Ad Code

বর্ষণ বিলাস পর্ব - ২৮

লেখিকাঃ তাহিনা আইরাত ইরা

 উষ্ণ দৌড়ে গিয়ে মোহ'র মাথা টা নিজের কোলে তুলে নেয়। মোহ এক দৃষ্টিতে উষ্ণের পানে তাকিয়ে থাকে। মোহ'র চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। উষ্ণ বিচলিত হয়।

মোহ কে কোলে করে হাসপাতাল এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পিছন পিছন যায় প্রভা ও তটিনী। অন্যরা তখনো হতভম্ব। তটিনী কান্না করছে। আপাকে এভাবে হারাতে রাজি নয় সে। তবে তটিনীর এই কষ্ট প্রভা বুঝতে পারে না। খেঁকিয়ে ওঠে সে,
- "এখন ন্যাকা কান্না কাঁদছো কেন? তোমার তো শান্তি হয়েছে, মোহ আর শাওন দু'জনেরই অবস্থা খারাপ। শাওন তো মনে হয় এতক্ষণে মারা গেছে। তুমি যদি এতো কথা না বলতে তাহলে এমন কিছু হতো না..।"
তটিনী কিছু বলে না। তার অনুভুতি টা সে ই ভালো বুঝবে।
উষ্ণ মোহ কে নিয়ে ডাক্তার এর কাছে যায়। মোহ কে স্ট্রেচারে শোয়ানো হয়। ওটি তে নিয়ে যাওয়ার আগে মোহ উষ্ণের হাত ধরে। উষ্ণ ও মোহ'র কপালে চু'মু খায়। মোহ উষ্ণ কে উদ্দেশ্য করে বলে,
- "আমাদের মনে হয় আর এক হওয়া হবে না, সংসার করা হবে না..।"
উষ্ণ মোহ'র মুখে হাত রাখে। উষ্ণের চোখের পানি মোহ'র চিবুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।
- "এমন কথা বলে না সোনা, আমাদের যে এখনো অনেক সপ্ন পূরণ করা বাকি, সংসার করা বাকি।"
মোহ প্রতুত্তরে কিছু বলে না। শুধু হাসে। মোহ কে নিয়ে যাওয়া হয় ওটি তে। তটিনী এতক্ষণে তৌফিক ইসলাম ও আরিফা বেগমকে ফোন করে সব বলেছে। প্রভা ও প্রহর কে ডেকেছে। প্রহর আসামাত্রই পাগলের মতো উষ্ণকে মারতে থাকে।
- "কু'ত্তার বাচ্চা, তোকে বলেছিলাম না আমি? তোর জন্য যদি আমার মোহ'র কিছু হয় তাহলে তোকে আমি ছাড়বো না। তুই আমার মোহ কে মেরে ফেলেছিস..। কেন করলি এমন? কেন?"
প্রহরের চোখ থেকে অনবরত পানি পড়তে থাকে। প্রভা প্রহর কে জড়িয়ে তাকে শান্তনা দেয়। উষ্ণ তবুও নির্বাক। প্রহর কেও আটকায়নি সে। সত্যিই তো, তার জন্যই তো এমন হয়েছে..। কেন শাওনের মতো একটা কালসাপের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল? উষ্ণ সেখান থেকে বাইরে চলে আসে। হাসপাতালের পিছনে একটা বড় বাগান। দেখে মনে হয় জঙ্গল। ওই জঙ্গলেরই একটা বড় গাছের তলায় বসে পড়ে সে। চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। তবে তার আহাজারি কেউ শোনে না..। কান্না করতে করতে উষ্ণ খেয়াল করে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরেছে। মাথা উঁচিয়ে দেখে মোহ! তার মোহ তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তাকে শান্তনা দিচ্ছে। তার মোহ সুস্থ হয়ে গেছে..। উষ্ণ খুশি হয়ে যেই মোহ কে জড়িয়ে ধরতে যায় সেই মোহ উধাও হয়ে যায়। মোহ শুধুই উষ্ণের কল্পনা ছিল!
হতভম্ব উষ্ণ খেয়াল করে না তার পাশে তটিনী এসে বসেছে। তটিনী উষ্ণের কাঁধে হাত রাখে। উষ্ণ চমকে পাশে তাকায়। দেখে তটিনী বসে আছে। উষ্ণ তটিনীকে দেখে নিজের চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে। তটিনী বাঁধা দেয়।
- "উহু, পানি মুছতে হবে না। আজ যে কাঁদার দিন। কাঁদতে পারেন আপনি।"
উষ্ণ কিছু বলে না। গভীর নিরবতা বিরাজ করে তাদের আসেপাশে। শুধু পাখির কাঁচকাঁচালি আর বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। নিরবতা ভেঙে উষ্ণই বলে ওঠে,
-" একটা ঘটনা শুনবে? এক অভাগা ছেলের ঘটনা? "
তটিনী নাকচ করে না। রাজি হয়। উষ্ণ একটা ক্ষীণ হাসি দিয়ে বলতে থাকে,
- "আমি যে ছেলেটার কথা বলবো, সে আর কেউ নয়। সে আমি নিজেই। আমি ছোটবেলায় এক আভিজাত্য পরিবারে জন্মগ্রহন করি। বেশ আদর যত্নের মধ্যেই আমি বড় হতে থাকি। আমার বয়স যখন দুই বছর, তখন আমার একটা ভাই হয়। তার নাম রাখা হয় শ্রেষ্ঠ। আমি শ্রেষ্ঠকে অনেক ভালোবাসতাম। শ্রেষ্ঠও আমায় ভীষণ ভালোবাসতো। ভাই ছাড়া কিছু চিনতো না। আমাদের জীবন খুব সাচ্ছন্দেই কাটছিল। হাসি, মজা সবকিছুর মধ্যে দিয়ে আমরা বেড়ে উঠতে থাকি। কিন্তু একটা ঘটনা আমার আর আমার ভাই এর জীবনটা ধ্বংস করে দেয়। আমার বয়স তখন ছয়, আর শ্রেষ্ঠ'র চার। আমরা মা আর বাবার সাথে মালেশিয়া ট্রিপে যাই। ট্রিপ থেকে বাংলাদেশে আসার পর আমাদের উপর কিছু ডাকাত হামলা করে আমাদের সব কিছু নিয়ে যায়৷ আমার বাবা রাস্তার এক পথচারীর ফোন দিয়ে তার বোনের স্বামীকে ফোন দেয়। আমার বাবার একটাই বোন ছিল। আমার ফুপির স্বামী কয়েক এক ঘন্টার ব্যবধানে আমাদের রিসিভ করতে চলে আসে। আমরা তখন ছোট ছিলাম, কিছু বুঝতাম না। ওই লোকটা আসার পর পরই আমার বাবার শরীরে ছুড়ি ঢুকিয়ে দেয়। যা দেখে আমার মা আমাদের বাঁচানোর জন্য একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে। ক্রমে ক্রমে সেখানে লোক বাড়তে থাকে। আমার বাবা ততক্ষণে মারা গেছে। ওই লোকটা আর তার সাথী রা আমার মা কে একা পেয়ে...।"
আর বলতে পারে না উষ্ণ। তার গলা ধরে আসে। তটিনী অধীর আগ্রহে পুরো ঘটনা শোনার জন্য উষ্ণের পানে তাকিয়ে আছে।
উষ্ণ আবারো বলতে থাকে,
- "শ্রেষ্ঠ তা দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। আমি তাকে থামানোর চেষ্টা করলেও পারি নি। মা কে ওভাবে দেখে সে ঠিক ছিল না। ওই লোকটা আর তার সাথীরা শ্রেষ্ঠ কে টেনে হিচড়ে নিয়ে যায়। ওরা আমাকে ধরতে আসার আগে আমি পালিয়ে অন্য ঝোঁপের পিছনে লুকিয়ে পড়ি। ওরা আমার ভাই কে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। আমি আমার মা কে দেখেছিলাম, কীভাবে শ্রেষ্ঠ আর বাবার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার আশা ছিল, আমি বেঁচে আছি। কিন্তু, আমি তাকে বাঁচাতে পারলাম না। পরবর্তীতে ওরা আমায় খুঁজে পায়নি। পালিয়ে বেড়িয়েছি আমি। মৃতদেহ গুলোকে ওরা পাহাড় থেকে ফেলে দেয়। আর সমাজে ছড়িয়ে দেয়, আমি আমার মায়ের জা'রজ সন্তান!
অনেক ছোট বয়সে আমি সব কিছু হারিয়েছি। গ্যারেজে কাজ করে পেট চালাতাম। কত মা'র খেয়েছি। আজ এই অবস্থা আমার..।"
উষ্ণ মলিন হাসি হাসে। চোখে তার পানি চিকচিক করছে। উষ্ণ সেই পানি মুছে ফেলে। তটিনীর চোখেও পানি।
- "আপনি আজ আরও কিছু হারিয়েছে।"
- "শাওন!?"
- "না, আপাকে। আমার আপা আর নেই...।"
উষ্ণের পৃথিবী থমকে যায়। তার মোহ নেই! আকাশ চিরে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। উষ্ণ পাথরের ন্যায় চলতে থাকে। তার মোহ কে শেষবার দেখার জন্য। তটিনীর বুক ও ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে।তবে তা প্রকাশ করে না সে। উষ্ণ হাসপাতালে গিয়ে দেখে তৌফিক ইসলাম আর আরিফা বেগম একটা স্ট্রেচারের সামনে বসে কাঁদছে। স্ট্রেচারের উপর সাদা কাপড়ে মোহ'কে শুইয়ে রাখা হয়েছে। উষ্ণ মোহ'র পানে এগিয়ে যায়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
- "তোমার কথাই সত্যি হলো বিভ্রম। আমাদের আর এক হওয়া হবে না! এই বর্ষনে আর বিলাস করা হবে না!"
________________
দু'দিন আগেই মোহ কে দাফন করা হয়েছে। উষ্ণ সেই বটবৃক্ষের নিচে সিগারেট ফুসঁছে। উষ্ণ সিগারেট খেতে খেতেই মোহ'র কবরের দিকে এগিয়ে যায়। তটিনী সেখানে আগে থেকেই ছিল। উষ্ণ তাকে দেখে কিছু বলে না। কিছুসময় কবরের দিকে তাকিয়ে চলে যেতে নেয়। তটিনী মুখে কিছু না বললেও তার চোখের ভাষা উষ্ণের প্রতি তার অনুভুতি প্রকাশ করছিল। পরক্ষণেই তার মনে আসে, উষ্ণ তার মৃত বোনের স্বামী। চোখ সরিয়ে নেয় তটিনী।
রাস্তায় যেতে যেতে প্রহরের সাথে দেখা হয় উষ্ণের। এই প্রহর আর আগের প্রহরের মধ্যে অনেক পার্থক্য। দু'দিনেই প্রহরের চেহারা টা শুকিয়ে গেছে। দাড়ি গোফ গজিয়েছে। উষ্ক খুষ্ক চুল। প্রহর উষ্ণকে দেখে থামে।
- "মোহ কে ছাড়া দিন কাল কেমন যাচ্ছে?"
প্রহরের কথায় উষ্ণ থামে।
- "ঠিক মোমের ন্যায়।"
- "কেন?"
- "মোমের ভিতরের সুতায় আগুন লাগালে মোম যেমন গলে যায়, তেমন আমার মোহ কে ছাড়া আমার দিন ও তেমনই কাটে।"
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
- "নতুন করে জীবন শুরু করো, আর কিছু ঠিক হবে না।"
- "উহু, আমার মোহ ব্যতীত আমার মন আর কেউ নিতে পারবে না। যদি এর জন্য আমার সারাজীবন অপেক্ষা করা লাগে, তবু আমি অপেক্ষা করবো।"
উষ্ণ আর দাঁড়ায় না। চলে আসে খোলা আকাশের নিচে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। হঠাৎ পিছন থেকে উষ্ণ কে কেউ ডাক দেয়। উষ্ণ ফিরে তাকায়। তার মোহ! তার মোহ ডেকেছে তাকে।
- "উষ্ণ? বর্ষনে বিলাস করবে না?"
__সমাপ্ত__


Post a Comment

0 Comments

Close Menu