লেখিকাঃ সাদিয়া আকতার
দ্রুত গতিতে বাস ছুটে চলেছে পাচুলিয়া শহরের উদ্দেশ্যে। আলভি'র চোখ বন্ধ তবে মস্তিষ্ক সজাগ। অনেক প্রশ্ন কিন্তু উত্তরের কোটা খালি। মি. জামশেদের বাড়ির দেয়ালে ঝুলানো ফটো ফ্রেমের আসল গল্প টা কি। অ্যাপ কিভাবে একটা মানুষ কে নিয়ন্ত্রণ করলো যে সে নিজেকে সর্বোচ্চ কষ্ট দিয়ে আত্মহত্যা করবে। সব ঘটনা কেন পাচুলিয়ার সাথে কোন ভাবে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এমন সব প্রশ্ন বারবার নাড়া দিচ্ছে আলভি'র মনে সময় যেন বড় দীর্ঘ হয় যায়। নিজেকে প্রবোধ দেয় এবারের পদক্ষেপ নিতে হবে খুব সাবধানে ও সর্তক হয়ে, যেন পাওয়া খন্ড সূত্র একটি সমাধানে পরিনত হয়। লম্বা শ্বাস নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে নাম্বার খোঁজে পাচুলিয়া শহরের ইন্সপেক্টর সামস কে কল করে,,
: জ্বি... আমি আলভি
বলছিলাম.... ভালো আছেন?...
: জ্বি জ্বি চিনতে
পেরেছি মি. আলভি.... ভালো আছি হঠাৎ গোয়েন্দা সাহেবের আমাকে স্মরণ?!.....
: হাহাহা.... আসলে
চলমান সিরিয়াল কিলিংয়ের কেস টায় আমিও আছি....
: ওহ! আচ্ছা.. আচ্ছা....
কোন সাহায্য লাগবে?...
: হুম... লাগবে...
বলা যায় না... অসুর নিধন পাচুলিয়াতেও হতে পারে...
: বলেন কি!!....
আচ্ছা... তো কি সাহায্য করবো?!...
: আমার শিপন রায়ের
পরিবারের সাথে দেখা করা টা জরুরি...উনারা কি এখনো আছেন??...
: উম্মম... শিপন
রায়!.. ওই যে ছেলে টা কিছুদিন আগে সুইসাইড করলো?...
: হুম...হুম... হোস্টেল
রুমে....
: আচ্ছা.... যতটুকু
মনে পড়ে ওর বাবা তো হাইস্কুলের প্রিন্সিপাল... এখনো থাকার কথা.... আমি দেখছি...
: জ্বি... ধন্যবাদ...
আর ঠিকানা টা দয়া করে আমাকে পাঠিয়ে দিবেন...
: হ্যাঁ দিয়ে দিবো....
বলছি আপনি এখন গাড়িতে নাকি?...
: হুম... আপনাদের
পাচুলিয়াতে আসছি...
: ও তাহলে তো আমার
বাড়িতেই থাকতে হবে... কোন বারণ শুনছি না....
: না.... না....
: বললাম না.... বারণ
শুনছি না... আপনি বরং আমাদের বাড়িতে থাকবেন.... এখানেই বাকি কথা হবে... আমি আসবো আপনাকে
নিতে.....
: শুধু... শুধু ঝামেলা
করছেন...
: এত বুঝি না...
রাখছি এখন... আমি আসছি এটা মনে রাখবেন...
: আ... আচ্ছা ঠিক
আছে.... স্মীত হেসে কল কেটে দেয় আলভি।
যবে থেকে এই কেসের
সাথে জড়িয়েছে আলভি দিন রাত কেমন যেন এক হয়ে গেছে। সারাদিন এত ব্যস্ত ছিলো যে রবিনের
কল মেসেজের রিপ্লাই করা হয় নি। দু'বার রিং হতে ওপাশে রবিনের গলা শোনা যায়, ব্যস্ত হয়ে
অভিবাদন জানায় আলভি কে।
: কি ব্যাপার রবিন!...
হঠাৎ এত উত্তেজিত কেন তুমি?!....
: আর বলো না... আজ
আমি ছুটি নিয়ে বেরবো ভাবছিলাম... তোমার সাথে থাকবো কেসের ব্যাপারে....
: হুম্মম... তো?
: উফফ... একটা ছেলে
এসেছিলো ট্রিটমেন্টের জন্য.... সেম একই কথা পাপমুক্তি!!...
: বলো কিহ!!... ত...
তারপর?!!...
: ছেলেটার কথা বার্তা
কেমন যেন অসংলগ্ন.... তার পরিবার পরিচয় ঠিক ভাবে বললো না...
: পাপমুক্তি নিয়ে
কি বলেছে?...
: আমার মনেহয় ওকে
হয়ত ওর অগোচরে কেউ হেপনটাইজ করছে... কিন্তু ও বুঝতে পারছে না... বলে স্বপ্নে কেউ ওকে
আত্মা উৎসর্গ করতে বলেছে.....
: কারণ??...
: উদ্ভট একটা যুক্তি
শোনায় আমাকে.... বলে যার জীবনে কোন দুখ নাই... সে যদি সেচ্ছায় নিজের জীবন কে ত্যাগ
করে.... স্রষ্টা খুশি হয়ে তাকে পাপমুক্তি দিবে....
: কি যত্তসব কথা!!...
তুমি ওর রক্তের পরিক্ষা করোনি?!....
: হুম.. স্যাম্পল
নিয়েছি.... রিপোর্ট চলে আসবে...
: গুড!!... শোন তোমাকে
এখানে আসতে হবে না... তুমি কিছু কাজ করে দাও বরং...
: হুম.. হুম....
বলো না....
: তুমি এখনি থানায়
যাবা আর ওই ছেলেটার স্কেচ করাবা.... ওকে খুজে বের করতে হবে....
: ছেলে টা তো কাল
আবার আসবে বলেছে...
: নাও আসতে পারে!!....
দ্বিতীয় কোন অঘটন হোক এটা চাইনা... জলদি কর....
: আচ্ছা.... আমি
বেরোচ্ছি...
-------------------
রাত ঠিক দশটায় হিজলপুর
থেকে আগত বাস এসে থামে পাচুলিয়া শহরে। আলভি বাস থেকে নামতেই খেয়াল করে ইন্সপেক্টর সামস
তার জন্য অপেক্ষা করছে। কুশল বিনিময় করে ওরা গাড়ি নিয়ে পৌছে যায় মি. সামসের বাড়িতে।
বেশ যত্ন করে তারা আলভি'র। উদর পুর্তি করার পরে চোখের পাতা জোড়া আর কোন ভাবেই বিচ্ছিন্ন
রাখা সম্ভব হয় না আলভি'র।
----------------------------
ভোর পাচ টায় ঘুম
ভাংগে ফোন কলের শব্দে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে আলভি। কল করেছেন ইন্সপেক্টর বাবুলাল,,,
: স...সরি...সরি...
আলভি বাবু... আপনার ঘুম নষ্ট করলাম...
: নাহ... কি যে বলেন...
আমাকেও তো উঠতে হতো... যাকগে... ব..বলছি কোন জরুরি খবর?...
: হ্যাঁ.... ডাক্তার
বাবু তো এসেছিলেন... স্কেচ বানাতে...
: খোজ পেলেন ছেলেটার?
... গম্ভীর স্বরে জানতে চায় আলভি
: প্রায় সব বাড়িতে
খোজ নেয়া হয়েছে... সারারাত আমাদের টিম সজাগ ছিলো.... কোন বাড়িতেই নেই...
: হোটেল যে বাদ পরে
গেলো দারোগা বাবু!!....
: উম্মম্ম.... আসলে...
স্মীত হেসে আলভি
বলে "চোখ কান আমাদের আরো সজাগ রাখতে হবে ইন্সপেক্টর বাবু!!!....."
: আচ্ছা... আমি দেখছি...
: হুম্ম...
ফোন রেখে আলভি ফ্রেশ
হয়। হালকা নাস্তা করে ইন্সপেক্টর সামস কে নিয়ে বেরিয়ে পরে শিপন রায়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
পূজোর ঘর থেকে বেরোতেই এত সকালে অপরিচিত লোকের আগমনে বিপন রায় বেশ অবাক হলেন। ইন্সপেক্টর
সামস নিজেদের পরিচয় দিয়ে আস্বস্ত করেন তাকে। আলভি এগিয়ে আদাব জানায় এরপর বলে
" মাস্টার মশাই!! আমার শিপন কে নিয়ে কিছু জানার ছিলো!!!...."
: এতদিন পর আবার
কেন পুরোনো ক্ষত তাজা করতে চাইছেন!!...
: আমি সত্যিই ক্ষমা
প্রার্থী!!.... তবে আমাদের ধারণা যদি ভুল না হয়.... তাহলে আপনার ছেলে খু**ন হয়েছে...
: খ... খু**ন!!...
আ..আমার ছেলের খ.. খু**ন!!... বলে বিপন রায় আহাজারি শুরু করেদেন। তিনি বিপত্নীক ছিলেন
তাই তাকে শান্তনা দিতে চাকর শুম্ভ ছাড়া আর কেউ ছিলো না বাড়িতে।
নিজেকে সামলিয়ে ধরা
গলায় বলতে শুরু করেন " ছেলে টা আমার বড্ড চঞ্চল চিলো বাবু... মা মরা ছেলে আমার...
কষ্ট করেই বড় হয়েছে... আমিই ওর বাবা মা ছিলাম কিন্তু... ওই.. ওই যে দুষ্টু ছিলো তাই
অনেক বকাও দিতাম.... কি করবো বাবু ছেলে আমার লেখা পড়ায় মন দিতো না... সারাদিন বন্ধু
আড্ডা... এসব করেই পার করতো.... একদিন... একদিন আমি ওকে পাড়ার কিছু ছেলের সাথে নেশা
করতে ধরে ফেলি.... বাড়িতে এনে ছেলে কে প্রচন্ড মার দিয়েছিলাম... এরপর থেকে বাবা ছেলের
মধ্যে আরো বড় দেয়াল হয়ে গেলো.... মাধ্যমিক পরীক্ষার পর নিজেই এসে বলেছিলো কলেজের হোস্টেলে
থাকবে...... বলে আবার কান্নাজুড়ে দেন বিপন রায়।
: হুম্মম.... এরপরে??
: এরপরে তো ছেলে
আমার পরই হয়ে গেলো...বাড়ি তেমন আসতো না...হ্যাঁ... হ্যাঁ.... মারা যাবার কিছুদিন আগে
এসেছিলো....
: কিছু বলেছিলো?....
: নাহ!.... সোজা
ওর রুমে যায়...কি কি যেন নেয়...এরপর ওর মায়ের যা কিছু স্মৃতি ছিলো সবই নিয়ে চলে যায়...
: আপানার স্ত্রী'র
জিনিস?!... কেন??
: জানিনা বাবু!!....
হয়ত ওর মা'কে মনে পরত... শুধু এটুকু বলেছিলো ওর মা নাকি পাপমুক্ত করে গেছে সবাই কে...
: কিহ!!.... আলভি
চোখ বড় করে তাকায় সামসের দিকে যদিও ইন্সপেক্টর সামস এর অর্থ বোঝেন না।
আলভি পুণরায় জিজ্ঞেস
করে " আচ্ছা মাস্টার মশাই!.... আপনি পড়াশোনা মানে উচ্চ মাধ্যমিক কোথায় করেছেন?...."
সামসের কাছে এটি
অহেতুক প্রশ্ন মনে হয় তবুও সে উত্তর জানতে বিপন রায়ের দিকে তাকায়।
ক্ষীণ কন্ঠে বিপন
রায় বলে " পাচুলিয়া সেন্ট্রাল কলেজ.... যেখানে আমার ছেলেও পড়তো......"
: হুম্মম্মম....
মাস্টার মশাই!!... আসি এবার!....
: ছেলে আমার আত্মহত্যা
করেছিলো বলে.... এতটাই রুঢ় বাবা হয়েছিলাম যে ওর শৎকারে পর্যন্ত যাই নি....কিন্তু...
কিন্তু এবার আমি বিচার চাই....
: আমরা সর্বোচ্চ
চেষ্টা করবো....
প্রিন্সিপাল বিপন
রায় থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে দুজনেই। আলভি ইন্সপেক্টর সামস কে বলে এখনই তাদের একবার
সেন্ট্রাল কলেজে খোজ নিতে যেতে হবে।
বিনাবাক্যবয়ে ইন্সপেক্টর
সামস আলভি কে নিয়ে কলেজে হাজির হয়। সাধারণত এত সকালে অধ্যক্ষ মহোদয়ের সাক্ষাত পাওয়া
দুস্কর ছিলো তথাপি আসন্ন জাতীয় উৎসব কেন্দ্র করে হয়ত তিনি উপস্থিত থাকতে পারেন এই অনুমানে
তারা সেখানে পৌছায়। দেখা যায় তাদের অনুমান ভুল হয় না অধ্যক্ষ মহোদয় নিজ কামরায় ছিলেন।
কেরানি গোছের লোক টাকে জানালে অধ্যক্ষ তার কক্ষে ওদের কে ডাকেন। আলভি প্রথমে কুশল বিনিময়
করে এরপরে কলেজের সম্পর্কে নানা বিষয় নিয়েই অধ্যক্ষ মহোদয়ের সাথে আলাপ করে। এরই মাঝে
তাদের জন্য তিন কাপ চা'ও দিয়ে যায় কেরানি। শিপনের প্রসঙ্গে জানা যায় ছেলে টি একদম নাকি
চুপচাপ ছিলো, তেমন কোন বন্ধুও ছিলো না। বেরিয়ে যাবার আগে আলভি একটা ছবি দেখালে অধ্যক্ষ
মহোদয় উৎফুল্ল হয়ে যা জানেন বলেন। হাসি মুখে বেরিয়ে আসে আলভি।
ইন্সপেক্টর সামস
বিরক্তি নিয়ে বলেন,,,
: মি. আলভি! কি করলেন
এটা আপনি?.....
: যেমন?....
: কাজের কোন কথা
বললেন বলুন?.... চা খেলেন আর কলেজ... রাজনীতি এসব নিয়ে আলাপ জুড়ে দিলেন....
রহস্যময় হাসি দিয়ে
আলভি বলে " আসল খবর জেনেই এসেছি.... রাতে আবার ডাকাতি করতে যেতে হবে তো এখন চলুন!....
বাড়ি যেয়ে পেট পুর্তি করে নিই......."
ইন্সপেক্টর সামস
অবাক হয়ে বলেন " ড... ডাকাতি করবেন!!...."
: শ... শ... আস্তে!!....
দেখেন খালি এই কেস টা আর কি কি করায়!.....
: আচ্ছাহ!!!... আপনি
তো আর আগে থেকে কিছু বলবেন না.... চুপ থাকাই শ্রেয়!!....
আলভি ইন্সপেক্টর
সামসের দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে দেয়।
--------------------------
ইন্সপেক্টর সামস
থানাতে চলে গেছেন অগত্যা আলভি একাই রাতের ডাকাতিতে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
মোটামুটি ছক কষা শেষ এবার খুশি মনে আলভি রবিন কে কল দিতে রিসিভ হয়।
আলভি বলে "
বন্ধু!!! আজকে সত্যিই তোমাকে অনেক মিস করবো... আজ কে ডাকাতি করতে যাচ্ছি তো!!....."
ওপাশ থেকে রবিনের
উত্তর কি ছিলো শোনা যায় না কিন্তু রবিন হয়ত বিশেষ কোন তথ্য দিয়েছে যারফলে আলভি'র হাসি
মাখা মুখ টা ভীষণ রকমের গম্ভীর হয়ে যায়।
চলমান......
( গল্প টি আপনার
কেমন লাগছে কিংবা এর প্লটের কোন ভুল ত্রুটি থাকলে কমেন্ট বক্সে জানানোর অনুরোধ রইলো)
0 Comments