লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
আছিয়া ছাদে দাঁড়িয়ে আছে, সমুখে ম্লান বিকেলের আলোকচ্ছটায় অপার্থিব ছায়াপ্রলেপ। মৃদুমন্দ শীতল বাতাসে তার কেশপাশ উড়ে বেড়াচ্ছে, অদৃশ্য কোনো প্রতিজ্ঞার আহ্বান। প্রভাতের সঙ্কটময় সেই স্বপ্ন, যা তার চেতনাকে ঘিরে রয়েছে, তাকে বিভ্রান্ত করছে অবিরাম। স্মৃতির কোণে প্রতিধ্বনিত হয় জীবন ভাইয়ের সেই ডাকে মোহন সুর, যা ফুলবাড়ির পথে তাকে আহ্বান জানিয়েছিল। ভালোবাসার অকপট উচ্চারণে তাকে বক্ষে আশ্রয় দিয়েছিল; তারপর, জীবন ভাইয়ের সেই প্রগাঢ় চুম্বনে সে অকস্মাৎ অচেতন হয়ে পড়ে।
অবচেতনার নীলাঞ্জন কুয়াশা ভেদ করে যখন সে চক্ষু মেলল, নিজেকে আবিষ্কার করল নিজের ঘরে। কিরূপে এলো সে এখানে? স্বপ্ন হলে তো প্রত্যাশিত রূপে বসন পরিবর্তন থাকত। অথচ, যা পরে গিয়েছিল, তা-ই দেহে বিদ্যমান! চিন্তাসূত্রের আঁধারে অন্ধকারে সে খেই হারিয়ে ফেলে; সরলতার আচ্ছাদনে আচ্ছন্ন, সে কীভাবে বোঝে এ নিগূঢ় রহস্য? তন্মধ্যে জীবন ভাইয়ের মোবাইলও নির্বাক! ব্যাকুল হৃদয়ে বারবার চেষ্টা করে, একটিবার জানার জন্যে সব দিগন্তে আকুল আহ্বান জানাচ্ছে।
আচ্ছা, জীবন ভাই নিজেই কি তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছেন? কিন্তু, এতটা অলৌকিক কি করে সম্ভব হয়? অপ্রাকৃত অনুভূতির ভাঁজে ভাঁজে সে হারিয়ে যায়, চিন্তায় নিমগ্ন কপালে রেখা ফুটে ওঠে। হাতে ধরা মুঠোফোনে বারংবার জীবনের ফোনে অস্থির কল পাঠায়, যেন অজ্ঞাত এক উত্তর প্রত্যাশায় প্রতিটি আঙুল কাঁপছে।
ফোন বারংবার কল করেও একই প্রতিধ্বনি, “বন্ধ,” আর সহ্য করতে না পেরে গভীর বিষণ্নতায় আছিয়া নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। হঠাৎ, নিরাশার গহ্বর ভেদ করে রিংটোনের মৃদু সুর শোনা যায়; বিস্ময়ে তার দৃষ্টিতে ঝিলমিল করে আনন্দের অশ্রু। জীবন ভাইয়ের সেই নাম্বার থেকে, অভিজ্ঞান যেন ফিরে আসে। আনন্দের জোয়ারে আছিয়া আত্মহারা। রিসিভ করতেই জীবনের কণ্ঠ ভেসে আসে,
——— “হুঁ, বলো পরি।”
পরি! এই সুমধুর শব্দ শুনে আছিয়ার হৃদয় ত্রাসিত নীরবতা ভেঙে আনন্দের ঢেউয়ে উথলে ওঠে। পরি! তার মানে প্রভাতের সেই নিঃশব্দ অনুভব কল্পনা নয়, সত্যের প্রতিচ্ছবি! উৎফুল্ল কণ্ঠে, জিজ্ঞাসা করে,
——— “জীবন ভাই, আমি ভোরে অজ্ঞান হওয়ার পর বাড়ি কেমন করে এলাম?”
জীবন হেসে বলে,
——— “কোথায়? তুমি তো নিজেই হেটে হেটে বাড়ি প্রবেশ করেছ, মনে নেই?”
সরল অন্তরের আছিয়া বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে যায়। অচিন্ত্য রাগের ক্ষিপ্ততা নিয়ে বলে,
——— “না, না! আমাকে বোকা ভাবছেন? সত্য বলুন, কেমন করে বাড়ি ফিরলাম আমি?”
জীবন মৃদু হাস্যে দোকানের দ্বারে প্রবেশ করতে করতে বলে,
——— “একটা বড় বানর এসে তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে।”
আছিয়া চোখ বিস্ফারিত করে বলল,
——— “কিহ! আল্লাহ! যদি আমাকে খামচে দিত? যদি কামড়ে দিত? আপনি আমাকে বানরের হাতে একা নির্দয় ছেড়ে দিলেন? কিভাবে পারলেন?"
আছিয়ার অজ্ঞ দৃষ্টির বিস্ময় দেখে জীবন অট্টহাস্য করে বলে,
——— “ভয় করো না! সে বানর তোমার কোনো ক্ষতি করবে না! ভয় তো আমার, সে কিছু করতে হলে আমাকেই গ্রাস করবে।”
জীবনের কথার অন্তর্গূঢ় ইঙ্গিত সরল আছিয়ার ভাবনার গণ্ডিতে প্রবেশ করে না। হালকা মিষ্টি হাসির বিনিময়ে ফোন রেখে দেয় জীবন, বাতাসে ভাসতে ভাসতে আছিয়া গৃহে প্রবেশ করে। এখন তো রূপচর্চা প্রয়োজন, ত্বকের যত্নে মুখে ফেস প্যাক লাগাবে সে—তবেই তো তার রূপলাবণ্য বয়ে যাবে পরিপূর্ণতা নিয়ে!
_____________
——— "ভয় পাবে না তুমি! যদি মুগ্ধ কিছু বলার দুঃসাহস দেখায়, সোজা আমার কাছেই অভিযোগ আনবে! সে কি না সিআইডি, তাতে কি! তুমি হয়ত অবগত নও, মুগ্ধ আমাকে সমক্ষে দেখলে ত্রাসে কাঁপে; দেহের এক পলকও টলতে সাহস পায় না! জানো, সিআইডি হবার মর্ম সে আমার দ্বারাই চিনেছে! আমার প্রতিটি পদক্ষেপ তার দৃষ্টিতে এমন এক বীরত্বে আবৃত যে, অজান্তেই আমাকে আদর্শ জ্ঞান করে নিজেই সিআইডি হতে প্রবৃত্ত হয়েছে। আহা, কতখানি মানে আমাকে! ওহ্, দাঁড়াও, আমি কি যেন জিজ্ঞাসা করছিলাম?"
আঁখির মনে যেন হাজার স্রোতের তুফান উঠেছে, মাথা ভারাক্রান্ত ও চঞ্চলতায় আবদ্ধ; কপালে হাত রেখে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
——— "আমার বয়স..."
রোহান দন্ত-নখে হেসে সগর্বে প্রত্যুত্তর দিল,
——— "হাহ্ হাহ্! বয়সের ন্যায় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মন মথিত করো না! শুনলে, প্রাচীন কালে কন্যাদের সপ্তম কিংবা অষ্টম বর্ষেই বিবাহ হত, তবুও বিচ্ছেদের মাত্রা ছিল ন্যূনতম, ভালোবাসা ছিল অটল! শোনো, তোমাকে তো বলেই দিলাম মুগ্ধের কাছে কোনো ভয়-বিহ্বল হওয়া প্রয়োজন নেই! আচ্ছা যাই হোক, তোমার বয়স কতই বা?"
আঁখি ক্লান্ত ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
——— "দুদিন পরেই ১৮!"
রোহান হাসিতে উগ্রভঙ্গিতে দাঁত বের করে বলল,
——— "আহহা! জন্মদিন, তাই তো! বেশ, শোনো, উপহারের অভাবে মন ভার কোরো না যেন! আমার বন্ধুও দেখো একেবারে গর্দভ! জানে না মেয়েদের সাথে কথোপকথন কিভাবে শুরু করতে হয়! হাহাহা! সে যে আমার ছায়া ছাড়া এক পা-ও ফেলতে পারে না! দুজন মিলে ওর মাথায় চেপে বসব, ঠিক আছে?"
আঁখি একটু লজ্জিত হয়ে হাসল, মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। রোহান হাসিতে লুটোপুটি খেতে খেতে বলল,
——— "আহহা! আমি কি ঐ শালার মতো ভীষণ রাক্ষস নাকি? আমাকে ভয় পাওয়ার কী আছে? জানি, সবাই আমার ভয়ে দূরে থাকে! আমার সাথে কথা বলতে গেলে হাঁটু কাঁপে সবার! কিন্তু তুমি, পিচ্চু, তোমার ভয় পেতে হবে না! আমি তো তোমার... ভাসুর? না, না, ভাইয়া বললেই ভালো হয়, বুঝলে? ভাসুর তো দূর সম্পর্কের কথা বলে! তাই না?"
আঁখি আর ধৈর্য রাখতে পারল না! মনে হচ্ছিল দুই হাতে দুই কান চেপে ধরতে। মনে মনে বলল,
——— "ভয় করবে না? এই যে, থামতে জানে না! আল্লাহ, কেন দেখা হলো! আল্লাহ আমাকে রক্ষা করো! আর কখনও এ পথে পা বাড়াব না!"
আঁখি আজ নিঃসঙ্গ মনে প্রশান্তি খুঁজতে শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত পুকুর পাড়ে পদচারণা করেছিল। এই পুকুর পাড়, তার জীবনস্মৃতির অমূল্য রত্ন, যেখানে বাতাসের মৃদু মর্মরে স্নিগ্ধ প্রশান্তি মেলে। নির্জনতার আবহে সে কিছুটা শান্তি পেয়েছিল, সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু হায়, প্রত্যাবর্তনের পথে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এক অদ্ভুত দৃশ্য! লুঙ্গি পরিহিত এক উল্লসিত নৃত্যশিল্পী যেন কেবল তার দিকেই ধেয়ে আসছে, আর সে যে আর কেউ নয়, সেই রোহান, তার কথার তো কোনো শেষ নেই! আঁখি তার একঘেয়ে বকবকানি সহ্য করতে না পেরে এক প্রকার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, মনে মনে আকুলভাবে কামনা করে যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রেহাই মেলে।
অবশেষে বিরক্তির সুরে মৃদু হাসি হেসে বলল,
——— "ভাইয়া, আপনার কি 'ক খ' পাঠ জ্ঞান হয়েছে?"
রোহান ভ্রু কুঁচকে আত্মগরিমায় বলল,
——— "ওহহহ মাইইই গড! তুমি কি বলে বসলে! বড় বড় বিদ্যাপীঠে আমার জ্ঞানের খ্যাতি ছড়িয়ে আছে! কত শিক্ষক মন্ডলী, কত ছাত্র-ছাত্রী আমায় বিশেষ অতিথি হিসেবে ডাকেন, যেন একদিনের পাঠও তাঁদের সমৃদ্ধ করে! আর আমি ক খ পারব না? হহাহাহা! বলো, তুমি কি আমার কাছ থেকে ক খ শিখতে চাও?"
আঁখি ঠোঁটে চাপা হাসি রেখে বলল,
——— "আপনি তো মহা জ্ঞানবৃক্ষতুল্য! তবে শর্ত এই, পুরো ক খ থেকে ঁ-চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত যদি নির্ভুলভাবে বলতে পারেন, তাহলে আজ আপনাকে ট্রিট দেবো। তবে একটি ভুলও হলে, বাসায় গিয়ে শিখে আসতে হবে। পরদিন আবার এখানে আসবেন, আমি তখন শুনে নিবো। কিন্তু ট্রিট পাবেন না! রাজি?"
রোহান একটুখানি গম্ভীর হয়ে বলল,
——— "ওহহোহো! চ্যালেঞ্জ? ওকে ওকে, আই লাইক চ্যালেঞ্জ!"
আঁখি ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে বলল,
——— "নিন, শুরু করুন! আর চোখ বুজে বলুন! তাহলে সব কল্পনায় ভেসে আসবে! "
কথামতো রোহান চোখ বুজে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর গলায় শুরু করল,
——— "ক খ গ ঘ ঙ... জ ঝ ঞ... প ফ ব..."
কিন্তু হঠাৎ করেই মাথায় কারো ঝটকা খেয়ে রোহানের চিন্তায় বাধা পড়ল! সে মাথা হাত দিয়ে রাগে চোখ খুলে তাকাল এবং মুহূর্তেই অবাক! একি আঁখি কই? আঁখি তো কোথাও নেই। আর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ! রোহান হতভম্ব হয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
——— "মুগ্ধ! তুইই? আঁখি কই??"
মুগ্ধ গম্ভীর স্বরে বলল,
——— "গাধা! তোকে ধোঁকা দিয়ে টুপি পরিয়ে পালিয়েছে।"
——— "কিহহহ!"
মুগ্ধ ধীরে শ্বাস ফেলে বলল,
——— "ওর কানের কাছে বকবক চালিয়ে যেতে কে বলেছিল।"
রোহান হতাশার সুরে মাথায় হাত দিয়ে বলল,
———" হায় হায়! আমায় ক খ পড়ানোর ফাঁদে ফেলে গেলো? তোর বউ কি ছলনার কারিগরি খুলে বসেছে? সে কি টুপির ব্যবসায়ী? আমায় এমন টুপি পরিয়ে দিলো!"
রোহান মথায় হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে চারপাশে তাকিয়ে বলল,
——— "কিরে, টুপি কোথায়?"
মুগ্ধ গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
——— "আমার হাতে ধোলাই খেতে না চাইলে, ওকে আর এমনভাবে পথে আটকে তোর বকবক চালু করিস না!"
কিন্তু রোহান লুঙ্গির প্রান্ত আঁকড়ে প্রবল উন্মাদনায় দৌড় দিল, উচ্চস্বরে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
——— "তোর বউ কোথায় লুকাবে? আমি তাকে পাকড়াবোই! সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যদি আমি ক খ পারি আমাকে ট্রিট দিবে! অথচ এখন সেই আমাকে ছলনার ফাঁদে ফেলে কোথায় আত্মগোপন করেছে? এখনও এই পথেই লুকিয়ে আছে, নিশ্চয়ই! ওহে ক্ষুদ্র প্রতারণাকৌশলিনী, কোথায় লুকালে? আমার প্রাপ্য ভোজ অনির্দিষ্ট থাকতে পারে না! কোথায় আছ তুমি?
মুগ্ধ বিস্ময়ের নিমগ্নতায় স্থাণু হয়ে তাকিয়ে রইল! এ কি তার বন্ধু কি পাগল? এখন সে আঁখির পিছু নেবে, আর একটুখানি খাবারের জন্য এভাবে অপমানিত হবে! অপার নির্লজ্জতায় সে কনিষ্ঠার অর্থ দখলে আগ্রহী! মুগ্ধর মনে হল, এই মুহূর্তে নিজের কপালে হাত ঠুকিয়ে হাহাকার করে। ভাগ্যিস আঁখিকে এই পথে যাত্রা করায়নি!
ঠিক তখনই আঁখি গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো, এবং হাসির প্রাবল্যে তার সমস্ত অস্তিত্ব কম্পিত হয়ে উঠল, যেন হেসে অঙ্গাঙ্গি ভেঙে পড়বে যে কোনো মুহূর্তে!
মুগ্ধ বিরক্তির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আঁখির দিকে ঘুরে তাকিয়ে রইল। আঁখি মুখ চাপা দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
———" বাহ বাহ, আপনার বন্ধু এখন আমার পিছু শিকারের ন্যায় লেগেছে!"
মুগ্ধ এক দীর্ঘশ্বাসে অস্থিরতা প্রকাশ করে, আঁখির কাছে গিয়ে দুই কাঁধ ধরে তাকে গাছের সাথে ঠেসে ধরল! আঁখির মুখের হাসি মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল; বিস্ময়ের চোখে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে রেগে বলে উঠল,
——— "এই, আবার সেদিনের মতো শুরু করেছেন? কেবল মাত্রা ছাড়ান! বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঘু'ষি মেরে নাক ভেঙে দিবো!"
মুগ্ধের চোখে ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল; গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
——— "আমার সামনে হাসবে না! যদি কোনো অঘটন ঘটে, তার দায়ভার তুমি বহন করবে?"
আঁখি চোখ পাকিয়ে একদম মুগ্ধর পেটে আঘাত করল, মুগ্ধ ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে ছেড়ে দিল, এটা প্রকাশ্য পথ, কেউ দেখে ফেলতে পারে! আঁখি ক্রোধে বলল,
——— "অসভ্য লোক! আমাকে স্পর্শ করার সাহস আসে কোথায় আপনার? আর হ্যাঁ, দুর্ঘটনা তো ঘটবেই! আপনার হাত-পা ভেঙে দেব আমি, সেটার দায়ভারও আমারই! হুহ!"
মুগ্ধ কঠোর মুখে ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি চাপা দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
——— "জেলে নিক্ষেপ করবো! বেমালুম ভুলে যাচ্ছো তুমি কার সাথে কথা বলছো?"
আঁখি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল,
——— "কচু! আগে গিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের দমনে মনোযোগ দিন! এসেছে আমাকে ভয় দেখাতে!"
মুগ্ধের কণ্ঠ ক্রমশ কঠিন হলো, বলল,
——— "অপরাধীর সঙ্গেই তো আলাপ করছি এখন।"
আঁখি ভ্রু কুঁচকে প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,
——— "হ্যাঁ হ্যাঁ, নিন, করুণ গ্রেপ্তার!"
দুই হাত তুলে যেন আত্মসমর্পণ করল আঁখি, আর মুগ্ধ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আঁখি ঠোঁটের কোণায় এক মৃদু বিদ্রূপের হাসি ঝরিয়ে বলল,
——— "হুহ! এলো আমায় ধরতে! যত্তসব!"
ঠিক সেই মুহূর্তে রোহান যেন এক বলদ্রূত বলশালী ষাঁড়ের মতন লুঙ্গির প্রান্তে প্রবলবেগে দৌড়ে এগিয়ে ফের এল। আঁখিকে দেখেই তার কণ্ঠস্বরে জয়ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল,
——— "পেয়েছি, পেয়েছি! এই তো প্রমাণিত হলো! তোমরা দুজন আমাকে ধোঁকা দিয়ে প্রেমালাপের প্রহসনে মেতে আছো? আহা, তবে পিচ্চু আমার ট্রিট চাই!"
রোহানের দৃষ্টিপথে দৌড়ে আসতে দেখে আঁখি তৎক্ষণাৎ দংশিত বালিকার ন্যায় জিভ কামড়াল। মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে আকুলভাবে বলল,
——— "এইই! আপনার বন্ধু কি পাগল? থামান তাকে! "
একথা বলেই আঁখি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পলায়নের পথ ধরল। রোহান তার পিছু পিছু খেকিয়ে খেকিয়ে হাসতে লাগল,
——— "কোথায় পালাবে! আমাকে প্রতারণায় মজিয়েছো, আর ভাবছো পালাতে পারবে?"
রোহান যখন মুগ্ধর পাশ দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে অতিক্রম করতে উদ্যত, মুগ্ধ তখন শ্বাপদগ্রস্ত সিংহের তেজে তার কলার আঁকড়ে ধরল এবং নির্দয় কঠোরতায় দাঁত চেপে বলল,
——— "কী ব্যাপার ভাই? কি সমস্যা? ওর পিছু লাগলি কেন? তুই কি পাগল?"
রোহান হঠাৎ মুগ্ধর পেশীবহুল বুকের উপর রসিকতার আঘাত হেনে হাসিতে ফেটে পড়ল,
——— "হা হা! দূর হ ব্যাটা! আমি কি তোর সংসার ভাঙছি নাকি যে তোর বউয়ের পিছু নিব? বাচ্চা মানুষকে ভয় দেখিয়ে মজা নিতে বেশ লাগে! হিহিহি! "
মুগ্ধ ক্ষিপ্ত স্বরে হুংকার দিয়ে বলল,
——— "প্রথমত, আমার বউয়ের উপাধি দেওয়াটা বন্ধ কর! আর একবার যদি এই সম্বোধন শুনি, তবে দাঁতগুলো একটিও অবশিষ্ট রাখব না!"
রোহান ঠোঁট বাঁকিয়ে ঠাট্টার সুরে বলল,
——— "হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি গোপনে মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের রাজনীতি চালাও! আর আমরা বললেই হঠাৎ বিপ্লব! শালার গোপনে আমায় দূরে ঠেলে দিয়ে এতক্ষণ তো বেশ করেই ঘনিষ্ঠ আলাপ জমিয়েছিলি!"
মুগ্ধ নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল,
——— "আচ্ছা তুই কি মানুষ হবি না? তুই গাধার মতো কথা বলে তার কান খেয়েছিস, তাই ওকে বোঝালাম যে তোর মাথায় কোনো মানসিক গোলযোগ নেই!"
রোহান মুখ ফুলিয়ে আবেগে সুর করে বলল,
——— "হেই, ইউউউ, চুপ কর! আমায় দেখলেই তোর বউ ভয়ে কাঁপতে থাকে! দেখলি না, কীভাবে দৌড়ে পালালো?"
মুগ্ধ বিরক্ত কণ্ঠে উত্তর দিল,
——— ‘পাগল দৌড়ানি দিলে কি করবে?? আর ভয়? এই যে তোকে পাগলাগারদে পাঠানো হয়নি, সেই দানে তুই দোয়া কর!.! গাধা!’
রোহান চোখে বিদ্রূপের শিখা জ্বেলে মুগ্ধের দিকে রুষ্টভাবে তাকিয়ে বলল,
——— "তুই তো এখন বউয়ের হয়েই কথা বলবিই! ওরে বাবাহ, কী অপূর্ব নাটকীয়তা! তুই আর তোর বউ মিলে সবাইকে এমন চতুরতার টুপি পরাস! আজ আমাকেও সেই ধাঁধায় আবদ্ধ করলি!"
মুগ্ধ বুঝলো কথা বাড়িয়ে লাভ নাই! তাই কথা এড়িয়ে যেতে মুগ্ধ নিঃশব্দে রোহানের কাঁধে হাত রাখল, কণ্ঠে গভীরতার মিশেল,
——— ‘চল, চায়ের কাপে আস্বাদ মেলে তুই-আমি মিলেই।’
রোহান মুগ্ধের আহ্বান পেয়ে তুলতুলু শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে বলল,
——— "হ্যাঁ হ্যাঁ, চল বন্ধু, যাই!"
অদ্ভুত এই বন্ধুত্বের বাঁধন! পাথরসদৃশ কঠোর মুগ্ধের সামনে একমাত্র রোহানই নির্দ্বিধায় সব বলার সাহস রাখে, নিঃশব্দ অশ্রুত বন্ধুর নামে একান্তভাবে নিজেকে সঁপে দেয়। পৃথক অস্তিত্ব, পৃথক প্রবৃত্তি হলেও, এ বন্ধুত্ব ব্যতিরেকে জীবন যেন তুচ্ছ, রঙহীন মরুভূমির ন্যায় নিঃসঙ্গ! রোহান তার একগুঁয়ে বন্ধুর হাসির পিছনে প্রহসনের মুখোশ পরিধান করে দাঁড়ায়, তাকে হাসাতে যদি নিজেকে ব্যঙ্গের প্রতিমা বানাতে হয়, তবুও দ্বিধা থাকে না। বন্ধুর জন্য এইটুকু কি করা যায় না?
আর মুগ্ধও সহাস্যে রোহানের কথাগুলি শ্রবণ করে যায়, নিঃশব্দে মেনে নেয় বন্ধুর উচ্ছল অভিব্যক্তি। হ্যাঁ, কখনও কখনও রোহান কথার সীমা অতিক্রম করলে, মুগ্ধের নির্ভুল ঘুষির জবাবে নির্ধারিত সীমা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। তবে, বন্ধুত্বের এই অদ্ভুত প্রণয়ে রোহানের মনের গভীরে যে চাপা দুঃখ ও আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে আছে, মুগ্ধ তা নিঃসন্দেহে অনুভব করে। মুগ্ধর আত্মা এই বোঝাপড়ার মাধ্যমেই রোহানের অন্দরের কষ্টগুলি ধারণ করে।
কিন্তু তাদের এই মধুর স্মৃতির মাঝেই অমোঘভাবে উঁকি দেয় এক তিক্ত স্মৃতি, আফ্রিদির। সেই অন্ধকারে ডুবে থাকা বন্ধু, যাকে জেলখানার প্রাচীরের মাঝে জীবনভর গুমরে মরতে হচ্ছে। মুগ্ধও অস্বীকার করতে পারে না, সেই পুরানো বন্ধুর জন্যও তার অন্তরের প্রতিটি কোণ জ্বলেপুড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ওঠে। যুক্তির পথ যখন বন্ধ হয়ে যায়, অন্তর্দাহের গভীর থেকে একটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, ‘মুগ্ধ, সব তোরই দোষ! তোর জন্যই আজ এই ছিন্নভিন্ন দশা।’
মুগ্ধের আর কিছু করার থাকে না তখন। সে এক অসহায় আগুনে দগ্ধ এক ভ্রষ্ট আত্মা, যার হাত থেকে ফসকে গেছে বন্ধুর জন্য প্রার্থিত শান্তি। সে শুধুই প্রার্থনা করে,
——— "থাকুক এই বন্ধুত্বের অমোঘ বন্ধন। যেন আর কখনও এমন দুর্যোগ আসে না, যে ভুল বুঝাবুঝির ছোবলে সব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।"
_____________
রুদ্র, এক অজানা আশঙ্কায় দীর্ণ, নিজেকে ডাক্তারের সঙ্গেই ব্যস্ত রেখেছে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, বুকে গভীর সত্তার অসহ্য ভার। প্রিয়ার আকস্মিক অন্তর্ধান যখন কালকের সারাটা দিন কেবল উদ্বেগ আর আশ্চর্যের ঘনঘটায় আচ্ছন্ন করেছিল, তখনো তার কল্পনা ছিল না এমন মর্মান্তিক পরিণতির সম্ভাবনা। তবু মনোজগতের আবছায়া কোণায় এক চাপা দুঃশ্চিন্তা বিষাদময় ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যেন অশুভ সংকেতের মৃদুমন্দ উপস্থিতি। চাচা-চাচির আশঙ্কার ছায়াও গভীর হয়ে আসছিল, বেদনাভারাক্রান্ত ঊর্মিলা বেগম অসহায়ভাবে আকুল ক্রন্দনে যখন প্রায় মূর্চ্ছার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন।
কাল রাতে যখন হাসপাতাল থেকে নীরব, অশরীরী কণ্ঠের মতো সেই ফোন এলো, তখনই এক বিপন্নতার অন্ধকারে ডুব দিয়েছিল রুদ্রের আত্মা। প্রিয়ার বিধ্বস্ত দেহ হাসপাতালের স্নিগ্ধ, র'ক্তমাখা শীতল গন্ধময় বাতাসে অচেনা এক নৈরাশ্যের স্রোত বয়ে এনেছিল। রাতে একবার তাকে দেখে গিয়েছিল রুদ্র; কিন্তু চাচিকে, আর্ত অনুরাগে বেঁধে রাখা ঊর্মিলা বেগমকে সে রেখেছিল প্রিয়ার পাশেই। যেতে পারেনি রুদ্র; চাচির সেই অভিশপ্ত শূন্যতার পাশে নিজেও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল, তবুও স্বীয় কৃপায় জয়নাল সাহেবকে বাড়ি পাঠাতে সমর্থ হয়েছিল। একদিকে বৃদ্ধকায় ক্লান্ত দেহ, অন্যদিকে হাসপাতালের ক্লোরোফর্ম আর ঔষধের গন্ধের কাছে তিনি ক্রমেই অসহায় বোধ করছিলেন।
আজ দিনের সমস্ত কর্তব্যের শেষে, মনকে দৃঢ় করেই পুনরায় উপস্থিত রুদ্র হাসপাতালে।
রুদ্র বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল যখন শুনল প্রিয়ার প্রতি নৃ'শংসতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে, কেরোসিন খাইয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে, মুখের একপাশে কাঁ'চির ধার দিয়ে কে'টে দেওয়া হয়েছে নির্দয় হিং'স্রতায়। এমন পৈশাচিকতা, কোন অজ্ঞাত পরশত্রু এত ভয়ংকর হিংসা পোষণ করে প্রিয়ার প্রতি? এই নবাগতা, যার এ স্থানে কিছুমাত্র পরিচয় নেই, এমন মর্মান্তিক অত্যাচারের শিকার হল কেন? রুদ্রের মন আড়ষ্ট হয়ে পড়ল প্রশ্নবানে, কে এমন নিষ্ঠুরতম পৈশাচিকতায় প্রবৃত্ত হল?
ডাক্তার জানিয়েছেন, প্রিয়া সঙ্কটাপন্ন, মলিন ও অচেতন কণ্ঠে কথা বলার সামান্য ক্ষমতাও তার নেই। রুদ্র তাই অপার কৌতূহল চেপে রেখে অপেক্ষা করেছিল, নিজেকে সংবরণ করেছিল জিজ্ঞাসার শিকলে। তবে আজ, ডাক্তার খবর দিয়েছেন, প্রিয়ার দেহে ক্ষীণ শক্তির প্রাবল্য আসতে শুরু করেছে, কথোপকথনের সাহস সে অর্জন করেছে, যদিও অতিরিক্ত প্রশ্নে তাকে ক্লান্ত করা নিষিদ্ধ।
রুদ্র এখন থমকে দাঁড়িয়েছে, প্রিয়ার কাছেই চলেছে জিজ্ঞাসাবাদ করতে, এক পরিস্ফুট রহস্যের অন্ধকারে আলো ফেলতে। সেইসব জটিলতার মাঝে সুধীর আহ্বান রয়েছে; হৃদয়ের গভীরে প্রবল সংকল্প, প্রিয়ার দুঃসহ নীরব যন্ত্রণার অন্তঃস্থল স্পর্শ করবে, তার কণ্ঠ থেকে সত্যকে মুক্ত করবে।
রুদ্রের পদ থমকে দাঁড়াল, অজানা আশঙ্কায় গ্রথিত তার হৃদয়। কেবিনের দরজার ওপার থেকে ভেসে আসা ঊর্মিলা বেগমের কণ্ঠস্বর তাকে বিচলিত করে তুলল, সেই কণ্ঠে এক চাপা ধ্বনি, যা প্রশ্নের মৃদু ধারায় ছিন্ন করে তুলেছে বাতাসকে,
——— "বাবা, তুই চিন্তা করিস না! রুদ্রর তোকে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই! ও ধরতেও পারে নি তোর আসল চেহারা! আর ওই মেয়েটা? ওই মেয়েটাই এমন করেছে তুই শিউর?"
প্রিয়ার কণ্ঠ ভাঙা, তবুও সেখানে নিরেট দৃঢ়তা, এক অব্যক্ত শঙ্কার ছায়া। সেই স্বর যেন রুদ্রের মস্তিষ্কে স্রোতের মতো প্রবাহিত হলো, অদৃশ্য অন্ধকারের স্বরূপের দিকে টেনে নিয়ে গেল,
——— "হ্যাঁ মা! ওই মেয়েটাই! মা, ও অনেক ভয়ানক! প্রথম থেকেই আমি ওর প্রকৃত চেহারা বুঝতে পারি নি, কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল! সে নির্দয় পাষাণী! আমায় চিনতে পেরে আমায় শেষ করতে চাইছে!"
রুদ্র তখনই থমকে গেল, গভীর চিন্তার গোলকধাঁধায় নিমজ্জিত হল। এই অজানা রহস্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর সত্য, প্রিয়ার প্রতি কারও নির্মম আক্রোশের কারণ। তবে প্রিয়া কে? কেমন সেই অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি, যার নির্মম ছোবলে প্রিয়া আজ এমন বিপন্ন?
রুদ্রের পায়ের শব্দ কেবিনের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিল, আর মুহূর্তেই প্রিয়া ও ঊর্মিলা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। নিজেকে নির্বিকার রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে রুদ্র কেবিনে প্রবেশ করল, যেন কিছুই শুনেনি এমন ভান করে।
ঊর্মিলা বেগম সস্নেহে ডাকলেন,
——— "আয় বাবা, বোস! দেখ, আমি এমনি এমনি চিন্তা করিনা! কে যেন মেয়েটাকে ভয়ানক অত্যাচার করেছে।"
রুদ্র চেয়ার টেনে বসে পড়ল, কিন্তু বসার সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখ আটকে গেল প্রিয়ার গলায়। হসপিটালের রোগীসুলভ পোশাকের নিচে উন্মুক্ত গলার ওপরে সেই অদ্ভুত দাগ, কোনো গভীর রহস্যের চিহ্ন। এই দাগটি দেখে রুদ্রের বুকের মধ্যে এক ধাক্কা খেল, তার মানসপটে জেগে উঠল এক পরিচিত নাম, যা বহুদিনের স্মৃতিতে চাপা পড়ে ছিল।
কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে কঠিনভাবে সংযত করল রুদ্র, কীসের ভিত্তিতে এমন অবাস্তব কল্পনা? কেবল একটি জন্মদাগ দেখে এমন ভাবা কি যুক্তিসঙ্গত? পৃথিবীতে একই রকম দেখতে মানুষ থাকতে পারে, এ তো জানা কথাই। তবু এই দাগ যেন তার মানসপটের দৃশ্যকে তীক্ষ্ণ করে তুলেছে, সেই আড়ালে লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত মিলের অবধারিত টান অনুভব করছে সে।
প্রিয়া তার দৃষ্টির অবচেতন প্রতিক্রিয়া অনুভব করে অপ্রস্তুতভাবে তাড়াহুড়ো করে গলায় চাদর টেনে নিল।
রুদ্র দ্রুত দৃষ্টিটা অন্যদিকে সরিয়ে নিল, হঠাৎ ধরা পড়ে গিয়েছে এমনই অপ্রস্তুতি তার চোখে-মুখে। মনের ভেতরে সন্দেহের ক্ষীণ স্রোত বইছিল, সে কি ঠিকমতো প্রিয়াকে কখনো দেখেছে? সত্যি বলতে, একই বাড়িতে থেকেও প্রিয়ার উপস্থিতি তার কাছে অবজ্ঞার কারণ ছিল! এমনকি প্রিয়া তার ঘরের কাজের মেয়ে, তবুও কোনোদিনই তাকে গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করেনি। সামনে এলে শুধু চেহারাটা ভেসে উঠত, কিন্তু সেই দেখায় যত্নের লেশমাত্র ছিল না; বরং কিছুটা বিরক্তি বোধ করত।
তবু, আজ এই জন্মদাগটি দেখে হঠাৎ করেই তার মনে হলো প্রিয়ার চেহারার মধ্যে কোনো পুরনো চেনাশোনা ছায়া রয়েছে, যা বহুদিন আগের স্মৃতি থেকে উঠে এসেছে। এমন নয় রুদ্রর মনে আগে এসব ধারণা আসে নি! এসেছে বহুবার! এই অদ্ভুত মিল তার মনে এক অস্পষ্ট আভাস দিয়েছে বারংবার! প্রিয়ার ছটফটানি, তার ব্যবহার, অতীতের এক প্রিয় ব্যক্তির স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলেছিল আগেই। এমনকি সামান্য আচরণে তার হাসি পেত, মনে মনে তুলনা করত, তবুও এই আচরণের মিলের উৎসে ছুঁতে পারত না।
এখনও রুদ্রের মনে সেই মানুষের স্মৃতি ঘিরে দুঃখমাখা অভিশাপের ধোঁয়াশা ঘনীভূত হয়। মানুষটি অনেক আগেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে, কিন্তু প্রিয়ার সাথে তার এই অজানা মিল রুদ্রকে সেই পুরোনো স্মৃতির সমুদ্রস্রোতে বারবার টেনে নিয়ে যায়, দুঃখ আর বিস্ময়ের জালে আটকে রাখে।
কিন্তু রুদ্র সুস্পষ্ট জানে যে চাচিও প্রিয়ার সঙ্গী; তবু অজানা সন্দেহে সে প্রিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল আজই হয়ে যাক সব মিটমাট! আর মনের অস্থিরতা!
——— "আমার প্রিয় খাবার কী?"
প্রিয়া একটু থতমত খেল, কিন্তু ঠোঁটের কোণে লুকানো এক রহস্যময় হাসি ফুটলো! ঊর্মিলা বেগম এই অকালে এমন এক প্রশ্নের নেপথ্য মর্ম উপলব্ধি করতে পারলেন না। অথচ রুদ্র জানে, কেন তার এই আগ্রহ! তার হৃদয়ের কূট কৌতূহল আজ চিরতরে নিরসন পেতে চায়। প্রিয়া এক নিঃশ্বাসে উত্তর দিল,
——— "বিরিয়ানি!"
——— "আমার প্রিয় গৃহপালিত পশু কী?"
——— "বিড়াল।"
——— "আমার প্রিয় রঙ কোনটি?"
——— "কালো।"
——— "আমার প্রিয় বিনোদন?"
——— "মাছ ধরা!"
——— "পঞ্চম শ্রেণিতে থাকাকালীন একবার বাজিতে হেরে আমি এক মেয়ের খাতায় থুতু দিয়েছিলাম; তার নাম কী?"
——— "শানু!"
রুদ্র অদ্ভুত হাসি হাসল; কিন্তু তার হৃদয় থরথর কেঁপে উঠল। রহস্যের আড়ালে লুকানো অপরাধী আজ অনায়াসে উন্মোচিত হলো। সে নিঃশব্দে বলে উঠল,
——— "আমি এখনই আসছি, ওয়াশরুম থেকে।"
এই বলে সে দাঁড়ালো, অলক্ষ্যে জেগে উঠল এক গভীর উদ্দেশ্য। পাশে বসে থাকা ঊর্মিলা বেগমকে উদ্দেশ করে বলল,
——— "চাচি, আপনি বাড়ি ফিরে যাও। প্রিয়ার দেখভাল আমিই করব। চাচা বাড়িতে একাকী অপেক্ষা করছে।"
এই বলে রুদ্র তাকে কেবিন থেকে একরকম টেনে বের করল, সমস্ত সুত্র তার হাতে অটুট বাঁধা রয়েছে।
অন্যদিকে, কৌশলী প্রিয়া এত কষ্টে এই দীর্ঘদিনে নিজের শল্যকার্যের অবয়ব নির্মাণ করেছে, আর আজ এক মুহূর্তে নিজেই তার সমূহ বিলয় ঘটালো! সে বেমালুম ভুলেছে সে একজন সিআইডির সাথে কথা বলেছে! কথার জালে কিভাবে ফাসাতে হয় একজন সিআইডি ঢের ভালো জানেন! রুদ্রের প্রশ্নমালার সূক্ষ্ম ছলনা যে তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে ফাঁদে ফেলেছে, তা বোঝার মতো প্রবুদ্ধতা তার থাকল না। রুদ্র ইতিমধ্যেই চাচিকে গাড়িতে তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার অন্তরের অগ্নিশিখা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে; চোখের রক্তিম আভায় রাগ ও বেদনার গভীরতা জ্বলজ্বল করছে।
কেমন করে পারল মানুষটা এমন কপট আচরণ করতে? মাথার ভেতর শোরগোল উঠছে, সমস্ত চিন্তা ঝড়ের মতো আঘাত করছে রুদ্রর অন্তরজুড়ে! তীব্র ঘৃণায় রুদ্রের অন্তর বিদ্রোহ করছে; তার রাগ, দুঃখ, হতাশা, সবকিছু কুন্ডলীকৃত জ্বালারূপে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কাঁদবে সে? নাকি প্রবল ক্রোধে তছনছ করবে? নাকি হৃদয়ের শূন্যতায় নিস্তব্ধ খুশি বোধ করবে? নিজেকে কী করবে, বুঝতে পারছে না; অস্থিরতায় যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চাচি যে প্রিয়ার প্রতি অন্ধবিশ্বাসে এতটা আসক্ত, এতটা স্নেহশীল, তার কারণটা এখন স্পষ্ট। কেন এমন হলো? নিজের অসহায়ত্ব ও বিরহের তাড়নায় নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে রুদ্রের। কোনো বর্ণনাহীন, উদগ্র চিৎকার যেন গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, যেনো সমস্ত পৃথিবীর কাছে সে তার বেদনা শোনাবে!
______
নিস্তব্ধ নিশীথের প্রতিটি মুহূর্ত প্রতীক্ষার বিষাদে পরিপূর্ণ। প্রিয়ার ক্ষীণ, ক্লান্ত দেহ থেকে স্যালাইনের নলটি খুলে ফেলা হয়েছে, আর সে নিস্তরঙ্গ বিষণ্ণতায় একাকী কেবিনে বসে আছে। এখনকার অবস্থা আগের তুলনায় কিছুটা সুস্থ, কিন্তু মনোরাজ্যে সেই অজানা অপূর্ণতার তীব্র যন্ত্রণা।
কিছুক্ষণ আগে নার্স তাকে ঔষধ খাইয়ে গিয়েছে, অথচ এখন চারঘণ্টার অপেক্ষায়ও রুদ্রের ছায়া মেলেনি। জানালার কাচের ওপারে অন্ধকারের নিঃশ্বাসে ভেসে থাকা রাতের আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে, গালে হাত রেখে প্রিয়া যেন এক রহস্যের অন্তর্দ্বারে প্রবেশ করছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে এক অদৃশ্য পায়ের শব্দে নীরবতা ভাঙে; রুদ্র, তার চোখে ক্লান্তির আবরণ, মুখমণ্ডলে বিষণ্ণতার চিহ্ন। চোখের কোণ ভিজে উঠেছে, কী কষ্টে নিজেকে রুদ্ধ রেখেছে সে, কেবল সেই জানে! নিঃশব্দে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, প্রিয়ার দৃষ্টি আবদ্ধ করতে সেই মনের দুর্বোধ্য কৌশলকে একবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে ধরা পড়ার জন্য। আর ধীর, গম্ভীর স্বরে, গাঢ় রাতের আঁধারকে স্পর্শ করে বলে ওঠে,
——— "প্রিয়া..."
অবশেষে প্রিয়া ফিরেও তাকালো না! স্নিগ্ধ এক চেতনায় সে বাইরে নির্বিকারভাবে চেয়ে আছে, ধ্যানস্থারূপে বিলীন। অম্লান এক হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে, রুদ্র দ্বিতীয়বার আহ্বান জানালো,
——— "প্রিয়া!"
কিন্তু সরলমতি মূর্খা সে, তাকে যে কেউ ডাকে, তা সুধা করতে পারল কই! একে তো গভীর ধ্যানে নিমগ্ন, তার ওপর উদাসীন ভাবনায় আবিষ্ট; এমন সময়ে কৃত্রিম নামে আহ্বান জানালে তা অনুধাবন করবে কীভাবে? মূঢ়তা চরমে পৌঁছালে এমনই হয়!
রুদ্র একটুখানি মুচকি হেসে ম্লান চোখে তাকাল, গম্ভীর স্বরে, গভীর কণ্ঠে শেষবারে উচ্চারণ করল তাঁর প্রকৃত নাম,
——— "প্রান্ত?"
অপেক্ষিত সুর শুনে তৎক্ষণাৎ সজাগ হলো প্রান্ত, এক মুহূর্তেই সম্বিৎ ফিরে পেল! অবশেষে সার্থক হলো প্রয়াস, অতি চতুরতারই আত্মবিনাশ!
0 Comments