লেখিকাঃ আশা রোজমেরি
রাতের বুকে ঠাঁই নিয়েছে জোনাকিরা।মিটিমিটি জ্বলে, রাতের নিকষ কালো আধাঁরের সঙ্গী হচ্ছে।এতো রাতে আলোকিত রুম দেখে যুঁথি দরজা ঠেলে ভিতরে গেলো।সজিবের হাত ক্যানভাস রাঙাতে ব্যস্ত।চোখে মুখে আকুলতা।টি-টেবিলে একাকিত্বে পরে আছে এক কাপ চা।ছুঁয়ে ও দেখেনি বুঝাই যাচ্ছে।এটা তার নিত্য রাতের অভ্যাস।রাত জেগে ছেলের এমন পাগলামি দেখে যুঁথি বলে উঠলো,
--আর কতো রাত জাগবি সজিব
"উদাস কন্ঠে উত্তর আসলো",
--ঐ মায়াবী আঁখিদ্বয় ভুলতে পারছিনা, আম্মু।
--এমন আঁখিদ্বয় এক জোড়া নয়।আরো আছে।এমন চোখের মায়া কাটাতে হয় বাবা।
" সজিব চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র"
--আমি শিল্পী মানুষ, আম্মু।যদি ক্যানভাসে রাঙাতে পারি,কাজলে সাজাতে পারি আঁখি।তাও কিছু মায়া থেকে যাবে।একেবারে মুছে যাবে না।
--তার জন্য এতো রাত জেগে রোজ রোজ একই চাহনি ফোঁটাতে হবেনা।একবার বললেও যেমন ভালবাসি,বারংবার বললেও ভালবাসি।শুধু প্রকাশটাই ভিন্ন।ভালবাসাটা নয়।তেমনি তোর রঙের ছোঁয়ায় ফুঁটে উঠা এই চাহনির মায়া একবারেই ভালবাসার কথা বলে।আমি বুঝি।তোর মা'এর বুঝাতে কি এনাফ নয়?
--বাহ! আমার আম্মু দেখছি লাভ গুরু হয়ে গেছে।দাঁড়াও আমার একটা বন্ধু আছে আরজে।ওর সাথে আলাপ করে তোমাকে একটা শোতে লাভ গুরু হিসেবে জয়েন করাবো।
--খুব হয়েছে।এবার ঘুমাবে।এই যে পাশে চা এর কাপ অলসতার সঙ্গী হয়ে পরে থাকে।উষ্ণতা হারিয়ে ঠান্ডা হয়েও তোর অপেক্ষা করে।এক চুমুক দিয়েও তো সাড়া দিসনা।তাহলে কেনো শুধু শুধু চা এর কাপ পাশে রাখিস।কাল থেকে এসব বন্ধ।
--এক কাপ চা এর জন্য খোঁটা দিচ্ছো।যাও তোমার হাতের চা আর খাবো না।
--তাহলে যে বউমা আনতে হয়।
--ঘুমাবো আম্মু।ডিস্টার্ব করছো কেনো।যাও, বাবা তোমার জন্য ওয়েট করছে। (বলেই এক গাল হাসলো)
--দুষ্ট ছেলে হয়েছে আমার।কাল ভার্সিটি আছে।এখন আর জাগবে না।গুড নাইট
--গুড নাইট
বিছানায় শরীর ছোঁয়াতেই যুঁথির মনে ছয় মাস আগের ভাবনারা জায়গা করে নিলো।"সজিব সেদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলো।তারপর সে শান্ত করে রুমে নিয়ে বসায়।জানতে চায় এমন অবুঝের মতো কান্নার কারন,
--কি হয়েছে, কাঁদছিস কেনো?
--আম্মু,আমি রিকশা করে আসছিলাম।হঠাৎ ডাস্টবিনে চোখ যেতেই দেখি একটা ফুটফুটে বাচ্চা।আমি রিকশা থেকে নেমে কাছে গেলাম।ওর চোখে কি আকুলতা।যেনো আমাকে বাঁচতে চাওয়ার কথা বলছে।আমি কি করবো বুঝতেছিলাম না।রিকশওয়ালা মামা ডাক দিতেই চলে এলাম।তার লেট হচ্ছিলো।কিছু দূর আসার পর ভাবলাম, আমরা তো ওকে আমাদের কাছে রাখতে পারি।তাই রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম রিকশা ঘুরাতে।কিন্তু গিয়ে দেখি রাস্তার দুইটা কু*কুর ওকে কাঁমড়ে দিয়েছে।খু*বলে খাচ্ছে মনে হচ্ছে।আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো।তখনই কেনো নিয়ে এলাম না।আচ্ছা আম্মু,কেনো ও একটা পরিবার পেলোনা।কেনো মা'এর বুকের উষ্ণতা পেলোনা।ওর কি দোষ ছিলো!
সজিব এর কথায় যুঁথির চোখের কূল ছাপিয়ে জল গড়ালো,
--বাবা, পৃথিবীর মানুষ বড় নিষ্ঠু*র।নিজেদের পা*প ডাকতে কতো শিশুর জীবন জন্মাতেই মৃ*ত্যুর হাতছানি পায়।জানিনা এসবের শেষ কোথায়।এর জন্য নিজেকে অপরাধী ভাববেনা।তোমার মতো মহান কয় জন আছে বলো।যারা অবহেলায় পরে থাকা বাচ্চা বাসায় নিয়ে আসার কথা ভাবে।
সজিব সেদিন রাত পর্যন্ত চুপচাপ মা এর পাশে ছিলো।একটা শব্দও করেনি।রাতের খাবারও খাওয়ানো যায়নি।ঘুমাবে বলে ১২টার দিকে নিজের রুমে যায়।মাঝ রাতে যুঁথির ঘুম ভাঙতেই সজিব এর কথা মনে পরলো।বিছানা থেকে উঠে দেখে দরজা ভিড়ানো।ঢেকে রুমে ঢুকতেই দেখে রঙ তুলিতে ক্যানভাসে আঁকা মায়াবী আঁখিদ্বয়।সেই থেকে রোজ নিয়ম করে তার রাত জেগে একই কাজ।
যুঁথি জানালার পর্দা টেনে একপাশে নিলো।থাই গ্লাস ভেদ করে রুমে আলোকরশ্মি আগমন করলো।তারপর ফ্যান এর সুইচ অফ করতেই সজিব এর সাড়া পাওয়া গেলো,
--উফ আম্মু, তুমি সবসময় আমাকে জ্বালাও
--উঠেন বাপজান।নাস্তা রেডি করেছি।আজ ক্লাস আছে, ভুলে গেলে হবে।
রিকশার হুডি টানতেই সজিব বললো,
--হুডি উঠাবেন না মামা
--আইজ অনেক রইদ উঠছে।হুডি না দিলে খারাপ লাগবো।
--না, সমস্যা নেই আমার
একই রিকশায় তার নিত্য দিনের আসা-যাওয়া।রিকশাওয়ালা মামা খেয়াল করলো তার চোখের চাহনি রাস্তার আশেপাশে নজর রাখে।ডাস্টবিনের পাশে যেনো সেই মায়াবী আঁখিদ্বয় খুঁজে ফিরে।
0 Comments