Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৪২

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
হেমন্তের করুণাময় স্পর্শ সীমানা ছুঁয়ে শীতের আগমনী সংকেত প্রচার করছে! কনকনে হিমেল বায়ুর তীক্ষ্ণ কামড়ে দেহে প্রকম্পন জাগে, শিরা-উপশিরায় শীতলতার স্রোত বহমান। উত্তরবঙ্গের প্রান্তরে এই শৈত্য প্রবাহ যেন কয়েকগুণ তীব্র, রুদ্র প্রকৃতির প্রতিফলন। এই বর্ষপূর্তির ঋতুতে ধানের শীষে সোনালী আবরণ জাগ্রত, যেন মহাকালের দান। ব্যাবসায়ীদের জন্য এ কালের আহ্বান, সময়ের বহমান প্রবাহে সঞ্চয়ের উষ্ণতা খুঁজে নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ!
কিন্তু শিকদার বাড়ির ব্যবসার আকাশে লাল সংকেত উঁকি দিচ্ছে! ধান তো বটেই, তাদের প্রতিটি বাণিজ্যেই নেমে এসেছে মন্দার অশনি-সংকেত! সিআইডির কঠোর অভিযানের পর তাদের অবৈধ কারবার চূড়ান্তভাবে স্তব্ধ হয়ে গেছে। এরা দেশের ফসল, সবজি, মাছ, গবাদি পশু থেকে শুরু করে সকল সম্পদ পার্শ্ববর্তী দেশ সহ নানা দেশে উচ্চ মূল্যে পাচার করত, অথচ এই মাটি থেকে উৎপন্ন সম্পদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করত কৃষক, জেলে, ও শ্রমজীবী মানুষদের! সরল শ্রমিকরা তাদের মধুর কথায় মুগ্ধ হয়ে ন্যায্য অধিকারটুকুও দাবি করতে ভুলে যায়, যেন তারা কেবল শোষণের করুণ নাটকের নীরব চরিত্র!
সিআইডির কঠোর অভিযানে শিকদার বাড়ির ব্যবসার দুয়ারে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, সতর্কবার্তার খড়গও ঝুলছে শিরে! তাদের স্পষ্ট হুমকি—এ হীন কর্ম পুনরায় সংঘটিত হলে শিকদারদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। দেশের জনসাধারণের মৌলিক আহারের প্রয়োজন মেটানোর আগে অন্য দেশে রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রার লোভে পা বাড়ানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ!
ব্যবসার ক্রান্তিকালে আজগর আলীর মস্তিষ্ক চিন্তার তীক্ষ্ণ শূলবিদ্ধে বিদীর্ণপ্রায়! আজ তার হৃদয়ের অন্তর্গূঢ়ে বড় ভাই ইকরাম আলীর স্মৃতির প্রতিচ্ছায়া ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। ইকরাম আলী বেঁচে থাকলে হয়তো সিআইডির নাকের ডগা দিয়েই এই ব্যবসার গুপ্ত খেলা নির্বিঘ্নে চলত। তার নিষ্ঠুর বুদ্ধির পাকে শাসকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও যেন স্তিমিত হয়ে যেত। যদিও ইকরাম আলীর মৃ'ত্যুর অশুভ কাঁটাতারে একপ্রকার নির্মম শান্তি পেয়েছিল আজগর, তথাপি আজ এই ব্যর্থতার ক্রান্তিলগ্নে সেই হারানো সাহসের প্রতিমূর্তির জন্য মনের গভীরে এক অমোচনীয় শূন্যতা অনুভব করছে!
শিকদার বাড়ির বাণিজ্য কি কেবল এই সীমারেখার মধ্যেই অবরুদ্ধ? বহির্বিশ্ব হতে সামান্য মূল্যে আমদানি করা রত্নরাজি হোক কিংবা মূল্যবান ধাতু, কিংবা অযত্নে ফেলে রাখা যান্ত্রিক সওদা; গাড়ি ও মোটরবাইক—তাদের কূটকৌশলে সজ্জিত বিপণনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে সেগুলির বর্ধিত মূল্যায়নে বিপণন কার্য সম্পাদিত হয়েছে। এছাড়াও, চাঁদাবাজির ভয়ঙ্কর চক্র তো পূর্বাপর চলমান ছিল। কিন্তু সিআইডি বাহিনীর অনুসন্ধিৎসু শৃগালগুলো লালবাতি প্রজ্জ্বলিত করে সেই সকল অধর্মের কীর্তি স্থগিত করেছে, ব্যবসার পথকে নিষিদ্ধ সংকেতে আবদ্ধ করেছে। বহির্বিশ্বের অসংখ্য সমৃদ্ধ ক্লায়েন্ট হারাতে হয়েছে, আর দেশের অমূল্য সম্পদ রপ্তানির সুযোগও অপমৃত্যু পেয়েছে। এখন সবকিছুতে জ্বলজ্বলে লাল সংকেত, আর আজগর আলীর ক্রোধ ফুটন্ত অগ্নিতরঙ্গের মতো উৎক্ষিপ্ত হয়ে প্রজ্বলিত হচ্ছে। কখনও কি আজগর আলী এসব ধ্বংসাবশেষকে ধারণ করেছে? ইকরাম আলীই তো সব সুনিপুণ কৌশলে সামলেছেন। আজ, সর্বস্ব হারিয়ে আজগর আলী অনুধাবন করেছেন তাঁর ভাইয়ের মর্মার্থ, তাঁর প্রবল বুদ্ধিমত্তা ও নিষ্ঠুর কৌশল কতখানি প্রবল ছিল। নিঃসন্দেহে এর কোনো প্রমাণের অভাব নেই, কারণ যৌবনকালেই তাঁর নির্মম প্রতিভার প্রখর উদাহরণ পেয়েছিলেন তিনি।
তবে এসব তো নিতান্তই সামান্য, তুচ্ছ ব্যাপারমাত্র! এর অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে এক অতি গুপ্ত, আরও বৃহৎ ও কদর্য বাণিজ্য, যেটি এখনো সিআইডির সেই শঠ তীক্ষ্ম মুগ্ধ, রুদ্র এবং মহুয়ার তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানেও অধরা রয়ে গেছে। তবে এতদূর পর্যন্ত তারা যখন পৌঁছেছে, তখন সেই গুপ্ত বাণিজ্যের গূঢ় রহস্য উন্মোচনে পৌঁছাতে আর কতক্ষণ! গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তাঁর বুক থেকে। হুট করেই রাজ্যের ভার কাঁধে এসে পড়েছে, আর সেই ভারে যেন আজ তিনি অবনত, ক্লান্ত।
এসব উদ্ভ্রান্ত কল্পনার মধ্যে আকস্মিকভাবে ফোনটি বেজে উঠল আজগর আলীর কর্কশ বাস্তবতায়। ফোনটি তুলে ধরতেই প্রতিধ্বনিত হলো এক অপ্রীতিকর বার্তা,
——— "স্যার! আমেরিকার যে ক্লায়েন্ট ছিলেন, তারা চুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন! অপেক্ষার সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা আর অধিক প্রতীক্ষা করতে নারাজ!"
এই সংবাদ শুনে আজগর আলীর ক্রোধ যেন মুহূর্তে উন্মত্ত অগ্নিবলয়ের মতো প্রজ্জ্বলিত হলো! প্রচণ্ড উষ্মায় তিনি ফোনটি আছড়ে ফেললেন মেঝেতে, যা আঘাতে দুই খণ্ডে বিদীর্ণ হলো। ক্রুদ্ধ মস্তিষ্কের তীব্র উত্তাপ তাঁকে গ্রাস করল, দৃষ্টির সম্মুখে রক্তিম ক্ষোভের তরঙ্গ বহমান। অবশেষে ক্লান্তি তাঁকে শয্যায় সোপান করল, আর তিনি দেহ এলিয়ে দিয়ে ক্রোধে অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলন্ত মাথাটি নিস্তরঙ্গ রোষে দগ্ধ হতে থাকল।
ঠিক তখনই কানে ভেসে এলো বাইরে থেকে প্রবল কোলাহল! আজগর আলীর রাগ যেন আরও চড়চড় করে বাড়তে লাগল। লুঙ্গির ভাঁজ আঁকড়ে ধরে তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দ্রুত পদক্ষেপে এগোলেন। একসময়ের প্যান্ট-শার্টে সাজানো-গোছানো, জৌলুসময় আজগর আর নেই—গৃহে তিনি এখন একেবারে অকৃত্রিম বাঙালির সাজে, লুঙ্গি আর সাধারণ গেঞ্জি পরিহিত। মনের অবস্থা যখন বিষাদে নিমজ্জিত, তখন সে চাকচিক্য আর গৌরব কোথায়! এ যেন ক্রুদ্ধ সিংহ, যার গাত্রে অভিজাততার কোনো চিহ্ন নেই, শুধু তীব্র ক্রোধ আর রোষানলের প্রতিফলন।
ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই দৃশ্যপটটি যেন ক্রোধের মশালে ঘি ঢেলে দিল আজগর আলীর রাগের আগুনে। মুগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে চোয়াল শক্ত করে, গভীর প্রতিজ্ঞায় পকেটে হাত গুঁজে। তার পাশেই রুদ্র, একই দৃঢ়তা আর অবিচল মুখাবয়ব নিয়ে, যেন পাষাণের অবয়ব। মহুয়া, সেই দুর্দমনীয় নারী, লেডিস প্যান্টের পকেটে হাত রেখে কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে, কঠোর প্রতীক্ষায়। আজগর আলীর বুকের ভেতর ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা আরও প্রজ্বলিত হলো। এই সিআইডির শ'ত্রুরা! এই শঠ কু'কু'রগুলোর জন্যই তো তাদের সকল পরিকল্পনা, সকল বাণিজ্য লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। প্রতিটি মুহূর্ত এদের মুখ দেখতে দেখতে তিক্ততায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সবার মন! উফফ, যেন শাপে বর হয়ে এসেছে এই দুর্ভাগ্যগুলো।
________________
—— ❝ব্যথা কি বুঝতে পারো? শরীরের উপর শাস্তি প্রাপ্ত হলে কি ব্যথার সীমা শুধুমাত্র ত্বক বিদীর্ণের যন্ত্রণায় অবস্থিত থাকে? কখনো কখনো বচনের প্রখরতা হৃদপিণ্ডে এমন ক্ষত সৃষ্ট করে, যা এক প্রকার সূক্ষ্ম যন্ত্রণা, অবর্ণনীয়, অকথ্য। অঙ্গের ঘা সলিলা, মলম কিংবা ঔষধে সান্ত্বনা পায়। সে ক্ষত অমোচনীয় হলে মৃ'ত্যুই মুক্তি। কিন্তু মর্মভেদী বিদারকের জ্বালা? সেই ক্ষোভের অম্ল তৃষ্ণা কার ঔষধে শমিত হবে? তার কোনো পরিচর্যা নেই, কোনো মুক্তি নেই। এটি বাড়ে, নিরন্তর বি'ষময় অশ্রুপাতের মত। অথচ কেও প্রাণত্যাগ করে মুক্তি পায় না, বরং জীবন্ত শবের মতো অতীতের দীর্ঘশ্বাসে বেঁচে থাকে। তুমি আমার সেই ঔষধ, যা চিরজীবনধারণের প্রয়োজন। কোনো অনুতাপ নেই! আমি চেতনাহীন ব্যথার ভার বহিব। কিন্তু ঐ অমৃত কেবল একারই জন্য বরাদ্দ। আমি সেই রোগাক্রান্ত প্রাণী—কেবল আমি। অন্য কেউ নয়। বুঝলে? অসভ্য অবিবেচক প্রণীতা?❞
হিমেল প্রভাতের শীতল হাওয়ায় শালবৃত আঁখি পদচারণে লিপ্ত, হাতে ধরা সেই চিঠি, সপ্তমবার নয়; শত'তমবারেরও অধিক পঠিত হয়ত! যুগের ধারায় বদলেছে অনেক কিছুই; দিন, সময়, রূপান্তরিত হয়েছে মানুষের মনন। তবে একটি বিষয় আজও অবিচল; সেই অজ্ঞাত পুরুষটির বার্তা। পূর্বে শুধুই স্নেহময় ও প্রেমবিহ্বল বাণী প্রেরিত হতো, এখন সে বার্তায় ক্রমশই যুক্ত হয়েছে অভিমান ও ক্রো'ধের প্রগাঢ় ছাপ। যেদিন তার হৃদয়ে ক্ষোভ ও বিরক্তির ঝড় ওঠে, সেদিন উপহার মেলে না; নিরবতা রাখে সে। কিন্তু যেদিন ভালোবাসা জাগে, সেদিন চিঠির সাথে আসে ক্ষুদ্র, অপরূপ সামান্য উপহার; আঁখির শৈল্পিক ড্রয়ার উপহার ও চিঠিতে পূর্ণ। তার আলমারির একাংশও পূর্ণ সেই দুর্লভ স্মারকপূঞ্জে। সপ্তাহের এক বিশেষ দিবস, বৃহস্পতি—সেদিনই সেই অদৃশ্য পরমাত্মা প্রেরণ করে তার অনুভবগাথা, প্রতিটি শব্দে রহস্যময় অনুরাগ জড়িয়ে।
কিভাবে সেই চিঠিগুলি আঁখির হাতে পৌঁছে যায়, সে এক রহস্য! অজ্ঞাত সেই প্রেরক কোন দূর অজানায় বসে কি পুরনো দিনের কবুতর অথবা কারও নিয়োগে প্রেরণ করে? সময়ের স্রোতে তার সাহস এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধ অথবা শিশুর হাত ধরে আসে সেই বার্তা, তারা আসন্ন হয় মূক, বধির অথবা অন্ধের বেশে, সরলতার আবরণে ঢাকা; এদের প্রতিটি ভিন্ন, এদের কারও চোখে নেই দৃষ্টি, কারও মুখে নেই ভাষা, কারও কানে পৌঁছায় না পৃথিবীর শব্দ। আঁখি ভেবে পায় না, কোথায় পায় এদের? এ কি ভাড়াটে বার্তাবাহক, না কোন চিরন্তন প্রেরণার অপূর্ব সন্ধান?
প্রতি বৃহস্পতির প্রভাত আঁখির প্রত্যাশায় জাগ্রত হয়, পুকুরপারের সেই নির্জন একাকী মোহনায় তার জন্য বরাদ্দ একান্ত প্রহর, যেখানে চির অজানা সেই পরমাত্মার মুগ্ধ বার্তা এসে তার স্পর্শে অমৃত হয়ে মিশে যায়, প্রতিটি শব্দে লুকিয়ে থাকে এক গভীর, রহস্যময় প্রেমের আহ্বান।
কেন যে আঁখি এই রহস্যময় চিঠিগুলি গ্রহণ করে, তার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ সে জানে না। দুর্বলতা নয়, বরং কেবল একবার চোখে দেখার আকাঙ্ক্ষা; দেখতে চায় সেই অজ্ঞাত কাব্যরাজকে, যার হৃদয়স্পর্শী শব্দে আবৃত প্রতিটি বাণী তার অন্তরে গভীর রেশ রেখে যায়। তবে আগের সেই উদ্দাম তাড়না আর নেই; যে নিজ থেকে প্রকাশিত হতে চায় না, তাকে আর কীভাবে স্পর্শ করবে আঁখি?
আঁখির মনে আছিয়ার গোপনে দেওয়া চিঠির স্মৃতি ভেসে আসলেও তা চেপে রাখা সহজ হয়নি। সন্দেহের দানা উঠেছিল মুগ্ধর প্রতি, যদিও মন তৎক্ষণাৎ বিদ্রুপ করে উঠেছিল—মুগ্ধর কী এতই সময় যে চিঠি আদান-প্রদান করবে! তাও আবার তার মতন এমন কঠোর নির্দয় পুরুষ? যে সবসময় আঁখি কে অপদস্ত করার চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে থাকে! তবুও মনে মেঘের মতো ছায়া পড়ে, নিজস্ব এক অপূর্ণ হাসি ভাঁজে লুকিয়ে রেখে আঁখি মুগ্ধর হাতের লেখা মিলিয়ে দেখার ফাঁদ পেতেছিল। শেষ অবধি, কোনো যোগসূত্র মেলেনি; চিঠির লেখার সাথে তার হাতের লেখার এক চুলও মিল ছিল না।
আছিয়াকে আর লুকিয়ে চিঠি পৌঁছে দিতে হয় না; সে নিজেই পুকুর পাড়ে অপেক্ষায় থাকে, যেমন এক দীর্ঘশ্বাস অপেক্ষায় থাকে তার অপরিহার্য পরিণতির জন্য।
এখন সে অপেক্ষারত, এক নীরব প্রত্যাশার অবগাহনে নিমগ্ন; যে দিন সেই অজ্ঞাত পুরুষ, সে নিঃশব্দের কবি, নিজে এসে প্রকাশিত হবে! এখন প্রতি বৃহস্পতি একা আসে আঁখি সেই পুকুরপারের নির্জন কোণে। চার বান্ধবীর সমবেত পদচারণা আজ বিরল; একে একে তারা যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে জীবন থেকে, একজন পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি দিয়েছে, আরেকজন বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গৃহস্থ জীবন ধারণ করেছে, আর তৃতীয়জন, সে যেন জীবিত থেকেও অস্তিত্বহীন এক প্রতিচ্ছবি মাত্র।
হ্যাঁ, আছিয়ার কথাই হচ্ছে। সেই নির্জলা ভালোবাসায় ডুবন্ত কিশোরীটি, যে ভালোবাসার সুধা বিলায়ে নিজেই ক্রমে নিঃশেষিত হচ্ছে। হৃদয়ের গভীর একান্ত বাসনায় জ্বলে-পুড়ে ম'রে, অথচ সেই পাষাণ পুরুষটির চোখে সে যেন কেবল ছায়ামাত্র। আঁখির বুকের ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস অগোচরে বেরিয়ে এলো—সে কি তবে এতটুকুও বুঝতে পারে না নিজের প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর এই অসহনীয় কষ্ট? সেই তেজী, সাহসী, রাগী মেয়েটা আজ কেমন করে যেন নিজেকে সঙ্কুচিত করে তুলেছে; মিথ্যে এক মুখোশে আড়াল করে ভালো থাকার ভান করে। আছিয়া কিছুই বলে না আঁখিকে, নিঃশব্দে চেপে রেখে যায় নিজের যন্ত্রণার অতল গহ্বর। আঁখি জানে, তবু জেনেও অজানা, থেকে যায় যেন এক অজ্ঞানের মোড়কে আবৃত!
কিন্তু আজকের এই পথযাত্রা, এই শীতল প্রভাতের পদচারণা—এই কেবল আছিয়ার জন্য। একটু পরেই মেইন রোডে পৌঁছে যাবে সে; আছিয়ার জন্য এই সূচনালগ্নে বেরিয়েছে ঘর থেকে। সাথেই সেই চিঠি, যে চিঠির শব্দে একান্ত সঙ্গ খুঁজে পায় আঁখি, একাকীত্বের অবসরে। তবে আজ, আঁখির মনে জমে থাকা কিছু হিসেব রয়েছে, এক ব্যক্তির সাথে গোপনে করা এক গোপন কারবার।
অবশেষে আঁখি পৌঁছালো মূলপথে। সেখানে দ্রুতগামী যানবাহনের শাঁই শাঁই শব্দে ধূলিকণা উড়ছে, যেন ঠান্ডা হাওয়ার তীব্রতায় সেই ধুলোবালি অমোঘ বিস্তৃত হচ্ছে। কনকনে শীতে প্রহরকে যথার্থ রেখেই পৌঁছেছে সে; মোবাইলের পর্দায় একবার সময় দেখে আশ্বস্ত হলো, দেরি হয়নি তার। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করছে সে, অপেক্ষিত ব্যক্তিটির জন্য। সে জানে, এই পথ ধরেই, এই নির্ধারিত সময়ে সে লোকটি যাবে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আচমকা দৃষ্টিতে পড়ল সেই ব্যক্তিটি; রাস্তার ধারে নিঃসাড় দাঁড়িয়ে। আঁখি নিঃশব্দে এক দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। শ্বাসের প্রতিটি গ্রহণ হিম বায়ুর গভীরে ঢুকে তার সমস্ত অস্তিত্বে বরফের মতো শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে; কিন্তু সেসবে মগ্ন হওয়ার অবকাশ নেই তার।
কাছেই দাঁড়িয়ে সেই পুরুষ, সামনের গাড়ির অপেক্ষায় স্থির। তখনই আঁখি দৃপ্ত কণ্ঠে পেছন থেকে তাকে সম্বোধন করে,
——— “ভাইয়া! শুনুন!”
জীবন দাঁড়িয়ে গাঢ় ধূসর শীতপোষাক লং কোটে, দু’হাত পকেটে গুঁজে। হঠাৎ এক নারীকণ্ঠের সুর শুনে ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকালো। দৃষ্টিতে আঁখির অবয়ব ধরা পড়তেই চোখ বিস্ময়ে প্রশস্ত হলো, আঁখি এখানে? কেন ডাকছে তাকে? মুহূর্তটিতে চারপাশের দৃশ্যাবলী স্তব্ধ হয়ে গেলো, মনের অলিন্দে এক তীব্র সংশয় দানা বাঁধতে লাগল।
তবে আঁখি বিন্দুমাত্র সংকোচ না করে গভীর নিঃশ্বাসে সামনে এগিয়ে এল, কণ্ঠে প্রত্যয় আর কঠিন সংযমের মিশ্রণে সোজাসাপটা উচ্চারণ করল,
——— “আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, একটু সময় দিতে পারবেন?”
জীবন একটুখানি গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
——— "বলো, কি বলতে চাও?"
তাতেই আঁখির মুখে এক ক্ষণিক উজ্জ্বলতার আভা খেলে গেলো। সে সংক্ষিপ্তভাবে বলল,
——— "একটু সাইডে আসুন!"
সেই অনুরোধ করেই আঁখি রাস্তার পাশ থেকে সরে গিয়ে চায়ের দোকানের নিকটবর্তী স্থানে দাঁড়ালো। জীবনের বিস্ময় যেন ক্রমেই গভীর হলো; মনে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে—কেনই বা তার সাথে আঁখির এমন একান্ত কথা বলার প্রয়োজন? আঁখির অদ্ভুত এই ব্যবহারে জীবন এক মুহূর্তের জন্য অবাক-বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তার দৃষ্টি আঁখির প্রত্যেক গতিবিধির উপর নিবদ্ধ।
অত:পর জীবন ধীরে ধীরে আঁখির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
——— "হুম, বলো।"
আঁখি এক মুহূর্ত থেমে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, নিজেকে সৃষ্ট শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছে। আর তারপর গভীর নিঃশ্বাসে সরাসরি কথাটা বলেই দিল, কোনো আড়ম্বর ছাড়াই,
——— "মেয়েটা ম'রে যাচ্ছে!"
জীবন মুহূর্তেই হতবাক হয়ে আঁখির দিকে তাকালো, কণ্ঠে বিস্ময়ের কম্পন,
——— "কে??"
আঁখি শীতল দৃষ্টিতে জীবনের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বলল,
——— "আপনি জানেন আমি কার কথা বলছি।"
জীবনের মুখের কঠোরতা কিছুক্ষণ স্থির রইল, তারপর সে একটি মলিন হাসি হাসল—হাসি, যা দুঃখে আচ্ছন্ন। আঁখি সেই দুর্বিনীত হাসির চোরাস্রোত দেখল, এক মুহূর্তে তার সমস্ত অনুভূতি পাঠ করতে সক্ষম হলো। আঁখি নীরবে বলল,
——— "নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন, আর তাকেও কষ্ট দিচ্ছেন।"
জীবনের মুখের রেখাগুলো যেন আরও গভীর হলো, আর কিছুক্ষণ নিরব থেকে মনে মনে সে ভেবে গেল, এই নিষ্ঠুরতার দায়ভার আসলে কার? জীবন গভীরভাবে চোখ মুঠে বলল,
——— "তাকে সুরক্ষিত রাখার তাগিদেই এই দূরত্ব... সে তো অনেক ছোট! আজ যা তাকে উদ্দীপ্ত করে, তা তো কেবল বয়সের আবেগ। একদিন, যখন সে পরিপক্বতায় পৌঁছাবে, জীবনের আস্বাদ গ্রহণ করবে, এইসব স্মৃতির দিকে ফিরে তাকিয়ে কেবলই হাসবে! এ সময়টাই তো এমন—অস্থির ও রঙ্গিন। সে যদি পাগলামি করে, আমারও কি তাতে সঙ্গ দেওয়া সাজে? আমি তো বড়! আমাকে মাটির মতো স্থির থাকতে হবে।"
আঁখি বিষণ্ণ নিঃশ্বাস ছেড়ে গভীর কণ্ঠে প্রতিউত্তরে বলল,
——— "তার বয়স কম বলেই তার অনুভূতির গভীরতাকে আপনি হালকা আবেগ বলে উড়িয়ে দিতে পারেন না, ভাইয়া।"
জীবনের মুখে হালকা তিরস্কারের ছাপ ফুটে উঠল,
——— "সে জীবনের কঠিন অন্ধকার দেখেনি, আঁখি! সে বোঝে না, বাস্তবতার কপাট কতটা নির্মমভাবে মানুষের স্বপ্ন চূর্ণ করে।"
আঁখি নির্বাক, কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। ভাবনাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু জীবনের কথা শুনে যেন আরো গভীর এক বোধে আটকে গেল।
জীবন মৃদু হেসে বলল,
——— "সে না বোঝা পর্যন্ত তার চোখের জল হয়েই আছি। তার হৃদয়ের স্বপ্নসাজা ভালোবাসায় নিজেকে সঁপে দিতে না পারলেও এইটুকু তৃপ্তি নিয়ে আছি।"
আঁখি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
——— "তবুও কি পারবেন না আপনার ভালোবাসার চাদরে তাকে আশ্রয় দিতে? তার ভেতরের তীব্র ঝড়গুলোকে একটু আপনার সহানুভূতিতে স্তিমিত করতে?"
জীবন চোখের পলক মেলল না, বলল,
——— "এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ভালোবাসা নয়, প্রয়োজন শক্তিমান অর্থের। সে বিলাসী জীবনের অভ্যস্ত। তার একদিনের খরচ, আমার পুরো মাসের পরিশ্রমের মূল্য। এই অভিজাত সংসার কিভাবে শুধুই আবেগের নিক্তিতে মাপো তুমি, আঁখি?"
আঁখি গভীরভাবে জীবনের দিকে তাকিয়ে বলল,
——— "ভালোবাসা তো আবেগেরই প্রবাহ, জীবনের নিয়তিকে মিশিয়ে। তাকে আমি সত্যি ভালোবাসি, তাই আমার অন্তরে এই আবেগ কাজ করছে! জানেন, সে নিজেকে আপনার জন্য নিজেকে বদলাতেও প্রস্তুত। সে শুধু চায় একটু আপনাকে পাশে। আমি বলছি না সম্মতি দিতে, শুধু একটি সুযোগ দিন। এই মুহূর্তে আপনার সামান্য করুণাই তার বাঁচার অবলম্বন। সে যেন ঝরে না যায় আপনার এতোদিনের ত্যাগের কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে। আপনি নিজেই বললেন সে আবেগপ্রবণ, অথচ আপনি তাকে ঠেলে দিচ্ছেন শূন্যতায়। যদি তার আবেগ তাকে দুঃখের তীব্রতায় ডুবিয়ে দেয়, তখন কি তার ভার আপনি নিতে প্রস্তুত?"
জীবনের চোখে প্রগাঢ় বিষণ্ণতা ভেসে উঠল; নিঃশব্দে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আঁখির কথাগুলো তার আত্মার গহীনে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। জীবন আর একটিও বাক্য উচ্চারণ করল না। তার বুকের ভেতরে প্রলয়ের ঘূর্ণিঝড়। নিস্তব্ধতায় ভরে ওঠা অস্তিত্বের কোনো অশ্রুত হাহাকার মর্মে মর্মে বিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। রক্তাভ নয়নে গভীর যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। আঁখি হয়তো বুঝতে পেরেই মুখ খুলল,
——— "আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কিছু বলি নি। কিন্তু আপনারা দুজনেই দু প্রান্তে কষ্টে ডুবে আছেন; এরই বা অর্থ কী হয়, বলুন? আমার কথায় ব্যথিত হবেন না।"
জীবন একটি মৃদু হাসি হাসল, যার অর্থবহতা অকথ্য। শান্তভাবে বলল,
———" তুমি নিজেও জানো, তাকে ফিরিয়ে দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবুও তুমি এসেছো, শুধুমাত্র তোমার প্রিয় বান্ধবীর বিষাদ সহ্য করতে না পেরে। নতুবা যার হৃদয়ে আবেগ নেই, সে আমার কাছে এসে আবেগের প্রতিধ্বনি তুলবে কেন?"
আঁখি স্তব্ধ নীরব হয়ে রইল। জীবনের কাছে এ কথা সে প্রত্যাশা করে নি। জীবন এ কথা কিভাবে জানে? তার সাথে তো এই প্রথম কথোপকথন হচ্ছে তার! জীবন আরও একবার হেসে, স্নেহের পরশে আঁখির মাথায় হাত রেখে বলল,
——— "বড় হও! তাকে দেখে রেখো! আমার অনুভূতি কখনো তার সামনে তুলে ধরো না! অনুরোধ রইল!"
আর এক মুহুর্ত রইল না, জীবন দ্রুত পদক্ষেপে সেখান থেকে প্রস্থান করল, যেন কোনো অলিখিত অঙ্গীকারের ভারমুক্ত হলো। আঁখির চোখের কোণে অনুচ্চারিত অশ্রু জমে উঠল। সত্যিই তো! সে নিজেই তো ভালোবাসার ভাবধারার বাইরে বহু দূরে অবস্থান করে! আর সেই ব্যক্তি এসেছে জীবনকে প্রেমের মর্মার্থ বোঝাতে!
__
জীবন অবনত চোখে টলোমলো পায়ে অজান্তেই একটি অটোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, দেহের সমস্ত ভার তাতে চাপিয়ে নিজের অস্তিত্বের একটি অশ্রান্ত হাহাকার মুছতে চায়। বুকের মাঝে প্রচণ্ড যন্ত্রণার হাহাকার তোলপাড় করছে—মনে হয় যেন হৃদয়ের সমস্ত শিরা উপশিরা এক কঠোর দণ্ড গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই নির্মম যন্ত্রণার তুলনায় আর কোনো শাস্তি আছে কি, যা ভালোবাসার মানুষকে অবহেলার পাপবোধকে নিস্তব্ধ করতে পারে?
জীবনের আয় এখন মন্দ নয়; সে যথেষ্ট স্বাবলম্বী, সম্মানিতও। বাবা-মা আর সে, তিনজন মিলে গড়ে তুলেছে মধ্যবিত্ত জীবনের শান্তিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি, যা নিম্নবিত্তের চিরচেনা সংগ্রাম থেকে উত্তীর্ণ। মা আগের চেয়ে সুস্থ, যদিও অতিরিক্ত যত্নে তাঁকে সযত্নে রাখতেই হয়। তাদের ছোট্ট সংসারে এখন নেই কোনো দুঃখের ছাপ; কেবল হাসি-খুশির সুরে সমৃদ্ধ প্রতিটি ক্ষণ—একটি নিঃশব্দ সান্ত্বনার ছায়ায় জুড়ে আছে তাদের জীবন। তবুও, সেই অমলিন সুখের মাঝে একটি অপূর্ণতার শূন্যতা জীবনকে এক অব্যক্ত বেদনাভারের দণ্ডে দণ্ডিত করছে।
কেননা জীবনের এ সামান্য আয়ের সীমাবদ্ধতা আছিয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং তা তার চাহিদার বিশাল সমুদ্রের ক্ষুদ্রতম ঢেউমাত্র। আছিয়া যে বিলাসব্যসনে অভ্যস্ত, যেখানে তার ইচ্ছাপূরণের মঞ্জুরিসূত্রে কোনো অবকাশ নেই, কোনো দ্বিধা নেই। যখন-তখন যা চেয়েছে, তা সাথে সাথে পাবার অভিপ্রায়ে বেড়ে ওঠা আছিয়ার হৃদয়ে জীবনের সীমাবদ্ধতা একদিন একটি গভীর আফসোসের আকৃতি ধারণ করবে। সময়ের স্রোতে এ আফসোস অনিবার্যভাবে বাড়তে থাকবে; ক্রমে ক্রমে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হবে, যখন জীবনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণের জন্যই আছিয়া তার নিজের ভুল স্বীকার করবে, বুঝবে এ যে কী বিপুল অনুতাপের সিদ্ধান্ত!
কিন্তু জীবনের হৃদয়ে আছিয়ার এমন অনুশোচনা চিরন্তন বিষাদের প্রতিধ্বনি হয়ে বাজবে না; তার অন্তরে নেই এমন কোনো পিপাসার আশ্রয়, যা তাকে তিক্ততায় ডুবিয়ে দেবে। সে জানে, অবারিত ভালোবাসার এক বিশাল আকাশ নিয়ে আছিয়াকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, কেবল যেন তাকে বেঁধে রাখতে না হয় এমন এক শৃঙ্খলে, যা একদিন আছিয়ার জন্য আক্ষেপের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠবে।
আর সেদিনের কঠোর তিরস্কারের কালে যে নিষ্ঠুর বাস্তবতার রূঢ় চিত্র আছিয়ার পিতা, সাজ্জাদ সাহেব তুলে ধরেছিলেন, তা তপ্ত লোহার মতো হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। জীবনের সম্মুখে সেই দিনের ঘটনা যেন এক দূর্ভেদ্য গ্লানি হয়ে ফিরে আসে বারংবার। মিলির বিবাহের জন্য কেনাকাটার দিনে আছিয়া নিজ শপিং মলের অপেক্ষমাণ চৌহদ্দিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় কাটিয়েছিল—কেউ কি এড়িয়ে যাবে? অবচেতনে জীবন আছিয়ার হাত ধরে তাকে প্রস্থান করতে বাধ্য করেছিল। অথচ এই বিরল মুহূর্তটি, সহকর্মীর ক্ষণিক দৃষ্টির প্রহরে ধরা পড়েছিল এবং সেই নিঃশ্বাসে বিষ ছিটিয়ে সাজ্জাদ সাহেবের কর্ণগোচর হয়েছিল।
রাতের অন্ধকারে সাজ্জাদ সাহেব যখন জীবনের সামনে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখ থেকে আগ্নেয়গিরির মতো একের পর এক অপমানের জ্বালা বের হতে থাকে। জীবনের প্রতি সেই আক্রোশ, সেই জ্বলন্ত শব্দ, ধুলিস্মাৎ করে দিতে চায় সমস্ত স্নেহের বাধন। জীবন তাঁর পিতামাতার প্রতি সেই নির্মম উক্তির প্রতিবাদে স্থির হয়ে থাকলেও, অন্তরের গভীরে তা বিধ্বস্ত হয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। পিতামাতার প্রতি এমন অনধিকার চর্চা, এমন মরীচিকার মতো তীব্র তিরস্কার জীবনকে আঘাত করে এমনভাবে, তার আত্মার স্তরে স্পর্শ করেছিল।
অপার্থিব ভালোবাসা, যা দূরত্বেই সীমাবদ্ধ থাকাই শ্রেয়—জীবন উপলব্ধি করে নেয় যে কখনো কখনো প্রিয়জনের কাছাকাছি আসা মানেই দুর্ভেদ্য যন্ত্রণার বাঁধনে আবদ্ধ হওয়া। সেই রাতে জীবনের চোখে অনন্ত আকাশের তারাদের মতো একান্ত প্রেমের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, যার শেষ গন্তব্য শুধুই নিরবতা, শুধুই নির্জনতা।
---
আঁখি ধীর, ভগ্ন মনের ভারে নত হয়ে, গৃহপথে পদচারণ করছে। শীতল বাতাসে তার ম্লান, শুষ্ক মুখে যেন কঠিনতার কর্কশতা বিরাজ করছে, ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে র'ক্ত বের হবে বুঝি, আর নাসারন্ধ্র থেকে নির্গত ক্ষুদ্র শীতল স্রোতে মলিনতাও ছায়ারূপে সঙ্গী হয়েছে। তবে এ সবকিছুর প্রতি তার দৃষ্টি নতজানু; অন্তর ভারাক্রান্ত, ভালোবাসার নির্মম পরিহাসে বিধ্বস্ত। সে কি জানে না, ভালোবাসা কিরূপে মানবহৃদয়কে পিষ্ট, ক্ষতবিক্ষত, নিঃশেষ করে? সখির এই আকুতি দেখে, ভালোবাসার বিষাক্ত কাঁটায় জর্জরিত অবস্থায় তার অস্তিত্ব ব্যর্থতায় নিমজ্জিত—কিছু করার সামর্থ্যহীন, যেন সে নিঃসীম নির্লিপ্ততায় হারিয়ে গিয়েছে।
গৃহদ্বারে পৌঁছাতেই দেখল সিআইডির গাড়ি, আর আচমকা কোলাহলের ঘূর্ণি আঘাতে আঁখি অভিভূত হলো। প্রবল আর্তনাদে কানিজ বেগমের ক্রন্দন যেন হৃদয়কে বিদীর্ণ করে। কণ্ঠের উন্মত্ত শীৎকারে আঁখির মনেও শঙ্কার ছায়া উদ্ভাসিত হলো। পায়ে দ্রুততা এনে অন্দরে প্রবেশ করল আঁখি, দৃশ্যটি দেখে যেন প্রলয়ঙ্করী বিস্ময়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ল সে। মুগ্ধ কঠোর হস্তে কুদ্দুস আলীর বস্ত্রের কলার ধরে পাষাণ নায়কের ন্যায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে—চেহারায় জ'ল্লাদের হিং'স্র আভা। রুদ্র ও মহুয়ার কঠিন মুখচ্ছবির নিস্তব্ধতা পরিস্থিতিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। গৃহের সকলেই যেন নির্বাক পাথরে রূপান্তরিত, এবং আলো প্রবল প্রকম্পনে ছটফট করছে। আঁখি ছুটে গিয়ে আলোর গাল স্পর্শ করে তীব্র কৌতূহলে জানতে চাইলো,
——— "কী হয়েছে আলো? তুই এমন করছিস কেন?"
তবে আলো নিরুদ্বেগ কণ্ঠে, কম্পমান চুল ধরে অশান্ত ভঙ্গিতে উত্তরে জানালো,
——— "মেজো আব্বু...মেজো আব্বু খ-খুন করেছে!"
নাঈম নিঃশব্দে বসে আছে। মুখে শূন্যতার ছাপ, কোন প্রতিক্রিয়ার চিহ্নমাত্র নেই। শান্ত তো নীরবে বাঁধা হেসে ফেলে রিক্ত ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে; সেই কুদ্দুস আলীর ভাগ্য এমনটাই নির্ধারিত ছিল। সময় তার যথাযথ বিচার করেছে। কুদ্দুস আলীর মুখে তিক্ত আকুতি,
——— "আমাকে ছেড়ে দাও! আমি কোনো খু'ন করিনি! আর ওই রিতু কেও কিছু করিনি!"
কিন্তু মুগ্ধ নীরব। ভ্রূক্ষেপহীন চাহনিতে তাকিয়ে তেজী কন্ঠে বলল,
——— "আপনি আমার পিতৃসম। চাইছি না সম্মুখে একটা আঘাত হানতে। ভালোয় ভালোয় চলুন। নইলে ভাষার যে বহর আপনার জানা আছে, তার মোক্ষম উত্তরে আমাকে আপনি চিনতেই পারবেন না।"
তারপর, হ্যান্ডকাফের শীতল ধাতব আঙুলে কুদ্দুস আলীর হাত আঁটিয়ে ধরা হলো, এমনভাবে যেন সে নিজের অস্তিত্বের প্রতিটি রন্ধ্রে পরাজয় মর্মে অনুভব করে। এই পরিণাম কুদ্দুস আলীর কল্পনার সীমায় ছিল না; জীবনের গোধূলিবেলায় এমন অসম্মানিত ও ধরাশায়ী হতে হবে, এমনটি তো কখনো ভাবেননি।
মহুয়ার কণ্ঠে রাগের প্রখরতা যেন বজ্রের মতো আছড়ে পড়ল কুদ্দুস আলীর দিকে। তার কড়া কথায় আবদ্ধ ন্যায়বিচারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা,
——— "ওই বৃদ্ধকে আপনি নির্ম'মভাবে হ'ত্যা করেছেন, এবং আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়ে রিতুকেও শেষ করতে চেয়েছিলেন! ভাগ্য সহায় ছিল, তাই আমরা সময়মতো এসে তাকে রক্ষা করতে পেরেছি। তবে এখনো সে মৃ'ত্যুর সাথে লড়ছে; জীবন আর মৃ'ত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে। কিন্তু শাস্তি? সেটি আপনি পাবেনই।
এই কথা শুনে আঁখি যেন এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল, মুখে শব্দের স্পন্দন হারিয়ে ফেলল।। ঠিক এমন সময় পাশে এসে চাপা অথচ তীব্র এক বিদ্রুপে শান্ত বলল,
———" কোথায় গিয়েছিলি এত সকালে? চেহারা শুকনো কেন? যা গিয়ে মুখ হাত ধু! শীতে সবসময় লোশন-মেরিল মাখতে হয় শরীরে, বুঝলি? যা, দেরি করিস না!"
আঁখি তাকালো শান্তর দিকে। শান্ত কুদ্দুস আলীর দিকে চেয়ে ঠোঁট কামরে হাসছে! সেই নরম হাসি, যেন চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার মনেই প্রবেশ করেনি। একদিকে বাড়িতে এত বড় কাণ্ড ঘটেছে, তবু যেন শান্তর হৃদয়ে কোন স্পর্শই ফেলেনি।
তারপর সব প্রতিরোধ ভেঙে মুগ্ধ, রুদ্র এবং মহুয়া দৃঢ় পায়ে কুদ্দুস আলীকে টেনে নিয়ে গেল। কুদ্দুস আলীর বহুদিনের গর্ব, অহংকার, সমাজে প্রতিষ্ঠিত মান—সব ধুলায় মিশে গেল এক নিমিষে। আজগর আলী সেই শুরুতে সোফায় বসেছিলেন; সেই বসাই থেকে আর উঠতে পারলেন না।



Post a Comment

0 Comments

Close Menu