লেখকঃ পল্লি কবি জসীম উদ্দীন
আজাহের ছেলেকে লইয়া মেছো হাটে আসে। ইলিশ মাছের দোকানের চারধারে বেশী ভীড়। তাম্বুলখানা যাইয়া অবধি আজাহের ইলিশ মাছ খায় নাই। আলীপুর থাকিতে মাঝে। মাঝে পদ্মা নদীতে যাইয়া সে ইলিশ মাছ মারিয়া আনিত। লোকের ভীড় ঠেলিয়া আজাহের ইলিশ মাছের ডালির কাছে যাইয়া উপস্থিত হইল। বছির তাহার পিছনে। নাড়িয়া চাড়িয়া বড়টা ছোটটা ইলিশ মাছ ধরিয়া দেখিতে আজাহেরের আরাম লাগে। পয়সা দিয়া ত সে কিনিতে পারিবে না।
“বলি, এই মাছটার দাম কত অলদার মশায়?” যাহারা বাজারে মাছের ব্যবসা করে তাহাদিগকে হাওলাদার বা কৈবর্ত বলে। আজাহেরের হাত হইতে মাছটি লইয়া পরীক্ষা করিয়া কৈবর্ত বলে, “দাম পাঁচ সিহা।”
আজাহের জানে মাছের বেপারীরা খরিদ্দারের কাছে মাছের ডবল দামের মতন প্রথমে চাহে। অর্ধেক দামের উপরে দুই একআনা বেশী বলিলেই সে মাছটি তাহাকে দিবে। আজাহের বলে, “আট আনা নেন অলদার মশায়।”
“আরে মিঞা! যে আতে মাছ দরছাও হেই আতখান বাড়ি যায়া ধূইয়া তাই রাইন্দা খাও গিয়া। আট আনায় ইলশা মাছ খাইছ কুনুদিন?”
আজাহেরের গায়ের শত ছিন্ন মলিন কাপড় দেখিয়া দোকানী তাহাকে গরীব বলিয়া চিনিতে পারিয়াছে।
“আইচ্ছা নয় আনা লেন।” মাছের বেপারী অন্য লোকের সঙ্গে কথা বলে। আজাহেরের কথার উত্তর দেয় না। বাপের অপমানে বছিরের কাদিতে ইচ্ছা করে। সে ভীড়ের ভিতর হইতে বাপকে টানিয়া লইয়া আসে। “কাম নাই বাজান, আমাগো ইলিশ মাছ কিনুনের।” আজাহের ওধারের পুঁটি মাছের ডালির কাছে যাইয়া মাছ দর করে। ডালির ঢাকনির উপরে ভাগে ভাগে পুঁটি মাছ সাজানো।
“কত কইরা বাগ দিছ অলদার মশায়?”
“চাইর পয়সা কইরা ভাগ।” মাছের উপর পানির ছিটা দিতে দিতে বেপারী বলে।
“আরে বাই! এক পয়সা বাগ ন্যাও।”
“তা অবিন্যা মিঞা বাই!”
পুঁটি মাছের বেপারীর কথায় তেমন ঝাঁজ নাই। বরঞ্চ একটু দরদ মিশানো।
দুই পক্ষে অনেক কাকুতি-মিনতি কথা বিনিময়ের পরে দুই পয়সা করিয়া পুঁটি মাছের ভাগ ঠিক হয়। ধামার মধ্যে মাছ উঠাইতে উঠাইতে আজাহের অনুনয়-বিনয় করিয়া আরও কয়েকটি মাছ চাহিয়া লয়।
এইভাবে হাট করা শেষ হইলে আজাহের বাড়ি রওয়ানা হয়। মেছো বাজার পার হইলেই রাস্তার দুই ধারে মেঠায়ের দোকান। বছির বলে, “বাজান! পানি খাব।” ছেলের মুখ শুকনা। সেই সকালে খাইয়া আসিয়াছে। আহা কত যেন ক্ষুধা লাগিয়াছে! পয়সা থাকিলে পেট ভরিয়া সে ছেলেকে মিষ্টি খাওয়াইত। তবু খাক, পানির সঙ্গে কিছু সে খাক। মিষ্টির দোকানে সব চাইতে সস্তা দামে বিক্রি হয় জিলিপি। অনেক দরদস্তুরের পর দোকানী এক পয়সায় দুইখানা জিলিপি বেঁচিতে স্বীকৃত হইল। পাতায় করিয়া দুইখানা জিলিপি শূন্য হইতে দোকানী বছিরের হাতে ঘুড়িয়া দিল। পাছে মুসলমানের ছোঁয়া লাগিয়া। তাহার দোকানের সমস্ত মিষ্টি নষ্ট হইয়া যায়। বছির দুই হাত পাতিয়া সেই মিষ্টি গ্রহণ করিল। দোকানের বাহিরে টুল পাতা। তাহার আশেপাশে গা-ভরা ঘা-ওয়ালা কুকুরগুলি শুইয়া আছে। সেই টুলের উপর বসিয়া মুসলমান খরিদ্দারেরা মিষ্টি খাইয়া থাকে। হিন্দু খরিদ্দারেরা দোকানের মধ্যে যাইয়া চেয়ারে বসিয়া খাবার খায়। সেই কুকুরগুলিরই পাশে পিতলের দুই তিনটি নোংরা গ্রাস মাটিতে গড়াগড়ি যাইতেছে। তাহারই একটিকে বাম পায়ে খাড়া করিয়া দোকানী শূন্য হইতে ঘটিভরা পানি ঢালিয়া দিল। আস্তে আস্তে সেই দুইখানা জিলাপী বছির বহুক্ষণ ধরিয়া খাইল। তারপর সেই গেলাসের পানিটুকু ঢক ঢক করিয়া খাইয়া দোকানীর কাছে আরও পানি চাহিল। দোকানী তাহার গ্লাসে পূর্ববৎ শূন্য হইতে ঘটিভরা জল ঢালিয়া দিল। যতক্ষণ ছেলে খাইতেছিল ততক্ষণ আজাহের মিষ্টির দোকানের কঁচের আবরণীতে রক্ষিত সন্দেশ, রসগোল্লা, পানতোয়া প্রভৃতি স্তরে স্তরে সাজানো নানারকমের মিষ্টিগুলির উপর চোখ বুলাইয়া লইতেছিল। ইহাতে তাহার অন্তরের অন্তঃস্থলে কি যেন আরাম বোধ হইতেছিল।
তাহাদেরই মত বহুলোক হাট হইতে বদরপুরের রাস্তা বাহিয়া নানা গাল-গল্প করিয়া । বাড়ি ফিরিয়া যাইতেছিল। কে আগে-হাটে দুধ বেচিয়া দুই পয়সা জিতিয়া আসিয়াছে; কে কোন বড়লোক মাড়োয়ারীকে তোষামোদ করিয়া কাপড়ের দাম কম করিয়া লইয়াছে, এই সব গৌরবজনক কথায় সকলেই মশগুল। আজাহেরও সুযোগ বুঝিয়া কি করিয়া পাঁচ আঁটি চেঁকি শাক দিয়া এক ভদ্রলোকের বউ এর কাছ হইতে চার আনা বকশিস্ লইয়া আসিয়াছে। সেই গল্পটি বলিয়া ফেলিল। পার্শ্ববর্তী শ্রোতা শুনিয়া অবাক হইয়া বলিল, “কওকি মিঞা! চাইর আনা বকশিস পাইলা?”
আজাহের খুশী হইয়া তার হাতে একটা বিড়ি আগাইয়া দেয়। “খাও মিঞা, তামুক খাও।”
অপর পাশের লোকটি আজাহেরের এই গৌরবের কাহিনী শুনিয়া হিংসায় জ্বলিয়া যাইতেছিল। সে আরও জোরের সঙ্গে বলিতে লাগিল, “এড়া আর কি তাজ্জবের ব্যাপার? হোন মিঞা! আমার একটা গল্প হোন আগে।”
“আচ্ছা কন বাই কন।” সকলে তাহার কথায় মনোযোগী হইল। লোকটি একটু কাশিয়া আরম্ভ করিল,–
“আইজকা আটে গেলাম তরমুজ লয়া। এক বাবু আইসা কয়, তরমুজের দাম কত নিবি? আমি জানি তরমুজির দাম চাইর আনায়ও কেও নিবিন্যা, কিন্তু আল্লার নাম কইরা দশ আনা চায়া বসলাম। বাবু কয়, অত দাম কেনরে? আট আনা নে? আমি বাবি আরও একটু বাড়ায় নি। আমি কইলাম, বাবু! এত বড় তরমুজডা দশ আনার কম দিব না। বাবু তহন নয় আনা কইল। আমি অমনি দিয়া ফেলাইলাম। হেই বাবুরে চিনছ তোমরা? গোল তালাপের পূর্ব কোণায় বাড়ি।”
একজন বলিয়া উঠিল, “চিনব না ক্যান? করিম খার ছাওয়াল। ওর বাবা সুদীর টাহা জমায়া গ্যাছে। কত লোকের বিট্যা-বাড়ি বেইচা খাইছে।”
আর একজন বলিল, “ওসব তলের কতা দিয়া কি অবি। আরে মিঞা খুব বাল জিতন জিতছাও। বিড়ি দেও দেহি?”
তলের খবর ইহারা কেহই জানিতে চাহে না। সহজ সরল এই গ্রাম্য লোকগুলি। কত শত শত শতাব্দী ভরিয়াই ইহারা ধনিকদের হাতে বঞ্চিত হইয়া আসিতেছে। কতই অল্পে ইহারা তুষ্ট–কতই সামান্য ইহাদের আকাভক্ষা। শহরের আরাম-মঞ্জিলে বসিয়া যাহারা দিনের পর দিন ইহাদের যথা-ধ্বস্ব লুটিয়া লইতেছে, দিনের পর দিন যাহারা ইহাদিগকে অর্ধাহার অনাহারের পথে ঠেলিয়া দিতেছে তাহাদের প্রতি ইহাদের কোনই অভিযোগ নাই।
লোকটি গামছার খোঁট হইতে বিড়ি বাহির করিয়া আশেপাশের সকলকেই একটা একটা করিয়া দিল।
বাড়ি ফিরিতে আজাহেরের প্রায় সন্ধ্যা হইল। সারাদিনের পথ চলায় এবং ক্ষুধায় ছেলেটি বড়ই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। সামান্য কিছু খায়াই সে ঘুমাইয়া পড়িল। ছোট বোন বড়ু আসিয়া কত ডাকাডাকি করিল। সারাদিনে এ-বনে ও-বনে ঘুরিয়া কত আশ্চর্য জিনিস সে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিল। সেগুলি মিয়াবাইকে না দেখাইলে কিছুতেই সে তৃপ্ত হইতে পারিতেছিল না। কিন্তু গভীর ঘুমে বছির অচেতন হইয়া পড়িল। ছোট বোন বড় মুখ ফুলাইয়া অভিমান করিয়া খানিক কাদিল। তারপর বাপকে ডাকিয়া তাহার আশ্চর্য জিনিসগুলি দেখাইতে লাগিল। বয়স্ক পিতা সেগুলি দেখিয়া অভিনয় করিয়া যতই আশ্চর্য হউক তার মিয়া ভাই-এর মত আনন্দে ডগমগ হইতে পারিল না। বারবার অন্যমনস্ক হইয়া পড়িতে লাগিল। ছোট্ট বক্তার কাছে ইহা ধরা পড়িতে বেশী সময় লাগিল না। তখন সে হাল ছাড়িয়া দিয়া নিজের জিনিসগুলি গুছাইয়া রাখিতে প্রবৃত্ত হইল।
প্রভাত না হইতেই আজ বড়ু আগে উঠিল, “ও মিয়া বাই! শিগগীর উঠ। দেহ আমি জঙ্গলের মদ্দি কি হগল কুড়ায়া পাইছি!”
চোখ ডলিতে ডলিতে বছির ঘুম হইতে উঠিয়া ছোট বোনের সংগৃহীত জিনিসগুলি দেখিতে লাগিল। লাল টুকটুক করে এত বড় একটা মাকাল ফল। রাশি রাশি লাল কুঁচ, এক বোঝা কানাই লাঠি আরও কত কি।
“এ হগল কনহানে পাইলিরে?” বড় ভাই বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল। ঘাড় দোলাইয়া দোলাইয়া সুন্দর মুখোনি বাকাইয়া, ঘুরাইয়া ছোট বোন তাহার বিশদ বর্ণনা দিতে লাগিল।
“ওই জঙ্গলডার মদ্দি আমগাছের উপর বায়া গ্যাছে মাকাল ফলের লতা। কত ফল ঝুলত্যাছে গাছে। এহেবারে হিন্দুরের মত লাল টুকটুক করতাছে। তুমি চল মিয়া বাই, আমারে পাইড়্যা দিব্যানে।”
“চল,” বলিয়া বছির ছোট বোনটিকে সঙ্গে লইয়া জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল।
যে আমগাছটিতে মাকাল ফল ঝুলিতেছিল সেই গাছের তলায় আসিয়া তাহারা দেখিল, ফুলু তার বড় বাই নেহাজদ্দী ও গেদাকে সঙ্গে লইয়া পূর্বেই সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। এক লাফে বছির গাছে উঠিয়া মাকাল ফল ছিঁড়িয়া তলায় ফেলিতে লাগিল। নেহাজদ্দী ও গেদার কাছে এ কার্যে কোনই উৎসাহ জাগিতেছিল না। নেহাজদ্দী বনের মধ্য হইতে একটা গুইসাপ ধরিয়া লতা দিয়া বাধিয়া সেই গাছের তলায় টানিয়া আনিল। তাহা দেখিয়া বড় চিৎকার করিয়া উঠিল। ফুলু খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। এই সব জন্তু তাহাদের নিত্য খেলার সাথী। তাহাদিগকে দেখিয়া ভয় পাইতে সে কাহাকেও দেখে নাই। গুইসাপ দেখিয়া বছিরও গাছ হইতে নামিয়া আসিল। তখন সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিল–গুইসাপের একটা বিবাহ নিশ্চয় দিতে হইবে। কিন্তু কাহার সঙ্গে ইহার বিবাহ দেওয়া যায়। প্রথমেই নেহাজীর বাড়ির কুকুরটির কথা মনে হইল। কিন্তু এমনতর রাগী বরের সঙ্গে উহার বিবাহ হইলে কনে কিছুতেই সুখী হইতে পারিবে না। দিনরাত বরের। মুখের ঘেউ ঘেউ দাঁত খিচুনী আর কামড় খাইতে হইবে। তখন অনেক যুক্তি করিয়া স্থির। হইল, ফুলুর আদরের বিড়ালটির সঙ্গে ইহার বিবাহ হইবে। দৌড়াইয়া যাইয়া ফুলু বাড়ি হইতে বিড়ালটিকে লইয়া আসিল। বরের মা কিছুতেই ভয়ে মেয়ের কাছে যাইতে পারে না। সে গুই-সাপের দড়িটি ধরিয়া দূরে দাঁড়াইয়া রহিল। অনেক টানাটানিতে গুইসাপটি হয়রান হইয়া স্থির হইয়া পড়িয়াছিল। পূর্ব হইতেই ঠিক হইয়াছিল বছির মোল্লা হইয়া বিবাহ পড়াইবে। বিড়াল ম্যাও ম্যাও করিয়া বিবাহের কলমা পড়িল। কিন্তু গুইসাপটিকে লইয়া বড়ই মুস্কিলে পড়িতে হইল। তাহারা কাঠি লইয়া এত তাহাকে খোঁচাইল-হাতে থাপড় দিয়া শব্দ করিল, কিছুতেই সে কলমা পড়িবে না। তখন বড় যেই হাতের লতাটায় একটু ঢিল দিয়াছে অমনি গুইসাপ দৌড়। তাহারাও কলরব করিয়া তাহার পিছে পিছে চলিল।
ইতিমধ্যে আজাহের কাঠ কুড়াইতে জঙ্গলে আসিয়াছিল। ছেলেদের কলরব শুনিয়া সে নিকটে আসিয়া সমস্ত ব্যাপার দেখিল। গুইসাপটির মাথায় লতা বাধা ছিল বলিয়া সে বেশী দূর দৌড়াইয়া যাইতে পারে নাই। কাটা গাছের সঙ্গে লতা জড়াইয়া আটকা পড়িয়াছে। সে গুইসাপটি ধরিয়া তাহার মাথা হইতে লতার বাঁধন খুলিয়া দিল। সাপটি দৌড়াইয়া গভীর কাটা বনে প্রবেশ করিল।
এইবার আজাহের সব ছেলে-মেয়েদের ডাকিয়া বুঝাইয়া বলিল, “গুইসাপ মারিতে নাই। মারিলে জঙ্গলে এত সাপ হইবে যে তাহার ভয়ে কেহই বনে আসিতে পারিবে না।”
বছির জিজ্ঞাসা করিল, “কেন বাজান?”
আজাহের বলিল, “গুইসাপ হগল সাপ ধইরা খায়। যেহানে গুইসাপ আছে আর হগল সাপ সেহান ত্যা পলায়া যায়।”
তারপর সে সকলকে সঙ্গে লইয়া জঙ্গলে খড়ি টুকাইতে লাগিল।
আজ আর টেকিশাক পাওয়া গেল না। আজাহের অনেকগুলি বেতের আগা কাটিয়া লইল। শহরের লোকেরা বেতের আগা খাইতে খুব পছন্দ করে। কালকের পরিশ্রমে আজ আর বছির বাপের সঙ্গে শহরে যাইতে চাহিল না। আজাহের একাই লাকড়ীর বোঝার উপর কতকগুলি বেতের আগা লইয়া বাজারে চলিল।
এইভাবে এক একদিন আজাহের বন হইতে এক একটা জিনিস শহরে লইয়া যায়। বিক্রি করিয়া যাহা পায় তাহাতে তাহার ক্ষুদ্র পরিবারের অন্নসংস্থান হইয়া সামান্য কিছু উদবৃত্ত থাকে। বউও সারাদিন বসিয়া থাকে না। সেই যে বিদায়ের দিন মিনাজদী মাতবরের স্ত্রী তাহাকে ঢাকাই-সীমের বীজ দিয়াছিল, শ্রীচন্দনের বীজ দিয়াছিল তাহা সে ভালমত করিয়া উঠানের এ-পাশে ও-পাশে রোপিয়া দিয়াছে। দীনু মাতবরের বাড়ি হইতে বেগুনের চারা আনিয়া বাড়ির পালানে পুঁতিয়াছে। উঠানের অর্ধেকখানি ভরিয়া লাল নটে। শাকের ক্ষেত আরো রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। লাল টুকটুকে হইয়া ছোট ছোট নটে চারাগুলি উঠান ভরিয়া হাসি ছড়াইতেছে।
রাতের বেলা ছেলে-মেয়েদের পাশে লইয়া বউ ঘুমাইয়া পড়ে। চারিদিকে নিশুতি স্তব্ধ রাত্রি। আজাহেরের চোখে ঘুম আসে না। তাহার জীবনের ফেলে-আসা অতীত দিনগুলি সাপের মত তাহাকে যেন কামড়াইয়া মোচড়াইয়া দংশন করিতে থাকে। দিনের বেলা নানা। কাজের চাপে সে মনকে শক্ত করিয়া রাখে। কিন্তু রাতের বেলা যখন সকলেরই চোখে ঘুম, চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ, তখন সেই অতীত দিনগুলি একে একে জীবন্ত হইয়া তাহাকে বেষ্টন করিতে থাকে। আজাহের ভুলিয়া যাইতে চায়। আবার নতুন করিয়া ঘর-বাড়ি গড়িবে, নতুন করিয়া সংসার পাতিবে, নতুন দিনের সুখ দিয়া অতীতকে ঢাকিয়া রাখিবে। কিন্তু বালুর উপরে আঁক কাটিলে যেমন ঢেউ আসিয়া তাহা নিমিষে মুছিয়া ফেলে তেমনি তাহার ভবিষ্যতের সকল চিন্তা মুছিয়া ফেলিয়া অতীত আসিয়া সুস্পষ্ট হইয়া কথা কয়। সারাটি জীবন ভরিয়া লোকের কাছে সে শুধু অবিচারই পাইয়াছে। জীবনের সেই। প্রথম-বেলায় কতজন কত আশা দিয়া তাহাকে খাটাইয়া লইয়াছে, তারপর বেতন চাহিলে তাহাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে। সেই শঠ পাটের বেপারী মিষ্টি কথা বলিয়া নানা গাল-গল্প করিয়া তাহাকে কেমন করিয়া ঠকাইয়াছে, সেই ভণ্ড-মওলানা সাহেব তাহার শিষ্য-উপশিষ্য লইয়া কত কৌশল-জাল বিস্তার করিয়া তাহাকে লুটিয়া লইয়া গিয়াছে, সেই প্রবঞ্চক মহাজন,–তাহার কথা ভাবিতেও গা শিহরিয়া উঠে, কেন–কেন ইহারা এমন করে! আর কেন–কেন এতদিন সে নীরবে ইহাদের অত্যাচার সহ্য করিয়া আসিল? কেন–কেন সে সাপের মতন ইহাদের ঘাড়ে ঝাপাইয়া পড়িল না? সে যে সব কিছু এতদিন নীরবে সহ্য করিয়া আসিয়াছে সে জন্য আজ সে নিজেকেই ক্ষমা করিতে পারিতেছে না। অপমানে ধিককারে আজ তার নিজের দেহের মাংস টানিয়া ছিঁড়িয়া চিবাইয়া খাইতে ইচ্ছা করিতেছে। কোন আদিম কালের হিংস্র রক্ত-ধারা যেন তাহার সকল অঙ্গে নাচিয়া উদ্দাম হইয়া উঠে। তারই সঙ্গে সঙ্গে তার মনের গহন অন্ধকারে অভিনব হিংস্র বৃত্তিগুলির জন্ম হইতে থাকে। আজাহের কিছুতেই স্থির হইয়া থাকিতে পারে না। রাতের অন্ধকারের ফলকে ছবির পর ছবি ফুটিয়া উঠে–এত স্পষ্ট–এত জীবন্ত–এত হিংস্র–এত বিষাক্ত। দেশে দেশে যুগে যুগে এরাই মানুষকে পথে চলিতে দেয় না। মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়া যায়–মুখের হাসি-দীপ এক থাপড়ে নিবাইয়া দিয়া যায়–কোলের শিশু-কুসুম ঝরিয়া পড়ে, মায়ের বুক-ফাটা আর্তনাদে খোদার আসমান ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহে, কিন্তু ইহারা তাহাতে ভ্রূক্ষেপও করে না। কেন–কেন এমন হইবে? এমন কি কেহ কোথাও নাই যে ইহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারে? যাহার হুংকারে মুহূর্তে ইহাদের সকল অত্যাচার থামিয়া যায়?
আজাহের গৃহের মধ্যে চাহিয়া দেখে তাহার ছেলে বছির মায়ের গলা ধরিয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। এই ছেলেকে সে লেখাপড়া শিখাইয়া মানুষ করিয়া তুলিবে। তিলেতিলে তাহার অন্তর সে এই সব অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে বিষাইয়া তুলিবে। আজাহের বাঁচিয়া থাকিবে। শুধু এই একটি মাত্র আশা বুকে লইয়া সে আবার নূতন করিয়া ঘর গড়িবে। দরকার হইলে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করিবে, একবেলা খাইবে–আধ পেটা খাইবে, তবু সে তাহার ছেলেকে লেখাপড়া শিখাইবে। তাহার হাতের লাঠিতে বনের বাঘ পালায়হিংস্র বিষধর সাপ গর্তে লুকায় কিন্তু কলমের লাঠির সঙ্গে সে যুদ্ধ করিতে জানে না। সেই কলমের লাঠি সে তাহার ছেলের হাতে দিবে। ভাবিতে ভাবিতে আজাহেরের চোখ ঘুমে ভাঙ্গিয়া আসে। শেষ রাত্রের শীতল বাতাসে সে ঘুমাইয়া পড়ে।
0 Comments