Ad Code

ইরিনা পর্ব - ১০

লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ

তাঁর মন খুবই খারাপ।

Facebook  প্ৰায় এক ঘণ্টা তিনি তার ঘরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত হাঁটলেন। তার স্বভাব হচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর সিডিসিকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলা। এই এক ঘণ্টায় তিনি এক বার সিডিসিকে ডাকেন নি। দুপুরের খাবার খান নি। সবচে বড় কথা, একবারও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মুগ্ধ চোখে দেখেন নি। এইবার দাঁড়ালেন। নিজের চেহারা দেখে তেমন কোনো মুগ্ধতা তার চোখে ফুটল না। বরং ভুরু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইলেন। যেন খুব বিরক্ত হচ্ছেন। সিডিসি। বলুন শুনছি। আমাকে কি খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, হচ্ছে। তুমি কি জান, আমি কী নিয়ে উত্তেজিত? জানি না, তবে অনুমান করতে পারি। তোমার অনুমান কী? আপনি অরচ লীওনের ব্যাপারে চিন্তিত। মোটেই না। ওকে নিয়ে চিন্তিত হবার কী আছে? কিছুই কি নেই? না, কিছুই নেই। আমি আমার জন্যে নতুন একটা নাম ভাবছি। কোনোটাই মনে ধরছে না। আপনি এই নিয়ে চিন্তিত? এমন একটা নাম হতে হবে, যা ছোট, সুন্দর এবং কিছু পরিমাণে কাব্যিক। আবার বেশি কাব্যিক হলে চলবে না। আমি কি নামের ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করব? না।
তিনি আয়নার সমানে থেকে সরে দাড়ালেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি চমৎকার একটি নাম খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি। এবার হাত মুঠো করছেন, একবার খুলছেন। খুশি হলে তিনি এমন করেন। সিডিসি। জি বলুন। তোমাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম, তুমি কর নি। ভুলে গেছ। আমি কিছুই ভুলি না। কুৎসিত রাজপুত্রদের নাম চেয়েছিলেন। নাম এবং অন্যান্য তথ্য জোগাড় করা হয়েছে। আপনাকে কি এখন দেব? না, এখন দিতে হবে না। তুমি বরং অরচ লীওনেকে পর্দায় নিয়ে এস, ওর সঙ্গে কথা বলব। ঘরের যে অংশে আয়না ছিল, সেই অংশটি অদৃশ্য হল। বিশাল এক পর্দায় অরচ লীওনের ছবি ভেসে উঠল। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। সে তার সামনে রাখা পর্দায় অসম্ভব রূপবান এক যুবকের ছবি দেখছে। সিডিসির কথা শোনা যাচ্ছে– অরচ লীওন, উঠে দাড়াও এবং অভিবাদন কর মহান গণিতজ্ঞ অমর বিজ্ঞানীকে। অরচ লীওন, উঠে দাঁড়াল। তার মুখে কোনো কথা নেই। সে এই দৃশ্যের জন্যে তৈরি ছিল না। তার ধারণা ছিল অত্যন্ত বয়স্ক এক বৃদ্ধকে দেখবে— যার মাথার সমস্ত চুল পাকা। চোখে ঘোলাটে। যে বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গিয়েছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমার অভিবাদন গ্ৰহণ করুন। গ্রহণ করা হল। তুমি বস। তুমি নিষিদ্ধ নগর সম্পর্কে অন্যায় কৌতূহল প্ৰকাশ করেছ? হ্যাঁ। কেন করেছ? করেছি, যাতে আমার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি পড়ে। কারণ আমি জানতাম কৌতূহল প্ৰকাশ করামাত্রই আপনারা তা জানবেন। আপনারা আমার সম্পর্কে কৌতূহলী হবেন। যদি আপনাদের কৌতূহল অনেক দূর পর্যন্ত জাগাতে পারি, তাহলে হয়তো— বা আপনারা আমাকে ডেকে পাঠাবেন। সরাসরি আপনাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হবে। আমি যা করেছি, এই উদ্দেশ্যেই করেছি। আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাও কেন?
কৌতূহল, শুধুই কৌতূহল। এর বেশি কিছু না? জ্বি না, এর বেশি কিছু না। কৌতূহল মিটেছে? না। এখনো বাকি? হ্যাঁ। আমি অনেক কিছু জানতে চাই। আমার মনে অনেক প্রশ্ন। আমি নিজেই সেই সব প্রশ্নের জবাব বের করেছি। আপনাদের সঙ্গে কথা বলে জবাবগুলো মিলিয়ে নিতে চাই। তোমার একটা প্রশ্ন বল। প্রশ্নটি হচ্ছে… থাক, এখন আর তোমার প্রশ্ন শুনতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যেতে পার। সিডিসি, পর্দা মুছে দাও। পর্দা অন্ধকার হয়ে গেল। তাঁর তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, তৃষ্ণার সঙ্গে সঙ্গে বমির ভাবও হচ্ছে। এই দুটি শারীরিক ব্যাপার, তার একসঙ্গে কখনো হয় না। আজ হচ্ছে কেন? সিডিসি। বলুন শুনছি। অরচ লীওন মানুষটি কি বুদ্ধিমান? আপনার কী মনে হয়? আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করছি, তুমি তার উত্তর দেবে। উল্টো প্রশ্ন করছি কেন? যা বলছি তার জবাব দাও।
লোকটি বুদ্ধিমান। নিষিদ্ধ নগরীতে আসবার জন্যে সে যে পদ্ধতি গ্ৰহণ করেছে তাতে কোন খুঁত নেই। সে চায় কি? সেটা কি তার পক্ষে জবাব দেয়া সহজ নয়? আমি পারি শুধু অনুমান করতে। তোমার অনুমান হবে যুক্তিনির্ভর। সেই অনুমানটি বল। আমাকে আরো কিছু সময় দিন। আমাকে তিন দিন সময় দেয়া হল। এখন তুমি প্রথম শহর থেকে আসা ছেলে এবং মেয়েটি সম্পর্কে বল। কী জানতে চান? ওরা কী করছে? ওরা এই মুহুর্তে গোলকধাঁধায় পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওদের গোলকধাঁধায় ছেড়ে দেয়া হল কেন? আপনাকে আনন্দ দেবার জন্য। দুটি বুদ্ধিমান প্ৰাণী পথ খুঁজে পাচ্ছে না, পাগলের মত এদিক-ওদিক যাচ্ছে, এই দৃশ্যটি অত্যন্ত উত্তেজনক। আপনার দেখতে ভালো লাগবে। কী করে বুঝলে, আমার দেখতে ভালো লাগবে? অতীতে এই জাতীয় দৃশ্য আপনি দেখেছেন। আপনার ভালো লেগেছে। আপনি কি এখন দেখতে চান? পৰ্দায় ওদের ছবি এনে দেব? না, এখন দেখতে চাই না। আমার তৃষ্ণা হচ্ছে, ক্ষুধা হচ্ছে, খাবার ব্যবস্থা কর। প্রচুর খাবার চাই। খাবার পানীয়।
খাবার চলে এল। খাবার দেখে তাঁর আর খেতে ইচ্ছে করল না। মুখ বিকৃত করে খাবারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাথার মধ্যে কেমন যেন করছে। শৈশবের একটি অর্থহীন ছড়া ঘুরপাক খাচ্ছে— এরণ পাতা ক্যান ক্যান বেমান বাতা এসেছেন। অং ডং ইকিমিকি চন্দ্ৰ সূৰ্য ঝিকিমিকি।। কিছুই ভালো লাগছে না। অমরত্ব অসহনীয় বোধ হচ্ছে। একজন মানুষ নির্দিষ্ট কিছু সময় বঁচে। এটা জানা থাকে বলেই জীবনের প্রতি তার প্রচণ্ড মমতা থাকে। এই মমতা তার নেই। জীবনকে এখন আর তিনি সহ্য করতে পারছেন না। অসহ্য বোধ হচ্ছে। সিডিসি। শুনছি। মাথার মধ্যে একটা ছড়া ঘুরপাক খাচ্ছে, এটাকে মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না। শুধুই ঘুরছে এবং ঘুরছে। মনে হচ্ছে লক্ষ বছর ধরে ঘুরবে। আপনি খাবার শেষ করুন। আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। সবচে ভালো হয়, যদি দীর্ঘদিনের জন্য আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া যায়। যেমন এক বছর কি দুবছর। তুমি মূর্খের মতো কথা বলছ। আমার সম্পর্কে এই বাক্যটি আপনি প্রায়ই ব্যবহার করেন।
তাতে কি তোমার অহঙ্কারে লাগে? কিছুটা। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। সিডিসি একটি কম্পিউটারের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তার মধ্যে থাকবে শুধু লজিক। আবেগ-অনুভূতি থাকবে না। কোথাও কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? কিছু কি বদলে গেছে? সিডিসি গভীর স্বর বের করল, আপনার জন্যে একটি ক্ষুদ্র দুঃসংবাদ আছে। কি দুঃসংবাদ? অমর মানুষদের দুজন আর আমাদের সঙ্গে নেই। তার মানে? খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছে জানতে চান? না, জানতে চাই না। আমি আন্দাজ করতে পারি কিভাবে ঘটেছে। আগেরগুলো যেভাবে ঘটেছে, এটিও সেভাবেই ঘটেছে। আত্মহত্যা? তাই না? হ্যাঁ তাই। দুজন একসঙ্গে ঘটনাটা ঘটিয়েছেন। মারা যাবার আগে একটি নোট লিখে রেখেছেন। নোটটি কি আপনাকে পড়ে শোনাব? না। পর্দায় আন। আমি দেখব। পর্দায় হলুদ চিরকুট ভেসে উঠল। লেখা একটিই। সই করেছেন দুজনে মিলে। লেখার একটি শিরোনামও আছে।
আমাদের কথা আমরা দুজন এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নিলাম। কিছু কিছু সিদ্ধান্ত হঠাৎ করেই নিতে হয়। নয়তো আর কখনো নেয়া হয় না। দীর্ঘ জীবন কাটালাম। জীবন এত ক্লান্তিকর, কল্পনাও করি নি। কোথাও বিরাট একটা গণ্ডগোল হয়েছে। মনে হচ্ছে সমস্তই ভুল। শেষ লাইনটি লাল কালি দিয়ে দাগান। তিনি বিড় বিড় করে বললেন, মনে হচ্ছে সমস্তই ভুল। এই বাক্যটি তাঁর মাথায় বিধে গেল। তিনি বারবার বলতে লাগলেন, মনে হচ্ছে সমস্তই ভুল। মনে হচ্ছে সমস্তই ভুল। মনে হচ্ছে সমস্তই ভুল। তিনি লক্ষ করলেন, তার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। সিডিসি নিশ্চয়ই ঘুম পাড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে। তাঁর ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে বলেন, আমি ঘুমাতে চাই না। আমি জেগে থাকব। অনন্তকাল বেঁচে থাকব। অযুত নিযুত বছর বেঁচে থাকব। আমি মৃত্যুহীন। অজার-অমর-অবিনশ্বর! তিনি তা বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, মনে হচ্ছে সমস্তই ভুল! মনে হচ্ছে সমস্তই ভুল! মনে হচ্ছে সমস্তই ভুল!!!


Post a Comment

0 Comments

Close Menu