লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
৫
বদরুল হাসিমুখে বলল, কি ব্যাপার স্যার ?”
মনসুর সাহেব বললেন, 'কাগজ নিতে এসেছি। পাঁচ দিস্তা দিন ।’ ‘পরশুদিনই না কাগজ নিয়ে গেলেন।'
‘নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে...'
বদরুল কাগজ বাঁধতে বাঁধতে বলল, 'অঙ্কটার অবস্থা কি ? খুব টেনশানে
আছি।'
মনসুর সাহেব কিছু বললেন না। উঠতে যাচ্ছেন বদরুল হাহাকার করে উঠল, 'চা আনতে পিচ্চিকে পাঠিয়েছি। একটু স্যার বসুন গল্পগুজব করি ।’ 'গল্পগুজব করতে আমার ভালো লাগে না বদরুল ।
“তাতো স্যার জানি। আপনিতো 'বাদাইম্যা না কাজের লোক। দিন রাত অঙ্ক করাতো সহজ ব্যাপার না। অঙ্কটার নাম যে কি ? ফেক্কি ?
‘ফিবোনাক্কি !’
‘নাম শুনলেই প্যালপিটিশন হয়। অঙ্কটা শেষ হলে দেশের অবস্থার কি কোনো পরিবর্তন হবে স্যার ?'
মনসুর সাহেবের মন খানিকটা বিষণ্ণ হল । এই ছোকরা তাকে নিয়ে রসিকতা করার চেষ্টা করছে। অতি বুদ্ধিমানরা নির্বোধদের নিয়ে যে জাতীয় রসিকতা করে সে জাতীয় রসিকতা। মনসুর সাহেব সহজভাবেই বদরুলের প্রশ্নের উত্তর দিলেন— 'অঙ্কের সমাধানের সঙ্গে দেশের অবস্থার সরাসরি কোনো যোগ নেই ।'
'আপনি স্যার কথাটা বিনয় করে বলেছেন। আমরা ধারণা ফাটাফাটি হয়ে যাবে । ইউরোপ আমেরিকায় আপনাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে।’
চা নিয়ে এসেছে, মনসুর সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। বদরুল একটু ঝুঁকে এসে গলা নিচু করে বলল, 'অপরাধ যদি না নেন একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
'জিজ্ঞেস কর।'
‘বাংলাদেশে আপনার চেয়ে কোনো জ্ঞানী লোক কি স্যার আছে ?”
স্থূল রসিকতায় মনসুর সাহেবের মন আরো খারাপ হল । তিনি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, 'না নেই ।
‘স্যার আমিও তাই ভেবেছি। আপনি হচ্ছেন জ্ঞানীদের সম্রাট।'
“যাই বদরুল ?”
‘জ্বি আচ্ছা স্যার । আপনি আসেন এত ভালো লাগে । জ্ঞানী লোক কিছুক্ষণ সামনে বসে থাকলেও জ্ঞান বাড়ে। আমার স্যার এর মধ্যেই অনেক জ্ঞান বেড়ে গেছে।'
মনসুর সাহেব সরাসরি বাসার দিকে রওনা হলেন না। হেডমাস্টার সাহেব প্রেসার মাপাতে বলেছেন। ডাক্তার বজলুর রহমানের কাছে প্রেসার মাপাতে গেলেন। আজো সেখানে আড্ডা বসেছে। ডাক্তার সাহেব আজ ভূতের গল্প করছেন না। ব্যাঙের পেটে যে মণি থাকে তার গল্প করছেন—
‘লোকাল ভাষায় একে বসে ব্যাঙের লাল। সাত রাজার ধন—এরকম বলা হয় থাকে । প্রাণী থেকে পাওয়া মণি মুক্তার মধ্যে সাপের মণি হচ্ছে নাম্বার ওয়ান, নাম্বার টু হচ্ছে ব্যাঙের মণি, নাম্বার থ্রি হাতির মাথায় যেটা থাকে— গজমতি । নাম্বার ফোর গরুর বুকে যেটা থাকে।'
'গরুর বুকেও থাকে না-কি ?'
'তাও জানেন না। গরুর বুকে যেটা থাকে তার নাম ‘গোচনা। সবচে' কমদামি রত্ন থাকে ঝিনুকের মধ্যে—মুক্তা...'
উদ্ভট গল্প শুনতে ইচ্ছা করে। গল্পে বাধা দিতেও মন চায় না। সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনছে...তারপরেও মনসুর সাহেব বললেন—ইয়ে আমার প্রেসারটা...
বজলুর রহমান গল্প থামিয়ে ড্রয়ার থেকে প্রেসার মাপার যন্ত্র বের করলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, 'হেডস্যার বলেছেন—আপনার না-কি হাই প্রেসার বোর্ডে আবোল তাবোল কী সব লিখেছেন। দেখি হাত দিন।'
মনসুর সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন। প্রেসার মাপার যন্ত্রের বাল্ব টিপতে টিপতে গল্পে ফিরে গেলেন—
'ব্যাঙের লালের রঙ হল আপনার সবুজাভ লাল...ওজন ত্রিশ থেকে চল্লিশ রতির বেশি হয় না...মনসুর সাহেব আপনার ব্লাড প্রেসার নরম্যালের একটু উপরে—তেমন কিছু না। হাঁটাহাঁটি করবেন—হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম ব্যাঙের লাল ছাড়ার টাইম হল ভাদ্র-আশ্বিন মাস...'
0 Comments