Ad Code

নিয়তি

লেখিকাঃ আশা রোজমেরি

মেহেরকে আজ দেখতে আসবে।মামী মা সহ্য করতে পারছেন না,নিজের মেয়ের আগে ননদ এর মেয়ের বিয়ে হবে।তাও আবার মেহের ছোট।পাড়া প্রতিবেশী এই নিয়ে কানাঘুষা করবে।অন্যদিকে, আবার খুশিও আপদ বিদায় হবে।নিজের সংসারের উপর ঘেরে বসেছিলো।ছেলে মেয়ের স্বাদ আহ্লাদ পূরন না করে এই মহারানীর পড়াশুনা চালিয়ে নিতে হচ্ছে।

দীপ্তি, মেহেরকে সাজাচ্ছে।
মেহের এর মুখে হাসিরা লুকোচুরি করছে।এইটুকু জীবনে নিখাদ সুখ বলতে মামা আর ভালবাসার মানুষটা পাওয়া ছাড়া আর কিছু নেই তার।তিন বছর ধরে মেহেরাবকে চিনে।তাকে এতোটুকু আঘাত করে কথা বলেনি।আজ মা বেঁচে থাকলে কতো খুশি হতো।ভাবতেই হাসিমাখা মুখ অঁধারে ছেঁয়ে গেলো।জল ছুঁই ছুঁই করলো চোখ জোড়া।দীপ্তি বললো,
--সাজ ন*ষ্ট হবে মেহের।একদম কান্নাকাটি করবিনা।আজকে তারা আংটি পরিয়ে যাবে।আজকে নিয়ে যাচ্ছে না, যে কাঁদবি তুই।মেহমান চলে আসছে প্রায়।কিছুক্ষন আগে ফোন করেছিলো।আর শুন, সবার সামনে মুখটা ঘোমরা করে রাখবিনা।এমন চাঁদ মুখে অমাবস্যা মানায় না, বাবু।
মেহেরকে রেডি করে মায়ের কাছে চলে গেলো,দীপ্তি।মা'কে হাতে হাতে হেল্প করছে।শরবতও গুলে রাখলো।গরুর মাংস,রোস্ট, পোলাও,দধি সবকিছুই করা হয়েছে।ঘ্যানঘ্যান করে কাজ করছেন।মাঝে মাঝে ননদকে নিয়ে ক*টু কথা বলছেন।নিজে তো ম*র*লো।মেয়েটারে নিয়ে ম*র*তে পারলোনা।
দীপ্তি, মায়ের উপর রাগ হলো,
--তুমি কি শুরু করলে মা।তোমার ভাইয়ের বাসায় গেলে, আমাদের যদি এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, তাহলে তোমার কেমন লাগবে।
--চুপ কর।মুখে মুখে কথা বলবিনা।কোথায় আমরা আর কোথায় মেহের।যার মা এমন ঘটনা রটিয়ে ম*রে।তার সাথে কিসের তুলনা করিস।আমার বাবা-মা দেখে শুনে বিয়ে দিছে।আমার ছেলে-মেয়ে আমার মতোই হবে।
তাদের মা-মেয়ের কথার শব্দ ড্রয়িংরুমে পোঁছে গেছে।রোশন আরা আরো কিছু বলতে যাবেন, তখনই আলতাফ মির্জা কিচেনে এলেন।হালকা করে শাসালেন,
--আজকে বাসায় মেহমান আসছে।কোনো অপ্রীতিকর কথা বললে খারাপ হয়ে যাবে।চুপচাপ কাজ করতে পারো না।নাহলে এই বয়সে তোমাকে বাবার বাড়ি রেখে আসবো।
রোশন আরা আঁচলে খানিকটা মুখ ঢেকে রান্না রেখে রুমে চলে গেলেন।দীপ্তি, বাকি রান্না নিজেই করতে লাগলো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হাতছানি দিয়েছে।তার মধ্যেই মেহমান এসে উপস্থিত।মেহেরাবের মা-বাবা, বোন,বোন জামাই আর সাথে একটা বন্ধু এসেছে, আহিল।আলতাফ মির্জা সালাম বিনিময় করে সবাইকে ড্রয়িংরুমে বসালেন।
রোশন আরা আসতে চাইলেন না।আলতাফ মির্জা তর্জন গর্জন করে সবার সামনে আনলেন।নাহলে কি মান-সম্মান থাকবে।তিনি এসেই হালকা নাস্তার আয়োজন করলেন।তারা জানালেন,
মেহেরকে দেখে কথা পাকাপাকি করে পরে খাবার খাবেন।মেহেরাবও এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।আহিল, খোঁ*চা দিয়ে বললো,কিরে এখনই তর সইছেনা।
"একটা আকাশী রঙা শাড়ি পরেছে।হাতে কালার মেচিং করা চুড়ি।কপালে ছোট্ট কালো একটা টিপ।চোখে গাঢ় করে কাজল টানা।সুদীর্ঘ চুলো গুলো খোঁপায় শোভা পেয়েছে, বেলি ফুলের মালাতে।তাতেই ভুবনমোহিনী মনে হচ্ছে।"
"হালকা সাঁজেও মেয়েটা ঘেমে গেছে।মেয়েদের দেখতে আসলে আলাদা একটা টেনশন কাজ করে তাইনা রে? দীপ্তি, মেহেরকে বললো।
মেহের কিছু বললো না।
দীপ্তি, মেহেরকে ধরে নিয়ে গেলো ড্রয়িংরুমে।সোফার খালি জায়গায় বসালো।মেহেরাবের দিকে অজান্তে চোখ পরতেই ইশারা করলো।তাতে করে আরেকটু লাজুক হয়ে গেলো মেহের।সবাই বললো, "মেয়ে মাশা-আল্লাহ সুন্দর।মেয়ে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।মেহেরাব এর মা জিজ্ঞেস করলেন,
---তোমার নাম কি মা?
---মেহের মিনহা
তারপর বাবার নাম, মায়ের নাম জিজ্ঞেস করলেন।মেহের উত্তর দিলো।কিন্তু বাবা কি করে জানতে চাইলো যখন, তখনই মেহের আর কিছু বলতে পারলোনা।বুকের ভিতর কান্নারা দলা পাকিয়ে আসতে লাগলো।"কি বলবে সে? বাবা থেকেও নেই।জন্মের পর তো বাবা নামক মানুষটাকে দেখেইনি।আর অমন মানুষকে সে কখনো দেখতেও চায়না।যার জন্য আজকে সে মা হারা।কোন ছোট বেলায় মা গলায় ফাঁ*স দিয়েছে।বাবা তো দেখতেও আসেনি।"
কি হলো মা,কথা বলছো না যে?
"মেহেরাব এর মায়ের ডাকে ভাবনার ঘোর কাটলো, মেহের এর।"
তখনই আলতাফ মির্জা আগ বাড়িয়ে বললেন,
--মেহের আমার ছোট বোনের মেয়ে।মেহের এর ৩ বছর বয়সে আমার বোন মা*রা যায়।তখন ওর বাবা ওকে রেখে চলে যায়।আমার কাছেই মানুষ হয়েছে।বাবা-মা বলতে আমি আর ওর মামী মা-ই।আমি একজন সরকারি চাকরিজীবি।আমার পরিচয়েই মেহের এর পরিচয়।
তার কথার মাঝাখানে রোশন আরা বললেন,
--তারা আমাদের আত্মীয় হবেন।পরে জানার থেকে আগে জানাই ভালো।তুমি বলো না কেনো? "মেহের এর মা, মৃন্ময়ী আত্ম*হ*ত্যা করেছে।প্রেম করে বিয়ে করছিলো।মৃন্ময়ীকে গর্ভাবস্থায় রেখে, জামাই বিদেশ চলে যায়।মৃন্ময়ীর আর খোঁজ খবর রাখেনা।মৃন্ময়ী অপেক্ষা করে।ভাবে হয়তো কোনো বিপদে পরেছে।বিপদ কাটলে খোঁজ নিবে।পরে জানতে পারে সেখানে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে।সহ্য করতে না পেরে গলায় ফাঁ*স দেয়।
আলতাফ মির্জার আর কিছু করার থাকলোনা।কারো ক্ষ*তি করার জন্য, সমালোচনা আর নিন্দা করা মানুষের মুখ কখনো আটকানো যায়না।বেচারির ভাগ্যটা যেনো মায়ের মতো না হয়।মনে মনে আওড়ালেন তিনি।তারপর সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
সব ফ্যামিলিতেই অপ্রীতিকর ঘটনা থাকে।সেগুলো চাপা রাখতে হয়।এসব যত ঘাটে,ততোই গন্ধ বের হয়।আর এসবে মেহের এর কোনো হাত নেই।এজন্য ওকে আঘাত করতে চাইনি আমি।আর সবার সামনে অস্বস্তিতেও ফেলতে চাইনি।আপনারা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
মা এর পাশে দীপ্তি দাঁড়ানো ছিলো।মা'কে চোখের ইশারায় থামাতে চেয়েছে।কিন্তু অভ্যাসগত কারনে তিনি তার মুখকে নিয়ন্ত্রণ করেননি।কারন তিনি চাননি এতো ভালো পরিবারে মেহের বউ হয়ে যাক।আলতাফ মির্জা যখন সবটুকু স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন, তখন যেনো রোশন আরার শান্তি হলো।
থমথমে পরিবেশে মেহেরাব এর মা, মুনিয়া পারভীন আমতা আমতা করে দীপ্তির উদ্দেশ্যে বললেন,
--- মেহেরকে রুমে নিয়ে যাও একটু।
"উনার আদেশে মেহের স্বস্তি পেলো।চোখের পানিকে কতোক্ষন আটকে রাখা যায়।রুমে গেলে চোখ দুটো হাফ ছেড়ে বাঁচবে।এখন তো বর্ষনের অপেক্ষা মাত্র।"
দীপ্তি বাধ্য মেয়ের মতো মুনিয়া পারভীন এর কথায় সায় দিয়ে, মেহেরকে রুমে নিয়ে গেলো।মেহের কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
--আপু আমাকে একটু একা থাকতে দিবা প্লিজ।
"কথা না বাড়িয়ে দীপ্তি চলে যায়।কিছু সময় মানুষকে একা থাকতে দিতে হয়।"
আলতাফ মির্জা বললেন,
--এখন আপনারা খেয়ে নিন।তারপর বাকি কথা শুনবো।
"খাবারের আয়োজনের মাঝে যে সময় টুকু তারা পেলেন।সেটুকুতে নিজেরা আলাপ আলোচনা করে নিলেন।তার মধ্যেই খাবার পরিবেশন করা হলো।মেহেরাব চেয়েছিলো, মেহেরকে ডাকার জন্য।কিন্তু মা'এর চোখ রাঙানোতে পেরে উঠলো না।"
দিহান ক্লাস নাইন এর স্টুডেন্ট।এতোক্ষন রুমেই ছিলো।মা এর ব্যবহার এর কথা তার জানা।তাই জন্য একবারও বাইরে চোখ ফেলেনি।কতোক্ষন আর রুমে থাকা যায়।তাই বেরিয়ে এসে মাকে বললো, "আমি বাইরে যাচ্ছি"।বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো।উনারা চেয়ে রইলেন।
মেহেরাব এর বাবা, মেজবাহ উদ্দিন বললেন,
--এটা কি আপনার ছেলে?
আলতাফ মির্জা উত্তরে বললেন,
--হ্যা,আমার এক ছেলে এক মেয়ে।বলা যায় আমার দুই মেয়েই।মেহেরকে তো দেখলেন।এই মেয়ে দীপ্তি, আর ছেলে দিহান।ভাইজান আগে খেয়ে নিন।খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে।আপনাদের জন্য সকাল সকালই আয়োজন শুরু করেছিলাম।
মেজবাহ উদ্দিন বললেন,
--আপনারাও বসে পরেন।আমরা একা খাবো ভালো দেখায় না।
"আলতাফ মির্জা আপত্তি জানালেন।তার মনে কষ্টরা হামাগুড়ি দিচ্ছে।কেউ আমার মেহেরকে ডাকছে না।চশমার আঁড়ালে জলটুকু হাতের এক আঙ্গুলে মুছে নিলেন।"
অন্যদিনে,
মেহেরের চোখে আজ বান ভেসেছে।চোখের কাজলে লেপ্টে গেছে গভীর ক্ষত গুলো।শাড়ি খুলে ফেলেছে।চুড়ি জোরে খুলতে গিয়ে ভেঙে হাত কে*টে গেছে।র*ক্ত পরছে,তাও মুছবার নাম নেই।হাত কা*টার জ্বালার থেকে যে মনের জ্বালা বেশি হচ্ছে।যা চোখের পানি হয়ে ঝরে যাচ্ছে।
খাওয়া শেষে তারা হঠাৎ জানালেন আমরা আপনাদের মেয়ে দীপ্তিকে বউ করে নিতে চাই যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।
"আলতাফ মির্জার বুকে ব্যাথা করে উঠলো।নেহাৎ ভদ্রলোকের বাড়ি এটা।নাহলে সোজা বাসা থেকে বের করে দিতাম।"
কিন্তু রোশন আরা, এক কথায় বলে দিলেন আমাদের আপত্তি কেনো থাকবে।এতো ভালো ফ্যামিলি।মেয়েকে তো এক জায়গায় না, এক জায়গায় বিয়ে দিবোই।তাহলে এখানে আর আপত্তি কিসের।
মেহেরাব এর বোন মারিয়া বললো,
--আংটি ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছিনা।শুভ কাজে আসছিলাম।শুভ কাজ সেরেই যাবো।এক পরিবারেরই তো মেয়ে।সে যেই হোক।
অনেক আলোচনার পর দীপ্তির সাথে এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো।তারা যাওয়ার আগে বিয়ের তারিখ ফিক্সড করে গেলো আগামী শুকবার।আর এক সপ্তাহ হাতে।এর মাঝেই দীপ্তিকে সাথে নিয়ে বিয়ের শপিং করা হলো।মেহের ফোন অফ রেখেছে।রুম থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হয়নি।মামার আবদারে খেতে হয়েছে মাঝে মাঝে।দীপ্তি মেহেরকে বলতে চেয়েছে তার অনিচ্ছার কথা।কিন্তু মেহের শুনেনি।বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো।যথা সময়ে গায়ে হলুদ,বিয়েও হয়ে গেলো।মেহের নিজে সব দায়িত্ব নিয়ে করেছে।সারাক্ষন হাসিখুশি থেকেছে।কিন্তু কাছে মানুষ জনদের সাথে চোখের চাহনি বিনিময় করতে সাহস করেনি।বেঈমানদের চোখ পড়তে চায়না সে।মেহেরাব এর দিকে তো ফিরেও তাকায়নি।যদিও মেহেরাব চেস্টা করেছিলো অনেক বার, কথা বলার জন্য।কিন্তু লাভ হয়নি তাতে।মেহের তাকে, দুলাভাই বলে ডেকেছে।
ছয় মাস পর
------------------
মেহেরাব এর বাসা থেকে মিষ্টি পাঠিয়েছে।দীপ্তি প্রেগ*ন্যান্ট, সেই সুবাদে।খবরটা শুনা মাত্রই ডুকরে কেঁদে উঠলো,মেহের।ভেবেছিলাম, পরিবারের জোরাজুরিতে রাজি হয়েছে মেহেরাব।মানিয়ে নিতে কয়েক বছর কেটে যাবে।কিন্তু আমি সব কিছুতে ভুল।প্রতিটি দিন চোখের পানির সাথে কাটে তার।দিন গড়াতে লাগলো।
তারপর ৭মাসে দীপ্তিকে এ বাসায় আনা হলো।চোখের সামনে নিজের ভালবাসার মানুষের সন্তান বহন করছে।তারপর আবার দীপ্তি মেহেরাবকে নিয়ে রোমান্টিক গল্প জুড়তে চায়।মেহের তখন কথা ঘুরিয়ে ফেলে বা নিজের রুমে চলে যায়।এসবের মাঝে মেহের যেনো মৃ*ত্যুকে চোখের সামনে দেখছে।তাই সিদ্ধান্ত নিলো হোস্টেলে উঠে যাবার সাথে কিছু টিউশন করার।কতো দিন আর মামার টাকায় চলবে।মামার থেকে পারমিশন নিয়ে হোস্টেলে চলে গেলো।প্রতিদিনই মামার সাথে ফোনে কথা হলো।দীপ্তির মেয়ে হবার খবরও পেলো।কিন্তু এলোনা আর এ বাসায়।যোগাযোগ রাখলোনা কারো সাথে।শুধু আশ্রয়দাতা মামাকে ছাড়তে পারলো না।এভাবে বছর কেটে যেতে লাগলো।
৫ বছর পর
-----------------
রাতের আঁধারে ছাদের কর্নারে দাঁড়িয়ে আছে মেহের।আহিল,মেহেরাব এর ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছিলো,যার কারনে নিজেকে এতোটা গুটিয়ে নিয়েছিলো সে।কতো বার চেয়েছে নিজেকে শেষ করে দিতে।কাছের মানুষের এতো বিশ্বাসঘাতকতায় বাঁচা কঠিন।কিন্তু নিজের মা'কে কলুষিত করতে চায়নি।সবাই যে ধিক্কার দিবে।আহিল, এর আগে অনেক কথাই বলেছে।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।রিসিভ করতেই দীপ্তির গলা।বাবার থেকে নাম্বার নিয়েছি।কেমন আছিস? জানিস, মিনাক্ষী পুরো তোর চেহারা পেয়েছে।মেহের দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলগোছে বললো, "নিয়তিটা আমার মতো না হলেই হয়"!তারপর ফোন রেখে দিলো।কালকেই একটা নতুন সিম কিনবো।

লেখিকার অন্যান্য গল্প

Post a Comment

0 Comments

Close Menu