Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ১১

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
*
*
--"রেওয়ামিলের অমীমাংসিত গণনার মতো তোমার কেশগুচ্ছের সহচর হতে চাই,
রূপসী তব অলকাবলীর বন্ধন হতে চাই,
রেশম সম কৃষ্ণ কেশের কোমল স্পর্শে প্রণয়ে হৃদয়কে আন্দোলিত করতে চাই,
তোমার দীর্ণ মসৃণ কেশের মত্তকর সুরভিতে সঙ্গীতিমগ্ন হয়ে প্রাণকে সঞ্জীবিত করে, নিজেও মাতাল হতে চাই।
যবে অগ্নিসাম্য তাপে কাতর, বাঁধিবে চিকুর তুমি,
তখন হইব তব সখা প্রিয়, নিকটে থাকিব আমি।
তোমার কেশের সাজে শিল্প-কাঠি হয়ে বুকের মাঝে আকরে ধরব,শীতল স্পর্শে জুড়াব তোমায়, দূর করিব তোমার তাপ। তব কেশপাশে থাকিব সদা, এই মোর অভিলাষ।
ইতি,
-তোমার নামহীন প্রেমিক "
নাঈম উঁচু স্বরে পড়ছিল, এরপর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আঁখির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আঁখি ধরা-পড়া চোরের ন্যায় হাত কচলাচ্ছে। নাঈম মজা করে চিৎকার করে বলল,
-" বইননন, তুই,,, তুই কোন কবির নাতির লগে প্রেম করস? আমার দাঁত অর্ধেক খুলে গেলো রে,, বুঝছি,, আবার নতুন করে বাংলা শিখা লাগবো,, এই তোর কবির নাতি কে বলিস আমারে শিখিয়ে দিতে,,, হুদাই অন্য জায়গায় শিখে টাকা নষ্ট করমু কেন বল ! "
আঁখি নাঈমের দিকে রা'গান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
- "চুপ কর, আমি তো বলেছি, এইটা কোথা থেকে এলো আমি জানি না!"
- "নাটক কম কর ! এই তো উড়ে উড়ে তোর কাছে এসেছে! আমার কাছে মিথ্যা বলছিস? "
এরপর নাঈম কপালে হাত দিয়ে চিৎকার করে কাঁ'দার অভিনয় করে বলল,
- "আল্লাহরেএএএ, আমার ২৬ বছরের জীবন বৃথা! এই জীবনে আমি কী করলাম? আর তুই, ১৭ বছরেই কবির নাতির সাথে প্রেম করলি? তোর বয়সে আমরা পাড়ায় ডাব চু'রি করমু কেমনে ওই চিন্তায় থাকতাম!! আর তুই মন চু'রি করে অলরেডি গোল দিয়ে দিছস?? হায় আল্লাহ, আমি এই সমাজে মুখ কীভাবে দেখাবো? আমার আগে আমার ছোট্ট চেও চেও মুরগি বোনটাই প্রেম করছে!"
আঁখি এবার রা'গে মেজাজ হারিয়ে আ'গুনের মতো জ্ব'লতে জ্ব'লতে বলল,
-" চুপ করবি তুই? আমার কথা বিশ্বাস কর। আমি সত্যিই জানি না, এটা কোথা থেকে এলো, সত্যিই জানি না, বিশ্বাস কর ভাইয়া! "
-" উহু উহু, নহে নহে, আমি বিশ্বাস করি নহে। বলো হে ভগিনী, কাহার সাথে করিয়াছো প্রেম তুমি?
এরপর নাঈম দাত বের করে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
- "হিহি,, আমিও পারি!"
এরপর নাঈম পেটে হাত দিয়ে ঝুকে হাসতে মগ্ন হলো। আঁখি মুখ বি'কৃত করে বিস্ময়বোধকভাবে দাঁড়িয়ে রইল। এই ছেলেটাকে কিছু বলার কোনো অর্থ নেই! স্বীয় কল্পনায় উৎপন্ন বর্ণনাগুলি উচ্চারণ করতে আরম্ভ করে যেন পা'গলপ্রায়। এখন নাঈমকে কীভাবে ব্যাখ্যা দিবে যে, এটা তার নয়?
গত দু'দিন যাবৎ কলেজ যাওয়া ছাড়া অন্য কোথাও যায়'ই নি আঁখি। বর্ষাকাল, বৃষ্টি যে কোনো সময় প্রপাত হতে পারে; অতএব বাড়ির বাহিরে যাওয়াও নিষিদ্ধ। কলেজ থেকে আসলে নাঈম আঁখি'কে ছাদে গল্প করার জন্য বলেছে, কারণ সে গেম খেলে বোরিং হয়ে গিয়েছে । এছাড়া মাঝেমধ্যে তারা ছাদে গল্প বিলাশ জুরে বসে সকলে মিলে। আঁখি ফ্রেশ হয়ে প্রথমে নামাজ সম্পন্ন করেছে। নামাজের জন্য পৃথক কক্ষ আছে, সেখানেই সে দৈনিক নামাজ আদায়; ইবাদত করে থাকে । কারণ আঁখির নিজ কক্ষে নানান জীবজন্তুর চিত্র সহ চিত্রকলার বাহুল্য রয়েছে, যা তার নিজ হাতে নির্মিত। ইসলামী বিধানানুযায়ী, যে কক্ষে কোনো প্রাণীর চিত্র দৃশ্যমান রয়, তাতে নামাজ আদায় করলে মাকরূহ বলে গণ্য হবে। তবে নামাজের সময় চিত্র ঢেকে রাখলে নামাজ মাকরূহ হবে না অর্থাৎ জায়েজ।
শৈশব হতেই আঁখির চিত্রশিল্পের প্রতি গভীর আসক্তি রয়েছে। মনঃক'ষ্টে, বা আনন্দিত থাকলে, অথবা একাকিত্বের প্রহরে, নিজ জীবনের ঘটমান ঘটনা ও অনুভূতিসমূহ চিত্রাঙ্কন করতে থাকে। তার স্মৃতিশক্তি অতুলনীয়, একবার যা দেখে বা শুনে থাকে, তা চিরকাল অমলিন রয়ে যায়। তার স্মৃতিশক্তি হতেই এই সকল চিত্রের উৎপত্তি।
নামাজ সমাপন করে ছাদে গমনের পূর্বে আঁখি কক্ষে ছোট বোন আলোর অনুসন্ধানে প্রবেশ করেছিল। তার বোন এখনো স্কুল থেকে আসেনি, পরমুহূর্তে কক্ষে আলো'কে না পেয়ে তার দৃষ্টি বিছানায় অবস্থিত কলেজের ব্যাগে নিবদ্ধ হলো, যা সে নিজেই রেখেছিল। ব্যাগটি পড়ার টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে দেখল, চেইন কিছুটা খোলা আছে। কৌতূহলী হয়ে সম্পূর্ণ চেইন খুলল এবং অন্তঃস্থলে একখানা দীর্ঘাকৃতি খাম দেখতে পেল । আঁখি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে খামটি করতলে ধারণ করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। "এটা কি? কে দিলো? কবে দিল?" এই সকল প্রশ্নমালা তার মনে আবির্ভূত হতে লাগল।
অবশেষে, সে খামটি খুলে ভেতরের বস্তু দেখার চেষ্টা চালায়। খুলে দেখতে পেল স্বর্ণাভ রঙের অলঙ্কৃত একখানি কেশবন্ধন কাঠি, যা রাজকীয় সৌন্দর্যে তার সম্মুখে উদ্ভাসিত হলো। কাঠির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আঁখি চেয়ারে বসে পরল এবং টেবিলের উপর খাম রেখে কাঠিটি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল, ভাবতে লাগল, এটা তাকে কে দিতে পারে? তাও এভাবে না জানিয়ে?
এইদিকে, নাঈম ছাদে অপেক্ষা করছে, কিন্তু আঁখির আসার কোনো নামগ'ন্ধ নেই। সে আঁখিকে ডাকার জন্য কক্ষের সামনে এসে দেখল, আঁখি চেয়ারে আরামসে বসে কেশবন্ধন কাঠিতে মগ্ন। এই দৃশ্য দেখে নাঈমের বি'রক্তি বৃদ্ধি পেল; নাঈম দাঁড়িয়ে আছে আর উনি কি সুন্দর বসে আছে!! নাঈম অগ্রসর হয়েই দৃষ্টি টেবিলের উপর অবস্থিত খামটিতে পরলে ভ্রু কুচকে হাতে তুলে নিলো।
নাঈমের উপস্থিতি দেখে আঁখি ধ্যান হতে প্রত্যাবর্তিত হলো। কেশবন্ধন কাঠির সৌন্দর্যে সে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে, অন্য কোনো কিছু লক্ষ্য করতে পারে নি। আঁখি বলল,
- "ভাইয়া, তুই আসলি কেন? আমি তো যাচ্ছিলামই।"
নাঈম খামটি দেখিয়ে বলল,
-"হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি! কিন্তু এটা কি?"
-" এটা আমার ব্যাগ থেকে পেলাম। কোথা থেকে আসলো জানি না! আর এই চুলের কাটা টা এর ভেতরেই ছিল! "
আঁখি হাত উচিয়ে দেখালো, নাঈম একবার দৃষ্টিপাত করল সে কেশবন্ধন কাঠির দিকে। এ সকল নারীত্বময় বিষয়াদিতে তার কোনো আগ্রহ নেই। পরক্ষণে খামের অন্তঃস্থলে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল এবং একখানি ক্ষুদ্র নীলচিরকুট দেখলো। আঁখি তখনই ওটা লক্ষ্য করল। চিরকুটটি হাতে নিয়ে কক্ষ থেকে বের হতে হতে নাঈম বলল,
- "এই চল তো ছাদে গিয়ে দেখবো ! তাড়াতাড়ি আয় নয়তো একটু পরেই বৃষ্টি আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে আছড়ে পরবে!!"
আঁখি এখন ল'জ্জায় অবনত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত, সে নিজেও মনে করেছিল, কেশবন্ধনের কাঠিটি হয়ত কেও তাকে দিয়েছে । কিন্তু চিরকুটে লিখিত বাক্যপাঠে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত , এটা আর যাই হোক তার জন্য কেও দেয় নি, বরং ভুলক্রমে তার কাছে এসেছে। ইশশস,, পরলো তো পরলো কার হাতে? নাঈমের হাতে! এবার নাঈম তাকে জ্বা'লিয়ে মারবে!
নাঈম চিন্তিত ভঙ্গিতে চিবুক স্পর্শ করে বলল,
- "তবে একটা জিনিস বেশ চিন্তার বিষয়!"
আঁখি ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞাসা করল,
- "কী?"
- "তোর প্রেমিক যে তোর চুলের কাটা, না কি নাম ওটার?"
- "হেয়ার পিন,"
- "এহহ,, হেয়ার পিন,, এটা হলো কেশবন্ধন কাঠি,,"
- " হুম, তো কি হয়েছে? দেখ, আমি আবারো বলছি.."
- " চুপ কর মুরগি,,"
-" তুইই চুপ কর কা'না!"
- তুই মুরগি!
- আর তুই কি? তুই বিশ্ব কা'না!
- "হাহাহাহ!. আচ্ছা, আছা,, আগে আমার কথা শুন। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা...!"
- "কী বল?"
- "আচ্ছা, তোর প্রেমিক তোর মাথার কাঁটা হতে চাইলো, আগে জানতাম গোলাপের ডান্ডায় কাঁটা হয়, চুলেরও কাঁটা হয়, এই প্রথম শুনলাম। তোরা বেডি মানুষেরা যে কি কি দেস,,, সে যাক'গে, আসল কথায় আসি..."
নাঈম অতি গম্ভীর মুখে বুক প্রসারিত করে বলল,
- "ও যে তোর চুলের কাঠি হতে চাইলো, তোর চুল যখন ম'য়লা হয়ে যাবে, আর সেই ম'য়লা চুলে তুই ওই কাঠি দিয়ে চুল বাঁধবি, আর তোর প্রেমিক চুলের কাঠি হয়ে তোরে বুকে আগলে নিবে... ইশশশ... সত্যিই ছেলেটা তোকে আসলেই ভালোবাসে, মানতে হবে! ক'জন পূরুষ এমন টা পারে বল?? "
আঁখি বিস্ময়ের আবেশে নাঈমের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখল, নাঈম মুখ টিপে হাসছে। এই ছেলেটা আসলেই পা'গল! আঁখি তো জানত, তার সহিত এমনই কিছু ঘটবে। রা'গে আঁখি দাঁতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে নাঈমকে মা'রার জন্য উদ্যত হলে নাঈম হাসতে হাসতে দৌড়ে পালাল। ছাদের চারিধারে যেন একটি ছোট খাটো একটা দৌড় প্রতিযোগিতা খেলা শুরু হলো।
নাঈমের খুনসুটি যেন আঁখির নিত্যদিনের সঙ্গি। নাঈম যে আঁখিকে খে'পায়, তা তার ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। যদিও আঁখি তার সহোদর বোন নয়, তবুও নাঈমের জন্য আঁখি যেন তার নিজের মায়ের পেটের ভাইবোনের চেয়েও কাছের। বড় মা ও তার ছেলের আচরণে আঁখির জীবন যখন বি'ষময়, তখন নাঈমই তার একমাত্র খুশির আশ্রয়। নাঈম জানে না কেন ওরা আঁখির মতো কোমল মেয়েটাকে ক'ষ্ট দেয়, আর জানতেও চায় না। ও শুধু চায় আঁখি যেন সবসময় হাসি-খুশি থাকে। আজও, সেই খুনসুটি আর দুষ্টুমির মাঝেও, নাঈম খুশি আঁখির হাসি দেখে। এক স্নিগ্ধ, মায়াবী হাসি, যা তার কাছে পৃথিবীর সবকিছুর চেয়েও মূল্যবান। যদিও নাঈম নিশ্চিত যে আঁখি সত্য বলছে। তার সরল মনের মুরগি বোনটা যে কখনোই এইসব প্রেম-প্রণয়ে লিপ্ত হবে না, তা সে ভালো করেই জানে।
দৌড়াদৌড়ির মাঝে পূর্বিকা ছাদে আগমন করল। দুইজনকে এমনভাবে দৌড়াতে দেখে তার ভ্রু কুচকে গেল। সপ্রশ্নে বলল,
- "এখানে কি বাদরের রেস চলছে ?"
পূর্বিকার উপস্থিতি দেখে দু'জন থেমে গেল। নাঈম তৎক্ষণাৎ চিরকুটটি পকেটে সন্নিবিষ্ট করল। আঁখি চোখের ইশারায় নাঈমকে অনুরোধ করলো কাউকে কিছু না জানাতে । নাঈম হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
- "আর বলিস না! মু'রগি দৌড়াচ্ছিলাম!"
- "তোর খেয়ে কাজ নেই?"
- "নাই, তোর তো আছে, যা গিয়ে থালাবাসন ধো! সারাদিন তো আটা-ময়দা মাখতে থাকিস!"
- "নাঈমের বাচ্চাআয়ায়া! "
- "হ্যাঁ, বিয়ের পর হবে, তোকে 'ফুফু' বলে ডাকবে!"
আঁখি মুখ চেপে হাসছে। পূর্বিকা ছাদে আফ্রিদির সহিত কথোপকথনের জন্য এসেছিল কিন্তু এই দুইজনের সামনে তো বলা যাবে না। সুতরাং, বি'রক্তিতে নাঈমকে ভেংচি কেটে চলে যেতে নিলে, নাঈম গলা উঁচিয়ে পূর্বিকাকে বলল,
- "সারাদিন তো খালি ফোন গু'তাস! একটু কাম-কাজেও মন দে! নয়তো বিয়ের পর তোর শাশুড়ী তোরে গু'তাবে! "
বলেই নাঈম আর আঁখি ফিক করে হেসে দিল।
রাত্রির আকাশের কালো আঁধারের মতোই শাহারিয়াজ ভবনের প্রতিটি সদস্যবৃন্দদের অন্তরে নেমে এসেছে গাঢ় অন্ধকার। মুগ্ধ এসেছে চার দিনও হয় নি ঠিক ভাবে, অথচ এরই মধ্যে তার শরীরে প্রবল জ্বরের আঁচ লেগেছে, ১০৪ ডিগ্রির উত্তাপ। এরই মাঝে, মোশারফ সাহেব দুই দিন ধরে পুত্রের সাথে একটিও বাক্য বিনিময় করেননি, এমনকি তার খোঁজও রাখেননি। সুহানা বেগম পুত্রের জন্য চিন্তায় পা'গলপ্রায়, মুগ্ধর এমন তীব্র জ্বর থাকা সত্ত্বেও সে নিজের প্রতি সামান্যতম যত্ন নিচ্ছে না। ঔষধ খাচ্ছে না কিংবা কোনো খাবারও মুখে তুলছে না। তবে তিনি বুঝতে পেরেছেন, পিতা ও পুত্রের মধ্যে নিঃসন্দেহে কোনো দ্ব'ন্দ্ব হয়েছে। কিন্তু সে দ্ব'ন্দ্বের কারণ কী, তা কারোই বোধগম্য নয়। ডাক্তার সতর্ক করেছেন, যদি এভাবে চলতে থাকে তবে তাকে শীঘ্রই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আম্বিয়া বেগম সারাদিন নাতির জন্য কা'ন্না করেই যাচ্ছেন । গৃহের সকলের মন উদ্বেগে আচ্ছন্ন, শুধু মোশারফ সাহেব বাদে। তিনি নিজের ক্রো'ধে আচ্ছন্ন, এখনও তিনি মানতে পারছেন না যে তার পুত্র শ'ত্রুর কন্যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছে। এ গোপন কথা কেবল মোশারফ সাহেব, সাজ্জাদ সাহেব এবং আরাফ এই মাঝেই আবদ্ধ।
গত দুদিন যাবৎ মুগ্ধর ফুফু বিনু বেগম তার স্বামী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছিলেন। আজ সকালেই তারা চলে গিয়েছেন নিজ গৃহে। মূলত এই কারণেই মোশারফ সাহেব কিছু প্রকাশ করতে চাননি। তিনি চান না, বাড়িতে কোনো অশা'ন্তি উত্থিত হোক। তাই এখনও তিনি এ বিষয়ে নীরব রয়েছেন। এবং ভবিষ্যতেও বলার ইচ্ছে তার নেই।
সাজ্জাদ সাহেব প্রবেশ করলেন মোশারফ সাহেবের কক্ষে। মোশারফ সাহেব তখন জরুরি দলিলাদি পর্যালোচনা করছিলেন। তাকে দেখে, তিনি চোখে চশমা ঠেলে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
- "আয়, বোস।"
- "বসতে আসিনি,"
দৃঢ় কণ্ঠে বললেন সাজ্জাদ সাহেব।
মোশারফ সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,
- "তবে কেন এসেছিস?"
- "ভাই, তুমি সব জেনেও কেন না জানার ভান করছো? মুগ্ধের এমন জ্বরের কারণ তুমি ভালো করেই জানো।"
- "যা বলতে এসেছিস, সরাসরি বল।"
- "আমি চাই তুমি মুগ্ধর সাথে কথা বলো। তার শরীরের কী অবস্থা হয়েছে দেখেছো? সবই সে তোমার ওপর রা'গ করে করছে, শরীরের দিকে কোনো খেয়াল রাখছে না।"
মোশারফ সাহেব বললেন,
- "সে আর শিশু নয়, সাজ্জাদ। আটাশ বছরের পুরুষ শিশুর মতো আচরণ করলে সে দায়িত্ব আমার না। যখন সে বুঝবে, তখন নিজেই নিজেকে ঠিক করবে।"
- "ভাই, ঝড় আসার পূর্ব মুহূর্ত সর্বদা শান্ত থাকে,"
বললেন সাজ্জাদ সাহেব।
-"কী বলতে চাস?"
- "মুগ্ধ এখনো শান্ত, কিন্তু আমরা সবাই জানি ও কেমন। ও যখন বলেছে..."
- "কী বলেছে? কী বলেছে ও ? তুই আমাকে ওর ভ'য় দেখাতে এসেছিস?? আমি না ওকে ভ'য় পাই, আর না ওর বলা কথা কে!! আমি ওকে ত্যা'জ্যপুত্র করবো, যদি ওই ইকরামের মেয়েকে বিয়ে করে!"
মোশারফ সাহেব চিৎকার করে রা'গে ফুসতে ফুসতে বললেন! এই উচ্চ স্বরে চমকে উঠলেন সাজ্জাদ সাহেব। এত দিন পরে, এ প্রথম তার ভাই তার প্রতি এমন জোরালো সুরে কথা বললেন।
মুগ্ধর ছোটবেলা হতেই বৃষ্টির পানি সহ্য হয় না। বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর আসে। অথচ পিতার প্রতি ক্রো'ধের কারণে সে এখনও কোনো ওষুধ মুখে নেয়নি। মাকে শান্তনা দিতে ওষুধ নিলেও, সে তা আড়ালে ফেলে দিয়েছে। এ দৃশ্য সাজ্জাদ সাহেব নিজ চোখে দেখেছেন। এমন অবস্থা চলতে থাকলে মুগ্ধের বড় রকমের ক্ষ'তি হতে পারে। তাই তিনি এসেছেন ভাইয়ের কাছে। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে!
কিন্তু যেমন পিতা, তেমনই পুত্র! দুজনেই তাদের জে'দ নিয়ে অটল রয়েছে। এমন সময়, দৌড়ে এসে কাজের মহিলা হাপাতে হাপাতে দাঁড়ালো। সাজ্জাদ সাহেব এবং মোশারফ সাহেব দুজনেই কৌতূহলভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন।
---
মুগ্ধ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে, যেন এক মত্ত পুরুষ। তার মনের গতি কী, তা সে নিজেই জানে। সারাক্ষণ ধরে কখনো তার মা জননী, কখনো চাচি, আবার কখনো দাদি, আবার কখনো বা তিনজনই এসে তার যত্ন করেই যাচ্ছে , খাওয়ানোর জন্য জোর করেই যাচ্ছে। কিন্তু মুগ্ধর এসব কিছুর প্রয়োজন নেই। তার আসল ঔষধ এখনো সে পায় নি। যখন পাবে, তখন তার জ্বর কেন, সকল হৃদয়ের রো'গ এমনিই সেরে যাবে। এ সময়ে আরাফ মুগ্ধের সহিত কথা বলতে এসেছে । আরাফ নিজেও একজনকে ভালোবাসে এবং যাকে ভালোবাসে তাকে না পাওয়ার দুঃ'খ কি প্রকার ম'র্মব্য'থা সৃষ্টি করতে পারে, তা আরাফের থেকে ভালো কে জানে! সে এসেছে মুগ্ধকে বুঝাতে, যেন মুগ্ধ যথাপ্রকারে ঔষধ সেবন করে।
আরাফ দেখল মুগ্ধ কক্ষে নেই। কক্ষে প্রবেশ করে বেলকনির দ্বার খোলা দেখে অনুমান করল, মুগ্ধ বেলকনিতেই আছে। আর বিলম্ব না করে আরাফ বেলকনির দিকে চলে গেল। যা অনুমান করেছিল, তাই সত্য হল; মুগ্ধ উন্মাদের ন্যায় দাঁড়িয়ে ধূ'ম্রপান করছে, আর সেই ধোঁয়া ফু দিয়ে হাওয়ার সাথে উড়াচ্ছে।
আরাফ ডাকল,
- "ভাই!"
মুগ্ধ তাকাল, তার র'ক্তিম নয়নে! সুদর্শনা যুবকের এ কি দু'রবস্থা হয়েছে! দেখে আরাফের বক্ষে একপ্রকার বে'দনার তীব্রতা অনুভূত হলো। মুগ্ধর তীক্ষ্ণ, মা'দকতাপূর্ণ চাহনি, কালো মণির পার্শ্ববর্তী সাদা অংশ আর সাদা নেই; সম্পূর্ণ র'ক্ত লা'লে আচ্ছন্ন। শিরাগুলি স্পষ্ট। তার কালো সিল্কি কেশ এলিয়ে কপালের উপরে ছড়িয়ে । লালাভ নাসিকা, বিষণ্ণ মুখাবয়ব, তবুও সবসময়ের ন্যায় ভাবলেশহীন সেই দৃষ্টি। আরাফ প্রথমে মুগ্ধর নেওয়া সিদ্ধান্তে খুশি হলেও এখন তাকে বিষয় টা বেশ ভাবাচ্ছে! কারণ তখন তো সে নিজের কথা ভেবেছিল। তবে আরাফ এখন অবাক নয়নে লক্ষ্য করছে সামনের গম্ভীর, রা'গী, ব'দমেজাজি সুদর্শন পুরুষটির দিকে। সত্যিই কি তার মতো পাথর হৃদয় মানবের মনে কেও দাগ কেটেছে? এই দৃশ্য যেনো অবিশ্বাস্য। মুগ্ধও কি ভালোবাসতে জানে? আজ পর্যন্ত, এই প্রথম আরাফ মুগ্ধকে এক নারীর জন্য এত উন্মাদ, অস্থির হতে দেখলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না! এটি যেনো এক স্বপ্ন, ঘুম ভাঙলেই শেষ। নারীর এত ক্ষমতা কি সত্যিই আছে? হ্যাঁ, হয়তো। না, হয়তো কেন? এটা তো নিশ্চিত, নারীর ক্ষমতা এমনই যে পাথর হৃদয়ের মানুষের মন গলাতে পারে। কী এক অদৃশ্য শক্তি দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা! সামনেই মুগ্ধ তার উদাহরণ।
কেন মুগ্ধ? কিসের প্রয়োজন, এক নারীর জন্য নিজেকে এমন উন্মাদ করার? আরাফ এটা বলতে চেয়েও থেমে গেল। কোন মুখে বলবে? সে নিজেও তো এক নারীর প্রেমে উন্মাদ!
তবে আরাফ জোর গলায় বলল,
- " ভাই, তুমি এমন করলে কিভাবে হবে বলো? নিজের কি হাল বানিয়েছো দেখেছো তুমি? প্লিজ ভাই। আমি তোমাকে এভাবে আর দেখতে পারছি না! তুমি কেন বৃষ্টিতে ভিজতে গেলে? তুমি জানো তোমার বৃষ্টি সয় না। আচ্ছা তাও বাদ, ঔষধ কেন খাচ্ছো না? খাবার কেন মুখে নিচ্ছো না? বাড়িতে থাকছ না! বড় মা তোমার চিন্তায় নিজেও অসুস্থ হয়ে যাবে। দাদিও কাঁদছে! মাও চিন্তায় অস্থির । তোমার এই একটা কারণে বাড়ির প্রত্যেকেই অ'সুস্থ হয়ে পড়বে! দেখো, আমি তোমার অনুভুতি বুঝি কিন্তু, এভাবে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছো তুমি? প্লিজ ভাই, ঔষধ খেয়ে নাও, প্লিজ! "
এক দমে কথাগুলো বলে আরাফ মুগ্ধের সম্মুখে হাতজোড় করে দাঁড়াল। মুগ্ধের তাতে কোনও ভ্রক্ষেপ নেই । সে ধীরে ধীরে সিগারেট শেষ করে মা'তালের ন্যায় সূরে আরাফের দিকে না তাকিয়ে বলল-
- "আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দে!"
আরাফ বিস্মিত! সে এসেছে বুঝাতে, আর এখন উল্টো তাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে!? তবুও আরাফ বলল, WhatsApp
-" আচ্ছা, সেসব পরে হবে । কিন্তু তুমি চলো তো আগে কিছু খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবে চলো!! "
- " মুগ্ধ কারও কথায় চলে না। "
ভাঙবে তবু মচকাবে না। আরাফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
- " আচ্ছা, বলো! "
- "তোর প্রিয় জিনিসে কেউ নজর দিলে কি করবি?"
আরাফ অনেকটা অবাক হলো! এখন এইসব কথার উত্তর দিতে হবে তাকে? ইশশশ! , বড় ভাইকে এসব বলতে তো লজ্জা লাগে। যদিও মুগ্ধ আরাফের থেকে তিন বছরের বড় তবুও! মুগ্ধকে সে যথেষ্ট সম্মান করে। অন্য কেউ থাকলে তাও বলা যেত। কিন্তু মুগ্ধ! ওকে কিভাবে এসব বলবে? আরাফ একবার ভাবলো মুগ্ধর প্রশ্নটার মানে। ভাবতেই মাথায় চাড়া দিলো এক শ্যামবর্ণা কন্যার মনমুগ্ধকর সে হাসি। সেই হাসির প্রতি যদি কেও দৃষ্টি দেয়!! সঙ্গে সঙ্গে আরাফের অন্তরে ক্ষো'ভ জেগে উঠল। গম্ভীর স্বরে বলল,
- "আমি তার চোখ উ'পড়ে ফেলবো!"
মুগ্ধ বাঁকা হাসল। আবার প্রশ্ন করল,
- " যদি কেও তাকে স্প'র্শ করার চেষ্টা করে, তখন কি করবি? "
আরাফের ক্রো'ধ আরও বেড়ে গেল। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল,
- " আমি ওর হাত কা'টতে দুবার ভাববো না! "
মুগ্ধ এবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল আরাফের দিকে। র'ক্তিম নয়নে রহস্যময় সে হাসি। মুগ্ধ'কে অন্যরকম দেখাচ্ছে। আরাফ কিছুটা অ'স্বস্তি অনুভব করতে লাগল। মুগ্ধ সিগারেটের শেষাংশটা মুঠোর মধ্যে পিষে ফেলল। ধীরে ধীরে আরাফের দিকে এগিয়ে এসে র'ক্তিম চোখে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
- " আমার প্রিয় জিনিসে তাকানো তো দূরস্থান, যদি কেও শুধু চিন্তাও করে... তার ক'লিজা ছিঁ'ড়ে ফেলব আমি! You know na, Mugdha never gives anyone a second chance!!! And when it comes to something I love...
মুগ্ধ বাকিটা আর কিছু বলল না। চোয়াল শক্ত করে বেলকনি ত্যাগ করে নিজ কক্ষে গমন করল। আরাফ মুগ্ধের কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে, হঠাৎ তার মনে এক ভী'তি সঞ্চার হলো। কণ্ঠস্বর নিচু করে বিড়বিড় করে বলল,
- "পূর্বিকার দিকে কেও নজর দিলো কি না..."
পূর্বিকার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু আরাফ আ'শঙ্কায় পরিপূর্ণ ছিল-না জানি কার প্রতি মুগ্ধ ক্রু'দ্ধ হয়েছে। নাহ, যেভাবেই হোক, মুগ্ধকে বুঝাতেই হবে। এই ভেবে আরাফ তৎক্ষণাৎ মুগ্ধের অনুসরণ করল। গিয়ে সরাসরি মুগ্ধকে বলল,
- "দেখ ভাই, তুমি রা'গ করো না! কোনো না কোনো পথ নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তুমি নিজের রা'গ নিয়ন্ত্রণে রাখো ভাই!"
মুগ্ধর এখন কথা বলার ইচ্ছে নেই। আরাফের প্রতি দৃষ্টিপাত করে পুনরায় সেই বিদ্রূ'পমূলক হাসি হেসে বলল,
- "তুই কি ভেবেছিস আমি অ'সুস্থ?? হাহাহা! নো ওয়ে!! আ'ম নট! আমি তো বিশ্রাম নিচ্ছি!"
- "মানে??"
- "সব মানে বুঝতে নেই! আমার অনেক কাজ বাকি আছে! সেসবের জন্য এখন বিশ্রাম নিচ্ছি!"
আরাফের মাথা কাজ করছে না! একে তো জ্বরে ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না! সে নাকি বিশ্রাম নিচ্ছে! আসলেই জ্বরের ঘোরে মানুষ উল্টো পাল্টা প্রলাপ বকতে থাকে।
এমন সময় নিচ থেকে মোশারফ সাহেবের গ'র্জন শোনা যায়, যেন সকল কিছু ভে'ঙে চু'রমা'র করছেন। আরাফ বিমূঢ় দৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকালো, মুগ্ধর মনোভাবের কোনো পরিবর্তন নেই। আরাফ একমুহূর্ত আর দেরি না করে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে কী ঘটছে তা জানার জন্য বেরিয়ে যায়। মুগ্ধ নরম তুলতুলে বিছানায় ঠাস করে পিঠ এলিয়ে দিয়ে মা'তালের ন্যায় হাসতে থাকে। সেই কৌতুকপূর্ণ হাসি দিয়েই বলে,
- বোকা!


Post a Comment

0 Comments

Close Menu