Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ২৬

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
*
*
বিশাল আকারের পালঙ্কে শান্ত শায়িত, তার বলিষ্ঠ দেহে শুধুমাত্র পরম উ'ষ্ণ'তার চাদর অর্ধাংশে ঢেকে রয়েছে, পাশে রয়েছে আজকের রাত্রির ভো'গ্যা। উভয়ের চাহিদা তৃপ্ত হয়ে ধীর জি'হ্বায় এক অচেনা ক্লান্তির ছোঁয়ায় এক প্রান্তে বিশ্রাম নিচ্ছে। শান্ত উঠে ধীরে ধীরে পাশের টেবিল হতে সিগারেট উঠিয়ে নেয়। প'তি'তা নারী নিঃশব্দে লাইটার প্রজ্বলিত করে দেয়। শান্ত ধূমপানের মেঘ নিক্ষেপ করে নারীর মুখমণ্ডলের দিকে। মেয়েটি মৃদু হাসি হাসল, যেন সমস্ত পৃথিবীর নি'কৃ'ষ্ট'তা সে পেরিয়ে গিয়েছে।
অন্তরালে হঠাৎ দরজায় অতি মৃদু, কিন্তু নির্ভুল শব্দ। শান্ত ধূমপান চলমান রেখেই তার গম্ভীর কণ্ঠে নির্দেশ দিল,
——— "যা! দরজা খুলে দে।"
——— "এখন কে এলো?"
নারীটি কৌতূহলী। কিন্তু তার এই প্রশ্ন সহ্য করা শান্তের জন্য কঠিন হয়ে উঠল। একদমে সে পা'ষা'ণ পা দ্বারা মেয়েটির পাঁজরে আ'ঘা'ত করল, দন্তব্যগ্রে ক্রো'ধের দ্যুতি ছড়িয়ে বলল,
——— "আমার সম্মুখে কথা বলার সাহস তোর হয় কীভাবে? যা দরজা খুল!"
মেয়েটি দ্রুত একটি চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে নিল, কিন্তু শান্তর মুখে তখনও সেই নি'ষ্ঠুর হাসি। খিঁচিয়ে বলল,
——— "তুই আবার ঢাকবি কি? যা দেখার, সবই তো দেখা শেষ!"
খেক করে হাসল, সিগারেটটি নিঃশেষ করে মদের গ্লাস তুলে নিল। দরজা খুলতেই ইয়াসিন প্রবেশ করল। শান্তের অর্ধ উ'ল'ঙ্গ দেহ দেখেও একগ্লানিবিহীনভাবে পাশে বসে পড়ল। মেয়েটি পুনরায় শান্তের পাশে শরীর সেঁটে বসল। শান্তর চুলে মৃদু স্পর্শ করতে লাগল।
ইয়াসিন বলল,
——— "ডেকেছিস কেন?"
——— "এত কিছুর পরও প্রশ্ন করছিস? ওই মেয়েটার খোঁজ দে আমাকে।"
———"কোন মেয়ে?"
শান্ত হাসল, এক নি'র্ম'ম অভিজ্ঞতার গভীরে নিমজ্জিত হয়ে,
——— "নাটক করিস না। আমি নাটকের পরিবারে বড় হয়েছি। কে নাটক করে আর কে সত্য বলছে, তা ভালো করে জানি আমি। ভালোয় ভালোয় বল!"
———"ও এই নিষিদ্ধস্থানেরই এক নারীর সন্তান।"
শান্তর পাশে থাকা সেই নারী মৃদু হাসি সহকারে কটাক্ষ করে বলল,
——— "টাটকা। এখনো কাউকে দে'হ দেয় নি।"
এটা শুনতেই শান্তের চোয়াল শক্ত হল শান্তর। অপ্রতিরোধ্য ক্রো'ধে সেই নারীর মুখে একে বারে তীব্র আ'ঘা'ত করল, নর'কস্পর্শী চ'র মারল, যার সুর তীব্রভাবে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হল। শান্ত নারীর চুলের মুঠি আকস্মিক টান দিয়ে, নিম্ন কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
———"এত সাহস তোর? আমার সামনে দাঁত বের করছিস?"
একটি আকস্মিক ঝটকায় তাকে দূর করল, ইয়াসিনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করল,
——— "নাম কী?"
——— "রিমি,"
ইয়াসিন বলল। শান্ত এক নি'ষ্ঠু'র ব্যঙ্গোক্তি সহকারে হেসে উঠল, বলল,
——— "রিমি? এতদিন পর্যন্ত কোথায় ছিল? এর সঙ্গে তোর কি কোনো গো'প'ন সম্পর্ক আছে?"
ইয়াসমিন মুখের কথার গতি হারিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
——— "না, কিছুই নেই! কিছুই না!"
শান্ত হস্তে মদের গ্লাস থেকে হালকা চুমুক দিয়ে অট্টহাস্যে বলল,
———— "থাকলেও লাভ নেই! আমার শয়'নস'ঙ্গি'নী হওয়ার এত সখ তার? আমার বাবার সামনেও মিথ্যা বলিস? হাহাহা! সমস্যা নেই! আমি তার স্বপ্ন পূর্ণ করব। তাকে আমার চাই। তাজা মাল, মজাই আলাদা! যা, তাকে নিয়ে আয় আমার কাছে।"
ইয়াসমিন দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে মাথা নোয়িয়ে অগ্রসর হল, অনিশ্চয়তায় গ্রস্ত হয়ে বাহিরে চলে গেল। শান্ত তার পাশের সেই নারীর প্রতি লক্ষ্য করে বলল,
——— "তোকে কি আলাদা করে বলতে হবে?"
মেয়েটি নিঃশব্দে শান্তের সম্মুখে ন'গ্ন দেহে বস্ত্র পরিধান করতে লাগল, অত:পর বিদায় নিলো। এটা শান্তর দৈনন্দিনের অংশ। শান্ত ধীরে ধীরে হস্ত-পদ মুচড়িয়ে এক প্রচ্ছন্ন হিংস্রতায় হাসতে হাসতে বলল,
——— " শা'লা'র মানুষের অস্তিত্ব দেখলেই র'ক্তগরম হয়! মনে হয় যেন ত'লোয়া'রের আ'ঘা'তে মস্তক পৃথক করে দিই! শা'লা'রা একেকজন মুখোশধারী শিল্পী—ভিতরে ন'ষ্ট, প'চ'নশীল আত্মা, আর বাইরের আবরণে সজ্জিত মিথ্যের ঝলকানি। তোরা কি ভেবেছিস, আমি তোদের অন্তঃসারশূন্যতা বুঝতে পারি না? হা হা হা! আমি তোদের বি'কৃ'ত জগত স্পষ্ট দেখি, যে ন'র'কের স্থপতি তোরা-ই। সবই তো ফাঁকি, নিরর্থক প্রতারণা। গি'লে খাবো একদিন তোদের!
___________________
জীবন চরম বিরক্তি নিয়ে আসনে বসে । ইচ্ছে করছে সম্মুখে থাকা কন্যাটির মুখে এক প্র'হা'র করে দাঁত ভেঙে ফেলতে । কী নি'র্ল'জ্জ'তার সহিত দাঁত দেখিয়ে হাসছে সে! আছিয়া, যখন হতে এসেছে, তখন হতেই বসেই আছে। দুই গালে হাত রেখে, স্থির দৃষ্টিতে জীবনকে নিরীক্ষণ করছে এবং ক্রমাগত হাসছে।
এখন জীবনের কী উপায় রইল, এই উ'ন্মত্তা বালিকাটিকে কিরূপে বুঝাবে যে, এই স্থান একটা শপিং মল, এবং তারও অধিক, যেই স্থানে জীবন পরিশ্রম করে, তা পুরুষগণের জন্য নির্দিষ্ট। পুরুষের প্রবল সমাগমে আচ্ছন্ন এই স্থানে, এই বুদ্ধিহীন বালিকা এসে বসে রয়েছে। ধৈর্য্য আর রইল না জীবনের।
অতঃপর, সে উঠে দাঁড়াল, কঠোর স্বরে কন্যার প্রতি বলল,
——— "এখান থেকে যাবে?"
——— "না।"
আছিয়া, মুখ অন্যত্র ফিরিয়ে নিস্পৃহভাবে উত্তর দিল। জীবন গভীর শ্বাস গ্রহণ করল। স্বার্থপর পা'গ'লও কখনো কখনো নিজের মঙ্গল বুঝে, কিন্তু এই বালিকা কবে তা অনুধাবন করবে? আবার একবার চারিপাশে দৃষ্টিপাত করল জীবন। যুবকের দল সতৃষ্ণ নয়নে আছিয়ার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। কেনই বা তারা না তাকাবে? এটা তো পুরুষগণের স্থান! এই পরিসরে এক কন্যার উপস্থিতি এমনই অস্বাভাবিক, যা সকলের দৃষ্টির আকর্ষণ ঘটাতে বাধ্য। এ বলতে এমন নয় যে, নারীসমাজ এখানে আগমন করে না। হ্যাঁ, তারা আসে—তাদের স্বামী, ভ্রাতা, প্রেমিক, কিংবা পিতার প্রয়োজনে। পোষাকাদি, জুতা, ঘড়ি, এবং যা কিছু আবশ্যক, তারা সংগ্রহ করে ত্বরিতে প্রস্থান করে।
কিন্তু এই অবুঝ কন্যাটি! এসেছে পরে থেকেই এখানেই একই স্থানে আসন গ্রহণ করে বসে আছে, আর সকলকেই নির্বাকভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পক্ষান্তরে, তার প্রতি উন্মুখ হয়ে যুবকের দল তাকাচ্ছে, যেরূপে শিকারি পশু কোনো অচেনা শিকারকে নিরীক্ষণ করে। জীবন দাঁত কটমটিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
———" তুমি এখনো কাঁচের চশমায় বর্ণিল মায়া পরিহিত, বাস্তবতার কঠিন রূপরেখা এখনো তোমার হৃদয়ের পৃষ্ঠতলে আঁ'চ'ড় কাটেনি। একবার সে স্পর্শ করলে, ভালোবাসার সেই স্বপ্নালু সুর আর মধুর থাকবে না। বাস্তবতার নি'র্ম'ম'তা এলে ভালোবাসা আর শুধুই মোহের খেলায় বেঁচে থাকে না; হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বিস্তার লাভ করে শুধুই অমোঘ য'ন্ত্রণা।"
অবুঝের ন্যায় আছিয়া বলল,
——— "বাস্তবতা! কোথায় তার অবস্থান? কিভাবে, কোন পথ ধরে পা বাড়ালে তার মুখোমুখি হবো? তিনি কি ছায়ার মতো অধরা, নাকি জ্বলন্ত অ'গ্নি'র মতো অপ্রতিরোধ্য? আপনি বলেন, আমি জানি না; কোন ভাষায় সে কথা বলা যায়! আমি তো শুধুই এক পথিক, সময়ের আ'ঘা'তে ক্লান্ত; কোন স্রোতে ভেসে চলেছি, তা-ও জানি না। শুধু জানতে চাই, সেই মুহূর্তটি কেমন? যখন আমি বুঝবো; এটাই বাস্তবতা, আর কোনো কল্পনার ছায়া নয়?
জীবনের নানাবিধ প্রান্তরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রইলো আছিয়ার প্রতি। সেই কিশোরী, যা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, তা কি আসলেই অবাক করার মতো নয়? বড়লোকের আদরের দুলালী , যে বিলাসিতার কোলাবৃত্তে বেড়ে উঠেছে । তাইতো, সত্যের সঙ্গেই তার পরিচয় নেই, জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত। জীবন তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
——— "তুমি, যার শৈশবের আকাশে কোনো কালো মেঘের ছায়া পড়েনি, সোনালী সূর্যের আলোকচ্ছটায় ঢেকে ছিল সবকিছু। সৃষ্টির বুকে যা কিছু বিলাস, তোমার স্পর্শে তা ধন্য হয়েছে। কষ্ট, দুঃখ—এ যেন তোমার কাছে নিষিদ্ধ শব্দমালা, অচেনা সুরের মতো যা তোমার কানে কখনো বেজে ওঠেনি। একবেলার আহার, কিংবা কোনো আকাঙ্ক্ষার অপূর্ণতা, এই শব্দগুচ্ছ তোমার জীবনসীমার বাইরে পড়ে থাকে। যা চেয়েছ, তা-ই হয়েছে তোমার সামনে; পছন্দের জিনিস না পেলে অট্টালিকা কেঁপে ওঠে তোমার ক্রো'ধে।
কিন্তু তুমি কি জানো, বেদনার গভীরতা? অনুভব করো কি সেই ক্ষুধার জ্বা'লা, যা আত্মাকে ভ'স্ম করে দেয়, না পাওয়া আকাঙ্ক্ষার দাহ? তোমার জানাশোনা সীমাবদ্ধ তৃপ্তির বৃত্তে, বাস্তবতার নির্মম ক'ষা'ঘাত সেখানে কখনো প্রবেশ পায়নি।"
আছিয়া জীবনের এত লম্বা গভীর ভাষণ শুনে হা করে তাকিয়ে রইলো, যেন প্রতিটি শব্দ তার মনের গহীনে প্রবাহিত হচ্ছে। আবারও প্রেমের অদ্ভুত উন্মাদনায় আক্রান্ত হলো, যেন কোনো রহস্যময় উষ্ণতা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। ঠোঁটের কোণে অল্প হাসির রেখা এনে, সে মনে মনে বলল,
———“এত কথা শুনে কি হবে? প্রেম তো হৃদয়ের অনুভূতি, তা বোঝা যায় ভাষায় নয়।”
জীবন তপ্ত শাস ফেলে ফের বলল,
——— "তবে কীভাবে তুমি সেই বাস্তবতার পথের সন্ধান পাবে? কোন দুঃসহ সত্যের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তোমার অন্তর উপলব্ধি করবে জীবনের প্রকৃত রূপ? কোন স্ফু'লি'ঙ্গ সেই স্বপ্নের আবরণ ছিন্ন করবে, তোমার হৃদয়ের শীতল নিস্তব্ধতায় বাস্তবতার কঠিনতম ভাষ্যকে রচনা করবে? কীভাবে তুমি সেই মায়ার কুহক থেকে বেরিয়ে বাস্তবের নি'ষ্ঠু'র সত্যকে আলিঙ্গন করবে?"
আছিয়া ঠোঁট উল্টে বলল,
——— "হুহ আমার আপনাকেই চাই! আমি বড় হলে বিয়ে করবেন আমায়??"
জীবনের চোখ ছোট হয়ে আসল। ভ্রূ কুঁচকে কন্যার দিকে চাইল; এই মেয়ে কি রসিকতা করছে?
জীবন রা'গে চোখ গরম করে আছিয়ার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল। আছিয়া ল'জ্জা পেয়ে ফের মাথা নুইয়ে আসল। আছিয়ার ল'জ্জা'মাখা র'ক্তি'ম মুখ দেখে জীবনের মে'জা'জ আরো তীব্র হলো! সে কি ল'জ্জা:জনক কিছু বলেছে?
আছিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করছে! এই জীবন নামক য'ন্ত্র'ণার প্রতিমূর্তি তার অন্তরে অনবরত আ'ঘা'ত হেনে চলছে। তার জীবন এই পুরুষের দ্বারা ধ্বং'সে'র প্রান্তে, অথচ এই পা'ষা'ণ হৃদয় তার ব্যথাবিধুর হৃদয়ের ভাষা বুঝার কোনো চেষ্টাও করে না। আছিয়ার হৃদয় বারংবার আহত হয়েছে, অথচ তার প্রতি জীবনের অবহেলা অসীম। সে ফোন করলে জীবন তাকে অগ্রাহ্য করে ফোনের পথ রুদ্ধ করে দেয়। কদাচিৎ ভুলে সামনাসামনি আসলেও, তাকে দৃষ্টিপথে ধরা দেয় না। এমনকি জীবনকে দেখবার আশায় তার গৃহে গমন করলেও তাকে পায় না আছিয়া।
তাই এইবার সে এই কঠোর ব্যক্তির সম্মুখে নিজেকে সমর্পণ করে উপস্থিত হয়েছে; লোকে যা বলবে বলুক, তার পরোয়া নেই! ম'র'লে কি লোকে ম'র'বে? ম'র'বে তো আছিয়া! তাকে তো বাঁচতে হবে! এই জীবনের দর্শন ব্যতীত তার জীবন এক বিষাদময় শূন্যতায় পরিণত । আজ বহুদিন পরে এই শ্যামবর্ণ, কঠিন পুরুষের দর্শন পেয়ে অবুঝ অন্তরের তৃষ্ণা কিছুটা মিটছে। তথাপি, এই পাষাণ হৃদয় তা সহ্য করতেও অক্ষম!
জীবন আর তার অন্তর্গত ক্রো'ধ নিবৃত্ত করতে পারল না! সে অতি কঠোরভাবে আছিয়ার হাত ধরে এক হেচকা টানে তাকে উচ্চে উঠিয়ে সেই সমাবেশ হইতে বহির্গত করল। জীবনের দৃঢ় হাত আছিয়ার কোমল হাতে ছোঁয়া লাগতেই, যেন অদ্ভুত এক শিরশিরানি অনুভূতি সমগ্র দেহে প্রবাহিত হলো। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা, হ্যাঁ, এই প্রথমবার জীবন আছিয়াকে স্পর্শ করল! সে ডেবডেবিয়ে তাকিয়ে রইলো, হৃদয়ের গোপন স্থানে এক অস্বস্তি, এক আকর্ষণ কাজ করতে লাগলো।
যদি এভাবে রাগান্বিত হলে সে পুরুষের চেহারায় মায়াবী এক দৃষ্টিকোণ প্রকাশ পায়, তবে আছিয়া বারবার এখানে ফিরে আসবে। ওই মুহূর্তগুলো যেন একটি জাদু, যা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে—পুনরাবৃত্তি ঘটবে, প্রতিবার ভেসে যাবে সে অভিজ্ঞতার সাগরে।
জীবন কঠোরভাবে বলল,
——— "এখন যাও!"
আছিয়া লজ্জাবতী অবস্থায় সমগ্র শপিং মলের মধ্য দিয়া দৌড়ে প্রস্থান করল। তার প্রস্থান করবার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের কঠোর মুখাবয়ব শীতলতা ধারণ করল। তার সম্মুখ হতে আছিয়ার আকৃতি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। জীবন সেই স্থানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, মুঠি শক্ত করে চেপে ধরল, পরিশেষে নিম্ন কণ্ঠে বলল,
——— "তুমি জ্ঞানের গভীরে প্রবেশের প্রয়োজন অনুভব করো না, কারণ সে স্রোতে ডুব দিতে ইচ্ছে তোমার নয়। সব জটিলতা, সব বিশ্লেষণ তোমার কাছে মূল্যহীন; যা তুমি চাও, তা হলো একমাত্রিক, নিরবধি। তুমি আমাকেই চাও; তাহার আর কোনো অর্থ না থাকে, কোনো কারণ বা প্রেক্ষাপটের প্রয়োজন নেই। তুমি স্থির, অবিচল; তোমার ইচ্ছায় যেন বিশ্ব কাঁপে।"
হঠাৎ করেই জীবনের কাঁধে এক শক্তপোক্ত হাতের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। অপ্রত্যাশিত সেই স্পর্শে জীবন ধাক্কা খেলো। দ্রুত পাশে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠল, চোখমুখ বিস্ময়ে ভরা।
——— "স্যার, আপনি কখন এলেন?"
মুগ্ধর মুখভঙ্গি তেমনই কঠিন ও অপ্রতিরোধ্য। জীবনের দিকে একবারও না তাকিয়ে, সামনের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে, গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল,
——— "কাজ কতদূর?"
জীবন সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দে আত্মরূপান্তরিত হয়ে, কঠোর মুখাবয়বে ফিরে আসল। বলল,
——— "এখনো আঁটকে! "
দুজনের চোখে অদ্ভুত এক নিঃশব্দ বোঝাপড়া। কথাগুলো যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে রহস্যের বেড়াজালে আবৃত। মুগ্ধ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
——— "বিচলিত হবে না। সে অন্ধকারের পথিক, সহজে ধরা দেবে না। যে ছায়ায় নিজেকে গড়ে তুলেছে, সেখানে আলো পৌঁছায় না।"
জীবনের কণ্ঠস্বর ঠাণ্ডা, কুয়াশাচ্ছন্ন,
——— "যা নির্দিষ্ট ছিল, তা তার গতিপথে চলেছে। কিন্তু সামনে যা আসছে, তা কি রু'দ্ধ করা যাবে? সময় যেন তার পক্ষে কাজ করে। যারা গিয়েছে তারা আর ফিরে নি! "
——— "সময়ের স্রোতে সে বুদ্ধি খুঁজে পায়, প্রবাহের ভিতরে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু স্রোত শেষে এসে থামবেই। তখন দেখবে, সব হিসেব এক জায়গায় মিলে যাবে। সময় বাকি কৌশল পাল্টাতে হবে! "
জীবন মাথা নোয়ালো, কণ্ঠে গুপ্ত ইঙ্গিত,
——— "পথচিহ্নগুলো অদৃশ্য থাকুক। পরিকল্পনার শেষে যা ঘটবে, তা কেউ টের পাবে না। তবে বেশি দেরি করা যাবে না! সুযোগ এলেই কাজটা শেষ করতে হবে! "
——— "আবার ভুল হলে পথ আরও কঠিন হবে। বুঝে ফেললে সবটা হাতের বাইরে চলে যাবে। এবার খেলা শেষ হওয়ার পথে, কিন্তু প্রতিপক্ষ ধূ'র্ত। কেবল বাইরে থেকে দেখতে যতটা সাধারণ, ভেতরে ততটাই দু'র্ধ'র্ষ। সে নিজের পথের শিকার নয়, সে নিজেই শিকারি।"
--------
অবসন্ন সন্ধ্যার স্তব্ধতা নামিয়াছে, মিলির বিবাহের বাজার সদাই সমাপন হইয়াছে। বোধহয় পুরো মার্কেটের সব কিনে ফেলেছে! বেশ রাত হয়ে গিয়েছে! একে একে সকলেই বের হয়ে আসছে। যাত্রার পূর্বে মিলি অধীর কৌতূহলে কাতর, যে তার হবু স্বামীর সহিত স্বল্পসময়ের জন্য কথোপকথনে নিযুক্ত হবে। তাদের একান্তে আলাপচারিতা সকলে অনুকূল দৃষ্টিতে গ্রহণ করলেও, মিলির শাশুড়ী ও ননদের সহিত ব্যাপারটি মোটেও সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। ক্রো'ধে তাদের দেহে প্রবল দাহ অনুভূত হচ্ছে। কী ধরণের কন্যার সহিত তার পুত্রের বিবাহ সম্বন্ধে স্থির হয়েছে? এতক্ষণ যাবত একত্রে থেকেও তৃষ্ণা মিটল না? আবার কায়দা করে সকলের সম্মুখে পিতা-মাতা ও শ্বশুর-শাশুড়ীর চোখের পলকে নিয়ে গেল কথা বলতে? ফাহাদের মাতার মস্তিষ্ক ল'জ্জায় বিপর্যস্ত; বোধ হয় বিবাহের পূর্বেই তার পুত্র তার হস্তপলাবিল। একে তো পুষ্ঠ না, তাতে পুনরায় ঢলাঢলি করবার স্প'র্ধা! এই কন্যার অহংকার দৃষ্টে তার দেহ পুড়ছে! বিয়ে টা হোক একবার, তার পরই সমস্ত বে'হা'য়া'পনা হস্তগত করবে ফাহাদের মা। অন্যদিকে, নাঈম বাহিরে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে আসনে উপবিষ্ট ; গেম খেলাতে মগ্ন সে.! ভুলক্রমে ভূমিকম্প হলেও বোধ করি এখন সে টের পাবে না।
আঁখি ও আছিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে সবার সাথে। সকলকে পিছনে ফেলে কীভাবে বিদায় দেওয়া সম্ভব? আছিয়া একান্তমনে তার করতল স্পর্শ করে, অনিমেষে ল'জ্জা'য় লাল হচ্ছে। সেই স্পর্শ যা জীবন স্পর্শ করবছে! এই চিন্তামাত্র তার ল'জ্জা'র আভায় মুখ শোণিত। আঁখি দীর্ঘক্ষণ ধরে আছিয়ার অবস্থাটি লক্ষ্য করছে। আঁখির আছিয়ার প্রতি ইতিমধ্যেই উত্তপ্ত, কেবল এতো জনমানুষের সমাবেশে কিছু বলছে না। আছিয়া কোথায় গিয়ে আঁখিকে নিঃসঙ্গ করে ফেলেছিল, আর এখন দেখো, কি চঞ্চল হাসি হাসছে! আঁখির র'ক্তে রো'ষ সঞ্চার হয়ে সে আছিয়াকে ঠেলে বলল,
——— "বিয়ের হাওয়া তোর গায়েও লাগল নাকি?"
——— "তার চেয়েও অধিক!"
আঁখি বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া বলিল,
——— "কিহহ?"
——— "না না, কিছুই না! কিছুই না!"
আঁখি দৃঢ় দৃষ্টিতে আছিয়ার প্রতি তাকিয়ে রহিল। অপরদিকে, আরাফের চোখ আঁখির উপর নিবদ্ধ । আজ সমগ্র দিনে একবারো কাছে যেতে পারে নি, কথা বলতে পারে নি, তাই দূর হতেই মিলির পিতা হাবিবুর রহমানের নিকট দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
এদিকে লজ্জায় গুটিয়ে থাকা মিলি হাত কচলাতে লাগল। ফাহাদ কপালে ভাঁজ ফেলে উষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ধৈর্যচ্যুত স্বরে বলল,
——— কিছু বলবে নাকি? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি! না কিছু বলছ, না বলতে দিচ্ছো! ওদিকে সকলেই অপেক্ষা করছে তো!
মিলির মুখ ল'জ্জা'য় র'ক্তি'ম হয়ে উঠল। নরম স্বরে বলল,
——— "আপনি অনেক ভালো।"
ফাহাদ কেশে উঠল এবং বক্ষ বিস্তৃত করে ভাবুক হয়ে বলল,
——— 'এই জন্যই আপনি আমাকে এত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য ডেকে এনেছেন? আসলেই অত্যন্ত গোপন বিষয়! কাওকেও বলা যাবে না!"
মিলি আরও ল'জ্জা'য় নুয়ে পড়ল। সে কীভাবে বলবে যে তার ফাহাদের সহিত সামান্য কথোপকথন করার ইচ্ছা হচ্ছিল? এতক্ষণ এত লোকের ভিড়ে ভালো করে দেখতেও পর্যন্ত পায় নি! তাই তো কথা বলার জন্য এনেছে, কিন্তু কি বলবে তা খুঁজে পেলো না। এর পূর্বে কারও সহিত বলেছে কি? এটাই তো প্রথমবার!
ফাহাদের হৃদয়ের অন্তর্গত প্রদেশে দ্বিতীয়বার বিবাহের চিন্তা ছিল এক নিতান্ত নিষ্ক্রিয় ধারণা, যেন কালের বয়ে চলার সাথে সাথে তার সমস্ত ভালোবাসার পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম পত্নীর মৃত্যুর পর সঞ্চিত শূন্যতা আর বেদনাই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী। বাধ্য হয়েই মিলির দর্শন করতে হয়েছিল, যেন কোনো আকাঙ্ক্ষা বা প্রতীক্ষা ছিল না তার হৃদয়ের গভীরে। কিন্তু বিধির লিখন অন্যরকম; প্রথম দৃষ্টিতেই মিলির অবয়ব, তাহার উজ্জ্বল স্থূলতা, আর নিস্কলুষ হাস্যধ্বনি তার মনকে স্পর্শ করেছিল। ফাহাদের বুকের বদ্ধপ্রাণ দরজা, যা বহুদিন নির্জীব ছিল, সেই দরজায় যেন ধীরে ধীরে এক নীরব কড়া নেড়ে মিলি প্রবেশ করল। মিলির কোমলতা, তার নীরব মাধুর্য, এক অপ্রত্যাশিত উষ্ণতা সঞ্চার করে তাকে তার অতীতের দুঃখ হতে টেনে তুলল। এই হাটুর বয়সি ছোট্ট মিলি, যে কিনা তার জীবনের ভাবনায় কখনও স্থান পায় নি, এখন তার মনের আঙিনায় এক কোমল অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বসে আছে।
অপরদিকে, মিলির জন্য ফাহাদ কেবল একটি নাম নয়, বরং তার জীবনের সর্বপ্রথম এবং একমাত্র প্রেম—এক নিঃস্বার্থ সমর্পণের প্রতীক। তার জন্য ফাহাদ এক অবিচ্ছিন্ন আকাঙ্ক্ষা, এক বিশুদ্ধ ভালোবাসার প্রতিরূপ। মিলির চোখে, হৃদয়ের গভীরে ফাহাদের স্থানের কোন তুলনা নাই।
এই অদ্ভুত অনুভূতি, এই অজানা আকর্ষণ, যা মিলির সুশোভিত সরলতায় আবদ্ধ হইয়া ছিল, ফাহাদের হৃদয়ের নিঃশব্দ আবেগে ছাপ ফেলিয়াছিল।
ফাহাদের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটল। মিলির টানা টানা চোখের দিকে তাকিয়ে, ফাহাদ নতি স্বীকার করব আস্তে বলল,
——— আমার গলুমলু বউ এর কি এতটুকু অপেক্ষা সইছে না?
মিলি নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। ফাহাদ বলল,
——— আচ্ছা, চলো কাজি অফিসে যাই! আজই বিয়ে করে ঘরে তুলব!
মিলির চোখ বিস্ফারিত! ফাহাদ হেসে বলল,
——— কী, রাজি? চলো যাই!
এই বলে ফাহাদ যখন মিলির হাত ধরতে উদ্যত হল, মিলি আচমকা দূরে সরে গেল! মিলি হঠাৎ আতকে উঠে বলল,
——— এহহহ! আমি এত কেনাকাটা করলাম, এগুলোর কী হবে? আমার বিয়ে ধুমধাম করে হবে! আমি আমার বিয়েতে ইচ্ছেমতো পেটপুরে খাবো! নাচবো! হুহহহ! এগুলো কিছু না করেই আমি আপনার ঘরে উঠবো না! হুহ, আমার কত স্বপ্ন! আপনি জানেন?
ফাহাদ হেসে উত্তর দিল,
——— সব হবে! কিন্তু একটা করা যাবে না!
——— কী?
——— নাচা যাবে না!
——— এহহহ! আমার বিয়েতে আমি লাফিয়ে লাফিয়ে নাচবো!
——— চুপ! যা বলেছি, তাই করবে—নাচা যাবে না কারো সামনে!
——— আচ্ছা, ঘরের ভেতরে নাচবো!
——— আমার বউয়ের নাচার তো বেশ শখ! বিয়েটা করো, আমি সব পূর্ণ করবো!
——— আর আমাকে চারটা বাচ্চা দেবেন!
ফাহাদ বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল! এই মেয়ে তো তাকে ছাড়িয়েও এডভান্স! বাঁকা হাসি দিয়ে এবার ফাহাদ ঝুঁকে বলল,
——— তুমি চাইলে একটা টিম বানাতে পারি!
——— না না, দুটো ছেলে, দুটো মেয়ে! যেন কেউ ভাই-বোনের অভাব ফিল না করে! দেখেন, যদি শুধু দুজন থাকে, তখন আমাদের ছেলে বলবে, ‘ইশ, আমার যদি একটা ভাই থাকতো!’ আর মেয়ে বলবে, ‘ইশ, আমার যদি একটা বোন থাকতো!’ তাই আমাকে চারটা বাচ্চা দেবেন! ঠিক আছে?
ফাহাদ মিলির মায়াবী মুখখানার দিকে নির্বাক চেয়ে রইল। মিলির এমন যুক্তি শুনে তার হাসি চাপা দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। অনেক কষ্টে হাসি আটকে এবার পাবলিক প্লেসেই নির্লজ্জভাবে মিলির গলুমলু গাল দুটো টেনে দিয়ে, নেশাভরা কণ্ঠে বলল,
——— আর বলো না! নয়তো নিজেকে সংযত করা কঠিন হয়ে যাবে আমার জন্য, বউ!
মিলি লজ্জায় নিজ অবয়বে অবনত হল, যেন ল'জ্জা'র ভারে তার কোমল অবয়ব আচ্ছাদিত হচ্ছে। ফাহাদ তার এক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগল, আপন চক্ষুতে মুগ্ধ হচ্ছিল তার সেই স্নিগ্ধ, স্বাস্থবতী গোলাকার সৌন্দর্য-মণ্ডিত ক্ষুদ্র প্রেয়সীকে। এই ছোট্ট আলুর বস্তাটা যে তার হৃদয় হরণ করে নেবে সে কি ফাহাদ ঘুনক্ষরেও টের পেয়েছিল? লোকালয় না হলে বোধহয় বুকে টেনে নিতো তার হবু ব্যাক্তিগত কোলবালিশ টিকে!
--
এদিকে আঁখির অন্তর অস্থিরতায় বিদ্ধ ; কিসের জন্য তা সে নিজেও অবগত নয়। মুগ্ধের চিন্তাধারা ঘুরপাক খাচ্ছে মস্তিষ্কের অন্তর্গত কোণে। মুগ্ধ উপস্থিত, আছিয়া ও আরাফ এটা অবহিত নাকি? যদি তারা জানত, তবে কি এমন স্বাভাবিক থাকত? বলবে কি মুগ্ধের উপস্থিতি সম্পর্কে? কিন্তু পরক্ষণে তার মস্তিষ্কে আসল; জানলে জানুক; না জানলে নেই! তাদের আপনজন, অবশেষে নিজগুণে জানবেই।
অতঃপর মুগ্ধের আগমন ঘটল, নাম উচ্চারণ হতে না হতেই সে প্রান্তর হতে উদ্ভাসিত হল। গুরুগম্ভীর ভাবের আবরণে, পকেটে হস্ত সংস্থাপিত করে, সে শপিং মল হতে আগমন করল। কেও তাহকে লক্ষ্য করল না তখনো। কিন্তু যখন মুগ্ধ তার পার্ক করিয়া রাখা বাইকে আরোহণ করতে গেল, তখন সবার দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ হল। যেন বজ্রপাত হল সবার মস্তকে!
মিলি ও ফাহাদও তখন আগমন করছে। মুগ্ধকে হঠাৎ করে প্রত্যক্ষ করে তাদের নয়ন বিস্ফারিত হল। স্তব্ধ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরাফ, আছিয়াও তার সাথে সকলে। আঁখির দৃষ্টি স্থির রইল লোকটির উপর। সে কারও সহিত বাক্য বিনিময়ের প্রয়োজন অনুভব করল না। এ কেমন ব্যক্তিত্ব?
আছিয়া যেন বুলেটের মতো ছুটে গেল, সাথে আরাফও ভীষণ অস্থির হয়ে মুগ্ধের সম্মুখে উপস্থিত হল। আরাফের মুখ হতে উচ্ছ্বাসমিশ্রিত উদ্বেগে উচ্চারিত হল,
——— "ভাই, এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? আমরা তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম! "
অন্যদিকে আছিয়া খুশির আতিশয্যে গদগদ হয়ে মুগ্ধকে বলল,
——— "ভাইয়া! আমার জন্য কি এনেছো?"
আছিয়ার বোকামি শুনে আরাফের ধৈর্য টুটিল, তার মুখ মলিন হল ক্রো'ধে। বোনের অবোধ প্রশ্ন তার চিন্তায় বিদ্ধ হল; এক মাস পর মুগ্ধ ফিরল, আর সে শুধালো—কি এনেছো?? বিরক্তিতে আরাফ আছিয়ার মাথায় ধপ করে গাট্টি মে'রে বলল,
——— "এই গাধী! এখান থেকে সর!"
আছিয়া ক্রুদ্ধ চাহনি দিয়ে পাল্টা জবাব দিল,
——— " তুই গাধীর ভাই যাহ, তুইই যা এখান থেকে!"
তবে পরক্ষণেই, হাস্যোজ্জ্বল মুখে মুগ্ধের দিকে ফিরে বলল,
——— "ভাইয়া, আমি কিন্তু তোমার সব কাজ ঠিকমতো করেছি।"
মুগ্ধের মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটল, যেন সামান্য তিলমাত্র। কিঞ্চিত কণ্ঠে বলল,
——— "তোর জন্য যা এনেছি, তোর ঘরেই রেখেছি।"
আছিয়া তখন প্রগাঢ় আনন্দে মুগ্ধ হল। তবে আরাফ এখনো অস্থির, পুনরায় আকুলভাবে প্রশ্ন করল,
——— "বলছ না কেন? কোথায় ছিলে এতদিন? আমাদের কিছুই জানাও নি কেন!"
মুগ্ধ বাকা হাসিতে ম্লান হল, তার মুখে রহস্যের ছায়া। আরাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
——— "কাজ ছিল।"
——— "কিসের কাজ?"
——— "সময় হলে জানবি।"
——— "সে যাই হোক, আমাদের একটিবার খবর দিতে পারতে! বড় মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে! তাড়াতাড়ি চলো।"
মুগ্ধ স্থির কণ্ঠে উত্তর করিল,
——— "তোর কি ধারণা, আমি মা'য়ের সাথে দেখা না করেই এখানে এসেছি?"
——— "তাহলে..."
আরাফের বাক্য শেষ হতে না দিয়া মুগ্ধ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
——— "আমার খবর জানার কারো সাধ্য নেই! কিন্তু তোদের খবর আমি সর্বদা রাখি। তোরা কি করিস, কোথায় যাস—সব জানি।"
এই বলেই মুগ্ধ বাইক স্টার্ট দিল, আর কোনো মুহূর্ত দণ্ড নষ্ট না করে বলল,
——— "শিক্ষকতা করছিস; ব্যাপারটা যেন এপর্যন্তই থাকে!"
মুগ্ধ তৎক্ষণাৎ তার ইয়ামাহা R15 V4-এ আরোহণ করে, সূক্ষ্ম স্পর্শে ইঞ্জিন জাগ্রত করে মুহূর্তের মধ্যে অশ্ববেগে উত্থিত হয়ে, ধূলি উড়িয়ে, দৃষ্টির সীমানা হতে অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন সময় ও স্থানের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করব সে বায়ুর বক্ষ বিদীর্ণ করে কোথাও মিলিয়ে গেল, ধূলিকণার প্রতিটি উত্থান তার গতির সাক্ষী মাত্র।
আরাফ অবশ দাঁড়িয়ে রইল, স্তব্ধ হয়ে। কেমন করে মুগ্ধ এটা জানিল? মুগ্ধকে বুঝা বোধ হয় এক অপার রহস্য!
মুগ্ধের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যেন মুহূর্তেই পরিবেশে এক অদ্ভুত সুনসান নীরবতা নেমে এলো। রাত গভীরতা বাড়ছে, আর একে একে সবাই গাড়িতে উঠে পড়তে লাগল। মিলিরা শাহারিয়াজ বাড়ির গাড়ি করেই এসেছিল, আর তাদের গাড়ির শব্দ যেন ধ্বনিমন্দ্রিত বাতাসে মিশে শো শো করে চলে যেতে থাকল। নাঈম ড্রাইভিং সিটে বসে, আঁখি পাশে নির্জনতার সাথে রাতের অন্ধকারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে। তার মনে দুশ্চিন্তা ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে। কিছুই কিনে নি সে আজ, আর জানে না যে বাড়ি ফিরে কী ধরনের ঝড় তার অপেক্ষায় আছে। একটা উদ্ভট ভাবনা তার মাথায় খেলে গেল—যদি কিছু কিনত, তাহলে সেই জিনিসগুলো সহ তাকে আগুনে জ্বালিয়ে দিত তারা! তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আঁখি, যেন অন্তরের ভেতরে জমা অশান্তি আকাশের দিকে মুক্তি পেতে চাইছে।
নাঈম, ড্রাইভ করতে করতে, আঁখির দিকে একবার তাকাল। তার চিন্তাগ্রস্ত মুখের দিকে নজর পড়তেই বুঝতে পারল, আঁখি কিছু গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। মৃদু হাসিতে বলল,
——— "কিরে মুরগি, এত কি ভাবছিস?"
আঁখি মাথা ঘুরিয়ে একটু হেসে উত্তর দিল,
——— "ভাবছি যে তুই তো কানা! এখন যদি এক্সিডেন্ট করে ফেলিস, দুজনেই অক্কা পাবো!"
আঁখির মুখে ফিক করে হাসি ফুটে উঠল। নাঈম একটু রাগ দেখিয়ে বলল,
——— "কিহহহ! দাড়া, তোকে এই গাড়ি থেকে ফেলে দিব আমি! মুরগি কোথাকার!"
৩০.৮ কিলোমিটার পথ এখনও বাকি। পুরোটা পারি দিতে সময় লাগবে এক ঘণ্টা ছয় মিনিট, যদি সব ঠিকঠাক মতো চলে। রাত দশটার কাছাকাছি বাজে। নাঈমের মুখে হাসি থাকলেও, চিন্তার মেঘ তার মনেও ঘনীভূত হচ্ছে। আর গাড়িটা, কেমন যেন ধীরে চলতে শুরু করেছে। সে যতই স্পিড বাড়ানোর চেষ্টা করুক, যেন সেই গতি আর ফিরছে না—এক অদৃশ্য ভার যেন গাড়িটাকে ঠেলে ধরেছে, আর নাঈমের মন সেই ভারে ডুবতে শুরু করেছে।
ভাবতে ভাবতেই রাত্রির নিস্তব্ধতায়, হঠাৎ করেই গাড়িটি নিস্তেজ হয়ে থমকে দাঁড়াল। মিলিদের গাড়ি অনেক দূরে অদৃশ্যের পানে ধাবিত হয়ে গিয়েছে, আর আঁখি বিস্ময়ে নাঈমের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জিজ্ঞাসা করল,
——— “গাড়ি কেন থামালি?”
নাঈমের কপালে চিন্তার ভাঁজ, কিন্তু কণ্ঠে এক অদ্ভুত নিশ্চুপতা,
——— “বুঝতে পারছি না! ওয়েট, দেখি চেক করে।”
এই বলে নাঈম ধীরপদে গাড়ি হতে বের হলো। আঁখি নিঃশব্দে বসে রইল, অন্ধকারে ছায়াগুলির খেলা দেখছিল যেন। নাঈম ইঞ্জিনের ড্যাশবোর্ডের পেট্রোল গেজের দিকে তাকাল; বাকা এক হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। আঁখির দৃষ্টি সাঁতার কেটে নাঈমের হাসির রহস্য সন্ধানে ভ্রু কুচকালো।
——— "কী হয়েছে?"
আঁখির কণ্ঠে উদ্বেগের মৃদু সুর।
——— "পেট্রোল শেষ!"
নাঈমের উত্তর নিঃশ্বাসের মতো হালকা।
——— "পেট্রোল শেষ মানে?"
আঁখি হঠাৎ বিদ্যুৎ-দ্রুত সাড়া দিয়া গাড়ি হতে বাহির হল। চারিদিকে গভীর অন্ধকারে লীন দোকানপাট, মাঝে মাঝে কিছু আলোকবিন্দু যেন রাত্রির অন্ধকারে জীবন্ত চিহ্ন। মেইন রোডে শো শো করে চলছে গাড়িগুলি, তার নিঃসীম গতির নীচে পৃথিবী যেন ছোট হচ্ছে। আঁখির মেজাজ বিদ্যুতের ন্যায় তীব্র হল।
——— "ফোন দিয়ে বাড়িতে খবর দে!"
আঁখির নির্দেশ যেন অনিবার্য।
——— "ফোন বন্ধ,"
নাঈমের কণ্ঠে নির্লিপ্ত স্বীকারোক্তি।
——— "ফোন বন্ধ মানে?"
আঁখির চোখ জ্বলতে লাগল, যেন সহস্র প্রশ্ন তাহার নীরব চাহনিতে ফুটল। নাঈম মাথা চুলকাইল, তার অবস্থা স্পষ্ট; গেম খেলে খেলে হস্তছাড়া হয়েছে । আঁখি যা বুঝবার বুঝল, দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
——— "আরও গেম খেল, বেশি করে খেল! এখন কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো?"
গাল ফুলিয়ে, আঁখি থমকে দাঁড়াল। নাঈম নিজের হাসি দমাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে দূরের অন্ধকার পেরিয়ে এক অশ্বারোহীর ন্যায় এক বাইক হাওয়ার গতিতে তাদের দিকে ধাবিত হল। বিপুল গর্জনে তার আগমন যেন স্তব্ধ রাত্রি বিদীর্ণ করে দিল। আঁখির সম্মুখে ব্রেক চেপে, এক ক্ষণিকের মধ্যে বাইক থামল। আঁখির চোখে অবিশ্বাসের ছায়া, আর সেই লোকটি যখন হেলমেট খুলল, আঁখির মুখে হতবাক বিস্ময় খেলা করল।
আঁখির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ বাকা হেসে গম্ভীরকন্ঠে বলল,
——— “চুনোপুঁটির গাড়ি কি তবে অকেজো হয়ে গেল?”
~ জোনাকি গায় ফিসফিস,
হাওয়া দিয়ে যায় শিষ,
তাতে আমার কিছু যায় আসে না,
সে যে এখন আমায় ভালোবাসে না
ওঠে আনন্দ চাঁদ, গলায় গলায় গান,
শুধু আমার গলায় সুর আসে না
সে যে এখন আমায় ভালোবাসে না ~
রাত দশটা। শূন্যতার অন্তর্গত একটি ক্ষণ, সময় স্থবির, নিস্তব্ধতা প্রতিটি মুহূর্তকে গিলে ফেলে। বিক্ষিপ্ত দোকানপাট তাদের নিষ্প্রাণ দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে, যেমন এক ম্রিয়মাণ প্রদীপের শেষ আলো। বাতাসের শ্বাসপ্রশ্বাসে যেন গাঢ় গুঞ্জন ধ্বনিত হচ্ছে, সো সো করে উড়ে যাচ্ছে সে,ধরণীর বুকে একান্তে এক প্রতিধ্বনি রেখে।
রাস্তার প্রান্তে ধীরে ধীরে কমে আসছে গাড়ির বহর, যদিও সেই নীরবতা ভাঙছে কিছু বাস আর ট্রাকের উদভ্রান্ত আর অস্থির গতিতে ছুটে যাওয়া। এই আধো জাগ্রত, আধো নিদ্রিত রাতের মধ্যে, আঁখির ক্লান্ত চোখের সামনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ। তার শক্ত দেহের উপস্থিতি অচঞ্চল পাহাড়, মুগ্ধর বিরক্তিমাখা কন্ঠ,
———" হয়েছে আপনার? এবার চলুন!"
আঁখি তার ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকালো, শ্বাসের ভারে যেন ভারাক্রান্ত মনে হলো তাকে। এতক্ষণ দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে, তবুও মুগ্ধর চোখে চোখে কি বিনিময় হল নাঈমের সাথে, সে বুঝতে পারেনি। যখন নাঈম এসে বলল যে তাকে মুগ্ধর বাইকেই যেতে হবে, আঁখি যেন চমকে উঠলো।
মুগ্ধর বাইকে যেতে হবে? তাও আবার তিনজন মিলে এক বাইকে? এ যেন এক অসম্ভব বাস্তবতা, যেমনটা দিনের আলোয় চাঁদ দেখা। আঁখি অবজ্ঞার সাথে সিএনজি বা রিকশার সন্ধান করতে লাগল। কিন্তু প্রতিটি সিএনজি বা অটো রিকশা মুগ্ধর অবিচল দৃষ্টিতে পলকহীন দাঁড়িয়ে থাকা দেখে দ্রুত ফিরে যাচ্ছিল। দুটো সিএনজি এবং তিনটি অটো সে থামিয়েছিল, কিন্তু কেউ যেতে রাজি নয়।
মৃদু দুঃসহ হতাশা গ্রাস করল আঁখিকে। সপ্তাদশী কন্যা, এই রাতের জালে আটকে গিয়েছে। অথচ নাঈম ইতিমধ্যেই মুগ্ধর বাইকে বসে রয়েছে, মুখের কোণে হাসির এক সূক্ষ্ম রেখা টেনে। আঁখি কি জানে, আজ তার পা এক অজানা ফাঁদে পড়ে গিয়েছে? নাঈমের নির্বিকার আচরণে তার রা'গ ক্রমশ বাড়ছে। কিভাবে এত ঠাণ্ডা মাথায় রয়েছে ও? এই পরিস্থিতি থেকে বের হলে নাঈমকে সে ঠিকই বোঝাবে আঁখি কি জিনিস!
তবে মুগ্ধ; সে এক অন্য ধাতুতে গড়া। গম্ভীর মুখে, পকেটে হাত গুজে সে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে । আঁখির প্রতিটি প্রয়াস তার ক্ষুদ্র চোখের সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে, একেকটি কার্যকলাপ যেন পরখ করছে, তীব্র বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে।
আঁখির কপালে ঘামের বিন্দু বেয়ে পড়ছে। একবার আরেকবার, তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে চাইছে। হঠাৎ মুগ্ধের কণ্ঠ ভেসে এল, গম্ভীরতায় আচ্ছন্ন,
——— " আপনার হয়েছে চুনোপুঁটি?"
আঁখি শব্দহীনভাবে নিজের ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করল, এক ধরণের ভাবলেশহীনতার আড়ালে এক অজানা সংকল্পের রেখা টেনে নিল। এরপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকালো মুগ্ধর দিকে। এক বাকা হাসি তার ঠোঁটে ফুটে উঠল, কন্ঠে এক অনাবিল স্পষ্টতা নিয়ে বলল,
———" যখন সোজা আঙুলে ঘি উঠে না, তখন চামুচ ব্যবহার করাই শ্রেয়। শুধু আঙুল বাকানোর প্রয়োজন নেই।"
মুগ্ধও সেই বাকা হাসির সুরে সাড়া দিল, কণ্ঠে এক নির্মম বিদ্রুপ ফুটে উঠল,
——— "মাথার পোকারা কিলবিল করছে ?"
আঁখি প্রতিত্তোরে কেবলমাত্র এক নির্জন,হাসি ফুটিয়ে তুললো, যেন এক নিঃশব্দ অভিসন্ধি তার মনের অন্তরাল থেকে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে। মুগ্ধের বলিষ্ঠ বাহুর আশ্রয় পাশ কাটিয়ে তার নরম, কৃশ দেহ নিয়ে আঁখি নীরবে নাঈমের দিকে অগ্রসর হলো, যেন পথটি একান্ত তার নিজেরই জন্য প্রস্তুত। মুগ্ধ লক্ষ্য করল, এই মেয়েটির মনে এখন কি খেল চলছে!
আঁখি কে দেখে নাঈম এক প্রশ্রয়দায়ক হাসি হেসে বলল,
——— "স্বীকার করতেই হলো, তাই না? চল, এখন বাইকে উঠ। অনেক দেরি হয়ে গেছে!"
নাঈমের এই অবজ্ঞামূলক হাসি আঁখির ক্রো'ধের শিখা বাড়িয়ে দিলেও, সে দৃঢ়ভাবে তা গিলে ফেলে নিজেকে সংযত রাখল।। হাত বাড়িয়ে সে বলল,
———"তোর ফোনটা দে!"
নাঈমের ভ্রু ভেঙে গেলো—কৌতূহল আর অবিশ্বাস মিশ্রিত সুরে বলল,
——— "ফোন? ফোন তো বন্ধ! ফোন দিয়ে কি করবি?"
আঁখির চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি ফুটে উঠলো,
——— "প্রশ্ন করিস না। ফোনটা দে!"
নাঈম ধীরগতিতে তার পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই আঁখি মুহূর্তের মধ্যে খপ করে ফোনটা ছিনিয়ে নিলো। যেন তার নীরব যুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ সফলভাবে শেষ হলো। এরপর, কোন কথা না বলে সে উলটো পথে অগ্রসর হলো এক দিকের দোকানের দিকে। কিছু মৃদু বাক্য উচ্চারণ করলো, যা দোকানদার বিমুখভাবে নাকচ করে প্রত্যাখ্যান করল। ক্রমাগত একের পর এক দোকানে প্রবেশ করতে লাগল আঁখি, কিন্তু সকলেই প্রত্যাখ্যান করছে। সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে মুগ্ধ দেখছে তা। হয়ত ইতিমধ্যেই অনুধাবন করেছে আঁখির অভিলাষ। মনে মনে একরূপ ব্যঙ্গাত্মক হাস্য করল মুগ্ধ এবং স্বগতোক্তি করল,
——— "এমনি এমনি তো এত জীবন ছাই হয় নি!"
মেয়েটি পায়ে পায়ে ক্রমশ দূর অগ্রসর হচ্ছে, এবার রাস্তা পার হয়ে অন্যত্র গমন করছে, রাত্রির এই ঘোর নিশীথে। মনে হয় ভীতির আদৌ অস্তিত্ব নেই তার অন্তরে। গাঢ় নিশ্বাস ফেলল মুগ্ধ। সে নিজেও তার পিছু নিল। আঁখির নিকট আসবার জন্য সেও রাস্তা পার হতে লাগল। নাঈম দূর হতে সবই পর্যবেক্ষণ করছে, ইচ্ছাকৃতভাবেই স্থির অবস্থায় বসে! তথাপি এই মুরগি মেয়েটি প্রকৃতপক্ষে কী পরিকল্পনা করছে, তা নাঈমের মনে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে না।
অবশেষে আর একটি দোকান উন্মুক্ত ! আঁখি ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হল, যদিও সে একা নয়! মুগ্ধ সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন, গম্ভীর মুখে নীরবে তার পেছনে দাঁড়িয়ে । আঁখি এক নজরে ফিরে দেখল, কিন্তু বলল কিছুই না। প্রত্যেকবারের ন্যায়, এইবারো সেই দোকানদারও অস্বীকৃতি প্রকাশ করার প্রান্তে । তবে মুগ্ধের উপস্থিতি দৃষ্টি গমন করলে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে রইল। মুগ্ধ অতি গম্ভীর স্বরে আদেশ করল,
——— "যেটা চাচ্ছে, সেটাই করুন!"
নাঈম একবার তার কব্জিতে বাঁধা ঘড়িতে হাত বুলালো। সময় দেখেই শিউরে উঠল! দশটা ত্রিশ অতিক্রান্ত হয়েছে! এই মুরগিটা আসলে কী চায়? কি করছে ও ? এতক্ষণে অর্ধেক পথ বাইকে অতিক্রম করতে পারত! ভাগ্যিস যাত্রার পূর্বে রেস্টুরেন্টে আহার করে এসেছিল, নাহলে ক্ষুধার জ্বালায় চেতনা হারাতে হত। নাঈম চোখ আধখোলা করে দূরে রাস্তার ওপারে দোকানে দাঁড়ানো দুই জনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। মাঝে মাঝে বাস যাচ্ছে, ফলে তাদের স্পষ্ট দেখতে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে । কিন্তু পরমুহূর্তে যা দেখল, তাতে সে একদম হতবাক হল! হঠাৎ করে ধপ করে সোজা হয়ে দৌড় দিল। এই মেয়েটি তার ফোন দোকানদারের হাতে দিল কেন? বিক্রয় করছে নাকি? হায় আল্লাহ! ঐ ফোনে সে গেম খেলত! না, না! এটা হতে দিবে না নাঈম! দেহ মন উন্মত্ততায় একত্র হয়ে সে দৌড় দিল চোখমুখ বিকৃত করে! রাস্তা পার করে সোজা এসে দাঁড়াল তাদের সম্মুখে! হাপাতে হাপাতে আঁখির দিকে তাকিয়ে ধমক দিল,
——— "ওই মুরগি, তুই আমার ফোন এখানে দিলি কেন? দে আমার ফোন, এখনই দে! কোথায় আমার ফোন??"
আঁখি নিরুত্তর । এক হাসি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। নাঈম এবার মুগ্ধের দিকে ফিরে তাকাল, ব্যাপারটি বুঝার জন্য। মুগ্ধ চোখের ইশারায় দোকানের অভ্যন্তরের দিকে নির্দেশ করল। এটা এক মোবাইল সার্ভিসিং দোকান। ভেতরের দোকানদার অস্বাভাবিক হাস্য করছে। নাঈম দেখল, তার ফোনটি পাশেই চার্জে লাগানো রয়েছে। নাঈমের চক্ষু বিস্ফারিত হল! আশ্চর্য হয়ে আঁখির দিকে তাকাল! আঁখি দুই হাত জোড় করে কিছু ফিসফিস করছে, যেন আল্লাহর নিকট কিছু প্রার্থনা করছে। কিন্তু কি প্রার্থনা করছে এই ধুরন্ধর মেয়েটি?
আঁখি নিস্তব্ধতায় মাথা ঘুরিয়ে চারিপাশে তাকাতে লাগল। স্পষ্টতই কিছু অনুসন্ধান করছে সে। মুগ্ধ এবার আর কোনো কূলকিনারা করতে পারল না—আঁখি আসলে এই অন্ধকার রজনীতে কী খুঁজছে? হঠাৎ আঁখির চোখে কোনো বস্তু পড়ল, যা সে এতক্ষণ হতে খুঁজছিল। আনন্দে তার দৃষ্টিতে একপ্রকার ঝিলিক জ্বলে উঠল! ইহত্তে, এতক্ষণে নাঈমের ফোনে বিশ শতাংশ চার্জ পূর্ণ হয়েছে! আঁখি অতি উচ্ছ্বসিতভাবে সেই ফোনটি চার্জার হতে এক টানে খুলে নিল এবং এক অমিততেজে দৌড়ে চলল। দৌড়াতে দৌড়াতে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে ডাকল,
——— "এইই চাচায়ায়া! চাচায়ায়া! শুনছেন? ও চাচা, শুনুন??? "
এক জনৈক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি নিরালোক নিশীথে ধীরে সাইকেল আরোহন করছিলেন, রাস্ত্রের কিনারা ধরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। হঠাৎ পৃষ্ঠদেশে রমণীয় কণ্ঠের নিকটতর আহ্বান শুনে তিনি স্থির হলেন। কে যেন অন্ধকার বিদীর্ণ করে উদ্দাম স্বরে ধ্বনিত হচ্ছে! কৌতূহলে চূর্ণ হৃদয়, তিনি পশ্চাৎ ফিরলেন। ক্ষুদ্র নত নেত্রে নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখলেন; এক শ্যামলকান্তি কিশোরী ধাবমান, তার অভিমুখে দ্রুত ধেয়ে আসছে! এই কুমারী কন্যা কে? কি সে সমাচার? তাকে উদ্দেশ্য করে ডাকছে কি? এত রাত্রিতে কি দুষ্টরাহুর পানে পথভ্রষ্ট হয়েছে? নাকি কারো কুরুচিকর অভিসন্ধিতে কন্যাটি নিপতিত হয়েছে? লক্ষ লক্ষ প্রশ্নের প্লাবন প্রবাহিত হল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির অন্তরে। পরিশেষে, শ্বসনরুদ্ধ আঁখি নিকটে উপনীত হল।
মুগ্ধ আর নাঈম স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল! মুগ্ধ আশ্চর্য হয়ে বলে উঠল,
———" এটা ওর কোন চাচা??"
নাঈম বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে উত্তর দিল,
——— "আমি জানি না ভাই, এইটা ওর কোন জন্মের চাচা লাগে!!"
নাঈমের রাগ যেন ফুসে উঠল! এই রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে কী নাটক শুরু করেছে মেয়েটা? ইচ্ছা করছে তাকে তুলে আ'ছা'ড় মা'র'তে! মাথার ঘিলু ওলটপালট করে দেওয়া উচিত! ধুরন্ধর মেয়ে! বয়স মাত্র ১৭, অথচ চাহনি আর আচরণে মনে হয় যেন ২৭!
হঠাৎ মুগ্ধ চোয়াল শক্ত করে, দৃষ্টিতে অ'গ্নিসঞ্চার করে নাঈমের কলার চেপে ধরল। কণ্ঠস্বর রাগে বাষ্পায়িত হয়ে উঠল,
——— " তুই কি ভুলে গিয়েছিস যে আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি? তোর সাহস কি করে হয় এসব ভাবার?
এ বলে মুগ্ধ তাকে ছেড়ে দিলো এবং পা ফেলে আঁখির দিকে অগ্রসর হল। নাঈম বিস্ময়ে অভিভূত। তার মনের গভীর চিন্তা মুগ্ধ কিরূপে জানল? ইশশ! এই দুইজন যেন একযোগে তাকে পা'গল করে ছাড়বে! নাঈমকে আর থামায় কে! সেও পিছে পিছে হেঁটে চলল, আঁখিকে নজরে রাখে, দেখল সেই কৌতূহলোদ্দীপক দৃশ্য; আঁখি ওই লোকটার সহিত অতি সানন্দে আলাপনরত। কিসের এত হাসি, কিসের এত কলকল? হায়! কী যেন ফোনে নিয়ত মগ্ন! বৃদ্ধ ব্যক্তিটি কি তার স্নেহ মেখে বিদিত, নাকি আঁখি তার নম্বর সংগ্রহ করছে? নাঈমের মন মর্মরিত হইল সহস্র প্রশ্নের বাষ্পে। মুগ্ধ পুনর্বার র'ক্তাভ নেত্রে চাইল; এ কি! ফের নাঈমের চুপিসারে ভাবনাও কি সে শুনল? নাঈমের বিস্ময়ের সীমা রইল না; কি অদ্ভুত লোক? এখন ভাবনাও কি নিষিদ্ধ? বোন তারই, এক ভাইয়ের অধিকার কি নেই বকুনি বর্ষণ করবার? বেদনার হাহাকার! হুহহ! কেমন রাগ দেখাচ্ছে নাঈমকে! অথচ আঁখি তাকে নাকে দড়ি দিয়াই ঘুরাচ্ছে, তা যেন সে দেখতে পাচ্ছে না! মুগ্ধর নীরব প্রশ্রয়ে মেয়েটির সাহস বারংবার অতিক্রম করছে সীমা; না হলে এতক্ষণে নাঈম আঁখির কানের নিচে দু'ঘা বসিয়ে দিত। কিন্তু মুগ্ধ! সে তো তাকে সুযোগই দিচ্ছে না! সর্বদাই আঁখিকে ‘চুনোপুঁটি’ বলে অভিহিত করে, অথচ এখন তার মুখ নিঃশব্দ; চুনোপুঁটিকেই কিছু বলার সাহস করছে না! কেবল তার চারপাশে ঘুরছে, যেন এক সুতীব্র আকর্ষণ তাকে বেঁধে রেখেছে!
মুগ্ধ কপাল কুচকে নিবিড় দৃষ্টিতে দেখল, আঁখি লোকটিকে কী যেন ফোনে দেখালো। লোকটিও হাসি দিয়ে সারা দিচ্ছে।
তারপর ঘটল আশ্চর্য ঘটনা; অচেনা লোকটি আপন সাইকেল আঁখির হস্তে সমর্পণ করে নাচতে নাচতে প্রস্থানে উল্লসিত হল। একযোগে স্তম্ভিত হল মুগ্ধ ও নাঈম।
কিছু একটা ভাবলো অত:পর এতক্ষণে মুগ্ধর মর্মে স্ফূরিল রহস্যের আবছায়া, সবই বুঝতে পারল সে, অথচ নাঈমের বুদ্ধি জাগ্রত হল না। তার চরণদ্বয় দ্রুততর হল, মুগ্ধর পূর্বে আঁখির নিকট উপস্থিত হয়ে বলল,
——— " লোকটা উনার সাইকেল তোকে দিয়ে নাচতে নাচতে চলে গেলো কেন?"
——— "কিনে নিয়েছি!"
——— "কিনেছিস মানে! টাকা কোথায় পেলি? কখন দিলি? লোকটিকে চিনলি কিভাবে?
——— "অচেনা লোক সে! দশ হাজার টাকার বিনিময়ে কিনেছি ! বিকাশের মাধ্যমে তোর একাউন্ট হতে টাকা তার একাউন্টে হস্তান্তর করে।"
বরফের মতো জমে গেল নাঈম! এই ভগ্নপ্রায়, জরাজীর্ণ সাইকেল কিনা দশ হাজার মুদ্রা ব্যয় করে কেনা? হায় রে হায়! সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে পড়ল সে। আঁখি হেসে বলল,
——— " এটা তোর দায়িত্বহীনতার জন্য প্রাপ্য দণ্ড! আজ বাড়িতে ফিরলে এমনিতেও ঝড় উঠবে, সুতরাং আগে হতেই তোর প্রাপ্য শাস্তি দিলাম! বোধগম্য হল কি আমার কানা ভাইয়া?
নাঈমের ক্রো'ধে মস্তিষ্ক প্রায় ফেটে যাবার উপক্রম। এমন সময় পাশে উপস্থিত হয়ে মুগ্ধ তার কাঁধে হাত রেখে মৃদু হাস্যে দাত কটমটিয়ে বলল,
——— " আমার ক্রোধ দেখিস নি! ভুলেও যা ভাবছিস, তা করার চেষ্টাও করিস না!"
ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাঈম! হৃদয় দহন, হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদার ইচ্ছা জাগল তার। এই মেয়েটি কি তাকে এভাবে ধোঁকা দিল? এরপর আর কী! যা হবার, তাই ঘটল; আঁখি সাইকেলে ফুল স্পিডে প্রস্থান করল, আর তার পিছে পিছে মুগ্ধ ধীর গতির ঠেলা গাড়ির মতো বাইক চালাচ্ছে। নাঈম হতাশ হয়ে মুগ্ধর শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ পিঠে মাথা রেখে আপন ভাগ্যের উপর শাপশাপান্ত কতে লাগল। তার আর কিবা করার আছে? নাঈম আফসোসের স্বরে বলল,
——— "এত কিছু করে কি হলো? কোনো লাভ হলো কি?? কিচ্ছু হলো না! কি করলে তুমি?? শুধু আমার উপর রা'গ দেখালে ধুররর! "
মুগ্ধর নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর,
——— " অনুভব করেছি! "
——— "এখানে অনুভবের কি আছে? হ্যাঁ আমিও অনুভব করেছি,,, ইচ্ছে হয়েছে একটা থাপ,,,,, "
নাহ আর বলা যাবে না! চুপ রইলো নাঈম! নয়ত ধাক্কা দিয়ে মুগ্ধ ফেলে দিতে দ্বিধা করবে না! শুধু বলল,
——— "তোমার মতো মহাপুরুষ হওয়ার সাধ্য সবার নেই ভাই!"
মুগ্ধ নীরব, কোনো কথার প্রয়োজন বোধ করল না। গভীর অন্ধকারে একা আঁখি সাইকেল চালিয়ে চলছে, আপন গতিতে, যেন সে রাত্রির বুকে একমাত্র জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। মুগ্ধ তন্ময় হয়ে দেখতে লাগল; এই চুনোপুঁটি কন্যা নির্ভয়ে রাত্রির নিঃসীমতায় নিজস্ব পথে এগিয়ে চলছে। সাইকেলের চাকার ঘূর্ণায়মান শব্দ নীরবতার বুক ছিড়ে, মুগ্ধকে আরও গভীরে টেনে নিলো। মুগ্ধ মনে মনে কিছু কথা উচ্চারণ করল; অদ্ভুত, নীরব বচন, যা তার মত গম্ভীর, রাগী পুরুষের মুখে কখনোই ধ্বনিত হতে কেও শুনে নি। একেবারেই অপরিচিত সেই ভাবনা। কেওই তার এই অন্তর্লীন কথাগুলি জানতে পারবে না, কেওই বুঝতে পারবে না সেই নিঃশব্দ অনুভব, যা কখনো তার ঠোঁট স্পর্শ করবে না,
——— "অনুভব; তা কি জানিস? বুঝিস কিছু? তার অস্তিত্ব যেন এই নিস্তব্ধ পৃথিবীর প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছে, অথচ তাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না। একান্তই বক্ষের গভীরে খোদাই হয়ে আছে; যেন কেউ তীক্ষ্ণ কোদাল দিয়ে হৃদয়ের পৃষ্ঠদেশ চি'রে দিচ্ছে। সেই চি'রে যাওয়া বুকে র'ক্তের সাথে বুনে যাচ্ছে অনুভূতির সূক্ষ্ম জাল, যা শুধু তাকে ঘিরেই সৃষ্ট। তার অস্তিত্ব সেই জালের প্রতিটি সুতোয় মিশে থাকে, হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে তার নাম প্রতিধ্বনিত হয়। মনের প্রতিটি কোণ, হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন শুধু তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। র'ক্তের প্রতিটি প্রবাহে তার সত্তা মিশে গেছে, প্রতিটি স্পন্দনে তার অস্তিত্বের প্রতিধ্বনি বাজে।
শুধু বাইকের গতিতে ছোঁয়ার তীব্র বাসনা অনুভব নয়!! পেছনে বসিয়ে ক্ষিপ্রগতির ব্রেক কষে তার শরীরের উষ্ণতা, তার স্পর্শের লোভে দিগন্ত ভেদ করা অনুভব নয়! না, এটা মোটেও অনুভব নয়। আমার আকাঙ্ক্ষা স্পর্শের মতো এতটা ক্ষুদ্র নয়; আমি তার স্পর্শের বাইরেও এক অন্য অনুভূতি খুঁজছিলাম। আমি কেবল তার অস্তিত্বকে হৃদয়ের প্রতিটি শিরায় গেঁথে রাখছিলাম, যেন তার উপস্থিতি মনের নিঃশ্বাসে মিশে থাকে। যেখানে ইন্দ্রিয়ের ভূমিকা শেষ হয় এবং অনুভূতির শাশ্বত জগৎ শুরু হয়। "
____________________
রাত্রির গভীর নিস্তব্ধতা ভেদ করে যখন সময়ের কাঁটা ১১:৪৫ অতিক্রম করল, নাঈম ও আঁখি শিকদার বাড়ির প্রবেশদ্বারে উপস্থিত হল। দরজায় আলতো ধাক্কা দিতেই যেন পূর্বেই প্রস্তুত ছিল, মুহূর্তেই দরজাটি উন্মুক্ত করলেন কানিজ বেগম। তাঁর চোখে স্পষ্ট উদ্বেগের ছায়া। নাঈম প্রথম প্রবেশ করে অগ্রসর হল, আঁখি পেছনে সঙ্কুচিত হয়ে ঢুকল। প্রবেশ করেই কানিজ বেগম দ্রুততার সহিত দরজা বন্ধ করে দিলেন।
অভ্যন্তরের নীরবতা হঠাৎ চূর্ণ করে এক গভীর, অন্ধকারময় কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হল,
——— "রাত কটা বাজল?"
ইকরাম আলীর দৃষ্টিতে যেন ক্রোধের অগ্নি, চক্ষু লালাভ আভায় দীপ্ত। তাঁর কঠিন কণ্ঠে শিকদার বাড়ির নীরব অন্দর কেপে উঠল। আসনে গভীর স্থিরতায় বসে রয়েছেন কুদ্দুস আলী, ইকরাম আলী, ও আজগর আলী। তাদের নিকটেই শান্ত হাতে চাবুক নিয়ে সিগারেট ফুকছে, তার চক্ষু নিস্পৃহ অথচ হিং'স্র দৃষ্টিতে আঁখির দিকে নিবদ্ধ। রোকেয়া বেগম ও কানিজ বেগমের মুখমণ্ডলে স্পষ্ট আতঙ্কের রেখা ফুটে উঠেছে। আর আফিয়া বেগম! তার ক্রো'ধ যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে! আঁখিকে দেখেই তার তীব্র দৃষ্টিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত হল, সোজাসুজি আঁখির দিকে ছুটে গেলেন!
——— "এই নোং'রা মেয়ে কোথাকার ! রাতের বেলা বাহিরে থাকিস? ল'জ্জা হল না? এই বাড়ির মেয়ে হয়ে আমাদের নাম ডুবাতে চাস?
আঁখি নীরব, নাঈমের পেছনে আত্মগোপন করে আছে। নাঈম শান্ত স্বরে নিবেদন করল,
——— " আহহা! বড় আম্মা, একটিবার কথা শুনো? পথিমধ্যে গাড়ি খারাপ হয়ে পড়েছিল। ফোনের চার্জও ফুরিয়ে গিয়েছিল, যার কারণে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি, আর আসতে এত দেরি হলো! "
ইকরাম আলী সেই অজুহাত শুনে রা'গে উন্মত্ত হলেন,
——— "আর কোনো অজুহাত শুনতে চাই না! মধ্যরাতে কন্যারা বাহিরে থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে না!"
তার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা আঁখির প্রতি নিবদ্ধ রইল, যেন কঠোরতা ভ'স্মী'ভূত করবে। আঁখি মাথা নত করে নাঈমের পশ্চাতে দাঁড়িয়ে রইল, নিঃশব্দে যেন রক্ষার প্রত্যাশা। কানিজ বেগমের হাত কাঁপছে, তার চোখে উদ্বেগের স্পষ্ট চিহ্ন।
নাঈম ধীর কণ্ঠে আবার বলল,
——— "বড় আব্বা, তুমি ভুল বুঝছ। সত্যই গাড়ি বিকল হইয়া গিয়েছিল, সেইজন্য দেরি হয়েছে।"
এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে থাকিয়া আফিয়া বেগম ফের ধেয়ে আসলেন, তার চক্ষু যেন আ'গ্নে'য়'গিরির লাভায় দগ্ধ।
———" আমি এইসব অজুহাত শুনতে চাই না! এই মেয়েটি (আঁখির দিকে ইঙ্গিত করিয়া) আমাদের মানহানি করতে পণ করেছে!"
রোকেয়া বেগম ক্রো'ধভরে প্রতিবাদ করলেন,
——— "ভাবি, নাঈম বলছে তো, গাড়ি খারাপ হয়েছিল! তবু তুমি এমন কথা বলছ কেন?"
আফিয়া বেগম ক্রুদ্ধ স্বরে উত্তর দিলেন—
——— "তুই চুপ থাক! মেয়ে সামলাতে জানিস না, আবার বেশি কথা বলিস?"
রোকেয়া বেগম হতবাক হয়ে আজগর আলীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। আজগর আলী নিশ্চুপ, কিন্তু তার মুখের রেখায় স্পষ্ট ক্রো'ধের ছাপ।
বাহিরে সাইকেলের চাকার ঘূর্ণি শেষে আঁখি ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়ছে। ঘামের ফোঁটা ললাট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, আর সমগ্র দেহ অবসন্নতায় আচ্ছন্ন। রোকেয়া বেগম মেয়ের এ অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে রান্নাঘর হতে এক পাত্র জল এনে স্নেহমাখা কণ্ঠে আহ্বান করলেন,
———" তুই আয় মা, বোস! কিছু হবে না, কেও কিছু বলবে না।"
কিন্তু আফিয়া বেগম কি তা সহজে গ্রহণ করবেন? রোকেয়ার হাতে ধরা জলপাত্র নিমিষে কেড়ে নিলেন, এবং এক মুহূর্ত দেরি না করে সেই জল সশব্দে আঁখির মুখমণ্ডলে ছুড়ে দিলেন! জল ছিটকে আঁখির ক্লান্ত মুখমণ্ডল যেন আরও বিবর্ণ হল, তার দেহ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।
ইকরাম আলী নিঃশব্দে হাসলেন। তার চক্ষুতে এমন প্রশান্তি, যেন বউয়ের কঠোর হাতে এই কন্যার শাসনের ভার দিয়ে তিনি একদম অসংশ্লিষ্ট দর্শক হয়ে বসে রইলেন। কুদ্দুস আলী মুখ নত করে আছেন, পুত্রের এই লা'ঞ্ছনা যেন তার আত্মমর্যাদায় চরম আ'ঘা"ত করছে। আজগর আলী তার কন্যার এই অবমাননা সহ্য করে যেন নির্লিপ্ত, যেন তার হৃদয়ের তৃপ্তি কণ্ঠের অতলে নিমগ্ন রইল। ভাবির কঠোরতায় তার অন্তরেও সন্তোষের তরঙ্গ জাগ্রত হল।
কিন্তু নাঈমের দেহে ক্রো'ধের স্ফু'লি'ঙ্গ জ্বলে উঠল। তার মুখ কঠিন, মুষ্টি আক্রোশে সংকুচিত হয়ে গেল।
শান্তর ঠোঁটের সিগারেটের শেষাংশ নিঃশেষিত হয়ে গেল। এবার উঠে দাড়ালো সে, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে পায়ের নিচে পিষিয়া ফেলল সে, হাতে চা'বু'ক, চোখ র'ক্তা'ভ, চোয়াল দৃঢ়। চা'বু'ক'টা শূন্যে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে । তার দিকে তাকিয়ে রোকেয়া বেগমের বুক ধক করে উঠল; আতঙ্কিত ভঙ্গিতে ছুটে এসে শান্তর সম্মুখে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
——— "এ কি করছিস বাবা? ও তো তোর বোন! এমন করিস না, বাবা!"
শান্তর র'ক্ত'মা'খা দৃষ্টি এক বিন্দু নড়ল না, আর কঠোর কণ্ঠে সে উত্তর দিল,
——— " তুই সর সামনে থেকে!"
রোকেয়া বেগম ভয়ে কাঁপছেন, অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন আজগর আলীর দিকে। কিন্তু আজগর আলীর চোখে খুশির ঝলক! শান্ত যেন তারই দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত কর্মটি সম্পন্ন করছে। তৃপ্তির স্রোত বইছে তার অন্তরে। ইকরাম আলীর বুক চওড়া হয়ে গিয়েছে, ছেলের এমন কঠোরতা তার মনে গর্বের ঢেউ তুলছে। এটাই তো প্রকৃত পুরুষের কাজ!
কুদ্দুস আলী যদিও নাঈমের প্রতি বিরক্ত, কিন্তু শান্তর প্রতি সন্তুষ্ট। আজ তিন ভাই মিলে সমস্ত ভার শান্তর হাতে সঁপে দিয়েছে; আজ শান্তই আঁখিকে সোজা করবে। তারা শুধু বসে দেখবে আর তৃপ্তির সুধা পান করবে।
আফিয়া বেগম শান্তর দৃঢ়তায় খুশি হয়ে উৎসাহ দিয়ে উঠলেন,
——— "দে, মে'রে দে! দু ঘা লাগা! তাহলেই বুঝবে, এই বাড়ির কথার অবাধ্য হলে কি পরিণাম হয়!"
রোকেয়া বেগমের স্থিরতা দেখে শান্ত ক্রো'ধে অধীর হয়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল; ছিটকে পরতে গেলে কানিজ বেগম ধরে নিলেন তাকে । শান্ত আঁখির প্রতি র'ক্তা'ভ চক্ষু নিক্ষেপ করে শিরশ্চরণে একবার লক্ষ্য করল। আঁখি তখন নাঈমের পশ্চাতে আত্মগোপন করছে। শান্ত হঠাৎ তি'ক্ত হাস্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
——— "তুই কি ভাবছিস, ওর পেছনে লুকিয়ে থাকলে আমার থেকে পালাতে পারবি? তোর প্রকৃত স্থান আজ তোর সম্মুখে প্রকাশ করব! এত বড় হয়ে গিয়েছিস? রাত পর্যন্ত বাহিরে থাকিস? তাও আবার শ'ত্রুর জায়গায়? তোর রক্ষা আজ কেওই করতে পারবে না! তোর নাঈম ভাইও না!
——— "ও তো যেতে চায় নি! নাঈম জোর পূর্বক নিয়ে গিয়েছে।"
কানিজ বেগম তীব্র স্বরে বললেন। কিন্তু আফিয়া বেগম পুত্রের পক্ষালম্বন করব বললেন,
——— "ওর কথা শুনতে হবে নাকি? সে ছেলে মানুষ, বলবেই! তাই বলে নাঈমের সাথে যেতে হবে কেন?"
শান্ত ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হল। নাঈম কঠোর কণ্ঠে বলল,
———" তুই কি ভুলে গিয়েছিস যে আমি এখানেই আছি? তোর এমন ধৃ'ষ্ট'তা কিরূপে হল যে চা'বু'ক আনার সাহস করলি? কিভাবে তুই ভাবলি যে আমার উপস্থিতিতে ওর গায়ে আ'ঘা'ত করতে পারবি? ওকে স্পর্শ করার আগে তোর আমার মুখোমুখি হতে হবে!"
শান্ত সশব্দে পরিহাস্য হাস্যবৎ হেসে উঠল! বলল,
——— " শুরুটা তাহলে তোকে দিয়েই হোক? "
এই বলে শান্ত এক ঘু'ষি মা'র'ল নাঈমের চোয়ালে। কিন্তু নাঈম কি থেমে থাকার মানুষ? সে-ও দিলো পাল্টা ঘু'ষি! দুই ভাইয়ের মধ্যে তুমুল ধ'স্তা'ধ'স্তি শুরু হলো। এই দৃশ্য দেখে আজগর আলী বললেন,
——— "ভাই, আটকাবো?"
ইকরাম আলী মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
——— "কোনো দরকার নেই!!"
শান্ত আর নাঈমের লড়াই তীব্রতর হলো, ধ'স্তা'ধ'স্তি'র এক পর্যায়ে শান্ত নাঈমের কানে বাঁকা হাসি দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
——— "ওভার অ্যাক্টিং এর জন্য ১০ টাকা কাট!"
শান্তর এমন কথা শুনে নাঈম রা'গা'ন্বিত মুখ বদলে হেসে ফেলল! কিন্তু পরক্ষণেই আবার রা'গের মুখোশ পরিয়ে নিলো। শান্ত এবার ফিসফিস করে বলল,
———" সরি ভাই..."
বলেই আবার এক ঘু'ষি মেরে নাঈমকে ফেলে দিলো! সঙ্গে সঙ্গে আফিয়া বেগম ছুটে গিয়ে নাঈমকে চেপে ধরলেন। এই সুযোগে শান্ত আকস্মিক বলিষ্ঠভাবে আঁখিকে টেনে বাহ্যিক জগৎ হতে রু'দ্ধ করে রুমে নিয়ে গেল, এবং দ্বারপাট বন্ধ করল। নাঈম উচ্চকণ্ঠে চেচিয়ে বলল,
——— " তোমাদের মা ছেলের সমস্যা কি?? কেন ওর পেছনে উঠে পরে লেগেছো? কি ক্ষ'তি করেছে ও তোমাদের.? বড় আব্বা তুমি কেন কিছু বলছো না? ছোট আব্বা তোমার মেয়েকে এভাবে মা'র'ছে কেন কিছু বলছো না?? "
তবে কারো কর্ণগোচর হল না নাঈমের চেচামেচি! ইকরাম আলী সহাস্যবদনে উঠে আফিয়া বেগমকে নিয়ে রুমের পথে যাত্রা করলেন। কুদ্দুস আলী কানিজ বেগমকে টেনে টেনে ছেলেকে ব'কা'বা'জি করে কক্ষে প্রবিষ্ট হলেন। আজগর আলীও হাসিতে প্রকম্পিত হয়ে রোকেয়া বেগমকে জোরপূর্বক টেনে সঙ্গে নিয়ে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। যেন কিছুই ঘটে নি, কিছু ঘটবে না; ঘটছে না!
প্রাসাদ নিস্তব্ধ। আলো আর পূর্বিকা নিঃসঙ্কোচে নিদ্রাবৃত, তাদের অবচেতনে বাড়িতে কি ভ'য়াবহতা হয়ে গেলো , তা কেও জানতেও পারল না। বাহিরে নাঈম ব্যর্থে দ্বার আঘাত করছে আর বলছে দ্বার খোলার জন্য। ভিতর হতে শুধু চা'বু'কে'র ম'র্মা'ন্তি'ক আ'ঘা'তে'র শব্দ আসছে!


Post a Comment

0 Comments

Close Menu