লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

কপি করা নিষিদ্ধ। এই গল্প অতিরিক্ত রোমান্টিক নয়। ধোঁয়াশা ও রহস্যময়তায় ভরা গল্পটি শুধু ধৈর্যশীল এবং রহস্য সমাধানে আগ্রহী পাঠকদের জন্য।

ঢাকার নির্জন অন্ধকারে জেগে থাকা অর্ধসমাপ্ত পঞ্চদশ তলার চূড়ান্ত উচ্চতা, মৃ'ত্যুর হাতছানি দেওয়া ছাদের প্রান্তে, নিয়তির মতো জমাট বাঁধা এক উত্তপ্ত সন্ধিক্ষণে, লোহার চেয়ারকে উপেক্ষা করে অধিরাজ্যের মসনদে বসার মতো আরামে হেলান দিয়ে রয়েছেন আজগর আলী। কনকনে শীতল হাওয়ায় বাতাস অলঙ্ঘনীয় ব্যূহ রচনা করেছে; তার মধ্যখানে দাঁড়িয়ে প্রজ্জ্বলিত আলো টেবিলের উপর মদের গ্লাসে খেলছে। তাঁর নিস্তরঙ্গ মুখাবয়ব নিয়তির শিলালিপি, অপরিবর্তনীয়, শীতল।
সামনের চেয়ারে বসা মোটা লোকটি, যার দাঁতের ফাঁক দিয়ে পান চিবানোর শব্দ শূন্যতার বুক চিরে বেরোয়, নিস্পৃহ অম্লান মুখে ফিক করে হাসল। লোকটির কণ্ঠস্বর গড়গড় শব্দে ফেটে পড়ল,
——— "আপনি তো এতদিন আমাদের কিছুই দেননি। এখন অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে কি লাভ? আমাদের যে লোকসান হলো! শুনেছি সিআইডি নাকি আপনাদের পেছনে হাতপা ছুড়ছে। আবার ধরা পড়লে তো আমিও গেলাম!"
আজগর আলীর ঠোঁটের কোণে চিরন্তন বিদ্রূপের রেখা ফুটে উঠল। চারপাশে বসা তাঁর দেহরক্ষীরা নীরব প্রহরার দৃঢ় প্রতীক হয়ে জড় পদার্থে পরিণত। গ্লাসটি টেবিল থেকে তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি গভীর গলাভরী উচ্চারণে বললেন,
——— "সিআইডি? তারা আমার কি করবে? আপনি যদি আমার পার্টনার হয়ে এমন ছেলেমানুষি কথা বলেন, তবে কিন্তু আমাকে অন্যভাবে ভাবতে হবে।"
——— "অন্যভাবে মানে?"
——— "তুই বাকি টাকা মে'রে নিয়ে এখন বলছিস, আমি টাকা বেশি চেয়ে ভুল করছি?"
——— "ম-মানে, কী বলতে চাইছেন?"
আজগর আলী হো হো করে হেসে উঠলেন। তাঁর হাসির আওয়াজ নির্মম রজনীর অন্ধকার ছিদ্র করে বিদ্ধ করল। গম্ভীর অথচ প্রণিধানযোগ্য কণ্ঠে তিনি বললেন,
——— "তুই কি জানিস, তোর সামনে কে বসে আছে? ইকরাম নয়, আজগর বসে আছে। এতদিন তো তুই আমার ভাইয়ের পেছনে টাকা মেরে তৃপ্তি খুঁজেছিস। কিন্তু আমি? আমি সেই অভ্যাস তোর ভিতর থেকে নির্মূল করব। আজ রাতেই।"
চারপাশের বাতাস হিম হয়ে গেল। লোকটির মুখে পান ধরা অবস্থায় থেমে গেল, চোখে জ্বলজ্বল করছে আতঙ্ক। আজগর আলীর দৃষ্টিতে নেমে এল তীক্ষ্ণতম সংকল্প। আজগর আলীর ইশারায় তাঁর অনুগত সহকারী এক মুহূর্তও অপব্যয় না করে প্রতিটি দেহরক্ষীকে সংকেত প্রদান করল। সেই সংকেত র'ক্তের প্রবাহে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিল চারপাশে। মোটা লোকটি নিজের পেছনে থাকা তারই গার্ডদের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য আশ্বাস খুঁজল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম কৌতুকে প্রত্যেকের কপালে ঠেকানো বন্দুকের নল, সময়কে থমকে দিল। মোটা লোকটির চোয়াল শক্ত হলো, কপাল দিয়ে ঘামের রেখা বয়ে পড়ল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে সে গর্জে উঠল,
——— "এই আজগর, তুই জানিস তুই কার সামনে আছিস? তুই ভুল করছিস!"
আজগর আলী, যিনি এই নাট্যমঞ্চের একমাত্র পরিচালকের মতো দাঁড়িয়ে আছেন, ঠোঁটের কোণে এক নিঃশব্দ বিদ্রূপ নিয়ে বললেন,
——— "এবার তুই নিজেই বুঝবি, তুই কার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস।"
এ কথার পর আর কোনো পূর্বাভাসের প্রয়োজন পড়ল না। মুহূর্তের ব্যবধানে মোটা লোকটির শরীরকে কঠিন গ্রন্থির মতো আঁকড়ে ধরল আজগরের লোকেরা। চিৎকার করার সময়টুকুও, সে হারিয়ে ফেলল। কাঁচা মাং'সের মতো ঠেলে তাকে ছাদের কিনারে নিয়ে গিয়ে নিচে ছুড়ে ফেলা হলো। পনেরো তলার উচ্চতা থেকে পতনের সময় বাতাস চিরে উঠে আসা তার আর্তনাদ রাতের অন্ধকার গিলে নিল, এই নগরীর হৃদয়েও এর অস্তিত্ব লুপ্ত হলো।
আজগর আলী উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের কিনারায় এগিয়ে এসে দাড়ালো, হিম আধারে কৌতুক মুখশ্রী সহিত তাকালো! পরমুহূর্তে ধীর পায়ে টেবিলের কাছে ফিরে এসে তাঁর হাত দু'টি ধীরে ধীরে মুছলেন। তারপর নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা সহকারীকে তীক্ষ্ণ চোখে নির্দেশ দিলেন,
——— "পুলিশকে টাকা দিয়ে 'সুইসাইড কেস' বলে রফা করিয়ে দে। আর ওর সব কুকীর্তির খবর ফাঁস করে দে মিডিয়ায়। তখন দেখবি, ওর লাশের ওপর লোকে থুতু ফেলবে।"
কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল নিস্তব্ধ নির্মাণশীল ভবনের গাঢ় অন্ধকারে। একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে, তিনি পকেট থেকে ফোন বের করলেন। স্ক্রিনে আঙুল বোলাতে বোলাতে তাঁর মুখে ফুটে উঠল অশুভ তৃপ্তি। যেন এই মহাকাব্যের চূড়ান্ত অধ্যায় তিনি নিজেই রচনা করেছেন, যার নায়কও তিনি, এবং নিয়তির কারিগরও। অত:পর অন্ধকার ছাদের চিলেকোঠায় ঝুলে থাকা নীরব রাতের বুকে সহকারী কাঁপাকাঁপা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল, যেন শব্দগুলো নিজেরাই নিজেদের বের করে আনার সাহস খুঁজছিল,
——— "স্যার, উনি তো শহরের প্রভাবশালী নেতা! উনার কুকর্ম ফাঁস করতে গেলে যদি আমাদের নাম উঠে আসে?"
আজগর আলী হালকা বিরক্তির ছাপ নিয়ে, গ্লাসটি পাশে রেখে এক গভীর নির্লিপ্ততার সাথে উত্তর দিলেন:
——— "তোরা কি গাধা নাকি? আমরা কিছু করেছি? যে আমাদের নাম উঠবে? সবটাই লোক দেখানো। আমরাই প্রমাণ করব আমরা ধোয়া তুলসী পাতা। চিন্তা করিস না।"
সহকারী চুপ হয়ে গেল, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আজগর আলী আবার ফোনের স্ক্রিনে মনোনিবেশ করলেন। অদূরে একটা আন্তর্জাতিক ডিলের অপেক্ষায় তিনি। বিদেশি ক্লায়েন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এগিয়ে আসছে। এই রাতের আয়োজনও মূলত সেই তুরুপের তাসের জন্য।
কিছুক্ষণ পর সহকারী আবার এগিয়ে এল। সংকোচ নিয়েই বলল,
——— "স্যার, আরেকটা কথা... সিলিন্ডারের ট্রাক ব্লা'স্ট করিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটালেও লাভ হলো না। ভাবি তো ম'রলেন না।"
আজগর আলী এক মুহূর্ত গ্লাস হাতে স্থির হয়ে রইলেন। তারপর হেসে উঠলেন এমনভাবে, যেন শিকারি কৌশলে পরাজিত শিকারের দিকে তাকাচ্ছে।
——— "আহা, ভাবির কই মাছের প্রাণ! তাড়াহুড়ো করলে কি আর সব হবে?"
——— "কিন্তু স্যার, ভাবি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন! এখন কোমায় চলে গেছেন।"
আজগর আলীর মুখে হাসি মিলিয়ে গেল। তাঁর চোয়াল শক্ত হলো, কণ্ঠস্বর হিমশীতল।
——— "আর আমাকে এসব শুনাচ্ছিস? ওটাকে এখনো মে'রে ফেলিস নি কেন?"
সহকারী ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
——— "লোক পাঠিয়েছি স্যার। কিন্তু ওখানে সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ আর সিআইডি সবসময় নজর রাখছে।"
——— "পুলিশকে টাকা খাইয়ে ঠান্ডা করিস নি?"
——— "স্যার, পুলিশদের খাওয়ানো গেছে। কিন্তু সিআইডি… ওদের তো কিনতে পারা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। একবার ওরা জানলে ঝাঁপিয়ে পড়বে!"
আজগর আলী গ্লাস টেবিলে রাখলেন। কণ্ঠে গভীর দমন করা ক্রো'ধ ফুটে উঠল:
——— "আমি কিছু শুনতে চাই না। ভাবির উপর নজর রাখ। যখনই সুযোগ আসবে, ওকে একদম চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিস। এমনিতেও তো ঘুমে আছে, এই কোমা থেকে আর ফেরার দরকার নেই।"
সহকারী অসহায় গলায় বলল:
——— "কিন্তু স্যার, শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় লাভ কী হলো? অযথা এত মানুষ ম'র'ল!"
আজগর আলী হেসে উঠলেন। সেই হাসি যেন নরকের গহ্বর থেকে উঠে আসা।
——— "ধুরর! যারা ম'রেছে, তারা তো ব'স্তি'র কী'ট। ফ'কি'রের বাচ্চা। ম'রে গিয়ে ওরা মুক্তি পেয়েছে, নইলে ম'রে ম'রে বেঁচে থাকত। বরং ভালোই হয়েছে। এই সব নিয়ে সময় নষ্ট করিস না।"
তিনি পা তুলে গ্লাসে চুমুক দিলেন, তারপর গলায় বিদ্রূপ মিশিয়ে সহকারীকে নির্দেশ দিলেন,
——— "ভাবির দিকে নজর রাখ। আর হ্যাঁ, মা'রার আগমুহূর্তে বলিস ভাবিকে, তার দেবর তাঁকে খুব ভালোবাসে। এই ভালোবাসা তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত থাকবে, চিরন্তন ঘুমের মধ্যেও!"
আজগর আলী ফের ফোনে মন দিলেন। স্ক্রল করতে করতে তাঁর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একটি নির্দয় হাসি, নিয়তির সর্বময় নিয়ন্ত্রণ যেন তাঁর মুঠোয়।
_____________________
——— "বলো, বলো পিচ্চু! কেন ডেকেছো?"
কনকনে শীতের শাসনে বদ্ধ, কুয়াশার চাদরে ঢাকা সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে রোহান। আশপাশে মহীরুহসম গগনচুম্বী বৃক্ষরাজি, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, শিরীষ। শীত তাদের শুষে নিয়েছে প্রাণস্পন্দন, ঝরিয়ে দিয়েছে সমস্ত পত্রপল্লব, রেখে গেছে শুধুই নির্জীব কঙ্কালসার ডালপালা। সেই নিঃসঙ্গতার মাঝে রোহান নিজের উষ্ণতার খোঁজে মাফলারটিকে আরও আঁটসাঁট করে জড়িয়ে, মৃদু কৌতূহল মাখা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তার সম্মুখে, স্বল্পবাক আঁখি। মুখে একরাশ নিঃশব্দ হাসি, যার গভীরতা রোহানের অজ্ঞাত। নিজের কোর্টের উপর জমে থাকা শিশির কণা মুছে, আঁখি সেই প্রাঞ্জল হাসি নিয়ে বলল,
——— "চলুন, আজ আপনাকে ট্রিট দেব।"
রোহান বিস্ময়ে অভিভূত! ট্রিট? এই তুচ্ছ কারণে তাকে ডাকা হয়েছে? মাথায় হাত রেখে ব্যাকুল স্বরে বলল,
——— "আয় হায়! এতদিন পর সুবুদ্ধির উদয় হলো! সেদিন তো আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে। এবার কি আল্লাহ তোমার হৃদয়ে বিবেক জাগ্রত করলেন?"
——— "বলুন ভাইয়া, কী খেতে ইচ্ছুক?"
রোহান একটু থমকালো। কী খাবে? কী-ই বা উপযুক্ত? গালে হাত রেখে চিন্তার গভীরে নিমজ্জিত হলো। কিছুক্ষণ পর, মৃদু শীতল হাওয়া থেকে মুক্তি পেতে মোজা পরা দু’হাত ঘষে, সিদ্ধান্ত জানাল,
———" শোনো, বিলাসী রেস্তোরাঁর প্রাচুর্যের কোনো প্রয়োজন নেই। নগরপথের ধারে কত বয়স্কা মা-দাদিরা শীতের ভাঁপে উনুনের উত্তাপ জ্বালিয়ে পিঠা বিক্রি করছেন। চলো, গরম গরম পিঠা খাই। এতে তাদের সাহায্যও হলো, আর আমার ট্রিটও যথার্থ রূপ পেল।"
কনকনে শীতল বাতাসে দাঁড়িয়ে আকাশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শীতল রৌদ্রটুকু আঁখির মৃদু হাসির সাথে গোপন সমঝোতা করছে। সে হঠাৎই বলল,
——— "বোধ করি, আমি পূর্বেই অবগত ছিলাম! আপনি এ কথাই বলবেন, ভাইয়া!"
রোহান ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। সমগ্র বাক্যের অর্থ তার কাছে হিমালয়ের অরোধ্য শিখরে লুকিয়ে রয়েছে। কিছুই স্পষ্ট হলো না তার কাছে। আঁখি তার মমতাভরা হাতে পেপারে মোড়ানো ভাপা পিঠা আর চিতই পিঠে বাড়িয়ে দিল। মৃদু কণ্ঠে বলল,
——— "আপনার ট্রিট!"
রোহান বিস্ময়ে গোলাকার হয়ে ওঠা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল। সেই বিস্ময়ের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে কি যেন খুঁজতে লাগল। আঁখি ততক্ষণে তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা এঁকে শান্ত কণ্ঠে বলল,
——— "আপনি সহজাতভাবে একজন ভালো মনের মানুষ। তবে যার তার ডাকে অনায়াসে ছুটে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন!"
এই বলে আঁখি একটি হাসির আবরণে নিজেকে ঢেকে উল্টো পথে পা বাড়াল। পদক্ষেপ যেন শীতের কুয়াশায় এক একটি ছায়ামূর্তি আঁকছিল। রোহান স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল,অথচ তার অর্থ উদ্ধার করতে অপারগ।
তার মস্তিষ্কে প্রশ্নের ঢেউ জাগলো, এই মেয়ে কি তাকে কোনো অবোধ শিশু মনে করছে? যে একেবারে বিনা আড়ম্বরে তার মতো একজন প্রাপ্তবয়স্কের কাছে এমন গূঢ় উপদেশ রেখে গেল!? আচ্ছা রোহানকে কি অপমান করে গেলো নাকি? আজব? রহস্যের গভীরে লুকিয়ে থাকা কথাগুলোর অর্থ তার বোধের সীমানায় এসে ধাক্কা দিয়ে অতিক্রম করে চলে গেল।
হাতে ধরা পিঠাগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে মনে হলো, বলার আগে কিভাবে জানল? তবে কি আঁখির এই পূর্বানুভূতি কোনও অলৌকিক ষষ্ঠেন্দ্রীয়ের ফসল?
এক অব্যক্ত বিস্ময় নিয়ে, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা রোহানের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির স্রোত বয়ে চলল। তার সমগ্র অস্তিত্ব যেন এক কুয়াশা-আবৃত সাহিত্যিক দৃশ্যের প্রতীক হয়ে রইল।
--
আজ সকালবেলা রোহানের ফোনে এক অচেনা নম্বর থেকে অপ্রত্যাশিত কল এসেছিল। প্রথমবার নম্বরটি দেখে সে উপেক্ষা করল, কিন্তু দ্বিতীয়বারের আহ্বানে বাধ্য হয়ে রিসিভ করতেই কানে এলো আঁখির কণ্ঠস্বর। মুহূর্তের জন্য রোহান নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল; হতভম্ব, বিস্ময়াভিভূত। আঁখি! তার কাছে এই নম্বর কোথা থেকে এলো? মনের গভীরে নানা অযৌক্তিক চিন্তার ঘূর্ণিপাকে ডুবে থাকা রোহান হঠাৎ শুনতে পেল আঁখির অনুরোধ, বিকেলে একান্তে দেখা করার।
কিন্তু কেন? কেন এই একাকীত্বের আহ্বান? রোহান ভেবেছিল, হয়তো মুগ্ধকে নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ তুলবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে এখানে পৌঁছে সে যেন আরেক বাস্তবতার সম্মুখীন হলো। আঁখি তাকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে ট্রিটের জন্য? বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক হলেও তার গভীরে অস্বাভাবিকতার এক অদৃশ্য ছায়া স্পষ্ট।
তারপর, কথার জাল বুনতে বুনতে, আঁখি হঠাৎ অগোছালো ও বিক্ষিপ্ত বাক্য বর্ষণ করে এখন রোহানকে যেন ধাঁধায় ফেলে চলে গেল।
রোহান একরাশ বিভ্রান্তি নিয়ে নিজের কপাল চুলকে বলে উঠল,
——— “এই মধু আর মধুর বউ পুচকু! এরা দুজনেই যেন মানব প্রজাতির সীমা ছাড়িয়ে কোনো ভিন্ন গ্রহ থেকে এসেছে! ভুলক্রমে এই নশ্বর পৃথিবীতে নেমে পড়েছে!”
___________
অতঃপর আঁখি, কনকনে শীতল প্রকৃতির নির্মম শাসন অগ্রাহ্য করে, ঠান্ডা মাটির গা ঘেঁষে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। উলের কোটটি আঁটসাট করে জড়িয়ে ধরে, ঠোঁটের কোণে জমে থাকা শীতের ধোঁয়ার কুন্ডলিকে উড়িয়ে দেয়। কিছু দূর অতিক্রম করতেই পুকুর পাড়ের সেই সুপরিচিত প্রান্তরে দাঁড়ায়, একদা কোলাহলমুখর, প্রাণচঞ্চল স্থান, যা আজ নিস্তব্ধতার ভারে নুয়ে পড়েছে।
এই স্থানে একসময় বান্ধবীদের অট্টহাসি বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতো। রূপার দুরন্ত চাঞ্চল্য ভেসে ওঠে স্মৃতির স্রোতে, তার চঞ্চল অথচ দুষ্টু হাসি যেন এখনো কানাকানি করে বলে,
———"আমি এখানেই আছি, বিলাই!"
মিলির স্থূল অথচ উজ্জ্বল চেহারার পেশি-সন্ধানী হাসি চোখে ভেসে ওঠে; তার ফোলা গালে আনন্দের দাগ মেখে মিলি বলত,
——— "আমার জন্য খাবার কই, বিলাই?"
আর আছিয়ার কোমল নয়নে জ্বলে ওঠা দাহজ্বালা তার রক্তিম দৃষ্টিতে অগ্নিশর্মা হয়ে প্রশ্ন,
——— "কার এত সাহস? কে তোকে কী বলেছে? আমাকে বল!"
কিন্তু আজ? সময়ের নিয়মে সবই এক ভয়ংকর শূন্যতাকে আলিঙ্গন করেছে। পুকুরের সেই পাড়, সেই ঘাট, সেই মাটি, সবই অবিকল থেকে গেছে। অথচ, গাছের পাতা ঝরে পড়েছে, মাটির আর্দ্রতা শুষ্কতায় হারিয়ে গেছে, পুকুরের জল ফুরিয়েছে। প্রকৃতির এই পরিবর্তন চক্র অবিরাম ঘূর্ণায়মান; একদিন হয়তো আবার সবুজ পাতায় ঢেকে যাবে গাছ, মাটি ফিরে পাবে তার সজীব স্পর্শ, পুকুর ভরে উঠবে জলে।
কিন্তু মানুষগুলো? আঁখি এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই পুকুর, এই মাটি, এই আকাশ, এই গাছ, সবকিছুর স্মৃতিতে মিশে আছে তাদের হাসি, কান্না, রাগ, ভালোবাসার এক একটি অধ্যায়। প্রকৃতি সাক্ষী হয়ে আছে সেই গল্পগুলোর, অথচ তাদের অস্তিত্ব আজ কালের করাল গ্রাসে বিলীন।
শীতল বাতাসে স্তব্ধতা ভেদ করে আঁখির মনে ভাসে সেই চিরন্তন প্রশ্ন,
——— "সময় কি কেবলই বিস্মৃতির আরেক নাম?"
অতঃপর কুয়াশার শিশিরে সিক্ত ঘাটের পাথুরে প্রান্তে ধীরেসুস্থে বসে পড়ল আঁখি। আকাশে শীতল নীরবতা নেমে এসেছে; চারপাশের নিস্তব্ধতা সমুদ্রের গর্জনের মতো ভারী। তখনই দূর থেকে প্রতিভাত হলো এক অবয়ব, এক অন্ধ প্রবীণ, শীতের তারণায় কুচকে যাওয়া কালো ত্বক, চোখে কালো চশমা, হাতে একটি লাঠি এবং আরেক হাতে একখানি খাম। গায়ে চাঁদর মুড়িয়ে লাঠি মাটিতে ঠেকিয়ে তিনি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন ঘাটের দিকে। নীরবতার মোড়কে বাঁধা সেই আগন্তুক একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। শুধু দৃষ্টিহীন প্রত্যাশা নিয়ে হাত উঁচু করে বাড়িয়ে দিলেন খামখানি, যেন কোনো অলিখিত দায়িত্ব সমর্পণের ইঙ্গিত।
আঁখি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। থমকে থাকা সময় তার কাঁধে বাষ্পের ভার রেখে চলেছে। সে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে নিল খামখানা। তৎক্ষণাৎ বৃদ্ধ লোকটি কোনো দিশাহীন পাখির মতো উল্টো দিকে পা বাড়িয়ে লাঠি ঠেকাতে ঠেকাতে মিলিয়ে গেল কুয়াশার স্তব্ধতাপূর্ণ পর্দায়। আঁখি কিছু বলল না, কেবল দীর্ঘশ্বাসের ভারে তার বুকের খাঁচা আরও ভারী হয়ে উঠল।
নিজের জায়গায় ফিরে বসে পড়ল সে। তার মনে প্রশ্ন, "কবে আসবে সেই অজ্ঞাত মানবটি? কতদিন এমন বোবা, অন্ধ দূতদের হাতে বার্তা পাঠাবে?" নিরুত্তর এই প্রতীক্ষার ভার অন্তরের গভীর কোনো স্রোত বয়ে নিয়ে চলেছে।
অবশেষে আঁখি খামের সিল খুলল। ভেতরে বেরোল একখণ্ড সাদা, মলিন কাগজ। পরিচিত হাতে লেখা সেই চিরন্তন অক্ষরগুলো চোখে পড়তেই বুকের গভীরে অজানা আলোড়ন সৃষ্টি হলো। কী আশ্চর্য সেই লেখনী! কাগজের প্রতিটি অক্ষর জীবন্ত, যেন সেগুলো সময়ের স্রোত ঠেলে অতীত থেকে আঁখির কাছে পৌঁছেছে। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ হৃদয়ের গভীরতম স্তরকে নাড়িয়ে দিয়ে বলে,
———"আমি এখানে আছি, তোমার সঙ্গে।"
আঁখি তন্ময় হয়ে চেয়ে রইল। কুয়াশা ধীরে ধীরে আরও গাঢ় হলো, কিন্তু সেই লেখা, সেই বার্তা, তার কাছে এক অমোঘ, অসীম চিরন্তনের সাক্ষ্য হয়ে রইল।
---
বৃদ্ধ লোকটি খানিক দূর যেতেই অদ্ভুত স্বাচ্ছন্দ্যে চোখ থেকে কালো চশমাটি খুলে নিল। তার গতি বদলে গেল; যে মানুষটি অন্ধতার ছদ্মাবরণে লাঠি ঠেকিয়ে পথ পেরোচ্ছিল, সে মুহূর্তেই হয়ে উঠল স্বাভাবিক ও সতেজ। লাঠিটি হাত ঘুরিয়ে খেলিয়ে নিয়ে এক অনায়াস ভঙ্গিতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। শীতের কুয়াশামাখা বাতাসে তার চলার ধ্বনি এক অভিজ্ঞান হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
পথ কিছুটা পেরিয়ে, সে থামল ভিন্ন রকম দৃশ্যপটে। সামনে বাইকের হ্যান্ডেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ ব্যক্তি। তার পরনে কালো লেদারের জ্যাকেট, মাথায় শক্ত হেলমেট, আর মূর্তিতে ভাস্বর এক গম্ভীরতা। কুয়াশায় ঢাকা দৃশ্যপট তার উপস্থিতিতে থমকে গেছে। সেই অপরিচিত ব্যক্তি, দাঁড়িয়ে থাকা স্তম্ভের মতো, নিজের বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে আকাশকে ছুঁতে চাইছে।
বৃদ্ধটি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে নতস্বরে বলল,
——— "দিয়ে এসেছি!"
বলিষ্ঠ ব্যক্তি মাথা একটু ঝাঁকাল, কিন্তু কোনো বাক্য বিনিময় করল না। সে বাইকের সীটে স্থির ভঙ্গিতে বসল। তার চোয়াল শক্ত, শীতের হিমবাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক অচল পর্বত। তার আঙুল বাইকের স্টার্টে ঘুরতেই ইঞ্জিনের গর্জন কুয়াশার স্তব্ধতা ভেদ করে ছুটে চলল।
বাইকের টায়ার থেকে উচ্ছ্বলিত বরফকণার মেঘ এক নিমেষে বাতাসে মিলিয়ে গেল, আর সে পূর্ণ গতিতে চলে গেল পথ বেয়ে। সেই ঝড়ো স্পন্দনের পেছনে রইল শূন্যতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধটি। তার চোখ স্থির, মুখ নিঃশব্দ, কিন্তু সেই দৃষ্টিতে সময়ের কোনও গভীর রহস্যের ছায়া।
এ দৃশ্য কুয়াশার পাতায় লেখা রূপকথার মতো, যেখানে শব্দ নয়, নিঃশব্দের ভারী উপস্থিতিই সকল গল্পের সারাংশ বলে দেয়।
________________________
পরের দিন প্রভাতের সূর্যালোকে বিভোর নগর। সময়ের নিঃশব্দ প্রহর ঘড়ির কাঁটায় টিকটিক শব্দে জানান দিচ্ছে সকাল দশটার উপস্থিতি। শান্ত, সদ্য আইসিইউ থেকে বেরিয়ে, কিছুক্ষণ মায়ের পাশে কাটিয়ে এসেছে। সময় এখন তার জন্য হাসপাতালের করিডোরেই থমকে আছে। সে ক্রমাগত এখানেই অবস্থান করে, পুলিশের নিবিড় নজরদারির মধ্যেই। নাঈম অস্থায়ীভাবে বাইরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনে রত, আর শান্ত তার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় করিডোরে বসে। হাতে ফোন, আঙুলের আলতো চাপে স্ক্রল চলছে বাস্তব থেকে সাময়িক পলায়ন যেন।
এমন সময় হাসপাতালের প্রশস্ত দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল এক দুর্বোধ্য ছায়ামূর্তি। তার চোখ দু’টি শিকারি পাখির মতো সতর্ক ও সন্দেহপ্রবণ, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতার ধার অন্ধকার বিদীর্ণ করে। মুখে মাস্ক, শরীর কালো চাদরে আবৃত, রহস্যের মোড়কে ঢাকা। প্রতিটি পদক্ষেপ নিস্তব্ধ, তবু তা পরিবেশকে ভারী করে তুলছে। ধীরে ধীরে সে আইসিইউ’র কাছাকাছি পৌঁছে গেল। সেখানে পুলিশের সতর্ক পাহারা ও করিডোরে স্থির হয়ে বসা শান্তর উপস্থিতি দেখে তার গতি হঠাৎ থমকে গেল।
চোরা দৃষ্টিতে শান্তকে পর্যবেক্ষণ করল, আর তার ভেতরে জন্ম নিলো বিক্ষোভের অনল। একটি মুহূর্তের জন্যও একাকী পাওয়া যাচ্ছে না আফিয়া বেগমকে! ক্রোধ তার শিরা-উপশিরায় বিদ্রোহী তরঙ্গের মতো দোলা দিলো। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে স্তব্ধ করে রাখল, সে নিজেই নিজের ছায়ায় লুকিয়ে যাচ্ছে।
হাড় কাঁপানো শীতল হাওয়ায় ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে বেরিয়ে এলো সেই রহস্যময় ব্যক্তি। ক্রমাগত জমাট রাগ তার ভেতরে তুষারঝড়ের মতো প্রবল হয়ে উঠেছে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে অর্থের প্রলোভন সহজ, কিন্তু শান্ত? সে যেন এক অবিচল প্রাচীর, অচঞ্চল, অদম্য। তাকে সরানো এক দুরূহ কর্তব্য। হতাশার ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে বিরক্ত শ্বাস ফেলে ছুটে চলল নির্জনতার খোঁজে, যেখানে তার ক্রোধ নিঃশ্বাস নিতে পারে।
দূরে এক নির্জন কোণে গিয়ে সে চাদরের নিচ থেকে ফোন বের করল। শীতল আঙুলে যন্ত্রের বোতাম চেপে ডাক পাঠাল এক অজানা গন্তব্যে। অপর প্রান্তে রিসিভ হতেই নিচু স্বরে চাপা ক্রোধ ঝরে পড়ল কথায়,
———— "আমি নজর রাখছি, কিন্তু একটুও সুযোগ পাচ্ছি না! ওই শান্ত আর নাঈম যেন হাসপাতালের মেঝেতে পেরেক ঠোকা। তারা এক মুহূর্তের জন্যও সরে না! তবু, একবার সুযোগ পেলেই ভাবিকে শে'ষ করে দেব!"
——— "Are you sure?"
শব্দটি তুষার ঝড়ে আঘাত হানা বজ্রের মতো, রক্ত জমিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেই রহস্যময় ব্যক্তির শরীরে রুদ্ধ কাঁপন জাগল, এবং সে বুঝল, অন্ধকারে লুকিয়ে থাকলেও কিছু ছায়া বরাবরই আরও গভীর।
পেছনে ঘুরতেই চোখে পড়ল শান্ত, এক ব্যাধের মতো স্থির দাঁড়িয়ে। তার ঠোঁটে লেগে থাকা একধরনের রহস্যময় হাসি, সমগ্র পরিস্থিতি তার মুঠোয় বাঁধা। কোর্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে রাখা শান্তর র'ক্তাভ চোখদুটি কোনো গভীর অরণ্যের অন্ধকারে জ্বলতে থাকা নক্ষত্র, শীতল অথচ ধ্বং'সাত্মক। মুহূর্তেই বুকের গভীরে বাজ পড়ার মতো ধাক্কা খেলো সেই ব্যক্তি।
আতঙ্কের তাড়নায় ছায়ামূর্তি ক্রমশ কুয়াশার আবরণে দৌড়ে পালিয়ে মিশে গেল, তার পদক্ষেপে অনিশ্চিত দৌড়, যেন ভূতুড়ে সময়ের করাল ছায়া তাকে তাড়া করছে।
শান্ত অচঞ্চল। তার ঠোঁটের হাসি আরও গভীর হলো। সে হাতের পেছনে দিয়ে নাক ঘষল, যেন সমস্ত ঘটনাটিই এক তুচ্ছ নাটকের অংশ। প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল বাইকের কাছে। চোখে বা ভঙ্গিমায় কোনো উৎকণ্ঠা নেই, বরং নির্ভীকতা। যেন এই দৃশ্য, এই মুহূর্ত, এবং এই সত্তা সবই তার পূর্বপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণের ফল।
বাইকে হাত রেখে সে থেমে দাঁড়াল, আর তুষারঘেরা পরিবেশে এক অনুচ্চারিত সংকেত ছড়িয়ে দিল, তার নীরবতা আসন্ন প্রলয়ের পূর্বাভাস।
শান্ত বাইকের উপর বসতেই তার চোয়াল কঠিন গ্রানাইটের মতো দৃঢ় হয়ে উঠল। এক মুহূর্তের জন্যও সময় নষ্ট না করে বাইক গ'র্জে উঠল, শীতল পরিবেশ ভেদ করে যেন বিদ্রোহী বজ্রের আর্তনাদ শোনা গেল। ইঞ্জিনের র'ক্তক্ষরণসম গর্জনে সে ফুল স্পিডে ছুটে চলল। তার চোখে শিকারির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সামনে কুয়াশার অন্তরালে ছুটে চলা সেই আতঙ্কগ্রস্ত ছায়ামূর্তি।
লোকটি মরিয়া হয়ে দৌড়াচ্ছে, পায়ের পেশি যেন তার ভাঙনের সুর তুলছে। কিন্তু মানবশরীরের সীমাবদ্ধতা মেশিনের গতির কাছে কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে? এক চক্ষু নিমেষে শান্ত বাইক নিয়ে লোকটির পাশ দিয়ে চলল। সেই ভয়ানক ঠান্ডা, ব্যঙ্গাত্মক হাসি আবারও ফুটে উঠল তার মুখে। যেন সে মৃ'ত্যুর দূত, শিকারকে উপভোগ করছে।
শান্ত মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে, গভীর কণ্ঠে বলল,
——— "আরেকটু জোরে দৌড়া!"
তার কথাগুলো শীতল হাওয়ার ধারালো ছু'রির মতো লোকটির শরীর চিরে গেল। দৌড়ের ছন্দে ভয়ের কম্পন, শ্বাসকষ্টের করুণ সুর। চারপাশে শূন্যতা, আর কেবল শান্তর উপস্থিতি যেন নিয়তি হয়ে তাকে তাড়া করছে।
শান্তর দেহভঙ্গি পাথুরে নির্লিপ্ত, অথচ স'র্বনাশা। এক হাতে বাইকের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেই অপর হাতে গ্রাস করল লোকটির কলার। দমকা হাওয়ার বিপরীতে চলন্ত বাইক হঠাৎ যেন শিকারি পাখির মতো আক্রমণে উন্মত্ত হলো। এক চরম ঝাঁকিতে লোকটি নিজের ভারসাম্য হারিয়ে বাইক থেকে সজোরে আছড়ে পড়ল পিচঢালা রাস্তায়।
ফুল স্পিডে বাইকের চলার গতি অব্যাহত থাকল, আর তার পেছনে ধূলি-ধূসরিত শীতের রাস্তায় টেনে নিয়ে চলল লোকটির নির্জীবদেহ। হাত-পা র'ক্তা'ক্ত হতে শুরু করল, রাস্তার ধারালো পাথর আর শীতের নির্মম পীড়নে চামড়ার আবরণ ছিঁড়ে গিয়ে জ্বলন্ত আগুনের মতো তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে দিল। লোকটির করুণ চিৎকার কুয়াশার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, যেন মৃ'ত'প্রায় প্রাণীর শেষ আর্তনাদ।
শান্তের চোখ, দাহ্য কূপের লাল শিখা। তার চোয়াল পাথরের মতো শক্ত, মুখে অনমনীয় দৃঢ়তা। বাইকের গর্জন আর শিকারীর আর্তনাদ মিলে এক অতিপ্রাকৃত সুর সৃষ্টি করল, যা শীতার্ত পরিবেশকে আরও ভয়াবহ করে তুলল।
এত নির্জনতার মাঝেও শান্ত থামল না। সে লোকটিকে র'ক্তাক্ত অবস্থায় টেনে নিয়ে বাইকসহ আরও দূরে চলে গেল, যেখানে কুয়াশা আরও ঘনীভূত, আর নীরবতা মৃ'ত্যুর পদধ্বনি। অন্ধকারে গড়িয়ে পড়া নিয়তির প্রতিচ্ছবি, যেখানে প্রতিশোধের আগুন নির্বিকারভাবে জ্বলছে।
শান্ত বাইক থামাল একেবারে নির্জন, শুনশান প্রান্তরে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার বিশ্বস্ত অনুচরেরা, নিরব সাক্ষী হয়ে অপেক্ষা করছিল আসন্ন পৈ'শাচিক নাটকের। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পরিত্যক্ত, ভগ্নপ্রায় বাড়ি, যার প্রতিটি ইট অতীতের অ'ভিশাপ ধারণ করে, জায়গাটিকে আরও ভৌতিক করে তুলল। বাতাসে এমন নিঃসঙ্গতা, যেখানে জীবজন্তুর পদধ্বনি তো দূরের কথা, নিশ্বাসের শব্দও জাগতিক কোলাহলের মতো শোনায়।
শান্ত লোকটিকে মাটিতে আছড়ে ফেলল। তার শরীর ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ল রুক্ষ মাটির ওপর। পেছনের কুয়াশায় ঘোলা সূর্যের আলোয় লোকটির দুর্দশা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল। শান্ত ধীরে বাইক থেকে নেমে কঠোর হাতে বাইকটিকে একপাশে ছুঁড়ে ফেলল, সমস্ত র'ক্তগরম ক্রোধ ওই যন্ত্রের ওপর আছড়ে পড়ল।
চোখে জ্বলন্ত শিখার মতো ক্রোধ, মুখে অগ্নিদগ্ধ নীরবতা। হাঁটু গেড়ে বসে লোকটির চাদর টেনে ছুরে ফেলে কলার চেপে ধরে সে মুখোমুখি হলো। কণ্ঠ গভীর অরণ্যের গর্জন, প্রতিটি শব্দে বয়ে আনল ভরকেন্দ্রহীন ভয়,
——— “আমার মা'কে মা'র'বি? তোর কলিজায় এত সাহস? হ্যাঁ? দেখি, দেখি, তোর কলিজা কত বড়!”
শান্ত হঠাৎ এক ভয়ানক হাসি ছড়িয়ে দিল, এক ধরনের শীতল অথচ মরণঘাতী ব্যঙ্গ, যা হিমায়িত বাতাসকেও ছিন্নভিন্ন করতে পারে। লোকটি আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে কথা জড়ালো,
——— “আ-আমি কিছু করি নাই। আমাকে ছেড়ে দিন! এসবের কিছুই আমি জানি না!”
শান্ত তখন আরও উচ্চস্বরে হেসে উঠল, হাসির প্রতিধ্বনি এই প্রান্তরের প্রতিটি ছায়ায় ছড়িয়ে পড়ল। হাসি থামিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। লোকটির দিকে অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে বলল,
——— “তুই নাটক করছিস আমার সামনে? মিথ্যা বলছিস আমাকে? ভেবেছিস আমি বুঝি তোর চালাকি ধরতে পারব না?”
ধীর, নীরব পদক্ষেপে শান্ত এগিয়ে গেল। তার চোয়াল দৃঢ়, চোখে লাল আগুনের মত এক দহন। পায়ের গোড়ালির কাছে বাঁধা ছুরির হাতল, প্যান্টের নিচের অংশ সামান্য উপরে তুলে বের করল এক ভয়ঙ্কর ধারালো ছু'রি। সেই ছু'রির ব্লে'ড শীতের আলোয় চকচক করল, মৃ'ত্যুর আগাম ঘোর নিয়ে।
লোকটি মুহূর্তে আতঙ্কে থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করল। শীত আর ভয় মিলে তার শরীরকে জড়োসড়ো করে তুলেছে। তার মুখ দিয়ে বেরোল করুণ আর্তনাদ।
শান্ত মুখে এক নি'র্মম হাসি ফুটিয়ে বলল না একটিও কথা। আচমকাই, ধূমকেতুর মতো আচরণে ছু'রি'টি সোজা লোকটির নাকের ভেতরে প্রবেশ করাল। টান দিয়ে ছিঁ'ড়ে নাকের অগ্রভাগ মুহূর্তে ছি'ন্ন'ভি'ন্ন হয়ে গেল। লোকটির আর্তনাদ কুয়াশার ভেতর হিমশীতল বুলেটের মতো ছড়িয়ে পড়ল।
তবে শান্ত থামল না। ছু'রির তীক্ষ্ণ ফল এবার তার মুখের ভেতরে গভীরে প্রবেশ করাল। মুখের ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ টা'নে গাল ছিঁ'ড়ে ছু'রি বের করল, র'ক্তে'র স্রোত ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। শান্তর মুখে ছিটকে পড়া উষ্ণ র'ক্ত তার শীতল দেহে এক অদ্ভুত উন্মাদ আনন্দ এনে দিল।
তারপর চোখ। সে অতি যত্নে লোকটির ডান চোখে ছু'রি বসাল। ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে মণিটিকে ছু'রির ফলায় ধরে টেনে বের করল। লোকটির কণ্ঠ থেকে ভেসে আসা হাহাকার মৃ'ত্যুর শেষ সুর হয়ে প্রতিধ্বনিত হলো। র'ক্তা'ক্ত ছু'রি'টি এবার বুকের ওপর তুলে ধরল শান্ত। একের পর এক প্রচণ্ড আ'ঘা'তে বুকের প্রতিটি পেশি ছি'ন্ন করে কু'পি'য়ে র'ক্তের বন্যা বইয়ে দিল। লোকটি ধীরে ধীরে নিশ্চল হয়ে গেল, তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে মিলিয়ে গেল শূন্যতায়।
শান্ত এবার ছু'রির র'ক্ত'মাখা ফলাকে দেখে হাসল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল নি'র্মম তৃপ্তির হাসি। মাটি র'ক্তে ভিজে লাল হয়ে উঠল, আর শান্ত মৃদু কণ্ঠে, শাসনে বলল,
——— "আমার পরিবারকে ছোঁয়া মানে মৃ'ত্যু। ছোঁয়া তো দূরের কথা, আমার পরিবারের কথা ভাবার সাহস করলেই সেটার মূল্য চুকাতে হবে প্রা'ণ দিয়ে।"
এই ঠান্ডা শীতলতা পৃথিবীকে গভীর নীরবতার এক চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র কুয়াশায় মোড়া এই নির্জন প্রান্তরে একমাত্র সাক্ষী হয়ে রইল নিথর দেহটি। লোকটির চিৎকার বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেছে, এ স্থান কোনও শব্দকেও ধারণ করতে অক্ষম। জীবন ও মৃ'ত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা এই মুহূর্তে চারপাশের প্রকৃতি মৃ'ত্যুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরব হয়ে গেছে।
শান্ত ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী, তবুও অদ্ভুত নিয়ন্ত্রণে বন্দী। চোখের ভেতরে ভীষণ দহন, মুখের রেখায় অব্যক্ত প্রতিশোধের ছাপ। তার পাশে থাকা লোকেরা দ্রুত এগিয়ে এসে এক বোতল পানি এগিয়ে দিল। কিন্তু শান্তর ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার দীর্ঘ লং কোটটি এক ঝটকায় খুলে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল। শীতল বাতাস তার চামড়ায় শেলের মতো বিঁধছে, কিন্তু তার চোখের তেজ তাতেই উত্তপ্ত হয়ে আছে।
একটি বড় বোতল হাতে তুলে নিল শান্ত। ঠান্ডা পানির ধারায় হাত পা ধুতে শুরু করল। পানি এতটাই হিমশীতল যে তার স্পর্শে চামড়া যেন জমে যাচ্ছে, কিন্তু শান্তর চোখে কোনও ভয় নেই, কোনও কাঁপুনি নেই। সেই পানির প্রতিটি ফোঁটা, র'ক্তমাখা শরীর ধুয়ে মাটিতে গলে পড়ল, প্রতিটি ফোঁটায় বয়ে গেলো অপূর্ণ প্রতিশোধের গল্প।
এ যেন এক শিকারি, যিনি তার কাজ সম্পূর্ণ করে নতুন শিকারের জন্য প্রস্তুত।
কুয়াশার অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা এক ব্যক্তি, লোকটির পুরো দেহ শীত আর ভয়ের এক নিদারুণ শিহরণে আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। ঝোপের আড়াল থেকে তার কাঁপতে থাকা হাত ফোনটি ধরে রেখেছে, যার পর্দায় রেকর্ড হচ্ছে ভয়াল অধ্যায়। এমন দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে তার আত্মা দগ্ধ হচ্ছে আতঙ্কে। হাতের তালু দিয়ে মুখ চেপে রেখেছে, যেন একটুও শব্দ বেরিয়ে না আসে। তার হৃদস্পন্দন এত জোরে বেজে উঠেছে যে মনে হচ্ছে, সেই শব্দও যদি শুনে ফেলে!
সামনের বিভীষিকাময় কাণ্ড দেখে তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে, যদিও শীতের ঠান্ডা বাতাস তার গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। লোকটি বুঝতে পারছে, এই মুহূর্তে তার অস্তিত্ব শুধু একটি সূক্ষ্ম ভুলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। একটু নড়াচড়া, সামান্য ফিসফাস, যেকোনো কিছু তার জীবনকে শেষ করে দিতে পারে। শান্ত আর তার লোকজন যদি টের পেয়ে যায়, তবে ঝোপে লুকিয়ে থাকা এই ব্যক্তি মুহূর্তের মধ্যে র'ক্তা'ক্ত মাটির আরেকটি অংশ হয়ে যাবে।
অত:পর ভিডিও সেভ করে, ফোনটি মৃদু হাতে পকেটের গভীরে গুঁজে রাখল, যেন তা আর একটুও শব্দ না করে। মাথায় একটাই ভাবনা, যেভাবেই হোক, এই প্রমাণ তাকে সিআইডির হাতে পৌঁছাতে হবে। এই ভিডিও সত্যের সাক্ষী। এখন ভাবছে, এখান থেকে বের হওয়ার পর প্রথমেই মায়ের কোলে গিয়ে নিজেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে।
জীবনের শেষ মুহূর্ত যে এত দ্রুত আর নিঃসাড়ে এসে হাজির হবে, তা লোকটি কল্পনাও করেনি। চুপিসারে এগোতে গিয়েও আর এক পা ফেলার সুযোগ পেল না। পেছনে ঘুরতেই শীতল বাতাস বিদীর্ণ করে আসা এক বুলেট তীক্ষ্ণভাবে তার মস্তিষ্ক ভেদ করে পার হয়ে গেল। কোনো শব্দ নেই, কোনো সতর্কতা নেই, শুধু মৃ'ত্যুর অমোঘ উপস্থিতি। সে বুঝতে চাইল, কী ঘটল, কিন্তু সময় তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। চোখের পলকে প্রাণপাখি উড়ে গেল অজানা গন্তব্যে।
শরীরটা ভারী ধাতব বস্তুর মতো ছিটকে পড়ে গেল বরফ-ঠান্ডা মাটিতে। র'ক্ত গড়িয়ে এক গভীর, গাঢ় লাল রঙে রাস্তাকে চিত্রিত করতে থাকল। তার ঠোঁট থেকে শেষ নিঃশ্বাসটুকুও বেরোনোর আগেই সব কিছু শেষ হয়ে গেল।
কিছু পরে যাওয়ার শব্দ পেয়ে শান্ত মুহূর্তেই সতর্ক হয়ে উঠল, তার লোকদেরও চটজলদি বন্দুক বের করে নিতে দেরি হলো না।
নাঈম দাঁড়িয়ে অদ্ভুত নির্বিকার ভঙ্গিতে। তার মুখে কোনো অনুভূতি নেই, সে এই মৃ'ত্যুকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না। তার হাতে ধরা আধুনিক সাইলেন্সারপ্রুফ পিস্তল, যার মা'রণক্ষমতা যেমন নিখুঁত, তেমনই শব্দহীন। বুলেট ছুটে গেলেও কোনো আওয়াজ হয়নি, বাতাসে একটি পাতাও নড়ল না।
নাঈম ধীর, আত্মবিশ্বাসী হাতে পিস্তলটিকে ঘুরিয়ে পরীক্ষা করল। তার চোখে ভয় নেই, অনুশোচনা নেই, কেবলই শীতল অস্বীকার। তারপর এক স্বাভাবিক গতিতে অস্ত্রটি কোমরের পেছনে গুঁজে রাখল, ঠিক যেন কিছুই ঘটেনি। তার সামনে পড়ে থাকা নিথর দেহটি কেবলই নিছক কীটপতঙ্গ! অত:পর লোকটির মৃত দেহের পাশে হাটু গেড়ে বসে। নিস্তব্ধতার মধ্যে, কোনো আগ্রহ নেই, তার মুদ্রিত হাত সোজা চলে গেল লোকটির প্যান্টের পকেটে। ছিনতাইয়ের মতো নিখুঁত দক্ষতায় ফোনটি বের করে আনল। চোখে তার খু'নের পরিণতির প্রতি কোনো ভাবনা নেই, শুধু মুখে এক শীতল হাসি ফুটে উঠল, এটা যেন তার কাজের অংশ, কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
নাঈমকে দেখে শান্তের লোকেরা কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে রইল, কোনো শব্দ হয়নি। শান্ত, ধীরে ধীরে মুখে পানি ঢালতে থাকল। তার চোখের কোণে কোনো দুঃখ, ক্রো'ধ অথবা আবেগের ছায়া দেখা গেল না, যেন সবকিছু তার কাছে অতীত হয়ে গেছে। শান্ত কোনো প্রশ্নের প্রয়োজন মনে করল না, কারণ পুরো দৃশ্যটি তার পরিকল্পনার অঙ্গ ছিল।
একটা নিঃশ্বাস ফেলেই, নাঈম উঠে দাঁড়াল। লোকটির নিথর দেহ, বুকের ওপর দিয়ে স্বাভাবিক গতিতে পা ফেলল। অদৃশ্য পাথরের মতো শান্তর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল, কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই।
শান্তকে লক্ষ করে, কন্ঠে মৃদু, কিন্তু দৃঢ় শব্দে বলল,
——— "গাধার মতো, দিন দুপুরে খোলা মেলা জায়গায় খু'ন করছিস! ওদিকে যে কেউ ভিডিও করে পালাচ্ছিল, সে দিকে নজর আছে??"
শান্তর চোখের কোণে চিহ্নিত তীব্র গ্লানির ঝলক রেখে, নিঃশব্দে নাঈমের দিকে এক পলক তাকাল। তার পর যেন কোনো কথার প্রয়োজন নেই, বরং সে আরেকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে ঠান্ডা গলায় বলল,
——— "আরে ধুর! পালাচ্ছে! পালাক! কতদূর আর যেতে পারবে?"
কথার মধ্যে অপার অবিশ্বাস, একটি তীব্র অবজ্ঞা, এরা কিছুই করতে পারবে না। নাঈম ফোস করে শ্বাস ছাড়ল! পরবর্তীতে নাঈম নির্দেশে লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে আরও কিছু বলল,
——— "লা'শ দুটি নদীতে ফেলে দিয়ে আসো! হদিস যেন কেও না পায়!"
শান্ত তার দিকে অজ্ঞাত এক হাসি উপহার দিল। তবে, সেই হাসির মধ্যে যেন ছিল একটা অশুভ নিশ্চয়তা এক অদৃশ্য কিন্তু ভয়ঙ্কর বোধ। তারপর নিঃশব্দে, যেন এক রক্তাক্ত চুক্তির অঙ্গীকার, শান্ত বলল,
——— "বাকি লা'শগুলো এভাবে নদীতে ফেললে, কোনো কেসই হতো না! আর আমার মা ও ধরা পড়তো না! আর আজ এই অবস্থাও হতো না!"
__________________________
সন্ধ্যা সপ্তপ্রহর। সিয়াইডি দপ্তরের রহস্যময় অন্ধকারে নিমজ্জিত, মুগ্ধ গভীর মনোযোগে ডুবে রয়েছে সিসিটিভি ফুটেজের অক্ষরযাত্রায়। চঞ্চল চোখের মণিদ্বয় প্রতিটি মুহূর্তে চিত্রিত দৃশ্যাবলির অন্তর্গত ইঙ্গিত অনুধাবনে নিবিষ্ট। হঠাৎ কর্কশ, অসভ্য ফোনের রিংটোন ভেদ করে নীরবতার শৃঙ্খল ছিন্ন করল। বিরক্ত ভঙ্গিতে মুগ্ধ ফোনটি হাতে তুলে নিল। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে পরিচিত নাম, রোহান।
মুগ্ধের কপালে ভাঁজ পড়ল।
——— "এ সময় রোহান ফোন করছে কেন?"
মনের গহীনে ত্রস্ত প্রশ্ন উদয় হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দ্বিধাভরিত আঙুলে রিসিভ বাটনে চাপ দিল সে। ওপার থেকে উচ্ছ্বল অথচ খানিক ব্যঙ্গাত্মক সুরে রোহানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
——— "টুকি মধু! হাও ডু ইউ ডু?"
মুগ্ধ দন্তমঞ্জরীর কঠোর সংযমে কণ্ঠস্বরকে ধারালো করল,
——— "ফোন করেছিস কেন?"
ওপাশ থেকে রোহানের উৎফুল্ল কণ্ঠের সুরেলা তীক্ষ্ণতা ভেসে এলো,
——— " কয়েকজনের নামে কেস করতে!"
মুগ্ধ যেন উন্মত্ত র'ক্তের চাপে চোয়াল সংযত রাখতে ব্যর্থ হলো। দন্তপঙ্ক্তি দৃঢ়করে বলে উঠল,
——— "চ'রিয়ে দাত উপড়ে ফেলব! কেস করতে হলে পুলিশ স্টেশনে যা! আমাকে ফোন করছিস কেন?"
রোহান হাস্যোদ্দীপ কণ্ঠে বায়বীয় বাতাসে ভাসতে ভাসতে প্রতিউত্তর দিল,
——— "এহহহ! আমার বন্ধু সিআইডি, আর আমি কিনা নিজে গিয়ে পুলিশ স্টেশনে ভীড় করব? না, কখনও না! তুই আগে আমার কথা শুন।"
মুগ্ধ বিরক্তি আর সহ্যের শেষ সীমায় বলল,
——— "যা বলবি, বল দ্রুত। সময় অপচয় করিস না।"
রোহান এবার নাটকীয় সুরে বলল,
——— "অনেক অপরাধীকে ধরতে হবে তোকে! বুঝতে পারছিস? একসঙ্গে অনেকগুলা!"
মুগ্ধ ধৈর্যের সমস্ত রাশ খুলে ফেলে দৃপ্ত কণ্ঠে গর্জে উঠল,
——— "বলবি কি না? নাহলে এই মুহূর্তে ফোন রেখে দিচ্ছি!"
রোহানের কণ্ঠ এবার কৌতুকের সীমা ছাড়িয়ে সঙ্গীতময় অনুনয়ে পর্যবসিত হলো,
——— "আররে আররে না না! ফোন কেটে দিস না, বন্ধু হুইহিহি!"
মুগ্ধের অন্তর্দাহ তখন এমন উচ্চমার্গে পৌঁছেছে যে, ফোনের ভেতর ঢুকে রোহানের বেহায়াপনা থামানোর ইচ্ছে হয়। কিন্তু বাস্তবতা কেবল তার ধৈর্যের পরিহাস করে। অবশেষে, ক্রোধে দগ্ধ হয়ে, ধাম করে ফোন কেটে দিল।
সিসিটিভি ফুটেজের স্তূপে নিমজ্জিত কর্মচাঞ্চল্যে অনধিকার প্রবেশ মুগ্ধের সহিষ্ণুতার সীমারেখা বারংবার অতিক্রম করল। এই প্রহসন অসহনীয়! কাজের মধ্যগগনে এমন ব্যাঘাত যেন গভীর শাপে পরিণত।
ফের কর্কশ, কর্কটাক্রান্ত শব্দে ফোনের রিংটোন মুগ্ধের ধৈর্যের শেষ বাঁধ ভাঙল। স্ক্রিনে পুনরায় রোহানের নাম দেখে মুগ্ধের শিরদাঁড়ার প্রতিটি স্নায়ু আরও টানটান হলো। কিন্তু ভেতরের ক্রো'ধকে সংবরণ করে ফোনটি রিসিভ করল। ওপার থেকে রোহান এবার এক নাটুকে গাম্ভীর্যের আবরণে কণ্ঠস্বর জড়িত করল,
——— "খুব মারাত্মক কেস! শোন আগে। সবার বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে! এদের জেলে ঢোকাতে হবে।"
মুগ্ধ দীর্ঘশ্বাসের দীর্ঘতর নিঃশ্বাস ছাড়ল, প্রত্যাশিত দুঃস্বপ্ন আর একবার বাস্তবের রূপ নিচ্ছে। সে জানে, রোহানের 'মারাত্মক কেস' মানেই উদ্ভট কোনো পরিস্থিতি, যার সমাধান নয়, বরং হেস্তনেস্ত করাই প্রধান উদ্দেশ্য। কিছু না বলে চুপ করে অপেক্ষা করল,"এই উন্মাদ তার প্রলাপ শেষ করুক, তবেই কাজ করা সম্ভব হবে।"
রোহান এবার গম্ভীর স্বরের নিচে চাপা মনখারাপের সুর এনে শুরু করল,
——— "দেখ মধু, আমি সত্যিই বিপদে আছি। একটা ফেসবুক পেজ খুলেছি, কিন্তু... একটিও ফলোয়ার নাই! একটিও লাইক নাই! আমার সাধের পেজ! বুঝতে পারছিস?"
মুগ্ধ এবার ভ্রূকুঞ্চিত করে বলল,
——— "তুই আমাকে এই পাগলামির জন্য ফোন দিয়েছিস?"
রোহান তড়িৎ প্রতিবাদ জানাল,
——— "না না, তুই আসল কথা শুন আগে! এতো অধৈর্য কেন হোস, শা'লা! শোন... পেজে আমি শায়েরি-কবিতা দিই, আর সেখানে কমেন্ট বক্সে শুরু হয় মহাপ্রলয়ের নৃত্য।"
তারপরে একের পর এক দলের উদ্ভট কার্যকলাপ রোহান এক নিশ্বাসে বলে গেল,
——— "প্রথম দল বলে, কেউ অনলাইনে জব করবেন?
দ্বিতীয় দল বলে, কেউ প্রেম করবেন?
তৃতীয় দল বলে, কেউ বন্ধু হবেন?
চতুর্থ দল বলে, পাশে থাকলে পাশে পাবেন!
পঞ্চম দল বলে, ভিডিও কলে কাজ করবেন?
ষষ্ঠ দল বলে, আল্লাহর নাম লাইক হবে?"
শেষ কথাটি বলেই রোহান যেন ধপ করে থেমে গেল। তারপর ভারী স্বরে বলল,
—— "এগুলো কী, ভাই? বল তুই! এ আমি সহ্য করি কেমনে?"
মুগ্ধের ধৈর্য এবার আর স্রোতের মতো বয়ে গেল না। ঠান্ডা অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
—— "তুই আমাকে এইসব কুযুক্তি শুনানোর জন্য কাজের মধ্যখানে বারবার বিরক্ত করছিস?"
অত:পর মুগ্ধ বিমূঢ়! কানে যেন আর্তনাদ ধ্বনিত হলো,"একি শ্রবণযোগ্য, নাকি প্রহেলিকাময় দুঃস্বপ্ন?" মনোযোগের কেন্দ্রে এমন উদ্ভট অনুপ্রবেশ তাকে বাকরুদ্ধ করল। নিজের মস্তিষ্কে ধূসর চিন্তাস্রোতের মধ্যে দিয়ে একটাই প্রতিধ্বনি হলো,"আল্লাহ, এ কি পা'গ'ল ছাগলের প্রলাপ!"
তার নির্লিপ্ততায় এতটুকু ফাটল ধরাতে এইসব অকথ্য কথার ভার যথেষ্ট ছিল। মুগ্ধর মস্তিষ্কে ক্রো'ধের দাবানল প্রজ্বলিত হয়ে উঠল, যেন মাথা দিয়ে ধোঁয়া নির্গত হবে। চেয়ারের স্থিতি ত্যাগ করে হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে উঠল সে, রাগে আ'গুনের শিখায় রূপান্তরিত।
তারপরই রোহানের কণ্ঠস্বর করুণ নাটকের মোড়কে আরও উচ্চকিত হলো, জীবনের সমস্ত হতাশা নিয়ে সে পৃথিবীর অবিচার বর্ণনা করছে,
——— "বন্ধু, আমার পেজের কমেন্ট বক্সটা দেখলেই মনে হয় যেন জব ইন্টারভিউয়ের মেলা বসেছে। ইমু ব্যবসায়ীদের বংশধররা এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানিস, কোন গাধার বাচ্চা এই ধরনের কীর্তি ঘটাচ্ছে? কেউ এসে আল্লাহর নামে লাইক চাইছে! এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে না, অথচ আল্লাহর নামে লাইক চায়! বুঝতে পারছিস, এই পাপিষ্ঠদের পরিমাণ কত ভয়াবহ?"
মুগ্ধ চোখ বন্ধ করল, নিজেকে সংযত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাল, কিন্তু রোহান থামার পাত্র নয়। সে আরও উচ্চকিত হলো, এক অনন্ত হতাশার সুরে বলল,
—— "আর সেই ‘পাশে থাকলে পাশে পাবেন’ দল! এটা কি রকম পাশের বিষয়? ধর আমি যদি মু'ততে যাই আর ওরা যদি সেখানে পাশে না থাকে, তাহলে কিসের পাশে থাকা হলো? তুই বল, বন্ধু! এমন ছাগলদের আমি সহ্য করি কেমন করে?"
শেষে, যেন তার সমস্ত কল্পিত অ'ত্যাচারের প্রতিকার মুগ্ধকেই করতে হবে, রোহান করুণ অথচ নাটকীয়তার চূড়ান্ত সুরে বলে উঠল,
——— "তুই আমার হয়ে এই পা'গলগুলোর পা'ছা'য় র'ড দিয়ে বারি মা'রবি। সবগুলোর আইডি, নাম আছে! ওদের জেলে ঢোকা উচিত, বন্ধুউউউ!"
মুগ্ধর মুখ ফুটে একটি কথাও বের হলো না। মনে মনে বলল,
——— "পৃথিবীর সব পাগল বোধহয় আমার কাঁধেই এসে ভর করেছে।"
ফোনের অপর প্রান্তে রোহানের কর্কশ কথার স্রোত হঠাৎ থেমে গেল। খট করে ফোন কেটে দেওয়ার শব্দ রোহানের কানে বিদ্ধ হলো। স্থির, নীরব মুহূর্তে এক গভীর দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ হল ঘরে। মুগ্ধ চেয়ারে ফিরে বসল, ভ্রূকুঞ্চন যেন তার কপালে দুঃশ্চিন্তার ছায়া আঁকছে। কিন্তু খানিক বাদেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
——— "হ্যাঁ, পা'গল বন্ধুই তো!"
তবু, এমন পা'গলামি নি'কৃষ্ট ও স্বার্থপর এই পৃথিবীর প্রতারণাপূর্ণ মানবের চেয়ে বহুগুণে সহনীয়। এই নি'র্বোধ কথাগুলোতেও একধরনের নির্দোষতা লুকিয়ে থাকে, যা রোহানকে আলাদা করে তোলে। গভীরভাবে চিন্তা না করে, মুগ্ধ হাসতেই লাগল। সেই হাসির রেশ ধরে পুনরায় কাজে মনোনিবেশ করল।
তবে রোহানের ফোনের আসল উদ্দেশ্য মুগ্ধ জানল না। রোহান আসলে ফোন করেছিল তাকে গতকালের ঘটনাটি জানাতে, যে আঁখির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। কিন্তু কী বলবে? কীভাবে ব্যাখ্যা করবে যে তার বউ তার পকেট হালকা করে রোহানকে ভাপা পিঠে আর চিতই পিঠে দিয়ে গিয়েছে?
পুচকি মাইয়া! যে বয়সে এখনো নাক টিপলে দুধ বের হয়, সেই তাকে এমন জ্ঞান দিয়ে গেছে যেন রোহানের মতো দামরা লোককে বলেছে যে কেও ডাকলে না যেতে! এটা কেমন অবান্তর কথা? এটাকি অপমান নয়? হুহ! রোহান চেয়েছিল তা বলতে, কিন্তু ঠোঁট কামড়ে চুপ করে গেল।
——— "পরে একদিন বলব।"
সে ভাবল, যেদিন মুগ্ধ নিজেও এমন করে তার বউ হাতে অপমানিত হবে, সেদিন তাকে এই গল্প শুনিয়ে হাসাবে। তাছাড়া, মুগ্ধ যদি জানে যে আঁখির টাকা খসিয়েছে, তবে মুগ্ধ রোহানকে নিশ্চিত পে'টাবে।
তাইতো প্রহসনের আড়ালে সেই রসবোধ লুকিয়ে রাখল, যা বন্ধুত্বের চিরায়ত রূপ। আঁখি কে তার চিনা হয়েছে! সে জানে, মুগ্ধের সঙ্গে এই গল্প বলার দিন আসবেই। ততদিন সে শুধু স্মৃতির হাস্যরস জমিয়ে রাখল।
——— "বন্ধু আর পাগল কখনোই আলাদা নয়,"
রোহান মনে মনে বলল।
____________________
শীতলতম রাত্রির অন্ধকারে, শীতের দহনময় কনকনে বাতাসের সঙ্গী হয়ে, সাজ্জাদ সাহেব গম্ভীর গদ্যে নিজের চেয়ারে স্থিত। মোশারফ সাহেবকে তিনি বাড়িতে প্রেরণ করেছেন পূর্বেই, আর নিজে রয়ে গেছেন তথাকথিত কর্তব্যের অজুহাতে। অথচ কাজের নামেই বা কতটুকু প্রবাহ! মনের গহীনে অস্থিরতার নিঃশব্দ উথালপাথাল, যা তার মুখাবয়বকে কঠোরতা ও তীক্ষ্ণতায় আবদ্ধ করে তুলেছে।
দৃষ্টি তার বারংবার দরজার পানে ধাবিত হচ্ছে, সম্ভাবনার এক অদৃশ্য আবেশে। তীক্ষ্ণ রাগের রেখা তার মুখাবয়বে খোদিত, কিন্তু প্রখর আত্মসংযমে তা রুদ্ধ। প্রাচীরঘড়ির কাঁটাগুলি কেবলমাত্র সময় নয়, প্রতীক্ষার দীর্ঘশ্বাসও মাপছিল। রাত্রি তখন ৮:৩০ মিনিট পেরিয়ে গেছে।
হঠাৎ করেই, এক অদ্ভুত দুর্বোধ্য ধ্বনি মৃদু কড়ানাকাড়িতে দরজার প্রতীক্ষা ভঙ্গ করল। দরজা ঠেলে প্রবেশ করল অতি আশ্চর্য কালো মূর্তি। মাথা টাক, অন্ধকারের গাঢ় কৌতূহল নিয়ে উদ্ভাসিত। তার পরিধান, মোটা খয়েরি জ্যাকেট, উপস্থিতির রহস্যকে আরো নিবিড় ও অস্পষ্ট করে তুলল। সঙ্গত বললে, তার অবয়ব চোরের কু'ৎসিত ছায়া ভেদ করেও কেমন যেন অস্বস্তিকর শূন্যতার প্রতীক।
সাজ্জাদ সাহেব স্থির, কিন্তু দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত পাখির মতো শিকারীর অপেক্ষার গভীরতা। এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতায়, সময় নিজেই নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে।
সাজ্জাদ সাহেব ক্রোধের অনল নিয়ে বজ্রকণ্ঠে বললেন,
——— "দেরি কেন?"
সম্মুখে দাঁড়ানো কালো জ্যাকেটের লোকটি লজ্জানত স্বরে ফিসফিসিয়ে উত্তর করল,
——— "সরি স্যার!"
সাজ্জাদ সাহেব ভ্রু কুঞ্চিত করে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলেন। তার কণ্ঠে কর্তৃত্বের অদমনীয় দৃঢ়তা ঝরে পড়ল,
——— "যা বলেছি, তা মনে আছে তো?"
লোকটি মাথা নুইয়ে তৎক্ষণাৎ জবাব দিল,
——— "এক্কেবারে পাকা মনে আছে! সব ব্যবস্থা সম্পন্ন, লোকগুলোও প্রস্তুত। এখন শুধু মধ্যরাতের প্রতীক্ষা। তবে, স্যার..."
সাজ্জাদ সাহেব তার ভারী চশমাটি ঠেলে চোখের দৃষ্টি শাণিত করলেন। কণ্ঠস্বর গম্ভীর পাহাড়ি ঝর্ণার মতো গর্জে উঠল,
——— "তবে কী?"
লোকটি খানিক জড়সড় হয়ে আমতা আমতা করতে লাগল,
——— " মুগ্ধ স্যার যদি জানতে পারেন...?"
সাজ্জাদ সাহেবের ঠোঁটের কোণে তির্যক এক হাসির ছায়া ফুটে উঠল। ঠান্ডা অথচ তীক্ষ্ণ গলায় তিনি বললেন,
——— "ওকে জানাবে কে?"
লোকটি নড়বড়ে স্বরে প্রতিবাদ করল,
———" না, তাও ঠিক! তবে... উনি তো আপনারই ভাতিজা! তার উপর সিআইডি কর্মকর্তা। তার ইনফর্মারকেই এভাবে শেষ করার পরিকল্পনা করছেন...!"
সাজ্জাদ সাহেব দন্তাবলিতে ক্রোধ চেপে থেমে থেমে বললেন,
———" এসব তোর ভাবনার বিষয় নয়! তুই তোর নির্দেশ পালন কর। প্রতিদিনের মতো আজও জীবন মধ্যরাতে কাজ সমাপ্ত করে বাড়ি ফিরবে। আর সেই পথেই তাকে নিঃশব্দে সরিয়ে দে। দেহটিকে এমনভাবে গুম করবি, যেন পৃথিবীও তার অস্তিত্ব ভুলে যায়।
লোকটি নিঃশব্দে মাথা নাড়ল, কিন্তু তার চোখের কোণে এক অদ্ভুত ভীতির আভাস খেলা করল। সাজ্জাদ সাহেব তার চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, শ'য়তানের প্রতিমূর্তি নিজেই নিজের পরিকল্পনার নীরব প্রশংসা করছে।
লোকটি মাথা নত করেই বলল,
——— "এই মুরাদ কোনোদিনই পরাজিত হয়ে ফেরেনি, স্যার। আজকের রাত্রিই সেই জীবন নামধারী মানুষটির জীবনের অন্তিম অধ্যায় হবে।"
সাজ্জাদ সাহেবের চোখে রাগের আগুন আরও তীব্র হলো। গভীর ও শীতল কণ্ঠে তিনি ফিসফিসিয়ে বললেন,
——— "হুম। আমাদের শপিং মলের কাজ ছেড়ে নিজের দোকান খুলে বসেছে এখন! এবং সেই সামান্য দোকানের আড়াল থেকে আমার নিষ্পাপ মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলার দুঃসাহস দেখিয়েছে। কত বড় স্পর্ধা! আমি তাকে সতর্ক করেছিলাম, আমার মেয়ে এখনও শিশু, কিছু বোঝে না। তাকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম। অথচ সে আমার ছোট্ট, সহজ-সরল মেয়েটাকে সাইকেলে চড়িয়ে গ্রামের পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আমি কি তাকে ঘোরাব না? ছোটলোকের বা'চ্চা হয়েও আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে!
তিনি ক্রমে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে বলতে ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলেন। মুখমণ্ডল ক্রুদ্ধ র'ক্তিমতায় দীপ্ত হয়ে উঠল। শ্বাস দ্রুত ও ভারী হয়ে উঠল। একসময় ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে মুরাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
———" যা এখন!"
লোকটি বিনা বাক্যে মাথা নত করে বিদায় নিল। আর সাজ্জাদ সাহেব, একটি তীব্র ঝড়ের শেষে ঘনীভূত স্তব্ধতায় নিমজ্জিত, চেয়ারে হেলান দিয়ে নীরবে তাকিয়ে রইলেন। চোখের মণিতে প্রতিহিংসার শিখা যেন নৃত্যরত। বলে উঠলেন,
——— "আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর ফল তুই আজ রাতে বুঝবি জীবন.! "
0 Comments