Ad Code

তোমাদের জন্য ভালোবাসা পর্ব - ১

 লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ

০১. সবাই এসে গেছেন

সবাই এসে গেছেন।

কালো টেবিলের চারপাশে সাজান নিচু চেয়ারগুলিতে চুপচাপ বসে আছেন তাঁরা। এত চুপচাপ যে তাঁদের নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও কানে আসছে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূৰ্ণ বৈঠক বসবে। কাল রাতের বেলা ভয়ানক জরুরী ছাপমারা লাল রঙের চিঠি গিয়েছে সবার কাছে। সেখানে লেখা, আসন্ন মহাসংকট নিয়ে আলোচনা, আপনার উপস্থিতি প্রয়োজন। মহাকাশ প্রযুক্তিবিদ্যা গবেষণাগার-প্রধান এস, মাথুরের সই করা চিঠি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ বলে পরিচিত মহামান্য ফিহাও হয়তো হাজির থাকবেন এই জরুরী বৈঠকে। চিঠিতে অবশ্য এই কথা উল্লেখ নেই। কখনো থাকে না। অতীতে অনেকবার বিজ্ঞানী সম্মেলনের মহাপরিচালক হিসেবে তাঁর নাম ছাপা হয়েছে, কিন্তু তিনি আসেন নি। বলে পাঠিয়েছেন, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আসতে পারছি না, দুঃখিত। কিন্তু আজ তাঁকে আসতেই হবে। আজ যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা তো আর রোজ রোজ দেখা দেয় না। লক্ষ লক্ষ বৎসরেও এক-আধা বার হয়। কিনা কে জানে! এ সময়ে ফিহার মত বিজ্ঞানী তাঁর অভ্যাসমতো শুয়ে শুয়ে গান শুনে সময় কাটাবেন, তাও কি হয়!

Facebook

আমার মনে হয় মাথুর এসে পড়তে আর দেরি নেই। যিনি কথা বললেন, সবাই ঘুরে তাকালেন তাঁর দিকে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, নীরবতা ভাঙার জন্যই নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় এ কথাগুলি বলা হয়েছে। বক্তার দিকে তাকিয়ে দুএকজন ভূ কোঁচকালেন। বক্তা একটু কেশে বললেন,

কাল কেমন ঝড় হয়েছিল দেখেছেন? জানালার একটা কাঁচ ভেঙে গেছে আমার।

কথার উত্তরে কাউকে একটি কথাও বলতে না শুনে তিনি অস্বস্তিতে আঙুল মটকাতে লাগলেন। মাথা ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলেন।

ঘরটি মস্ত বড়। প্ৰায় হলঘরের মতো। জরুরী পরিস্থিতিতে হাজার দুয়েক বিজ্ঞানীর বসার জায়গা আছে। আজ অবশ্য এসেছেন। আটাশ জন। বসবার ব্যবস্থা হয়েছে নিয়ন্ত্রণকক্ষের পাশের ফাঁকা জায়গাটায়। পর্দা টেনে নিয়ন্ত্রণকক্ষকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। অদ্ভুত ধরনের ঘর। শীতকালে জমে যাওয়া হ্রদের জলের মত মসৃণ মেঝে কালো পাথরের ইমিটেশনে তৈরি দেয়াল, দেখা যায় না। এমন উঁচুতে ছাদ।

যেখানে বিজ্ঞানীরা বসে আছেন, তার পাশের ঘরটিতে মহাশূন্যের এ-প্ৰান্ত থেকে ও-প্ৰান্ত পর্যন্ত উড়ে-যাওয়া স্টেশন, অভিযাত্রী দল, সন্ধানী দলের সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। যাবতীয় কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করছে কম্পিউটার সিডিসি। বিজ্ঞানীদের হাজার বছরের সাধনায় তৈরি, মানুষের মস্তিকের নিওরোনের ১নিখুত অনুকরণে তৈরি নিওরোন যার জন্য প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে। কে বলবে, আজকের এ বৈঠকে হয়তো কম্পিউটার সিডিসিও অংশ গ্রহণ করবে, নয় তো ঠিক তার পাশের ঘরেই বৈঠক বসোনর কোনো কারণ নেই।

YouTube 

এস. মাথুরের আসার সময় হয়েছে ঠিক দেড় ঘণ্টা আগে কথাগুলি বলে পদার্থবিদ স্রুরা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অল্প বয়সে অকল্পনীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়ে তিনি সম্মানসূচক একটি লাল তারা পেয়েছেন। তাঁর আবিস্তৃত দ্বৈত অবস্থানবাদ নিয়ে তিন বৎসর ধরেই ক্রমাগত গবেষণা হচ্ছে। সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়, যখন দ্বৈত অবস্থানবাদ স্বীকৃতি পেয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা স্রুরার দিকে তাকিয়ে রইলেন। উত্তেজন।… স্রুরা অল্প কাঁপছিলেন। তাঁর টকটকে ফস মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কপালের উপর এসে পড়া লালচে চুলগুলি বা হাতে সরিয়ে তিনি দৃঢ় গলায় বললেন,

একটি মিনিটও যেখানে আমাদের কাছে দামী, মাথুর কি করে সেখানে দেড় ঘণ্টা দেরি করেন ভেবে পাই না।

বিরক্তিতে স্রুরা কাঁধ ঝাকাতে লাগলেন! প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, মাথুরের মনে রাখা উচিত, সমস্যাটি মারাত্মক।

বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসলেন। সমস্যাটি নিঃসন্দেহে মারাত্মক, হয়তো ইতিমধ্যেই তা তাদের গ্রাস করতে শুরু করেছে। এই ঘর, এই গোল কালো রঙের টেবিল, ঘরের ভেতরের ঠাণ্ডা বাতাস সমস্তই বলছে,

সময় খুব কম, সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের ভয়-পাওয়া মুখের ছায়া পড়েছে। ঘরের কালো দেয়ালে। বুকের ভেতর শিরশির করা অনুভূতি নিয়ে তাঁরা নীরবে বসে আছেন।

TikTok

মাঝে মাঝে একেকটা সময় আসে যখন পুরনো ধারণা বদলে দেয়ার জন্যে মহাপুরুষদের মতো মহাবিজ্ঞানীরা জন্মান। কালজয়ী সে সব অতিমানব মানুষের জ্ঞানের সিঁড়ি ধাপে ধাপে না বাড়িয়ে লাফিয়ে ধারণাতীত উঁচু ধাপে নিয়ে যান। বিধাতার মতো ক্ষমতাধর এ সমস্ত মানুষেরা বহু যুগে এক-আধা জন করে জন্মান। জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ শুরু হয় তখন। মানুষের আদিমতম কামনা, দৃশ্য—অদৃশ্য যাবতীয় বিষয় আমরা নিয়মের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলব, অজানা কিছুই থাকবে না, অদেখা কিছুই থাকবে না। কোনো রহস্য থাকবে না।

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময়টা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের ক্ষমতার কাল চলছে। পুরনো ধারণা বদলে গিয়ে নতুন নতুন সূত্র ঝড়ের মতো এসে পড়ছে। যে সমস্ত জটিল রহস্যের হাজার বৎসরেও সমাধান হয় নি, অতীতের তারৎ বিজ্ঞানীরা যা অসহায়ভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছেন, তাদের সমাধানই শুধু হয় নি—-সে সমাধানের পথ ধরেই নতুন সূত্রাবলী, নতুন ধারণা কম্পিউটারের মেমরি সেলে সঞ্চিত হতে শুরু হয়েছে। জন্ম হয়েছে ফিহার মতো মহা আঙ্কিকের, যিনি তাঁর তুলনাহীন প্রতিভা নিয়ে ত্রিমাত্রিক সময় সমীকরণের সমাধান করেছেন মাত্র ছবিশ বৎসর বয়সে। জন্ম হয়েছে পদার্থবিদ স্রুরার, পদার্থবিদ এস. মাথুরের। মানুষের তৈরি কৃত্রিম নিওরোন নিয়ে তৈরি হয়েছে মানবিক আবেগসম্পন্ন কম্পিউটার সিডিসি। গ্রহ থেকে গ্রহে, মহাকাশের এ-প্ৰান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। কে বলে জ্ঞানের শেষ নেই, সীমা নেই? মানুষের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়তেই হবে জ্ঞানকে। বিজ্ঞানীদের পিছু ফেরবার রাস্তা নেই।–আরো জান, আরো বেশি জান।

Threads

এমনি যখন অবস্থা, ঠিক তখনি আবিষ্কৃত হল টাইফা গ্রহ; এন্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জের একপাশে পড়ে থাকা ছোট্ট একটি নীল রঙের গ্রহ। চারপাশে উজ্জ্বল ধোঁয়াটে রঙের ছায়াপথের মাঝামাঝি গ্রহ একটি। একটি হঠাৎ আবিষ্কার। বৃহস্পতির কাছাকাছি মহাকাশ গবেষণামন্দির থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল WGK-166, একটি সাদা বামন নক্ষত্রকে, যা দ্রুত উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে প্রবল বিস্ফোরণে গুড়িয়ে যাবার জন্যে। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ করলেন সাদা বামন নক্ষত্র৮ থেকে বেরিয়ে আসা বিকিরণ–তেজের প্রায় ষাট ভাগ কেউ যেন শুষে নিচ্ছে। এই প্রকান্ড ক্ষমতাকে কে টেনে নিতে পারে? অন্য কোনো গ্রহের কোনো উন্নত প্ৰাণী কি এই মহাশক্তিকে কাজে লাগাবার জন্যে চেষ্টা করছে? যদি তা-ই হয় তবে সে প্ৰাণী কত উন্নত?

আবিষ্কৃত হল টাইফা গ্রহ।

বৃহস্পতির কাছাকাছি মহাজাগতিক স্টেশন নিনুপ-৩৭-এর অধিনায়ক টাইফার অনন্যসাধারণ আবিষ্কারক। সেই স্টেশনের সবাই অতি সম্মানসূচক দুই নীল তারা উপাধি পেলেন।

টাইফা গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ হতে সময় লাগল এক বৎসর। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা হকচাকিয়ে গেলেন। টাইফা গ্রহের গণিতশাস্ত্রের খবর আসতে লাগল। বিক্ষিত বিজ্ঞানীরা কী করবেন বুঝতে পারলেন না। সমস্তই তাঁদের জ্ঞান ও বুদ্ধির অগোচরে। সেখানে সময় বলে কি কিছুই নেই? সময়কে সব সময় শূন্য ধরা হচ্ছে কেন? বস্তু বলে কি কিছুই নেই? বস্তুকে শূন্য ধরা হচ্ছে কেন? শক্তিকে দুই মাত্রা হিসেবে ব্যবহার করছে কেন?

Instagram

মহা আঙ্কিক ফিহা, পৃথিবীর সব অঙ্কবিদরা নতুন গণিতশাস্ত্রের নিয়মাবলী পরীক্ষা করতে লাগলেন। ভূতুড়ে সব গণিতবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, কোথেকে কী হচ্ছে? তাদের ফলাফল হিসেবে মহাশূন্যে কোথাও কোনো বস্তু নেই। চারদিকে অনন্ত শূন্য! মানুষ মহাজাগতিক শক্তির একটি আংশিক ছায়া। তাহলে আমাদের ভাবনা-চিন্তা, আমাদের অনুভূতি, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, প্রেম, ভালোবাসা সমস্তই কি মিথ্যা? ছায়ার উপরেই জন্ম-মৃত্যু?

পৃথিবীর খবরের কাগজগুলিতে আজগুবি সব খবর বেরুতে লাগল। কেউ কেউ লিখল, টাইফা গ্রহের মানুষেরা পৃথিবী ধ্বংস করে দিচ্ছে। কেউ লিখল, তারা পৃথিবীতে তাদের ঘাঁটি বানাবার জন্যে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। কেউ লিখল কি সুক্ৰানীদের মাথা গুলিয়ে ফেলার জন্যে তারা আজগুবি সব তথ্য পাঠাচ্ছে। গুজবের পিঠে ভয় করেই গুজব চলে। টাইফা গ্রহ নিয়ে অজস্র বৈজ্ঞানিককল্পকাহিনী লেখা হতে থাকল। দুজন পরিচালক এই নিয়ে গ্ৰী ডাইমেনশনাল ছবি তৈরি করলেন। ছবির নাম নরক থেকে আসছি। কেমন একটা অদ্ভুত ধারণা ছড়িয়ে পড়ল, টাইফা গ্রহের বিজ্ঞানীরা নাকি পৃথিবীর বিজ্ঞান-পত্নী সিরানেম এসে যাবতীয় বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করছে। মহাশূন্য-গবেষণা বিভাগ, খাদ্য-উৎপন্ন বিভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে। বাধ্য হয়ে এস. মাথুর সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন।

জনসাধারণকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে। অমূলক ভয়ভীতি সরিয়ে দিয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিজ্ঞান–পল্লী সিরানে সেবারই সর্বপ্রথম অবিজ্ঞানীরা নিমন্ত্রিত হলেন।

 WhatsApp

বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক এস. মাথুর বলছি,–

বিজ্ঞান-পল্লী সিরানে সর্বপ্রথম নিমন্ত্রত অতিথিরা, আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন। শুরুতেই টাইফা গ্রহ সম্বন্ধে আপনাদের যাবতীয় ধারণার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করছি। টাইফা গ্রহ নিয়ে আপনারা যত ইচ্ছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনা করুন, ছবি তৈরি করুন, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। নরক থেকে আসছি ছবিটা আমার নিজেরও অত্যন্ত ভালো লেগেছে।

গ্যালারিতে বসা দর্শকরা এস, মাথুরের এই কথায় হৈ হৈ করে হাততালি দিতে লাগলেন। তালির শব্দ কিছুটা কমে আসতেই এস. মাথুর। তাঁর নিচু ও স্পষ্ট কথা বলার বিশেষ ভঙ্গিতে আবার বলে চললেন, আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা উন্নত ধরনের প্রাণীর সন্ধান টাইফা গ্রহে পেয়েছি।

এক জন দর্শক চেঁচিয়ে বললেন, তারা কি দেখতে মানুষের মতো?

তারা দেখতে কেমন তা দিয়ে আমার বা আপনার কারো কোনো প্রয়োজন নেই। তবে তারা নিঃসন্দেহে উন্নত জীব। তারা ওমিক্রন রশ্মির সাহায্যে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমরা ওমিক্রন রশ্মির যে সংকেত পাঠাচ্ছি, তা তারা বুঝতে পারছে এবং তারা সেই সংকেতের সাহায্যেই আমাদের খবর দিচ্ছে। এত অল্প সময়ে সংকেতের অর্থ উদ্ধার করে সেই সংকেতে খবর পাঠান নিঃসন্দেহে উন্নত শ্রেণীর জীবের কাজ।

হলঘর নিঃশব্দ হয়ে এস. মাথুরের কথা শুনছে। শুধু কয়েকটা মুভি ক্যামেরার সাঁ সাঁ ছট ছট শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এস. মাথুর বলে চললেন, আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, টাইফা গ্রহ গণিত ও পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন সূত্রাবলী সম্পর্কে যা বলতে চায় তা হতে পারে না, তা অসম্ভব।

কথা শেষ না হতেই নীল কোট পরা এক সাংবাদিক বাঘের মতো লাফিয়ে উঠলেন, চেঁচিয়ে বললেন, কেন হতে পারে না? কেন অসম্ভব? আমরা বুঝতে পারছি না বলে?

Email

এস. মাথুর বললেন, তাদের নিয়মে সময় বলে কিছু নেই। এক জন অনায়াসে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে চলাফেরা করতে পারে। এ অসম্ভব ও হাস্যকর।

সাংবাদিক চড়া গলায় বললেন, কেন হাস্যকর? হাজার বছর আগেও তো পৃথিবীতে টাইম মেশিন নিয়ে গল্প চালু ছিল।

এস. মাথুর বললেন, গল্প ও বাস্তব ভিন্ন জিনিস। আপনি একটি গল্পে পড়লেন যে একটি লোক হঠাৎ একটি পাখি হয়ে আকাশে উড়ে গেল। বাস্তবে আপনি সে রকম কোনো পাখি হয়ে উড়ে যেতে পারেন না। পারেন কি?

কথা শেষ না হতেই দর্শকরা হোঃ হেঃ করে হেসে উঠল এবং বিক্ষিপ্তভাবে হাততালি পড়তে লাগল। সাংবাদিক লাল হয়ে বললেন, আমি পাখি হবার কথা বলছি না। আপনি কথা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন।

এস. মাথুর হাসিমুখে বললেন, না, আমি এড়িয়ে যাচ্ছি না। টাইম মেশিনের কল্পনা কতটুকু অবাস্তব তা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরুন। একটা টাইম মেশিন তৈরি করলাম, মেশিনে চড়ে আমরা চলে গেলাম। অতীতে, যখন আপনার জন্মই হয় নি। আপনার বাবার বয়স মাত্র বার। মনে করুন। আপনার সেই বার বৎসর বয়সের বাবাকে আমি খুন করে আবার টাইম মেশিনে চড়ে বর্তমানে এসে হাজির হলাম। এসে দেখি আপনি সিরান-পল্লীতে দাঁড়িয়ে আমার বক্তৃতা শুনছেন। অথচ তা হতে পারে না। কারণ আপনার বাবা বার বৎসর বয়সে মারা গেছেন। অতএব আপনার জন্মই হতে পারে না।

সাংবাদিক বললেন, আমি বুঝতে পারছি, আমাকে ক্ষমা করবেন।

কিছুক্ষণ আর কোনো কথাবাত শোনা গেল না। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন মহামান্য ফিহা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ, দুর্লভ তিন লাল তারা সম্মানের অধিকারী, ত্রিমাত্রিক যৌগিক সময় সমীকরণের নির্ভুল সমাধান দিয়ে যিনি সমস্ত বিজ্ঞানীদের স্তম্ভিত করে রেখেছেন। ফিহা মাথা নিচু করে হেটে গেলেন মাথুরের কাছে, বললেন, আমি কিছু বলব।

Facebook

সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। ফিহা বলে চললেন, কাল আমি সারারাত ঘুমুতে পারি নি, আমার একটা পোষা বেড়ালছোনা আছে, সাদা রঙের, ধবধবে সাদা, বিলিয়ার্ড বলের মতো। ওর কী একটা অসুখ করেছে, সারারাত বিরক্ত করেছে আমাকে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ভোর রাতে ঘুমুতে গেছি, হঠাৎ মনে হল টাইফা গ্রহের বিজ্ঞান নিশ্চয়ই নির্ভুল। আচমকা মনে হল, সময় সংক্রান্ত আমার যেসব সূত্র আছে, সেখানে সময়কে শূন্য রাখলেও উত্তর নির্ভুল হয়, শুধু বস্তুকে ভিন্ন খাতায় নিয়ে যেতে হয়। আমি দেখাচ্ছি করে।

ফিহা ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে চলে গেলেন। একটির পর একটি সূত্র লিখে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অঙ্ক কষে চললেন। পরবর্তী পনের মিনিট শুধু চকের খসখস শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। ফিহা এক সময় বোর্ড ছেড়ে ডায়াসে উঠে এসে বললেন, সবাই বুঝতে পেরেছেন আশা করি? দর্শকদের কেউই বুঝতে পারেন নি কিছুই। শুধু অঙ্ক কষার ধরন–ধারণ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। সবাই মাথা নাড়ালেন, যেন খুব বুঝতে পেরেছেন। ফিহা বললেন, এখন মুশকিল হয়েছে কি জানেন? তারা এত উপরের স্তরে পৌঁছে গেছে যে তাদের কোনো কিছুই এখন আর আমাদের ধারণায় আনা সম্ভব নয়। তাদের গণিত বলুন, তাদের পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা–কিছুই নয়।

এবার বিজ্ঞানীদের ভিতর একজন দাঁড়িয়ে বললেন, কেন সম্ভব নয়?

ফিহা বিরক্ত হয়ে বললেন, বোকার মতো কথা বলবেন না। মানুষ যেমন উন্নত, পিপীলিকাও তার স্কেলে অগৎি তার প্রাণিজগতে উন্নত। এখন মানুষ কি পারবে পিপীলিকাকে কিছু শেখাতে? গণিত শেখাতে পারবে? পদার্থবিদ্যা শেখাতে পারবে? পিপীলিকার আগ্রহ যতই থাকুন না কেন।

সভাকক্ষে তুমুল হাততালি পড়তে লাগল। এস. মাথুর। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনার হৈচৈ করবেন না। এইমাত্র নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে একটা মারাত্মক খবর এসেছে। আজকের অধিবেশন এই মুহূর্তেই শেষ।

YouTube

এস. মাথুর উত্তেজনায় কাঁপছিলেন। যিনি তাঁকে এসে কানে কানে খবরটি দিয়েছেন তিনিও ঘনঘন জিব বের করে ঠোঁট ভেজাচ্ছেন।

মারাত্মক খবরটি কী? আমরা জানতে চাই। দর্শকরা চেঁচাতে লাগলেন। বসে থাকা বিজ্ঞানীরাও উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মাথুরের দিকে।

মাথুর ভীত গলায় বললেন, কিছুক্ষণ আগে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানান হয়েছে, হঠাৎ করে ভোজবাজির মতো টাইফা গ্রহটি হারিয়ে গেছে। কোনো বিস্ফোরণ নয়, কোনো সংঘর্ষ নয়, হঠাৎ করে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া। যেখানে গ্রহটি ছিল, সেখানে এখন শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই। আপনারা দশ মিনিটের ভেতর হলঘর খালি করে চলে যান। এক্ষুণি বিজ্ঞানীদের বিশেষ জরুরী বৈঠক বসবে। সভাপতিত্ব করবেন। মহামান্য ফিহি।

ফিহা বিরক্ত হয়ে বললেন, আমার এক্ষুণি বাড়ি যাওয়া প্রয়োজন। বেড়ালছানা রাত থেকে কিছু খায় নি। তাকে থুকোজ ইন্টারভেনাস দিতে হবে।

মাথুর বললেন, আপনি চলে গেলে কী করে হবে?

ফিহা বললেন, আমি থাকলেই বুঝি সেই গ্রহটা আবার ফিরে আসবে?

সন্ধ্যাতেই আভ্যন্তরীণ বেতার, বহিবিশ্ব বেতার থেকে জরুরী নির্দেশাবলী প্রচারিত হল–

আমি বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক এস. মাথুর বলছি।

এই মুহূর্তে থেকে পৃথিবীর উপনিবেশ মঙ্গল ও চন্দ্র এবং পৃথিবীর যাবতীয় মহাজাগতিক স্টেশনে চরম সংকট ঘোষণা করা হল। টাইফা গ্রহ যে রকম কোনো কারণ ছাড়াই মহাশূন্যে মিশে গেছে, তেমনি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রও মিশে যাচ্ছে। আমাদের কম্পিউটার সিডিসি কত পরিধি, কোন পথে এবং কত গতিতে এই অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তা বের করতে সক্ষম হয়েছে। দেখা গিয়েছে যে এই গতিপথ চক্রাকার। তা টাইফা গ্রহ থেকে শুরু হয়ে আবার সেখানেই শেষ হবে। দুভাগ্যক্রমে পৃথিবী, চন্দ্র, বৃহস্পতি ও শনি এই আওতায় পড়েছে। হিসেব করে দেখা গেছে পৃথিবী আর এক বৎসর তিন মাস পনের দিন পর এই দুভাগ্যের সম্মুখীন হবে। বিজ্ঞানীরা কী করবেন তা স্থির করতে চেষ্টা করছেন। আপনাদের প্রতি নির্দেশ–

এক, আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। আতঙ্কগ্রস্ত হলে এই বিপদ থেকে যখন রক্ষা পাওয়া যাবে না, তখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে লাভ কী?

দুই, যার যা করণীয় তিনি তা করবেন।

TikTok

তিন. কোনো প্রকার গুজব প্রশ্রয় দেবেন না। মনে রাখবেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সব সময় আপনাদের সঙ্গেই আছেন। যা অবশ্যম্ভাবী, তাকে হাসিমুখে বরণ করতে হবে নিশ্চয়ই, তবু বলছি বিজ্ঞানীদের উপর আস্থা হারাবেন না।

 

কালো টেবিলের চারপাশে নিচু চেয়ারগুলিতে বিজ্ঞানীরা বসে আছেন। পদার্থবিদ স্রুরা বললেন, আমরা কি অনন্তকাল এখানে বসে থাকব? এস. মাথুর যদি পাঁচ মিনিটের ভেতর না আসেন। তবে আমি চলে যাব।

ঠিক তক্ষুণি এস. মাথুর এসে ঢুকলেন। এক রাতের ভিতরেই তাঁর চেহারা বদলে গিয়ে কেমন হয়ে পড়েছে। চোখের দৃষ্টি উদভ্ৰান্ত, গালের চামড়া ঝালে পড়েছে। কোনো রকমে বললেন,

আমি দুঃখিত, আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি এতক্ষণ চেষ্টা করছিলাম ফিহাকে আনতে। তিনি কিছুতেই আসতে রাজি হলেন না। প্রেইরি অঞ্চলে চলে গেছেন হাওয়া বদল করতে। এত বড় বিপদ, অথচ–।

Threads

স্রুরা মুখ বিকৃত করে বললেন, ওর প্রাণদন্ড হওয়া উচিত, যতবড় প্রতিভাই হোক, প্রাণদন্ডই তার যোগ্য পুরস্কার। মাথুর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।



Post a Comment

0 Comments

Close Menu