লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা
সাদা বিছানা চাদরে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। বিছানার এক পাশে তুর্য ঘুমিয়ে আছে। অন্য পাশে হীর গুটিয়ে বসে আছে। একটু আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। সারারাত মরার মতো পরে থাকার পর ভোর রাতের দিকে তার চোখ লেগে যায়। কিন্তু কিছু সময় পর পুনরায় তুর্যর স্পর্শে আতকে উঠে হীর। যদিও তুর্য ঘুমের ঘোরে তাকে জরিয়ে ধরেছিল তবুও তুর্যর স্পর্শে ভয়ে কেঁপে উঠে সে। কাল রাতের ঘটনা যদি দুঃস্বপ্ন হতো তাহলে হয়তো মন্দ হতো না। হীর ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে সারা শরীরে। তুর্য যে এতোটা অমানবিক নির্যাতন করবে তার উপর এটা হীর ভাবতে পারে নি। অবশ্য তুর্যর কাছে এসব নতুন কিছু না। এর আগেও তুর্যর এমন ভয়াবহ রূপ হীর সহ্য করেছে। তবে এবার নির্যাতনের ধরণ টা ভিন্ন।
আগের বার তুর্যর আঘাত শুধু শরীরে ব্যথা দিয়েছিল। কিন্তু এবার তার আঘাত আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তুর্য আমার সাথে জোর জবরদস্তি করলেন! কিভাবে পারলেন সে এটা করতে!
ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখছি। সারা শরীরে কামড় আর আঁচড়ের দাগ। খামচি দেওয়া জায়গাগুলো তে রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে। একটা মানুষ যে এতোটা নিচ হতে পারে সেটা আমার জানা ছিল না। ঝর্ণার পানি শরীরে পরাতে ক্ষতস্থানে আরও বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে। শত যন্ত্রণা উপেক্ষা করে হলেও পুরো শরীর ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। তুর্যর কোনো স্পর্শ আমার শরীরে লেগে থাকুক সেটা আমি কখনোই চাইবো না।
প্রায় একঘন্টার মতো সময় নিয়ে শাওয়ার শেষ করে নিলাম।তুর্য এখনও ঘুমিয়ে আছেন। কুম্ভকর্ণও হয়তো এর থেকে কম ঘুমায়। আমার জীবন থেকে শান্তি কেড়ে নিয়ে সে দিব্বি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছ। এটা আমি হতে দেবো না।
বেড সাইড টেবিলে রাখা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে তুর্যর মুখে পানি ঢেলে দিলাম। আচমকা চোখে মুখে পানি এসে পরায় চমকে উঠে তুর্য।
-- বৃষ্টি হচ্ছে! বৃষ্টি হচ্ছে! হীর গ্লাস ক্লোজ করো।
-- ক্লোজ করা চোখ জোড়া খুলে দেখেন। বৃষ্টি নয় টর্নেডো দাঁড়িয়ে আছে আপনার সামনে।
-- ওভাবে সঙ এর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? আর আমার উপর পানি ছুড়ে দিলে কেনো?
হঠাত্ তুর্যর কথার সুর কেমন বদলে গেলো মনে হচ্ছে। কাল রাতে কতোটা বাজে ছিল এখন আবার এতো সুইট করে কথা বলছেন। মতলব টা কি তোর বেটা খচ্চর?
-- তুমি এইমাত্র শাওয়ার শেষ করলে বুঝি!
-- হ্যাঁ তো!
-- না মানে তোমার ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি মেঝেতে পরছে।
-- নেশা টেশা করেছেন বুঝি?
-- তুমি নিজেই তো একটা আস্ত নেশা! তোমাকে দেখলেই নেশা ধরে যায়।
তুর্যর কথায় আমার কান দিয়ে গরম ধোয়া বেরুচ্ছে।
-- এসব কি বলছেন?
-- কিছু না। কাছে এসো। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।
-- তো আমি কি করবো!
-- তোমাকে জরিয়ে ধরলে আমার ক্লান্তি চলে যাবে।
তুর্যর কথায় আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। সত্যি মনে হয় ঘুমের ঘোরে নেশা করেছেন। আমি কাছে না আসাতে তুর্য নিজেই আমার হাত ধরে হেচকা টান দিলেন। টাল সামলাতে না পেরে তুর্যর কোলে গিয়ে পরলাম। তুর্য আমার চুলগুলো সরিয়ে তার ঠোঁট জোড়া আমার দিকে এগিয়ে আমার ঠোঁটে চেপে ধরলেন। কি বিশ্রি পরিস্থিতি। কেনো তাকে উঠাতে গেলাম। নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারা যাকে বলে। এই লোকটার শক্তির সাথে পেরে উঠা আমার পক্ষে কখনই সম্ভব হবে না।
হঠাত্ দরজায় টোকা পরলে তুর্য কে সরিয়ে উঠে পরলাম।
দরজায় কিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে। এমন সাত সকালে তুর্যর ঘরে আসার তার একমাত্র উদ্দেশ্য হীর আর তুর্যর মধ্যে কি চলছে সেটা জানা। বন্ধ দরজার ওপাশে তুর্য আর হীর এর মধ্যে কি হচ্ছে এই চিন্তায় কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি সে। এতোদিন তুর্য কে একা ছেড়ে সে বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে। এখন সেই ভুল টা পুনরায় রিপিট করতে চায় না। দরজা খুলতেই কিয়ারার বুকটা মুচড়ে উঠে। হীর এর শাড়ির আঁচল ঠিক নেই। তবে কি তুর্য সম্পূর্ণ ভাবে হীর এর হয়ে গিয়েছে? না এটা হতে পারে না। তুর্য শুধু তার।
-- কিয়ারা তুমি? এতো সকালে? কিছু প্রয়োজন ছিল?
হীর এর ডাকে কিয়ারার ধ্যান ভাঙে।
-- মামি তোমাকে আর তুর্য কে নিচে যেতে বলেছেন। অনেক কাজ আর মামি একা সামলাতে পারছে না।
-- ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।
-- হ্যাঁ?
-- তুর্য তোমার বড়। তাই তাকে নাম ধরে না ডেকে ভাইয়া বলে ডাকবে কেমন। আর আমি সম্পর্কে তোমার ভাবী,, তুর্যর ওয়াইফ।
হীর এর কথায় কিয়ারার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তুর্য কে সে কখনোই ভাইয়ের চোখে দেখে নি। তার থেকে বড় কথা হীর তুর্যর উপর অধিকার জমাচ্ছে যেটা তার মোটেও ভালো লাগছে না।
কিয়ারা চলে গেলে হীর আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। তুর্য অবাক হয়ে হীর কে দেখছে।
-- ওভাবে কি দেখছেন?
-- আর ইউ ফিলিং প্রটেকটিভ টুওর্ডাস মি?
-- এ্যা! প্রটেকটিভ তাও আবার আপনাকে নিয়ে! হা হা হা। ভেরি ফানি!
-- তোমার কি হিংসে হয় কোনো মেয়ে আমার কাছে এলে?
-- না একদমই না। আপনার কাছে মেয়েরা আসুক বা আপনি মেয়েদের কাছে জান। আমার তাতে কিছুই আসে যায় না।
-- সত্যি?
-- হ্যাঁ সত্যি।
-- ভেবে বলছো তো? কাল জেসিকা ফোন করেছিল। যেতে বলেছে।
জেসিকার নাম শুনে হীর রেগে আগুন হয়ে যায়।
-- আপনি জেসিকার কাছে জান আর অন্য কোন মেয়ের কাছে জান আমার কিছু আসে যায় না। বুঝলেন আপনি? কিছু আসে যায় না আমার।
-- ওকে কুল কুল। আচ্ছা এটা তুমি আমাকে বললে নাকি নিজেকে?
-- আমি আপনার সাথে কথাই বলতে চাই না।
হীর রাগ করে রুমের বাইরে চলে যায়। তুর্য বিছানা ছেড়ে উঠে শাওয়ারে যাওয়ার সময় তার চোখ বিছানার উপর পরে। রক্তের দাগ গুলো জানান দিচ্ছে হীর এর যন্ত্রণার কথা। কাল রাতে তুর্য নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিল। সেই রাগের ফলেই হয়েছে সবকিছু। হীর কে সে কষ্ট দিতে চায় নি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে তার হাতে কিছুই ছিল না।
হয়তো কাল রাতের পর হীর তাকে ভুল বুঝবে। কিন্তু সে তো শুধু হীর এর ভালোবাসা পেতে চায়। এটা কি তার খুব বেশি অন্যায় হচ্ছে? এক মুহূর্তের জন্য তুর্যর মনে হয় হয়তো সে হীর কাছে অনেক বেশি কিছু চাইছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে একটা আশা ঘর বাধে। এমনও তো হতে পারে যে হীর সত্যি তাকে ভালোবাসে কিন্তু কোনো কারণে তার উপর অভিমান করে আছে। যেই জন্য হীর তার ভালবাসা কে মেনে নিচ্ছে না। এমন তো যে হীর জেসিকা আর তুর্যর অতীতের সম্পর্কের জন্য তুর্য কে মানতে পারছে না!
তাফসির বিয়ের পর এই ব্যাপারে হীর এর সাথে কথা বলে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটাতে চায় তুর্য।
আর এক-দেড় ঘণ্টা পরেই তাফসি আর রায়ান এর বিয়ে পড়ানো হবে। বিউটিশিয়ান রা এসে তাফসি কে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে। পরনে লাল একটা লেহেঙ্গা আর বেশ ভারি গহনায় অপরুপা লাগসে তাফসি কে। তবে এতে তাফসির তেমন মাথা ব্যথা নেই। এতো সাজগুজ করার তার কোনো ইচ্ছাও ছিলো না। তমা বেগমের জোরাজোরিতেই এতো সেজেছে সে। সাধারণত বিয়ের দিন মেয়েরা সাজগোজ নিয়ে চিন্তায় থাকলেও তাফসির চিন্তা শুধু রায়ান কে নিয়ে। আগের বার বিয়ের মাত্র দুই ঘণ্টা আগে বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। সেই বার বহু কষ্টে নিজেকে সামলিয়েছিল সে। এবারও যদি এমন হয় তাহলে আর নিতে পারবে না সে। হয়তো আজকের দিনই তার জীবনের শেষ দিন হতে চলেছে! ছোট একটা কাঁচের শিশি সবার অগচরে কোমরে লেহেঙ্গার ভাজে গুজে নেয় সে। একবুক আশা বেধে শুধু একটাই দোয়া করছে সে আজ যেনো তার আর রায়ান এর বিয়ে তে কোনরকম বাধা না আসে।
হঠাত দরজায় নক পরলে তাফসি লেহেঙ্গার আচল দিয়ে শিশি তা ঢেকে ফেলে।
তাফসির রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি ভিতরে আসার অনুমতির অপেক্ষায়। কাল রাতে বড় আম্মু তাফসিকে হলুদ ছোয়া তে দেন নি। আজ যদি তাফসি মানা করে দেয়!
আমার ভাবনা কে ভুল প্রমাণিত করে হাসি মুখে আমাকে ভিতরে দেকে নেয় তাফসি।
-- বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছিস?
-- না আসলে তোমাকে দেখতে এসেছিলাম। তৈরি হয়েছো কিনা!
-- হ্যাঁ। দেখ আমাকে কেমন লাগছে।
-- এই বিয়ে টা করো না তাফসি। রায়ান ভালো না।
-- আমি শুধু চাই তুমি সুখি থাকো সবসময়। আর রায়ান এর কাছে তুমি কিভাবে সুখি থাকবে? রায়ান তোমাকে ঠকাচ্ছে। রায়ান তোমাকে ভালোবাসে না তাফসি।
-- তুই এখান থেকে যা তো হীর। একটু পরেই আমার বিয়ে। আমার মন নষ্ট করিস না।
তাফসির কথার পিঠে আর কিছুই বলতে পারলাম না। কেন তাফসি বুঝতে পারছে না রায়ান ভালো না!
তাফসির রুম থেকে বেরুতেই ড্রয়িং রুমে রায়ান এর সাথে দেখা হয়। রায়ানের চেহারাও এখন আর সহ্য হয় না। রায়ান কে উপেক্ষা করে যেতে নিলে রায়ান পথ আটকে ধরে।
-- হুয়াট হ্যাপেন্ড হীর? তোমাকে অনেক টেন্সড্ মনে হচ্ছে! কি হয়েছে নাকি?
-- এতো খুশি হওয়ার কিছুই নেই। আমি আপনার মনবাসনা কখনও পূরণ হতে দেব না।
-- তুমি কিছুই করতে পারবে না। ফাইনাল এ্যান্ড মাষ্টার স্ট্রোক আমি অলরেডি খেলে নিয়েছি। এখন সবকিছু আমার প্ল্যান অনুযায়ী হবে।
-- একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন রায়ান? কি লাভ পাবেন আপনি তাফসি কে কষ্ট দিয়ে? আপনাকে বিয়ে করে তাফসি কষ্ট পাবে, আর এতে আপনি কি সুখ পাবেন?
-- তাফসি কষ্ট পেলে তুমি আর তুর্য কষ্ট পাবে। এতে আমার ইগো স্যাটিসফাই হবে। কারণ তোমরা দুজন আমার প্ল্যান ফেইল করেছ।
0 Comments