লেখিকাঃ ফাতেহাতুন নিলা
**********
ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে মেহরাবের গাড়িটা নিজ গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। সময়টা সন্ধ্যা, চারদিকে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে রাস্তাগুলো। গাড়িতে মেহরাব আর নিদ্রিতা ছাড়া আর কোনো অস্তিত্ব নেই।মেহরাব তার আপন মনে গুন গুন করে গান গাইছে আর ড্রাইভ করছে।এদিকে নিদ্রিতা সিটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে আছে।হয়তো চোখ বুঁজে মেহরাবের গুন গুন করে গাওয়া গানটা শুনতে চাইছে।
' কি ব্যাপার মহারাণী কি বেশি ক্লান্ত? এত চুপচাপ যে। অন্য সময়তো মেহরাব ভাই, মেহরাব ভাই করে মাথা ধরিয়ে দেও'।
কথাটি বলেই এক ব্রু উঁচু করে তাকায় নিদ্রিতার দিকে।
'আপনি কি শ্রেয়া আপুকে ভালোবাসেন মেহরাব ভাই?'
শ্রেয়ার বলা প্রশ্নে মেহরাবের কুঁচকে থাকা ভ্রু আরো কুঁচকে যায়।
' তোমাকে কি আমি এটা জিজ্ঞেস করেছি নিদ্রিতা? তোমাকে বলেছি বেশি ক্লান্ত লাগছে কিনা এভাবে যে আছো।আর তুমি আমাকে তার বিনিময়ে কি বলছো, "আমি শ্রেয়াকে ভালোবাসি কিনা!" এটা কি ঠিক নিদ্রিতা?'
' না, কিন্তু আপনি বললে সমস্যা কোথায় মেহরাব ভাই? আপনি কি ভালোবাসেন তাকে? '
' হ্যাঁ ভালোবাসি। হয়েছে এবার। '
মেহরাবের উওরে নিদ্রিতা এবার মাথা নিচু করে বসে থাকে। চোখ দুইটা পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। নিদ্রিতার ভেজা চোখ দেখে মেহরাবের বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে। মনে মনে বলতে থাকে,
' ক্ষমা করে দিও নিদ্রিতা তোমাকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছা আমার বিন্দুমাএ নেই।আমি চেষ্টা করছি তো সম্পূর্ণ করে তোমাকে পাবার জন্য। আমিও যে ভালোবাসি তোমাকে প্রেয়সি।খুব করে ভালোবাসি। কিন্তু চাইলেও যে মুখ ফুটে বলতে পারছি না। কি করব বলো মা বাবা, ফুপি ফুপাকে রাজি না করানো পর্যন্ত তোমাকে আমার মনের কথা বলতে পারবো না নিদ্রিতা। অপেক্ষা করো কিছুদিন প্রেয়শী। খুব শীঘ্রই তোমার হয়ে যাব। শুধু কিছুটা দিন অপেক্ষা কর। তোমার চোখে এক ফোটা পানি পড়তে দেব না। '
মনে মনে কথাগুলো ভেবেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেহরাব।অতঃপর গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দেয়।কিছুটা সময় পড় তাদের গাড়িটা বাড়ির সামনে পৌঁছায়।
' আমরা বাড়িতে চলে এসেছি নিদ্রিতা। '
' হুম '
বলেই নিদ্রিতা গাড়ির দরজা খুলে বের হতে যায় তখনি মেহরাব নিদ্রিতার হাত ধরে তাকে আটকে দেয়। নিদ্রিতার হাতে একটি শপিং ব্যাগ দেয়।হটাৎ মেহরাব তাকে শপিং ব্যাগ দেওয়ায় জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকায় মেহরাবের দিকে। নিদ্রিতার দৃষ্টি বুঝতে পেরে মেহরাব বলে,
' এটা তোমার, পছন্দ হয়েছিল আমার তাই নিয়ে আসলাম তোমার জন্য। এখন বাসায় যাও ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেও ভালো লাগবে। '
' আমার এটার প্রয়োজন নেই মেহরাব ভাই। আপনার ওই ভালোবাসার মানুষ শ্রেয়া আপিকে দিয়ে দেন। '
নিদ্রিতার বলা বাক্যে মেহরাব অনেকটা অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
' কি বলো এসব নিদ্রিতা এত ভালোবেসে আনলাম তোমার জন্য। তুমি বলছ তোমার প্রয়োজন নেই।উল্টো শ্রেয়াকে দিয়ে দেওয়ার কথা বলছো এটা কি ঠিক করলে নিদ্রিতা। এভাবে আমার মনটা ভেঙে দিতে পার না। যাইহোক কোথায় যেন খুব করে কোনো কিছু পুড়ছে। পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে। তুমি কি গন্ধটা পাচ্ছ নিদ্রিতা? '
মেহরাবের এমন খেয়ালিপনা কথা শুনে নিদ্রিতা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
' হুম পেয়েছি। মন পুড়ছে আমার। এটা মন পুড়ার গন্ধ। ' বলেই নিদ্রিতা ব্যাগগুলো নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। নিদ্রিতার চলে যাওয়া দেখে মেহরাব মুচকি হেসে বলে,
' প্রেয়সি, আমার প্রেয়সি। '
কথাটা বলেই মেহরাব ফোন দেয় সায়ানের কাছে। ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই রিসিভ করে সায়ান হয়তো এই কলটা আসবে বলে তৈরি ছিল সে।
' হ্যাঁ বল, মেহরাব'।
' ঠিক মতো পৌঁছেছিস '
' হুম '
' ঠিক আছে, কালকে একটু কাজ আছে আমাদের তেরি থাকিস বাই। '
বলেই খট করে ফোনটা কেটে দেয়। ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠে একটা বাঁকা হাসি।
গাড়িটা এক পাশে রেখে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে।
' ফ্রেশ হয়ে আমাদের রুমে আসো মেহরাব। তোমার বাবা অপেক্ষা করছেন। ' বলেই মুনিরা বেগম সোফা থেকে ওঠে দাঁড়ান।
' কি এমন জরুরি কথা যার জন্য আজকে বাবাও বাসায় এই সময়। '
' ফ্রেস হয়ে আসো তারপর না হয় জানতে পারবে।'
' হুম।' বলেই মেহরাব তার রুমে চলে যায়। মেহরাবের চলে যাওয়ার পর মুনিরা বেগম তার রুমে যায়।
কিছুক্ষন পর মেহরাব তার বাবা মায়ের রুমের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দেয়। টোকার শব্দ শুনে মুনিরা বেগম রুমে আসতে বলে।
' তোমাকে একটা বলতে চাই মেহরাব আসা করি বুঝার চেষ্টা করবে। ' বলেই মেহরাবের পানে তাকাই জহির চৌধুরী।
' বলো আব্বু '
' আমরা তোমার বিয়ের কথা বলতে চাইছি। এতদিনে তুমি হয়তো এই টুকু অবগত হয়েছ যে আমরা কার সাথে তোমার বিয়ে নিয়ে ভাবছি। '
' হুম আমি জানি কিন্তু আমি তোমাদের আগেই বলে দিয়েছিলাম আমি শ্রেয়াকে বিয়ে করতে পারব না। 'Email
' তোমাকে এটা মানতে হবে মেহরাব। আমাদের মান সম্মান এর কথা এটা।তুমি জান যখন আমরা বিপদে পড়েছিলাম তখন এই মনিরুল আমাদের সাহায্য করেছিল। '
' জানি আব্বু, তার বিনিময়ে তিনি কিন্তু আমাদের থেকে কম সম্মান পাননি। তাছাড়া আঙ্কেলের কোনো প্রয়োজনে কিন্তু আমাদের থেকে কম সাহায্য নেন নি। যা চেয়েছেন তাই দেওয়া হয়েছে তাকে।তাই বলে যে তার জামাই হিসেবে আমাকে চাইবে এটা ঠিক না। আমি পারব না শ্রেয়াকে বিয়ে করতে।'
' আমরা তোমাদের বিয়ে ঠিক করে নিয়েছি। সামনের মাসে ভালো দিন দেখে তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেব।'
' আমাকে না জানিয়ে ঠিক করেছ কেন? '
' কারণ তোমাকে জানালে কখনো মত দিতে না। '
' তোমার কি মনে হয় আমি এখন মত দিব। অসম্ভব এটা।'
' তুমি শ্রেয়াকে বিয়ে করতে চাও না কেন? '
' কারন আমি নিদ্রিতা চাই। ভালোবাসি নিদ্রিতাকে। '
মেহরাবের এমন উওরে জহির চৌধুরী থমকে যান।এমনটা হয়তো তিনি কখনো আশা করেন নি।
' এটা অসম্ভব মেহরাব তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি আমি। তুমি খুব ভালো করেই জানো আত্মীয়র মাঝে আত্মীয়তা আমার একদম পছন্দ নই। শুধু মাএ মনিরুল এর কাছে আমি ঋণী বলে এই সম্মন্ধে রাজি হয়েছি।'
' আমি জানি এটা আর এটাও জানি কেন আত্মীয় এর মাঝে আত্মীয়তা করতে চাও না। কিন্তু তোমার ধারণা ভুল আব্বু।ফুপি আর ফুপার সম্পর্কে ফাটল ধরায় এই না যে সবার ক্ষেএে এমনটা হবে। '
' আমাকে জ্ঞান দিতে এস না মেহরাব।যাইহোক তুমি যে নিদ্রিতাকে ভালোবাসো তা কি নিদ্রিতা জানে?'
' আমি নিদ্রিতাকে ভালোবাসি তা নিদ্রিতা জানে না। '
' ঠিক আছে। নিদ্রিতাকে ভুলে যাও আর শ্রেয়াকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত হও।'
' দুঃখিত আব্বু। ছোট থেকে এই পর্যন্ত তোমাদের কথামতো চলেছি। কিন্তু এখন তোমার এই কথা রাখতে পারব না আমি।'
' তুমি বাধ্য মেহরাব। তোমাকে এটা করতেই হবে। শ্রেয়াকে আমি এই বাড়ির বউ হিসেবে চাই। '
' একটা দওক ছেলে নিয়ে নেও। তার সাথে শ্রেয়াকে বিয়ে দিয়ে দেও। তাহলেই শ্রেয়া এই বাড়ির বউ হয়ে যাবে। তোমাদের ঋণ শেষ হবে।আঙ্কেলের ইচ্ছা টাও পূর্ণ হবে।'
' ফাজলামো করছো তুমি!'
' না, তোমাদের মতামত দেওয়া শেষ এবার। আমি বলব এবার। আমি নিদ্রিতাকে ভালোবাসি। বিয়ে নিদ্রিতাকেই করব।এতোদিন চুপ ছিলাম তোমাদের বলে রাজি হবার পর নিদ্রিতাকে বিয়ে করব।যেহেতু তোমরা এটা মান না তাই আমি নিদ্রিতাকে নিয়ে দূরে চলে যাব। এবার তোমাদের সিদ্ধান্ত। শ্রেয়াকে আমি বিয়ে করব না এটাই আমার লাস্ট কথা।'
কথাটা শেষ করেই মেহরাব কেওকে কিছু বলতে না দিয়ে দরজা ঠেলে বাহিরে চলে আসে।মেহরাবের চলে যাওয়া দেখে জহির চৌধুরী একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন মেহরাব তাদের কথা মেনে চললেও যেটা তার অপছন্দ তা সে ভুলেও করবে না। সরাসরি কথার পরিপেক্ষে না করতে না পারলেও অন্য উপায় বের করে ঠিকি তা করেনি।সেই জায়গায় আজকেতো সরাসরি না করে গেছে।ত্যাড়া সভাবের ছেলে যা বলেছে তাই করবে।এদিকে মেহরাবের চলে যাবার পর মুনিরা বেগম মনে মনে বলতে থাকেন, ' আমিও তোমার মা মেহরাব। শ্রেয়াকেই তোমার বউ করে আনব। খুব তাড়াতাড়ি তাও তোমার মতে। দেখি তুমি কিভাবে না করে পার। আর রইলো নিদ্রিতা তাকেও আমি তোমার থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিব।"
0 Comments