Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৪৮

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
——— “একজন পুরুষ, কিসের আকাঙ্ক্ষায় নিজেকে নারী রূপে রূপান্তরিত করতে চায়? কীভাবে এই বিবর্তন সম্ভব, এবং এর প্রক্রিয়া কতটা দীর্ঘ?”
রুদ্রের লালচে চোখের গভীরে অদ্ভুত বিষণ্ণতা, কন্ঠস্বর বিদ্রোহে শ্বাসরুদ্ধ। এসময় ডক্টর উজ্জ্বল তার চশমার কিনারা ঠিক করতে করতে ধীরগম্ভীর কণ্ঠে প্রতিউত্তরে বললেন,
——— “সার্থক প্রশ্ন করেছ, রুদ্র। এমন ইচ্ছা, এমন কাজকে এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে আমাদের ধর্ম। এই আত্মবিকৃতির প্রতারণা যে স্রষ্টার সৃষ্টির বিরোধিতা, সে সত্য উপলব্ধির জন্য পবিত্রতায় গভীর চিন্তন প্রয়োজন। যারা এই পথে চলে, তারা সৃষ্টিকর্তার রূপকার্যের অপরাধে লিপ্ত হয়। আমাদের সমাজে আজ এই কুপ্রবৃত্তির বিস্তার বেদনাদায়ক, ভাবলে গাত্রদাহ হয়। পুরুষত্বের পূর্ণতাকে উপেক্ষা করে, এক বিকৃত আকাঙ্ক্ষায়, পবিত্র সৃষ্টির অপমানের স্পর্ধায় পুরুষেরা নারী হতে চায়, নারীরা পুরুষ হতে চায়! এরূপ কুপ্রবৃত্তি, কেবল হতাশাজনক নয়, বরং অপরিবর্তনীয় পাপ।”
রুদ্র নিস্তব্ধ, চোখে জিজ্ঞাসার গভীরতা। উজ্জ্বল সাহেবের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, সমস্ত অন্তরের জটিলতা নিয়ে তার উত্তর খুঁজছে। পাশেই মিথিলা টেবিল মুছছিল, কিন্তু কথাগুলোর মায়ায় আবদ্ধ হয়ে থমকে দাঁড়াল। উজ্জ্বল সাহেব একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
——— “এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘকালীন, এবং বিভিন্ন জটিল ধাপের সমন্বয়ে গঠিত। প্রাথমিক পর্যায়েই আসে মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন, যেখানে একজন বিশেষজ্ঞ রোগীর লিঙ্গ-অসামঞ্জস্যতার বেদনা, তার উপলব্ধি এবং আত্মার দ্বন্দ্বের গভীর পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের মানসিক প্রস্তুতি এবং অন্তর্নিহিত অনুভূতির মূল্যায়নই চিকিৎসার প্রকৃত পথ নির্ধারণ করে। এরপরে ধাপে ধাপে আসে শারীরিক প্রস্তুতি ও হরমোন চিকিৎসার সূচনা। অবশেষে, সেই দীর্ঘকালের প্রস্তুতির পরে আসে অস্ত্রোপচারের ধাপ, যেখানে শরীরকে অভ্যন্তরের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মিলিয়ে তোলার প্রয়াস চলে।”
——— "কি কি ধাপ স্যার.?? পুরোটা বিশ্লেষণ করে বলুন!"
রুদ্রর ভাঙা কণ্ঠ তার মনের ভেতরের বিপন্নতার ছায়া। তার গভীর আকুতি আর চাহনির স্থিরতা দেখে উজ্জ্বল সাহেবের ভেতরেও বিস্ময়ের মেঘ জমে উঠলো। সবসময় প্রাণবন্ত থাকা ছেলেটি কেন এমনভাবে ভেঙে পড়েছে? আর এই সকাল বেলায় এমন প্রশ্নই বা কেন? তখনই মুগ্ধ এসে ঢুকল, তদন্ত নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু রুদ্রর নিস্তেজ চেহারা আর স্থির, নীরব অবস্থান দেখে তার কপালে ভাঁজ পড়ল। পরিস্থিতির ভেতর কি যেন অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে, এমন অনুভূতি হলো মুগ্ধর।
উজ্জ্বল সাহেব একটুখানি গলা পরিষ্কার করে, ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন,
——— “পরবর্তী ধাপটি হলো হরমোন থেরাপি, রুদ্র। এই পর্যায়ে ইস্ট্রোজেন এবং এন্টি-অ্যান্ড্রোজেনের মাধ্যমে শরীরে নারীত্বের লক্ষণগুলোকে বিকাশিত করা হয়। এ সময়ে শরীরে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে, স্ত'নের বৃদ্ধি ঘটে, ত্বক হয়ে ওঠে মসৃণ ও কোমল, এবং শরীরের চর্বি সঞ্চালন এমনভাবে রূপান্তরিত হয় যেন তা নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্যের অনুরূপ হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ার সূচনা থেকে প্রথম পরিবর্তনগুলো দেখতে সাধারণত ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লেগে যায়, তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি; এর প্রভাব পুরোপুরি বিকশিত হতে বহু বছর লেগে যেতে পারে। এ এক ধৈর্যের পরিক্রমা, যেখানে নিজেকে এক নতুন পরিচয়ে রূপায়িত করার প্রত্যাশায় অগণিত সাগর পারি দিতে হয়।”
উজ্জ্বল সাহেবের কথা শুনে রুদ্রর ভিতরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো, বুকের মধ্যে গুমরে ওঠা ঘেন্না তাকে ভেতর থেকে পোড়াচ্ছে। মুগ্ধ ততক্ষণে বুঝতে পারল যে আসলেই ট্রান্সজেন্ডার বিষয় নিয়েই কথা চলছে। এদিকে মহুয়াও ছুটে এলো, কিন্তু সবার মুখে এমন গাম্ভীর্যের ছায়া দেখে তার মুখের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। রুদ্রর দিকে তাকাতেই তার মনে ভয় চেপে বসলো, এমন ক্লান্ত, ভেঙে পড়া চেহারা তো তার আগে কখনও দেখেনি!
উজ্জ্বল সাহেব এক চুমুক পানি নিয়ে আবার গভীর ও মেপে মেপে বললেন,
——— “তৃতীয় ধাপটি হলো লি'ঙ্গ পুনর্গঠন শল্যচিকিৎসা। এই পর্যায়ে শল্যচিকিৎসা দ্বারা শরীরের যৌ'নাঙ্গ পুনর্গঠন করা হয়, যেমন ভ্যাজিনোপ্লাস্টি; এছাড়াও স্ত'ন বৃদ্ধির শল্যচিকিৎসা এবং মুখমণ্ডলের নারীত্ব বাড়ানোর বিভিন্ন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রতিটি শল্যচিকিৎসার নিজস্ব সময়কাল এবং পুনরুদ্ধারের সময় ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, ভ্যাজিনোপ্লাস্টির সময়কাল কয়েক ঘণ্টা হলেও, পুরোপুরি সেরে ওঠার জন্য প্রায় ৬ মাস থেকে ১ বছরের প্রয়োজন হয়।
তার পাশাপাশি, কণ্ঠস্বর নারীত্বে পরিবর্তন করতে ভয়েস থেরাপি এবং অবাঞ্ছিত লোম অপসারণে লেজার হেয়ার রিমুভালের মতো অতিরিক্ত চিকিৎসাও প্রয়োজনীয়। প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য বিশেষজ্ঞের গভীর তত্ত্বাবধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে, যা মূলত রোগীর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার উপর নির্ভরশীল।”
মহুয়া বিস্ময়ে স্থবির, যেন বাস্তবতায় এমন এক অজানা আলোড়নের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই বিষয় নিয়ে এত গভীর আলোচনা? কেন সকলের মুখে এমন গুরুগম্ভীরতা? নাক কুঁচকে এক তীব্র অবজ্ঞার স্বরে বলে উঠল,
——— "স্যার, এ অভিশপ্ত অপচেষ্টা, এক নিঃশব্দ অপরাধ! এদের উচিত সকলের সম্মুখে উলটো ঝুলিয়ে কঠোরতম তিরস্কারে দণ্ডিত করা!"
উজ্জ্বল সাহেব একটি সংক্ষিপ্ত হাসির আবেশ নিয়ে বললেন,
——— “হ্যাঁ হ্যাঁ! এ এমন এক বিকৃত অবক্ষয়, যা শাস্তির জন্য অনিবার্য। এ সৃষ্টির আদর্শে আঘাত করা; প্রকৃতির নিয়মকে ব্যঙ্গ করা। এদের সৃষ্টির পরম্পরায় স্থান দেওয়া মানেই জঘন্যতম কৃত্যের অনুমোদন। এজন্য কঠোর শাস্তিই বিধিসম্মত হয়।”
রুদ্র নির্বাক, মনের অন্তর্গত ক্ষতবিক্ষত আবেগের ভারে পায়ের তালে বিভ্রান্ত পথিকের মতো এলোমেলোভাবে প্রস্থান করল। বিদীর্ণ হৃদয়ে তার গতিবিধি নির্লিপ্ত, তবুও মুগ্ধের তীক্ষ্ণ নজর এড়ালো না। সে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলো, হঠাৎ কেন এমন গভীর প্রশ্ন রুদ্রর মুখ থেকে উচ্চারিত হলো? একরাত আগেও তো ছেলেটির হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ছিল দৃষ্টি-কাঁপানো; অথচ আজ, তার চাহনিতে ক্লান্তি আর বিষণ্ণতার অদৃশ্য ছায়া। চোখ-মুখ ফোলা, বিবর্ণ রঙের আভাসে বেদনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে, যা মুগ্ধের অন্তরকে কেঁপে তুলল। তাকে কিছুতেই শান্তি দিচ্ছে না এই অদ্ভুত পরিবর্তন, তাই নিঃশব্দে রুদ্রর পথ অনুসরণ করে তার সত্যটি জানার জন্য এগিয়ে চলল।
অন্যদিকে মহুয়া, সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে, উজ্জ্বল সাহেবের সাথে অতি উৎসাহে কথার গাঁথুনি বসিয়ে নিন্দায় মত্ত; রুদ্রর অন্তরের গভীরে যা ঘটে চলছে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। সে কি জানে, তার প্রেমিকের অন্তরে প্রলয়কাণ্ড চলছে, এক জ্বলন্ত নরকের অগ্নিশিখায় পুড়ে যাচ্ছে, যা নিরবেই তার আত্মাকে ভস্মীভূত করছে?
__
রুদ্রর চোখে বেদনায় আকাশ ভেঙে জল জমেছে, সেই জলপ্রবাহ বাঁধ মানতে চায় না। তবু সে কঠিন চেষ্টা করছে নিজেকে সামলে নিতে, কিন্তু এমন সময় মুগ্ধর ভারী, অথচ গভীর সহানুভূতির স্পর্শ তার কাঁধে এসে পড়ল। মুগ্ধের কণ্ঠে নীরব দৃঢ়তা, যা অবলম্বন খুঁজে নিতে চায়,
——— “কি হয়েছে রুদ্র?”
রুদ্র দ্রুত চোখের কোণ মুছে নিলো, এবং মুখে এক কৃত্রিম হাসির আবরণ পরিয়ে মুগ্ধর দিকে ফিরল,
——— “কই? কিছু না তো!”
মুগ্ধ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার দিকে, রুদ্রর অভ্যন্তরের প্রতিটি ক্ষতচিহ্ন মুগ্ধের নীরব দৃষ্টি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। অবশেষে সে বলল, গলায় অটল এক বিশ্বাসের সুরে,
——— “ভুল মানুষের সামনে মিথ্যে বলছো, রুদ্র! বলো তো, কি হয়েছে? তোমার মনে কোনো ভার থাকলে তা প্রকাশ করো! হয়তো আমি তা মুছতে না পারি, কিন্তু সঙ্গ দিয়ে শিথিল তো করতে পারি। আমাদের উচিৎ একে অপরের পাশে থাকা, আমরাও তো এক সঙ্কলিত পরিবারের মতো, তাই না?”
মুগ্ধের সহানুভূতির কোমল স্পর্শ পেয়ে রুদ্র যেন অবরুদ্ধ জলরাশির মতো নিজের অন্তর্গত বেদনার স্রোত উগরে দিলো, চোখে বেদনার আলোড়ন নিয়ে প্রান্তের সব কুকর্ম উন্মোচন করলো। মুগ্ধ গভীর মনোযোগে শুনল, মুখমণ্ডলে কঠিন গাম্ভীর্য ধারণ করে। তারপর ধীর, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
——— “প্রান্ত কোথায় এই মুহূর্তে?”
রুদ্র ম্রিয়মাণ কণ্ঠে উত্তর দিলো,
——— “জানি না! সারারাত এ পথ সে পথ ঘুরেছি কেবল, পলায়নপর আত্মার মতো।”
মুগ্ধ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
——— “তবে কি প্রান্তের মতো একজনকে এখনো আইন-আচারের অধিকারভুক্ত করনি?”
রুদ্র তিক্ততায় ও কষ্টে বিদ্ধ হয়ে ফিসফিস করে বলল,
——— “তার মুখোমুখি যাইনি, স্যার! ঘেন্না, বেদনা, আর কষ্টের মাঝে পথ হারিয়ে বসেছি। কি করব, স্যার?”
মুগ্ধের কণ্ঠ তখন কঠোর ও সংকল্পময়; তার স্বর শিলার মতো কঠিন, অনড়,
——— “প্রথমত, প্রান্ত এক অমঙ্গলপ্রবণ পথ অনুসরণ করে শুধু সামাজিক অনুশাসনই ভঙ্গ করেনি, বরং এক লজ্জাকর ও নিন্দনীয় অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই কাজ আইনত গুরুতর অপরাধ! বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় তার এই নিন্দনীয় কার্যকলাপ শাস্তিযোগ্য অপরাধ; এই ধারায় গুরুতর শাস্তির বিধান আছে, যা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে ব্যর্থকেই উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করবে। (৩৭৭ ধারার শাস্তি: দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এবং অর্থদণ্ডের বিধান।) তাই, এখন আমাদের উচিৎ তার মুখোমুখি হওয়া, যেখানে তুমি মনের সমস্ত বেদনা, ঘৃণা প্রকাশ করতে পারবে, তাকে তার পাপের দায় বুঝাতে পারবে, এবং বিচারিক কর্তৃপক্ষের হাতে সমর্পণ করাই হবে তার প্রাপ্য দণ্ডের সূচনা। যেভাবে মহাবিশ্বের প্রতিটি কর্মের প্রতিদান আছে, তেমনি তারও অনিবার্য শাস্তি হবে। এসো, এখন ওকে ধরে জেলে পুড়ব চলো!"
মুগ্ধের চোখে কঠোর সংকল্পের দীপ্তি; রুদ্রর হাত শক্ত করে ধরে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
——— “চলো! এ ধরনের নিকৃষ্ট অপরাধীদের পথচারণে স্বাধীনতা দিতে পারি না আমরা! আমরা সিআইডি অফিসার, আমাদের নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব তাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা।”
তাদের দৃঢ়তার দৃশ্য দেখে মহুয়া এগিয়ে এসে কৌতূহলীভাবে ভ্রু কুঁচকে মুগ্ধকে জিজ্ঞাসা করল,
——— “কি হয়েছে স্যার?”
মহুয়া একবার রুদ্রর দিকে তাকাল, আর একবার মুগ্ধর দিকে। কঠিন কিছু ঘটছে, এবং তাকে এই কঠোরতার মর্ম বুঝতে হবে.!
_______________
মুগ্ধ স্বজ্ঞানে নিজেকে সহকর্মীর পাশে দাঁড় করিয়েছে, যেন তার সদাচরণ কিংবা দোষত্রুটি পর্যবেক্ষণের গুরুদায়িত্ব থেকে পিছু না সরতে হয়। অন্তত মানুষ হিসেবে তো এটুকু কর্তব্য সে পালন করবে। একই কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সুবাদে আশেপাশের মানুষের মানসিক অবস্থা, তাদের কল্যাণ, সবকিছুতে এক ধরনের মৃদু নজর রাখা আমাদেরও কর্তব্য। এর মাধ্যমেই সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় হবে, স্বার্থপরতার আধিক্য ম্রিয়মাণ হবে।
এই ক'দিনে মুগ্ধ রুদ্রকে খুব যত্নসহকারে মূল্যায়ন করেছে। প্রতিভার দীপ্তিতে দীপ্যমান, মেধার দ্যুতি ছড়ানো এক তরুণ সে, এটা মুগ্ধ স্পষ্ট বুঝেছে। এমনকি রুদ্রের পারিবারিক ইতিহাসও তার জানা, যেহেতু সে জানে যে পিতামাতাহীন, একাকী এই যুবক তার পিতৃবন্ধুর আশ্রয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। সাম্প্রতিক মর্মান্তিক প্রতারণায় ছেলেটির মনোবল যে তছনছ হয়ে গেছে, মুগ্ধ তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে।
বর্তমানে যে গভীর, অনবদ্য কেস তাদের কাঁধে ভার হয়ে উঠেছে, রুদ্রের মন সেই জটিলতা থেকে আপনা-আপনিই সরে আসবে। ঘনিষ্ঠজন এমন বিভীষিকাময় বিশ্বাসঘাতকতা করলে, কতটা বলিষ্ঠই হোক না কেন, মনুষ্য হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়। অতএব, প্রান্তের সাথে সরাসরি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা রুদ্রর জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর সেই প্রান্তের স্থান কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
অন্য কোনো পরিস্থিতি হলে মুগ্ধ হয়তো পুলিশকেই অবহিত করে নিজের পথে নির্বিকার থাকত; তবে এবার ঘটনা ভিন্ন। ইতিমধ্যেই মহুয়া সব জানতে পেরেছে, আর বিস্ময়ের সাথে তার হৃদয় রুদ্রর জন্য ফেটে যাচ্ছে। তাই তিনজনই এখন রুদ্রর গৃহে পা বাড়াচ্ছে, সেখানে যাবার আগে হাসপাতালেও খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে প্রান্ত সকালেই বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে।
____
গতরাত্রি রুদ্র কাটিয়েছে বিরহের নিদারুণ বৃত্তে বন্দী হয়ে, অন্তঃকরণে বেদনাবাহী অবর্ণনীয় ক্রন্দনে একাকার হয়ে। কি করবে সে? শৈশবের প্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন স্নেহ ও নিরাপত্তা বিলুপ্ত হয়েছিল, তখন পিতৃবন্ধুর আশ্রয়ে এক নব অধ্যায় সূচিত হয়েছিল তার জীবনে। সেই সংসারে চাচা-চাচিকে সে আপন রক্ত সম্পর্কের মর্যাদায় ভেবেছিল; প্রান্তকে বন্ধু, সখা, এমনকি ভাইয়ের স্থান দিয়ে আপন হৃদয়ে স্থাপন করেছিল।
কিন্তু প্রান্ত, যে ছিল তার আত্মার দোসর, কেমন করে এক বিভীষিকাময় ছলনার আড়ালে নিজেকে লুকালো? কেমন করে নিজের মরণের মোহনা রচনা করে, এক ভয়ানক ছদ্মবেশে, লি'ঙ্গান্তরে পরিণত হয়ে মায়াবিনী নারীর ছদ্মরূপে ফিরে এল? কীভাবে, সেই প্রান্ত, যার প্রতি তার নির্ভেজাল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল, কদর্যতার নিঃশেষ রূপে তাকে অবমাননা করতে উদ্যত হলো? ছিঃ!
রুদ্র আজ সমগ্র জগতের প্রান্তরে এক অদ্ভুত পাগল হিসেবে নিজেকে উপলব্ধি করছে। সেই অনন্ত প্রশ্নের বিষবৃক্ষ তার মনে বিষাক্ত শিকড় বিস্তার করেছে, যার উত্তরে সে কেবল অসীম অন্ধকারের আবর্তনই খুঁজে পাচ্ছে।
____
রুদ্রর গৃহের সম্মুখে গাড়ি এসে থেমে গেলে, মুগ্ধ গম্ভীর নির্ভীকতায় ড্রাইভিং সিট হতে অবতরণ করল; রুদ্র ক্লান্ত, বিদীর্ণ পদক্ষেপে নেমে দাঁড়ালো; মহুয়াও নীরবতার গভীরতা ধারণ করে পাশে এসে দাঁড়ালো। মুগ্ধ দৃঢ় চোয়ালে, কঠোর সংকল্প নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, প্রতিটি পদক্ষেপে শীতল অথচ অটল প্রতিজ্ঞার ঝাঁঝ ছড়িয়ে দিচ্ছে। রুদ্র চেনা গৃহের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো, তবে আজ সেই চেনা গৃহ অচেনা বিভ্রমে আচ্ছন্ন, অতল রহস্যে মণ্ডিত মনে হল তাকে।
তিনজনে ধীরে ধীরে সদর দরজার অভিমুখে পদার্পণ করল। মুগ্ধ কলিং বেলের বোতামে আঙুলের চাপ দিল, স্নায়ুতে শীতল এক শিহরণ খেলে গেল চারপাশে। মুহূর্তের নীরবতার পর, দরজা খুলে গেল; জয়নাল সাহেব, চিন্তার ভারে চাপা বিমর্ষ মুখাবয়বে উন্মুক্ত করলেন দ্বার।
রুদ্রকে দেখেই জয়নাল সাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল, যা পরমুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেল। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন,
——— "রুদ্র বাবা, কাল সারারাত কোথায় ছিলি? তোর এমন অবস্থা কেন? কি হয়েছে বল তো? আয়, আয় ভেতরে আয়! তোমরাও এসো বাবা!"
এ কথা বলেই তিনজনকে ঘরে প্রবেশ করতে দিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। মুগ্ধ ও মহুয়ার দিকে তাকিয়ে স্নেহমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন,
——— "তোমরা বসো। আমি রুদ্রর চাচিকে ডাকছি।"
——— "আমরা বসতে আসিনি, চাচা। আপনার ছেলেকে ডাকুন।"
রুদ্র চোখ মুদে ফেলল, এই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার জন্য তার মানসিক শক্তি মুহূর্তেই ভেঙে পড়েছে। জানে, জয়নাল সাহেব এখনো এই নির্মম সত্যের অন্ধকার ছায়ায় প্রবেশ করেননি; জানেন না যে তার আপন সন্তান অস্তিত্ব বদলে, ট্রান্সজেন্ডারের মাধ্যমে নারীর ছদ্মবেশে ফিরে এসেছে। যখন তিনি এ সত্য জানতে পারবেন, তখন এক পিতৃহৃদয়ে কেমন নিদারুণ আঘাত নেমে আসবে?
মুগ্ধর তীক্ষ্ণ প্রশ্নে জয়নাল সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। দ্বিধাভরা কণ্ঠে বললেন,
——— "আমার ছেলে? মানে রুদ্র! এই তো আমার ছেলেটি, আমার রুদ্র!"
মুগ্ধ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিল,
——— "আপনার প্রকৃত পুত্রকে ডেকে আনুন।"
জয়নাল সাহেব হতভম্ব হয়ে পুনরায় বললেন,
——— "প্রকৃত পুত্র? সে তো বহু বছর পূর্বেই মৃ'ত্যুর আড়ালে হারিয়ে গেছে!"
এই কথাটি বলতেই তার গলা কম্পিত হয়ে এল, বুকের গভীরে বেদনার বজ্রাঘাত পুনরায় বাজল। ছেলের মৃ'ত্যুর কথা উচ্চারণ করলেই তার অন্তর কেঁপে ওঠে। মহুয়া এগিয়ে এসে রুদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনার হাত রাখল, আর রুদ্র ম্লান হাসিতে নিজেকে সামলাতে চাইল। মুগ্ধ কঠোর চোয়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, বাবার সামনে এই করুণ সত্য উচ্চারণ করতে তারও মর্মে আঘাত লাগে; তবু দৃঢ়তার সাথেই উচ্চারণ করল,
——— "আপনার ট্রান্সজেন্ডার রূপান্তরিত সন্তান, প্রিয়াকে ডাকুন।"
অচঞ্চল নিস্তব্ধতা, ঘরের প্রতিটি কোণে অশরীরী স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ল। জয়নাল সাহেব মুহূর্তেই পাথরের মূর্তিতে রূপান্তরিত হলেন। মুগ্ধের মুখ থেকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যের বিষবাক্য শুনে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। রুদ্র তার চাচার দিকে ছুটে গিয়ে শক্ত করে ধরে ফেলল, এই গভীরতর শোকের ভার একা বুকে বহন করার ক্ষমতা তার নেই।
জয়নাল সাহেব অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কম্পিত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বললেন,
——— "আ-আমার সন্তান? ট্র-ট্রান্সজেন্ডার? প-প্রিয়া? ক-কি বলছে ও রুদ্র? তোর স্যার এই সব কি কথা বলছে?"
রুদ্র তার চাচার কাঁধে মাথা গুঁজে বুকের গভীর থেকে অশ্রুর স্রোত বইয়ে দিল, এই মর্মান্তিক মুহূর্তে তার নিজের শক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসছে। সে চাচার হাত ধরে টেনে তাকে সোফায় বসিয়ে দিল, যেন আঘাত তাকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলার আগে সামান্য স্থিতি এনে দেয়।
জয়নাল সাহেব জড়সড় হয়ে আছেন, নিথর পাথরের মতো, চোখের দৃষ্টিতে নেমে এসেছে অবিশ্বাসের ছায়া। তাঁর নিজের কানে যেন এই সত্যের প্রতিধ্বনি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না। তার সন্তান, যে নিজেকে মরণে বিলীন করেছে বলে ভাবতেন তিনি, আসলে প্রতারণার ছায়ায় নারীর রূপ ধরে ফিরে এসেছে?
প্রভাতের শীতলতায় হাসপাতাল থেকে ফিরে প্রান্ত ও ঊর্মিলা বেগম যে অন্তরালে নিজেকে গুটিয়ে রেখে দরজার আড়ালে অচেনা রহস্যে নিজেকে মেলে ধরেছেন, সেই রুদ্ধদ্বার সঙ্গম যেন কোনো অভিশপ্ত গুপ্ত কাহিনী বলে। জয়নাল সাহেবের মনেও সন্দেহের ছায়া কিঞ্চিৎ মেঘের মতো আচ্ছাদিত হয়েছিল, তবে তিনি চিন্তাকে প্রবাহিত হতে দেননি। কিন্তু রাতভর রুদ্রর অনুপস্থিতি, প্রভাতে ঊর্মিলা বেগম ও প্রিয়ার সেই অস্বাভাবিক অঙ্গবিন্যাস, সব কিছু যেন কোন গূঢ় সত্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
তবুও, প্রিয়াকে তো তিনি কন্যার মতোই স্নেহময় আশ্রয়ে রেখেছিলেন; ঊর্মিলা, তার স্ত্রী, এ রহস্য জানতেন? যদি জানতেন, তবে এত বড় বিষাক্ত সত্য গোপন রাখলেন কী করে? মাতৃত্বের আদ্রতায় সন্তানকে ভালোবেসে, প্রান্তের এই অপকর্মকে কীভাবে তিনি নির্বাক সয়ে গেলেন? প্রিয়ার আচরণে যে প্রান্তের স্মৃতির ধ্বনি শুনতেন, সেই ভালোবাসা কর্পুরের মতো উবে যাবে, এমন কল্পনাও করেননি তিনি।
কিন্তু কে জানত, সেই প্রিয়াই আসলে প্রান্ত, প্রবঞ্চনার ছলনায় রূপান্তরের আবরণে মিশে থাকা এক প্রতারণার মূর্তি!
______
মুগ্ধ আর কালবিলম্ব করল না। রুদ্রর নির্দেশনা মোতাবেক দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সেই বন্ধ কক্ষের অভিমুখে। দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কঠোর তর্জনীর আঘাতে মুগ্ধ বলে উঠল,
———" প্রান্ত! দরজা খোলো!"
মুগ্ধর গম্ভীর কণ্ঠস্বর আর দরজায় তার বলিষ্ঠ আঘাতে ভেতরে থাকা প্রান্ত ও ঊর্মিলা বেগম শঙ্কায় কম্পিত হয়ে উঠলেন। তারা তখনও ছদ্মবেশে, পরিত্রাণের ব্যাগ গুছিয়ে গোপনে পালানোর প্রণোদনা বুনছিলেন। ঊর্মিলা বেগম মমতার ছায়ায় ছেলেকে সাহায্য করছিলেন। মনে তীব্র আতঙ্ক, কিন্তু কায়মনোবাক্যে দৃঢ়। তড়িঘড়ি করে ছুটে আসা সিআইডি মানেই অনিবার্য শৃঙ্খল।
প্রান্ত, শঙ্কার তীব্রতায় কেঁপে উঠে মায়ের শরণাপন্ন হয়ে বলল,
———" মা, আমাকে রক্ষা করো!"
ঊর্মিলা বেগম ছেলেকে বক্ষাবৃত করে বললেন,
——— "আমি থাকলে তোকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।"
তবু বাইরের নিষ্ঠুর বাস্তবতা তো স্থির থাকে না। মুগ্ধ, নিয়তির মতো, পরম শক্তি দিয়ে দরজায় একের পর এক আঘাত হানতে লাগল। শেষমেশ তার সর্বশক্তির প্রচণ্ডতায় দরজার সিটকিনি অন্তিম ধ্বনিতে ধপ করে ভেঙে গেল, আর সঙ্গী হলো শূন্যতাভরা নীরবতা, যেখানে আচ্ছন্ন উন্মোচিত গোপন পাপের করুণ দৃশ্যপট।
মুগ্ধ কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করতেই সম্মুখে দেখতে পেল ঊর্মিলা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন, আর তার পিছনে সেই ট্রান্সজেন্ডার রূপান্তরের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকা কপট চরিত্র। মুগ্ধ বিস্ময়ে স্থির, কেননা এ তো সেই ছলনাময়ী রূপান্তরিত ব্যক্তি, যে একদা তাদেরই শপিংমলে আঁখির সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে সঙ্কটের মেঘ ঘনিয়েছিল। সেদিন তো তাকে কিছু করেনি মুগ্ধ, কারণ সে জানত না তার আড়ালের কপটতা। কিন্তু আজ এই ছলনার মুখোশ খুলে নিয়তি যেন তাকে শাস্তি দেওয়ার এক অনন্য সুযোগ দিয়েছে, এ এক অসামান্য প্রতিশোধের মঞ্চ!
মুগ্ধ তার মুখে বিষাক্ত মুচকি হাসি ফুটিয়ে, যেন শিকারী শিকারকে ঘিরে ফেলে মৃদু গলায় বলে উঠল,
——— "তাহলে তুইই সেই ছদ্মবেশী?"
মুগ্ধর আগমনে প্রান্তের র'ক্ত হিমে জমে গেল; চোখের পলকে চিনতে পারল এই মুখ, এ সেই লোক, নিয়তি যেন নিষ্ঠুরতায় তাকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে তার ছলনার পথ রুদ্ধ। মুগ্ধ নির্দয় কণ্ঠে ঊর্মিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বলল,
——— "চাচি, সরে দাঁড়ান! আপনার এই ছলনাময়ী সন্তানকে আর ঢাল দিবেন না। সরুন সামনে থেকে!'
ঊর্মিলা বেগম কেঁদে উঠে আকুতি জানালেন,
——— "না না, আমার সন্তানকে ছুঁয়ো না! ওকে ছেড়ে দাও!"
———" সরুন, বলছি!"
———" আমার সন্তানকে আঘাত করতে হলে, তোমায় প্রথমে আমার জীবনের শেষ বিন্দু স্পর্শ করতে হবে!"
মুগ্ধ বিদ্রূপের হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে বলল,
——— "আপনি কি ভাবছেন, চাচি? অপরাধীকে সাহায্য করার পাপেও শাস্তি আছে, আপনাকেও ভোগ করতে হবে আজীবন কারাগারের নিকৃষ্ট বন্দিত্ব।"
ঊর্মিলা বেগম চমকে উঠে, কাঁপতে থাকা হাত জড়ো করলেন বুকের সামনে। মুগ্ধ দৃঢ় হাতে পেছনে থাকা প্রান্ত নামক ছলনাময়ী প্রিয়ার কলার চেপে ধরে, বেদনাহীন শীতলতায় টেনে বের করে আনল তাকে। প্রান্ত আর্তনাদে ফেটে পড়ল, আর ঊর্মিলা বেগম দৌড়ে গিয়ে সন্তানকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু মুগ্ধর কঠিন নিয়তিতে আজ সব রুদ্ধ।
মুগ্ধের কঠিন হাতে টেনে হিচড়ে এনে প্রান্তকে ড্রয়িং রুমের মাঝখানে ছুড়ে ফেলার দৃশ্য এক মুহূর্তে স্তব্ধতার ঘনত্ব বাড়িয়ে দিলো। প্রান্ত মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়লো, তার ক্লান্ত-অপমানিত দেহটা সমস্ত অপমানের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেলো। ঊর্মিলা বেগম অসহায়ের মতো হাঁটু গেড়ে বসে ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন, বুকের গভীরে সেই সমবেদনার আশ্রয় দিতে চাইলেন।
মুগ্ধের চোখে তখনও কঠোরতার ছায়া। সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই দেখল জয়নাল সাহেব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছেন। মুগ্ধ থেমে গেল, কিছুই বলল না আর। এক পিতার অধিকার, তার সন্তানের প্রতি বলা না বলা কষ্টের গভীরতা আজ নিরব চিৎকার হয়ে তার চোখে ফুটে উঠছে। মুগ্ধ অনুভব করল, এই মুহূর্তে এই পিতার কাছে তাঁর সন্তানের সব অপরাধ ও সব ব্যথার তল খুঁজে পাওয়ার অধিকার আছে, যা একজন বাইরের কেউ কেবল দেখে যেতে পারে। মুগ্ধ নীরবে দাঁড়িয়ে সেই বিষাদমাখা প্রতীক্ষার সুযোগ দিলো, যেন অন্তরের সমস্ত গভীর থেকে ভেসে ওঠা কথাগুলি একে একে রূপ নিতে পারে নিস্তব্ধতার স্রোতে।
জয়নাল সাহেব অনেকক্ষণ প্রান্তের দিকে তাকিয়ে রইলেন, সেই মেয়েতে রূপান্তরিত সন্তান, যে একসময় তাঁর কাছে ছিল আদরের প্রান্ত, আর আজ সে হয়ে উঠেছে তাঁর হৃদয়ে অনন্ত বিষাদের প্রতীক। বুকে ঘেন্না আর প্রতারণার কষ্ট আগুনের মতো জ্বলছে। দৃষ্টির তীব্রতায় আর সহ্য করতে না পেরে চারপাশে তাকিয়ে কোনো কিছু খুঁজতে লাগলেন, আর ঘরের এক কোণে রডটি দেখেই সেটি তুলে নিলেন, আজ সব কিছু শেষ করে দিতে হবে! রাগে, জিদে, শোকে মাথা ফেটে যাচ্ছে।
দৌড়ে গিয়ে রড উঁচিয়ে প্রান্তের দিকে বাড়ি দিতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই মুগ্ধ সামনে এসে রডটি শক্ত হাতে ধরে ফেলল। মুগ্ধর কঠোর চোখে জয়নাল সাহেব তাকিয়ে রইলেন, দৃষ্টিতে অসহায়তার কান্না আকাশের দিকে প্রসারিত হয়ে গেল। মুগ্ধ এক মুহূর্ত থেমে তাঁকে শান্ত করল, বোঝাল অস্থিরতা থামিয়ে নিজেকে সংহত করেন।
এরপর মুগ্ধ ঘরের কোণায় চোখ বুলিয়ে কাঙ্খিত জিনিসটি খুঁজে নিলো, একটি শক্ত লাঠি। নীরবতায় লাঠিটি তুলে নিয়ে জয়নাল সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিল, যেন তিনি তাঁর ক্রোধকে কিছুটা মূর্ত রূপ দিতে পারেন। কৃতজ্ঞতায় ভরা এক গভীর দৃষ্টি দিয়ে জয়নাল সাহেব আবারও প্রান্তের দিকে তাকালেন, চোখে সেই অগ্নিমাখা শাস্তির প্রতিজ্ঞা।
জয়নাল সাহেবের গলা আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে উঠল, প্রতিটি শব্দে তাঁর ক্ষোভ ও তীব্র কষ্টের বহিঃপ্রকাশ। দৃষ্টিতে শীতল অগ্নি, হৃদয়ে প্রতারণার তীক্ষ্ণ ছু'রি নিয়ে তিনি বললেন,
——— "কেন করলি এমন?"
প্রান্ত নতজানু হয়ে কাঁপতে লাগল, চোখ দুটো লজ্জায় নত হয়ে রইল মাটির দিকে। কী বলবে সে? কীভাবে নিজের অপরাধের বোঝা লাঘব করবে?
——— "ঊর্মিলা সরো!"
মহুয়া টেনে ঊর্মিলা বেগমকে সরিয়ে দিলেন! ঊর্মিলা বেগম ছটফট করতে লাগলেন, কিন্তু মহুয়া তাঁর হাত চেপে ধরে শক্তভাবে। মুগ্ধ একপাশে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি নীরবে প্রত্যক্ষ করল, সে জানে, এ মুহূর্তে একটি বাবার হৃদয় নিঃস্ব হয়ে গেছে, আর প্রতারণার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।
জয়নাল সাহেবের রক্তচক্ষু দাবানলের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো, তার শক্ত লাঠির ঘায়ে প্রান্তের অস্তিত্ব প্রতিটি আঘাতে শুদ্ধির বেদনার্ত গানে রূপান্তরিত হতে লাগল। দেহ কম্পিত করে বিষণ্ণ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
——— "এই দিন দেখার নিমিত্তে কি তোকে আহ্লাদে মানুষ করেছি? তপ্ত শ্রমের ফোটা ফোটা ঘামে তোকে লালন করেছি? অপরিসীম স্নেহের প্রতিদানে তুই এই প্রতিদান দিলি? কত আবেগে বলতাম, "আমার ছেলে!" অথচ সেই ছেলেই আজ নারীত্বের অবয়বে দাঁড়িয়েছে! ধিক্কার তোকে! কেন মরণ আলিঙ্গন করলি না তুই? কেন বেঁচে থাকলি? তোর মৃ'ত্যু হলে কি আর অধিক পুণ্য হত না? অ'ভিশপ্ত সন্তানের মতো কসাইপোশ ছেলের অবয়ব কি আমার কপালে জুটতে হবে? হে আল্লাহ! কোন ত্রুটির কারণে এই শাস্তি প্রদান করলে? কেন আমাকে মরণ দিয়ে মুক্ত করলে না? আল্লাহ! আল্লাহ!
কণ্ঠ অবশ হয়ে ধপ করেই মাটিতে বসে পড়লেন জয়নাল সাহেব। এক জনকের হৃদয়ে যে পরিণতি লজ্জার চরম সীমান্তে পৌছায়, সেই অনন্ত গ্লানি তার দেহে শীতল বরফের মতো জমতে লাগল।
রুদ্র বাকরুদ্ধ হয়ে চুপ করে রইল, কিন্তু অশ্রু তার চোখের বাঁধ ভেঙে গড়াতে লাগল। চাচাকে আঁকড়ে ধরতেই জয়নাল সাহেব ক্লান্ত মলিন হাতে রুদ্রর গালে হাত রেখে বললেন,
——— "বাপ, আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি জানতে পারিনি যে আমার সেই অভিশপ্ত সন্তান এমন পথে অগ্রসর হবে! যদি জানতাম, তবে জন্মের ক্ষণেই তার গলা টিপে মুছে দিতাম এই কলঙ্ক!"
তারপর এক অনির্বচনীয় আক্রোশে উর্মিলা বেগমের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন এবং বললেন,
——— "তুমি মাতৃত্বের মহিমায় দাঁড়িয়ে কীভাবে এমন পাপের প্রশ্রয় দিলে? তোমার কি একবিন্দু লজ্জার অনুভব হল না? একটুও কি অপমানিত হলে না? ছেলে রূপান্তরিত হয়ে মেয়েত্বে প্রবেশ করল, তবু কি মাতৃত্বের বক্ষ কাঁপল না? বরং তুমি সেই বিকৃতিতে স্নেহের প্রলেপ লাগালে! মিথ্যাচার করে আমাকে অন্ধকারে রাখলে! রুদ্রের সাথে সেই পাপকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে উদ্যত হলে! ধিক! ধিক তোমার প্রতি! তোমাকে নিজের স্ত্রী বলতে আজ আমি নিজেই লজ্জিত বোধ করি!"
ঊর্মিলা বেগম আকাশ ফাটানো ক্রোধের তীব্র চিৎকারে উত্তাল হলেন,
———" আমি কি করব? আমি তো মা, সন্তান যেমনি হউক না কেন, মায়ের কাছে সে চিরকাল সন্তানই! দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে কত অমানুষিক কষ্ট সহ্য করেছি, কত ত্যাগের মহিমা রচনা করেছি, নিজের জীবন সমর্পিত করেছি সেই একটিমাত্র হাসির বিনিময়ে! সেই সন্তান হঠাৎ মৃ'ত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে গেলো আমি যেন উন্মাদ হয়ে উঠলাম। কিন্তু প্রিয়া যখন আমার দৃষ্টিগোচর হল, তখন মনের গভীরে এক রহস্যময় শঙ্কা জাগল! মাতৃপ্রাণের সংবেদনে সন্তানকে চিনতে কি দেরি হতে পারে? যখন জানলাম প্রিয়া আর কেউ নয়, আমারই প্রান্ত, তখন রাগের ক্ষুদ্র অভিব্যক্তিতে হৃদয় আড়াল করলেও, মাতৃচেতনায় তীব্র অমোঘ আকর্ষণে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলাম। ও বলল ও রুদ্র কে না পেলে আ'ত্মহ'ত্যা করে ফেলবে ! আমার আত্মা কেঁপে উঠল! আমার সন্তান, যেমনি হউক না কেন, আমি পুনরায় তাকে হারাতে চাই নাই। রুদ্রের প্রতি তার যে দুরাশক্তি ও আবেগ, তারই প্রণয়-দোষে সে এই নীতিভঙ্গ করেছে। এবং আমি,,আমি তো মা, এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছি, যেন এই একবার হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণায় আর পুনরায় বিধ্বস্ত হতে না হয়!"
এক নিশ্বাসে বলেই ঊর্মিলা বেগমের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে ভাঙাচোরা নদীর ন্যায় কান্নার প্রবল স্রোতে ভেসে গেলেন।
মুগ্ধ বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। হায়, এই ভালোবাসা! ভালোবাসার এত গভীর অন্ধকার কি লজ্জাজনক না? বিবমিষায় তার দেহে ঘৃণার শিহরণ জেগে উঠল। রুদ্রর সজল চোখ এক দৃষ্টিতে প্রান্তের পরিবর্তিত সত্তা প্রিয়া ওরফে তার পুরোনো বন্ধুর দিকে নিবদ্ধ । প্রিয়ার চেহারায় প্রান্তের ছায়া থাকবার কারণটি আজ স্পষ্ট। মনে পড়ল সেই আগের দিনের প্রান্তকে, যে দিনের অবুঝ সখ্যতাগুলি আজ নিতান্তই অতীত।
--
——— "রুদ্র?"
পনেরো বছরের কাঁচা বয়সের প্রান্ত নীরবতাকে হাতের আঙুলে কচলিয়ে প্রশ্ন করল। রুদ্র তখন খাতার পাতায় কচকচ শব্দে কিছু লেখছিল। কলমের গতি থামিয়ে সাদা গেঞ্জি ঝেরে হাসি মাখা মুখে উত্তর দিল,
——— "বল, কি কথা?"
——— "আমি… আমি একজনকে ভালোবাসি!"
——— "হায় রে! কাকে বল দেখি?"
——— "আসলে..."
——— "আরে বল না! ভাবীর নাম শুনি! এই বয়সেই প্রেমের ধোঁয়া তুলছিস? বাবাহ রে!"
———" কিন্তু... কিন্তু এ তো অপরাধ!"
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
——— "কিসের অপরাধ? ভালোবাসা অপরাধ নয়, বুঝলি? বরং যার হৃদয়ে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা সঞ্চারিত হয়, সে অমরত্ব লাভ করে। ভালোবাসার জন্য সব করা সম্ভব! যারা এই স্নেহগাথা বন্দী করতে চায়, তারাই প্রকৃত অপরাধী!"
সে দিনের সেই কাঁচা বয়সের কথাগুলি যে একদিন প্রান্তের অন্তরে এমন গভীরে দাগ কেটে বসবে, তা রুদ্র স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই!
রুদ্র ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার হৃদয়ে অগ্নি জ্বলে উঠেছে। অথচ কতকথা আছে যা মুখে আনতে বাধিত হচ্ছে। তবে প্রান্তের সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে গভীর এক তিরস্কারের স্বরে বলল,
——— "কেন এমন করলি, প্রান্ত? তোকে আমি বন্ধু ভেবেছিলাম! আর তুই... ছি! ঘৃণায় আমার র'ক্ত টগবগ করছে!"
প্রান্ত ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কাতরস্বরে উত্তর দিল,
———" আমি কি করব, রুদ্র? আমি যে ছেলের শরীরে জন্ম নিয়ে, অন্তরে নারীর মতোই অনুভূতি বহন করছিলাম! আমি কি করব? তোর প্রতি আমার আকর্ষণ শিশুকালেই জেগেছিল। আমার বাবা আর তোর বাবা তো ছিল পরম বন্ধু। যখন প্রথমবার তোর বাড়িতে আসলাম, তখন আমার বয়স মাত্র দশ, আর সেদিনই, হ্যাঁ, সেদিনই তোকে দেখে হৃদয় প্রেমে মুগ্ধ হয়েছিল রুদ্র! কেন এমন হল, জানি না; কিন্তু তোকে দেখলেই হৃদয়ের কোণে এক অচেনা শিহরণ জেগে উঠত, তোকে কাছে পাবার অদম্য বাসনা জাগত।"
প্রান্তের চোখে উদ্দাম উন্মত্ততা ফুটে উঠল। তীব্র আবেগে দম বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগল,
——— কিন্তু... কিন্তু তখন তো সেই মেয়েটাও ছিল, তোর পাখি! তুই সর্বদাই তার কথা বলতি, তার স্মৃতিতে তোর হৃদয় ভরপুর ছিল! আমার ভিতরে ঈর্ষার তীব্র আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত। ওদের সাথে তোর পরিবারের এত সখ্যতা আমার সহ্য হতো না শুধু মাত্র ওই মেয়েটার জন্য! তোদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ির দূরত্ব কম ছিল তুই সবসময় ওখানে থাকতি! ও তো সবসময় তোকে চোখে দেখত! তুই ওকে আদর করতি! আমার ইচ্ছে হতো ওকে মে'রে ফেলতে! আ-আমি তো দূরে থাকতাম.! যখনি ফোন দিতাম ওই মেয়েটার কন্ঠ শুনে আমার রাগ কিড়মিড় করত! "
আর যখন শুনলাম যে পাখি আর নাই, জানিস, আমি খুশিতে কেঁপে উঠলাম! ক-কিন্তু তোর মা-বাবার মৃ'ত্যুতে যেই শোক পাই নি, তার চেয়েও অধিক খুশি হলাম যখন জানলাম, তুই আমাদের সাথেই থাকবি।"
প্রান্ত শ্বাস নিয়ে বলল,
——— "তুই বড় হতে লাগলি, তোর প্রতি আমার আকর্ষণও গভীর হতে লাগল। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যখন পুরোদমে তোর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লাম, মনে এক অজানা ভয় দানা বাঁধল, তুই যদি অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবেসে বসিস? যদি তুই বিয়ে করে ফেলিস? সেই ভয়ের বশে আমি বাবার সকল সম্পদ হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী গাড়িতে আগুন লাগালাম, সেই সাথে আমার মতোই এক পোড়া মৃ'তদেহ ফেলে পালিয়ে গেলাম। ডাক্তারের নিকট প্রচুর অর্থ ব্যয় করে নিশ্চিত করলাম যেন পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে সেই মৃ'তদেহকে আমার বলে ঘোষণা করে।
এই সমস্ত কিছু করেছি, রুদ্র! শুধু তোকে পাওয়ার জন্য, তোর ভালোবাসার জন্য!"
প্রান্তের কণ্ঠে বেদনার প্রতিধ্বনি; প্রতিটি বাক্যে লুকানো অন্তর্দহন, অজানা যন্ত্রণার করুণ গাথা। সে বলতে লাগল,
——— "আমি যে কতকাল এই রূপান্তরের জন্য প্রতীক্ষা করেছি, রুদ্র! নিজেকে তিলে তিলে পরিবর্তন করেছি, ধৈর্যের বাঁধনে প্রতিটি ব্যথা সহ্য করে শেষ পর্যন্ত এক পূর্ণাঙ্গ নারীতে পরিণত হয়েছি। যখন নারীত্বের সমস্ত পূর্ণতা ধারণ করলাম, তখনই প্রিয়া নামে তোর কাছে ফিরে আসলাম। নকল পরিচয়ে এক নতুন অস্তিত্ব গড়ে তুললাম, শুধু তোকে পাওয়ার জন্য, তোর হৃদয়ের কাছে স্থান পাওয়ার জন্য।
রুদ্র! আমি তোকে ভালোবাসি, হৃদয়ের গভীরতম স্থান হতে ভালোবেসে সমস্ত কিছু করেছি, সবকিছু ত্যাগ করেছি, শুধু তোকে ভালোবাবার আকাঙ্ক্ষায়।"
মহুয়ার অন্তরাত্মা তীব্র ঘৃণায় বিদ্ধ হয়ে উঠল প্রান্তর এই কথাগুলো শুনে । তার বমি আসল, সমগ্র অস্তিত্বকে বিষিয়ে তুলছে এই নিকৃষ্ট ভাবনা। জয়নাল সাহেবের অবস্থা ওহে, আর সহ্য হয় না; ঘেন্নায় তার দেহ কেঁপে উঠছে। ঊর্মিলা বেগম মুখ চেপে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না, নিরুপায় এক মায়ের শোকে নীরব হাহাকার তার বুকে চেপে বসল।
মুগ্ধ, সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে অসহিষ্ণু হয়ে সোফায় বসে পড়ল, হাত কাঁপছে রাগে। প্রতিটি শিরায় আগুন জ্বলছে, যা অপেক্ষায় আছে প্রতিশোধ নেওয়ার। শুধু কথাগুলোর শেষ হবে, তার পর সে বুঝাবে তার সহ্যের সীমা কোথায়।
অন্যদিকে রুদ্র বিস্ময় ও ক্রোধে বদ্ধ; তীব্র অপমানে তপ্ত হয়ে উঠল তার র'ক্ত। বিষধর সেই বাক্যগুলো শুনে ক্রো'ধে আর অধীরতা তে এক কষে থা'প্পর বসিয়ে দিল প্রান্তর গালে। ব্যান্ডেজে মোড়ানো ক্ষতস্থানে এই আঘাতে র'ক্ত গলগল করে গড়িয়ে নামল, যা সমগ্র অপমানের প্রতিশোধরূপে প্রান্তের মুখে নিঃশব্দে কথা বলছে।
রুদ্র ক্রোধে লাল চোখে প্রান্তের দিকে তাকিয়ে বলল,
———" বন্ধুত্বের এই অবমাননা! এই কি বন্ধুর প্রতি তোর ভালোবাসা? ছি! আমি তোকে বেস্ট ফ্রেন্ড বলে জানতাম, আর তুই? তোর জন্য ঘৃণায় শরীর রি রি করছে! তোকে ভালোবেসেছিলাম বন্ধুরূপে, কিন্তু তুই যে এমন অপমানিত করতে পারিস, ভাবি নাই! থুতু তোর ভালোবাসার উপরে!
আর যদি এমন অস্বাভাবিক অনুভূতি তোর, তুই আমায় বলতি না হয়! চাচাকে জানাতিস! আমরা তোকে চিকিৎসা করাবার জন্য সব রকম চেষ্টা করতাম! কিন্তু তুই এই জঘন্য পথ বেছে নিলি? এমন নিকৃষ্ট আচরণ! ছি, এমন কলুষিত চিত্তে তুই কি ভাবে এই অন্ধকারে ডুবে গেলি?
রুদ্রের মুখমণ্ডল রাগে লাল হয়ে উঠল। কাঁপতে কাঁপতে, বিষণ্ণ ঘৃণায় সে প্রান্তের দিকে তাকিয়ে বলল,
——— "ভালোবাসাকে তুই নোংরা করেছিস! পবিত্র সম্পর্কের উপরে কলঙ্ক লেপেছিস! আমার পাখিকেও ছাড়িস নি? তাকে নিয়েও তোর এমন পঙ্কিল চিন্তা ছিল? সে তো আমার বোন! মায়ের পেটের না হলেও আমার কাছে তার আদর, ভালোবাসা কোনো অংশে কম ছিল না! আমার ছোট্ট পাখিকে কত যত্নে বড় করেছি, প্রাণ ভরে ভালোবেসেছি! আর তুই? আমি ভাবতাম, তুইও তাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসিস! অথচ তুই তো সেই নিষ্পাপ সম্পর্ককেও কলুষিত ভাবনায় আবদ্ধ করেছিস!
আমার পাখি ছিল কতটুকু বয়সের? এমন নিষ্পাপ শিশুকেও তোর কদর্য চিন্তার গ্রাসে আনলি? ভাই-বোনের সম্পর্ককেও তুই তোর বিকৃত মানসে অপবিত্র করেছিস! ছি! তোকে দেখলে আমার মন বিষিয়ে ওঠে! তোর এই পাপের শাস্তি হবে, জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে!"
মুগ্ধ আর ক্রোধের বাঁধ মানতে পারলো না! সোফা থেকে উঠে বজ্রের ন্যায় পদক্ষেপে রুদ্রের পাশে গিয়ে প্রান্তর গলাধরের মধ্যে আঙুলগুলো শক্ত করে বসিয়ে বলল,
——— "ওঠ! চল জেলের শিকল তোর গলায় তুলে দেই! ভালোবাসার বিষে সিক্ত করে তোকে ভালোবাসার আস্বাদ দিই এবার!"
ঊর্মিলা বেগম তার আদরের পুত্রকে এই নৃশংসতা থেকে বিরত রাখার জন্য চিৎকার করে আহ্বান জানাচ্ছেন! মহুয়া আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেছে যেন এই ক্রোধের মর্মভেদী ঝাঁঝ থেকে সে মুক্তি পায়। জয়নাল সাহেব, নীরব নিবিষ্টতায় জড়সড় হয়ে বসে আছেন! এই অশান্তি আর মনোবেদনা প্রতিরোধে তাদের মনে তীব্র বেদনার ঝলকানি উঠেছে! রুদ্রও উঠে দাঁড়ালো; তার চোয়ালে কঠোর সংকল্পের স্পন্দন ফুটে উঠেছে! মুগ্ধ প্রান্তর নাকে এক ঘু'ষি দিলে সঙ্গে সঙ্গে র'ক্তের ধারা বইতে শুরু করল! মুগ্ধের কণ্ঠে শীতল বিষাক্ততা প্রবাহিত হলো,
——— "তোর এই মেয়েলিপনা ভাঙিয়ে বের করে আনছি! চল!"
এই বলে আরও এক সপাটে চ'ড় কষিয়ে দিলো! প্রান্ত আঘাতে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে উল্টে পড়লো।
প্রিয়া, অর্থাৎ ট্রান্সজেন্ডারে পরিণত প্রান্ত উঠে দাঁড়ানোর পর, উদ্দাম আবেগে ফেটে পড়ল সে। কণ্ঠে অশান্তির সুর, প্রান্ত চিৎকার করে বলল,
——— "আ-আমি রুদ্রকে না পেলে জীবন বিসর্জন দিবো!"
রুদ্রের মনের গভীর ঘৃণায় তার দুই মুঠি শক্ত হলো, নিজেকে সামলে রাখার জন্যেই সে এই আঘাতের প্রতিহতিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুগ্ধর চোয়ালে কঠোরতার ছাপ ফুটে উঠলো, তার রাগ ক্রমশ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। তেড়ে গেলো প্রান্তর দিকে! প্রান্ত মুগ্ধের ক্রুদ্ধ পদক্ষেপ দেখে ভয়ে সরে গিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো। মুগ্ধর রক্ত উথলে উঠলো, মনে হলো এখনই প্রান্তর অস্তিত্বকে মুছে ফেলবে, নিজের শক্তিতে তুলে আছাড় মেরে তার অবমাননার প্রতিশোধ নিবে!
তৎক্ষণাৎ মুগ্ধও পিছনে পিছনে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু প্রবেশ করতেই তার ক্রোধে যেন আগুন জ্বলে উঠলো! কারণ প্রান্ত নিজের গলায় ধারালো ছু'রি চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে এক ঠান্ডা হাসি, চোখে বিদ্রূপের ছায়া, প্রান্ত মুগ্ধকে সতর্ক করে বলল,
——— "আরেক পা এগুলেই আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দিবো!"
ততক্ষণে রুদ্রও সেখানে এসে উপস্থিত হলো! প্রান্তকে এভাবে আত্মধ্বংসের প্রতিশ্রুতিতে দেখেই তার অন্তরে আগুন ধরে গেল। কঠোর কণ্ঠে বলল,
——— "পাগলামি থামা! ছু'রিটা ফেলে দে! আর শেষমেশ আত্মসমর্পণ কর। তোর স্থান এখন জেলের অন্ধকারে!"
প্রান্ত তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে উঠে বলল,
——— "এই চুপ কর! তোর জন্যেই তো আমি এই দশায় পরিণত হয়েছি! তুই আমার নারী রূপ দেখেও চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিস! অবজ্ঞা করেছিস, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে চলেছিস! তোর এতো অবহেলা আর সহ্য হয় না! আমি আর বাঁচবো না, জানিস তো!"
মুগ্ধ ততক্ষণে ক্রোধে দাঁত আঁটকে বলল,
——— "তোর ম'রার এতটাই ইচ্ছা? তুই ফাঁসিতেই ঝুলবি, শাস্তি তোর হবেই!"
এই বলে মুগ্ধ আবারও প্রান্তের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল। আতঙ্কে প্রান্ত কেঁপে উঠে বলে উঠল,
——— "না, না, আমি জেলের চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে ধুঁকে ম'রতে পারব না! এগুবি না! যদি আরেক পা এগাস, আমি নিজেকে শেষ করে দেবো!"
তবে মুগ্ধ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়, তার পা আর থামে না। সে প্রান্তকে ধরতে এগিয়ে যায়! কিন্তু মুগ্ধ পৌঁছানোর আগেই প্রান্ত নিজের জঘন্য আরেকটি কাজ সম্পন্ন করে ফেলল। ছু'রিটা হাতে তুলে, এক চরম মুহূর্তে নিজের গলায় একটি তীক্ষ্ণ পোচ দিয়ে আঘাত করল, রক্তের স্রোত গড়িয়ে পরল...


Post a Comment

0 Comments

Close Menu