Ad Code

২৩. পাঠশালার কথা - ৩

লেখকঃ পল্লি কবি জসীম উদ্‌দীন

 ২৩.

এইভাবে বহুদিন কাটিয়া গেল। একদিন গণশার সঙ্গে বছিরের আলাপ হইল। গণশার বাপ এদেশের একজন বর্ধিষ্ণ চাষী। বাড়িতে কোন কিছুরই অভাব নাই। বাপের বড় ইচ্ছা গণশাকে লেখাপড়া শেখায়। বাপ নিজে তিন চার গ্রামের মধ্যে সব চাইতে ধনী হইলেও লেখাপড়া জানে না বলিয়া লোকে তাহাকে সম্মানের চোখে দেখে না। সেইজন্য গণশাকে লেখাপড়া শিখাইয়া নিজের দৈন্যকে সে কতকটা ঢাকিতে চায়। কিন্তু মূর্খ পিতা ছেলেকে পাঠশালায় পাঠাইয়াই নিশ্চিন্ত। কি করিয়া ছেলের পড়াশুনার তদারক করিতে হয় জানে না। পাঠশালার মাষ্টার মহাশয়ের সেই মান্ধাতার আমলের শিক্ষা-প্রণালীর যাতাকলে পড়িয়া চার পাঁচ বৎসরেও ছেলে লেখাপড়ায় এতটুকুও অগ্রসর হইতে পারে নাই। কিন্তু পুস্তকের বিদ্যা না শিখিলেও তাহার মানস-বৃত্তি চুপ করিয়া থাকে নাই। কোন গাছের আম পাকিলে কি ভাবে চুরি করিয়া আনিতে হইবে, কোন জঙ্গলের ধারে কাহার গাছের কাঁঠাল পাড়িয়া আনিতে হইবে, এইসব বিদ্যায় তাহার সমকক্ষ কেহ নাই। এই সব চুরি-করা ফল-ফলারির একটাও সে নিজে মুখে দিয়া দেখে না। খেলার সাথীদের বিলাইয়া দিয়া আনন্দ পায়। এসব কথা প্রবাদের মত পাঠশালার সকল ছেলেই জানে।

Facebook

বছির তাকে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা গণেশ ভাই! তুমি ত একটা ফলও মুহি দাও না। তয় মানষীর বাড়িত্যা চুরি কইরা পাইড়া আইন্যা সকলেরে বিলাও ক্যান?”

গণশা বলে, “দেখ বছির! তুই বুঝবি ন্যা। যাগো আমি ও-সগল আইন্যা দেই তাগো বাড়িতে ফল-ফলারি একটাও নাই। তারা ওগো গাছের ফল-ফলারির দিকে চায়া থাকে। আমার ইচ্ছা করে কিন্যা আইন্যা ওগো খাওয়াই। পয়সা নাই বইল্যা কিন্যা যহন আনবার পারি না, তহন চুরি কইরা নিয়া আসি। আয় বছির! আয় নেহা! ওই জঙ্গলের মদ্দি কুশাইর চুরি কইরা আইন্যা রাখছি। তোগো ভাগ কইরা দেই।”

বছির বলিল, “ধেৎ, তা ঐলে গুনা ঐব।”

YouTube

গণশা হাসিয়া বলিল, “গুনা কিরে! ওগো খ্যাতে এত আছে! আমি ত মাত্তর কয়খানা নিয়া আইছি। চল তোগো জায়গা দেখায়া দেই। কাউকে কবি না কিন্তুক। ও-পাড়ার নেয়াজ আর মনসুর, তাগো নিজের বাড়ির কাঁঠাল চুরি কইরা আইন্যা খাওয়াইলাম। তারা কিনা মাষ্টার মশায়রে কয়া দিল। তা কয়া কি করল? মাষ্টার আমারে একটু মারল। এ মাইর ত আমার লাইগ্যাই আছে।”

DailyMotion

এই বলিয়া গণশাবছির আর নেহাজদ্দীনকে টানিয়া লইয়া চলিল। সাহাপাড়া ছাড়িয়া আদুর ভিটা। তারপরে মাঠ। সেই মাঠের ওপারে শোভারামপুরের জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝ দিয়া সরু একখানা পথ। সেই পথের উপরে দুই পাশের গাছের ডাল হইতে লতাপাতা আসিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। কোথাও বেতের শিষা আসিয়া পথ আটকাইয়াছে। অতি সন্তর্পণে তাহা সরাইয়া গণশাবছির আর নেহাজদ্দীনকে আরও গভীর জঙ্গলের মধ্যে লইয়া গেল। দুই পাশ হইতে কুব কুব করিয়া কানা কুয়া ডাকিতেছিল। সামনের জলো-ডুবায় বাচ্চা লইয়া ডাহুক ডাহুকী ডাকিতেছিল। তাহাদের শব্দ শুনিয়া উহারা ঘন বেত ঝাড়ের মধ্যে লুকাইল। ডোবার একধারে সইলের পোনা কিলবিল করিতেছিল। গণশা পানির মধ্যে হাত ডুবাইয়া ধীরে ধীরে টোকা দিতে লাগিল। পোনাগুলি আসিয়া তাহার চারিধারে জড় হইল! তখন সে পকেট হইতে মুড়ি বাহির করিয়া তাহাদিগকে খাইতে দিল। এরূপ ভাবে খানিকক্ষণ খেলা করিয়া গণশা সামনের দিকে আরও আগাইয়া গেল। পথের ওই ধারে একটি গর্ত। হাতের ইশারায় বছির ও নেহাজদ্দীনকে শব্দ করিতে বারণ করিয়া গণশা যাইয়া সেই গর্তের সম্মুখে আরও কতকগুলি মুড়ি ছড়াইয়া দিল। খানিক বাদে গর্তের ভিতর হইতে তিন চারিটি শেয়ালের ছানা আসিয়া সেই মুড়ি খাইতে লাগিল। গণশা তাহার দুই তিনটাকে ধরিয়া কোলে করিয়া এমন ভাবে তাহাদের আদর করিতে লাগিল যেন উহারা তাহার মায়ের পেটের ভাই-বোন। আদর করিতে করিতে গণশা বলিল, “এগো আদর কইরা সুখ আছেরে। পাঠশালার ছাত্তরগো মত বেইমান হয় নালিশ করে না।” এখান হইতে গণশা আরও খানিক দূরে ঘন ফুলখড়ি গাছের জঙ্গলের মধ্য হইতে চার পঁচখানা গেণ্ডারী টানিয়া বাহির করিয়া বলিল, “তোরা খা।”

TikTok

গেণ্ডারী খাইতে খাইতে তাহাদের অনেক কথা হইল। সন্ধ্যার পর কালো চাদর মুড়ি দিয়া কিভাবে গণশা শেখ হনুর খেত হইতে গেণ্ডারী চুরি করিয়াছিল, এমনি করিয়া দা ধরিয়া গেণ্ডারী কাটিলে শব্দ হয় না, গেণ্ডারী খেতের মধ্যেই বাঁশের চালার টং পাতিয়া হনু জাগিয়া খেত পাহারা দিতেছিল। তাহার কাশির শব্দ শুনিয়া গণশার বুক দুরু দুরু করিয়া কাঁপতেছিল। সে টের পাইলেই তাহার প্রতি হাতের তীক্ষ্ণধার টেটা হুঁড়িয়া মারিত, ইহার আনুপূর্বিক কাহিনী গণশা তাহাদের নিকট এমন করিয়া বর্ণনা করিল যেন সমস্ত ঘটনা তাহাদের চক্ষের সামনেই ঘটিতে দেখিতেছে। এই দুইটি শ্রোতার সামনে সমস্ত কিছু বলিতে পারিয়া গত রাত্রের অভিযানের সমস্ত দুঃসাহসিক ঘটনা তাহার নিকট কত বড় একটা গর্বের ব্যাপার হইয়া পড়িল।

Threads

খানিক পরে গেণ্ডারী চিবাইতে চিবাইতে-বছির বলিল, “আচ্ছা গণেশ ভাই! তুমি এত কাজ করবার পার কিন্তু রোজকার পড়াডা কইর‍্যা আস না ক্যান?”

গণশা বলে, “দেখ বছির! পড়বার ত আমারও মনে কয় কিন্তু পড়াডা মাষ্টার মশায় ক্যাবল একবার কয়া দ্যান। আমি মনে রাখপার পারি না। বাড়ি যায়া হে পড়া আমারে কিডা দেহায়া দিবি? আমাগো বাড়ির কেওই লেহাপড়া জানে না। সেন মশায়ের পুলারা বাল লেহাপড়া করে, ঘোষ মশায়ের পুলারা বাল পাশ করে, ওগো বাড়িতি পড়া দেহায়া দিব্যার লোক আছে, বাড়িতি মাষ্টার রাইখ্যাও ছাওয়ালপানগো পড়ায়।”

বছির বলে, “ঠিকই কইছ বাই। আমাগো বাড়িতি পড়া দেহায়া দিবার কেওই নাই। আমারেও মাষ্টার মশাইর মাইর খাইতি অয়। কিন্তুক আমাগো বাড়িতি যে বিদ্বান লোক নাই হে তো আমাগো অপরাধ না।”

গণশা বলে, “হে কতা কে বোঝে ভাই? তোরাও আমার মতন পোড়া কপাল্যা। সেই জন্যিই ত তোগো আমার এত ভাল লাগে!”

Instagram

বছির গণশার কাছে আরও আগাইয়া আসে। গণশা বলে, “আর এক কর্তা হোন বছির! ওগো পুলারা দেমাগে আমার লগে কতা কয় না। হে দিন যে নারক্যাল চুরি কইরা আনলাম না? স্যান মশার আর গোষ মশার পুলাগো দিলাম না দেইখ্যা আমার নামে মাষ্টার মশার কাছে নালিশ করল। আচ্ছা ক তো বছির! ওগো গাছ ভরা কত নারক্যাল, তার একটাও ওরা কাউরে কুনুদিন দিয়া খায়? আমার চুরি করা নারক্যাল ওগো আমি দিব ক্যান? নালিশ পায়া মাষ্টার মশায় আমারে যা মারল! তা আমিও কয়া দিলাম বছির! একদিন কায়দায় পাইলে আমি ওগো পিঠে তার শোধ তুলব।”

বছির বলে, “গণেশ ভাই। তোমারে যহন মাষ্টার মশায় ব্যাত দিয়া মারল আমার হামলায়া কানবার ইচ্ছা করল। কানলাম না ভয়ে যদি তানি আইসা আমারেও ওইভাবে। মারে।”

এই কথা বলিতেই কোথাকার সাতসমুদুরের কান্দন যেন গণশাকে পাইয়া বসিল। মাষ্টারের অকথিত অত্যাচারের জ্বালা সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস সহ্য করিয়া আসিতেছে, তার এত যে আদরের বাপ-মা আত্মীয়-স্বজন তারা কেউ কোনদিন এর জন্য এতটুকু সহানুভূতি তাকে দেখায় নাই। একবার মাষ্টার তাহাকে বাঁশের কঞ্চি দিয়া পিটাইয়া মাথার একস্থানে জখম করিয়া দিয়াছিল। সেই অবস্থায় বাপের কাছে গেলে বাপ বলিল, “তোরে পিটাইয়া মাইরা ফালাইল না ক্যান? মাষ্টার ত বিনি কারণে মারেন নাই। নিশ্চয়। কুনু দোষ করছিলি।” এই বলিয়া বাপ তাহার চোয়ালে আরও দুইটা থাপড় দিয়াছিল। ক্ষুদ্র পরিসর জীবনে সে যত দুঃখ পাইয়াছে সুবিশাল দুনিয়ার মধ্যে আজ এই একটি মাত্র লোক তাকে সহানুভূতি দেখাইল। মাষ্টারের এত যে মার তাতে সে কোনদিন চোখের জল ফেলে নাই। কিন্তু আজ এই ক্ষুদ্র বালকের কাছে সমবেদনার স্পর্শ পাইয়া তার সকল দুঃখ যেন। উথলাইয়া উঠিল। গায়ের জামা খুলিয়া গণশা বলিল, “দেখ বছির! মাষ্টার মাইরা আইজ আমারে রাখে নাই।”

ArtWorks

বছির চাহিয়া দেখিল, তাহার পিঠ ভরা শুধু লাঠির দাগ। কোন কোন জায়গায় কাটিয়া গিয়া রক্ত পড়িতেছে। সেই ক্ষত স্থানে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে বছির বলিল, “আহারে গণেশ বাই! তোমারে এমন কইরা মারছে?”

গণশা বলে, “দেখ বছির। আমি সন্ন্যাসী হয়া জঙ্গলে যায়া তপস্যা করব। দেবতা যদি আমার তপে তুষ্ট হয়া বর দিতি আসে তবে কইমু, আমারে এমন বর দাও ওই মাষ্টারের লাঠি গাছারে আমি যা হুকুম করুম ও যেন তাই করে। তহন আবার আইস্যা পাঠশালায়। পড়বার যামু। মাষ্টার যহন আমারে লাঠি দিয়া মারতি আইব অমনি লাঠিরে কইমু, লাঠি ফিরা যায়া মাষ্টারের পিঠি পড়, খানিকটা লাঠির বাড়ি পিঠি পাইলি তহন বুঝবি মাষ্টার, লাঠির মাইরের কেমুন জ্বালা।”

WhatsApp

বছির বলে, “আচ্ছা গণেশ ভাই! এমন মন্তর সেহা যায় না? যহন মাষ্টার মশায় তোমারে মারতি আসপি তহন মন্তর পইড়া আমি কুঁক দিব, অমনি মাষ্টারের আত অবশ হয়া যাবি।”

এইভাবে তিন কিশোর বালকের জল্পনা-কল্পনায় বনের মধ্যে অন্ধকার করিয়া সন্ধ্যা হইয়া আসিল। তাহারা বন হইতে বাহির হইয়া যে যার বাড়িতে চলিয়া গেল।

বছির বাড়ি আসিতেই বড় আগাইয়া আসিল, “মিঞা বাই! তুমি এত দেরী করলা ক্যান? তোমারে না কইছিলাম, আমার জন্যি সোনালতা লয়া আইবা? তা আনছ নি?” চৌধুরীদের বাড়ির সামনে একটি কুল গাছে প্রচুর সোনালতা হইয়াছে। সোনালতা দিয়া হাতের পায়ের অলঙ্কার গড়া যায়–মালা করিয়া গলায় পরা যায়। বছির যেখানে যা কিছু। ভাল জিনিস দেখে ছোট বোন বড়ুকে আসিয়া বলে। সেদিন এই সোনালতার কথা বলিতেই বড় সোনালতা আনিবার জন্য বড় ভাইকে বারবার করিয়া বলিয়া দিয়াছিল। বছির বড়ই

Email

অনুতপ্ত হইয়া বলিল, “আরে যা; সোনালতার কতা আমার মনেই ছিল না।”

মুখ ফুলাইয়া বোন বলে, “আচ্ছা, আচ্ছা। আমার কতা তোমার মনেই থাহে না।”

বছির বলে, “আমার সোনা বইন রাগ করিস না। কালকা আমি তোর জন্যি অনেকগুলিন সোনালতা আইনা দিব।”

বোন খুশী হইয়া বলে, “শুধু আমার জন্যি না। ফুলুর জন্যিও আইনো। আমরা দুইজনে তোমার জন্যি ডুমকুরির মালা গাইথা রাখছি। ফুলু অনেকক্ষণ দেরী কইরা এই এহন চইলা গেল।”

হাসিতে হাসিতে বড় ডুমকুরির মালা আনিয়া বছিরের গলায় পরায়া দিল।

রাত্রে বিছানায় শুইয়া বছিরের অনেকক্ষণ ঘুম হইল না। গণশার জীবনে যে অবিচারের কাহিনী সে আজ শুনিয়া আসিয়াছে, রাত্রের কালো পর্দায় কে যেন তাহা বার বার অভিনয় করিয়া দেখাইতেছিল। কিন্তু সে যে বড় অসহায়! কে তাহাকে এমন তেলেসমাতি শিখাইয়া দিবে যার বলে এক মুহূর্তে সে গণশার জীবন হইতে সমস্ত অত্যাচার মুছিয়া দিতে পারে?



Post a Comment

0 Comments

Close Menu