লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা
তুর্যর তীক্ষ্ম দৃষ্টি প্রবাহিত হতে হতে এক পর্যায়ে হীরের ভেজা শরীরের উপর এসে স্থির হয়। কালো জামাটা হীরের ভেজা শরীরের সাথে লেপ্টে থাকায় শরীরের অনেকটা ভাঁজ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। না চাইতেও তুর্যর দৃষ্টি সেখানে আবদ্ধ হচ্ছে বারবার। তুর্যর কামনায় ভরা দৃষ্টি হীরের দৃষ্টিগোচর হতেই হীরের শরীর কেঁপে উঠে ঘৃণায়। যেই মানুষটাকে এতোটা ভালোবেসে, যার সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছে সেই মানুষটার কাছে থেকে এসব সে স্বপ্নেও আশা করে নি।
অন্যান্য সময় তুর্যর একটি দৃষ্টির জন্য পাগলের মতো অপেক্ষা করি আর আজ সেই দৃষ্টি আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে ঘৃণায়। উনার দৃষ্টিতে লালসা স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে। ছিঃ! উনি এতোটা নিচ আমার জানা ছিল না। কিছুক্ষণ আগে ঐ মেয়েটার সাথে এতোকিছু করার পর এখন আবার আমার উপর কুদৃষ্টি দিচ্ছেন!
কোনোকিছু না ভেবে ঠাস্ করে তুর্যর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। আমি নিজেও জানি না এতো সাহস আমার মধ্যে এলো কিভাবে! শুধু এতোটুকু জানি এই খারাপ মানুষটার খারাপ দৃষ্টি আমি আর নিতে পারছিলাম না। তুর্য থাপ্পড় মারার পর থেকে মাথা নিচু করে রেখেছেন। প্রায় দেড় মিনিটের উপরে হয়ে গেছে। তারপরেও উনার কোনো নড়াচড়া নেই। এখন আমার সত্যি ভয় করছে। যতোই হোক বাড়িটা তুর্যদের, আর আমি এই বাড়ির আশ্রিতা। তুর্য যদি একলা ঘরে আমাকে আজকে মেরেও ফেলেন তবুও আমাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসার মতো কেও নেই। তুর্যর চেচামেচি, বকাঝকা, মার সব আমি দেখেছি। কিন্তু উনার এই ধরনের নীরবতা এই প্রথম আমার চোখে পরলো। উনার এভাবে থাকা আমাকে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এইটা ঝরের পূর্বের নীরবতা। না জানি আমার সাথে কি হতে চলেছে।
মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, হঠাত্ করেই চারপাশ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে শরীর নিস্তেজ হয়ে পরছে। আচ্ছা আমি কি জ্ঞান হারাচ্ছি!
ঘুমের ঘোরে কারো গরম নিশ্বাস আমার মুখের উপর আছড়ে পরছে। ঘুমের পাকড়াও এতোটাই জোরালো যে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চোখ খুলতে পারছি না। গরম নিশ্বাসের গতি ক্রমশ বেড়ে আমার ঠোঁট বরাবর এসে পরেছে। এখন আমার চোখ না খুললেই নয়। গালে আলতো কামড় পরতেই ঘুমের রেশ সম্পূর্ণ কেটে গেলো। চোখ খুলতেই তুর্যকে ঠিক আমার মুখের সামনে উপুর হয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম আমি। উনার শরীরের ভরও আমার উপরই দেওয়া। মানুষ কতোটা নিচ হলে একটা মেয়ের ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিতে পারে। তুর্যর চোখ দুটো বন্ধ করা অবস্থায় তাই বুঝতে পারেন নি যে আমি সজাগ হয়েছি। তুর্যর প্রতিটি স্পর্শ আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে ঘৃণায়। আর সহ্য না করতে না পেরে শরীরের সব শক্তি দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে উনাকে নিচে ফেলে দিলাম।
তুর্য হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এমন আকস্মিক আক্রমনের জন্য উনি প্রস্তুত ছিলেন না, তাই এভাবে দেখছেন। বিছানা থেকে নেমে উঠে দাড়াতেই মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো। মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলেই তুর্য আমার হাত ধরে টান দিয়ে তার বুকের সাথে চেপে ধরলেন। তার শরীরের সেই পরিচিত ঘ্রাণ আমার নাকে ভেসে আসছে। একটা সময় ছিল যখন এই ঘ্রাণ আমাকে মাতাল করে দিতো। আর আজ সেই একই ঘ্রাণ আমাকে চরম অস্বস্তিতে ফেলছে। তুর্যর বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তুর্যকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম।
-- আমাকে স্পর্শ করার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন না। বেরিয়ে যান আমার ঘর থেকে।
তুর্য এবার তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হীরের দুই বাহু চেপে ধরলো। হীরের বাহু ধরে স্বজোড়ে ঝাঁকিয়ে তুর্য বললো,
-- কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেনো? কি অন্যায় করেছি আমি যার কারণে তুই এমন করছিস?
-- হাত ছাড়ুন আমার।
-- তোর চোখে আমার জন্য এতো ঘৃণা কেনো? তুই রাতে আমার ঘরে গিয়েছিলি তাই না? কেনো গিয়েছিলি? কেনো এতোটা বিরক্তিবোধ হচ্ছে তোর আমাকে দেখে?
-- আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি বাধ্য নই। ছাড়ুন আমার হাত।
-- না ছাড়বো না। ততোক্ষণ হাত ছাড়বো না যতোক্ষণ না আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি।
-- কোনো উত্তরই আপনি পাবেন না। আপনার মতো একটা চরিত্রহীনের কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। চলে যান এখান থেকে নয়তো আমি চিত্কার করবো।
তুর্য হীর কে ছাড়ার বদলে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।
-- তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস? তোর এতো সাহস নেই যে তুই আমাকে হুমকি দিবি।
বাহু শক্ত করে ধরায় হীর ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো,
-- ছাড়ুন। আমাকে কষ্ট দিয়ে, আঘাত দিয়ে কি অনেক আনন্দ পান আপনি? কি অপরাধ আমার যে সারাক্ষণ আমাকে কষ্ট দেওয়ার অজুহাত খুঁজেন।
-- তোর এতো কথা আমি শুনতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই তুই কেনো আমার ঘরে গিয়েছিলি?
হীর ব্যথা পাওয়ার কথা বলার পরেও তুর্য গ্রাহ্য না করলে হীরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।
-- আপনার ঘর, আপনার জীবন, আপনার ভালোবাসা! আমি কোথাও নেই। আপনার জীবনের ত্রিসীমানাতেও আমি নেই। ভুল হয়ে গেছে আমার,, অনেক বড় অপরাধ হয়ে গেছে আপনাকে আপন ভেবে। আপনাকে মনের ঘরে রাজত্ব করতে দেওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। আমার সর্বনাশের জন্য আমি নিজে দায়ী। আমি নিজেই নিজের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। আপনার কোনো দোষ নেই। আমার এই পতনের দায় আমি কাউকে দেবো না।
হীরের পাগলের মতো আওড়াতে থাকা কথার এক কোণাও হয়তো তুর্যর বোধগম্য হয় নি।
-- কি বলছিস এসব?
-- আপনি দয়া করে এখান থেকে চলে যান। আমি আপনার পায়ে পরছি চলে যান এখান থেকে। আমি আর নিতে পারছি না। আমিও তো একটা মানুষ। একটু আমার দিকটা চিন্তা করেন। আমি কিভাবে এতো কষ্ট সহ্য করবো! চলে যান,, একা ছেড়ে দিন আমাকে।
হীর তুর্যকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ঘরের বাইরে বের করে দরজা ভিতর থেকে আটকে দিলো। তুর্য বন্ধ দরজার বাইরে মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে আর হীরের বলা কথাগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে। হীরের পাগলামী আর তার প্রতি রাগ দেখে এটা তুর্য ভালোই বুঝেছে যে হীর তাকে আর জেসিকা কে একসাথে দেখেছে। কিন্তু একসাথে দেখলেও হীরের এইভাবে রিয়েক্ট করার কারণ তুর্য কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। তবে কি হীরের মনেও তুর্যর জন্য অনুভূতি কাজ করে! সবকিছুই কেমন ঘোলাটে মনে হচ্ছে তুর্যর কাছে। হীরের অনুভূতিগুলো বোঝার সামর্থ্য তার নেই। হয়তো তার অপরাধবোধ তাকে এতোটাই শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে যে, সে বুঝতেই চায় না!
বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে তুর্য। দুচোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে তার। নিজের একটি ভুলের জন্য আজ সে হীরের চোখে অপরাধী হয়ে গেছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও এই ভুলের মাশুল সে দিতে পারবে না। "হীর তাকে ঘৃণা করে" কথাটা ভাবতেই কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করে তুর্যর মধ্যে। বুকের বা পাশে তীব্র চিনচিনে ব্যথা করছে তার। এতোটা কষ্ট হচ্ছে যা হয়তো চিত্কার করে সবাইকে বলতে পারলে কমতো। কিন্তু ছেলেদের কষ্ট পাওয়া বারণ। তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও মুখে হাসি ফুঁটিয়ে রাখতে হয়!
চোখের পানি দুহাতে মুছে, সিগারেটের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে ব্যলকোনিতে গিয়ে দাড়ালো তুর্য। সিগারেটের আগুন জ্বালিয়ে একের পর এক টান দিয়েই যাচ্ছে। ধোয়ার কুন্ডলী রাতের কালো আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বুকের ভিতরের কষ্টের আগ্নেয়গিরির তাপ কম করার বৃথা চেষ্টা করছে। অপরদিকে বিছানায় উপুর হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে অঝোরে কেঁদে চলেছে হীর।
দুজনের মনেই আজ কষ্টের লাভা টগবগ করে ফুঁটছে। দুজনের কারণ এক না হলেও ব্যথা টা সমপরিমানের। ভালোবাসায় শিক্ত দুটি হৃদয় দুই দিকে একটি নির্ঘুম রাত পার করে দিলো।
0 Comments