লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা
এলোমেলোভাবে রায়ানের সাথে একই বিছানায় শুয়ে আছে হীর। গ্রে কালারের স্টোনের শাড়ি টা তুর্য নিজে হীরের জন্য কিনে এনেছিল। সেই শাড়িটার অর্ধেক আঁচল মেঝেতে পড়ে আছে। এতোসব দৃশ্য মেনে নিলেও রায়হানের বুকের সাথে লেপ্টে থাকা হীরকে কোনো মতেই মেনে নিতে পারছে না তুর্য আর বাকি সবাই। কিছুক্ষণ বাদেই রায়ান আর তাফসির বিয়ে। এমন একটা সময়ে এই পরিস্থিতি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। হীরকে রায়ানের সাথে এই অবস্থায় দেখে ধীরে ধীরে তুর্যর পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। নিজের চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছে আদৌ কি সেটা সত্যি? সত্যি কি রায়ান আর হীর একসাথে!
কিছুক্ষণ আগে,,
বিয়ের দিন সকাল সকাল আফজাল সাহেবের পুরো পরিবার বিয়ের হলে এসে উপস্থিত হয়। গতকাল রাতে তুর্য অনেক চেষ্টা করেও হীরের সাথে কথা বলতে পারেনি। তবে সে ঠিক করেছে যে তাফসির বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে হীরকে সবকিছু খুলে বলে দেবে। তার মনের সব কথা, হীরের প্রতি তার সব অনুভূতি,, ভালোবাসা এবং তার করা একটি ভুলের কথাও সে হীরকে জানিয়ে দেবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি আর না। এবার সময় এসেছে তুর্য আর হীরের এক হয়ে যাবার। অনেকটা সাহস আর এক সমুদ্র ভালোবাসা বুকে নিয়ে তুর্য হীরের সামনে নিজের ভালোবাসা নিবেদনের জন্য প্রস্তুত।
.
যত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তাফসি আর রায়হানের বিয়ের সময় ততই এগিয়ে আসছে। তাফসি কে সাজানোর জন্য বিউটিশিয়ানরা এসে পড়েছে। রায়ান আর তার পুরো পরিবারও আগেই হলে এসে পড়েছে। কয়েকঘন্টা পরেই এই হলে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে।
চোখে হাজারো নতুন জীবনের স্বপ্ন সাজিয়ে বধু সাজছে তাফসি। ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে জমিয়ে এক সমুদ্র ভালোবেসে এসেছে সে রায়ানকে। আজ তার ভালোবাসা বৈধভাবে পূর্ণতা পেতে চলেছে। ভাবতেই কেমন সুরসুরি লাগছে তাফসির। তাফসির সাজ প্রায় শেষের দিকে এখন শুধু চুলে খোপা করে বিয়ের লেহেঙ্গাটা পড়া বাকি।
বেশ অনেকক্ষণ যাবত হীরকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তুর্য নিজে পছন্দ করে হীরের জন্য একটা গ্রে কালারের শাড়ি এনেছে। হীরের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করেই তার নিজের জন্য গ্রে কালারের পাঞ্জাবী। তুর্য নিজে শাড়ি টা হীরকে দিলে যদি হীর না নেয়, সেই ভয়ে তাফসিকে দিতে বলেছিল। তাফসির কোনো কথা হীর ফেলতে পারবে না এটা তুর্য খুব ভালো করেই জানে। তাই তো সেই শাড়িটা গায়ে জরিয়ে আছে হীর।
তুর্য হীরকে এদিক ওদিক কিছুক্ষণ খুঁজে কিন্তু পায় না। পরে সে নিজেই নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে রায়ান যেই রুমে ছিল সেই রুমের দরজা খুলছে না অনেকক্ষণ। রায়হানের ছোট বোন রিয়া অনেক বার দরজা ধাক্কায়। ভিতর থেকে রায়ানের কোনো সারা না পেয়ে সে তার মা-বাবাকে ডাকার জন্য সেখান থেকে চলে যায়। রায়ানের বাবা-মা আর তুর্য একসাথে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলছিলেন। সেখানে গিয়ে রিয়া রায়ানের দরজা না খোলার কথা বললে তুর্যও অনেকটা ঘাবড়ে যায়। তুর্য আর রায়ানের বাবা-মার পিছন পিছন তাফসীর বাবা-মা ও সেখানে উপস্থিত হয়। কয়েকবার রায়ানের নাম ধরে ডাকার পরও কোন সাড়া না পেলে দরজা ভাঙতে বাধ্য হয়। হট্টগোলের শব্দে তাফসিও সেখানে এসে উপস্থিত হয়। দরজা খুলতেই হীর আর রায়ান কে সবাই একই বিছানায় একে অপরের সাথে লেপ্টে থাকা অবস্থায় পায়।
আফজাল সাহেব, তমা বেগম, হাফসা বেগম, তুর্য আর রায়ানের বাবা-মা মূর্তির মত ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতির গম্ভীরতা বুঝতে পেরে রিয়া দৌড়ে গিয়ে রায়ান ক জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। তমা বেগম তার মেয়ের জামাইকে হীরের সাথে দেখে রাগে বিস্ফোরিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে বেড সাইড টেবিলে রাখা পানি ভর্তি গ্লাস হাতে নিয়ে হীরের মুখে ছুড়ে মারলো। আচমকা শরীরে পানি পড়ায় হীর আর রায়ান দুজনেই চমকে উঠে বসলো। চোখ মুখ হাত দিয়ে মুছে সামনে তাকাতেই বাড়ির সবাইকে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুক কেঁপে উঠল হীরের। কি এমন অন্যায় করেছে সে,, যার জন্য সবাই তার উপর এতটা রেগে আছে! পাশ ফিরে তাকাতেই আরেকটা ঝটকা লাগল হীরের। তার পাশে রায়ান কেনো বসে আছে? চোখ ফিরিয়ে নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই যেনো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে তার। শাড়ির আঁচল টেনে নিজের শরীরকে ঢেকে নিলো হীর। হীরের মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। কাল সকাল থেকে জ্বর তারওপর কাল রাত থেকে না খাওয়া এর কারণেই সে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সে যে মাথা ঘুরে ঘুরে এই রুমে পড়ে ছিল সেটা সে নিজেও জানে না। আর রায়ান তার সাথে কিভাবে এলো এই ব্যাপারে তারও কোন হদিস নেই।
পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। হীল আর রায়ান দুজনেই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ান কিছু বলছে না আর হীরের বলার মত কিছুই নেই। কারন সে কিছুই জানে না কি হয়েছিল আর কি হচ্ছে। তবে এটুকু বুঝতে পারছে তার দ্বারা অনেক বড় কোনো অন্যায় হয়েছে।
নিরবতা ভেঙ্গে তমা বেগম বাজখাই কণ্ঠে বলে উঠলেন,
-- এই দিন দেখার জন্যই তোকে এত আদর যত্ন করে বড় করেছিলাম তাই না রে হীর? কি না করেছি তোর জন্য আমরা আর তুই কিনা আমার মেয়ের সংসারে আগুন লাগিয়ে দিলি!
আফজাল সাহেব তমা বেগমকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করছেন।
-- আহা তমা! থামো। এসব কি বলছো তুমি?
তমা বেগম আফজাল সাহেব কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আবার বলতে শুরু করলেন।
-- এই প্রতিদান দিলি তুই আমাদের আদর-যত্নের। আমরা তোকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিলাম আর সেই তুই কিনা আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলি। আমার মেয়ের হবু স্বামীর সাথে ছিঃ! এসব করার আগে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে পারলি না তুই।
-- বড় মা বিশ্বাস করো আমি কিছুই করি নি। এখানে কি হয়েছে আমি কিছুই জানি না।
-- বিশ্বাস আর তোকে? তুই যা করেছিস তারপর তোকে আর বিশ্বাস করা সম্ভব না।
হীর কাঁদতে কাঁদতে আফজাল সাহেবের কাছে গেলো।
-- বড় বাবা তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো তাই না। তুমি তো জানো আমি এমন কিছুই করতে পারি না।
আফজাল সাহেব কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন হয়তো সে বিশ্বাসের চেয়ে চোখের দেখা কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। হীর কিছুক্ষণ আকুল দৃষ্টিতে তার বড় বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশ হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। হীরের কান্নাভেজা অস্থির দৃষ্টি বাড়ির সবার দিকে আটকে যাচ্ছে বারবার। সবার চোখে তার জন্য একফোঁটা বিশ্বাস খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কারো চোখে আজ হীরের প্রতি কোন বিশ্বাস দেখা যাচ্ছে না।
তাফসি মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। তার সামনে তার ছোটবেলার ভালোবাসা, তার হবু স্বামী অন্য একটা মেয়ের সাথে এই অবস্থায়! সেই মেয়েটাও তার নিজের ছোট বোনের মতো। এই মুহূর্তে তার প্রচুর আর্তনাদ করা উচিত। তার কান্না করা উচিত, হীর আর রায়ানকে দোষারোপ করা উচিত। কিন্তু সে এতোটা নীরব কেনো? কেনো সে কিছুই বলছে না। তাফসির এই নীরবতাকে হীর ভীষণ ভয় পাচ্ছে। সে সাহস পাচ্ছে না তাফসির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর।
সবাই হীরকে অবিশ্বাস করলেও তুর্য কিছুতেই চোখের দেখাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার হীর কিছুতেই এমন করতে পারেনা। হীরের চরিত্রে দোষ... না, না এটা সম্ভব নয়। হীর কখনই এটা করতে পারে না। এমনিতেও সে হীরকে ভুল বুঝে অনেক কষ্ট দিয়েছে।
0 Comments