Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ২৩

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
*
*
এক মাস পরিভ্রাজিত হলো। পুলিশের কর্মতৎপরতা যেন নিদ্রাবশে নিবিড় নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন, নাকে শর্ষের তেল মেখে নিষ্ক্রিয়। চার চারটি হ'ত্যা'র ন্যায়াসঙ্গত প্রতিকারহীনতায় যাদের জীবনের মূল্য নগণ্য, এই নগরীতে তাদের বিচার পাবার আশা মিথ্যা কল্পনার শৈল্পিক প্রলাপ মাত্র। দীনহীন জীবন যেন বৃষ্টিহীন মরুপ্রান্তরে বিলীন জলবিন্দু—তার জন্য ন্যায় কে চাইবে? সন্ধ্যার ছায়াপাতে আঁখি এখনও ভোলাদের গৃহে, আপন কর্তব্যের আহ্বান প্রতিনিয়ত যাকে বিদ্ধ করে। ভোলা, পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত সেই শিশু, যেন অকর্মণ্যতার প্রতিমূর্তি; অন্যন্ত অল্প লোভেই তাকে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করাতে হয়। দেখো, এই মুহূর্তে পায়েস চেটে-পুটে খাচ্ছে, কারণ তার গতকালের আবদার পূরণে আঁখি তাকে তুষ্ট করেছে। পড়ানো সমাপনে এখন পায়েসের প্রতি তার আকৃষ্ট মনোযোগ, আর আঁখি, গালে হাত রেখে, নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে ভোলার পানে তাকিয়ে আছে ।
এইমধ্যেই প্রবেশ করল ভোলার দাদি, হাতে আনে এক বিশেষ তেল, যা বহুপুরাতন প্রণালীতে প্রস্তুতকৃত—মাথার চুলের সঞ্জীবনায় এই তৈলপ্রয়োগ অতি উৎকৃষ্ট।ভোলার দাদির এক গাল হাসি নিয়ে আঁখির প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলল,
——— "তেল আনিছু, মাই!!"
পুরাতন ক্ষীয়মান খাটের উপর বসে আঁখি ও ভোলা মুহূর্তেই দাদির আহ্বানে পেছনে তাকালো । আঁখি তার অমলিন হাস্যভাষ্যে দাদির দিকে অগ্রসর হয়ে বলল,
——— "তোমার অভ্যাস তো গেলো না, দাদি! কিসের এত প্রয়োজন ছিল এত কষ্ট করে এই তেল আনার?"
ভোলার দাদি, পাশের গ্রামের সেই নারী জুলেখা, যার নিপুণ হাতে প্রস্তুত অমূল্য তেল, তার থেকেই আনে এই মমতা মাখা উপহার। আঁখির চুলের জন্য দাদির এই যত্নশীল অনুগ্রহের পরিসীমা নেই; তার আরও কিছু দিতে ইচ্ছে থাকলেও সেই সামর্থ্য তার সীমিত। তবে তবু এই তেল আঁখির প্রতি তার গভীরতর অনুরাগ প্রকাশ করে।
দাদির কন্ঠে স্মৃতির ভারে নত সুরে বললেন, আঁখির গালে স্নেহের হাত রেখে,
——— "তোর ..."
এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি যেন হারাল অতীতের গভীরে। আবার নিজেকে টেনে এনে বললেন হেসে,
——— "মোর বড় বেটি এই তেলখান চুলত দিত! আল্লাহ, কি ফাইন চুল! তোর চুলের মতো ঘন আর বড় । এই তেল খান ছাড়ি অন্য কোনো তেল দিতে চাইত না! মোর বেটা শেষ আনি দিত মাসত!
আঁখি বিনিময়ে নীরব হাসি ছড়াল, অপেক্ষায় রইল নাঈমের আগমনের জন্য। ভোলাদের একান্তে স্থিত বাড়িটি যেন প্রকৃতির নীরবতা ও নিঃসঙ্গতার প্রতীক, আশেপাশে কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। ভোলার চাচা, যিনি ছিলেন তার পিতার বড় সহোদর, একসময় প্রকৃতির মুগ্ধতায় নীরব স্থানে জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি কি জানতেন যে, একদিন এই নীরবতা তার শেষ সহচর হবে, মাকে একা ফেলে সকলে চিরতরে নীরব হয়ে যাবেন!
এই গৃহে পৌঁছাবার জন্য আঁখি দুই ধানক্ষেতের মধ্যবর্তী সরু পথ ধরে পা বাড়ায়। যদিও একা একা এই পথে চলা তার জন্য নিষেধাজ্ঞা, শুধু এই পথ কেন, আঁখির একাকী পা ফেলাই তার জন্য বর্তমান বারণ! কিন্তু নাঈম যখন বাধ্যতঃ অন্য কাজে আবদ্ধ থাকে, তখন শান্ত তাকে আনতে যায় তাও হঠাৎ!
আজ অন্ধকার ধীরে ধীরে ছড়াচ্ছে, আর নাঈম এখনও আসে নি! নিশ্চিত, বাড়ি ফিরলে তাকে কঠিন শাসনের মুখোমুখি হতে হবে। কেননা এই বাড়িতে যাতায়াত তার পরিবার কখনোই পছন্দ করে না। তথাপি, আঁখি যেন এক অদৃশ্য বন্ধনে বদ্ধ, জোর করেই আসে! কেমন করে সে তাদের, এই দরিদ্র দাদি ও নাতির, প্রতি উদাসীন হবে? তাদের এত কষ্টের মাঝে, আঁখি কি করে সেই বিশাল প্রাসাদসম বাড়ির নরম বিছানায় নিদ্রা যাপন করবে?
আঁখির হৃদয় যেন এক অবিচ্ছেদ্য তন্তুতে বাঁধা, নীরবতার মাঝে সেই তন্তু তার চলার পথ নির্দেশ করে, যেন সেই নিঃসঙ্গতা তার অন্তরের প্রতিধ্বনি। তখনই হাপাতে হাপাতে নাঈম দৌড়ে আসল! প্রতিদিন যখন সময় পায় তখনই এসে পড়িয়ে যায় চঞ্চল ছোট্ট ভোলা কে! আজ সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছে! যেকোনো দিনের তুলনায় আরও দেরি হয়েছে দ্বিগুণ ! আঁখি একপলক তাকে দেখেই তিক্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
——— "এইই কানা, এত দেরি করেছিস কেন?"
নাঈম বিরক্তিভরা কণ্ঠে উত্তর দিলো,
——— "চুপ কর মুরগি, কাজ ছিল!"
——— "হ্যাঁ, এখন চল! তোর জন্য আবার বকা খেতে হবে আমার!"
——— "তোর চেয়ে বেশি শোনার জন্য আমিও প্রস্তুত আছি! চল এখন!"
নাঈম ভোলার দাদির সাথে হাসিমুখে কিছু কথা বলে আঁখির সাথে বিদায় নিতে প্রস্তুত। যাওয়ার পূর্বে আঁখি ভোলার কান মুলে দুষ্টু সুরে বলল,
——— "আজকে ভালোভাবে পড়া দিস নি! কাল যেন পড়া হয় ঠিক আছে?"
ভোলা ব্যথায় আর্তস্বরে উত্তর দিলো,
——— "আ' আ: লাগোছে বইন!"
——— "হ্যাঁ, ফাঁকিবাজি করলে এমনি হবে! কাল যেন ঠিকঠাক পড়া পাই, বুঝেছিস?"
ভোলা মিটিমিটি হেসে বলল,
——— "কাইল মোর লিগা লুডুস আনুবু, তাইলে পড়িম!"
আঁখি একগাল হেসে বলল,
——— "সে তো আপনি পাবেন, কিন্তু পড়া দিতেই হবে!"
এই বলিয়াই সে আদুরে হাতে ভোলার কানে স্নেহভরা স্পর্শ রেখে দাদির নিকট বিদায় নিয়ে নাঈমের সাথে বেরিয়ে চলে গেল।
আসলে ভোলার মত এমন ফাঁকিবাজ বাচ্চাকে পড়ানোর ধৈর্য কেবল আঁখিরই আছে। বেচারার পড়াশোনার প্রতি আসক্তি তো দুরস্থান, 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' অবস্থা! তার স্কুলের গার্জেন হিসেবে আঁখিই সর্বদা খোঁজখবর নিতে যায়। ভোলার দাদি এসব ব্যাপারে বিশেষ কিছু বুঝে না, আর এসব কিছু বিনা স্বার্থে আঁখি বিনা পয়সায় ভোলাকে পড়ায়, সাথে রোজ ভোলার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে যাওয়া। এর জন্যই ওর পরিবার বিষয়টাকে দৃষ্টিকটু হিসেবেই নিয়েছে! স্কুলেও ভোলাকে বিনা পয়সায় পড়ানো হয়! অথচ যতবারই আঁখি স্কুলে যায়, ভোলার নামে কোনও না কোনও অভিযোগ অবশ্যই শুনতে পাবে। শিক্ষকগণ তার দুষ্টুমিতে বিরক্ত, কিন্তু আঁখির সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ তার সেই হাসিখুশি দুষ্টু শিক্ষার্থীর প্রতি এক ধরনের অদৃশ্য মায়ার ডোরে বাধা।
নিস্তব্ধ রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে ঝিঁঝিঁপোকার একটানা ডাক যেন আঁখি ও নাঈমের পথচলাকে সঙ্গ দিচ্ছে। দুই পাশে বিস্তৃত ধানক্ষেত, তার মাঝে সরু পথ দিয়া ধীরে ধীরে হাঁটছে উভয়ে। নাঈমের হাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট যেন তাদের অন্ধকার সরাবার ক্ষুদ্র প্রয়াস। হঠাৎ করেই মোবাইলের রিংটোনে সেই নিস্তব্ধতা খানিকটা ভঙ্গ হল। নাঈম একবার চোখ বুলালো নম্বরের দিকে, বিরক্তির ভাঁজ ফেলে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটি কেটে দিয়ে এয়ারপ্লেন মোডে স্থাপন করল।
আঁখি তার কপাল কুচকিয়ে, নীরবতার মধ্যে জিজ্ঞাসা করল,
——— "কে ফোন দিয়েছে?"
নাঈম তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
——— "কে আবার! হাওয়াই মিঠাই!"
আঁখির চোখে এক ধরনের গভীরতা দেখা দিল। সে খানিকটা শান্তভাবে বলল,
——— "সেদিন আপুর সাথে ওমন না করলেও পারতি!"
নাঈম কিঞ্চিৎ কটু হেসে বলল,
——— "ওর জন্য ওটাই ঠিক ছিল!"
আঁখি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল,
——— "অনেক আশা নিয়ে সেজেছিল! আর তুই কিনা দেখিসও নি! সারারাত অপেক্ষা করেছে! তুই আসিস নি! সকালে যাও বা আসলি ফিরেও দেখলি না! সেই যে কান্না করে গেলো! ছোট বাবা গেলো আনতে তবুও এলো না!"
নাঈম কিঞ্চিৎ ক্ষিপ্রভাবে উত্তর দিল,
——— "তোকে কে বলল আমি দেখি নি!"
আঁখি ক্ষীণ অথচ দৃঢ় স্বরে বলল,
——— "আড়ালে দেখে কি লাভ!"
নাঈম তীব্র দৃষ্টিতে বলল,
——— "তুই পারবি প্রকাশ্যে দেখতে?"
আঁখির মুখের ভাষা স্থির থাকল, সে কেবল বলল,
——— "উত্তর তোর জানা!"
নাঈমের চোখে অন্ধকারের মাঝে এক ধরনের কঠিন দৃঢ়তা দেখা দিল, সে নিস্তব্ধ গলায় বলল,
——— "আমার উত্তরও তোর জানা। এসব আমার জীবনে জায়গা নেই!"
______________
তৃতীয় তলাপৃষ্ঠে অবস্থিত আইসিটির ক্লাসে আসীন আঁখি, যেখানে সমগ্র শিক্ষার্থীর সমাবেশে কোলাহল মর্মরধ্বনিরূপে বিস্তৃত। আজকের দিনে অন্তিম ক্লাসটাই আইসিটির । এদিকে ইতোমধ্যেই মিলি তার বিবাহ-বিধানের পরম সুখ-সংবাদে সমগ্র সমাজজগৎকে অবগত করেছে। বিবাহের পূর্বালোক কার্যক্রম ইতোমধ্যেই প্রবল উৎসাহে প্রবাহমান। দায়িত্বভার বহন করছে স্বয়ং আরাফ। তাঁর সুনিপুণ অভিপ্রায়; কীভাবে আঁখির নিকটে থাকা যায়, সেই গূঢ় কৌশল। অন্যপক্ষে, চেয়ারম্যান ইকরাম আলী নিজ গ্রামস্থ কার্য্যসমূহের পর্যবেক্ষণে নিরত, যা এক নিপুণ চেয়ারের প্রকারান্তর। যদিও মিলির পরিবার মধ্যবিত্ত, দরিদ্র নয়, তথাপি ইকরাম আলী চেয়ারম্যান হিসেবে সহায়তায় হাত বাড়িয়েছেন। কিন্তু সত্যিকার প্রয়োজনে আরাফ নিজের কাঁধেই বিবাহের গুরুদায়িত্ব ধারণ করেছে। তার জানা, আঁখির প্রিয়তম বান্ধবী মিলির বিবাহে উপস্থিত থাকবে সে ; আর তার এই সুবর্ণ সুযোগ হারানোর মতো নির্বোধ আরাফ নয়। আঁখি, মিলি ও আছিয়া; তিনজনের মধ্যে পরিপূর্ণ আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। আজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখায় মননিবেশের কোনো স্থান ছিল না। সামান্য এক সপ্তাহ পরেই বিবাহ, এমন আনন্দোচ্ছ্বাসে নিমগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। সেই প্রচলিত বাক্যের মতো; “যার বিয়ে তার খোঁজ নেই, পাড়াপড়শীর ঘুম নেই ”—কিন্তু মিলির ক্ষেত্রে এটা উলটো। সর্বোচ্চ উচ্ছ্বাসের শিখরে অবস্থান করছে সাস্থমতী গলুমলু মায়াময়ী মিলি, যেন খুশির সীমান্ত অতিক্রম করেছে!
আঁখি লক্ষ্য করল, আছিয়া যেন হারিয়ে গেছে! এমন ভীষণ জনারণ্যে কোথায় গেল সে? এখানেই তো ছিল! তড়িঘড়ি মিলির দিকে ফিরল।
——— "আছিয়া কই?"
মিলি আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
——— "জানি না তো! এখানেই তো দেখেছিলাম!"
হঠাৎ যেন আঁখির চেতনায় এক প্রবল ঝটিকা বয়ে গেল। মনে পড়তেই কোনো বিলম্ব না করে ব্রাঞ্চের আসন থেকে সোজা উঠে দৌড় দিলো, স্যার এর অনুমতির তোয়াক্কা না করেই পিছনের দ্বারপথ দিয়ে শ্রেণীকক্ষ ত্যাগ করল। যেন ঝড়ের বেগে ছুটছে সে! মিলি বিস্ময়ে অর্ধমুখে তাকিয়ে রইল,
——— "এর আবার কি হলো?"
আঁখি এই মুহূর্তটির প্রতীক্ষায় ছিল; এইবার হাতে-নাতে ধরবে সে। তার মুখের প্রান্তে তির্যক হাসির আভাস! দ্বিতীয় তলার সোপান ভেঙে নেমে এল; আর এক শ্রেণীকক্ষ পার হয়ে তার শ্রেণীকক্ষ। এদিকে আরাফের আজ কোনো ক্লাস ছিলো না, তবু সে এসেছে। আঁখিকে এমন ঝড়ের গতিতে ছুটতে দেখে আরাফের কপালে ভাঁজ পড়ল। যদিও সে তিনতলাতেই ছিল, কিন্তু আঁখি ছুটে গেছে এমন বেগে যে, তার চারপাশে কারা আছে খেয়ালই করেনি। সিঁড়ি ভেঙে আরাফও নিচে নেমে দেখে, আঁখি এখন ধীর পায়ে তার শ্রেণীকক্ষের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
শ্রেণীর দরজার সম্মুখে এসে আঁখি হেলান দিয়ে দাঁড়াল। এটাই তো তার প্রত্যাশিত মুহূর্ত! মুখে বাঁকা হাসির রেখা। হঠাৎ শীতল কণ্ঠে বলে উঠল,
——— "সাবধানে, কেউ দেখে ফেলবে!"
আছিয়া আকস্মিকভাবে স্থবির, হস্তরাশি আঁখির কিসলয়ের অর্গলহীন ব্যাগ হতে বের করে নিলো; আঁখির নিবদ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে দাঁড়িয়ে, হস্তপদাচলন অস্ফুট হইয়া উঠল। শিরামর্মরে ভীতি প্রকম্পিত, সুপ্ত দেহ হতে ঘর্ম কণা প্রবাহিত হতে উদ্যত। আঁখির অপ্রকাশ্য, সূক্ষ্ম তীক্ষ্ণদৃষ্টি যেন অন্তঃস্থলে প্রবেশ করছে। সমগ্র দ্বিতীয় তলা নির্জন, নিশ্ছিদ্র নীরবতা।
আরাফ অতি মন্থর গতিতে অগ্রসর হয়ে আঁখির পেছনে নিঃশব্দে উপনীত হলো, ক্লাসে আবার আছিয়া কি করছে, তা অনুধাবনের চেষ্টা করল। আঁখি ধীরপদে আছিয়ার সম্মুখে অগ্রসর হল, যা প্রত্যক্ষ করে আছিয়া মুগ্ধবৎ শ্বাস গ্রাস করল এবং কপট স্বরে ব্যাখ্যা করতে লাগল,
——— "আমি, আমি ত তোকে... সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলাম... এই কারণে তোকে না জানিয়ে,, তোর ব্যাগে চকলেট রাখতে এসেছিলাম! এই চকলেট তো তোর প্রিয়! দেখ, দেখ তুই!"
এই বলে ব্যাগ হতে ত্বরিত কিটক্যাট চকলেট প্রদর্শন করল। আঁখি গম্ভীরভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নয়নে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম তিক্ত হাসি ফুটিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
——— "আমি তো তোকে কিছুই বললাম না! তবে ব্যাপারটা ; 'ঠাকুরঘরে কে? আমি তো কলা খাই নি!' এমন হয়ে গেলো না?? ঝালমুড়ি?!!"
আছিয়া কি বলবে, তাহা বোধগম্য হল না, বলপূর্বক হাসল এবং উত্তর দিল,
——— "আহহাহাহা! তুইও যে এমন বিদ্রূপের হাস্যরস করিস!"
হঠাৎ দেখল, দ্বারের সম্মুখে তাঁহার ভাই, ক্ষুদ্রদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। এই সুযোগ কি আছিয়া হারাতে পারে? অতঃপর চিৎকার করে বলল,
——— "আরেহ! ভাইয়া! হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি, যাচ্ছি ক্লাসে!!"
আঁখির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
——— " আইসিটি ক্লাস ফেলে এসেছি, ভাইয়া বকা দিচ্ছে , চল চল, ক্লাসে যাই!"
এ বলে ভো দৌড়ে চলে গেল আছিয়া । আরাফ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে তার পা'গ'ল বোনকে দৌড়ে যেতে দেখল; কেউ কি তাকে ক্লাসে যেতে বলেছিল? এমন কিছু কি সে উচ্চারণ করেছিল? নাহ, তাহার মুখ হতে কারও সম্মুখে কোনো শব্দই নিঃসৃত হয় নি!
আঁখির মনে রো'ষা'ন'লে উদ্দীপিত ক্ষোভ বর্ধিত হল, পুনরায় তার ব্যাগ চেক করে নিলো। না, কেবল চকলেট! আঁখি ইচ্ছাকৃতভাবেই ফাঁদ প্রস্তুত রেখেছিল, যেন শিকার নিজে এসে ধরা হয়। কেননা আঁখির মানস্পটে বহু আগেই সে ইঙ্গিত পেয়েছে এ কাজ আছিয়ার। আগে সে ব্যাগটা স্বভাবগত ক্লাসে রেখেই অন্যান্য ক্লাসে যেত। তবে এই একমাস যাবত ফাঁদরূপেই ব্যবহৃত করেছে । কিন্তু আরাফের উপস্থিতিতে সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ । কে তাকে আহ্বান করেছে এখানে আসতে? রা'গে ফেটে পড়ল আঁখি, চোখ দুটি যেন জ্বলন্ত অ'গ্নি'র শিখা। অন্যদিকে আরাফ, তীক্ষ্ণ চাহনিতে অনুসন্ধিৎসু, তার ঠোঁটের কোণে এক বক্র হাসি ফুটে উঠল। "রাগলে কতই না সুন্দর দেখায় তোমায়!" আরাফের বুকের গভীরে যেন বাণ বিধলো। ধীরে ধীরে আঁখির কাছে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে সে বলল,
——— "ম্যাডাম, রাগ কেন এত? আপনার রাগ দেখে কারো হৃদয় পু'ড়ে যাচ্ছে, সে খবর কি রেখেছেন?"
আঁখির রা'গ আরও বেড়ে গেল, ক্রো'ধের অ'গ্নি মাথায় ফুঁ'সে উঠল। তবু নিজেকে সংযত করে, কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল,
——— "ত্রিশ ক্ষণেও যদি আপনি সামনে থাকেন, তাহলে পরিণতি ভেবে রাখবেন!"
আরাফ ভান করে বলল,
——— "কিছু কি বললে? শ্রবণে ত্রুটি ঘটছে বুঝি!"
আঁখির সেই রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই আরাফ বুঝল, ক্রো'ধের সীমা ছাড়িয়েছে। মৃদু হাসিতে সে বলল,
——— "শান্ত হোন ম্যাডাম, শান্ত হোন! আমি চলে যাচ্ছি!"
এই বলে সে পিছনে ফিরল, দরজার দিকে অগ্রসর হলো, তবে অ'গ্নি'কন্যা'র দিকে একবার ফিরে চেয়ে মুচকি হেসে বলল,
——— "তোমাকে একেবারে ছেড়ে দিচ্ছি না! কেবল ক্ষণিকের জন্য বিদায় মাত্র! তোমার এই অ'গ্নি'মূর্তি দেখেও আমি প্রেমাবিষ্ট । যতবার তুমি ভিন্ন রুপে আত্মপ্রকাশ করবে, ততবারই নতুন করে তোমার প্রেমে নিমজ্জিত হবো। তোমার এই দ'হনশিখায় নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিব! ইতিমধ্যেই দহনক্লিষ্ট হয়েছি, এবার সমাপ্তিতে দ'গ্ধ হয়ে ছাইভ'স্মে রূপান্তরিত হবো! তুমি সেই ভ'স্ম বাতাসে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে! আর আমি সেই ভ'স্ম তোমার নরম গালের উপর আলতো স্পর্শ রেখে যাবো, যেন আমার প্রেমের অবশিষ্টাংশ চিরকাল তোমার সঙ্গে থাকে। "
সত্যিই কি চলে গেল? নাহ, সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রইল। এমন করেই ছেড়ে দেবে, এমনটি হতে পারে না!
আঁখি নিজের মনের তপ্ত অ'গ্নি শান্ত করার প্রয়াসে ক্লাসে প্রবেশ করল। ধীর স্বরে ফিসফিস করে বলল,
——— "আমারও দিন আসবে, সেদিনের প্রতিটি ক্ষণ আমার নামে লিখিত থাকবে!"
অপেক্ষার প্রহর গুনছে আঁখি। জানে লোকটি এখান থেকে যায়নি। ক্লাস প্রায় শেষ হওয়ার সময় আঁখি উঠে দাঁড়াল। তবে বারান্দায় বেরোতেই হঠাৎ এক হেচকা টানে তাকে সামনে টেনে নেওয়া হলো। আকস্মিক ঘটনায় আঁখি হতবাক হয়ে গেল, কিন্তু সামনের ব্যক্তিকে দেখে বিস্ময়ের সাথে বলল,
—— "সাব্বির! তুমি?"
সাব্বিরের মুখে অপ্রস্তুততা, আঁখির চোয়াল কঠিন হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—— "এটা কী ধরণের আচরণ? তোমার সৌভাগ্য যে, গালে আ'ঘাত পড়েনি!"
সাব্বির নম্র স্বরে বলল,
—— "ক্ষমা করো! ইচ্ছা এমন কিছু ছিল না, তবে তোমাকে একান্তে কিছু বলার ছিল, যা এক মাস ধরেই বলতে চাইছি।"
—— "সোজাসুজি বলো, সময় নেই!"
—— "আমি সাহায্য চাই, তোমার...!"
এই মুহূর্তে আরাফের কণ্ঠে কথার স্রোত থেমে গেল,
—— "এখানে কী হচ্ছে?"
আরাফ দাঁড়িয়ে রইল, পকেটে হাত গুঁজে, চোয়াল কঠোর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাব্বিরকে লক্ষ্য করল। আঁখি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সাব্বিরের দিকে তাকাল,
—— "তুমি কি বলবে?"
আবারও আরাফ ধমকের সুরে বলল,
—— "ক্লাস ফেলে এখানে কথা বলাবলি হচ্ছে?"
সাব্বির স্তব্ধ হয়ে গেল। আঁখি বিরক্ত হয়ে আরাফকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আঁখি চলে যেতেই আরাফ এগিয়ে সাব্বিরের কাঁধে হাত রেখে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে বলল,
—— "তোক সাবধান করেছিলাম, ওর থেকে দূরে থাকতে?"
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বৃদ্ধা মহিলাটি কিংবা ছদ্মবেশী কলেজের সামনে গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে। পড়নে মলিন ও ছেঁড়া শাড়ি, শরীরে মাটির স্তর জমে গেছে। কাঁধে ঝুলছে বড় এক ঝুলি, এলোমেলো সাদা চুল মুখমণ্ডল ঢেকে রেখেছে। তার এক হাতে মজবুত Leica Geovid দূরবীন, যা দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত প্রতিটি খুঁটিনাটি দৃশ্য স্পষ্টতই তুলে আনে। কিছুক্ষণ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করার পর, সে দূরবীনটিকে ঝুলির মধ্যে রেখে কানে থাকা Plantronics Voyager Legend ব্লুটুথের মাধ্যমে ফিসফিস করে বলল,
——— “স্যার! প্রতিটি পদক্ষেপ নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে!”
________________
নদীতীরে অবগুণ্ঠিত কুয়াশায় আচ্ছন্ন দুইটি প্রাণ, যেন আকাশমণ্ডলে জমে ওঠা কালো মেঘের মতোন নিবিড় সখ্যে মগ্ন। বৃষ্টির পূর্বাভাস বহমান বাতাসে ঝড়ের সম্ভাবনা দৃশ্যমান, তথাপি সেদিকে মনোযোগ নেই সেই দুই মানব-মানবীর। বৃক্ষের তলে, নিজ কোলের উপর বশীভূত আফ্রিদির অবিচল মুখখানি। পূর্বিকা মগ্ন মায়াবী মমতায়, তন্ময় অপার হৃদয়ের ভেতরকার দ্বিধায়।
আহা! এমন সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রান্তরে প্রেমাস্পদের সান্নিধ্য কে না চায়! সেই দিনটি, যখন মুগ্ধের সাথে বিরূপতা ঘটেছিল, ক্রোধে আফ্রিদি মামার নিবাসে আশ্রয় নিয়েছিল। রাগের দহনে নিজেকে পৃথক করে রেখেছিল সবার কাছ থেকে। সপ্তাহকাল পর প্রত্যাবর্তনে শোনে, কয়েকটি নৃশংস হ'ত্যা'কা'ণ্ড ঘটেছে। পূর্বিকার সুরক্ষার চিন্তা দোলা দেয় হৃদয়ে, আর মুগ্ধের অনুপস্থিতি নিয়ে নীরব সন্তুষ্টি গ্রাস করে। এই একটি মাস সে প্রশান্তির নিস্তব্ধতায় পূর্বিকার সাথে কাটিয়েছে। প্রথমদিকে পূর্বিকার কান্নার ঝড় বয়ে গেলেও, ধীরে ধীরে তার হৃদয় জয় করেছে আফ্রিদি। এখন তার মনে শান্তি, কারণ মুগ্ধ নেই। তবু কোথায় যেন এক অন্তর্লীন শঙ্কা দোলা দিয়ে যায় হৃদয়ে।
পূর্বিকার স্নেহশীল স্পর্শে আফ্রিদির চুলে আলতো বুলিয়ে দিচ্ছিল সে, আর আফ্রিদি চোখ বুজে স্বপ্নালু কণ্ঠে বলল,
——— "একটি কথা বলব, পূর্বি?"
——— "বলো?"
——— "মুগ্ধর সাথে আর কখনো কথা বলবে না। ওর সামনে যেও না। কথা দাও?"
পূর্বিকার হাত থেমে গেলো। বিস্ময়ে চমকে তাকাল, এতদিনেও আফ্রিদির হৃদয়ে মুগ্ধের ছায়া মুছে যায়নি? যেখানে মুগ্ধ একমাস নিখোঁজ, এও শুনেছে লোকমুখে নানা গুঞ্জন। তার পরিচিতি এমনই, গ্রামের লোকেরা প্রতিদিন মুগ্ধের খোঁজে থাকে। তথাপি এই অনিন্দ্য মুহূর্তে, তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির ছায়া টেনে আনলো কেন আফ্রিদি? পূর্বিকাকে কি সে বিশ্বাস করে না? যদি করত, তবে এমন কথার প্রয়োজন পড়তো?
পূর্বিকার নীরবতা তার হৃদয়ের অস্থিরতা বাড়িয়ে তুললো। কেন সে নির্বাক? তাহলে কি পূর্বিকার মনে মুগ্ধের জন্য কোনো স্থান আছে? এর আগে এমন প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। কেন আজ এতটা সময় নিচ্ছে? ব্যাকুল হয়ে আফ্রিদি উঠে বসলো। পূর্বিকার মোহিনী মেঘলা চোখে তাকিয়ে বলল,
———" কি হলো? কিছু বলছো না কেন?"
পূর্বিকা তাকালো সামান্যতেই অস্থির হয়ে যাওয়া পুরুষটির পানে! আফ্রিদির হাত ধরে সে মৃদু কণ্ঠে বলল,
——— "এত অস্থির, এত অধৈর্য, এত অল্পেই কেন ক্ষি''প্ত হও? কেন সহজে রা'গে ফেটে পড়ো? কেন বুঝতে চাও না, নাকি বুঝেও বুঝতে চাইছো না? আমি তো শুধু তোমার, শুধুই তোমার! তবু কেন এমন নিরর্থকভাবে তৃতীয় কাউকে টেনে আনছো?"
আফ্রিদির চোখে ক্রো'ধের ঝাঁঝ মিশ্রিত ভালোবাসার এক প্রবল স্রোত। সে পূর্বিকার গালে শক্ত হাত ছুঁইয়ে বলল,
——— "এত ব্যাকুল, এত উ'ন্মত্ত, এত বেপরোয়া আমি; সবই তো তোমার জন্য, পূর্বি! আজ পর্যন্ত কোনোদিন তোমাকে অসম্মানের সাথে স্পর্শ করিনি! তোমাকে শুধু আমার চাই, একান্ত আমার! এই জীবনে আমার একমাত্র সঙ্গিনী তুমি! আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি স্বপ্নে তুমি । আমার ক্লান্তি ঘোচানোর আশ্রয়ও তুমি, আর আমার আনন্দের ঝিলিকও তুমি। আমার রাগ, আমার কান্না; সবকিছুর কেন্দ্রে শুধু তুমি! এই হৃদয়ের গহীনে, একান্তই তুমি।
যখন কেউ আমার এই অন্তরের নারীকে চাইবে, তখন কি আমি অস্থির হবো না? বুকটা কি ছিন্নভিন্ন হবে না? তোমাকে হারিয়ে ফেলার শঙ্কা কি আমার অপরাধ? এক মুহূর্তের জন্যও আমি ভাবতে পারি না তুমি অন্য কারো হতে পারো। যদি তুমি আমাকে পা'গ'ল বলো, তবে হ্যাঁ, আমি পা'গল। যদি আমাকে ‘রেড ফ্ল্যাগ’ বলো, হ্যাঁ, আমি তাই। যদি বলো আমি তোমার স্বাধীনতা হরণ করছি, তোমাকে তোমার মতো বাঁচতে দিচ্ছি না, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি সেটাই করছি!"
পূর্বিকা নিশ্চুপ রইল, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রইল আফ্রিদির ওপর, যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটিকে একান্তভাবে অনুভব করতে চায়। কত সৌভাগ্য নিয়ে যে সে পৃথিবীতে এসেছে—একজন পুরুষ তাকে এমন গভীর ভালোবাসায় বেঁধেছে! এই পুরুষ ছাড়া সে কেমন করেই বা বাঁচবে? মৃদুস্বরে পূর্বিকা বলল,
——— "দেখো, তোমার এই অতিরিক্ত অধি'কারবোধ, অযথা হিং'সা, আর প্রচণ্ড রা'গের কারণেই আমার মৃ'ত্যু ঘটবে একদিন!"
তার কথা শুনে আফ্রিদির বুকের মধ্যে হুং'কার উঠল। উত্তপ্ত রা'গ ক্রমে তরঙ্গিত হয়ে ওঠল। মুহূর্তের মধ্যে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো, এমনভাবে চেপে ধরল যেন পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা আর ক্রো'ধ সেই আলিঙ্গনে ধরা দিয়েছে। পূর্বিকার শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম! তার কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে, আফ্রিদি হিমশীতল স্বরে হিসহিসিয়ে বলল,
——— "তোমার স্পর্ধা দেখে আমি হতবাক! ম'রবে তো তুমি অবশ্যই, আমার হাতেই! যেমন করে প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে তুমি মা'র'ছো!"
পূর্বিকার ছোট দেহ ক্রমে আফ্রিদির শক্ত বুকের ভেতর মিশে যাচ্ছিল, সে কাঁপতে কাঁপতে বিক্ষিপ্তভাবে আফ্রিদির বুকের ওপর হাত রাখতে শুরু করল। আফ্রিদি তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, তার চুলের ঘ্রাণ টেনে মাতালের মতো বলল,
——— "শশশশ! আমার অন্তরের এই ক্রন্দন দেখে কি তুমি থামবে? আমার এই অন্ত'র্জ্বালা কি তোমার চেয়ে বেশি?"
পূর্বিকা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, অর্থাৎ না! আফ্রিদি অদ্ভুতভাবে হাসল, যেন তার স্নায়ু একধরনের উত্তেজনায় থিরথির করে কাঁপছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশের বুকে ঘন মেঘ ভেঙে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। পূর্বিকা উঠতে চাইল, কিন্তু আফ্রিদি তাকে ছাড়ল না। প্রবল ভালোবাসার নেশায় সে তখন আচ্ছন্ন। এই মুহূর্তে পূর্বিকা কি আর আফ্রিদির সাথে পারবে? সে যে সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ! প্রবল ঝড়ে, তুমুল বৃষ্টিতে, নদীর তীরে তাদের দুইটি সত্তা ভিজে একাকার হয়ে গেল। পূর্বিকাকে বুকে আঁকড়ে ধরে আফ্রিদি বলল,
——— "তুমি, আমি, এই নদী, এই বৃষ্টি, আর কিচ্ছু চাই না। এ জীবন আমার তুচ্ছ, যদি তোমাকে এমনভাবে পাশে না পাই!"
বলে একমুহূর্তে পূর্বিকাকে ছেড়ে দিলো। পূর্বিকা যেন মুক্তির নিঃশ্বাস নিলো। সে যেন দৌড়ে বহুক্ষণ এসেছে—শ্বাস বন্ধ হতে হতে আবার ফিরে এসেছে জীবনের বুকে। তার ভেজা মুখ, কাঁপতে থাকা গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়, যেখান থেকে টপটপ করে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। সে অশান্তস্বরে বলল,
———" তুমি কি আমায় মে'রে ফেলতে চাও?"
আফ্রিদি তার ঘোর লাগা নয়নে চেয়ে রইল পূর্বিকার দিকে। যেন তার ভেতরের প্রাণবন্ত পুরুষ জেগে উঠছে। এতদিন ধরে, এত গভীর ভালোবাসায় সে যে পূর্বিকাকে সিক্ত করে আসছে, তা কি সে নিজেও জানে? পূর্বিকা তার চোখের ভাষা বুঝল। আফ্রিদি তার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
——— "যদি অন্য কোনো পুরুষকে তোমার আশেপাশে দেখি, আমি সত্যিই তোমায় হ'ত্যা করবো!"
পূর্বিকা আর কোনো কথা বলল না। সে নির্জন হয়ে রইল। আফ্রিদি তার হাত বাড়িয়ে পূর্বিকার দিকে এগিয়ে দিল, তার চোখের পলক বারবার ফেলে বলল,
———" কথা দাও, মুগ্ধর সাথে আর কখনো কথা বলবে না।"
পূর্বিকা হতচকিত হলো। এতকিছুর পরেও আবারো মুগ্ধ? তার মনে মুগ্ধকে নিয়ে শঙ্কা! এত সুন্দর মুহূর্তে তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব নিয়ে সে চিন্তিত কেন? পূর্বিকা জানে মুগ্ধ তাকে ভালোবাসার নামে কাছে টানছে না, এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। মুগ্ধ পূর্বিকার কলেজে এসেছে, আফ্রিদির বাড়িতেও গিয়েছে, তাকে ডেকে কিছু বলার চেষ্টা করেছে। নিশ্চয়ই তার বলার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। পূর্বিকা ভাবে, মুগ্ধকে একটু শোনা কি ভুল হবে? তাছাড়া আফ্রিদি তো মুগ্ধকে তাদের প্রেমের কথা কখনোই জানায়নি। কেন শুধুমাত্র মুগ্ধর উপস্থিতিতেই এতটা উত্তেজনা? যেখানে মুগ্ধ তার শৈশবের বন্ধু, সেখানে এক নারীর জন্য বন্ধুর কথা না শুনে এতটা ক্ষিপ্ত হওয়া কি সঙ্গত?
পূর্বিকার মন বলে, হয়তো মুগ্ধের চোখে ভালোবাসা নেই, তবে আছে এমন কিছু বলার ইচ্ছে, যা তাকে বলতে দেওয়া হচ্ছে না। আফ্রিদির উচিত মুগ্ধর কথা একবার শোনা!
আর এ নিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারণ করা সম্ভবপর নয়। পূর্বিকা জানে, এখন এটা বললে সঙ্গিনীকে নদীতলে ডুবিয়ে মৃ'ত্যু'মুখে নিক্ষেপ করতে সে প্রস্তুত। এই জন্যেই, কথা না বাড়িয়ে পূর্বিকা প্রতিজ্ঞা করে আফ্রিদির হাত আলতো স্পর্শ করে বলল,
——— "মুগ্ধ হোক, কিংবা অন্য কেও; কারো সঙ্গেই কথা বলব না! পরিবার ব্যতীত আর কেউই আমার সঙ্গ পাবে না! এতটুকু তো আমি দিতে পারি, তাই না?"
আফ্রিদির অধরে তৃপ্তির এক অস্ফুট হাস্য দেখা দিল। বলল,
——— "পূর্বি, তোমারে ভালোবাসি!"
নয়নে প্রগাঢ় নেশা; অন্তরের গভীরে প্রেয়সীকে অন্তরতম করে নেওয়ার বাসনা। কিন্তু, সে ইচ্ছাকে সংবরণ করে নিল। আফ্রিদি দুই হাতে মাথার কেশ টেনে ছিড়ে ফেলছে যেন অদম্য বাসনাটি দুর্বল হয়। পূর্বিকা জানে, এর পেছনের কারণ স্পষ্ট তার নিকট। এত বছরে এতটুকু কি তার অজ্ঞাত থাকতে পারে? পূর্বিকা নিজেই এক মুহূর্তে আফ্রিদির প্রশস্ত বক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর আফ্রিদি আপন শক্ত বাহুপাশে তাকে কঠিনভাবে আবদ্ধ করে নিল। পূর্বিকা নয়ন মুদিয়া ভাবল, এ যেন শেষ না হয়, সময় যেন এখানে থমকে যায়। বাহিরের প্রবল বৃষ্টির মতই দুটো হৃদয় ভিজে যাক অন্তরে, যেন তারা আর একত্রে ছিন্ন হতে না পারে! অন্তরের গহীন গহ্বরে তাহার বাক্যাবলীকে মুক্ত করল,
———— "প্রথম যেই স্পর্শে তুমি আমায় আপন করেছিলে, শেষ স্পর্শটিও যেন তোমারই হয়! শুনেছি, পুরুষের ভালোবাসা ভ'য়ং'কর হয়, সেই ভ'য়ংক'র ভালোবাসাতেই যেন আমার মৃ'ত্যু হয়! তোমার যে রাগ, সেই রাগে আমি পুড়ে ছাই হতে চাই! তুমি যখন আমাকে অন্য কারও সাথে দেখে হিং'সায় জ্ব'লে ওঠ, সেই হিং'সা চিরকাল জ্ব'লতে থাকুক। তুমি যখন বেপ'রোয়া হয়ে ওঠ, সেই বেপরোয়া আ'সক্তি যেন আরও প্রবল হয়ে উঠে! তোমার এই অস্থিরতা, এই পাগলামী, যেন শুধুই আমার জন্য হয়! আমি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সপে দিতে থাকব তোমায়! করো, সব করো, তুমি যেমনটা চেয়ে থাকো!
তবুও, এই যে তোমার অ'গ্নি'স্ফুলি'ঙ্গে'র মত কামনা আমায় স্পর্শ করার, তোমার পুরুষত্ব যখন জাগ্রত হয় আমার প্রতি, কিন্তু তুমি যেভাবে নিজেকে সামলিয়ে রাখো; এইখানেই তো আমার প্রথম ভালোলাগা! বাহ্যিক দেহ তো অনেকেই ছুঁতে পারে, কিন্তু তুমি আমার মন স্পর্শ করেছো! আমার জীবন যদি শেষ হয়, হোক তোমার সেই শেষ স্পর্শেই!"
পূর্বিকার কণ্ঠে ঝরে পড়িল একটি নিস্তব্ধ স্বীকারোক্তি, যেন তার সমস্ত সত্তা তাহার প্রেমিকের নিকট আত্মসমর্পিত হইয়া গেল। আফ্রিদি পূর্বিকার কেশাবরনে ঠোঁট ছুইয়ে বিষন্ন স্বরে ফিসফিস করে বলল,
——— "তোমার এই স্বীকারোক্তি আমি পূর্ণমাত্রায় বুঝি। হ্যাঁ, তুমি তোমার সমস্ত সত্তা আমার প্রতি সমর্পণ করতে চাচ্ছো। আমি জানি, তোমার অন্তর এখন এক ঘোরের মধ্যে আছে, তবে জানিও, আমার ঘোর তোমার চেয়ে দ্বিগুণ নয়, বরং তিনগুণ কিংবা তারও অধিক প্রবল! কিন্তু না, আমি কা'পুরুষ নই! তোমায় পূর্ণ করব, জ্বা'লাবও, কিন্তু এখন নয়!
যেদিন তুমি লাল বেনারসি পরে আমার ঘরে আসবে, সেই দিনই তোমায় স্পর্শ করব। তুমি চাইলে অন্য কোনো রঙের বেনারসি পরতে পারো, কিংবা শাড়ির পরিবর্তে লেহেঙ্গা বা বোরখা পরতে পারো। কিন্তু যেইদিন তুমি আমার বধূ হয়ে আসবে, সেই দিনই আমি তোমায় পু'রা'ব। তবে হ্যাঁ, সাবধান করে রাখলাম, তোমার মৃ'ত্যু আমার স্পর্শেই ঘটবে, পূর্বি।"

Post a Comment

0 Comments

Close Menu