Ad Code

আত্মহত্যার নেপথ্যে পর্ব ১


লেখিকাঃ সাদিয়া আকতার

ভোর থেকেই বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, আকাশও কেমন যেন সূর্য কে আড়াল করে রেখেছে। কোলাহল বিহীন পাখিদের কিচিরমিচির সুর তরঙ্গ ভালোই লাগছে আলভির। খোলা জানালার পাশে বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে সক্কাল সক্কাল বই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, সাইকোলজির বইয়ে তার যে কি এত দরকার কে জানে? রবিনেরও ঘুম ভেঙেছে মনে হলো পাশের ঘর থেকে পানির কলের শব্দ আসছে।

"ওহ! তুমি ওঠেছো?" তোয়ালে হাতে বেরিয়ে এলো রবিন ঘর থেকে।

:হুম,,,,উঠেছি,,,,আমিতো আর ভোদর নই,,,," বলে পিছন ফিরে আলভি দেখে নিলো রবিন কে।

:এই,,এই,,শোন,,ভোদর বলবে না,,আমি একজন ডক্টর,,,একটু তো রেসপেক্ট দাও,,,

: আহা মজা করছিলাম তো,,,তা চা নাস্তা কিছু হবে নাকি আমি যাবো,,,"

: নো! নেভার! তোমার রান্নার যে হাত,,,আমিই নিয়ে আসছি,,,," বলে রান্নাঘরে দিকে যেয়েও কি ভেবে পিছন ফিরে জানতে চাইলো " তা বলি কি সাত সকালে কি এত পড়ছেন মহাশয়??,,,"

রবিনের কথা শোনে মৃদু হেসে হাতে রাখা বইটা আলভি তুলে ধরে। বইয়ের নাম দেখে চোখ বড় করে রবিন বললো " হিউম্যান সাইকোলজি?!!"

মাথা দুলিয়ে সে উত্তর দিলো " হ্যাঁ বন্ধু!!,,, তোমার মত আমিও একটু জ্ঞান বাড়াতে চাচ্ছিলাম সাইকোলজি নিয়ে এই আর কি!!!,,,"

বন্ধুর এই কান্ডে কি আর বলার আছে রবিনের। সুন্দর একটু হাসি উপহার দিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে সকালের স্বল্প কিছু নাস্তা তৈরিতে।

ওহহো! আপনারা মনে হয় খুব বিরক্ত হয়েছেন। চলুন রবিন নাস্তা বানিয়ে আনুক এই ফাকে একটু ইনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। মিস্টার আলভি মাহমুদ, একজন এক্স ক্রিমিনাল ল'য়ার বেশ কিছু বছর আগে সেচ্ছায় ডিটেকটিভ পেশায় যুক্ত হয়েছেন এবং বর্তমানেও সুনামের সাথেই বহাল তবিয়তে আছেন। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি এখনো ব্যাচেলর। কলেজ লাইফের বন্ধু সাখাওয়াত রবিন। মাঝে পড়াশোনার জন্য দু'বন্ধুর যোগাযোগ কমে গেলেও কর্ম জীবনে ফিরে সেটা পুসিয়ে গেছে। রবিন পেশায় একজন সাইকাইট্রিস্ট, বিয়েও করেছেন বছর সাতেক হলো পাঁচ বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে আছে। পরিবার নিয়ে আসেননি হুলিয়া শহরে তাই ভিজিটিং ডেই তে আলভির সাথেই তার ফ্লাটে কাটিয়ে যান। মাঝে সাঝে তিনিও কেসের তদন্তে আলভির সাথে যোগ দেন। ওইতো রবিন ট্রে হাতে ফিরে আসছে।

YouTube

চা'য়ের ঘ্রাণে মোহিত কন্ঠে আলভি বলে " তুমি বেশ ভালো আদা চা বানাও বন্ধু,,,খুব মিস করছিলাম ক'দিন এই চা'য়ের স্বাদ!,,,"

: হাহাহা,,,তাই নাকি,,বেশ তো নাও,,আমিও তো আছি দিন কয়েকের মতো,,,তোমার ভোজনশালায় নাহয় কিছু দিন আমার শিল্প দেখিয়ে যাই,,,,"

গভীর আমেজে চা'য়ের কাপে এক চুমুক নিয়ে আলভি জবাব দিলো " হ্যাঁ,,, তাই ভালো ,,,,,সত্যিই দারুন চা!,,,"

: ধন্যবাদ,,,, বলছি তোমার কেসের কি খবর?

: কোন টা?

: ওই যে কলেজ পড়ুয়া ছেলে,,শিপন রায়,,,না কি যেন একটা নাম,,,,

: আত্মহত্যা করেছে,,,,

আলভির এমন হেয়ালি উত্তর রবিনের মন:পুত হলোনা। সে আবার জানতে চাইলো

: তুমি কি নিশ্চিত?

: দেখ!!,, পুলিশের বক্তব্য ছিলো এটা,,,,আর আমাকে তো হোস্টেল ম্যানেজার ডেকেছিলেন সেল্ফ ডিফেন্সের জন্য,, পরে কিছু করতে পারিনি কারণ কেস ক্লোজ করে দিয়েছিলো,,,,,,যদিও,,,

: যদিও??

: জানো তো,,, আমার না কেমন যেন একটা খটকা আছে ওই কেস টা নিয়ে,,,,মানে সবকিছুই এটা প্রুভ করছিলো এটা আত্মহত্যা,,, একদম ক্লিন ছিলো সব ব্যাপার কিন্তু আমি চোখে দেখলেও কিছু না কিছু হয়ত মিস করে ফেলেছি এই কেসে,,,,

আজকেও আমি এটা নিয়েই ভাবছিলাম,,, তাই ওই বইটা দেখলাম,,,,

: হাহাহাহা,,,প্রথমেই আমি এটাই ভেবেছি,,, তুমি হয়ত কোন কেস নিয়ে টেন্স আছো,,,,আচ্ছা যাইহোক এখন কি আর করার!

: অপরাধ কেন হয়?

রবিন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় আলভির এই প্রশ্নে। ওর এই এক সমস্যা হুটহাট কখন কি যে বলে বসে। তাও আমতা আমতা করে রবিন বললো

: ক্যারেক্টারিস্টিক ফল্ট,,, অর,,, সাইকোলজিক্যাল ইস্যু,,,,

: উম্মম,,,হয়ত,,কিন্তু আমার মনে হয় না,,,

: তবে?

: জাজমেন্ট,,,

: মানে?

: যখন ক্রিমিনালের বিচার হয়না কিংবা জাস্টিস পাওয়া যায় না তখনই মূলত ক্রাইম টেনডেন্সি বৃদ্ধি পায়,,,,,,

রবিন কিছু বলতেই যাবে এসময় পরপর তিন বার দরজার ঘন্টা বেজে উঠলো। একটু অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে দেখে, এত সকালে কে হতে পারে। তড়িঘড়ি আলভি দরজা খুলতে গেল এর মধ্যেই আরো দু'বার বেজে উঠলো ঘন্টা টা। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন থানার তরুণ ইন্সপেক্টর। পানি ভর্তি জগ দেখে নিজেই গ্লাসে ঢেলে গোগ্রাসে সাবার করে দিলেন। কিছুটা দম নিয়ে হাক দিলেন "তোমরাও ভিতরে আসো,,,,,"

Facebook

তার কর্মে এতক্ষণে দু'জন দরজার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো আরো তিন জন কনস্টেবল সঙ্গে এসেছে, তারাও ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করে। আলভি তাদের কেও বসতে বলে।

ইন্সপেক্টর বাবু ধাতস্থ হয়ে বললেন "গোয়েন্দা বাবু! খুব ঝামেলায় পড়েছি,,,,"

: সে তো বুঝতেই পারছি,,,আপনি একটু জিরিয়ে নিন,, তারপরে না হয় বলুন কি হয়েছে,,,,,রবিন! ইনি থানার নতুন ইন্সপেক্টর,,,বাবুলাল,,,,,ও আমার বন্ধু ডা. সাখাওয়াত,,,"

: সালাম ডা. সাহেব,,,,আলভি বাবু কথা বলে কাজ নাই,,, আপনি এখনি আমার সাথে স্পটে চলুন,,,তৈরি হয়ে নিন,,,

রবিনের সাথে চোখের

ইশারায় কথা বলে নিয়ে আলভি বললো

: তা বেশ তো চলুন না আমরা তৈরি,,,

: উনিও কি?!,,,

: হ্যাঁ উনিও যাবেন,,,আমার সহযোগী বলতে পারেন,,

: বেশ,,,,

সকাল তখন প্রায় ৮:৩০

পুলিশ ভ্যান সবাই কে নিয়ে ছুটলো, কিছুদূর যেতেই মেঘের গর্জন করে নামলো ঝুম বৃষ্টি সাথে হীম শীতল হাওয়া। ড্রাইভার পীচ ঢালা রাস্তায় সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পুলিশ ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছে।

বৃষ্টি দেখে জিভ কেটে ইন্সপেক্টর বাবু বললেন "এইরে!,,,প্রমাণ সব তো নষ্ট হয়ে যাবে বাবু,,,,"

কিঞ্চিৎ ভ্রু কোচকে আলভি বললো " অকারেন্স টা কি বাইরে কোথাও হয়েছে?...."

: হ্যাঁ বাবু,,বাড়ির পিছনের ফুল বাগিচায়,,,গায়ে এসিড ঢেলে দিয়েছে মেয়ে টা,,,,বাচ্চা মেয়ে কলেজে পড়ে,,,,সবাই বলছে খুব লক্ষিমন্ত মেয়ে ছিলো,,, ধার্মিক ছিলো,,,

বিড়বিড় করে আপন মনে আলভি বলে উঠলো " আবার একটা কলেজ ছাত্রীর আত্মহত্যা !!",,,, " আচ্ছা কোন কলেজের ছাত্রী মেয়েটা? জানতে চায় আলভি।

: হুলিয়া আদর্শ কলেজ,,,

: নাম?

: ফারজানা,,,,বডির খুব বাজে অবস্থা বাবু!!,,, আমার তো গা গুলিয়ে উঠেছে,,,

: খবর কখন পেয়েছেন?

: ভোর চারটায় থানায় কল আসছে,,

বাকি সময় টা নিরবেই কেটে যায়।

হটাৎ জোরে একটু ধাক্কা অনুভব করে সকলে, পালিশ ভ্যান ব্রেক কষার জন্য খানিকটা পিছলে সামনের দিকে গড়িয়ে গেছে।

ভ্যান থেকে নেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো আলভি, মেঘ কেটে গেছে মানে এখন তদন্তে বিঘ্ন ঘটার সম্ভব না আর নেই।

Threads

এই বাড়িতে একটি মেয়ের অপমৃত্যু হয়েছে শুনে পাড়ার প্রায় সব লোকের সমাগম শুরু হয়েছে। ভীড় ঠেলে সামনে যেতেই আলভি লক্ষ্য করলো বাড়ির ঠিক ডা'দিকে বাগানের দিকটা পুলিশ পাহারায় আছে কাউকে সেখানে যেতে দেয়া হচ্ছেনা। পিছনে ফিরে রবিন কে ডেকে দু'জনে চললো সেদিক টায়। পুলিশ কে কার্ড দেখিয়ে পরিচয় দেয়াতে ওদের ভিতরে প্রবেশ করতে দিলো।

বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে পড়ে থাকা বডি দেখে বিস্ফারিত চোখে দু'জন তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মেয়েটির আত্মা পৃথিবীর সব মায়া ছেড়ে চলে গেছে অনেক দূরে রেখে গেছে বহু প্রশ্ন নিয়ে তার নিথর দেহ টা।

প্রায় অর্ধেকের বেশি এসিডে গলে যাওয়া শরীর, কি বিভৎস ভাবে বাম গালের চামড়া খসে দাত দেখা যাচ্ছে, ডান চোখ গলে বেরিয়ে এসেছে কোঠর থেকে, মাথার খুলি গলে ঘিলু দেখা যাচ্ছে, পেটের বাম পাশ থেকে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসেছে,,,শরীরের বিভিন্ন জায়গার চামড়া হাড় পুড়ে গলে গেছে। রবিন তো প্রায় বমিই করে দিবে ভাব তাই সে দূরে গিয়ে দাড়ালো।

আলভি সতর্ক পায়ে এগিয়ে গেল লাশের দিকে। বৃষ্টির পানিতে কাদা মাটিতে এখন আর কোন ছাপ পাওয়া যাবে না বোঝাই যাচ্ছে। আতশ কাচ বের করে লাশের গলা, হাত খুটিয়ে দেখতে লাগলো।

"কিছু কি পেলেন?,,," উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্নটা করেছেন ইন্সপেক্টর বাবু।

কিন্তু জাবাব না দিয়ে আরো কিছুক্ষণ ওভাবেই হাটু গেড়ে লাশ টাকে দেখে নিয়ে আলভি বললো " বডিতে কোন আঘাতের চিহ্ন পেলাম না,,,,তা ফরেনসিক টীম কখন আসবে?,,,,

: এই তো চলে আসবে পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যে,,,

: হুম্মম,,

পাশে পড়ে থাকা এসিডের কন্টেইনার তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলো আলভি, রবিনও তখন পাশে এসে দাঁড়ায় লেবেল দেখে আঁতকে উঠে বলে

" হাইড্রো ফ্লোরিক!!!"

"হুম্মম,,,তাইতো,,,,"

ইন্সপেক্টর বাবু কে কন্টেইনার দিয়ে আলভি বললো "এটাও ফরেনসিকে পাঠাবেন,,, ফিংগার প্রিন্ট বা অন্য কিছু পাওয়া যায় কিনা,,,"

: আচ্ছা,,,,একটা বিষয় বুঝতে পারছি না আলভি বাবু?,,

: হুম্ম?,,

: মানুষের শরীর গলিয়ে দিলো এই এসিড অথচ কন্টেইনারের কিছু হলো না কেন?,,,

: এই এসিড যদি পলি ইথালিনের কন্টেইনারে এয়ার টাইট করে রাখা হয় তাহলে কিছু হবেনা,,, পাশ থেকে উত্তর দিলো রবিন

: ইন্সপেক্টর বাবুলাল!,,,, আপনি বরং এটাও একটু খোজ নিবেন ঠিক কোন কেমিক্যাল শপ থেকে এটা নেয়া হয়েছে,,,," বলে আলভি চলে গেলে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিক টায়।

প্রায় ত্রিশ মিনিটের মতো গাছের পাতা ডাল গোড়া এদিক ওদিক খুজে ভালো ভাবে দেখে ফিরে এলো। ওর মুখে কেমন যেন একটা হাসি লক্ষ্য করলো রবিন কিন্তু মনে চাইলেও এখন কিছু বলতে পারলো না।

ইতমধ্যে ময়নাতদন্তের দল এসে মেয়েটির অর্ধ গলিত শরীর গাড়িতে তুলে নিয়েছে।

ফিরে এসে আলভি ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. ফায়সালের সাথে করমর্দন করে কুশলাদি বিনিময় করে। মি. ফায়সাল বেশ উৎসাহী হয়ে জানতে চাইলেন " কিছু জানা গেল মিস্টার আলভি?,,,,"

চিন্তিত কন্ঠে বললো "কেবল তো এলাম,,,এখনো বাড়ির লোকদের সাথে দেখা হয়নি,,,"

পাশ থেকে ইন্সপেক্টর বাবু বললেন " আমি বলে রেখেছি,,, আপনি যেতে পারেন ওনাদের সাথে কথা বলা যাবে এখন,,,"

: ধন্যবাদ,,, আপনিও চলুন,,

ময়নাতদন্তের দল চলে যাওয়ার সময় তারা শুনতে পেল কেউ দোতলার বারান্দা থেকে আর্তচিৎকার করছিল

"না,,,নিয়ে যেয় না,,, আমার মেয়েকে,,,,আমার কলিজা মারা যাইনিই,,,,,আ,,আয়ায়া,,,"

এমনিতেই পরিবেশ ভারি ছিলো কিন্তু এক মায়ের এই কান্নায় যেন সবাই নির্বাক হয়ে যায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর যে নিজের মাকে স্বরণ করে আখি কোণে জলের বিন্দু জমেছে তা টের পেতে বিলম্ব হলো না।

গলা খাকার দিয়ে আলভি বললো "চলুন,,,,"

দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ইন্সপেক্টর বাবু বললেন " আমার তো মাথা ঘুরে যাচ্ছে আলভি বাবু!,,, কিভাবে যে কেসের একটা কিনারা করবো!,,,,"

: চিন্তা করবেন না! আমরা আছি তো!,,, সবার সাথে কথা বলে দেখি,,,

: কোন লাভ হবে কিনা! ওনারা তেমন কোন ইনফরমেশন দিতে পারেন নি,,,

: হুম্মম!,,,

: আমার তো সুইসাইড মনে হলো!,,,

: আসলেই?!,,

: দারোয়ান তো বললো কেউ আসেনি ভিতরে,,,

: ইন্সপেক্টর সাহেব!,,, আত্মহত্যার অনেক উপায় আছে,,, এসিড দিয়েই কেন? তাও আবার এভাবে বাইরে এসে??,,,

: তাইতো!!,,

ইন্সপেক্টর বাবুলাল একজন কনস্টেবল কে ডেকে কিছু বলাতে সে বাড়ির ভিতরের দিকে ছুটে গেল।

Instagram

তিন জন মন্থর গতিতে যেয়ে পৌছালো বেশ বড়সড় একটা কক্ষে। সম্মুখ আর ডান দিকে বড় দুটি জানালায় দামী রেশমি পর্দা ঝুলছে, পাশে কর্নারে ফুলদানিতে এখনো কিছু তাজা ফুল রয়েছে, দেয়ালের ফাকা জায়গায় দুটি তৈলচিত্র আর বড় করে ক্যালিগ্রাফি করা, প্রায় দশজনের বসার মত গদি আটা সোফা, মনের মাধুরি দিয়ে সাজিয়ে রাখা ঘরটা। যদিও কাল রাতের ঘটনায় অল্প বিস্তর এলোমেলো হয়ে আছে।

সবাই বসলেও আলভি গেল দেয়ালের বা'দিকের প্রায় অর্ধেক জুড়ে বড় একটা বুক শেল্ফ'র দিকে, প্রতিটি তাক সারনি নাম্বার করে সাজানো বই গুলো, শেল্ফের এক কোনে কিছু মেডেল নজর কাড়ে আলভির।

ফিরে এসে কনস্টেবল বললো "আপনারা এখানেই বসুন স্যার, ভিক্টিমের বাবা আসছেন,,,,"

"হুম,,,,, যাও" বললেন ইন্সপেক্টর বাবু।

"এগুলো সব আমার মেয়ের,,,," বললেন ফারহাদ সাহেব।

চকিত নজরে ফারজানার বাবা কে পাশে দেখে সালাম দিলো আলভি বললো,,

: আসলে আমরা সত্যিই নিরুপায়! এসময়ে,,,আসুন,,,বসুন,,,

: আমিও দুখিত! আপনাদের অপেক্ষা করালাম,,,,আসলে আমার স্ত্রী,,,,

: না,,,না,,,কি বলেন! এক মা এখন সন্তানহারা!,,,,, বলে রবিন।

: হ্যাঁ হ!,,,, কি থেকে যে কি হয়ে গেল!,,,

: আপনি যদি আমদের একটু সবটা খুলে বলতেন,,,, মানে ঘটনার আগে ফারজানা কিছু বলেছিলো কিনা,,,,ঠিক কি হয়েছিল,,,, জানতে চাইলো আলভি।

: কিছুই জানিনা! আমিতো বাইরে ছিলাম,,,কাল রাতে ফিরে মেয়ের সাথে কথা হলো,,, ও কেমন যেন উদাস ছিলো,, কেমন যেন ভাসা-ভাসা কথা বলছিলো,,, ভাবলাম পরে ঠিক হয়ে যাবে,,,আর ফারজানা তো মায়ের সাথেই সব কথা বলতো,, তাই আমি অন্য গল্প করে ওকে ঘুমাতে বলে আমার রুমে চলে যাই,,,,,,

: তারপরে??,,,

ফারহাদ সাহেব কিছু বলতে পারলেন না হু হু করে বেশ কিছুক্ষণ কাদলেন এরপরে স্বাভাবিক হয়ে বললেন

: খুব,,,খুব বাজে ছিলো,,,জানালায় কিছু পড়ার শব্দে ধরফরিয়ে ঘুম ভেঙে যায়,,, অনবরত কেউ ঢিল ছুড়ছে আর চিৎকার,,,কন্ঠটা,,,কন্ঠটা ফারজানার মতো,,,,আমরা দৌড়ে ওর রুমে গেলাম দেখি ও নেই,,,নেই ও,,,ওর রুম থেকে উকি দিয়ে দেখি হ্যাঁ ও আমার মেয়ে,,,ও এত রাতে কেন পাগলামি করছে তাড়াতাড়ি বের হওয়ার জন্য এই,,,, এই দরজার দিকে এসে দেখি বাইরে থেকে বন্ধ,,,,,,,,

TikTok

আবার কিছুক্ষণ দম নিয়ে ফারহাদ সাহেব বললেন

উপায় না পেয়ে ভুলু চাচা কে কল দিই দেখি উনিও জেগেছেন কিন্তু আটকে রাখা,,,,, এরপরে আমরা এই জানালার কাছে ছুটে আসি,,,এই,,,এই খানে,,,তখন ও বারবার বলছিলো নিজেকে শেষ করে পাপ মুক্ত করবে সব,,,,হাতজোড় করে কত কি বলে অনুনয় করছিলাম আমরা,,,আমার মেয়ে আমাদের চোখের সামনে কি যেন গায়ে ঢেলে দেয় আবছা আলো তে দেখি মেয়ে টা আমার কেমন যেন,, কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে শরীর টা,, কি যে সেই গলা ফাটানো চিৎকার!!!,,,,চোখের সামনে ছটফট করতে করতে পড় যায়,,,,,নিথর হয়ে যায়,,,,এসব দেখে আমার স্ত্রী চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়,,,,ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে যাই,,,,কোনমতে ভুলু চাচা কে কল করে বলি পুলিশ ডাকতে আর পাশের করিম ভাই কে কল দিতে,,,,পরে এলাকা বাসি বাউন্ডারির দরজা টপকে ভুলু চাচা কে বের করেন আর উনি আমাদের কে,,,,,,,

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলভি তাকায় রবিন ও ইন্সপেক্টর বাবু'র দিকে তারাও থমথমে মুখে বসে আছে।

আলভি বললো " কাল রাতে মেয়ে আপনাকে ঠিক কি বলেছিলো?,,,,"

: বলছিলো,,, বাবা আমার আত্মা কি যথেষ্ট হবে পাপ মোচনের জন্য,,,,মেয়েটা আমার বড় শান্ত ছিলো ওর মায়ের মত ধর্ম মেনে চলতো কিন্তু এই কথার মানে তখন আমি বুঝতে পারিনি,,,,,

মাথা ঝাকিয়ে আলভি বললো " পাপ মোচন!!,,,”

" আসবো আমি?" বললো এক নারী কন্ঠ।

সবাই মাথা ঘুরিয়ে দেখে তাদের পিছনে বড় ঘোমটা করে এক নারী অবয়ব যার খোলা চোখ দুটোর নির্লিপ্ত দৃষ্টি। কারো বুঝতে বাকি রইলো না ইনিই মিসেস সাফা ফারহাদ।

"এখানে বসো সাফা!,,," ডাকলেন ফারহাদ সাহেব বললেন "তু,,তুমি এখানে!! শরীর ঠিক আছে?!,,,"

"হুম,,," সংক্ষিপ্ত উত্তর

: আ,,,আপনি কি আমাদের কিছু জানাতে পারেন?,,,,জানতে চায় আলভি।

: জ্বি,,,,মেয়েটা আমার সব সময় কাছেই থাকতো,,, সব কথা খুলে বলতো কিন্তু গত পনেরো দিন থেকে ও কেমন যেন অন্যমনস্ক থাকতো,,,জানতে চেয়েছি,,বলেনি,,,

: কোন ছেলে কি ওকে ডিস্টার্ব করছে কিনা?,,,

: আমার মনেহয় না,,,কারণ ও গার্লস কলেজের ছাত্রী আর,, আমিই ওকে নিয়ে,, যাওয়া আসা করতাম,,

: হুম,,,ওর ফোন টা একবার দেখা যাবে?,,,

: নিন,,,

ইন্টারনেটে কিছু সাইট চেক করেও তেমন কিছু পাওয়া গেলো না, আলভি বললো " আমরা এটা নিয়ে যাচ্ছি আইটি এক্সপার্ট কে দেখিয়ে দিয়ে যাবো,,,"

: ঠিক আছে,,,,

: আচ্ছা আজ তাহলে উঠি,,,আপনাদেরও অনেক কষ্ট দিলাম,,,

: আর কষ্ট!! আমি বিশ্বাস করি আমার মেয়ে আত্মহত্যা,, করতে পারেনা,,,আপনাদের কাছে অনুরোধ যেভাবেই হোক ওর খু**নি কে খুজে বের করবেন,,,,

: আপনার কেন মনে হচ্ছে এটা খুন?!

: মায়ের মন!! মায়ের মন কখনো ভুল বলেনা,,,কিছুতো হয়েছিলো,,,তাছাড়া,,, তাছাড়া দুদিন আগেও যে মেয়ে এই বাড়ি কে সাজিয়ে রাখতো নিজে প্রাণবন্ত থাকতো তার,,,তার কি এমন হলো যে,,,,,,,কোন,, কোন পাপ মোচনের কথা বলছিলো,,,,আর,,আর ওই এসিড,,, ও কোথায় পেল এসব আমিত ওকে কিনতে দেখিনি,,,কেন,,,,,

মিসেস ফারহাদ আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

পরিস্থিতি বুঝে ফারহাদ সাহেবের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ির মেইন গেট পার হবে আলভি ঠিক তখন পিছনে থেকে আওয়াজ এলো

: দাড়ান!!,,,দাড়ান একটু,,,

: জ্বি বলুন?,,,

: আ,, আমার মেয়ে,,পাচুলিয়া শহরের কথা বারবার জিজ্ঞেস করতো,,,,

বিস্ময়ে আলভি বললো "পাচুলিয়া শহর!!,,,,আপনি কি ঠিক বলছেন??"

: হ্যাঁ আমরা আগে ওখানে ছিলাম কিছু বছর,,,ওনার বিজনেসের জন্য,, মেয়ে তখন অনেক ছোট,,,পরে এই শহরে এসে থেকে যাই,,,

: ফারজানা কখনো গেছে ওই শহরে?

: হ্যাঁ,,, দু'মাস আগে আমরা ঘুরতে গেছিলাম,,,

: ওখানে কিছু হয়েছিল কি?,,,

: নাহ! ওখান থেকে ফেরার পরেও স্বাভাবিক ছিলো,,, কিন্তু যখন ওর মন খারাপ হয়ে গেল তখন থেকে ও বারবার ওই শহরের কথা বলতো,,,,

: আপনি কি বিশেষ কিছু বলতে পারবেন মি.ফারহাদ পাচুলিয়া শহর নিয়ে??,,,

: আ,,আ,,,,না,,তেমন কি বলবো তাছাড়া আমরা তো ওখানকার বাসিন্দা নই,,,,,,

: আচ্ছা বেশ তবে,,,আল্লাহ হাফেজ

Whatsapp

-------------------------

বেলা ১২টা

সূর্য একেবারে মাথার ওপরে, এর মধ্যে সকালে কারো কিচ্ছু খাওয়া হয়নি, চোখ-মুখ প্রায় শুকিয়ে গেছে সবার।

থানার পাশে একটা হোটেলে ইন্সপেক্টর বাবু কে নিয়ে নেমে পড়লো আলভি আর রবিন। হোটেলের ছেলেটা কে তিন প্লেট মোরগ পোলাওয়ের অর্ডার দেওয়া হলো। আলভি কেমন যেন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে টেবিলের ওপর। কিছু একটা ভেবে বাবুলাল কে বললো "এর আগে পাচুলিয়া শহরে একটা কেস দেখেছিলাম,,, তখন আপনি ছিলেন না,,, ঠিক এই রকম ভাবে সাজানো ছিলো,,, আত্মহত্যা করেছে মনে হচ্ছিলো,,,,হোস্টেলের রুমে দরজা জানালা সব বন্ধ ছিলো ভিতর থেকে,,,"

: আত্মহত্যা করলে তো স্পট এরকমই হবে,,,,

: উমহু! সাজানো ছিলো সবটাই,,,এত,,এত নিখুঁত!!,,,যে কিছুই আন্দাজ করতে পারিনি,,,,

: আপনি তাহলে ইনভেস্টিগেশন করতেন,,,

: করেছি,,,কিন্তু কোন ক্লু মিলাতে পারিনি,,,যথেষ্ট প্রমানের জন্য আত্মহত্যা বলেই কেস ফাইল করা হয়,,,

: আপনার ক্যানো সন্দেহ ছিলো?,,

: ছেলেটা একটা চিরকুটে লেখেছিলো আমার আত্মা পাপ মোচনের জন্য উৎসর্গ করলাম,,,,কেউ দায়ী নয়,,,,

: এই!!,,,এরকমই কথা তো ফারজানাও বলেছিলো ওর বাবা কে!,,,, বললো রবিন

: ঠিক ধরেছ রবিন!! আমি এই কথাটারই অর্থ খুজছি,,,,

: তারমানে,,,, আলভি বাবু,,,ওরা কি দলবদ্ধ কোন অন্যায় কিছু করেছিলো?,,,

: সেটাই তো মিলছে না,,,কারণ সে তো ছেলে মানে শিপন রায় নাম,,, আর এ মেয়ে,,,,,মানলাম ছেলে মেয়ে'র টীম হয় কিন্তু,,, শিপন রায় মারা যাবার পরে তো ফারজানা ওই শহরে যায়,,,,ওর বাবা মা'র মতে এটাই ওর প্রথম যাওয়া,,,,তাহলে,,,,,উফফ!! কিচ্ছু বুঝতে পারছি না!!,,,

: আচ্ছা আগে ঠান্ডা মাথায় খাবার টা খেয়ে নাও,,,বাড়ি যেয়ে ভেবে নিও,,,,খালি পেটে বুদ্ধি বাড়ে না,,,খাও,,,খাও,,,,বললো রবিন

: ইন্সপেক্টর বাবু!,,, আপনি আমাকে আপডেট জানাবেন কিন্তু,,,,

: ঠিক আছে,,,,শিপন রায়ের ঘটনা ঠিক কবেকার?,,

: সাত মাস আগের,,,

খাবারের বিল মিটিয়ে ইন্সপেক্টর বাবুলাল চললেন থানার দিকে। বাড়ি ফিরে আলভি সোজা চলে গেল তার রুমে, জানা কথা সে কিছুক্ষণ এসব নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাববে তাই রবিনও রুমে চলে গেল ফ্রেশ হয়ে একটু ভাতঘুম দিবে।

-------------------------

ঘরটা অন্ধকার।

আরাম কেদারায় আধাশোয়া হয়ে হাতের এভিডেন্স প্যাকেট টার দিকে মন দিয়ে কিছু দেখছে আলভি। কৃষ্ণচূড়া গাছের বেশ পিছনে গোলাপ গাছে এই শার্টের টুকরো টা পায় সে। বোঝাই যাচ্ছে কেউ তো ছিলো সেখানে কিন্তু কে?

চলমান......

( গল্প টি আপনার কেমন লাগছে কিংবা এর প্লটের কোন ভুল ত্রুটি থাকলে কমেন্ট বক্সে জানানোর অনুরোধ রইলো)

আত্মহত্যার নেপথ্যে পর্ব ২

 

Post a Comment

0 Comments

Close Menu