লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


রুদ্র নিরন্তর চক্ষুপাতে মহুয়ার নিস্পৃহ দৃষ্টির প্রান্তরেখায় সঞ্চারিত প্রতিটি অনুচ্ছায়ার মগ্ন। অথচ মহুয়া, স্থির ও নিস্তরঙ্গ দৃষ্টিপাতে জানালার আড়ালে আবৃত, অজানা গভীরতায় নিমজ্জিত। মুগ্ধের প্রত্যাশিত বিলম্বের সংবাদে বিউরোতে দ্রুত গমনাভিমুখে গাড়ি নিয়ে পাড়ি দেয় তারা। পথ চলতে চলতে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত এক প্রকোপে রুদ্র কঠোর ব্রেক কষে থামায় যাত্রাপথ। মুহূর্তের ঘনঘোরে মহুয়া বিস্ময়ের অনুচ্চারিত ভাষায় তাকায় রুদ্রের দিকে।
মহুয়ার একাগ্র প্রশ্ন, কণ্ঠে বয়ে আসে অন্বেষণ,
——— “গাড়ি থামালে কেন?”
রুদ্র নির্জীব উত্তরে সাফ জানায়,
——— “কি হয়েছে?”
মহুয়া পুনরায় জানালার অন্তরালে মুখ ফিরিয়ে উদাসীন স্বরে, আবছা গলায় উচ্চারণ করে,
——— “কি হবে? কিছুই না!”
রুদ্রের রোষ ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠল, রক্তবর্ণ চক্ষুতে শাসনের বিদ্যুৎ জ্বলে উঠল। পুনর্বার গম্ভীর অথচ আবেগে ঘন উচ্চারণে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
——— “তুমি কি আমায় মূর্খ মনে করছো? আমি তোমার নয়নপল্লব দেখেই হৃদয়ের চাঞ্চল্য অনুভব করতে পারি। তোমার অর্ন্তজ্বালায় আরোপিত সে বেদনার রেশ আমি স্পষ্ট বুঝি! এখন বলো, কি এমন ঘটেছে যা তোমার মন বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন করেছে?”
মহুয়া ধীরে ধীরে জানালার অবগুণ্ঠন থেকে মুখ ফিরিয়ে রুদ্রের দিকেই আনত করল তার করুণ কপোল। সে নিস্তরঙ্গ নয়নের অতল গহ্বরে হঠাৎ অশ্রুর প্রবাহ টলমল করে উঠল, সেই বাষ্পিত অশ্রুবিন্দু সকল অনুভূতির বোঝা বহন করছে।
রুদ্র সেই নীরব ধারাজলে মুহ্যমান হল, অন্তরের উদ্বেগ চৈতন্যের আচ্ছাদন ভেদ করে বেরিয়ে এল। ক্ষীণস্বরে, কিন্তু উদার স্নেহে বলল,
——— “তুমি কাঁদছো কেন?”
রুদ্রের প্রশান্তি যেন মুহূর্তেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। মহুয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে উদ্যত হওয়া মাত্রই মহুয়া তার হাত শক্ত করে চেপে ধরল, সে সঙ্কট ও আক্ষেপে ভরা নয়নসমূহে চেয়ে নিঃশব্দে ব্যথার কথা বলল। রুদ্রের বিস্মিত চক্ষু যেন শূন্যতায় স্থির হয়ে গেল, মহুয়ার বেদনার বাণী তার অন্তরের আঙিনায় নিঃশব্দে আঘাত হানে।
মহুয়ার কণ্ঠে মর্মবেদনার করুণ ধ্বনি, অশ্রুসিক্ত নয়নে উচ্চারণ করল,
——— “সবই বুঝো, কিন্তু আমার হৃদয়ের গহ্বরে জ্বলে ওঠা নিঃশব্দ জ্বালাটি বুঝতে পারো না? তোমায় অন্য নারীর সন্নিকটে দেখলে আমার চিত্ত যেন বাষ্পিত অগ্নিদাহে খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়; সে মর্মপীড়া অনুভব করো কি?”
রুদ্র স্তম্ভিত হয়ে মহুয়ার পানে অপলক চেয়ে থাকে, যেন মহুয়ার ভাষার গভীরতা তাকে সম্পূর্ণরূপে বিহ্বল করেছে। এ কোন অযাচিত সন্দেহের আলোড়ন, কোন নির্জন আত্মবেদনা মহুয়াকে তাড়িত করছে? প্রিয়ার প্রসঙ্গে মহুয়ার সব কিছুই জানা; রুদ্র নিজেই আগাম সেই অধ্যায়ের অবসান ঘটাতে বলেছিল যাতে কোনোদিন অপ্রীতিকর প্রশ্ন না উঠে। তবে আজ মহুয়া কেন এমন অনভিপ্রেত বাক্যে আঘাত দিচ্ছে?
রুদ্রের অন্তরের তোলপাড় অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত হল, চোখে বিস্ময়ের ছায়া নিয়ে উচ্চারণ করল,
——— “তুমি এ কেমন অভিযোগ করছো, মহুয়া? প্রিয়ার সম্বন্ধে তো আগেই সব জানিয়েছি তোমায়! তবুও কেমন করে এই বিষাদগর্ভ কথা উচ্চারণ করতে পারলে তুমি?”
মহুয়ার ঠোঁটে এক করুণ, ম্লান হাসি তার অন্তর্গত যন্ত্রণাকে ভাসিয়ে তোলে। নীরবে কিছুক্ষণ সেই গহন দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিশিয়ে উচ্চারণ করল,
——— “আমি প্রিয়ার কথা বলছি না!”
রুদ্রের নির্জলা কণ্ঠের গাম্ভীর্য আরেকবার উদ্গত হল, সংশয় ও অজ্ঞাত কৌতূহলে,
——— “তবে কার কথা?”
মহুয়া এবার নিঃশব্দে স্থবির হয়ে গেল, তার ঠোঁট অন্তর্জগতের গভীর সত্য ধারণ করে নিরবতা বরণ করল। কেমন করে বলবে সে এই কথাটি? কেমন করে নিজের অন্তরে বাসা বাঁধা অনাহুত অশান্তির সুর প্রকাশ করবে? ছোট এক কন্যার প্রতি দ্বেষের জ্বালা তাদের সম্পর্কের পথ রুদ্ধ করুক, এ চায় না মহুয়া। তবু, সেই অচেনা ক্ষুদ্রার আকর্ষণেই তো রুদ্র প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত হয়ে ওঠে অচেনা মানব। সে এক গভীর দীর্ঘশ্বাসে, বেদনামাখা সুরে বলল,
——— “শিকদার বাড়ির ওই মেয়েটা! যার দর্শনপিপাসায় তোমার অন্তরে ব্যাকুলতা জাগে!”
রুদ্র মহুয়ার কথার অন্তর্নিহিত মানে অনুভব করতেই স্তব্ধতায় নিমজ্জিত হল, বিস্ময়ে প্রখর চক্ষু মহুয়ার দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে নিবদ্ধ, হতবাকের মতো সেই মুখের প্রতিটি রেখায় অন্বেষণ করল। রুদ্রের এমন অচঞ্চল চাহনি দেখে মহুয়ার ঠোঁটে এক বিষাদঘন ম্লান হাসি ভেসে উঠল, অন্তরের জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসের ভার সামলাতে চাইল সে।
রুদ্র ধীরে ধীরে মহুয়ার হাত থেকে নিজের হাত অনায়াসে মুক্ত করল, যেন সে এ মুহূর্তের তীব্রতাকে প্রশমন করতে চাইছে। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিল, নিজেকে সমস্ত আবেগ থেকে মুক্ত করতে চায়। মহুয়া এ নিস্তব্ধতায় আরও গহীনে হারিয়ে গেল, কোনো সাড়া না পেয়ে তার অন্তরের গহ্বর হাহাকারে পূর্ণ হলো।
মহুয়ার মনে প্রতিধ্বনিত হল অজানা এক ভয়, বুকের ভেতর অচেনা এক কষ্টের প্রবাহ ধীরে ধীরে বিস্তৃত হতে থাকল—তবে কি সত্যিই রুদ্রের হৃদয়ের সুপ্ত স্পন্দন শিকদার বাড়ির সেই কন্যার প্রতি নিবিষ্ট? এ নিঃশব্দ অবহেলা, এ নিঃশব্দ অপমান তার হৃদয় বিদীর্ণ করে ঢেউয়ের মত বয়ে চলল, কণ্ঠরুদ্ধ এক কান্না নিস্তব্ধতার আড়ালে চুপিসারে সুর হয়ে বাজল তার অন্তরে।
রুদ্র চোখ বন্ধ রেখেই নিজস্ব এক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অবকাশে সামান্য বেকে প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটি বের করল। নির্বিকারভাবে, নিঃশব্দে, মহুয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরল সে; তার চোখে নেই কোনো অভিমান, নেই কোনো উত্তেজনা, শুধু গভীর প্রশান্তির প্রতিচ্ছবি। মহুয়া বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রইল—একে কি আখ্যা দেবে সে? কেন তাকে এই মানিব্যাগটি প্রদান করা হচ্ছে?
রুদ্রের শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর মহুয়ার চিন্তাস্রোতকে বিঘ্নিত করল,
——— “ধরো! খুলে দেখো।”
মহুয়া বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, যেন সে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত সংকেতে অভিভূত। টাকা? রুদ্র কি তাকে টাকা দিচ্ছে? অথচ তার সেই স্থির দৃষ্টি এবং মানিব্যাগের অভিব্যক্তি মহুয়ার মনে উদ্বেগের সঞ্চার ঘটায়। অগত্যা সে মানিব্যাগটি হাতে তুলে নিল, এবং খোলার প্রাক্কালে রুদ্রের গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যেকটি শব্দ যেন মহুয়ার হৃদয়ে স্পন্দিত হল,
——— “টাকা নয়! ভেতরে একটি ছবি আছে, সেটি দেখতে দিয়েছি!”
মহুয়ার কাঁপা কাঁপা হাতে ধরা মানিব্যাগটির অন্দরমহলে প্রবেশ করে তার চোখ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। সেখানকার অর্থ কাগজপত্রে তার কোনো দৃষ্টি নেই, বরং একটি ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবির দিকে নিবদ্ধ হয়ে রইল। মানিব্যাগের অভ্যন্তরে বহু বছরের পুরানো একটি ছবি, যা রুদ্রের স্মৃতির সেই গভীরতম ক্ষতচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। একটি শ্যামাঙ্গী কন্যার শৈশবের চিত্রাঙ্কন—মাথায় চুলহীন সেই কন্যা, টাক্কু মাথার নিঃশব্দ কান্নায় সমগ্র আকাশও মৌনশ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহুয়া থমকে গেল; এই প্রতিচ্ছবি, এই বিহ্বল শূন্যতা, তার বোধশক্তিকে যেন কোনো নিঃশব্দ অথচ গভীর ব্যথায় আচ্ছন্ন করে দিল। কি বলবে, কি জিজ্ঞেস করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। তবুও, কণ্ঠস্বর মৃদু হয়ে প্রশ্ন করে ফেলল,
——— “এই মেয়েটা কে?”
রুদ্র ধীরে ধীরে চোখ মেলল, তার গভীর দৃষ্টি ক্রোধে নয়, বরং নির্লিপ্ত বিষাদে অনুরণিত। সেই দৃষ্টির অবগুণ্ঠনে অগ্নির চেয়ে তীব্র কোনো যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। রুদ্রের ঠোঁট থেকে নিঃসৃত হল অতি স্নিগ্ধ অথচ ভারী একটি শব্দ,
——— “আঁখি!”
এই একটি শব্দে তার হৃদয়ের সমগ্র ব্যথা, স্মৃতি, এবং চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা সেই ছোট্ট প্রতিচ্ছবির মধ্যেই কেন্দ্রীভূত হল।
তবে মহুয়া যেন বিস্ময়ের নিঃশব্দ মহাসাগরে তলিয়ে গেল। আঁখি? এই নামটি তার হৃদয়ের সমস্ত শব্দকেই স্তব্ধ করে দিল। আপন অজান্তে তার হাত থেকে ঝরে পড়ল মানিব্যাগ, সজোরে মাটিতে নেমে এল স্মৃতির ভার। রুদ্র শান্ত অথচ বিষাদাচ্ছন্ন মনে সেই মানিব্যাগটি তুলে নিল; তাতে লুকিয়ে থাকা ছবি এক মুহূর্তে তার অতীতের দর্পণে প্রতিফলিত হল।
নীরবতায় হাত বুলিয়ে, ছবিটির দিকে চেয়ে রুদ্র মৃদু কণ্ঠে বলে উঠল,
——— "সেদিন ছিল ভোরের আলো ফুটবার ক্ষণ, যখন পৃথিবীর প্রতিটি কণা যেন নীরবে প্রভাতের আলোকচ্ছটায় স্নান করছিল। ফজরের আযানের মৃদু ধ্বনিতে সে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, ছোট্ট এক অমল জ্যোৎস্নার ন্যায় তার আগমন আমাদের সকলের হৃদয়ে আনন্দের সুধা ঢেলে দিয়েছিল। তার কণ্ঠের প্রথম কান্নাতেও যেন আমাদের জন্য ছিল মধুর সুর। আঁখি; আমার ছোট্ট ‘পাখি,’ আমাদের দু’পরিবারের বন্ধনের এক গভীরতম আবেগ, যাকে আমি ১০ বছরের শৈশবে প্রথমবার কোলে তুলে নিয়েছিলাম। বাবা বলেছিলেন, ‘বোন হয়েছে, দায়িত্ব বাড়ল,’ সেই শব্দে আমার শৈশব যেন হঠাৎ করেই পরিণত বয়স হয়ে উঠল। তার ক্ষুদ্রতায় ছড়িয়ে ছিল অপরিসীম মাধুর্য; আমার ঘাড়ে চড়ে সে সারাক্ষণ মিষ্টি সুরে ডাকত, তার সেই কচি কণ্ঠের ডাক; ‘চমক ভাই’, আমার জীবনের প্রথমবার অনুভব করালো দায়িত্বের মহিমা। তার মুখের ক্ষুদ্র হাসির জন্য আমি যেন প্রহর গুণতাম, ক্ষণে ক্ষণে তাকে চমকে দিতাম। সবকিছুই তো ঠিকঠাক ছিল, আমাদের প্রতিদিনের ক্ষুদ্র আনন্দে জীবন কেটে যাচ্ছিল এক অজানা সুরে।"
একটু থেমে গেল রুদ্র; তার কণ্ঠ ভাঙছে, গলার গভীরে জমেছে অশ্রুর অপ্রকাশিত ভার। রুদ্র আবার ক্ষীণকণ্ঠে বলল,
——— "সাত বছর বয়স হয়েছিল তাঁর; আমার পাখির জন্মদিনে গিয়েছিলাম তার জন্য সমস্ত কিছু কিনতে। তাঁর মুখের সেই উচ্ছ্বাসভরা অপেক্ষা, 'তাড়াতাড়ি আসবে তো?’, আজও আমার হৃদয়ে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়। তবে ফিরেছিলাম বহু রাত শেষে; ততক্ষণে তীব্র শিখায় সমস্ত কিছু ছাই হয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা, আমার মা, আঁখির বাবা-মা, সকলেই সেই ভয়াল দহনেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি স্মৃতির পরতে পরতে কেবল জ্বলন্ত ছায়াপথ। কেবল আমার ‘পাখি’র দেহখণ্ড কোথাও খুঁজে পাইনি। যেন সেই ভস্মভূমিতে একান্ত অদৃশ্য, একান্ত অপূর্ণ থেকে গেল সে। একরাত্রিতে আমি সব হারিয়েছি—পরিবার, স্বজন, আর সেই নির্ভেজাল আনন্দ যা তার ছোট ছোট হাসিতে ফুটে উঠত।
বাবা সেদিন বারবার ফোন করেছিল; হয়তো সহায়তা চেয়েছিল, হয়তো শেষ কথাটি বলতে চেয়েছিল। আমি বুঝতে পারিনি! সেই বোকা আমি ফোনে মনোযোগ দেইনি। আর সেই এক বিরাট দেরির মূল্য আমাকে সমগ্র জীবনের একাকীত্ব দিয়ে চুকাতে হয়েছে। আজও সেই মুহূর্তে আমার পাখির সেই ছোট্ট কণ্ঠস্বর কানে বাজে, ‘তাড়াতাড়ি আসবে তো?’ অথচ, আমি তাড়াতাড়ি আসিনি... আমি আমার দেরির মূল্য দিয়ে সবকিছুই হারিয়েছি।"
মহুয়ার অশ্রুবিন্দু প্রতিটি ক্ষণে তার মুখের পটে ম্লান বেদনার ছাপ এঁকে যাচ্ছে। রুদ্রের রক্তিম চোখ, অন্তরে লুকায়িত হাহাকারের প্রবল বহিঃপ্রকাশ। তার কণ্ঠে শোনা গেল,
——— “শিকদার বাড়ির সেই ছোট মেয়েটিকে প্রথমবার যখন দেখলাম, এক মুহূর্তে আমার সত্তায় যেন ঝড় বয়ে গেল। মনে হলো, আমার সেই আঁখি ফিরেছে, ফিরে এসেছে প্রভাতের আলোকে শ্যামল কায়ায়। নামটাও তো একই, চোখের ভাষাটাও একেবারে মিলিয়ে গেছে। যেন অতীতের স্মৃতিরা তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে, সেই বেদনার স্মৃতিচিহ্ন।
বয়সও যে একই, কী আশ্চর্য মিল! আমার আঁখি, যাকে আমি অন্তরের কলিজা করে রেখেছিলাম। আপন বোন না হলেও কম ছিল না, মমতায় ছিল এক অনির্বচনীয় বন্ধন। যখন শিকদার বাড়ির সেই আঁখিকে দেখি, মনে হলো আমার হারানো আঁখি যেন সেখানে খুঁজে পেয়েছি। যেন সে এখনও আমার অপেক্ষায় রয়েছে, আমার ব্যর্থ খোঁজের প্রহসনে। আমি আজও কেবল ক্ষমা চাওয়ার তাড়নায় তাকে খুঁজি, তার সেই হেরে যাওয়া ‘চমক ভাই’-এর বিলম্বিত পলায়ন তার বিরক্তির কাছে ক্ষমাযোগ্য হবে কি না, সেই প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছি। জানি, এ কেবল এক সপ্নময় মরীচিকা মাত্র; তবে এই মরীচিকার ভিতরেই আজও আঁখিকে অনুভব করি, জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাস তার স্মৃতির জন্যই উৎসর্গিত।”
মহুয়া নিশ্চুপ। তার চোখ বেয়ে নীরবধি অশ্রুধারা ঝরে পড়ছে, নিঃশব্দে যন্ত্রণার নদী প্রবাহিত হচ্ছে। রুদ্র হালকা হাসির আভা ছড়িয়ে গাড়ি পুনরায় স্টার্ট দিলো, তার গতিপথ সেই শূন্যতার ভেতরে ছুটতে লাগলো। কেননা, পেশাদার জীবনের কঠোর নিয়মাবলী আর ব্যক্তিগত অনুভূতির দুর্বলতা এক সূত্রে বাঁধা চলে না। জীবন এখানে থমকে যাওয়ার নয়, থেমে গেলে একদিন ছিটকে পড়তে হবে, হারিয়ে যাবে অস্তিত্ব।
অথচ মহুয়ার হৃদয় কুন্ঠিত অপরাধবোধে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। রুদ্রকে আরও আগে এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করাটা তার দায়িত্ব ছিল, অথচ সে শুধু রুদ্র ও আঁখি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণায় নিমগ্ন ছিল। জানতোই না রুদ্রের বুকের গহীনে এত গভীর ক্ষতচিহ্নের বহন ছিল, এত অব্যক্ত কষ্টের ইতিহাস মুদ্রিত হয়ে ছিল তার অস্তিত্বে! তাদের মধ্যে "ভালোবাসি" শব্দটি কোনোদিন উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু প্রতিটি কাজে, প্রতিটি মুহূর্তে, রুদ্র মহুয়ার প্রতি তার নিবিড় প্রেম প্রকাশ করেছে। ভালোবাসা শুধুই কথার খেলা নয়; সে প্রমাণের দাবী রাখে। রুদ্র সেই প্রমাণ নিঃশব্দে অমোঘভাবে রেখে গেছে। যদিও তাদের পরিচয় অল্পদিনের। তবুও ভালোবাসা কি সময় মানে?
মহুয়া জানালার দিকে তাকিয়ে, রুদ্রের দিকে না ফিরে, মৃদু স্বরে সেই সীকারোক্তি করল,
——— "ভালোবাসি!"
রুদ্র গাড়ি চালাতে চালাতেই সম্মুখপানে তাকিয়ে তার মুখে একরাশ মৃদু তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে দিলো। শত বেদনার মাঝেও এই ক্ষণিক শান্তি তার অভ্যন্তরে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো। গাড়িটি ছুটে চললো সামনের দিকে, আর ভিতরে ছুটন্ত দুটো একান্ত হৃদয়, অদেখা বন্ধনে বাঁধা।
_________________YouTube
গুনে গুনে ত্রিশ মিনিট অতিবাহিত হতেই দরজার খিল খসে পড়ল। নিস্তরঙ্গ দৃষ্টিতে মুখাবয়বে নিরাবেগের গাঢ় ছাপ রেখে বেরিয়ে এলো মুগ্ধ। তার পিছে অনুগত ভঙ্গিতে, কাচুমাচু আঁখিও সহসা বেরিয়ে এলো। বাহিরে অপেক্ষারত শান্ত ও নাঈমের অস্থিরতা যেন আরও তীব্রতর হতে লাগলো, দরজার খুলে যাওয়ায় যেন তাদের বুকের ধুকপুকানি দ্বিগুণ হলো। আঁখির কাছে সজোরে এগিয়ে গেল নাঈম, আর মুগ্ধ কনিষ্ঠাগ্র পকেটে গুঁজে চলল আজগর আলীর সন্নিকটে।
আজগর আলীর কপালে চিন্তার ভাঁজ যেন আরও গভীর হয়ে উঠল। সন্দেহে জর্জরিত মনে প্রশ্ন উদয় হলো, আঁখি কি কিছু জানিয়ে দিয়েছে? না হলে মুগ্ধ এভাবে সামনে এসে দাঁড়াবে কেন! মুগ্ধের মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট হলেও ঠোঁটের কোণে কুটিল এক হাসি খেলে গেল। গম্ভীরভাবে হাত বাড়িয়ে বলল,
——— "এখন আসি!"
আজগর আলী খানিক দ্বিধায় থাকলেও হাত মিলালেন। তবে মুগ্ধের দৃষ্টি এবার সরে গেল কুদ্দুস আলীর দিকে; তাকিয়ে এক রহস্যময় হাসির আবহ ছড়িয়ে দিল তার দিকে। কুদ্দুস আলী মুগ্ধের সেই হাসির ইঙ্গিতে থমকে গেল, আর মুগ্ধ নিরুচ্চারে আরও একবার নিজের বলিষ্ঠ অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল। এরপর নিঃশব্দ পদক্ষেপে বাড়ি ছাড়তে লাগল।
বাড়ির প্রতিটি মানুষের চোখে চোখ রেখে, তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাদের অন্তঃসত্ত্বা পাঠ করতে ভুলল না। সদর দরজার চৌকাঠ অতিক্রমের সাথে সাথেই মুগ্ধর মুখাবয়বে কঠোরতার ছায়া আবারও দৃশ্যমান হলো। চোয়ালের পেশী শক্ত হয়ে উঠল, আর সে দৃঢ়পদে পা বাড়াল বিউরোর অভিমুখে, নিয়তির পাটাতনে কুটিলতার নতুন অধ্যায় লিখতে প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে।
---TikTok
মুগ্ধ বিদায় নিতেই, আফিয়া বেগম আঁখির দিকে তীব্র দৃষ্টিতে এগিয়ে এলেন। নীরবতার আবেশ ভেঙে তিনি এক প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিলেন,
——— "কিছু বলে দিসনি তো?"
আঁখি তার মাথা দুপাশে নীরবে নাড়ালো, ইঙ্গিত করল যে, না, কিছুই সে প্রকাশ করেনি। আফিয়া বেগমের মুখে তখনও তেজের ছটা। কণ্ঠে কঠোরতার ঝলক এনে বললেন,
——— "ঠিক আছে! আর শোন! এত বাইরে যাওয়ার শখ কেন? বেশি বাইরে পা বাড়ালে কিন্তু পা কে'টে রাখব! বুঝেছিস?"
এবারে রোকেয়া বেগম এক ব্যঙ্গমাখা আক্রোশের ছদ্মরূপে বললেন,
——— "কেন, বাইরে যাবে না কেন? তার কি সেই অধিকার নেই?"
আফিয়া বেগম বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালেন রোকেয়া বেগমের দিকে, যেন তার অনধিকার চর্চাকে চোখের ভাষাতেই নীরবে ভ'স্ম করতে উদ্যত। এদিকে, এই কূটমধুর পারিবারিক নাটকে কানিজ বেগম তীব্র বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। বিরক্তির ভারে কপাল কুঁচকে রুমের দিকে পা বাড়ানোর আগে রিতু খালাকে নির্দেশ দিলেন চা বানিয়ে তার ঘরে নিয়ে আসার জন্য মাথাটা আ'ঘাতপ্রাপ্ত সৈনিকের মতো বিক্ষত বোধ করছে।
অন্যদিকে, আজগর আলী মনে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলেন। আঁখিকে কিছু বলতে না হলেও, তার ভাবিই যা বলার বলে দিলেন। এমনই তো সম্পর্কের গূঢ়তা, অলঙ্ঘ্য অনুভূতির জালে বাঁধা। এ কারণেই তো ভাবির প্রতি তার এই গহীন মুগ্ধতা! এমনি তো নয়।
--Threads
বাড়ির আঙিনায় সিআইডির প্রতিনিয়ত আনাগোনা যেন এক অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে; অনির্দিষ্ট আতঙ্ক সর্বদা ছায়ার মতো সবার মনে গ্রাস করে আছে। প্রতিটি মুহূর্তে ভয়, কখন যে সত্যের আলোর মুখোমুখি হতে হয়, সেই অজানা ভীতির পাহাড় বয়ে চলেছে সকলে। আজ তারা বিদায় নিতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ঘরের প্রতিটি মানুষ, অশান্ত জলস্রোত অবশেষে কিছুক্ষণ নিরবধি শান্তিতে ভাসল। কিন্তু এই শান্তি কতক্ষণ, কে জানে!
এক এক করে সবাই নিজ নিজ কাজে ফিরে গেল। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল শান্তর জন্য, যারপরনাই অস্থির ছিল এই সময়টুকুর জন্য। দ্রুত আঁখির কাছে এসে, দুই গাল চেপে কোমল সুরে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
——— “তোকে কিছু করেনি তো?”
——— “না ভাইয়া!”
——— “কি বলেছে? আমাকে বল!”
আঁখি নিরুত্তর; তার চোখের গভীরে অব্যক্ত নীরবতা ঠাঁই নিয়েছে। বলবার মতো কিছুই তো নেই, নিঃশব্দের মাঝে তার প্রশ্নগুলোও ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে। ঠিক তখন, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাঈম স্নেহশীল স্পর্শে আঁখির মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাসের গম্ভীরতায় বলল,
——— “চিন্তার কিছু নেই! তাদের সাহস নেই এতটুকু যে আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে আমাদের বোনের ক্ষ'তি করবে!”
শান্তর কান দুটোতে কারো পায়ের শব্দের মৃদু আভাস পৌঁছাতেই সে মুহূর্তে ধরফরিয়ে আঁখি কে ছেড়ে ছিটকে দূরে গিয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করল। এক নিমেষেই কঠোর মুখাবয়ব নিয়ে, রাগের তীক্ষ্ণতায় কণ্ঠে বিদ্রূপ মিশিয়ে চিৎকার করে উঠল,
——— "বেশি সাহস দেখাচ্ছিস? বেয়াদব মেয়ে কোথাকার! মনে হচ্ছে, মা'রের কথা ভুলে গেছিস! আবার মনে করিয়ে দিতে হবে নাকি?"
এই বলে, কোনো প্রতীক্ষা না করে, গটগটিয়ে বাড়ির বাইরের পথে বেরিয়ে গেল শান্ত। চেহারার অভিব্যক্তি জটিলতার মোড়কে নিজেকে ঢেকে নিলো। এদিকে, নাঈম আঁখির দিকে তাকিয়ে নিরুপায় ভঙ্গিতে বলল,
——— "চল, এখান থেকে!"
এই কথার ইঙ্গিতে, নাঈম আঁখিকে নিয়ে দ্রুত ড্রয়িং রুম ত্যাগ করল, এক ফাঁকা ও নীরব নিঃশ্বাস ফেলে রেখে গেল সেই ঘরে। তবে তাদের এ খেলা পর্দার আড়াল থেকে নিঃশব্দে প্রত্যক্ষ করলেন কুদ্দুস আলী। আসলে তিনি এসেছিলেন মাত্র তার চশমাটি নিতে, যা ভুলে সোফার উপরেই রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগমনের দৃশ্যচিত্র এভাবে মোড় নেবে, তা তিনি বিন্দুমাত্র ভাবেননি। পায়ের শব্দটাও ইচ্ছাকৃতভাবে তুলেছিলেন কেবলমাত্র দেখার জন্য, ভেতরে ভেতরে কীভাবে চরিত্রের আসল রূপ বদলায় তা স্বচক্ষে উপলব্ধি করতে পারেন।
একটি কুটিল হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটে। চশমাটি সোফা থেকে তুলে নিয়ে চশমার কাঁচের ওপারে দিয়ে সেই নিঃশব্দ নাটকের বাকি আবহ মাপলেন। তারপর ঠোঁটের কোণে গোপন তৃপ্তির সাথে এক গুঞ্জনধ্বনি বের করলেন,
——— "চোরের উপর বাটপারি?"
এই কথায় যেন ঘরের প্রতিটি স্তব্ধ কোণ তাকে সাথে সাথে বিদ্রূপের সুরে প্রতিধ্বনি করে উঠল।
_______________________
আফিয়া বেগম নিজ শয়নকক্ষে, নিঃসঙ্গতা বেষ্টিত নির্জনতায় মগ্ন। দরজা বন্ধ, মৃদু আলোয় অনুজ্জ্বল চিত্রফ্রেমের দিকে তাঁর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ। সেই ফ্রেমে পূর্বিকার মুখচ্ছবি জীবন্ত স্মৃতিময়তায় স্পন্দিত। হাসিমাখা মুখখানি চিরন্তন হয়ে আছে, যদিও মেয়েটি এখন আর নেই; তার অস্তিত্বের ছায়া এই এক মাসেই লুপ্ত। সকলের জীবন ক্রমশ স্বাভাবিকতায় ফিরে এসেছে, প্রকৃতির শাশ্বত নিয়মের অবিরাম প্রবাহে।
আফিয়া বেগমও প্রিয়জন হারানোর বেদনা সংবরণে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন, জীবনের ছন্দ কারো জন্য থেমে থাকে না। তবুও এক অমোচনীয় আক্ষেপ রয়ে গেছে। সেদিনের রাতে তাঁর অনিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থান যদি সামান্যতম পূর্বাভাস দিত, তবে হয়তো মূর্ত প্রতিমাটি আজও তাঁর বুকের কাছে উষ্ণ স্পর্শে বিরাজমান থাকত।
রাতের এই নিস্তব্ধতার পরতে পরতে জমানো আবেগের ভার সহ্য করতে না পেরে, নিঃশব্দে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে থাকে। দিনের মুখোশ খুলে, আঁধার নামলেই তাঁর চেতনায় অন্তর্লীন ক্ষতের যন্ত্রণা তীব্র বেদনায় উন্মুক্ত হয়, এক নিরন্তর যন্ত্রণার অভিসার, যা তাঁকে রাতের আঁধারে একাকী কাঁদায়, যাকে প্রকাশ করতে পারেন না কেউ, বুঝতেও পারে না কেউ।
__________________
ফোনটিকে হৃদয়ের গভীরে চেপে ধরে আকুল বিলাপে ফেটে পড়ল আছিয়া! শূন্যে মিলানো ঐ পাষাণপুরুষ আজও তার আহ্বান গ্রাহ্য করলো না। কতবার যে তার গৃহের প্রাঙ্গণে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছে, একটিবার দেখা পাওয়ার তৃষ্ণায় তৃষিত হৃদয়ে! বাবার সাথে ভিড়ভরা বিপণিতে যায়, কেবলমাত্র জীবন নামক সেই অশ্রুতপূর্ব শূন্যতার সীমানায় দাঁড়ানো পুরুষটিকে এক পলক দেখতে। অথচ, সেই অবিচল পুরুষ ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এই কোমল হৃদয় এখন আর দাহের এমন দহন সহ্য করতে পারছে না।
সেই নারী, যাকে আছিয়া একদিন মনে করেছিল তার জীবন ভাই এর সঙ্গিনী, সেই নারীর সাথে একবার পথে দেখা হয়েছিল। সেদিন কৌতূহলবশত কথোপকথনেও জড়িত হয়েছিল। কেননা নারীর পাশে ছিল অন্য এক অপরিচিত পুরুষ। মনে হয়েছিল, হয়ত তার জীবন ভাইকে প্রতারণা করছে সে! কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, যখন নারীর কণ্ঠে শুনল যে জীবন তার দেবর, আর যে পুরুষ তার সাথে রয়েছে, সেই তার স্বামী—আছিয়ার হৃদয় সেই মুহূর্তে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল। মনে হয়েছিল, অকারণেই যেন ভুল ধারণার মেঘে আচ্ছন্ন হয়েছিল তার প্রিয় জীবন ভাইকে নিয়ে। ভাবনায় শান্তি এসে ধরা দিল যে, জীবন ভাইয়ের জীবনে অন্য কোনো নারী নেই।
তবুও, এই শান্তি ক্ষণস্থায়ী। ঐ হৃদয়হীন পুরুষ, যার অবজ্ঞার প্রতিটি আঘাতে সে ধীরে ধীরে মৃ'ত্যুর দ্বারে পৌঁছাচ্ছে,তার হৃদয় অবিচ্ছিন্ন শূন্যতার নিবিড় অন্তরালেই নিবদ্ধ।
আছিয়া ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে আসছে, আহার ত্যাগ করেছে সে। একদা যার সাথে ক্ষীণ কথোপকথন হতো, সেই নিঠুর পুরুষ এখন সম্পূর্ণ নির্বাক। সামনে পরীক্ষা, অথচ অধ্যয়ন তার জীবন থেকে বিস্মৃত হয়েছে! বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোর মাঝে মনোযোগ আর কোনো আশ্রয় খুঁজে পায় না। ক্রন্দনে চোখের নীচে নিকষ অন্ধকারের কোলাহল রচিত হয়েছে! আছিয়া ভাবতে থাকে, এই নিস্পৃহ জীবন ভাই কি তার এই দুঃসহ যন্ত্রণা একবারও লক্ষ্য করে না? করবে কেমন করে? দৃষ্টিপাত তো একবারও করে না সে!
অসহায় আকুলতায় ফ্লোরে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদে উঠে আছিয়া। থরথর কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
———"এত অবহেলা কেন জীবন ভাই? জীবনকে উপলব্ধি করতে পারি না বলে? তবুও কেন এত দহন আমার বুকের মাঝে? এই ব্যথাগুলো কি জীবনের অনুষঙ্গ নয়?"
তার এই প্রশ্নের উত্তর আর পাওয়া হয় না। জীবন ভাইয়ের অবিচলিত নিরবতার মাঝে শুধু তার হৃদয়ের তপ্ত দীর্ঘশ্বাস অনুরণিত হয়।
___________________Email
নিস্তব্ধতার রজনী গভীর এক আঁধারের মহাকাব্যিক পরিব্রাজক। নিশীথকাল ভেদ করে চৈতন্যহীন নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন আকাশ; সমস্ত মানব জাতি নিদ্রার গভীর অলিন্দে হারিয়েছে। অথচ আঁখির তন্দ্রার বিন্দুমাত্র আলিংগন ঘটেনি। সময়ের অনস্তিত্বে বিভোর হয়ে ঘড়ির কাঁটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে—ঠিক রাত দুটো। পড়ার টেবিলের সম্মুখে গ্রন্থপুঞ্জ উন্মোচিত, অথচ তার দৃষ্টি সেখানে নিবদ্ধ নয়; শূন্য কাগজে রঙের গূঢ় শিল্প প্রকাশিত হচ্ছে।
এমন যেন এক অন্তর্গত রঙ্গমঞ্চ, যেখানে অনুভূতির রঙে আচ্ছন্ন মূর্তির সৃষ্টি করছে আঁখি। বিরহ কিংবা ব্যথার প্রতিধ্বনি তার তুলিকায় প্রতিফলিত, রঙের মাধ্যমে সে তার অন্তর্লীন সত্তাকে প্রকাশিত করে। একমাত্র এই মাধ্যমেই সে নিজেকে স্বগত একান্ততায় বিলীন করতে পারে, প্রত্যেক অনুভূতির অতল গভীরতায় নিজেকে খুঁজে পায়।
প্রলয়-বর্ণিত নিস্তব্ধতা ভেদ করে শ্বেতপত্রের বুকে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে মগ্নচিত্র। সেখানে দেখা যাচ্ছে নীলাভ অন্ধকারে আলো-ছায়ার খেলা। সোফার কোণে নির্জীব হয়ে বসে আছে এক তরুণী, নিস্তরঙ্গ স্রোতে বন্দিনী; তার সম্মুখে স্থিত একজন পুরুষ, যার চোখের শিখাগ্নি যেন মর্মভেদী তীক্ষ্ণতার প্রতীক। তার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি, অন্ধকারের মধ্যে জ্বলন্ত শিখা। তার শক্ত মুঠিতে আকর্ষিত একটি পি'স্তল, মৃত্যু-নিয়তির রুদ্ধশ্বাস প্রতিচ্ছবি।
হ্যাঁ, এই নিপুণ চিত্ররূপে আঁখি এঁকেছে নিজেকে আর মুগ্ধকে, যেখানে মুগ্ধর শীতল ক্রো'ধ তাকে আচ্ছন্ন করে, আর আঁখির চোখে ভয়াভিভূত বিস্ময় খেলা করছে।
তখন জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে মুগ্ধ তাকে টেনে আনে এক প্রকার জোর করেই নির্জন কক্ষে, আর শ্বাসরুদ্ধ ঠাসে দরজার আড়ালে নিজেকে আলাদা করে। আঁখির বিস্ফারিত নেত্রে ধরা পড়েছে এক অলৌকিক আতঙ্ক, চোখের পাতার নিকট সীমান্তে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনো আদি-অভিযান।
মৌন-বিষাদ, কল্পনার অন্তরালে রচিত এক অমোঘ গল্প।
আঁখি বিস্ময়ে দৃষ্টিপাত করল এবং বলল,
——— “দরজার বন্ধ করা কি খুব দরকার ছিল?”
মুগ্ধের চোয়ালে শিরার নিঃশব্দ গর্জন! সে সজোরে সামনে এগিয়ে, দিগন্তপ্রতিম দীর্ঘকায় দেহটিকে নিচু করে আঁখির ক্ষুদ্র অবয়বকে আশ্চর্যের আঘাতে আচ্ছন্ন করে তার কাঁচামাটির ন্যায় কোমল বাহু দৃঢ়তায় আবদ্ধ করল। শক্তিবলে প্রায় মনে হচ্ছে, এই বাহুদ্বয় মাং'স কে'টে হাড় অবধি প্রবেশ করবে! আঁখি একেবারে হতবাক, মুগ্ধর এই অভাবিত আচরণে! দাঁতে দাঁত চেপে, গলায় একপ্রকার কাঁপুনি নিয়ে বলে উঠল,
——— “আ-আপনি কেন আমায় এভাবে ধরেছেন? ছাড়ুন! বলছি, আমাকে ছাড়ুন!”
মুগ্ধ, রক্তচক্ষু প্রজ্জ্বলিত করে, আঁখির বাহুতে আরো দৃঢ়পন্থায় চাপ দিলো! অগ্নিঝরা শ্বাস নিতে নিতে এতটাই নিচু হয়ে এল যে, তাঁর দীর্ঘ অবয়ব আঁখির ক্ষুদ্র চেহারার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। এ যেন দুটো প্রতিপক্ষের নয়নাগ্নি বিনিময়ের দুর্জ্ঞেয় খেলা! গভীর অভিব্যক্তিতে তাকিয়ে থেকে মুগ্ধ বলল,
——— “ তুমি অনেক বার বেড়েছো! ”
আঁখি, মুগ্ধের লোহার মতো কঠিন গ্রাসে আবদ্ধ, দম ফেলার আপ্রাণ চেষ্টায় কাতর স্বরে বলল,
——— “ আমি না! আপনি বেড়েছেন বেশি! ”
মুগ্ধ তখন এক আশ্চর্য আক্রোশে ধীরে ধীরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
——— " তোমাকে মারতে আমার বেশি সময় লাগবে না!”
মুগ্ধ শক্ত হাতে আঁখির পিঠ ঠেকিয়ে দিলো শীতল প্রস্তর-প্রাচীরে। এমন তীব্রতায় ধাক্কা যে মনে হলো, দেয়ালটিও যন্ত্রণার ক্ষীণ আর্তি করে উঠল! এরপর মুগ্ধ তার শিরায় গর্জিত আক্রোশে আঁখির নরম গাল দু’টি কঠোর মুঠোবদ্ধে চেপে ধরলো। আঁখির ঠোঁট দুটি গোলকৃতির ন্যায় উন্মুক্ত! সেই চিত্রের প্রতি ক্ষণিক মুহূর্তের নিবিষ্ট দৃষ্টিপাত করে মুগ্ধ আকস্মিক সত্তা বোধে নিজের চোখ বুজে নিল, মাথাটি হালকা দুপাশে ঝাকিয়ে আন্দোলনে স্থিরতা খুঁজল। তারপর চোখ খুলে এক নির্নিমেষ দৃষ্টিতে আঁখির দিকে তাকিয়ে বলল,
——— “এখন নিজস্ব রূপটি প্রকাশ করো! এখানে কেবল তুমি আর আমি, আর কোনো তৃতীয় অস্তিত্ব নেই!”
আঁখি তার দমবন্ধ কণ্ঠে অব্যক্ত কিছু কাইকুই আওয়াজ করে উঠল। মুগ্ধ পরিস্থিতি বুঝে তার গাল থেকে হাত সরিয়ে নিল, কিন্তু সহসা বাহুতে পুনরায় কঠোর পেষণে বন্দি করল! তার মুখ এতটাই কাছাকাছি এনে রাখল যে, দু’জনের শ্বাস একে অপরের বিরূপতাকে স্পর্শ করছে! আঁখি দ্রুত শ্বাস নিয়ে তার ভিতরের উত্তাপকে প্রশমিত করার চেষ্টা করল, তারপর এক নিঃসীম দৃঢ়তায় তাকিয়ে, সেই বিস্ফারিত র'ক্তিম দৃষ্টিতে এক হাস্যরসের তাচ্ছিল্যে ফিক করে হেসে উঠল। হাসিতে তীক্ষ্ণ দাঁতের ঝিলিক, বলল,
——— “অবশেষে ষাঁড় কি ক্রোধে ফেটে পড়লো?”
হাতের বাঁধন মুক্ত করে দিলো মুগ্ধ। মেরুদণ্ড সোজা করে, দৃঢ় পদক্ষেপে তাকিয়ে রইল অ'সভ্য কৃষ্ণকায়ার দিকে। কীভাবে অবজ্ঞার হাসি ঝরে তার ঠোঁটের কোণায়? মুগ্ধের নিশ্বাস গাঢ় হলো, উত্তপ্ত আগুনের স্রোত। ফের শক্ত হাতের মুঠিতে আঁটকে রেখে এক প্রবল টানে সোফায় আছড়ে বসালো আঁখিকে। টাল খেয়ে উলটে পড়লো সে। তারপরই বিদ্ধ দৃষ্টিতে, অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠল মুগ্ধের দিকে।
মুগ্ধ ঠান্ডা ধাতব মুখে চেয়ার টেনে আনল, একেবারে তার মুখোমুখি বসলো। আঁখি কিছু বলার আগেই মুগ্ধ তার পি'স্তলটি বের করে দক্ষ আঙুলে ঘুরাতে লাগল। খেলার মতো, নিঃশব্দ হুমকির মতো। আঁখির ভেতর শিরায় শিরায় ভয় ছড়িয়ে পড়তে লাগল, অথচ মুখের রেখায় এক চিলতে তাচ্ছিল্যও ফুটল। সামনে দাঁড়ানো এই দানবীয় শক্তির সামনে সে কোনোদিনই নিজের আতঙ্ক প্রকাশ করবে না; এ তার অহঙ্কার।
ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত রূঢ় হাসি এনে আঁখি সোজা হয়ে বসে, পায়ের উপর পা তুলে বলল,
——— তা, এখন বুঝি পিস্তলের ভয় দেখানো হচ্ছে?
মুগ্ধের ঠোঁটে প্রচণ্ড শীতল হাসি, যেন প্রতিশোধের প্রতিচ্ছবি। এক গভীর তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
——— এইতো খোলস থেকে বেরিয়ে আসছো! চলো, একটা খেলা খেলি।
পিস্তলটা আঁখির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল,
——— নাও, গু'লি করো আমাকে!
আঁখি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, চোখে অবিশ্বাসের ছাপ। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ শব্দ, মনের গভীরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। তবুও নিজের আতঙ্ক আড়াল করে, মুখে সেই প্রখর ব্যঙ্গ এনে বলল,
——— "ইশ্, সিআইডির মাথায় যে কেমন গোবর ভর্তি থাকে, তা আপনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না! একটা সাধারণ মেয়ের হাতে পি'স্তল তুলে দিচ্ছেন মা'রার জন্য? অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করতে এসেছেন না কি নিজেই অন্যায়ের রক্ষক?"
মুগ্ধ তার ঠোঁট বাঁকা করে সেই বিদ্রূপাত্মক হাসি দিয়ে বলল,
———" আমাকে মা'রতে তোমার বড় বড় কথার ভাষণ নয়, পিস্তলের গু'লি লাগবে। আর হ্যাঁ, অন্যায় হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্যই বলছি! চালাতে পারো কি না, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। নাও গু'লি করো।"
তারপর চোয়াল শক্ত করে, পাথরের মতো কঠোর দৃষ্টিতে বলল,
——— "আর যদি আজ আমাকে মা'রতে না পারো, তবে আমি তোমাকে মে'রে ফেলব! "
আঁখির সারা শরীর প্রগাঢ় শীতলতায় জমে গেল, অনিশ্চিত ভয়ের করাল ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে। মাথা ভারী হয়ে কাঁপছিল, ভারসাম্য হারানোর মতো অনুভব। নিজেকে দৃঢ়তায় আবদ্ধ করতে সে মাথা ঝাঁকিয়ে সংযত স্বরে বলে উঠল,
——— "যান, অনুমতি দিলাম! সাধ্য থাকলে মে'রে দেখান!"
তার প্রত্যয়ী অথচ তাচ্ছিল্যপূর্ণ শব্দে মুগ্ধের দৃষ্টিতে বিদ্বেষের অগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠার সাথে সাথেই কঠোর হাতে পি'স্তলটা তুলে আঁখির কপালে ঠেকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
——— আমার সতর্কতাকে তুচ্ছ ভাবার মাশুল আজকেই দেবে!
আঁখির চোখ ক্ষণিকেই শক্তভাবে বুজে এলো। মনে হলো অন্তিম অন্ধকারের অন্তর্লোকে প্রবেশ করছে, গাঢ় নির্জনতার অবরোধে। বুকের গভীরে একটা অবর্ণনীয় শূন্যতা ধকধক করছে। আশু মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে স্মৃতির সমুদ্র থেকে আপনজনদের মুখ খুঁজে নিতে লাগল। কালিমা পরতে শুরু করলো মনে মনে.!
মুগ্ধ শীতল হাসিতে উদাসীন চোখে তাকাল, মৃ'ত্যুর চেয়েও কঠিন অবজ্ঞায়। পিস্তলটা আঁখির কপালে রেখেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো, এবং তার দিকে এগিয়ে, নিকটবর্তী হয়ে, কণ্ঠে তীব্র হুমকি মিশ্রিত বিদ্রূপের সুরে বলল,
——— "আমাকে না মা'রার অপরাধের ফল ভোগ করবে নিজের জীবন দিয়ে! আজ হোক বা কাল!"
আঁখি নীরবে ঢোক গিলে চোখ মেলে তাকাল। আতঙ্ক তার সত্তার প্রতিটি কোষে জ্বলে উঠলেও মুখাবয়বে একটুও প্রকাশ পেল না। মুগ্ধ ধীরে তার কানের কাছে ঠোঁট এনে শীতল স্বরে ফিসফিস করে ভীন্ন কথা বলল,
——— "আমার অন্তিম অধ্যায় শুরু হলো।"
এই বলেই সে পিস্তল সরিয়ে আঁখির কপালে তার তর্জনী আঙুলের দ্বারা টোকা দিলো; মৃদু স্পর্শ রাখল, সেই স্পর্শে চিরন্তন অ'ভি'শা'প অঙ্কিত করে গেল, অন্তহীন দুঃস্বপ্নের প্রতিশ্রুতি রয়ে গেল তার ওই ক্ষণস্থায়ী টোকার মাঝেই।
আঁখি বিমূঢ় দৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকালো। এ কি রকম রূঢ় উপহাস? এতক্ষণ যা ভেবেছিলো, সবই কি কেবল এক নির্মম রসিকতা? আঁখি দাঁড়িয়ে পড়লো ক্ষোভে, দাঁত চেপে বলল,
——— “এই, আপনি কি তবে আমার সঙ্গে কেবলই মজা করছিলেন?”
মুগ্ধ ঠোঁট কামড়ে তার হাসিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলো। আঁখির দিকে প্রবল দৃষ্টিতে ঝুঁকে সিংহের গর্জনের মতো কণ্ঠে বলে উঠলো,
——— “শশশ! সম্মান দিতে শিখো! আমার সামনে এমন অসংযত আচরণ বরদাস্ত করবো না। সোজা দাঁত ভাঙবো!”
আঁখি বিষণ্ণ মুখে দৃষ্টিপাত ফেরালো অন্যত্র। একটু আগে আল্লাহর নাম স্মরণ করে ভয়াভিভূত হয়েছিল যে, তার মৃত্যুদণ্ড আসন্ন। অথচ এই ব্যক্তি ঠাট্টা করেছে তার সেই ভীতির ক্ষণে? কী অসভ্যতা!
কিন্তু মুগ্ধ আঁখির দুই বাহু আলতোভাবে ধরলো পুনরায়, সেই কঠোরতার স্পর্শ সেখানে নেই। তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এক ভ্রূ উঠিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
——— “তাদের সতর্ক করো! অন্যথায়, তারা তোমার আগেই মৃ'ত্যুবরণ করবে। তুমি বুঝেছো তো?”
আঁখি তার ক্ষুব্ধতা দিয়ে মুগ্ধর বলিষ্ঠ দেহে দমকা আঘাত হেনে সরিয়ে দিতে চাইল, কিন্তু মুগ্ধের কঠিন কাঠামো সামান্যতমও বিচলিত হলো না। বরং প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়ায় মুগ্ধ তাকে আরও কঠিন ও নির্ধারিত ভাবে চেপে আবদ্ধ করলো, যদিও সেই স্পর্শের মধ্যে কোনো কঠোরতা ছিল না—ছিল অভিজাত শাসনের শীতলতা। আঁখি দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল,
——— “এই, আমাকে ছেড়ে দিন! আপনার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি! ছেড়ে দিন!”
মুগ্ধ আজ যেনো বেহুঁশ পাগল; অন্ধ উন্মত্ততায় আকীর্ণ তার মন। আঁখির কানের কাছে সে ঠোঁট এনে চাপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
——— “স্পর্ধা দেখাচ্ছি না, আমার কথার গভীরতা বোঝো। আমি কেবল সতর্ক করছি, কাঁদার সুযোগও পাবে না, তোমার প্রাণবায়ু উড়ে যাবে তার আগেই!”
আঁখি অগ্নিগর্ভ কণ্ঠে প্রত্যুত্তরে বলল,
——— “আমাকে ছেড়ে কথা বলুন! এর পরিণাম শুভ হবে না!”
——— “তুচ্ছ চুনোপুঁটি কি তোমার ভাষ্যমতে ষাড়ের সাথে পেরে উঠবে?”
আঁখি নিশ্চুপ। বিরক্ত হয়ে গিয়েছে সে! মুগ্ধর দৃষ্টির গভীরতা আঁখির দিকে তীব্র নিক্ষিপ্ত হলো। গম্ভীর অথচ শীতল গলায় সে বলল,
——— “কখনো কারও সামনে নত হইনি, মেয়ে। অথচ তোমার সামনে বারবার নত হতে বাধ্য হচ্ছি! বোঝো?”
আঁখি নির্ভীক দৃষ্টিতে তির্যক কন্ঠে জবাব দিলো,
——— “তাহলে আপনার পা নিজেই কেটে ফেলুন! এভাবে উঁচু হয়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন কী আপনার? আমার সামনে এই রকম দৃঢ়তা দেখাচ্ছেন কেন?”
মুগ্ধ নিবিষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে রইলো আঁখির ক্রুদ্ধ শ্যামল মুখাবয়বের দিকে, যেখানে ক্রোধের অগ্নিময় দীপ্তি জ্বলছে! মনে মনে মুগ্ধ মৃদু হাসি চাপল এবং বলল,
——— “একবার আগুনে দগ্ধ করে শান্তি পাওনি? যদি সেটা তুমি না করে তোমার আদেশেই অন্য কেও করতো, তবুও তোমাকে ক্ষমা করতে পারতাম!”
পুরোনো স্মৃতিমালা মাথায় নাড়া দিতেই তীব্র ক্রোধে মুগ্ধর মাথায় অনল চেপে বসলো! সে আঁখিকে ছেড়ে দিয়ে দৃঢ়তায় সোজা হয়ে দাঁড়ালো, কঠোর অথচ শান্ত কণ্ঠে বলল,
——— “তোমার সাথে আমার এই জিজ্ঞাসাবাদ এইখানেই সমাপ্ত হলো।”
আঁখি ডেবডেবে নয়নে স্থির দৃষ্টিপাত করলো! এ কেমন অদ্ভুত ধাঁচের জিজ্ঞাসাবাদ! মুগ্ধ উলটো দিকে ঘুরে আরেক পা বাড়ানোর আগেই আঁখির কণ্ঠ ছিন্ন করলো নৈঃশব্দ্য! মুগ্ধ বিরক্ত দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকালো, আঁখির ঠোঁটের কোণে রহস্যময় এক বাঁকা হাসি।
——— "আপনি যতিচিহ্নহীন নির্বোধ প্রশ্নে সময় অপচয় করলেন, নিন, এবার আমি একটি প্রশ্ন করি!
আঁখি দুই হাতে সম্বরণ করল তার অবস্থান, মুখে অবিনাশী হাসি রেখে বলল,
——— "সিআইডিতে আপনার এই ছদ্মবেশ ধারণের কৌশল আপনাকে কে শিখিয়েছে??"
মুগ্ধর চোয়ালে শক্তির সংরাগ ছায়া ফেললো। আঁখি হেসে উঠলো, বলল,
——— "একথা মানতেই হবে যথার্থ, কিন্তু বুদ্ধিটা প্রখর!"
মুগ্ধ আর একটি শব্দও উচ্চারণ করলো না! গতি বাড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রবল হাতে দরজাটি খোলে দিলো।
--Email
সেদিনের পর আরও সাতাশটি দিন পেরিয়ে গেছে, দৃষ্টির নিমেষে ব্যস্ত সময়ের বৃত্তান্ত হয়েছে ক্ষণকালেই। কালো রাত্রির গভীর কোল ঘিরে এমন এক রহস্যময় পরিবেশ, নিস্তব্ধতা আর সুনসান গা ছমছমে আওয়াজে ভারাক্রান্ত। অর্ধবয়সী এক নারী, জড়ানো কালো মসৃণ চাঁদরে, শীতল রাত্রির স্নিগ্ধ বাতাসে হাঁটছে নিঃশব্দে। চারপাশ থেকে ভয়াল রাতজাগা প্রাণীদের বিকৃত চিৎকার আসছে, গা শিরশির করানো ভৌতিক মর্মস্পর্শী শব্দ কিছু ভেতর থেকে দম বন্ধ করে রাখে।
অন্ধকারের গাঢ় নিঃস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে সেই নারী হেঁটে যাচ্ছে অজানা অভিসারে। ঝোপঝাড়ের গাঢ় অন্ধকারে এগিয়ে যায় সে। শরীরে ঠাণ্ডা বাতাসের দোলা, তবু তা তার খেয়াল এড়িয়েছে। পৌঁছুল এক নির্দিষ্ট স্থানে; দাঁড়িয়ে গেলো সে, তার চাহনিতে নির্ঘোষিত ধ্বংসের গূঢ় সংকল্প।
সামনে তখন দাঁড়িয়ে কুদ্দুস আলী, অমীমাংসিত অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি হয়ে। রিতুর ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসির ঝিলিক, তীব্র রহস্যময়তা জড়িয়ে রেখেছে যেন। কুদ্দুস আলী হাসিমুখে এগিয়ে এলো; অতল গহ্বরের প্রান্তে দাঁড়ানো দুই আত্মা, চিরন্তন রহস্যের গভীর অন্তরাল হতে আহ্বান জানাচ্ছে বিপদকে।
0 Comments