লেখকঃ পল্লি কবি জসীম উদ্দীন
৩৩.
সেদিন বছির রহিম মল্লিকের বাড়ি বেড়াইতে গেল। রহিম মল্লিক তাহাকে জড়াইয়া ধরিল। “ওগো হুনছ নি? আমার মিঞাবাই আইছে। শীগগীর পাও ধুবার পানি দাও! মাথার ক্যাশদা পিড়াহান মুইছা আমার মিঞাবাইরে বসতি দাও।”
বউ হাসিয়া বারান্দায় একটি খেজুর পাটি বিছাইয়া দিতে দিতে বলিল, “আমার দাদাভাই আইছে। ভাই আমার জন্যি কি লয়া আইছে?”
বছির বলিল, “হোন দাদী! তোমার জন্যি কুদাল ভাইঙ্গা নথ গড়াইতে দিছি, আর কাঁচি ভাইঙ্গা হাসলি গড়াইতে দিছি সোনারু বাড়িতি। এহন কি খাবার দিবা তাই আন।” বউ বলিল, “তয় আমিও ইন্দুরের মাটি দ্যা তোমার জন্যি পায়েস রাইন্দা রাখছি। ক্যালার। ডাউগ্যার খাসী কইরা রাইন্দা রাখছি তোলই চেরা হাঁড়িতি। বইও কুটুম বইও, আইনা দিত্যাছি।”
শুনিয়া রহিমদ্দীন হাসিতে হাসিতে বলিল, “তোমরা দাদী নাতি যত খুশী দেওয়া নেওয়া কর। আমি ইয়ার মদ্দি নাই।”
দাদী তাড়াতাড়ি কোলা হইতে মুড়ি আনিয়া একটি সাজিতে করিয়া বছিরকে খাইতে দিল।
বছির বলিল, “না দাদী! এত সব বাল বাল খাওয়ার সামগ্রীর নাম করলা, শুইনাই জিহ্বায় পানি আইসা গেছে। তা থুইয়া আমার জন্যি শুধু মুড়ি আইনা দিলা! ওই সব না ঐলে খাব না।”
দাদী আঁচল দিয়া বছিরের মুখ মুছাইয়া বলিল, “সে সব বানাইতি ত সময় লাগবি। ততক্ষণে এই মুড়িগুলি খাও কুটুম!”
মুড়ি খাইতে খাইতে বছির রহিমদ্দীর হাল-হকিকত শুনিতে লাগিল। এই অঞ্চলের মধ্যে রহিমদ্দী সব চাইতে ভাল জামদানী শাড়ী বুনাইতে পারিত। লাল, নীল, হলদে সূতা নাইলে পরাইয়া সে শাড়ীর উপর কত রকমের নকসাই না করিত। দেশ-বিদেশ হইতে বেপারীরা আসিত তাহার শাড়ী কিনিতে। শুধু কি জামদানী শাড়ীই সে বুনাইত? মনখুশী, দিলখুশী, কলমীলতা, কাজল লতা, গোলাপ ফুল, রাসমণ্ডল, বালুচর, কত শাড়ীর নাম করিবে সে? কিন্তু এখন দেশে সূতা পাওয়া যায় না। যে সূক্ষ্ম সূতা দিয়া সে আগে শাড়ী বুনাইত তাহা এখন বাজারে পাওয়া যায় না। চোরাবাজারে যা পাওয়া যায় তাহা দিয়া শাড়ী বুনাইলে দাম বেশী পড়ে। লোকসান দিয়া বেচিতে হয়। লোকের রুচিও এখন বদলাইয়া গিয়াছে। শহরের বড়লোকেরা এখন নকসী শাড়ীর পরিবর্তে সাদা থানের উপর নানা রঙের ছাপ দেওয়া শাড়ী পরে।
“কি কব দাদা বাই! আমাগো এখন মরণ। দেহ আইসা, নকসী শাড়ীর ফর্মাগুলি ইন্দুরে কাটত্যাছে।” এই বলিয়া রহিমদ্দী তাহার ডানা ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া দেখাইল, ঘরের চালের সঙ্গে অনেকগুলি ফর্মা অযত্নে ঝুলিতেছে। তাহার উপর মাকড়সারা স্বেচ্ছায় জাল বুনাইয়া চলিয়াছে।
বছির বলিল, “আচ্ছা দাদা! সরু সূতা যহন পাওয়া যায় না তহন মোটা সূতার কাপড়ই বানাও না কেন?”
রহিমদ্দী বলে, “ভাইরে! এই হাতে সরু শাড়ীর নকসাই আসে। তবু অনেক কষ্টে মোটা সূতা কিনা গামছা বুনাই। কিন্তু সে সূতাও চোরাবাজারে কিনতি অয়। তাতে মোটেই লাভ অয় না। একবেলা খাই ত আর একবেলা না খায়া থাহি। গরীবের মরণ আর কি! আমাগো জন্যি কেউ বাবে না।”
খাইতে খাইতে বছির জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা, দাদা! সগল কারিকরগো অবস্থাই তোমার মত নাকি?”
রহিমদ্দী বলে, “তাগো অবস্থা আরও খারাপ। কারিকর পাড়ায় হাহাকার পইড়া গ্যাছে।”
এত সব কথা বছিরকে বলিয়া কি লাভ হইবে? তবু তার কাছেই রহিমদ্দী সকল কথা ইনাইয়া বিনাইয়া বলে। দুঃখের কথা বলিয়াও হয়ত কিছুটা তৃপ্তি পাওয়া যায়।
রহিমদ্দীর কাছে বছির আরও অনেক খবর পাইল। মেনাজদ্দী মাতবর ভেদবমি হইয়া মারা গিয়াছে। মৃত্যুর পর তার যা কিছু জমি-জমা সাতে ভূতে দখল করিয়া লইয়াছে। সেন। মশায় ডিক্রী জারী করিয়া তাহার বিধবা বউকে পথের ফকির করিয়াছে। এ-বাড়ি ও-বাড়ি করিয়া এখন তাহার দিনাতিপাত চলে।
0 Comments