লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা
ভোরের সূর্যের প্রথম কিরণ হীরের চোখে মুখে পরতেই তার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙতেই গতকাল ঘটে যাওয়া সব অঘটনের দৃশ্য একের পর এক চোখের সামনে এসে জরো হতে লাগতো তার। দুচোখের কার্নিশ বেয়ে কখন যে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছে সেও বুঝতে পারে নি। চোখের পানি মুছে নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হীর। আলমিরা থেকে একটা সুতির সালওয়ার কামিজ বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে পানির প্রতিটি ফোঁটা কে অনুভব করছে সে। এখন আর চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। অশ্রু শুকিয়ে চৈত্রের খরার মতো হয়ে গেছে চোখ দুটি। গোসল শেষ করে কাপড় পাল্টে কিচেনে চলে গেলো হীর, উদ্দেশ্য সবার জন্য রান্না করবে।
নিচে নেমে বেশ অবাক হলো হীর। হঠাত্ বুকটা মুচড়ে উঠলো তার। গত ছয় বছরে এই প্রথম চৌধুরী বাড়িতে হীরের ঘুম থেকে উঠার আগেই নাস্তা টেবিলে সাজানো। অথচ এমনও সময় পার হয়েছে যখন একদিন হীর সকালে নাস্তা না বানালে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতো তমা বেগম। টেবিলে তুর্য আর তাফসি নেই। তমা বেগম আর আফজাল সাহেব মুখ গোমড়া করে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন। নিচে নামার জন্য এক পা এগিয়ে দিয়েও পিছিয়ে নিলো হীর। খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এই পরিবারে তার অবস্থান কোথায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলো হীর। এই বাড়িতে কেউ তাকে আর চায় না। সে খুব ভালোই বুঝতে পারছে সবাই কি চায়! তবুও তার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাকে হাজার অপমান সহ্য করে হলেও এখানেই থাকতে হবে।
সকাল সকালই তুর্য তৈরি হয়ে নিলো। নিচে নামার আগে তাফসি কে দেখার জন্য তার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তমা বেগম তাফসির মাথার কাছে বসে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পাশেই খাবারের ট্রে রাখা আছে। তাফসি এখন আর কাঁদছে না। তবে তার মলিন মুখটা তুর্যর নজর এড়াতে পারে নি। একমাত্র বোনের এই কষ্ট তার হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। তার সাধ্যে কুলালে হয়তো এতোক্ষণে পৃথিবীর সব সুখ বোনের পায়ের কাছে এনে রেখে দিতো। কিন্তু সেই সামর্থ্যও আজ তার নেই। এতোটা অসহায় নিজেকে কখনও মনে হয় নি তুর্যর। এক মুহূর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলো সে।
তমা বেগম বহু কষ্টে মেয়েকে সামলিয়ে হালকা কিছু খাইয়ে ভিটামিন ট্যাবলেট খাইয়ে দিলেন। মেয়ের মলিন হয়ে থাকা মুখটার দিকে যতোবার তার চোখ পরছে ততোবারই চোখ ভরে আসছে। আজ যেনো তাদের সব অর্থই বৃথা। এসব কিছুর বিনিময়েও তারা তাদের মেয়ের জীবনে সুখ আনতে অক্ষম। তাফসির কপালে একটা চুমু দিয়ে তমা বেগম সেখান থেকে চলে গেলেন।
দরজার আড়ালে লুকিয়ে হীর এতোক্ষণ তমা বেগমের যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। তমা বেগম বেরিয়ে যেতেই হীর তাফসির একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এক রাতেই তাফসির চেহারা ভেঙে গেছে। হয়তো সারা রাত জেগেই কান্না করেছে, তাই তো চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে। হীরের খুব ইচ্ছে হচ্ছে তাফসির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, তাফসিকে জরিয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে সবটা খুলে বলতে। কিন্তু শত ইচ্ছা থাকলেও আগের মতো সেই অধিকার টা আর নেই।
খুবই ক্ষীণ কন্ঠে তাফসিকে ডাকলে সে চোখ খুলে হীরের দিকে তাকায়। হীর ভেবেছিল হয়তো তাফসি তাকে দেখে রাগ করবে কিন্তু হীরকে ভুল প্রমাণিত করে তাফসি খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিলো হীরের এখানে আসা টা।
বিছানা থেকে নিজেকে উঠিয়ে নিলো তাফসি। হীর সাহায্য করতে চাইলে হাতের ইশারায় মানা করে নিজেই উঠে বসলো।
-- দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? বস ওখানে।
হীর তাফসির ব্যবহারে ভীষণ অবাক হলো।
-- তুমি রাগ করো নি আমাকে এখানে দেখে?
-- রাগ করার কি আছে এখানে? তুই তো আর এই ঘরে নতুন আসছিস না।
-- না মানে, আসলে,, কালকের ঘটনার পর,,,
-- দেখ হীর, তুই আমাকে যা ই মনে করিস,, আমি কখনই তোকে আমার শত্রু মনে করি নি। আর তুই রায়ান কে ভালোবাসিস এই কথাটা একবার আমাকে বললে বিশ্বাস কর আমি নিজেই তোদের রাস্তা থেকে সরে দাড়াতাম।
-- তুমি আমাকে ভুল বুঝছো আপু। বিশ্বাস করো আমার আর রায়ানের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। রায়ান সবাই কে মিথ্যা কথা বলেছে।
-- তোর বলা প্রতি টা কথা আমি বিশ্বাস করতাম। যদি না তোদের এক বিছানায় না দেখতাম।
-- এসব মিথ্যে বিশ্বাস করো!
-- থাক ওসব কথা। বাদ দে। আর ভালো লাগছে না ওসব কথা। আমি রায়ান কে ভালোবাসি। সবসময় এমনভাবেই ভালোবেসে যাবো। তাতে কি হয়েছে সে আমাকে ভালো না বাসলে! আমি তার খুশি চাই।
-- আপু! এসব কি বলছো?
-- বাবা-মা আর তুর্য কে আমি কনভিন্স করতে পারবো তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
-- কি বলছো তুমি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-- তুই আর রায়ান যা চাইছিস তাই হবে।
-- তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও আমার কথা প্রমাণ করার! প্লিজ!
-- এর থেকে বেশি আর কিছু আমার কাছে চাস না হীর। অনেক কষ্টে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। এমন যেনো না হয় সহ্য করতে না পেরে আমি নিজেই সব শেষ করে ফেলি।
-- আপু!
-- চলে যা প্লিজ!
হীর কিছু বলতে গিয়েও কান্না চেপে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে গেলো। সে তো চায় সবকিছু যেনো আবার আগের মতো হয়ে যাক। কিন্তু এখানে তো সব তার ভাবনার বিপরীতেই হচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও সে পারছে না সব ঠিক করতে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে হীর একটা উপায় বের করলো সবকিছু ঠিক করার। রায়ানের মুখ থেকেই সব সত্যি কথা বের করবে সে, সেটা যে করেই হোক। যেই ভাবনা সেই কাজ। মোবাইল ফোন আর কিছু টাকা ব্যাগে ভরে রায়ানের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো হীর।
এর আগেও বেশ কয়েকবার তাফসির সাথে ওই বাড়িতে গিয়েছে সে। এজন্য খুব বেশি সমস্যা হয় নি তার।
.
.
অজানা গন্তব্যে আপনমনে কার ড্রাইভ করে চলছে তুর্য। একদিকে তার বোন আর অপরদিকে তার ভালোবাসা। দুজনেই কষ্ট পাচ্ছে। আর সে কারোর কষ্টই দূর করতে পারছে না। আর এই সমস্যার জন্য দায়ী শুধু রায়ান। রায়ানের জন্যই তার আপনজন রা এতো কষ্টে আছে! রায়ানের সাথে শেষবারের মতো কথা বলতে তুর্য রায়ানের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরায়।
.
রায়ানের বাড়িতে তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হীর। আজকে কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে ফিলিং আসছে হীরের এই বাড়ি থেকে। আগে কখনো এমনটা হয় নি। বারবার মনে হচ্ছে কোন কিছু ভয়ানক ঘটতে চলেছে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিজের ভয় কে দমিয়ে রুমে প্রবেশ করলো হীর।
রুমের বাম পাশের সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে রায়ান। হীর ঘরে ঢোকার আগেই মোবাইল এ ভিডিও মোড অন করে নিয়েছে। রায়ানের মুখ থেকে সত্যি টা উগলে ক্যামেরায় বন্ধী করে নেবে।
দরজায় টোকা পরতে, রায়ান ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই কড়া গলায় বললো,
-- কফি টেবিলে রেখে চলে যাও।
হালকা গলা ঝাড়ি দিয়ে হীর বললো,
-- আমি হীর। ভিতরে আসতে পারি?
হীরের গলা শুনে বেশ অবাক হয়ে ঝট করে দাঁড়িয়ে পরলো রায়ান। সে হীর কে এই সময় তার বাসায় মোটেও এক্সপেক্ট করে নি। সে খানিকটা চমকে গেলেও হীরের সামনে নিজেকে স্থির রেখে হীরের এখানে আসার কারণ জানতে চাইলো।
-- তুমি কেনো এসেছো এখানে?
হীর মোবাইল টা একটু উঁচু করে রেখে রায়ানের মুখ বরাবর এসে দাঁড়ায়।
-- আমি এখানে আপনাকে বোঝাতে এসেছি যে আপনি যা করছেন সেটা কতো বড় অন্যায়। এতে শুধু আপনি তাফসির না আমাদের চারজনেরই জীবন নিয়ে খেলছেন। আপনি কি জানেন এর পরিণাম কতোটা ভয়াবহ হতে পারে?
-- না। জানি না। সত্যি বলতে জানতে চাইও না।আমি যা করেছি সবার ভালোর জন্য করেছি। আর কেউ না জানুক অত্যন্ত তো তুমি আর আমি জানি এটাই সবার জন্য ভালো। আমি তাফসিকে ভালোবাসি না এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে কি লাভ বলো যেখানে ভালোবাসা নেই।
রায়ানের ধীরে ধীরে সব স্বীকার করে নেওয়াতে হীরের মনে একটা নতুন আশার আলো সঞ্চার হয়।
-- কিন্তু তাফসি আপনাকে অনেক ভালোবাসে সেটা তো আপনি জানেন। অন্তত ওর ভালবাসার কথা বিবেচনা করে হলেও এমনটা করবেন না।
-- তাফসির ভালোবাসার কথা চিন্তা করেই বিয়ে টা করছিলাম। কিন্তু এখন যখন সবাই সত্যটা জানে তখন আর লুকিয়ে কি লাভ বলো।
হঠাৎ করে রায়ানের কথার সুর পাল্টে যাওয়ায় খানিকটা বিচলিত হয়ে ওঠে হীর।
-- মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি? বুঝতে পারছি না ঠিক।
রায়ান একটু বাঁকা হেসে উত্তর দিলো,
-- এখন যেহেতু সবাই আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। এই সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়াই ভালো। তাই তো তোমাকে বিয়ে করে লাইফে সেটেল হয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছি। আমার বিশ্বাস আমি তোমাকে যতটা ভালোবাসি তুমি আমাকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসো।
রায়ানের কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে হীর বলল,
-- কি বলতে চাইছেন আপনি? এখানে আপনি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই যার সামনে আপনি মিথ্যা নাটক করছেন! সুতরাং মিথ্যা কথা বলা বন্ধ করুন। নিজের ভুলটা স্বীকার করুন আর তাফসি কে বিয়ে করে ভুলটা শুধরে নিন।
0 Comments