Ad Code

সেই তুমি (সিজন - ৩) পর্ব - ১

লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা

 হাত বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পরে আছি বেশকিছুক্ষণ হয়েছে। বেল্ট দিয়ে আঘাত করায় পিঠের অনেক জায়গা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। শরীর ব্যথায় কুকাচ্ছি তবুও একটুও দয়া হচ্ছে না তুর্য এর। বড় আম্মুর দেওয়া কালো শাড়ির আঁচলটা ছিড়ে ফেলেছেন উনি। ছেড়া অংশটুকু দরজার সামনে পরে রয়েছে। বুক ফেঁটে কান্না আসছে আমার। এতোটা অসহায় নিজেকে কখনও মনে হয় নি।

হঠাত দরজা খোলার শব্দ পেলাম। কিন্তু পিছন ফিরে তাকানোর মতো শক্তি শরীরে অবশিষ্ট নেই। তুর্য ঘরের ভিতর ঢুকে আমার কাছে এসে হাটু ভেঙে বসলেন। গালে চড় পরায় আমার ঠোঁট ফেঁটে রক্ত পরছে। উনি তার বা হাত দিয়ে আমার ঠোঁটের কোনে স্পর্শ করে চুইয়ে পরা রক্তটুকু মুছে ফেললেন। তার স্পর্শে যেনো আমার কষ্ট আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। কারণ চড়টা তারই দেওয়া উপহার ছিল। তুর্য আমার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে, আমাকে পাজাকোলে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাড় করিয়ে দিলেন। দাড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু পাচ্ছি না। পানির প্রতিটি ফোঁটা পিঠে পরে আগুনে পোড়ার মতো জ্বলছে।
যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তুর্যকে বললাম,
-- ভাইয়া আপনার পায়ে পরি, ছেড়ে দিন আমাকে। আর কখনও শাড়ি পরবো না। আমার ভুল হয়ে গেছে।
তুর্য আমার চুলের মুঠি ধরে আমার মুখটা তার মুখ বরাবর নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-- কেনো পরবি না শাড়ি? ওহ তার মানে এর পরের বার থেকে উলঙ্গ হয়ে সিডিউস করতে যাবি ছেলেদের?
-- ছিঃ! এসব কি বলছেন ভাইয়া? বলছি তো ভুল হয়ে গেছে।
-- আমি তোর কবে কার ভাইয়া? বারবার ভাইয়া কেনো বলিস আমাকে? স্যার বলবি। তোর মতো রাস্তার মেয়ের ভাই আমি হতে চাই না।
করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তুর্য এর দিকে। আট বছর পাড় হয়ে গেছে তবুও মাথা থেকে রাস্তার মেয়ের দাগ টা এখনও মুছতে পারি নি।
তুর্য আমার মুখপানে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিঠে এতোগুলো বেল্টের বারি পরেছে যে এখন স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছি। ঠিক কোন কারণে আমাকে এতো নির্মম ভাবে মারা হলো সেই কারণ টাই আমি জানি না।
কিছুক্ষণ আগে,
তাফসির ইংগেজমেন্ট পার্টিতে পরার জন্য বড় মা এর দেওয়া কালো শাড়িটা পরেছিলাম। শাড়িটা পরে খুব সুন্দর করে সেজেছিলাম কারণ শাড়িটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। যদিও সেই শাড়ি দ্বিতীয় বার পড়ার যোগ্য নেই। দুই টুকরো করে ছিড়ে দিয়েছেন। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে রাতের মধ্যের সময়ে কি হয়েছে তার কিছুই আমার মনে নেই। আর কেনোই বা এভাবে মারলেন উনি আমাকে! হয়তো উনাদের বাড়িতে আশ্রিতা তাই! আশ্রিতাদের মারার জন্য কারণের প্রয়োজন হয় না।
আমি হীর। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবো। একটু আগে যে আমাকে এভাবে মারলেন উনি তুর্য আহমেদ চৌধুরী। আফজাল চৌধুরী আর তমা বেগমের দুইমাত্র সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে। দুই মাস আগেই লন্ডন থেকে ফিরেছেন। আমি ছোট থেকেই তুর্যদের বাড়িতে থাকি। বড় বাবা (আফজাল সাহেব) আমাকে একপ্রকার রাস্তা থেকেই কুড়িয়ে এনেছিলেন। আমি নাকি বড় বাবার গাড়ির নিচে পরতে পরতে বেঁচেছিলাম। অবশ্য এটা কবেকার কথা আমার কিছুই মনে নেই। তখন থেকেই আমি এ বাড়িতে থাকি। এ বাড়ির মেয়ে হয়ে নয়, বরং আশ্রিতা হয়ে। সব গল্প তো সুখের হয় না! আমার গল্পও হয় নি, হয়ে উঠতে পারি নি এ বাড়ির মেয়ে।
এই বিষয়ে অবশ্য আমার তেমন আফসোস নেই। বড় বাবা আমার পড়ালেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এর থেকে বেশি আর কি চাই আমার।
গায়ের শাড়িটা খুলে ওয়াশরুমে রেখে বাতরোবটা গায়ে জরিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম। শরীর ব্যথায় ছিড়ে পরছে। রাত অনেক হয়েছে, এতোক্ষণে হয়তো বড় মা আর বড় বাবা ফিরে এসেছেন। নিচে যাবো যাবো করেও শক্তিতে কুলাতে না পেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। দুচোখের কোনা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে যাচ্ছে।
যখন থেকে ভালোবাসা শব্দটাও জানি না হয়তো তখন থেকেই তুর্যকে ভালোবাসি। কেনো ভালোবাসি জানি না, তার মতো বদমেজাজি আর রাগি একটা মানুষকে কেউ ভালোবাসতে পারে এটাও হাস্যকর। কিন্তু তবুও আমার প্রতিটা রাত কেটে যায় তার স্বপ্নে বিভোর থেকে। আট বছর আগে যখন উনাকে বড় বাবা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন, অনেক কান্না পেতো। খুব মনে পরতো উনার কথা কিন্তু আজও মুখ খুলে বলতে পারি নি ভালোবাসার কথা। আমার সেই তুমি টা হয়তো কখনও আমার হবে না।
সাত পাঁচ চিন্তা করতে করতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় হীর।
তুর্য হীর কে মেরেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। অবশ্য কারো হাতে এতো সময়ই নেই তার খবর রাখার। ব্যস্ত শহরে সবাই নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত! সারা রাতে তুর্য আর বাড়ি ফিরে নি।
খুব ভোরে দরজার কলিং বেল এর শব্দে হীরের ঘুম ভেঙে যায়। ধরফরিয়ে উঠে বসতেই ঘড়ির দিকে নজর পরে। বেলা সাতটা বাজে। আর আধা ঘন্টা পরেই তমা বেগম উঠে যাবেন। তমা বেগম উঠার আগে নাস্তা রেডি না পেলে হীরের কপালে দুঃখ আছে আর সেটা হীর ভালো করেই জানে। বিছানা থেকে নেমে হীর দৌড়ে সদর দরজার সামনে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
দরজার সামনে তুর্য দাড়িয়ে আছে। তুর্যর চেহারা দেখে হীরের বুকটা ধক করে উঠে। উস্কখুস্কু চুল সাথে লাল হয়ে যাওয়া দুটো চোখ আর ডান হাতে লেগে থাকা শুকনো রক্ত,, সব মিলিয়ে তুর্যর অস্বাভাবিক থাকা টা প্রমাণ করছে। না চাইতেও তুর্যর এই অবস্থা দেখে হীরের বুকের ভিতর টা মুচড়ে উঠছে।
তুর্য হীর কে পা থেকে মাথা অব্দি একনজর দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-- কাল রাতে এতো মার খেয়েও তোর শিক্ষা হয় নি তাই না হীর? কাল রাতেই ছেলেদের শরীর দেখানোর জন্য এতো মারলাম,, আর আজই তুই বাতরোব পরে ঘুরছিস।
তুর্যর কথায় আমার হুশ হলো। কাল রাতে বাতরোব পরেই ঘুমিয়েছিলাম। আর বড়মার বকার ভয়ে মাথায়ই ছিল না যে বাতরোব পরেই নিচে নেমে গেছি।
-- না আসলে আমি,,,
-- তোর মতো রাস্তার মেয়ের কাছে থেকে এর বেশি আর কি আশা করা যায়।
-- আপনি ভুল ভাবছেন,,
-- তোর মুখ থেকে আর একটা কথাও শুনতে চাই না। নাস্তা আমার ঘরে দিয়ে যা। ফাস্ট!
তুর্যকে নিজের সাফাই হিসেবে কিছু বলার আগেই তুর্য নাক সিটকে সেখান থেকে চলে গেলেন। তুর্যর ভালোবাসা পাওয়ার যতো চেষ্টা করি, মনে হয় ততোটাই ঘৃণা করেন উনি আমাকে।
দরজা আটকে দিয়ে ঘরে চলে গেলাম। চট জলদি ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে গেলাম নাস্তা বানানোর জন্য।
তাফসি আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। গতকাল এংগেজমেন্ট ছিল। আর একসপ্তাহ পরেই বিয়ে। এ বাড়িতে আমার একমাত্র বন্ধু তাফসি আপু। আমার সুখে দুঃখে সবসময় আপুকে আমার পাশে পেয়েছি। কিন্তু এখন সেও চলে যাবে। তাফসি আপুর হবু স্বামী রায়ান ভাইয়া খুবই ভালো মানুষ। আমাকে তার ছোট বোনের মতো আদর করেন। কাল থেকেই বিয়ের সব আয়োজন শুরু হয়ে যাবে।
শরীর এখনও ব্যথা করছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে তুর্যকে মেরে তার মাথাটা ফাটিয়ে দেই। হ্যাঁ এটাই করবো। আমি কি তার কেনা দাসী নাকি যে যখন ইচ্ছা তখন আমাকে মারবেন! এর একটা প্রতিবাদ করতেই হবে।
তুর্য এর জন্য খাবার ট্রে তে নিয়ে তার ঘরের সামনে দাড়িয়ে আছি। এ বাড়ির একমাত্র এই ঘরটাতে আমার ঢুকা নিষেধ। দুই মাস ধরে উনি ফিরেছেন আর এই দুই মাসে আমাকে এ ঘরে একবারের জন্যও ঢুকতে দেন নি। ট্রে টা দরজার সামনের টেবিলে রেখে দরজায় নক করলাম। দরজার পাশে রাখা ফুলদানিটা হাতে নিয়ে দাড়ালাম। সুযোগে আছি, তুর্য সামনে এসে দাড়ালেই ফুলদানি দিয়ে তার মাথায় এক ঘা বসিয়ে দেবো।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu