Ad Code

২৫. পাঠশালার কথা - ৫

 লেখকঃ পল্লি কবি জসীম উদ্‌দীন

২৫.

তাম্বুলখানার হাট হইতে ফিরিয়া আসিয়া আজাহের বউকে বলে, “আমাগো বাড়ির উনি গ্যাল কই? চায়া দেহুক কারে আনছি!”

রহিমদ্দীন কারিকরকে দেখিয়া বউ মাথার ঘোমটাটা আর একটু টানিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া তার পায় হাত দিয়া সালাম করে, “এই যে চাচাজান আইছে যে।”

বউকে দোয়া করিয়া রহিমদ্দীন হাসিয়া বলে, “কই, আমার বুবুজান কই?”

Facebook

মায় ডাকে, “ও বড়ু! এদিকে আয়। তোর কারিকর দাদা আইছে।” বড়ু একটু কৃত্রিম লজ্জা ভাব দেখাইয়া হাসিয়া আগাইয়া আসে। রহিমদ্দীন বলে, “এই যে বুবুজান! তোমার

জন্যি একখানা শাড়ী আনছি। তা এই বুইড়া জামাই তোমার পছন্দ অবি নি?”

মা ঘোমটার তল হইতে হাসিয়া উত্তর করে, “জামাইর গান হুনলি মাইয়া এহনই। কোলে যায় বসপ্যানে।”

রহিমদ্দী গান ধরে :

“মাগো মা, কালো জামাই ভালো লাগে না।”

গান ছাড়িয়া দিয়া রহিমদ্দী ডাকে, “আমার মিঞা ভাই গেলা কোথায়?” বছির আগাইয়া আসিয়া রহিমদ্দীনকে সালাম করে। বছিরের হাতে একখানা লাল গামছা দিয়া রহিমদ্দী বলে, “তোমার দাদী এই গামছাহানা বুনাইছে। বলে, নাতীরে দেহী না কত বচ্ছর। তারে গামছাহানা দিয়া আইস গিয়া। তা আইলাম তালখানার আটে। কাপড় নিয়া আইছিলাম। তা বিককিরিও বাল ঐল। এহন তোমাগো বাড়ি বেড়ায়া যাই।”

আজাহের বলে, “ও বছির! তোর কারিকর দাদার কতা মনে নাই? সেই যে ছোটবেলায় তোরে কোলে লয়া নাচাইত আর কত গান গাইত।”

বছিরের একটু একটু মনে পড়ে। তাকে নাচাইবার সময় কারিকর দাদা গান করিত :

“নাচেরে মাল, চন্দনে কপাল,
ঘেতমধু খায়া তোমার টোবা টোবা গাল।”

YouTube

আজাহের বউকে বলিল, “বড় মোরকডা দরো। আর চাইল বিজাও। পিটা বানাইতে অবি। আমি এদেক গিরামের হগল মানুষরে ডাক দেয়। আজ রাইত বইরা তোমার গান। হুনব চাচা।” রহিমদ্দী বাধা দিয়া বলে, “না, না অত কাণ্ড-বেকাণ্ড করণের লাগবি না। রাইত অয়া গ্যাছে। রাত্তির কালে বউ চাইল ভিজাইও না। সারা রাইত জাইগা ওসব করণের কি দরকার?” বউ বলে, “হোন কতা। জামাই শ্বশুর বাড়ি আইলি জামাইর আদর না করলি ম্যায়া যে আমারে খুঁটা দিবি। আপনিত রাইত বইরা গান করবেন, আমিও গান হুনব আর পিটা বানাব।”

আজাহের হুঁকোটি সাজিয়া আনিয়া রহিমদ্দীর হাতে দেয়। রহিমদ্দী জিজ্ঞাসা করে, “তা আজাহের! কেমুন আছ কও!” আজাহের উত্তর করে, “আল্লার দোয়ায় বাল আছি চাচা। আমাগো আলীপুরীর খবর কও। মেনাজদ্দী মাতবর কেমুন আছে?”

“সবাই ভাল আছে।” বলিয়া কোঁচার খোট হইতে লাউয়ের বীজ আর কনেসাজানী সীমের বীজ বাহির করিতে করিতে রহিমদ্দীন বলে, “আমার মনেই ছিল না। মোড়লের বউ এই বীজগুলি পাঠাইছে বউরে। তোমাগো হেই কন্যাসাজানী সীম গাছের বীজ। তোমরা ত চইলা আইলা। তোমাগো গাছে কি সীমই না দোরল! কিন্তুক মোড়ল-বউ এর একটাও কাউরে ছিড়বার দিল না। মানষীর কাছে কইত, আমার কন্যা গেছে বিদ্যাশে। কন্যাসাজানী সীম আমার কে ছিঁড়ব? আমি ওদিগে চায়া চায়া আমার কন্যারে দেখপার। পাই।” রহিমদ্দীর হাত হইতে সীমের বীজগুলি লইতে লইতে বউর চোখ দুইটি ছলছল করিতে লাগিল।

আজাহের জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা চাচা! আগের মত গীদটি আর গাও না?” রহিমদ্দীন বলে, “তোমরা চইলা আসার পরে গাজীর গানের দল করছিলাম। কয় বছর চলছিলও বেশ, কিন্তু বিনা তারের গান না কি কয়, হেই যে বাক্সের মদ্দি ত্যা গান বাইর অয়, সগল লোক তাই হুনবার জন্যি ছোটে। আমাগো গান কেউ পোছেও না। দিনি দিনি বাপু কাল বদলায়া যাইত্যাছে। এহন এসব গান কেউ হুনবার চায় না। ওই যে থিয়েটার না কি কয়, নাচনাআলীরা যে সব গান গায় লোকে হেই রহম গান হুনবার চায়। তা হে গান ত আমার জানা নাই।”

TikTok

আজাহেরও উৎসাহিত হইয়া উঠে বিনা তারের গানের কথায়, কিন্তু রহিমদ্দীকে যেন একটু সমবেদনা দেখাইবার জন্যই বলে, “তা দেহ চাচা! পেরথম দুই একদিন ওই বিনি তারের গান বাল লাগে। কিন্তুক যে মানুষ গীদ গাইল তারেই যদি না জানলাম, তার চেহারা, তার ভঙ্গী-ভাঙ্গী যদি না দেখলাম তয় গান শুইনা কি আরাম পাইলাম?” রহিমদ্দী খুশী হইয়া বলে, “তুমি জানি তা বুজলা। কিন্তু ওই যে কলে কথা কয়। সগগলি তাই কলের পাছে পাছে দৌড়ায়।” আজাহের যেন রহিমদ্দীকে সান্ত্বনা দিবার জন্যই বলে, “কিন্তুক আমি কয়া দিলাম চাচা, মানষীর মন ফিরবি। নতুন জিনিস দেখপার নিশা বেশী দিন থাহে না। আবার পুরান জিনিসের জন্যি মানষীর মন কানবি। ওই কলের গান থুইয়া আবার তোমাগো গান হুনবার জন্যি মানুষ ঘুরবি।”

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া রহিমদ্দী বলে, “হেই কাল যহন আইব তহন আমরা আর থাকপ না।”

আজাহের বলে, “কি যে কও চাচা? তা যা হোক, আইজ তোমারে গীদ গাইতি অবি। আমি ওদিক গিরামের সগলরে খবর দিয়া আসি।”

বউ রহিমদ্দীর সামনে মুড়ি আর গুড় আনিয়া দিয়া বলে, “চাচাজান খাউক।”

“আরে বেটি! তুমি কি লাগাইছাও আবার?” এই বলিয়া হাত পা ধুইয়া রহিমদ্দী মুড়ি খাইতে বসে।

Threads

বউ জিজ্ঞাসা করে, “চাচাজান! কেদারীর মা কেমন আছে?” “কেদারীর মা বাল নাই। বাতের বেদনায় বড়ই কাবু অয়া গ্যাছে। আসপার সময় কইল, বউরে কইস বাতের ব্যথায় পইড়া আছি। নাতী নাতনীগো জন্যি কিছু দিবার পারলাম না। বউরে আমার দোয়া কইস।”

কেদারীর মার কথা মনে করিতে বউর চোখ ছলছল করিয়া ওঠে। বিপদে-আপদে যখন যার দরকার কেদারীর মা বিনা ডাকে তাহার উপকার করিয়া আসে। এমন মানুষ কোথায় পাওয়া যায়?

রহিমদ্দী নাস্তা খাইয়া আরাম করে। বউ ওদিকে চুলায় রান্না চড়াইয়া দিয়া চেঁকিতে চাউল কুটিতে যায়। বড়ু এখনো চাউল আলাইতে শেখে নাই। বছির আর বড় দুইজনে চেঁকিতে পার দেয়। মা চুরুনের ওঠা নামার মাঝখানে নোটের মধ্যে হাত দিয়া চাউলগুলি নাড়িয়া দেয়। মাঝে মাঝে সেই আধগুঁড়ি চাউলগুলি কুলার উপর রাখিয়া আস্তে আস্তে মা কুলা দুলাইয়া গুঁড়িগুলি টেকিয়া লয়। কেমন দুই হাতে সুন্দর পরিপাটি করিয়া ধরিয়া মা কুলাখানা দোলাইতে থাকে। মায়ের হাতের চুড়িগুলি টুং টুং করিয়া বাজে। তারই তালে। তালে অভাঙ্গা মলকেগুলি নাচিয়া নাচিয়া মাকেই যেন খুশী করিবার জন্য কুলার একপাশে যাইয়া জড় হয়। গুঁড়িগুলি জড় হয় কুলার আর একপাশে। মা আস্তে করিয়া কুলায় একটি টোকা দিয়া সেই অভাঙ্গা মলকেগুলি নোটের মধ্যে ফেলিয়া দেয়। গুঁড়িগুলি ধামার মধ্যে রাখে। সাজানো-গুছানো ভাবে সুন্দর করিয়া কাজ করিবার মায়ের কতই নিপুণতা। পেঁকির উপর হইতে চাহিয়া চাহিয়া বড়ু দেখে, আর ভাবে কতদিনে সে মায়ের মত যোগ্যতা লাভ করিবে।

Instagram

চাউল কোটা শেষ হইলে মা চুলার উপরে পানি গরম দিয়া ধামায় সঞ্চিত গুঁড়িগুলি হইতে কিঞ্চিৎ লইয়া দুই হাতের মুঠায় বড় বড় গোলা বানাইয়া উননের সেই গরম পানির মধ্যে ফেলিতে থাকে। কিছুক্ষণ ঢেলাগুলি গরম পানিতে বলক দিয়া সেই পানিটুকুর কিছুটা গামলায় ঢালিয়া রাখে। এই পানির সঙ্গে ঢেলা হইতে কিছুটা চাউলের গুঁড়ি মিশিয়া গিয়াছে। বড় লোকেরা ইহা ফেলিয়া দেয়, কিন্তু মা ইহাতে নুন মিশাইয়া অতি তৃপ্তির সঙ্গে। খায়। তারপর মা গুঁড়ির ঢেলাগুলি থালের উপর রাখিয়া দুই হাতে আটা ছানিতে থাকে। কি আর এমন কাজ! কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুইটি তাহাই একদৃষ্টিতে চাহিয়া দেখে। এ যেন মায়ের পিঠা বানানোর নাট্যভিনয়! মাকে এই পিঠা বানাইতে তাহারা কতবার দেখিয়াছে, দেখিয়া দেখিয়া তবুও তৃপ্তি হয় না। শীতের দিনে মা শেষ রাতে উঠিয়া ভাপা পিঠা বানায়। ছেলে-মেয়ে দুইটি মায়ের সঙ্গে উঠিয়া কতবার তাকে ভাপা পিঠা বানাইতে দেখিয়াছে। প্রথম পিঠাটি সিদ্ধ হইলে মা তাদের খাইতে দেয় না। দ্বিতীয় পিঠাটি ভাঙ্গিয়া তাহাদের দুইজনকে খাইতে দেয়। তাদের খাওয়া দেখিতে মায়ের সকল পরিশ্রম স্বার্থক হইয়া ওঠে। আজাহেরের কাছে মা কতদিন হাসিয়া বলিয়াছে, “পুলাপান হওনের আগে পিঠা বানায়া সুখ ছিল না। চুলার পাশে বইসা পুলা-ম্যায়ারাই যদি না খাইল তবে পিঠা বানায়া কিসির সুখ?”

ArtWorks

আটা ছেনা হইলে মা ছোট ছোট করিয়া এক একটা গড়া বানাইল। সেই গড়াগুলি লইয়া আবার হাতের তোলায় চ্যাপটা করিয়া দুই হাতে টিপিয়া টিপিয়া এক একটুক ছোট্ট রুটির মত করিল। তারপর বেলুন লইয়া মা রুটি বেলিতে আরম্ভ করিল। মায়ের ডান হাতের বুড়ী আঙ্গুলের পরে যে ফঁক আছে তার মধ্যে বেলুনের উঁটির একধার পুরিয়া বাম হাতের তেলো দিয়া মা বেলুন ঘুরাইতে থাকে। মায়ের সুন্দর হাতের কাঁচের চুড়িগুলি আগের মতই টুং টুং করিয়া বাজিয়া উঠে। মায়ের বেলুনের তলার আটা ঘুরিয়া ঘুরিয়া রুটিতে পরিণত হয়। মায়ের আদরেই যেন এরূপ হয়। মায়ের এই কাজ দেখিয়া বছিরের বড়ই ভাল লাগে। মনে মনে ভাবে, মা যেন আরও কত কিছু বানাইতে পারে। ছোট বোন বড় মার কাছ হইতে একটু আটা লইয়া তার ছোট্ট বেলুনটি লইয়া রুটি বানাইতে চাহে। অপটু হাতে রুটির এদিকে মোটা হয় ওদিকে পাতলা হয়, মাঝে মাঝে আবার ছিঁড়িয়াও যায়। মা মিষ্টি করিয়া বলে, “আরে আদাখলের বেটি! এই রকম কইরা বল।”

বছির বলে, “মা! তুমি আমারে আটা দিয়া একটা নৌকা বানায়া দাও–একখানা পাল্কী বানায়া দাও।”

মা বলে, “একটু সবুর কর। আগে কয়খানা রুটি বেইলা লই।” সাত আটখানা রুটি বেলা হইলেই মা কাঠখোলা চুলায় দিয়া রুটি সেঁকিতে থাকে। রান্না করিতে হাঁড়ি-পাতিল ঠুসিয়া গেলে তাহার অর্ধেকটা ভাঙ্গিয়া মা কাঠখোলা বানাইয়াছে। তাহাতে কয়েকখানা রুটি সেঁকিয়া সদ্য রান্না-করা মুরগীর তরকারী একখানা মাটির সানকিতে করিয়া মা বলে, “তোরা আগে খায়া দেখ, কেমুন ছালুন ঐছে।”

WhatsApp

বছির আর বড় সেই তরকারীতে রুটি ভরাইয়া খাইতে খাইতে মায়ের তারিফ করে, “মা! ওমুন ছালুন তুমি কুনুদিন রাব্দ নাই।” তৃপ্তিতে মার প্রাণ ভরিয়া যায়। আরও একটু ছালুন থালায় ঢালিয়া মা বলে, “বালো কইরা খা।”

বছির বলে, “মা! আর একটু ছালুন দাও। মাথাডা আমারে দ্যাও।”

মা বলে, “দেখছস না তোর দাদা আইছে? আজকার মাথাডা তারে দেই। আবার যহন মুরগী জবো করব তহন তোরে মাথাডা দিব। তুই আইজ মাইটাডা খা।”

ছেলে-মেয়ের খাওয়া হইলে আজাহের গ্রামের লোকদের গান শোনার দাওয়াত দিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল।

রহিমদ্দীকে সঙ্গে লইয়া আজাহের এবার খাইতে বসিল। ইতিমধ্যে গ্রামের লোকেরা একে একে আসিয়া আজাহেরের বাড়িতে জড় হইল। দীনু মাতবর, মোকিম, তাহের লেংড়া, ও-পাড়ার মিঞাজান সকলেই আসিল। ফুলীকে সঙ্গে লইয়া মোড়লের স্ত্রীও আসিল। তাহারা আজাহেরের বউ-এর সঙ্গে বারান্দায় বসিল।

Email

উঠানের মধ্যে ছেঁড়া মাদুর আর খেজুরের পাটি বিছাইয়া পুরুষ লোকদের বসিতে দেওয়া হইল। মাঝখানে মোড়লের পাশে রহিমদ্দীকে বসিবার জন্য একখানা নক্সী কাথা বিছাইয়া দিল। খাওয়া শেষ করিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে সালাম আলেকম বলিয়া রহিমদ্দী সভাস্থলে আসিয়া দাঁড়াইল। গরীবুল্লা মাতবর উঠিয়া দাঁড়াইয়া সেই নক্সী কাঁথার আসন দেখাইয়া বলিল, “গায়েন সাহেব! বসেন।”

রহিমদ্দী বলে, “না, ও জায়গায় আপনি বসেন। আমি পাশে বসপ।” মোড়ল বলে, “আপনি ঐলেন আমাগো মেজবান। আপনাকে ওহানে বসতি ঐব।”

রহিমদ্দী বলে, “তা কি ঐতে পারে? আপনার মাইন্য ত আছে। আপনি ঐলেন মাতবর, তার উপর মুরব্বী। আপনি ওখানে বসেন।”

একে অপরকে টানাটানি করে, কেউ বসে না। তখন আজাহের বলিল, “আপনারা দুইজনেই ওই নক্সী কাথার উপর বসেন।” খুশী হইয়া মোড়ল রহিমদ্দীকে পাশে লইয়া সেই। নক্সী কাঁথার উপর বসিল। রহিমদ্দীর বিনয় দেখিয়া সভার সকলেই খুশী হইল। মোড়লের পাশে বসিয়া রহিমদ্দীন একটা বিড়ি বাহির করিয়া মোড়লকে দিল, নিজেও একটি ধরাইয়া টানিতে লাগিল। এমন সময় আজাহের একটি একতারা আনিয়া রহিমদ্দীর হাতে দিল। রহিমদ্দী একতারাটি হাতে লইয়া টুং টুং করিয়া বাজাইতে লাগিল। সকলের দৃষ্টি তাহার দিকে। না জানি কি মধুর কাহিনী সে আজ প্রকাশ করিবে তাহার ঐ একতারার ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে। কিন্তু রহিমদ্দী কেবল বাজাইয়াই চলিয়াছে। সমবেত শ্রোতাদের ঔৎসুক্য আর ধৈর্য মানে না। মোড়ল বলে, “গায়েন সাব! এবার গান আরম্ভ করেন।”

Facebook

রহিমদ্দী একতারা বন্ধ করিয়া একবার তার শ্রোতাদের উপর চারিদিকে চোখ ঘুরাইয়া দেখিয়া লইল। বুঝিতে পারিল, তাহাদের মন, কাহিনীর কম্পরাজ্যে ঘূরিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। সে একটু কাশিয়া বলিল, “কি গীদ আমি গাব। গলাডাও বাল নাই। আপনাগো হুননির যোগ্য গান কি আমি জানি?”

মোড়ল বিনয় করিয়া জবাব দেয়, “আরে মিঞা! আপনি যা গাবেন তাই আমাগো বালো লাগবি। এইবার আরম্ভ করেন।”

রহিমদ্দী যেন মাটির সঙ্গেই নত হইয়া বলে, “দোহার পত্তর সঙ্গে আনি নাই। একলার গলায় কি গীদ হুনবেন?”

আজাহের বলে, “বছির। বড়ু। তোরা কই গেলি? তোর দাদার পাশে বইসা গানের গড়ান দর।”

মোড়ল বলে, “নেহাজ! ফুলী! তোরাও আয়। ও কুনা কিডা বরান নাকি? আরে মিঞা! তুমি ত এক সময় গাজীর গানের দলের দোহার ছিলা। আওগাইয়া আইস। গায়েন সাবের গানের গড়ান দর।”

YouTube

দোহার ঠিক হইয়া গেল। হাতের বিড়িতে খুব জোরে আর একটা টান দিয়া নাকমুখ। দিয়া ধুয়া বাহির করিয়া রহিমদ্দী গান আরম্ভ করিল ।

ওকি আরে আরে আ—রে
দোহারেরা তাহার কণ্ঠ হইতে সুর কারিয়া গান লইয়া গায় :
 ওকি আরে আরে আ-আ-রে।

রহিমদ্দী আর বরান খর মোটা গলার সঙ্গে ফুলু, বড়, নেহাজ আর বছিরের তরুণ কণ্ঠ মিলিয়া উপস্থিত গানের আসরে এক অপূর্ব ভাবের সমাবেশ হয়। রহিমদ্দীর মনে হয়। এমন মধুর সুর যেন কোনদিন তার কণ্ঠ হইতে বাহির হয় নাই। সঙ্গের দোহারদের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, সেও যেন তার নিজেরই। তার অন্তরের অন্তস্থল হইতে ভাব-তরঙ্গ উঠিয়া তাহাদের কণ্ঠে যাইয়া যেন আছড়াইয়া পড়ে। তার মনে হয়, আজ এই সুরের উপর। যে-কোন কাহিনীকে সোয়ার করিয়া তাহার সূত্র লইয়া সে যে-কোন দেশে যাইতে পারে। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, মানুষ, দেবতা, দানব, অতীত, বর্তমান সব যেন আজ তাহার মুঠার। মধ্যে। যখন যাহাকে ইচ্ছা সুরের সূতায় টানিয়া আনিয়া শ্রোতাদের সামনে সে দাঁড় করাইতে পারে। রহিমদ্দী আরম্ভ করে?

DailyMotion

পূবেতে বন্দনা করলাম পূর্বে ভানুশ্বর,
একদিগে উদয় গো ভানু চৌদিগে পশর।
পশ্চিমে বন্দনা করলাম মক্কা মদিস্তান,
উদ্দেশে জানায় সালাম মোমিন মুসলমান।
উত্তরে বন্দনা করলাম হিমালয় পর্বত,
যাহার হাওয়াতে কঁপে সকল গাছের পাত।
দক্ষিণে বন্দনা করলাম ক্ষীর-নদীর সায়র,
যেইখানে বাণিজ্য করে চান্দ সওদাগর।
সভায় যারা বইসা আছেন পূর্ণমাসীর চান,
তানগো উদ্দেশে আমি জানাইলাম সালাম।
সকল বন্দনা কইরা মধ্যে করলাম স্থিতি
এই খানে গাব আমি ওতলা সুন্দরীর গীতি।

ইরান তুরান মুল্লুকে আছে এক বাদশা নামদার। তার একহি কন্যা নাম ওতলা সুন্দরী। ওতলা সুন্দরী, যার রূপের কোন তুলনা নাই। সেই কন্যার

হাতে পদ্ম পায়ে পদ্ম মুখে পদ্ম দোলে,
আসমানের চন্দ্র যেন ভূমিতে পড়ল ঢ’লে।
হাইট্যা হাইট্যা যায় কন্যা খঞ্জন খঞ্জন পায়,
সোনার নূপুর বাজে যেখান দিয়া যায়।

TikTok

গান শুনিতে শুনিতে বছিরের মনে হয় এ যেন তার বোন বড় আর ফুলীর রূপের বর্ণনা।

গায়েন গাহিয়া যায়, সেই কন্যার বিবাহ হইল এক সওদাগরের পুত্রের। সেই বিয়েতে কি কি শাড়ী পরছিল রাজকন্যা।

মোড়ল বলিল, “কি শাড়ী পরছিল গায়েন সাহেব? একটু নাইচা-পেইচা বলেন।”

রহিমদ্দী তখন তার গামছার খোট হইতে নূপুর জোড়া দুইপায়ে পরিয়া হেলিয়া দুলিয়া নাচিতে আরম্ভ করিল :

প্রথমে পরিল শাড়ী নামে গঙ্গাজল,
হাতের উপর থইলে শাড়ী করে টলমল।
মৃত্তিকায় থইলে শাড়ী পিঁপড়ায় লয়া যায়,
জলেতে রাখিলে শাড়ী জলেতে মিশায়।
সেই শাড়ী পরিয়া কন্যা শাড়ীর পানে চায়,
মনমত না হইলে দাসীকে পিন্দায়।

দোহারেরা ধূয়া ধরে :

Threads

ও কালো মেঘ যেন সাজিলরে।

রহিমদ্দীর নাচনের যেন আজ বাধ ভাঙ্গিয়াছে। প্রত্যেকখানা শাড়ীর বর্ণনা, যে ভাবে পরিচারিকারা তাহা রাজকন্যাকে পরাইতেছে, মনের মত না হইলে যে ভাবে রাজকন্যা শাড়ীখানা দাসীদের দিয়া দিতেছে, সদ্য বিবাহম্মুখ রাজকন্যার মনের সলাজ আনন্দ সব কিছু তার নাচের মধ্যে প্রকাশ পাইতেছে। রহিমদ্দী গাহিয়া যায়?

তারপরে পড়িল শাড়ী তার নাম হীত,
হাজারও দুঃখিতে পরলে তারও আইএ গীত।

এ শাড়ীও রাজকন্যার পছন্দ হইল না। সহচরীরা গুয়াফুল শাড়ী আনিল, আসমান-তারা শাড়ী আনিল, তারপর রাশমণ্ডল, কেলিকদম্ব, জলেভাসা, মনখুশী, দিলখুশী, কলমীলতা, গোলাপফুল, কোন শাড়ীই রাজকন্যার পছন্দ হয় না। তখন সব সখীতে যুক্তি করিয়া রাজকন্যাকে একখানা শাড়ী পরাইল।

তারপরে পরাইল শাড়ী তার নাম হিয়া,
সেই শাড়ী পিন্দিয়া হইছিল চল্লিশ কন্যার বিয়া।

Instagram

এই শাড়ী রাজকন্যার পছন্দ হইল। এবার রহিমদ্দী সেই শাড়ীর বর্ণনা আরম্ভ করিল :

শাড়ীর মদ্দি লেইখ্যা থুইছে নবীজীর আসন,
শাড়ীর মদ্দি লেইখ্যা থুইছে আল্লা নিরাঞ্জন।
শাড়ীর মদ্দি লেইখ্যা থুইছে কেলীকদম্ব গাছ,
ডালে বইসা ঠাকুর কৃষ্ণ বাশী বাজায় তত।

দারুণ অভাবের মধ্যে যাহাদের দিন কাটে তাহারা ত এই সব বিলাসের উপকরণ কোনদিন চোখেও দেখে নাই। বড় লোকদের সুন্দর সুন্দর মেয়েরা কত অষ্ট-অলঙ্কার পরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। তাহাদের জীবন কতই না মাধুর্যময়। সেই বিলাস উপকরণ–সেই রহস্যময় জীবনকে গানের সুরের মধ্যে ধরিয়া আনিয়া রহিমদ্দী তার সর্বহারা শ্রোতাদের মধ্যে ঢালিয়া দিতেছে। বাস্তব জীবনে যারা সব কিছু হইতে বঞ্চিত, রহিমদ্দীর গানের সুরে তার কিছুটা পাইয়া হয়ত তাহাদের অবচেতন মনের কোন একটি স্থান পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। রহিমদ্দীন গান গাহিয়া যায় :

আনিল বেশরের ঝাপি খুলিল ঢাকনি,
ডান হস্তে তুলিয়া লইল আবের কাঙ্কনখানি।
চিরলে চিরিয়া কেশবাসে বানল খোঁপা,
খোঁপার উপর তুইল্যা দিল গন্ধরাজ চাপা।
সাজিয়া পরিয়া এই দিন কন্যা হৈল ক্ষীণ,
কোমরে পরিল কন্যা সুবর্ণের জিন।
তার দিল তরু দিল কোমরে পাশুলী,
গলায় তুলিয়া দিল সুবর্ণের হাসলী।
কোমরখানি মাঞ্জা সরু মুইটের মধ্যে ধরে,
কাকুনিয়া গুয়া গাছটি হেইলা দুইলা পড়ে।
সাজিয়া পরিয়া কন্যা বসল বড় ঠাটে,
নীমাসামের কালে যেমন সূর্য বইল পাটে।

ArtWorks

সেই কন্যাকে বিবাহ করিয়া সওদাগরের পুত্র সারাদিন বারো বাঙলায় বসিয়া বউ-এর সঙ্গে পাশা খেলে। ষাইট’ কাহন নৌকা সওদাগরের ঘাটে বান্ধা থাকে। লোকজন পথে-ঘাটে সওদাগরের নিন্দা করে। এই খবর সওদাগরের কানেও আসিল। তখন ওতলা সুন্দরীর কাছে বিদায় লইয়া সওদাগর দূরের বাণিজ্যে পাড়ি দিল। যাইবার কালে

অশ্রুসজল কণ্ঠে সওদাগর মায়ের কাছে বোনের কাছে বলিয়া গেল ।

“ঘরেতে রহিল আমার ওতলা সুন্দরী,
আমার মতন তারে রাইখ যত্তন করি।”

সওদাগর ছয় মাসের পথ চলিয়া গিয়াছে। কত ইরানী-বিরানীর বন্দর পাছে ফেলাইয়া, কত বউখাটা, গোদাগাড়ী, চিরিঙ্গার বাজারে নৌকা ভিড়াইয়া সওদাগর সাত সমুদুরের তীরে আসিয়া উপস্থিত হইল। এখানে এক পাখির কাছে ছয় মাসের পথ একদণ্ডে যাইবার ফিকির জানিয়া সওদাগর গভীর রজনী কালে ওতলা সুন্দরীর মহলে আসিয়া উপস্থিত হইল। মা-বোন জানিল না। কাক-কোকিলও টের পাইল না। ওতলার বাসর-শয্যায় রাত্র। যাপন করিয়া প্রভাতের তারা না উঠিতেই আবার মন্ত্রবলে সওদাগর সমুদ্র তীরে যাইয়া উপস্থিত হইল।

দিনে দিনে হায়রে ভালা দিন চইলা যায়
গর্ভের চিহ্ন দেখা দিল ওতলার গায়।

WhatsApp

প্রথমে কানাকানি-তারপর লোক জানাজানি। বাশুড়ী-ননদীর কাছে ওতলা সকল কথা কয়। কিন্তু কে বিশ্বাস করিবে ছয় মাসের পথ হইতে সওদাগর একদণ্ডে গৃহে আসিয়াছিল। তখন গায়ের অষ্ট-অলঙ্কার খুলিয়া ছেঁড়া চটের বসন পরাইয়া শ্বশুড়ী-ননদী ওতলা সুন্দরীকে বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিল। ছিল রাজনন্দিনী হইল পথের ভিখারিনী। গানের সুরের ঝঙ্কারে রহিমদ্দী এবার রাজসিংহাসন হইতে তার নায়িকাকে নামাইয়া আনিয়া সর্বসাধারণের দলে মিশাইয়া দিল। কান্দিতে কান্দিতে ওতলা সুন্দরী পথে বাহির হইল :

“কান্দে কান্দে হায় ওতলা পন্থ চলে হায়
ওতলার কান্দনে আজকা আসমান ভাইঙ্গা যায়।”

গানের সুরে ঢেউ লাগাইয়া লাগাইয়া রহিমদ্দীন গাহিয়া চলে :

“গাছের পাতা ঝইরা পড়ে ওতলার কান্দনে,
খায় দানা না খায় পানি বনের মৃগী বনে।”

সেই কান্দনে সমবেত শ্রোতাদের চোখের পানি ঝরিয়া পড়ে। গামছার খোটে চক্ষু মুছিয়া রহিমদ্দী গাহিয়া যায়, এক বৃদ্ধ চাষা ওতলাকে আশ্রয় দিল। সেখানে ওতলার গর্ভে এক সোনার পুত্র জন্ম গ্রহণ করিল। সেই বৃদ্ধ চাষী মরিয়া গেল, পুত্র কোলে লইয়া অভাগিনী ওতলা আবার ঘরের বাহির হইল।

Email

“উচ্চ ডালে থাকরে কোকিল! অনেক দূরে যাও,
তুমি নি দেইখাছ পাখি আমার পতির নাও।
জাল বাউ জালুয়া ভাইরে! ছাইবা তোল পানি,
তুমি নি দেইখাছ আমার পতির নৌকাখানি।”

কিন্তু কেউ তার পতির সন্ধান দিতে পারে না। বনের মধ্যে থাকে এক দুষ্ট লোক। সে আসিয়া ওতলাকে বলে?

তোমার পতি মইরা গেছে নবলক্ষের দেশে
পান-গুয়া খাও ওতলা আমার ঘরে এসে।

ওতলা উত্তর করে :

আমার যদি মরত পতি শব্দ যাইত দূর,
রাম-লক্ষণ দুই গাছ শখ ভেঙে হইত চুর।
ভীন দেশে আমার পতি যদি মারা যাইত,
সিম্ভার সিন্দুর আমার মৈলাম হইত।

Facebook

সেই দুষ্টু লোক তখন কোল হইতে ওতলার ছেলেটিকে ছিনাইয়া লইল। ওতলা কান্দে :

“এখনো শেখে নাই যাদু মা বোল বলার বোল,
এখনো সাধ মেটে নাইরে তারে দিয়া কোল।
ওরে ডাকাত। আমার যাদুমনিকে তুই ফিরাইয়া দে।”

দুষ্টু তখন বলে :

“ফিরাইয়া দিব যাদু যদি যৌবন কর দান,
ফিরাইয়া দিব যাদু যদি খাও গুয়া-পান।”

ওতলা বলে :

“নাইকা মাতা নাইকা পিতা নাইকা সোদ্দের ভাই,
সেঁতের শেহলা হয়া ভাসিয়া বেড়াই।
তুমি আমার পিতা। আমার যাদুরে ফিরাইয়া দাও।” তখন সেই দুষ্টু লোক কি করে?

YouTube

ওতলার ছেলেকে শূন্যে উঠাইয়া বলে, “যদি তুমি আমার সঙ্গে না যাইবে তোমার এই সন্তানকে আমি আছড়াইয়া মারিব।” শুনিয়া ওতলা শিহরিয়া ওঠে। এই ভাবে কাহিনী করুণ হইতে করুণতর হইয়া আগাইয়া যায়। রহিমদ্দী গান গাহিতে গাহিতে গামছা দিয়া ঘন ঘন চোখ মোছে। নিদারুণ সেই দুষ্টুলোক প্রথমে ছেলের একখানা হাত কাটিয়া ফেলিল। তবু ওতলা রাজি হইল না তার কথায়। তারপর আর একখানা হাত কাটিল। তবু ওতলা অটল। তখন সেই নিদারুণ দুষ্টলোক ওতলার ছেলেটিকে আছড়াইয়া মারিয়া ফেলিল। পুত্র শোকে উন্মাদিনী ওতলা মাথার চুল ছেড়ে, বুক থাপড়ায়, মাটিতে মাথা ঘসে। হায়রে?

কারবা গাছের জালি কুমড়া কইরা ছিলাম চুরি,
সেই আমারে দিছে গালি পুত্র শোগী করি।
কোব্বা দেশে যায়া দেখব আমি সোনার যাদুর মুখ,
কোন্ দেশে যায়া জুড়াব আমার পোড়া বুক।

DailyMotion

উন্মাদিনী পথে পথে কান্দিয়া বেড়ায়। যারে দেখে তারই পায়ে ধরিয়া কান্দে–তোরা দে–আমার বাছাধনকে আনিয়া দে। ওতলার কান্দনে ভাটীর নদী, সেও উজান ধায়। আল্লার আরশ কুরছি কাপিয়া কাপিয়া ওঠে। গানের সুরে সুরে ঢেউ দিয়া কাহিনী আগাইয়া যায়। রাত্র ভোর হইতেই রহিমদ্দী গান শেষ করে। চোখের পানি মুছিতে মুছিতে শ্রোতারা। যার যার ঘরে ফিরিয়া যায়। গায়েন সাহেবের তারিফ করিয়া তাহারা এই ভাবের আবেগে এতটুকুও স্নান করিতে চায় না। রহিমদ্দীও বোঝে তাহাদের অন্তরে সে আজ নিজেকে ঢালিয়া দিতে সমর্থ হইয়াছে। এই ত গায়কের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার!

মূর্খ রহিমদ্দী এই গ্রামে মাত্র একটি রাত কাটাইয়া নিজের কথকতায় ছেলে-বুড়ো যুবক-যুবতী গ্রামের সকলকেই মুগ্ধ করিয়া দিয়া গেল। সে যেখানে যায় সেইখানেই এইরূপ আনন্দের হাট মেলে। তার কাহিনীর ভিতর দিয়া এই দেশের সব চাইতে যে শ্রেষ্ঠ আদর্শ সেই। একনিষ্ঠ প্রেমের জয় ঘোষণা করিয়া গেল। সেই প্রেমের মর্যাদা রাখিতে এ দেশের মেয়েরা। কত দুঃখের সাগরে স্নান করিয়াছে, কত বেহুলার কলার মন্দাস গংকিনী নদীর সেঁতে। ভাসিয়া, কত চিরিঙ্গার ঘাট কত নিতাই ধুপুনীর ঘাট পার হইয়াছে, যুগে যুগে এই প্রেম, দুঃখের অনলে পুড়িয়া নিজের স্বর্ণজ্যোতি আরও উজ্জ্বলতর করিয়াছে। অস্ত্র তাহাকে ছেদন করিতে পারে নাই, অগ্নি তাহাকে দাহন করিতে পারে নাই। রহিমদ্দীর মত বাঙলার গ্রামগুলিতে এইরূপ কত গায়ক, কত কবি, কত কথক রহিয়াছে। তাহারা বাঙলার অবহেলিত জনগণের মধ্যে আনন্দ-রসে ভরিয়া এই আদর্শবাদ আর নীতির মহিমা প্রচার করিতেছে। হয়ত সেই জন্যই আজও দেশে পুণ্যাত্মাদের সমাদর। অসৎ দুজন ব্যক্তিকে লোকে হেয় চক্ষে দেখে। কিন্তু রহিমদ্দীনের মত গুণী ব্যক্তিদের সমাদর ক্রমেই কমিয়া যাইতেছে। কে তাহাদের সভ্য সমাজে ডাকিয়া আনিয়া উচ্চ সম্মানের আসনে বসাইবে?

TikTok

আজাহের রহিমদ্দীকে থাকিতে বলিতে পারে না। একজন অতিথিকে আরও একদিন থাকিতে বলা মানে তাদের আর একদিন আধপেটা খাওয়া। দিন কামাই করিয়া দিন খায়। রহিমদ্দী। একদিন তাঁতের কাজ বন্ধ থাকা মানে তারও আর একদিন না খাইয়া থাকা। অনেক বলিয়া কহিয়া আবার আসিব বলিয়া রহিমদ্দী বড়ুর সরু বাহুবন্ধনখানি ছাড়ায়। আজাহেরের বউ বলে, “চাচাজান! এই শিশুর-ত্যালটুক নিয়া যান। কেদাইরার মরে দিবেন। হুনছি শিশুর-ত্যালে বাতের ব্যামো হারে। ও-পাড়ার মোকিমীর বাড়িত্যা কাইল সন্ধ্যায় আমাগো বাড়ির উনিরে দ্যা আনাইছি। আর এই ঢ্যাপের বীজগুলান নিয়া যান। চাচীজান যেন অদ্দেক রাহে আর অদ্দেক মোড়লের বউরে পাঠায়া দ্যায়। আরে তারে কইবেন, গরীব আমরা। গরে মিটাই থাকলি ঢ্যাপের বীজদ্যা খই বাইজা মওয়া বাইন্দা দিতাম। তানি যেন মোড়ল সাবরে মওয়া বাইন্দা খাওয়ায়।” রহিমদ্দী ঢ্যাপের পোটলা আর তেলের শিশি তার বোচকার মধ্যে বাঁধিতে বাঁধিতে বলে, “তোমরা সব পাগল ঐলা নাকি? এত জিনিস নেওয়া যায়?”

বউ বলে, আর এক কর্তা। মোড়ল বউরে কইবেন তার ছাইলার যহন বিয়া অবি আমারে যেন নাইয়ারে নেয়। কতকাল গিরামডারে দেহি না। একবার যাইবার ইচ্ছা করে।”

Threads

বিদায় লইয়া রহিমদ্দী পথে রওয়ানা হয়। আজাহের তাকে গ্রামের শেষ সীমা পর্যন্ত আগাইয়া দিয়া আসে। ফিরিবার সময় আজাহেরের মনে হয়, আজ যে গান গাহিয়া রহিমদ্দীন সকলের অন্তর জয় করিয়া গেল, এ যেন তাহাদের নিজেরই কীর্তি। সে যেন নিজেই গান গাহিয়া সকলকে মাতাইয়া দিয়াছে। রহিমদ্দী উপলক্ষ মাত্র। কারণ সেই ত তাহাকে ডাকিয়া আনিয়াছিল। গর্বে আজাহেরের নাচিতে ইচ্ছা করে।



Post a Comment

0 Comments

Close Menu