমেন্ট নিয়ে যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আরিফ। আজকের দিনটাই খারাপ। সকাল বেলাটাই শুরু হয়েছে খারাপ ভাবে।

 আশরাফ গেল সাড়ে তিনটার দিকে। যাওয়ার সময় আরিফের সঙ্গে দেখা হয়নি। আরিফ তখন গোডাউনে। বিষম খিদে পেয়েছিল। মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তবুও বাইরের প্রচণ্ড রোদ ভেঙে বটতলায় যায় আরিফ। আশরাফ মিয়াকে বলে নিজেই না হয় যাবে ঠেলাগাড়ি আনতে। পাঁচটায় গোডাউন বন্ধ হবে। এর আগে মালটা বের করতে না পারলে ঘাপলা। কিন্তু বটতলায় গিয়ে আশরাফ মিয়াকে না পেয়ে মনটা আরো খারাপ হয়ে যায় আরিফের। খিদে পেয়েছে, পকেটে পয়সাও নেই। তা ছাড়া এখানে খাবেই কী! কিন্তু খিদে পেয়েছে, না খেলে চলবে কেন।

চায়ের দোকানে ঢুকে আরিফ দুটো পরোটা নেয়। আর আট আনার ভাজি। খেতে শুরু করবে, তখুনি চায়ের দোকানের ছেলেটা বলল, আশরাফ ভাইয়ে আপনেরে বইতে কইছে। হেয় গেছে ঠেলা আনতে। শুনে মনে মনে খুশি হয় আরিফ। মনোযোগ দিয়ে খেতে থাকে। আশরাফ মিয়া গেছে ঠেলা আনতে। আশরাফ মিয়া যখন গেছে সিওর ঠেলা নিয়ে ফিরবে। পাঁচটার আগে মালটা খালাস করতে পারলেই হয়। গোডাউনের বাইরে রাখতে পারলেই হয় পরে আস্তেধীরে ঠেলায় ভরে সন্ধ্যার মুখে মুখে আউটফল থেকে বের করে নিতে পারলেই হয়। সন্ধ্যা হয়ে গেলে পুলিশে ঝামেলা করবে।

কিন্তু পাঁচটা বেজে গেল আশরাফ মিয়াও আর ফিরল না। আরিফ চারটার দিকে এসে বসেছে এখানটায়। আস্তেধীরে সব কক্টাক্টররা গেল, গোডাউন বন্ধ হল, আধঘণ্টা হয়ে গেল ওভারসিয়ার সাহেবও চলে গেছেন। আরিফ বসে আছে, আশরাফ মিয়া ফিরবে। এই লোকটা কথা দিয়ে মিস করে না। ভয়ানক লোভী লোক। বিশ ব্যাগ মালের লোভ ছাড়তে পারবে না। শালা লাভ তো করবে একশো টাকা। এটা কি মিস করবে।

Facebook

কিন্তু কেউ ফেরে না! না রহিম না আশরাফ মিয়া। রহিম না হয় ত্রিশ টাকা আর সাইকেল নিয়ে ভেগেছে, আর আশরাফ মিয়া ভাগল কেন?

আরিফ কিছু বুঝতেই পারে না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আরিফ আর কতক্ষণ বসে থাকবে? আস্তেধীরে নিজের ওপর রেগে যেতে থাকে আরিফ। পকেটে একটা সিগারেট ছিল, স্টার। বের করে ধরবে, তখন খেয়াল হয় ম্যাচ নেই। কাছেপিঠে লোকজনও নেই। রাগে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় আরিফ। শালার জীবনটাই বোগাস। বাপ শালা মরে গিয়ে বার তের হাজার টাকা আর দশজনের সংসারটা চাপিয়ে দিয়ে গেল। আরিফের বি এ পাসটা হল না। সংসারের ঘানি টানছে। একটা প্রেমিকা ছিল, তরী। বাপ মরে যাওয়ায়, বড় সংসার দেখে ও শালীও ভাগল। এখন কোন এক ডাক্তারের বউ। লিবিয়ায় আছে। আর আমি শালা এখানে বাল ছিড়ছি, কথাটা ভেবে চারদিকের ঘনায়মান অন্ধকার ভেঙে ওঠে দাঁড়ায় আরিফ। তখনি টের পায় রাগেদুঃখে কান্না পাচ্ছে তার। এখন কোথায় যাবে আরিফ। বেগমগঞ্জের গুমটি বাসায়। দশজন মানুষের কিলবিলে সংসারে!

YouTube

ওখানে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। আরিফ আবার বসে পড়ে। বসে পকেট থেকে সিমেন্টের ইনডেন্টটা বের করে। তারপর কুচি কুচি করে হেঁড়ে কাগজটা। ছিঁড়ে হাওয়ায় অন্ধকারে ভাসিয়ে দেয়। কাগজগুলো উড়ে উড়ে আরিফের চারপাশে পড়ে। আরিফ খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তারপর সেই ছেঁড়াখোঁড়া কাগজগুলোর ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদে। গুমরে গুমরে কাঁদে। অন্ধকারে আরিফের কান্না কেউ দেখে না।



Post a Comment

0 Comments

Close Menu