লেখিকাঃ তানজিল মীম
দিনটি শুক্রবার। পরন্ত বিকেলে মুখ ভাড় করে ছাঁদের ছোট্ট চিলেকোঠা ঘরে বসে আছে তানজু। তার বড্ড মন খারাপ হচ্ছে। এই মনখারাপের একমাত্র কারণ হলো তার কাজিন রিয়াদ ভাই তাকে বাদে বাকিসব কাজিনদের নিয়ে ঘুরতে গিয়েছে। তানজুর দোষ ছিল সে দুপুরে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমিয়ে ছিল তাতে কি– তাকে কি একবার ডেকে তুলে নিয়ে যাওয়া যেত না। ঘুম থেকে উঠে যেই না শুনেছে সবাই তাকে রেখে ঘুরতে গেছে সেই থেকে মনখারাপ, মুখ ভাড় তানজুর। রাগের বসে কাঁচের গ্লাসটা চাপড়ে ধরে ভেঙে ফেলেছে। এবং পরিশেষে হাত কেটে যগন্য অবস্থা। ইদানীং তার রাগ বেড়েছে সামান্য ব্যাপারগুলোতেও সে মারাত্মক রেগে যায়। বাড়ির সদস্যরা মনে করছেন রিয়াদের হাওয়া গায়ে লেগেছে। আগে রিয়াদ রাগ দেখাতো, এখন তানজু দেখায়।'
বর্তমানে ছাঁদের চিলেকোঠায় দরজা আঁটকে মুখ ভাড় করে বসে আছে তানজু। বিকেলের ঠান্ডা বাতাস জানালা ভেদ করে তার গাঁ ছুঁইয়ে। হাতের ব্যান্ডেজ করা হয়নি। কোনোরকম কাপড় পেঁচিয়ে বসে আছে। হঠাৎ ছাঁদের দরজায় খটখট করে আওয়াজ আসলো। তানজু গুরুত্ব দিল না। আবারও আওয়াজ আসলো তানজু রাগ নিয়ে বলল, “দরজা ধাক্কা দিয়ে লাভ নেই, আমি দরজা খুলব না।”
ওপাশের কেউ কথা বললো না। অনবরত দরজা ধাক্কানোর শব্দ শোনা গেল। তানজু বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি বলছি না দরজা খুলব না চলে যাও মা।”
এবার কণ্ঠ শোনা গেল। এক পুরুষালির ভাড়ি কণ্ঠে শুধাল রিয়াদ, “দরজা খোল তানজু, না হলে দরজা ভেঙে ভিতরে আসব আমি।”
রিয়াদের কণ্ঠটা কানে আসতেই তানজু যেন অবাক না হয়ে পারল না। তবুও দরজা খুলল না। সে বলল,
“আমি দরজা খুলব না রিয়াদ ভাই।”
“আমি কিন্তু সত্যি সত্যি দরজা ভেঙে ভিতরে আসব তানজু।”
“তোমার যা মন চায় তাই কর তবুও আমি দরজা খুলব না। যাদের নিয়ে ঘুরতে গেছ তাদের নিয়ে থাকো।”
মিনিট দুই কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তানজু ভাবে চলে গেছে। এরপরই বিকট শব্দে চিলেকোঠার পুরো রুমে কম্পন হলো। তানজু ভীমড়ি খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে তার বিয়াদ ভাই সত্যি সত্যিই দরজা ভেঙে ফেলেছে। স্তব্ধ বনে গেল তানজু। তাকাল রিয়াদের দিকে। তার চোখে প্রবল রাগ। তানজু শুঁকনো ঢোক গিলল। রাগটা কি বেশি দেখিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তার মনে হয় খুব একটা রাগ দেখায়নি। রাগ করে দরজা আঁটকে বসা থাকাটা খুব বেশি রাগ দেখার মধ্যে পড়ে না। তানজু জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। নিজেকে যথেষ্ট সাহসী রাখার চেষ্টা করল। রিয়াদ ভিতরে ঢুকল এরই মাঝে। হন হন করে এগিয়ে এসে তানজুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “দরজাটা খুললি না ক্যান?”
তানজু মুখ ভাড় করে বলল,
“তাই বলে ভেঙে দিবে।”
“আমার রাগ সম্পর্কে কি তোর ধারনা নেই?”
তানজু অবাক হয়ে বলল,
“তোমার রাগ হবে কেন?– রাগ করেছি আমি।”
আচমকাই তানজুর ডান হাতটা চেপে ধরল রিয়াদ। তানজু মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে। রিয়াদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“এগুলো কি করে হলো?”
“তোমায় বলতে বাধ্য নই আমি। হাত ছাড়ো আমার।”
রিয়াদ ছাড়ল না। আরো শক্ত করে চেপে ধরল হাত। তানজু ব্যাথা হাতে কুঁকড়ে উঠল, “ভাইয়া হাত ছাড়ো আমার লাগছে।”
তানজু তাকাল না। কেন তাকাবে–সে রাগ করেছে। রিয়াদের তার রাগ কন্ট্রোলে আনার চেষ্টা চালালো। পুনরায় বলল, “তাকা আমার দিকে।”
তানজু মাথা নুইয়ে বলল,
“কেন তাকাব আমি– তুমি আমায় রেখে বাকি সবাইদের নিয়ে কিভাবে ঘুরতে গেলে?”
“তুই ঘুমিয়ে ছিলি।”
এবার তানজু তাকাল রিয়াদের দিকে। চোখে পানি টলমল করছে। সে বলল,
“ঘুমিয়ে ছিলাম, আমায় কি ডাকা যেত না?”
“আমি ভেবেছিলাম কাঁচাঘুম ভেঙে দিলে তুই রাগ করবি।”
“আমায় ছাড়ো।”
“ছাড়ব কেন– ছাড়ার জন্য ধরেছি নাকি।”
“আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি।”
“তো।”
“বাড়াবাড়ি হচ্ছে ভাইয়া।”
রিয়াদ ছেড়ে দিল। চিলেকোঠার ছোট্ট চৌকিতে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“বিয়ের আগেই এত রাগ।”
“আমি তোমায় বিয়ে করব না।”
“তোকে করতে হবে না আমি করব।”
“আমি মাকে আজই বারন করে দিব।”
“সাহস থাকলে কর গিয়ে।”
তানজু গেল না। ঠায় বসে রইল। রিয়াদ বসল পাশ দিয়ে আসার সময় ফাস্ট এইচ বক্সটা নিয়ে এসেছিল। কতক্ষণ আগেই তানজুর মা রিয়াদকে ফোন করে সবটা বলে, তানজুর রাগ করা, রাগ করে গ্লাস ভাঙা, হাতে ব্যাথা পাওয়া আর পরিশেষে চিলেকোঠার ঘরে অভিমান নিয়ে বসে থাকা। রিয়াদ তানজুর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সেই ছোট বেলা থেকে। খুব শীঘ্রই তাদের বিয়ে পড়ানো হবে। আজ হঠাৎ করেই শিফারা বায়না ধরে তারা ঘুরতে যাবে। রিয়াদকে শুক্রবার ছাড়া তেমন একটা পাওয়া যায় না। তাই তাদের আবদার ঘুরতে নিয়ে রিয়াদকেই যেতে হবে। তানজুকে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ও ঘুমিয়ে থাকায় রিয়াদ নিল না। কিন্তু রিয়াদ কল্পনাও করেনি ঘুম ভাঙতেই এমন পাগলামি করে বসবে তানজু। রিয়াদরা কাছেই ছিল তাই তো কথা শুনতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুট্টে চলে আসলো।'
রিয়াদ কিছু পলক তানজুর দিকে তাকিয়ে থেকে হাতের প্যাচানো কাপড়টা খুলল। রক্ত শুঁকিয়ে হাতের সাথে লেগে পড়েছে কিছুটা। কাপড় ধরে টানতেই তানজু ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল। বলল, “লাগছে।”
রিয়াদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলল,
“রাগ দেখানোর আগে মনে ছিল না।”
“আমি রাগ দেখাইনি, একা একা হয়ে গেছে।”
রিয়াদ হাতে মলম লাগাতে লাগাতে বলল,
“লজ্জা করে না অন্যের ডায়লগ চুরি করে বলতে।”
“আমি কারো ডায়লগ চুরি করিনি, একা একা হয়ে গেছে।” (পলক ফ্যাক্ট)
“তানজু...
হেঁসে ফেলল তানজু। রিয়াদ সযত্নে তার হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আর কখনো যেন এমনটা করতে না দেখি।”
“কথা দিতে পারছি না।”
“থাপড়িয়ে কান একদম লাল করে দিব।”
“সে তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো।”
“তুই তো দেখছি আগের চেয়ে বড্ড কথা শিখেছিস।”
তানজু কথা বললো না। আচমকাই রিয়াদকে জড়িয়ে ধরল। রিয়াদ অবাক হয়ে গেল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কি হলো?”
“তুমি আমায় ভালোবাসা ছেড়ে দিবে না তো।”
তানজুর কথা শুনে রিয়াদ কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে অবাক স্বরে বলল,
“কি হয়েছে তোর?”
“কিছু হয়নি।”
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল তানজু। রিয়াদের যেন বিস্ময়ের শেষ নেই। সে তানজুকে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। তানজু ছাড়ল না। রিয়াদ বলল, “কি হয়েছে এভাবে কাচ্ছিস কেন?”
তানজু উত্তর দেয় না। রিয়াদ অস্থির কণ্ঠে শুধায়, “কেন বুঝিস না তুই কাঁদলে আমারও যে ব্যাথা লাগে। কি হয়েছে বল আমায়?”
তানজু তবুও কাঁদল। অশ্রুভেজা কণ্ঠ নিয়ে বলল,
“তুমি আমায় ছেড়ে কখনো যাবে না তো। আমি না আজ একটা স্বপ্ন দেখেছি। দেখি তুমি আমায় না বলে কোথায় যেন চলে গেছ। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম জানো। তারপর ঘুম ভেঙে যেই শুনলাম তুমি সত্যি সত্যিই না বলে শিফাদের নিয়ে চলে গেছ। তখন আমার আরো কষ্ট হয়েছে। বিশ্বাস কর আমি রাগ করেনি। আমি শুধু অভিমান করে চিলেকোঠায় বসে ছিলাম। কষ্টে আমি কাঁচের গ্লাসটা চেপে ধরেছিলাম কখন যে ভেঙে গেল বুঝতে পারিনি। আমায় ক্ষমা করে দেও ভাইয়া।”
রিয়াদ এতক্ষণে বুঝল সবটা। সে মনে মনে খুশি হলো। যাক সে একা শুধু তানজুকে হারানোর ভয় পায় না, তানজুও তাকে হারানোর ভয় পায়।'
সময় যায় তানজু রিয়াদকে ছাড়ে না। রিয়াদও আর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে না। ধীরে ধীরে প্রকৃতি হয় শান্ত। দূর আকাশের আলোরা একটু একটু করে নিভছে প্রায়। রিয়াদ ছোট্ট শব্দে ফিসফিস করে বলে, “ভালোবাসি।”
তানজুও খুশি হয়ে আলতো স্বরে আওড়ায়, “আমিও ভাইয়া।”
রিয়াদ অভিমান নিয়ে বলে,
“এক তো বলিস ভালোবাসিস আরেকদিকে ডাকিস ভাইয়া। ব্যাপারটা কেমন না!”
রিয়াদের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। হৃদয় জুড়ে এক শীতল হাওয়া বয়ে গেল। সে চোখ বন্ধ করে বলল, “তোকে এত ভালো কেন বাসি আমি!”
প্রশ্ন করলেও উত্তর আসলো না। এই প্রশ্নের উত্তর কি আধতেও কোনো প্রেমিক জানে। বোধহয় কেউ কেউ জানে। কেউ কেউ না।'
অতঃপর এখানেই শেষ হলো রিয়াদ-তানজুর এক চিলতে গল্পের অভিমানের চিলেকোঠা!'
0 Comments