লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


নিশীথের আকাশে মেঘগ'র্জনের প্রবল তা'ণ্ডব, তীব্র গ'র্জন যেন ধ্বং'সের পূর্বাভাস ঘোষণা করছে। শাহারিয়াজ ভবন সম্পূর্ণ থমথমে, এক গভীর নিস্তব্ধতা সবাক করেছে গৃহের প্রত্যেক সদস্যের চেতনাকে। প্রত্যেকেই উপস্থিত, কিন্তু প্রত্যেকেরই কণ্ঠ যেন উচ্চারণ করার শক্তি হারিয়েছে। মোশারফ সাহেবের চেহারায় ক'ঠোর ক্রো'ধ, তাঁর চিৎকার প্রাসাদভেদী। গৃহে পুলিশ প্রবেশ করেছে, আর তাতেই তিনি ক্রো'ধে ফেটে পড়েছেন। যাদের পা চা'টি'য়ে তৃপ্তি নিতেন, যারা তার পা'য়ের ধু'লো গ্রহণ করতে আসতেন, সেই পুলিশই আজই প্রথম তাঁর বিরু'দ্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছেন। ইকরাম আলী অভিযোগ এনেছেন , মোবারকের মৃ'ত্যুর পেছনে মোশারফ সাহেবের হাত থাকতে পারে। মোবারক ছিল ইকরাম আলীর পুরোনো অন্তঃপ্রাণ, এবং এইবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যানের পদে হেরে গিয়ে মোশারফ সাহেব প্রতি'শো'ধস্পৃহা নিয়ে ইকরাম আলীর প্রভাবশালী লোকজনকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়'যন্ত্র করছেন। এই কথা শোনার পর, মোশারফ সাহেব প্রবল ক্রো'ধে গ'র্জন করে উঠলেন, নিকটবর্তী টি-টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিটি আ'ছাড় মেরে চূ'র্ণবিচূ'র্ণ করলেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর এবার উচ্চারণ করলেন,
— "স্যার, এটা আমার কর্ম, আমার কিছু করার নেই। তবে আমরা এখানে শুধু আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসিনি!"
মোশারফ সাহেব ক্রো'ধে কণ্ঠভার করে বললেন,
—" আর কি কারণ?"
— "আপনার ছেলেকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে!"
এই কথা শোনামাত্র পুরো বাড়িতে যেন ব'জ্রপাত ঘটল। পুত্রকে? মানে তো মুগ্ধকে! মুগ্ধকে কেন নিয়ে যেতে এসেছে পু'লিশ? তবে আরাফের মুখমণ্ডল জুরে তৃপ্তিকর হাসি যা লুকিয়ে যাচ্ছে খনে খনে! কেন এই হাসি ? এর পেছনের আসল কারণ অজানা রয়ে গেলো সকলের নিকট। শুধু মনে মনে আরাফ বিরবিরালো,
— "ওই মোবারককে তো মরতেই হতো! "
পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবেই দৃঢ় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আরাফের। মোশারফ সাহেব রাগে উদ্দীপ্ত হয়ে ইন্সপেক্টরের কলার চেপে ধরলেন,
— "এইইই নিয়াজ! তুই ভুলে গেছিস আজ তুই এই জায়গায় আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছিস? তুই কি ভুলে গেছিস তোর এই পুলিশের পোশাক আমার জন্য পরেছিস? তুই ভুলে গেছিস তোর পরিবার আজ ভালোভাবে চলছে একমাত্র আমার জন্য? আর তুই আমার ছেলেকে ধরতে এসেছিস? তোর সাহস দেখে আমি স্তম্ভিত! বল, কত টাকা দিয়েছে তোকে ওই ইকরাম? বল, বল, কত টাকায় বিক্রি হয়েছিস ওই জা'নো'য়ারের কাছে? বল, নিয়াজ!"
ইন্সপেক্টর নিয়াজের কলার চেপে ক্রো'ধে গ'র্জিত মোশারফ সাহেব! পাশের দুজন কন্সটেবল তাঁকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। সাজ্জাদ সাহেব মোশারফ সাহেবের হাত ধরে তাঁকে নিবৃত্ত করতে চাচ্ছেন। আরাফ দৌড়ে এসে অন্য হাত টানছে। আম্বিয়া বেগম এই পরিস্থিতি দেখে মাটিতে বসে হায়-হু'তাশ করছেন। আছিয়া ভ'য়ে কুকড়ে তাঁর মা ও চাচির মাঝে দাঁড়িয়ে। সুহানা বেগম কেঁ'দে চলেছেন, তাঁর অ'সুস্থ পুত্রটিকে পুলিশ নিয়ে যেতে এসেছে! ইন্সপেক্টর নিয়াজ নিজের কলার ছাড়িয়ে, রা'গকে দমন করে বললেন,
— "হ্যাঁ স্যার, আপনি ছিলেন বলেই আমি আজ এখানে পৌঁছেছি! আপনার দেওয়া শিক্ষাই আমার পাথেয়। আমি কারো টা'কায় বি'ক্রি হয়নি, স্যার। আমি অকৃতজ্ঞও নই। আমি আমার কর্তব্য পালন করছি। আমি চাইলেই একজন পু'লিশের কলার ধরার অপ'রাধে আপনাকে তিন দিনের জন্য গ্রে'প্তার করতে পারি। কিন্তু আপনাকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি, স্যার! অনুগ্রহ করে আমাকে আমার কর্তব্য পালন করতে দিন। বিনা বাধায় আপনার ছেলেকে ডাকুন, অন্যথায় আমরা বাধ্য হব ঘরে প্রবেশ করে তাকে জো'রপূর্বক নিয়ে যেতে!"
— "কীহহহ? এত্তত্ত বড় স্প'র্ধা তোর? তোর জি'ভ টে'নে ছিঁ'ড়ে ফেলব! ভুলে যাস না, আমি এখনো জীবিত আছি! কোন অপ'রাধে আমার ছেলেকে ধরবি তুই? বল!"
— "স্যার, তদন্ত অনুযায়ী, যেদিন মোবারককে খু'ন করা হয়েছে, সেদিনই আপনার ছেলে মুগ্ধ বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল। পো'স্টম'র্টেম রিপোর্টে জানা গেছে, মোবারককে রাত দুইটা থেকে তিনটার মধ্যে খু'ন করা হয়। সেই সময় আপনার ছেলের মোবাইল লোকেশন মোবারকের খু'নের জায়গার আশেপাশেই ছিল। আর মুগ্ধর লাস্ট লোকেশনও সেটাই, এরপর থেকেই তার ফোন বন্ধ রয়েছে। এটাই যথেষ্ট স্যার, তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।"
ইন্সপেক্টরের এই উদ্ঘোষণা শুনে শাহারিয়াজ ভবনের প্রত্যেকটি সদস্য যেন এক প্রচণ্ড আ'ঘাতের সম্মুখীন হলেন, তাদের মাথায় যেন একের পর এক আকাশ ভে'ঙে পড়ছে। মোশারফ সাহেব মুহূর্তের জন্য দিন-দুনিয়া ভুলে গেলেন, এ কি কথা শুনলেন তিনি? সুহানা বেগম আঁচল দিয়ে মুখ চাপা দিলেন, অবিশ্বাসে চোখে বড় বড় করে ফেললেন, তাঁর ছেলে? না, না, এটা হতে পারে না, এটি সম্পূর্ণ অসম্ভব! প্রত্যেকের চোখ বি'স্ময়ে গোল গোল হয়ে উঠেছে, যেন পা'থরে পরিণত হয়েছে তারা। তবে কি সত্যিই মুগ্ধ রাতেই বাংলাদেশ এসেছে ? এসেছে যখন বাড়ি কেন ফেরেনি? কেন মিথ্যা বললো সে? কোথায় ছিল সারারাত? কেনই বা মোবারকের লা'শের পাশে অবস্থান করেছিল? এমন প্রশ্নগুলো তাদের মনের মধ্যে ঝ'ড়ের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। কারোরই মনে কোনো স্পষ্ট উত্তর আসছে না। তাদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, এখন কী হবে?
ইন্সপেক্টর ভদ্রভাবে সামনে এগিয়ে এসে বললেন,
—" স্যার, এবার কি আপনি আপনার ছেলেকে ডাকবেন?"
মোশারফ সাহেবের মুখে কোনো উত্তর নেই। তিনি নিশ্চুপ! ইন্সপেক্টর তার পাশে দাঁড়ানো কন্সটেবলদের দিকে ইশারা করলেন, মুগ্ধকে ভিতর থেকে নিয়ে আসার জন্য। ইশারামতো কন্সটেবলরা তৎক্ষণাৎ দৌড়ে ভিতরে প্রবেশ করল। মোশারফ সাহেব ধ'পাস করে বসে পড়লেন, তাঁর চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী যেন অন্ধ'কার হয়ে এসেছে! ইন্সপেক্টর নিয়াজ তাঁর দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
— "স্যার, আমি আপনার মানসিক অবস্থা অনুভব করতে পারছি। কিন্তু আমার হাত বাঁধা,,,"
মোশারফ সাহেব কাঁপতে থাকা হাতে ইশারা করে চুপ করিয়ে দিলেন। তিনি আর কিছু শুনতে চান না। তাঁর মাথা নিচু করে আছেন, যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বোঝা তাঁর কাঁধে এসে পড়েছে। সাজ্জাদ সাহেব সামনে এগিয়ে এসে ভাইকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাঁর কথাও যেন বাতাসে বি'লীন হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক সে মুহূর্তে দুজন কনস্টেবল তড়িঘড়ি করে ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এসে চিৎকার করে উঠল,
—" স্যারররর!!.! মমমুগ্ধ!!!"
—————
এম্বুলেন্সের হর্ন ব'জ্রগ'র্জনের মতো শোনাচ্ছে, তুমুল ঝ'ড়ের মাঝে গগনবি'দারী শব্দ করে ছুটে চলেছে হাসপাতালের দিকে। পেছনেই গ'র্জন করে এগিয়ে আসছে পুলিশের জিপ, মুগ্ধ যেন এক পলকের জন্যও দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে না পারে, গেলেই সে পা'লাবে। সুহানা বেগমসহ বাড়ির সব নারী সদস্যই কা'ন্নায় ভেঙে পড়েছেন। আরাফ নিজেকে শক্ত রেখেছে, এই মুহূর্তে তাকে দৃঢ় থাকতে হবে, কারণ তার দু'র্বল হওয়ার সুযোগ নেই। মোশারফ সাহেব যেন নি'স্তব্ধ এক মূর্তি হয়ে গেছেন, রোবটের মতো নি'স্পৃহভাবে বসে আছেন। চারদিকে শুধুই চি'ৎকার, এক মায়ের চিৎ'কার, বোনের চি'ৎকার, দাদির চি'ৎকার, চাচির চি'ৎকার; সবাই কাঁ'দছে, শুধুমাত্র একজন মানুষকে ঘিরে। মোশারফ সাহেবের মাথা ভো ভো করছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি তাঁর প্রা'ণপাখি উড়ে গেলো বলে।
হাসপাতালের সামনে এসে এম্বুলেন্স থামতেই, ইন্সপেক্টরসহ দুই কনস্টেবল দ্রুত বলিষ্ঠ অচেতন মুগ্ধকে স্ট্রেচারে শুইয়ে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতে শুরু করল। এতে অবশ্য বেগ পেতে হয়েছে পাথর ন্যায় ভারি মুগ্ধকে ধরতে। সেই সাথে, দৌড়াতে দৌড়াতে হাসপাতালে প্রবেশ করলেন পরিবারের সব সদস্য। সবাই ব্যস্ত, সবাই উদ্বিগ্ন। মোশারফ সাহেব শুধু নির্নিমেষে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর হাত-পা যেন অ'বশ হয়ে গেছে। আজ আকাশের ঘনঘটার মতোই তাঁর পরিবারের সকলেই কাঁ'দছে, এবং এই ভ'য়াল পরিবেশের মতোই তাঁর পরিবারেও প্র'লয় সৃষ্টি হয়েছে।
---
হাসপাতালের বাইরের প্রাঙ্গণে, রাত্রির আকাশে মেঘের গ'র্জন যেমন ভী'তিকর, তেমনই ভেতরে মুগ্ধের পরিবার অপেক্ষার প্রহরে যন্ত্র'ণার আ'গুনে দ'গ্ধ হচ্ছে। সুহানা বেগম, আছিয়া, আম্বিয়া বেগম, নিসা বেগম সকল নারী সদস্যই হাসপাতালে পেশেন্টের পরিবার বসার স্থানে বসে আছেন। সুহানা বেগম অবিরাম ক্র'ন্দন করছেন, চোখের জল কিছুতেই থামছে না। আছিয়া একদিকে কা'ন্নায় ভে'ঙে পড়ছে আবার বড় মাকে সা'ন্ত্বনা দিতেও চেষ্টা করছে। কিন্তু সবচেয়ে বে'দনা-বি'ধার চিত্র দেখা যাচ্ছে আম্বিয়া বেগমের মাঝে। তিনি চিৎ'কার করে কাঁ'দছেন, তাঁর হৃদয়বি'ধারী আহাজারিতে পুরো হাসপাতাল যেন প্রকম্পিত হচ্ছে। আশপাশের লোকজন বিরক্ত হলে, নার্সগণ তাঁকে থামাবার চেষ্টা করলেও, নিজের প্রিয় নাতির জন্য তার এই বে'দনার অ'শ্রু যেন থামবে না। নিসা বেগম, শাশুড়ি আম্বিয়া বেগমকে সা'ন্ত্বনা দিতে ব্যস্ত, অথচ নিজেই কা'ন্নার চাপে নুয়ে পড়ছেন। মোশারফ সাহেব নি'র্নিমেষে বসে আছেন, যার মুখে কোনোরূপ অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে না। যেন অন্তরের সমুদয় শো'ক নিঃশব্দে বহন করছেন তিনি। সাজ্জাদ সাহেব, ভাইয়ের পাশে বসে চিন্তায় মগ্ন। আরাফের কপালে স্পষ্ট চিন্তার রেখা। সকলেই শ'ঙ্কিত, অপেক্ষার প্রহর যেন যন্ত্র'ণার কাল হয়ে উঠছে। ইন্সপেক্টর নিয়াজ ও তার দুই কনস্টেবল নীরবভাবে দাঁড়িয়ে, প্রত্যেকের মুখমণ্ডলে গভীর চি'ন্তার ছাপ।
অত:পর, ডাক্তার ত্বরিত গমন করে ইমার্জেন্সি হতে বের হলেন। তাঁর মুখমণ্ডলে রো'ষের ছাপ, দৃপ্ত পদক্ষেপে বের হয়ে আসতেই আরাফ, নিয়াজ ও সাজ্জাদ সাহেব তাঁহাকে ঘিরে ধরলেন। সমগ্র পরিবার উদ্বেগপূর্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে , যেন তাদের আশা ও আশঙ্কার কেন্দ্রবিন্দু হলেন ডাক্তার।
ডাক্তার রুষ্ট হয়ে গলার স্বর উচু করে বললেন,
— "আপনারা কি জ্বরকে এতই হেয়ালি পনা মনে করেন? জ্বর কতটা মা'রা'ত্মক হতে পারে, জানেন? উচ্চ তাপমাত্রা, বিশেষ করে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট, স্নায়ুকোষে বিপ'র্যয় ঘটাতে পারে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে, হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে এমনকি অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর মা'রা'ত্মক ক্ষতি করতে পারে। এখন, পেশেন্ট এর অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। এতদিন ধরে ঔষধ গ্রহণ না করায়, তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে না আসার ফলে তার শরীরের অঙ্গগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এর ধারণা আছে আপনাদের? এখন এভাবে কেঁ'দে কি লাভ? জানেন কি তার তাপমাত্রা এখন ১০৫ ডিগ্রি হয়ে গেছে? যা জীবন-হু'মকি'স্বরূপ। যদি চিকিৎসা দ্রুত শুরু না করা হয়, তার অবস্থা আরো অব'নতি হতে পারে, যা তার জীবনের জন্য বি'প'জ্জ'নক হতে পারে। আমরা চিকিৎসক এটা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু আপনারা? পেশেন্ট কি সত্যিই আপনাদের ছেলে?? নাথিং টু সে!!"
ডাক্তারের বক্তৃতা শুনে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কী ভ'য়া'বহ অবস্থা ! হায় আল্লাহ, এমন একটি দিনও শাহারিয়াজ পরিবারের সবাইকে দেখতে হলো! বাড়ির বড় ছেলে মুগ্ধ। তীব্র জে'দি পুরুষ ! এটা ডাক্তারকে কিভাবে বোঝাবে? যে তাদের এই ছেলে কারো কথার ধার ধারে না!! ডাক্তার চলে গিয়েছেন। সবাই কেবল ভে'ঙে পড়ছেন। আর স'হ্য হচ্ছে না কারো। ইন্সপেক্টর নিয়াজ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে মোশারফ সাহেবের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
— "মুগ্ধ সুস্থ হয়ে উঠুক, তারপর আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করব। ততদিন আমাদের নজর থাকবে মুগ্ধের ওপর।"
এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন। মোশারফ সাহেব এখনো নি'ষ্প্রাণ হয়ে বসে আছেন। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, কি থেকে কী হয়ে গেল! একমাত্র পুত্র তার, যাকে কিছুক্ষণ আগেও তে'জ্য'পুত্র করবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন সাজ্জাদ সাহেবের নিকট, আর এখন? পুত্রের এমন ক'রুণ অবস্থায় দেখে মনে হচ্ছে যেন পুরো পৃথিবী তার মাথায় ভে'ঙে পড়েছে! এটাই কি তার পুত্রের প্রতি নিরব ভালোবাসা? যা পিতা পুত্রের জে'দ রা'গের মাঝে অপ্রকাশিত?
---------
নার্স, অবিলম্বে অত্র তত্ত্বাবধানে কিছু করতে ব্যস্ত ছিল, এমন অবস্থায় মুগ্ধের দিকে ক্রমাগত দৃষ্টি যাচ্ছে তার। নার্স চোখের পলক পর্যন্ত সরাতে পারছিল না। কত সুদর্শন পুরুষ! মুগ্ধর শরীর থেকে পুরুষালী চকলেটের মাতাল করা ঘ্রাণ তরুণী নার্সকে আরো আকৃষ্ট করে তুলছে। যদিও এটি তার কর্মস্থান, এমন অবস্থায় নিজের তত্ত্বাবধান থেকে বি'চ্যুত হওয়া সমীচীন নয়। কিন্তু মুগ্ধ! এই অমায়িক পুরুষটি কে? এত প্রশংসনীয় সুদর্শন কেন? পূর্বে গল্পে, চলচ্চিত্রে, নাটকে শুধুমাত্র শুনেছিল বা দেখেছিলো সে । আজ নিজ চোখে এই বলিষ্ঠ সুদর্শন অচেতন পুরুষকে দেখল। জ্বরে পুডা মলিন মুখমণ্ডল, উঁচু নাক লাল হয়ে আছে, এবং মাতাল করা চোখ বুজে যা অদৃশ্য জ্বা'লা ধরিয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত মনের কোনে। ফর্সা গালে কালো, খোচা খোচা দাড়ি। কী মুগ্ধকর রূপ! নার্সের চোখ মুগ্ধের এই অপূর্ব সুদর্শনা বিহ্বল হয়ে গিলে খাচ্ছে বারংবার,, মুগ্ধের পুরুষালি দেহের চকলেটির সুমিষ্ট সুবাস তার নাসিকায় প্রবাহিত হয়ে শু'কে নিচ্ছে না চাইতেই! নার্স লক্ষ্য করল মুগ্ধ তার ব্রাউন ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে কিছু বিড়বিড় করছে। তার কৌতূহলী মন সেই শব্দের উদ্দেশ্য ধরতে চাইল। মুগ্ধর মুখের কাছে এসে কান পাতল। কি বলছে ঠাউর করা মুশকিল, মুগ্ধ অস্পষ্ট স্বরে বলছে,,
—" প…প্র...ণী…তা !!"
তন্মধ্যে ডাক্তার এসে নার্সকে কর্মরত না দেখে ক'ঠোর ভাষায় ধ'মক দিয়ে উঠলেন। নার্স অবিলম্বে লাফিয়ে উঠে পেছনে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের দিকে ন'তজানু হয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। ডাক্তার কিছুটা হলেও নার্সের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করলেন। চুল যে এমনি এমনি পা'কেনি, কিছু হলেও বুঝতে পারছেন। নার্সকে তির'স্কার করে বহি'ষ্কার করে দিলেন এ কেবিন হতে। নার্স মাথা নিচু করে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। ডাক্তার সাহেব ফোস করে নিশ্বাস ফেললেন এবং অচেতন শুয়ে থাকা বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন পুরুষের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিলেন, যে কিছু একটা বিড়বিড় করছে ।
----------
ইন্সপেক্টর জিপে অবস্থান করে, বাহিরের প্র'লয়করী রাতের অ'ন্ধকারে ডুবন্ত আকাশের দিকে ঝ'ড়ের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করছেন। সামনে কনস্টেবল তীব্র গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। নিয়াজের পুলিশি মস্তিষ্কে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎই ফোনের তীব্র শব্দে চ'মকে ওঠেন। এরপর ফোন রিসিভ করেই নিয়াজ কৃতজ্ঞতায় বলেন,
— "আপনাকে ধন্যবাদ! আপনার মাধ্যমেই আমরা মুগ্ধের ব্যাপারে অবগত হতে পেরেছি। প্রয়োজনে আবার ডাকব!"
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে উত্তরে বলা হয়,
—" হাহাহাহা, স্যার,, সত্যটা আপনাদের সামনে তুলে ধরা আমার দায়িত্ব! আমি পরবর্তীতে আরো আপডেট দেব। কিন্তু যা কিছুই ঘটুক, মুগ্ধকে ছেড়ে দেবেন না।"
— "এটা আমার কর্তব্য, আমাকেই করার সুযোগ দিন!"
—" ঠিক আছে স্যার, রাখি তাহলে!"
ফোন কেটে যাবার সাথে সাথে চোয়াল শক্ত করে বেলকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির কণার প্রতিটি ফোটা তার শরীরে পড়তে দিতে লাগল আফ্রিদি। একইসঙ্গে দাঁত চিপে বলল,
— "আমার পূর্বির দিকে নজর দেওয়ার ফল এবার বুঝবি মুগ্ধ!! তুই জানিস না তুই কার দিকে নজর দিয়েছিস! এর জন্য তো তোকে প'স্তাতে হবেই! হবেই!! হবেই!! হাহাহা! তোর সাথে গায়ের জোরে না পারলেও বুদ্ধির জোরে ঠিকই পেরে উঠব! তুই সামান্য বৃষ্টি সহ্য করতে পারিস না তাহলে আমার কলিজায় হাত দিতে চেয়েছিস এটা আমি কী করে সহ্য করব?? আফ্রিদি কী জিনিস এবার বুঝবি! Just wait and watch!!!"
------
ভোলা’র বৃদ্ধা দাদি রাবেকুন্নেসা বেগম আজ কয়েক টুকরো মাংস রান্না করছেন। চতুর্দিক মাংসের সুবাসে পরিপূর্ণ। মুগ্ধর আসার উপলক্ষে নিমন্ত্রণ পাওয়ার পর পেট পূর্ণ করে মাংস ভাত ভক্ষণ করার পর বড় বড় টুকরো মাংসের পোটলা নিয়ে এসেছিলেন, পুনরায় নাতিকে রান্না করে খাওয়াবেন এ চিন্তা করে। ছোট্ট ভোলা কি জানে যে, প্রতিটি আহার তার ইচ্ছেমতো তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হবে না। যা পেট পুরে খেল, সেই খুশিতেই মাস পার করার কথা ছিল তার । কিন্তু উৎসব যে তার ঘরে আগমন করবে, তা কি তিনি ভোলার দাদি জানতেন?? সুতরাং খুশি মনে আজই নাতির সহিত খাদ্যগ্রহণ করবেন। ঘরে কিছু অল্পবিস্তর ময়দা দিয়ে রুটি প্রস্তুত করছেন রাবেকুন্নেসা বেগম। চারটি রুটি ছোট ছোট করে বানাচ্ছেন। ভোলা দাদির পাশে বসে দেখছে। আজ আবার মাংস খাবে! চোখে মুখে আনন্দের আভাস! ছোট্ট বাচ্চার মুখে হাসি দেখলে মনে হয় সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এক টুকরো মাংসের জন্য এত আনন্দ? কদিন পূর্বেই খেলো, কে যেন এলো, দাওয়াত দিয়েছিল। ছোট্ট ভোলা কি এত বুঝতে পারে? সে তো জানে, পেট পুরে খেতে পারবে। আজ আবারও! খুশিতে ভাসে যাচ্ছে ভোলা!
কিন্তু তার জীবন তো এমন হওয়ার কথা ছিল না! রাজকুমারের মতো অবস্থায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য তাকে রাজ ভিখিরি বানিয়ে দিয়েছে। না, এটা কি সত্যিই ভাগ্যে ছিল নাকি কেও জোরপূর্বক এমন করে দিয়েছে? আজ এক টুকরো মাংসের জন্য হাসছে! যেন স্বপ্ন! অন্যথায়, চার দিন পূর্বে খেলো, আর আজ পুনরায় খাবে? এটিই তো স্বপ্নের মতোই। সারাবছর নুনভাত খাওয়ার ছোট্ট ছেলেটি তো বুঝে, এক টুকরো মাংসের মূল্য কত! আহা, মানুষ রাস্তায় খাবার ফেললে, কুড়িয়ে খায়! তার জীবন তো এমন হওয়ার কথা ছিল না!
এসব চিন্তা করেই বৃদ্ধা রাবেকুন্নেসা বেগমের চোখের কোনে জল জমল। কিন্তু আজ তিনি কাঁদবেন না! আজ তিনি নাতির সঙ্গে আনন্দ উদযাপন করবেন। প্রয়োজনীয় মসলা, তেল, লবণ, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া ইত্যাদি এসব কিছু সংগ্রহ করতেই তো চার দিন লেগেছে। অন্যথায় আগেই রান্না করে খেতেন!
পুরানো স্টিলের থালায় রান্না করা মাংস ও রুটি পরিবেশন করলেন রাবেকুন্নেসা বেগম। তিনটি রুটি নাতির পাতে রাখলেন। একটির অর্ধেক রাখলেন নিজের জন্য। বাকি অর্ধেক রাখলেন যদি নাতির আরো প্রয়োজন হয়। ভোলা মাংসের ঘ্রাণ নিয়েই আনন্দিত হয়ে খেতে লাগল। রাবেকুন্নেসা বেগম খেতে গিয়েও থেমে গেলেন। যদি নাতির অতিরিক্ত প্রয়োজন হয়? সুতরাং নাতির খাদ্যগ্রহণ দেখতে লাগলেন। যদি ভোলা আর না খায়, তাহলে এক টুকরো রুটির অংশ অথবা কিছু ঝোল থাকলে খাবেন। দাদি খাচ্ছেন না দেখে ভোলা মুখে রুটির টুকরো চিবুতে চিবুতে বলল,
—" তুই খাবু না ?"
— "খাইম তো! আগত তুই খা! মুই আলাদা করি রাখি দিছু । তোর খাওয়া হলেই মুই খাইম! "
এ শুনিয়া ভোলা হাসতে হাসতে চারটা রুটিই মাংস দিয়ে খেতে লাগল। রাবেকুন্নেসা বেগমের ভাগ্যে এক টুকরো রুটির অংশ, কিছু মাংসের ঝোল আর জুটল না। তথাপি তিনি সন্তুষ্ট। মনে মনে হাসছেন, উঠে দাঁড়ালেন। পরনের ছেঁড়া শাড়ি সঠিক করে জানলার কাছে গিয়া দাঁড়ালেন। একবার তাকালেন, টিনের ফুটো দিয়ে পানি ময়লা বালতির উপরে পড়ছে। অল্প অল্প ফোটা পানি পড়ে বালতি পূর্ণ হবার পথে। বাহিরে উত্তাল ঝ'ড়ের বাতাস। গরিবের সুবিধা এই যে, বৃষ্টির দিনে বাইরে গিয়ে বৃষ্টির আনন্দ গ্রহণের প্রয়োজন হয় না! বৃষ্টি নিজেই টিনের চালের ফুটো ভেদ করে আসে। রাবেকুন্নেসা একবার নাতির দিকে তাকান, পরবর্তীতে জানলার দিকে তাকিয়ে বাহিরের গভীর অ'ন্ধকার রাতের ঝড় দেখছেন। খিলখিল করে হেসে বলতে লাগলেন,
— "ম'রিবে, ম'রিবে, একে একে সব ম'রিবে! ও জাগিছে ! এলাই কেও তোরা বাঁচবু না !! হাহাহাহা! সব ম'রিবে !!!"
_____________________
গোধূলি বেলায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টির অবিরত শব্দে মুখরিত চারিপাশ। তবে আকাশ আজ আর কালো মেঘে আচ্ছন্ন নয়। সাদা আকাশে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। হয়তো রোদ উঠবে। কিন্তু সূর্যি মামা'কে কি আর বিশ্বাস করা যায়? এখন তো বর্ষার দখলদারি। ইচ্ছেমতো লুকোচুরি খেলে, খুশি হলে চলে যায়, আর মন বে'জার হলে পৃথিবীর বুক ভিজিয়ে দেয়। বৃষ্টির ঋতু সকলের জন্য সুখকর নয়। কথায় আছে, "কারো পৌষ মাস, কারো স'র্বনাশ।" বর্ষাকাল এর জীবন্ত উদাহরণ। বৃষ্টি হলে কেউ খিচুড়ি নিয়ে বসে বৃষ্টিবিলাসে, কেউ বা শান্তিতে ঘুমায়, কোথাওবা কপোত-কপোতীরা বৃষ্টিতে ভিজে প্রেমলীলায় মত্ত হয়। কেউ জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির কণাগুলো স্পর্শ করার চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, কেউ ঘরের ছাদ ফুটো হয়ে পানি পড়ায় একের পর এক বালতি পাতিল রাখতে ব্যস্ত। রাস্তার ধারে অসহায় মানব মানবী শুকনো আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত। মানুষের এত ঝামেলা, অবলা প্রাণীদের দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়? রাস্তার ধারে ওই ল্যাং'ড়া কুকুরটি বৃষ্টিতে ভিজে স্যাতস্যাতে অবস্থায় পড়ে আছে। তার পাশের মোড়েই এক চোখ অন্ধ বিড়ালটি, সেও বৃষ্টিতে ভিজেই মা'রা গেল। এমন ন'র'কীয় জীবনে বেঁচে না থেকে ম'রে গেল। না কি মেরে ফেলা হলো? এসবের কোনো মূল্য আছে? আজকাল মানুষের জীবনের মূল্য নেই, তারা তো অবলা প্রাণী, তাই না?
তবে হ্যাঁ,, আল্লাহ্র অশেষ রহমতের নিদর্শন বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটায় সৃষ্টিকর্তার আদেশে স্নিগ্ধতা বর্ষিত হয়, যা ধরণীর বুকে জীবন ফিরিয়ে আনে। আল্লাহ্ যখন বান্দার উপর সন্তুষ্ট থাকেন, তখনই তিনি আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যাতে সৃষ্টিকুল নবীন জীবনের সন্ধান পায়। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় রয়েছে পবিত্রতা ও ক্ষমা, যা মানবজাতির পা'পের ক'লঙ্ক ধুয়ে মুছে ফেলার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং, বান্দার উচিত এমনভাবে ইবাদত করা, যেন তার অন্তরের সকল পা'পকর্ম বৃষ্টির পানির সাথে আল্লাহ্র রহমতে পরিশুদ্ধ হয়ে যায়।
— "বৃষ্টির ধারায় রহমত আসিয়া যায়,
পাপ মুছি দেয়, হৃদয় শুদ্ধ হয়।
সৃষ্টিকর্তার দানে স্নিগ্ধতা প্রদীপ্ত,
ইবাদতের পথে শান্তি হয়ে বিরাজিত। "
এই ধীরলয়ে বর্ষিত বৃষ্টির দিনে সপ্তদশী শ্যামলাভা কন্যা আঁখি ক্লাসে বসে আছে। তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কত না চিন্তার উদয়। যদি চিন্তাধারার কোনো প্রতিযোগিতা হতো, নিঃসন্দেহে সে সর্বপ্রথম স্থান অধিকার করত। মানুষের জীবনে যখন কোনো অম'ঙ্গল আসে, তা যেন অবিরামভাবে ধেয়ে আসে, থামবার নামগন্ধ থাকে না। আপাতত আঁখি ভাবছে চুলের কাঠি কে দিল। কাউকে সন্দেহ করবার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না, কারণ সে কোনো ছেলের সাথেই, খুব জরুরি না হলে কথা বলে না। তবে কে দিতে পারে, তা কিছুতেই বুঝে আসছে না। চুল বাধার কাঠিটি তার কাছে এখন আমানতের মতোই, যতদিন না প্রকৃত মালিকের সন্ধান মেলে, ততদিন আঁখি তা নিজের নিকট রক্ষা করবে। আজও তার হিসাববিজ্ঞান শিক্ষক কলেজে উপস্থিত নন। সেদিন তিনি হঠাৎ করেই সিঁড়ি থেকে উল্টে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। হাত-পায়ে ম'র্মা'ন্তিক আ'ঘাত পেয়েছেন। নাক, মুখ ও কপাল ফে'টে গিয়ে ভ'য়ঙ্কর অবস্থা। বর্তমানে রাসেল সাহেব হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আঁখি এ সংবাদ জানার পর খানিকটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কদিনেই সে অন্তত এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে রাসেল সাহেব এক নাম্বারের ল'ম্পট। তরুণী দেখলেই তার লা'ল'সার অ'গ্নি'শিখা প্রবল হয়ে ওঠে। কলেজের বহু তরুণীকেই তিনি হ'য়'রানি করেছেন, কিন্তু তরুণীরা নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি। কারো কারো তো এমন স্থানে স্পর্শ করেছেন, যা মুখে আনতেও ল'জ্জা হয়। তবু তারা চুপ করে সহ্য করেছে, কারণ এই সমাজে নারীদের দো'ষটাই আগে ধরা হয়। প্রশ্ন উঠবে, পড়াশোনা করতে গিয়েছিলে কেন? বিয়ে করলে কি এমন হতো? আর সকলের সেই ঘৃ'ণ্য দৃষ্টি! অথচ রাসেল সাহেব, তাঁর গৃহে স্ত্রী আছেন, দুই কন্যাও আছে। এরাই সমাজের কী'ট, যারা নোং'রামি করে বেড়ায়।
ক্লাসের জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আঁখি গুনগুন করে বলছিল, পাশেই মিলি বসে তার কথা শুনছে। আঁখির বলা শেষ হতেই মিলি বলে উঠল,
— "বাহ, তুই তো বেশ ছন্দ মিলিয়ে বলতে পারিস!"
— "তেমন কিছু না!"
— "হুম, আমার এত ট্যালেন্ট থাকলে এগুলা বি'ক্রি করে খাবার খেতাম, হিহি!"
— "ধ্যাত! খাওয়া ছাড়া তোর মাথায় আর কিছু চলে না?"
— "না, না, না, খাবার আমার সব, কিন্তু সুস্বাদু খাবার হুম। এই, এই, আমার একটা গান মাথায় আসছে!"
— "কী?"
আঁখি ভ্রু কুঁচকে বলল। মিলি গলা খাঁকরি দিয়ে সুর তুলে গাইতে লাগল,
— "আমারও পরানো যাহা চায়,
খাবার চাই, খাবার চাই গোওওও।
আমারও পরানো যাহা চায়,
তুমি খাবার যদি নাহি চাওওও,
দাও আমাকে সব খাবার দিয়ে দাওওও।
আমি খাবাররে চেয়েছি,
খেতে চেয়েছি, সুস্বাদু খাবার শুধু চাইইই গোওওও।
আমারও পরানো যাহা চায়,
খাবার চাই, খাবার চাইইই গোওওও।"
মিলির গান শুনে আঁখি আর নিজের হাসি চাপতে পারল না। মুখ চেপে হেসে উঠল আঁখি। মিলি দাঁত বের করে বলল,
— "সুন্দর না?"
— "হাহাহাহা.!! তোর মতোই সুন্দর!"
— "এএএ! আমি সুন্দর?"
— "হুম, সুন্দর। অনেক সুন্দর!"
— "যাহ্, আমার মতো ভুটকি সুন্দর হয় কিভাবে?"
মিলির কথা শুনে আঁখি চোখ রাঙিয়ে তাকায়। এরপর মিষ্টি করে বলে,
—" তোকে কে বানিয়েছে জানিস তো? আল্লাহ বানিয়েছে! বুঝিস কিছু? আল্লাহর সৃষ্টি সবকিছুই সুন্দর। আল্লাহর নিকট তোকে এভাবেই সুন্দর লেগেছে, তাই তোকে এভাবেই বানিয়েছে। বুঝেছিস? আর কখনো এসব বলিস না!"
মিলি একটু চুপ করে থাকে। এরপর আঁখির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। শ্যামবর্ণা সে মুখশ্রী, সমস্বর মুখমণ্ডলে শুধু মায়া আর মায়া! মিলি নিশ্চিত যে কেউ এই শ্যামবতীকে দেখলে মায়ায় আটকাতে বাধ্য! সৌন্দর্যে মুগ্ধ তো হয় অনেকেই, কিন্তু মায়ায় ক'জন পড়ে? মিলি আঁখিকে জিজ্ঞেস করল,
— "আচ্ছা, তোর কখনো খারাপ লাগে না?"
— "কেন খারাপ লাগবে?"
— "এই যে আল্লাহ তোকে শ্যামলা বানালেন! তুই কিন্তু এমনিতেও সুন্দরী, ফর্সা হলে তো আগুনের গোলা হয়ে যেতিস! হাহাহা!"
আঁখি হেসে বলল,
— "হাহাহা! ধ্যাত পাগল, খারাপ কেন লাগতে যাবে? আমার মতে শ্যামলা বা কালো মেয়েরাই ভাগ্যবতী!"
— "কিভাবে?"
— "দেখ, সুন্দর মানুষদের পেছনে সবাই পড়ে থাকে। তাদের সত্তাকে নয়, বরং তাদের রং আর সৌন্দর্যের জন্য মিথ্যা প্রেম দেখায়। এতে তারা অনেক হয়রানির শিকার হয়। তাদের জীবনে কে আসল বন্ধু, চেনা বড় দায়। ওদের জীবনে সঠিক ভালোবাসার মানুষও খুব কম আসে, কারণ সেই পুরুষেরা তাদের সৌন্দর্য দেখেই আসে, তাদের সৌন্দর্যের জন্য মুগ্ধ হয়ে আসে, তাদের আত্মা বা মনকে ভালোবেসে নয়। সেদিক থেকে আমরা কালো মেয়েরা অনেক ভাগ্যবতী! কোনো মিথ্যা প্রেম দেখানোর মানুষ নেই। যে ভালোবাসবে , সে এই কালো রূপ দেখেই ভালোবাসবে! আমার এই আমি'টাকে ভালোবাসবে! আমার সত্তা কে,, আমার ভালো খারাপ, সব কিছুকে ভালোবাসবে! আর আমি তোদের মতো বন্ধু পেয়েছি! খুব কম কিন্তু লোক দেখানো নয়, সত্যিকারের ভালোবাসা পাচ্ছি!! সব আসল, খাঁটি! তাই আমি ভাগ্যবতী! "
এরপর আঁখি বলল,
— "সবসময় নেগেটিভ চিন্তা করতে নেই! জীবনে বাঁচতে হলে পজেটিভ চিন্তা করতে হয়!"
আঁখির এই কথা শুনে মিলি একটু চুপ করে গেল। অত:পর সে আস্তে করে বলল,
— "তুই তো অনেক কিছু জানিস রে বিলাই রাণী ! আমি তো এভাবে ভাবিনি কখনো।"
আঁখি একটু হেসে বলল,
— "ইসলাম ধর্মে মানুষকে তার বাহ্যিক রূপে বিচার করা হয় না। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সবাইকে পরীক্ষা করার জন্য এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তিনি আমাদের রূপ-রং দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের আসল সৌন্দর্য হলো আমাদের চরিত্রে, আমাদের ইমানদারিতে। আবূ হুরাইরা রদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও ধন-সম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দিয়ে থাকেন তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি।”
[সহীহ] - [এটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।] - [সহীহ ইবনে হিব্বান - 2564]
তাই তো, সৃষ্টিকর্তা যেভাবে বানিয়েছেন, সেই রূপেই আমরা সবাই সুন্দর। আর কেও যদি খালি বাহ্যিক রূপ দেখে ভালোবাসে, সেটা আসল ভালোবাসা হতে পারে না। আসল ভালোবাসা সেই যে তোর হৃদয়, তোর আত্তা, তোর চরিত্রকে ভালোবাসে।"
মিলি চুপচাপ শুনছিল, তারপর বলল,
—" তুই ঠিক বলেছিস, বিলাই রাণী । আল্লাহর সৃষ্টিকে অস্বীকার করা মানে তাঁরই অবমাননা করা।"
আঁখি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, আর মিলির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
— "হুম, তুই যা সুন্দর তোর অন্তরে, সেভাবেই সুন্দর বাইরে। আল্লাহ্ তোকে যেমন বানিয়েছেন, তুই সেই ভাবেই সেরা!"
মিলি এবার শ্যামবর্ণা আঁখির নরম তুলতুলে গালে টিপে বলল,
—" হয়েছে হয়েছে, বিলাই রাণী! আর জ্ঞান দিস না! নয়ত আমি তোর জ্ঞান শুনে অক্কা পাবো! হাহাহা! এখন বল তো, ঝালমুড়িটা আসলো না কেন?"
— "আমিও তো তাই ভাবছি! আছিয়া কেন আসলো না?"
—" কে জানে! কালকে আসলে জানা যাবে!"
——————
শান্ত গুণধরে গোলাপী রঙের ক্ষুদ্র পুতুল ধারণ করে অগ্রসরমান হচ্ছে আঁখির শূন্য কক্ষে। অনুজ্ঞা ব্যতীত পরের কক্ষে প্রবেশ অশোভন, কিন্তু শান্ত কিরূপে এটা অনুধাবন করবে? অধরে কৌতুকমিশ্রিত বি'ভংগসহ অগ্রগতি করছে পুতুল হাতে। কক্ষে প্রবেশ করেই একবার চতুষ্পাশে চক্ষু নিক্ষেপ করিল! সমগ্র কক্ষ যেন অঙ্কিত অলঙ্করণে ভরপুর! শান্তর চিন্তাধারায় আসে না, এটা আঁখি কী লাভার্থে করে থাকে? কোথাওও চড়ুই পাখি অঙ্কিত, কোথাও সূর্য, কোথাও জন্মদিনের কেক! আরও আরও কত কী! মেয়েটি যা অঙ্কিত করে, যেন শিশুসুলভ প্রবৃত্তি! কিন্তু স্বীকার করতে হবে, যাই অঙ্কিত করে, সুষ্ঠু অঙ্কিত করে। তথাপি, শান্তর আজকার গমন অন্য উদ্দেশ্যে।
করতলে ধারণকৃত ক্ষুদ্র ও মনোহর পুতুলটি আঁখির টেবিলে স্থাপন করল শান্ত। একবার উচ্চকণ্ঠে অট্টহাস্য করে বলল,
— "এবার দেখব তোর গোপনীয়তা কোন পথে যাত্রা করে! আমাকে তোর ব্যাক্তিগত ব্যাপার দেখাতে এসেছিলি তাই না ? এবার আর তোর কোনো কিছুই আমার সামনে ব্যাক্তিগত থাকবে না, আড়াল থাকবে না... হাহাহাহা!"
পুতুলটির নেত্রে ক্ষুদ্র ক্যামেরা সন্নিবেশ করিয়েছে শান্ত, এবং এর জন্যই তার অন্তঃকরণ উল্লাসে পূর্ণ। এরপর আঁখির কক্ষ ত্যাগ করে সে এক শ'য়তানি হাস্য সহকারে বলল,
— "শান্তর সাথে ত'র্ক করার ফল, সারাজীবন তোকে ভোগ করতে হবে!"
সুদূর লোকালয় হতে বিচ্ছিন্ন একপ্রান্তে, চারিদিকে কোনো গৃহকুটির চিহ্নমাত্র নেই, মানবের কোনো চিহ্ন যেমন অনুপস্থিত, তেমনি নিঃসঙ্গ। শ্যামলাভূমি ভিজে শ্যাতশ্যে হয়েছে, ভিজা মাটির উপর পিলপিল করে পোকামাকড় বিচরণ করছে। সেই নীরব প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে শান্ত, অপেক্ষায়। দন্তাবলীতে দন্ত চেপে, কর্ণে ফোন ধরে কণ্ঠে অ'শ্লী'ল উক্তি করল,
— শা*লা,, বা*ই*ঞ্চ*ত! তুই আমায় ডেকে নিজেই কই উধাও হইলি? জানিস না, এখন আমার জিএফ এর সাথে দেখা করার সময়! শা*লা! রাখ! আমি চললাম!
শান্ত, কু'খ্যাত কা'মুক, নারীর প্রতি তার আকর্ষণ অনিবার্য। ম'দ্য'পানে আসক্ত এবং নারীর সহিত শয্যাশায়িত হবার নেশা তার নিত্য অভ্যাস। শান্তর বন্ধুর আহ্বানে এই নির্জনে উপস্থিত হয়েছিল, যেখানে তাদের আড্ডা জমে থাকে। ইচ্ছে ছিল তার প্রণয়িনীর সহিত বিলাসিতায়। কিন্তু বন্ধুর ফোন তার সমস্ত মনোভাব বিনষ্ট করে দিয়েছে। এক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সম্মুখের পথে অগ্রসর হতে লাগল।
ঠিক তখনই, হঠাৎই পেছন হতে কেও ধাম করে এক অজানা আ'ঘাত এসে শান্তর মাথায় সজোরে আ'ঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে শান্তর মস্তক হতে ভলভলিয়ে র'ক্ত প্রবাহিত হতে লাগল, শান্ত লুটিয়ে পড়ল র'ক্তা'ক্ত মস্তক সমেত, মুহূর্তেই তার চেতনা লোপ পেল নির্জন সে স্থানে।
-----
— "চমকের জ্ঞান সূর্যের রোশনাই,
জানো কি তোমরা ওই,
পাখি উড়ছে ডানা মেলে
তোমার খবর কই?"
গুনগুন করতে করতে গৃহমুখী পথে অগ্রসর হচ্ছে ক্ষুদ্র দেহের সপ্তদশী কন্যা আঁখি। এখন বৃষ্টি রহিত, আকাশ পরিস্কার ও দীপ্তিমান! তথাপি মাটির পথ পিচ্ছিল অতি। সাবধানতার সহিত অগ্রসর হচ্ছে আঁখি। হস্তে রুমাল ঘূর্ণায়মান অবস্থায় যাত্রা করছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত—যেকোনো ঋতুতেই তার ছোট্ট সরু, বুচি নাসিকা সর্বদা ঘর্মাক্ত থাকে, যাতে সে অতি বিরক্ত। "নাসা কেন ঘর্মাক্ত হবে?" এই প্রশ্ন তার মনে সর্বদা জাগ্রত। এই কারণে রুমাল সর্বদাই তার সঙ্গী থাকে, নাসার উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘাম মোচনের নিমিত্তে।
তখনি হুট করেই খেই হারিয়ে পথ চলতে চলতে পিচ্ছিল মাটিতে হঠাৎ ধপাস করে পিছলে যেতে যাচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ তার নরম করাঙ্গকে দৃঢ়ভাবে ধরে ফেলল এক নারীর শক্ত হাত। আঁখি তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল; সুন্দরী রমণী! শুভ্র কান্তি গালে এক ক্ষত চিহ্ন বিদ্যমান। তার মস্তকে অতি র'ক্তিম লাল সিদূর, কপালের পার্শ্বে লেপ্টিয়ে রয়েছে কিছুটা। আঁখি উনাকে চিনে; উনি রাধিকা, এই গ্রামেরই কন্যা , বিয়েও হয়েছে এই গ্রামেই প্রায় কয়েক বৎসর পূর্ণ হয়েছে। এর পূর্বে দেখলেও বাক্যালাপ হয় নি কখনো । রাধিকা আঁখির কর হস্ত দৃঢ়ভাবে আঁকড়েই ধরে আছে । আঁখি রাধিকার হস্ত হতে নিজ হস্ত মুক্ত করে লঘু হাস্যে বলল,
—" ধন্যবাদ, বৌদি! আপনি না থাকলে এখনি পরে যেতাম!"
রাধিকা নীরব থাকলেন। তার দৃষ্টি আঁখির প্রতি নিবদ্ধ। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন আঁখি কে! আঁখির পরিধানে রয়েছে ঢিলেঢালা আকাশবর্ণ থ্রি-পীস। অতি ক্ষীণ দেহে মাংসের অভাব, মনে হয় পোশাকটিই খুলে যাবে। চিকন দেহে বড় ওরনাই একমাত্র আবরণ; কেবল ছোট গোলগাল মুখই প্রদর্শিত। তবে শরীরের অসহায় অবস্থা প্রকৃতপক্ষে দৃশ্যমান। এই মেয়ে বড়লোক বাড়ির সন্তান বলে বোঝা যায় না; যেমন চালচলন তেমন সাবলীল ভাষা। রাধিকার দৃষ্টি স্থির রইল আঁখির শ্যামবর্ণ মুখশ্রীতে আঁখি অস্বস্তি বোধ করতে লাগল রাধিকার নীরবতার নিকটে। তার হাসি ক্রমে মিলিয়ে গেল।
রাধিকা তখন আঁখির প্রতি কঠিনস্বরে বলল,
— "নিজ দায়িত্বে চলতে শিখো, সর্বদা কেও তোমাকে রক্ষা করতে আসবে না।"
আঁখি বিস্ময়ে তাকাল, এটা কেমন কথা? আঁখির কোনো কথায় কি রাধিকা ক্রু'দ্ধ হয়েছে? তার মনে তো এমন কিছু আসল না যাতে রাধিকা ক্ষু'ব্ধ হতে পারে! রাধিকা নিম্নস্বরে পুনরায় বলল, কিন্তু তা আঁখির কানে পৌঁছিল না,
— "তুমি অনেক সুন্দরী!"
— কিছু বললেন বৌদি?
— "তোমার চোখ দুটি বড় সুন্দর!"
—" জ্বী?"
তখন রাধিকা কণ্ঠস্বর উচ্চ করে বলল,
— "এই ডাগর ডাগর চোখ দিয়েই সকলকে জব্দ করছো বুঝি?"
আঁখি বিস্মিত, হতভম্ব হয়ে রাধিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করল! কী কথা বলছে রাধিকা? তার কোনো জব্দের কাহিনী কি আছে? এ ধরনের কাজ তো আঁখির পক্ষে করা অসম্ভব! কল্পেও এ ধরনের চিন্তা আসে নি আঁখির। আঁখি যখন অবাক নেত্রে তাকিয়ে তখন রাধিকা আঁখির শ্যামল কোমল মুখে স্পর্শ করে বলল,
— ভাগ্যবতী দেখার আকাঙ্ক্ষা ছিল; তোমাকে দেখে তা পূর্ণ হলো!
আরাফ, প্রতিদিনের মতো আজও আঁখিকে দূর হতে গোপনে পর্যবেক্ষণ করছিল। মুগ্ধের জটিল অবস্থা পূর্বের ন্যায় আর অবশিষ্ট নেই; পরিবার এখন সঠিক নিয়ন্ত্রণে আছে। অতএব, আহারবিহীন আরাফ তাড়াহুড়ো করে ছুটে এসেছে কেবল প্রেয়সীর এক পলক দৃষ্টিপাত লাভ করার আশায়। যখন আঁখি পিছলিয়ে মাটিতে পতিত হবার উপক্রম হলো, আরাফ সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাকে ধরবার নিমিত্তে ছুটল, কিন্তু রাধিকা ততক্ষণে আঁখিকে ধরে ফেলেছিল । ফুস করে নিশ্বাস ত্যাগ করল আরাফ, এই ছোট্ট মেয়েটাকে ছাড়া তার জীবন অচল, ওকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব!
প্রতিদিনের ন্যায় আজও তার হৃদয়হরণী'কে এক পলকের জন্য না দেখলে যেন তার শ্বাসরু'দ্ধ হয়ে আসে। বেঁচে থাকতে হলে একপলক, এক সেকেন্ডের জন্য হলেও দেখা চাই! আঁখি ধীরে ধীরে দূরবর্তী পথে অগ্রসর হতে লাগল, আর রাধিকা বিপরীত দিকে চলে যাচ্ছে। তখন আরাফ দ্রুত দৌড়ে গিয়ে আঁখির পূর্বতন অবস্থানে উপস্থিত হলো, দেখল যে একটি শুভ্র রুমাল কর্দমাক্ত মাটিতে পরে আছে । আঁখির হাত ফসকে রুমাল টা পরে গিয়েছে, পিছলে পরার সময় । আরাফ একবার পিছু ফিরে দেখল; আঁখি নিঃশব্দে নিচের দিকে দৃষ্টিতে পথ অতিক্রম করছে, আশপাশে কে আছে, তা অনুধাবন করছে না। কেও তার পাশ দিয়ে গেলেও বোধহয় টের পাবে না, কে গেলো!! সবসময় মাথা নিচু করে হাটার অভ্যেস তার।
পুনরায় সামনে ফিরে আরাফ মাটির উপর পরে থাকা রুমাল তুলে নিলো। কিছুক্ষণ সেই রুমাল নিঃশব্দে দর্শন করল, তারপর ধীরগতিতে বুক পকেটে সেই কর্দমাক্ত রুমাল রাখল । এটা তার হৃদয়ের নিকটে স্থান পেলো, কেননা রুমালটি তার প্রেয়সীর স্মৃতিবিজড়িত। তাতে আঁখির ঘর্মাক্ত চিহ্ন আছে, যা আরাফের নিকট অমূল্য। তার অধরে মৃদু হাস্য উদ্ভাসিত হলো, এবং সে হাসপাতালের পথ ধরে চলে যেতে লাগল।
পথিমধ্যে তিন তরুণ যুবক তার পাশ কাটিয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ আরাফ থেমে গেলো। যুবকদল যে পথে যাচ্ছে, সেই পথেই আঁখিও যাচ্ছে। যদি একা আঁখি কে পেয়ে উত্য'ক্ত করে? এই চিন্তায় আরাফের অন্তর উদ্বিগ্ন হলো। সুতরাং, আরাফ পিছনে ঘুরে শক্ত কণ্ঠে আহ্বান করল,
— "এইইই, দাঁড়াও!"
যুবকগণ তৎক্ষণাৎ পিছু ফিরে ভ্রু কুচকে আরাফের দিকে দৃষ্টিপাত করল। আরাফ কঠোরভাবে জিজ্ঞাসিল,
— "ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?"
তাদের মধ্যে একজন বলল,
— "বাড়ির পথে, কেন ভাইজান?"
আরাফ ধীরে পকেট হতে মানিব্যাগ বের করে ১০০০ টাকার চকচকে নোট বের করল তাদের দিকে বাড়িয়ে বলল,
— "তোমাদের দেখে আমার ছোট ভাইয়ের কথা মনে পরে গেলো! বড় ভাই হিসেবে তোমাদের দিচ্ছি, কিছু খেয়ে নাও, আর এক্ষুনি খেয়ে নাও , বাড়িতে পরে যেও ।"
তরুণগণ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হলো। তাদের বিস্ময়ের মাত্রা চরমে পৌঁছাল, কিন্তু কিছু না বলে হা করে নির্জীবভাবে দাঁড়িয়ে দেখছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বাটে বলিষ্ঠ দেহের ক্লান্ত মুখশ্রী তে দাঁড়িয়ে থাকা, ছাই রঙা শার্ট পরিহিত সুদর্শন পুরুষের পানে! আরাফ পুনরায় মানিব্যাগ হইতে আরেকটি ১০০০ টাকার নোট বের করল। একজন বলে উঠে,
— " কিন্তু ভাই,,,,"
আরাফ আরো একটি এক হাজার টাকার নোট বের করে দিলো! এবার যেন ছেলেগুলার চোখ চকচক করে উঠল, যেন হাতে সোনা পেল, তাদের মধ্যে যুবকেরা পরস্পর কানে কানে বলল,
— "মামাহ,, চল, নিয়ে নেই ! এই পাগলের মাথা খারাপ! আজ পার্টি হবে চল।"
ছেলেগুলো হেসে উল্লসিত হয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে অর্থ গ্রহণ করে দূরে উল্টো পথে চলে গেল। আরাফ জানে, এ কাজ অনুচিত ছিল, অর্থ দ্বারা সে তাদেরকে সঠিক পথে আনয়ন করে নি, কিন্তু যখন প্রসঙ্গ আঁখির, তখন সে সর্বপ্রকার পন্থা অবলম্বনে প্রস্তুত। এখন আঁখিকে একাকী পথ চলতে দেওয়া অনুচিত। আঁখি যখন বাড়িতে নিরাপদে পৌঁছাবে, তারপরেই আরাফ হাসপাতালের দিকে যাবে। তদপেক্ষা আরাফ আঁখির পিছু পিছু ধীরগমনে চলতে লাগল; যা তার সবসময়ের কাজ । আঁখি অবগত নয় যে, দূর হতে তাকে একজন নিরবছিন্নভাবে সুরক্ষা দিচ্ছে, নিঃশব্দে তার রক্ষক হয়ে উঠেছে।
-------
হাসপাতালের পরিবেশ যেন রীতিমতো মাছের বাজারে পরিণত হয়েছে। মুগ্ধর অসুস্থতার সংবাদে বংশের অর্ধেক লোক ভিড় জমিয়েছে, ফলে দম ফেলারও উপায় নেই। বৃদ্ধ আম্বিয়া বেগমকে সকালেই পাঠানো হয়েছে, কারণ নাতির দুঃ'খে তিনি নিজেও অ'সুস্থ হওয়ার উপক্রম। সাথে নিসা বেগমকেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আছিয়াকে যাওয়ার কথা বললেও সে যায়নি। এত লোক দেখে মোশারফ সাহেব বির'ক্ত হয়ে সবাইকে ধমক দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়ে বললেন,
— "সবাই বাড়িতে যাও! এটা কি বিয়ে বাড়ি নাকি!"
সকলেই মুখ কালো করে একে একে বেরিয়ে যেতে লাগল। যেন দুঃখের মুহূর্তেও পাশে থাকা যায় না! তখনই মুগ্ধর ফুফু ফায়জা বেগম এগিয়ে এসে ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন,
— "ভাই, এসব কীভাবে হলো?"
— "তোর ভাতিজাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর!"
— "আহহ! এভাবে বলছ কেন? আমার মুগ্ধ..."
— "তোকে বলেছি, এই বকবক বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে মাকে সামলা! এখানে কী ভিড় করছিস? যা বাড়ি যা!"
ফায়জা বেগম, দুই সন্তানের মা, তাকেও এভাবে ধমকে পাঠাচ্ছেন মোশারফ সাহেব! তার এই বড় ভাই তো রাগী, আর তার ছেলে মুগ্ধ, সে তো আরও এক ধাপ এগিয়ে! ফায়জা বেগম বির'ক্ত হয়ে মুখ বাকিয়ে চলে যেতে লাগলেন। একে একে লোকজন কমতে শুরু করল। ঠিক তখনই এক লম্বাটে গড়নের চঞ্চল, ক্ষীণকায়, সুদর্শন পুরুষ, হেলেদুলে ভিড় ঠেলে এসে হাজির হলো। তাকে দেখেই মোশারফ সাহেব ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
— "পুরনো পাগলের ভাত নাই, নতুন পাগলের আমদানি!"
পরনে খয়েরি রঙের শার্টে সজ্জিত, নিম্নদেশে সাদা-কালো প্রিন্টের লুঙ্গি, পদযুগলে চামরার জুতো, ফর্সা গাত্রবর্ণের ক্লিন শেভ রোহান, চক্ষুযুগলে কালো চশমা সামান্য সরিয়ে লুঙ্গির এক প্রান্ত ধরে উদ্বিগ্নভাবে অগ্রসর হয়ে মোশারফ সাহেবের সম্মুখে এসেই ভান নিয়ে বলল,
— "চাচাহহহ! নো টেনশন, আই এম হিয়াররর! ডোন্ট বি ফিয়াররর! আমি আমার বন্ধুকে কিছু হতে দেব না!''
মোশারফ সাহেব তীব্র কণ্ঠে বললেন,
— "তাহলে ডাক্তারের কাছে কেন আনলাম? তোমার কাছে নিয়ে গেলেই তো হতো!"
— " ইয়েস, ইয়েস! কিন্তু চাচা, আমার বন্ধু কই? বন্ধু আমার অসুস্থ—এ শোক কেমনে সই! ওয়াহ ওয়াহ! কি শায়েরি হলো, তাই না চাচা! আমি রোহান, শায়েরি কবিতা হাজার হাজার মানুষ আমার কাছে শিখতে ভীড় লাগায়,, but, but, but, আমার এত সময় কই? I'm so busy handsome boyy! আমার মতো টেলেন্টেড মানুষ আপনি খুব কম দেখবেন! আর খোজ নিয়ে জেনে নিয়েন যারা পারে, ওরাও আমার থেকে শিখে গিয়েছে! আসলে রোহান দ্যা গ্রেট, সব দিক দিয়েই পারফেক্ট! হাহাহা! "
মোশারফ সাহেব, ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়ে, চিৎকার করে বললেন,
— " এইইই চুপপপ!!! আমার সামনে আর আসবে না! যাওও এখান থেকে, বা'চাল ছেলে কোথাকার!"
মোশারফ সাহেব তীব্র রো'ষে মুখ বেঁকিয়ে চললেন, আর তার পিছু পিছু রোহান, একখণ্ড হেলাপাওয়া হাস্যরস নিয়ে চশমায় ফুঁ দিয়ে চোখে জড়িয়ে বলল,
— "হাহ,, জেলাস! জেলাস! রোহানকে দেখে সকলকে জেলাস হতেই হবে! কারণ এমন প্রতিভাবান, হ্যান্ডসাম পুরুষ আর দ্বিতীয় নেই!"
রোহান রংপুর শহরে জরুরি কাজে গিয়েছিল, সেজন্য মুগ্ধের আগমনের দিনে সে উপস্থিত থাকতে পারেনি। আজই ফিরল এবং আসতেই শুনল মুগ্ধ হাসপাতালে। শুনেই ব্যস্ত হয়ে এক দৌড়ে এসেছে এখানে। পথে আফ্রিদিকে ডাকলেও, সে তার কাজে ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে আসতে পারেনি। রোহানের মন বুঝে না! বন্ধুর অসু'স্থতার সময় কোন কাজ এতই গুরুত্বপূর্ণ!
তখনি আরাফ এসে উপস্থিত হলো। সাজ্জাদ সাহেব ডাক্তারের সাথে কথোপকথন করছিলেন। ডাক্তার বলেছেন, দুই-তিন দিনের মধ্যে মুগ্ধকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। ইন্সপেক্টর নিয়াজও কনস্টেবলসহ উপস্থিত হয়েছেন। রাতের পাহারাদার পরিবর্তন করে সকালবেলায় অন্যজন দায়িত্ব পালন করছে। এখন নিয়াজ সাহেব এসেছেন নতুন পাহারাদার রেখে মুগ্ধের পরিস্থিতি জানতে। আরাফকে দেখে রোহান মিটিমিটি হেসে বলল,
—" আরেএএ আরুওও! কি খবর রে মামা! শুকিয়ে মরুভূমির মত হয়ে গেছিস! আহহা, চিন্তা করিস না! আমি তো এসে গেছি!! আমার বন্ধুত্বের অমর শক্তিতেই মুগ্ধ সেরে উঠবে! হেহেহে!!"
আরাফের মনে গভীর ক্রো'ধের সঞ্চার হলো। এই ছেলেটা সবকিছুরই অদ্ভুত নামে ডাক দেয়! এই তো তার সুন্দর নামটাকে আলুর ভর্তা বানিয়ে দিলো। আবার তার নিজের মাহাত্ম্য গাওয়ার শেষ নেই!
ঠিক তখনই মুগ্ধের কেবিন থেকে সুহানা বেগম চিৎকার করে মুগ্ধকে ডাকতে লাগলেন। ইন্সপেক্টর নিয়াজ, আরাফ, রোহান, মোশারফ সাহেব ও সাজ্জাদ সাহেব সকলে সেই ডাক শুনে বিষ্মিত হয়ে উঠলেন। সুহানা বেগমের চিৎ'কারের তীব্রতা ক্রমশ বেড়েই চলছে! মুহূর্তমাত্র দেরি না করে সকলেই এক দৌড়ে সেদিকে ছুটে গেলেন।
শুধুমাত্র রোহান এক মুহূর্ত বিলম্ব করে চক্ষুযুগলের চশমা সঠিক করল, শার্টের বাহুডোর গুটিয়ে নিয়ে, লুঙ্গির এক প্রান্ত করতলে ধারণ করে, ক্লিন সেভ দৃঢ় চোয়াল শক্ত করে, স্লো মোশানে দৌড়াতে শুরু করে উচ্চারণ করল,
— "ওহহ নোওও! এখন আমাকে ছাড়া কিছুই ঠিক হবে না! ডোন্ট ওয়ারি মধু, আমি আসছিইইই!.!!!"
রোহান কেবিনে প্রবেশ করে দেখল, সকলেই নীরবতা ধারণ করে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে! এমন দৃশ্য দেখে রোহানের ভ্রু কুঞ্চিত হলো; তার মনে হচ্ছে, এ যেন মৎস্যকীটসম, নিঃসন্দেহে ব্যাঙের মতো স্তব্ধ হয়ে রয়েছে প্রত্যেকেই। চক্ষুযুগলের চশমা সামান্য ঠেলে সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল শয্যার দিকে। মুগ্ধ কোথায়? চারিপাশে দৃষ্টি ফেলে কোথাও তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারল না। মনের মধ্যে উদিত হলো যে, বোধ হয় ওয়াশরুমে গমন করেছে তার বন্ধু মুগ্ধ!!
সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশরুমের দ্বার খুলে রোহান রঙ্গরসিক ভঙ্গিতে উচ্চারণ করল,
— " টুকি, আমি এসে গেছি!"
কিন্তু সেখানেও মুগ্ধ অনুপস্থিত! কোথায় উধাও হলো সে? মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে রোহান দু হাত মস্তকে রেখে, নাটকীয় ভঙ্গিতে চক্ষু বি'স্ফ'রিত করল। তার এই প্রহসনমূলক আচরণে আরাফের নিঃশ্বাস ক্রু'দ্ধভাবে ফুঁসে বের হলো; শুরু হলো রোহানের অভিনয়। মনে মনে আরাফ ভাবল, যদি না সে তার বড় ভাইয়ের বন্ধু হতো, কতবার যে তার পিঠের চামড়া খুলে রাখত !
সুহানা বেগম পুনরায় আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে অ'শ্রুসি'ক্ত হয়ে পড়লেন। আছিয়া নিশ্চুপ অবস্থায় দাঁড়িয়ে। গোটা কক্ষ যেন স্তব্ধতায় নিমজ্জিত।
এদিকে রোহান অনবরত কক্ষের চারিপাশে গোলাকার ভঙ্গিতে ঘুরতে লাগল, বলয়া উঠল,
— "Where is my বন্ধু? মুগ্ধ? মুগ্ধ?? Are you angry with me? হেইইই মধুউউউ! আই এম হিয়ারর প্লিজ কাম হেয়াররর ! ওয়াহ, ওয়াহ! আবারও কেমন সুন্দর শায়েরি বললাম! আমি তো আসলেই টেলেন্টেড! সাব্বাস, রোহান!"
নিজের বুকে নিজেই চাপড় দিতে দিতে রোহান সাবাশি জানাতে লাগল, যেন সে নিজেই কোনো রহস্য উদ্ঘাটনের মহানায়ক। মোশারফ সাহেবের সহ্যশক্তি যেন শূন্যের কোঠায় পৌঁছাচ্ছে; ইচ্ছা করল ঘা'ড় ধা'ক্কা দিয়ে এই পা'গ'লটাকে কক্ষ হতে বের করে দেন। মন ভাবল, "কিসব পা'গল-ছা'গল বন্ধু বানিয়েছে তার পুত্র!" অন্যদিকে সাজ্জাদ সাহেব অবিরামভাবে তাকে শান্ত হবার অনুরোধ করছিলেন। যতই হোক, মুগ্ধর বন্ধু তো! ওকে কিছু বললে পরবর্তীতে মুগ্ধ জেনে ফেললে আরেক নতুন ঝা'মে'লার সূত্রপাত হবে। মুগ্ধর রা'গ সামাল দেওয়া এমনিতেই কঠিন, আর তার বন্ধুর সাথে সম'স্যা বাঁধালে সেই আ'গুনে ঘি ঢালা ছাড়া আর কিছু হবে না। তাই বাধ্য হইয়া মোশারফ সাহেব নীরব রইলেন, মনে মনে বির'ক্তি চেপে রাখলেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে ইন্সপেক্টর নিয়াজ দৃপ্ত পদক্ষেপে রোহানের দিকে অগ্রসর হলেন । রোহান তার আগমন লক্ষ্য করেই তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
— " উম, স্যার! Do you know, where is my বন্ধু? প্লিজ, প্লিজ, calm down! আমি এখন এসে গেছি,,, আর কিছু হবে না এখন । মুগ্ধ আমার কথা ছাড়া এক পাও নড়বে না! আমরা ছোটবেলার বন্ধু, আর ছেলেবেলা থেকেই মুগ্ধ আমার বড় ভক্ত! সে আমার কথামতোই সবকিছু করে! এতদিন দেশের বাইরে ছিলো, এসে আমাকে পায় নি তাই রা'গ করেছে! ছেলেটা আমার ফেন তো তাই অভিমান করেছে! আমি বুঝি ওর অভিমান ! আমি অবশ্যই আমার বন্ধুর রা'গ ভাঙাবো আমার শায়েরি শুনিয়ে! দেখবেন, শুনেই আর একমুহূর্ত রা'গ করে থাকতে পারবে না! আহহাহাহাহ!! "
রোহান কিছুক্ষণ থেমে গুনগুন করতে করতে আবার বলে উঠল,
— " ওহ, ওহ! সরি, সরি, স্যার! আমাদের বন্ধুত্বের গল্প বলতে বলতে একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম, তা আমি কি যেন বলছিলাম..."
ইন্সপেক্টর নিয়াজের রা'গ ক্রমশ স্ফী'ত হয়ে উঠল; মনে হলো যেন তার কান দিয়ে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। ইচ্ছা করছে , পি'স্ত'ল বের করে রোহানের মুখ বরাবর গু'লি করে তাকে চিরতরে নীরব করিয়ে দিতে ! শা'লা'র দুই মিনিটেই মাথা খা'রা'প করিয়ে দিল! প্রজ্জ্বলিত ক্রো'ধে কাঁপতে কাঁপতে, নিয়াজ সাহেব রোহানের কাঁধে শক্ত করে হাত রাখল, মুখে এক ঠাণ্ডা অথচ রাগান্বিত হাসি ফুটিয়ে বলল,
0 Comments