লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


(

সতর্কীকরণ: "এই পর্বে কিছু স'হিংসতা, খু*ন, এবং র*ক্তের বিবরণ রয়েছে, যা কারো কারো কাছে অস্বস্তিকর লাগতে পারে। পাঠক নিজ দায়িত্বে পড়বেন।")
*
*
নিশিথিনির প্রগাঢ় তমসায় বাহিত বৃষ্টি ধরিত্রীর বুকে মৃদু স্পর্শে সিক্ত হয়ে বিলীনের সূচনা ঘটছে। এ মুহুর্তে ধরণী যেন এক অপার্থিব সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ হয়ে উঠেছে। মেঘের গর্জনে এক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে, পরমুহূর্তেই নেমে আসে ভুবনে বৃষ্টির ফোঁটা। প্রতিটি ফোঁটা যেন মাটির সাথে মিশে প্রকৃতিতে এক নতুন জীবনের বার্তার আগমন ঘটাচ্ছে। অম্বর আঁধারে মেঘে আচ্ছন্ন যেন প্রকৃতির হৃদয়ের অস্থিরতা প্রকাশ করতে চায়। ঝমঝম বৃষ্টির ফোঁটা গুলো মাটিতে আছড়ে পড়ছে বজ্রের হুংকারের সাথে। বৃষ্টির সাথে বজ্রপাত যেন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিচ্ছে। বাতাসের ঝাপটা জানালার কাঁচে তীব্র আঘাত করছে, যেন সেটা ভেঙে ফেলে দেবে এমনই মনে হচ্ছে।
আলো তার কক্ষে বিছানায় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল। আকষ্মিক জানালার তীব্র ঝাঁকুনির শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে আতঙ্কিত হয়ে চমকে ওঠে, চোখ উল্টে জানালার দিকে তাকায়। দেখতে পায় জানালাটা খোলা, এবং বাতাসের শীতল হাওয়া ঘরের ভেতরে প্রবেশ করছে। পুরো ঘরটা আধো-অন্ধকারে ঢেকে আছে, শুধু মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকের আলোয় ঘরের কোণগুলো আলোকিত হচ্ছে।
আলোর শরীর শিরশির করে উঠল। সে আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং জানালাটা বন্ধ করতে এগিয়ে যায়। জানালাটা বন্ধ করার সময় হঠাৎই তার মনে হলো, বাবা-মার ঘর থেকে কিছু একটা শব্দ এসেছে। তার মনের গভীরে অজানা অস্থিরতা ভর করে। হয়ত ঝড়ের তীব্র শব্দে এমন মনে হয়েছে। তাই সে জানালা লাগিয়ে পা বাড়ায় বিছানার দিকে তবে তার ধারণা ভুল প্রমানিত করে আবারো একই শব্দ ভেসে আসে কর্ণকুহরে ৷ মনে হচ্ছে গোঙানির শব্দ। এবার সে কিছু টা চমকে উঠে। কিছু কি হয়েছে? এত রাতে কি হবে? একবার কি যাবে বাবা-মায়ের ঘরে? না থাক, যদি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে তাহলে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। তাছাড়াও এত অন্ধকারে ভয় জেকে বসেছে পুরো দেহজুরে। ঝড়ের রাতে বিচিত্র শব্দ আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই ভেবে আলো পুনরায় বিছানার দিকে পা বাড়াতে উদ্দত হয় তৎক্ষনাৎ আবারো বিকট শব্দ কর্ণকুহরে বারি খায় ৷ এবার পা জোড়া থমকে দাঁড়ায়। নাহ, একবার গিয়ে দেখা উচিৎ । চোরও তো আসতে পারে? তাহলে তো বিরাট সমস্যা। কিন্তু একা একা যেতে ভয় কাজ করছে। তবুই ভয় ভীতি দূর করে বুকে সাহস সঞ্চার করে কক্ষের দরজা খুলে৷ পুরো আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়ি ৷ ঝড়ের তান্ডবে বজ্রপাতের রশ্মি একটু পর পর উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। আলো ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে বাবা-মার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আলোর সুশ্রী সুবর্ণ গৌড় কোমল আননে ভ্রু উচিয়ে নেত্রযুগোলের কম্পিত দৃশ্য দেখে তার ভীতি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে৷ বাবা মায়ের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায় আলো। দরজাটা হালকা চাপানো, পুরোপুরি বন্ধ নয়। ভেতরে মৃদু আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। বাবা মা কি ঘুমায় নি? কিন্তু তাই বলে এত রাতে দরজা কেন খুলা? বাবা কি বাহিরে গিয়েছেন? বাহিরে গেলে কোথায় যাবে এত রাতে? তাও এই ঝড়বৃষ্টির রাতে? আলোর মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবলো এত ভেবে কাজ নেই ঘরে গেলেই বুঝা যাবে। এই ভেবে সহসা সাহস সঞ্চয় করে দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে ভেতরে ঢোকতে শুরু করে আলো।
তবে ভেতরে আর ঢুকলো না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সামনের দৃশ্য দেখে। চরমভাবে মস্তিষ্কের উপর যেনো লোহা দিয়ে কেও আঘাত করলো। আলোর হৃদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলো সামনে তার মা-বাবার রক্তা*ক্ত শরীরে মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখে। বাবা-মায়ের মৃ*তদেহ দুটি মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, একটার ওপর আরেকটা পড়ে রয়েছে। খু*নি নির্মম*ভাবে কু*পাচ্ছে, ধারালো বড় ছু*রি যা গরু কোরবানির সময় ব্যবহার করা হয়, প্রতিটি আ*ঘাতে র*ক্তের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে, যা মাটিতে লাল প্যাচের মতো জমছে। ঘরটি যেন এক অভিশপ্ত র*ক্তের সাগরে পরিণত হয়েছে। দেয়াল, মেঝে, সবকিছু র*ক্তের লাল ছোপে ছেয়ে গেছে। ছু*রি দিয়ে কো*পানোর সময় র*ক্ত ফিনকি দিয়ে তার মুখমন্ডলে ছিটকে বারি খাচ্ছে। সেই খু*নী হাতের লেগে থাকা র*ক্তের ঘ্রাণ নিতে শুরু করে যেনো ফুটন্ত পুষ্পকলির তাজা মনোরম সুঘ্রাণ। খু*নির চোখের চারপাশে র*ক্তের কালো দাগ, যেন তার মুখমণ্ডল একটি ভয়ঙ্কর চিহ্নে পরিণত হয়েছে। ঘরের মধ্যে র*ক্তের ক্ষুদ্রতর গন্ধ বাতাসে ভাসছে, যা শ্বাসরুদ্ধকর। খু*নির নিঃশেষ হাসি এবং ধারালো ছু*রির ধারালো শব্দ মিলেমিশে একটি বিভীষিকা সৃষ্টি করছে, যা পুরো ঘরকে এক অন্ধকার ও আতঙ্কিত পরিবেশে পরিণত করছে। র*ক্তের ছিটেফোঁটা সমস্ত ঘর লাল বর্নে ধারণ করেছে । যেনো কেও লাল রংতুলি দিয়ে পুরো কক্ষে চিত্র অংকন করছে। সেই নৃ*শংস খু*নি, তার মুখে বিকৃত হাসি, দাঁতে র*ক্তের চিহ্ন। সে আরও কু*পিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে তৃপ্তির হাসি।
কোন স্বভাবিক মানবের পক্ষে এই দৃশ্য দেখে দু'মিনিট থাকা সম্ভব নয়৷ র*ক্তের ছিপছিপে গন্ধ আরো ছড়িয়ে পরছে পুরো কক্ষ জুরে। দুর্বল হার্টের রোগীর জন্য এ দৃশ্য দেখলে তার কাছে মৃ*ত্যুসম বলে মনে হবে। আলো এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে পাথরের মতো জমে গেছে। তার পনেরো বছর বয়সী মস্তিষ্ক ভয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে। শরীর অসাড় হয়ে যেনো নেতিয়ে যাচ্ছে৷ মা-বাবার মৃ*তদেহের সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হাজার হাজার প্রশ্ন ভিড় করছে। হৃদপিণ্ড ধকধক করে বুকে আঘাত করছে বারংবার। এটা কি স্বপ্ন? হ্যাঁ তাই হবে। আজ একটু আগেও তো বাবা মায়ের হাসি মুখটা দেখে তাদের সাথে কথা বলে ঘুমাতে গিয়েছিল আলো। এটা নিশ্চিত ভুল দেখছে আলো। এটা হতেই পারে না, এটা সম্ভবই না। ঘুম ভাঙছে না কেন? এরকম ম*র্মান্তিক ভয়াতুর স্বপ্ন দেখতে চায় না আলো। কেও বোধহয় পেছন থেকে জাপ্টে ধরেছে। নয়তো নড়তে পারছে না কেন?? আলো নিজের মনে মনে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে পলকহীন চোখে মনে মনে চিৎকার করে যাচ্ছে,
আলো : না, না, আমাকে জাগতেই হবে!! এমন নৃ*সংস স্বপ্ন আমি দেখতে চাই না। আলো উঠ আলো!! আলো উঠে পর, আমি এই দৃশ্য আর সহ্য করতে পারছি না!!! উঠ আলো!!
অকস্মাৎ র*ক্তাক্ত চোখে খুনি তার দিকে ঘার বেকিয়ে তাকায়, চোখে সেই হিং*স্র তীব্রতা। মৃ*ত নিথর দেহ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে৷ আলোর দিকে অগ্নি চক্ষু নিক্ষেপ করে। আস্তে আস্তে ছু*রি হাতে আলোর দিকে এগোতে থাকে । আলোর বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এসব তার সাথে?? এখন কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। হটাৎ খু*নি দাঁড়িয়ে পরে, শকুনের মতো অক্ষিযুগোল ছোট করে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে,
~"বাঁচতে চাইলে পালিয়ে যা।"
সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ জাগ্রত হলো আলো এক আত'ঙ্কের চিৎকারে। তার সারা দেহ শিউরে উঠল, থরথর করে কাঁপছে ভয়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ভারী, হৃৎপিণ্ডের দ্রুত ওঠানামায় বুকের পাঁজর যেনো ভেঙে যাবে। বিশাল আলিসান কক্ষের সাদা শুভ্র বিছানায় সে শুয়ে ছটফট করতে লাগলো, যেনো কোন দুঃ'স্বপ্নের করাল গ্রাসে আবদ্ধ। আর সহ্য করা যাচ্ছে না, বারবার সেই ম'র্মান্তিক দৃশ্য!
ক্লান্তি আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সজ্জিত কক্ষের সর্বত্র সাদা রঙের আবির্ভাব। ঘরের এক প্রান্তে, ডানদিকে, স্থাপিত হয়েছে এক বিশাল বিলাসবহুল বিছানা, যার ওপর সাদা সিল্কি কম্বল আর মখমলি কুশনের সমাহার, যেনো এক স্বপ্নের আভাস প্রদান করছে।
বিছানার বিপরীতে, কক্ষের বাম কোণে রয়েছে একটি সাদা সোফা, নরম কুশনে আবৃত যা যেনো আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আরাম আর অবসরকে। ড্রেসিং টেবিলটি সাদা রঙের মাধুর্যে আচ্ছাদিত, নানান প্রসাধনী সামগ্রী সাজিয়ে রাখা, যেনো একটি শুভ্র শীতের পুষ্পস্তবক। তার সামনেই কাঠের শক্তপোক্ত টুল, মখমলি কুশনে সজ্জিত, বসার নিমন্ত্রণে আমন্ত্রণ।
কক্ষের ডান পাশে ছোট একটি বুকশেলফ, নানা রঙের বইয়ে পূর্ণ, যা বর্ণাঢ্য পুষ্পবীথির মতো। দেওয়ালে বিভিন্ন ছবি আঁকা, প্রতিটি সাদা রঙের শেডে মোহিত হয়ে, কক্ষের সাদা থিমকে সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলছে। সাদা মার্বেল ফ্লোরিংয়ের মসৃণতায় কক্ষটি এক স্বপ্নীল অনুভূতি তৈরি করেছে, যেনো শুভ্রতার অতলান্ত মহাসাগরে ভাসমান এক নৌকা।
এই শান্ত পরিবেশেও আলোকে যেনো দুঃ'স্বপ্নের সেই ভ'য়াবহ দৃশ্য তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তার মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই দৃশ্যের আ'তঙ্ক, যা ঘুমের মধ্যেও এক সজাগ দুর্যো'গের মতো আছড়ে পড়েছে তার মনে।
আলো গিয়ে আয়নার সম্মুখে দাঁড়ায়। ফর্সা মুখমণ্ডল ঘামে একাকার। আয়নার প্রতিবিম্বে নিজের দিকে তাকিয়ে সে দেখে, ক্ষণিকের জন্য। যেন আয়নার গহবরে বন্দী প্রতিচ্ছবির মধ্যে অদ্ভুতভাবে সঞ্চারিত হয়েছে তার অতীতের সমস্ত রূপ, যা এখন প্রায় অচেনা। এরপর বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,
- "ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!! চারটি বছর শুধু ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। মুখশ্রীতে পরিবর্তনের ছাপ, চামড়ার উজ্জ্বলতা ফিকে হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালো দাগ, মুখের কোথাও দাগ, কোথাও ছোপ পড়েছে। প্রাণবন্ত সেই আমি যেন ম্লান হয়ে গিয়েছি । সবকিছু কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে । দেহটা ক্লান্তির ভারে অবসন্ন। কতগুলো দিন আমি শুধু অচেতন ছিলাম, যেন জীবনটাই থেমে গিয়েছে।"
আলো এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার নিকট গমন করে। জানালাগুলি সাদা সুতির মোলায়েম পর্দায় আচ্ছাদিত। আলো ধীরে হাত বাড়িয়ে সেই পর্দা সরিয়ে জানালা উন্মুক্ত করলে, এক মৃদু শীতল বায়ুপ্রবাহ এসে আছড়ে পড়ে তার মুখমণ্ডলে। বাহিরে উজ্জ্বল চাঁদ, যেনো এক সুবর্ণ থালার ন্যায় আকাশে উত্থিত। চাঁদের দিকে চেয়ে আলো ভাবছে, কীভাবে এক অচেনা লোক তাকে সাহায্য করল, এমনকি এখনও করছে। এই মুহূর্তে সে এই লোকের বাসগৃহেই আশ্রয় নিয়েছে। যেখানে আপন কাছের মানুষরাই সাহায্য করতে দ্বিধান্বিত হয়, সেখানে আদিত্যর মতো একজন প্রভাবশালী চিকিৎসক যে প্রথম থেকে তার জন্য এতকিছু করে এসেছে, তা কল্পনাতীত! মৃ'ত্যুর ক'রাল গ্রা'স থেকে রক্ষা করে নিজের হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছে, এখন নিজের গৃহে আশ্রয়ও দিয়েছে। যদিও আলো নিজে ইচ্ছুক ছিল না, তবে তার কোনো উপায়ও ছিল না। এই অজানা শহরে সে কাউকেই চিনে না; সে যে কতটা নিঃসঙ্গ! লোকে নানান কথা বলেছে, তবে সেসবের কোনো পরোয়া করেনি আদিত্য। সোজা নিজের গৃহে নিয়ে এসেছে। আদিত্যর পিতা, সোহেল সাহেব, রাগারাগি করলেও আদিত্যর একটুও পাত্তা দেয়নি। সোহেল সাহেবও শেষে নীরব হয়েছিলেন, ছেলেকে প্রথমেই থামানো যায়নি, এখন কীভাবে থামাবেন তিনি? আলো আদিত্যকে বলেছিল অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে, তবে আদিত্য নাকচ করে বলেছিল,
- "যতদিন না আপনার পরিবারের সন্ধান পাচ্ছি, ততদিন আপনি আমার বাড়িতেই থাকবেন। ভয় পাবেন না, আমার পাগলি একটা বোন আর এক ভাতিজা আছে। ওরা থাকতে আপনি একা বোধ করবেন না। আমার সাথে চলুন।"
আলো সত্যিই অবাক হয়েছিল সেদিন। কী অপরিসীম সহৃদয়তার পরিস্ফুটন এই অপরিচিত, অজানা মেয়েকে সাহায্য করতে! আদিত্য কী না করেছে, কী না করছে! এই মানুষের সহধর্মিণী যে হবে, সে যেন স্বর্গীয় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে। আজ দুই দিন হলো আলো আদিত্যর গৃহে আশ্রিতা। আদিত্য সত্যিই সত্যি কথা বলেছিল; এই দুই দিনে তার মোটেও একাকিত্ব অনুভূত হয়নি। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে আদিত্যর বড় বোন নীলিমা তার পাশে থেকেছে, এক আদরের স্নেহে সিক্ত করেছে, যেন ছোট্ট বোনের মতোই। এই ভাবনাগুলির মধ্যে নিমগ্ন ছিল আলো, যখন এক দীর্ঘশ্বাস আরেকবার তার ঠোঁটের কোণে এসে মিলিয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎই তার চোখ-মুখে রা'গের আভাস ফুটে উঠল। ফর্সা মুখমণ্ডল র'ক্তিমাভ বর্ণ ধারণ করে। এক অস্ফুট স্বরে বলল,
- "তোর সময় ঘনিয়ে এসেছে!"
-------Facebook
-" না মা! ওখানে গিয়ে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারি না। বুকটা মো'চড় দিয়ে ওঠে, মা! তুমি আমাকে ওখানে আর যেতে বলো না।"
কথাটি বলে ফোন কেটে দেয় আরাফ। বুক যেন ছিঁ'ড়ে যাচ্ছে পুরনো সেসব কথা মনে করে। কেন এমন হয়? যারা কিছুই চায় না, শুধু চায় একটু ভালো থাকতে, তাদের ভাগ্যে কেন সেই ভালো থাকা লেখা থাকে না? দীর্ঘশ্বাস ফেলে অফিসের কেবিনে বসে এসব ভাবছিল আরাফ। তখনই পাশ থেকে ভেসে আসে এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর,
~ "কী করছ আরাফ?"
কণ্ঠটি শুনে আরাফের আর বুঝতে বাকি নেই, এই কণ্ঠের মালিক কে। আরাফ বির'ক্তি সহিত তাকায় মুনিয়ার দিকে, যে হাস্যজ্জ্বল মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সকল সৌন্দর্য যেন তাকে ঘিরেই। ফর্সা আননের মায়াবী হাসিটা সবার হৃদয় কাড়লেও আরাফের মন সে গলাতে পারে নি। এরপরেও সে আরাফের পিছু লেগেই রয়েছে। আরাফ কিছু বলছে না দেখে মুনিয়া আবার বলে,
- "আজকে কফি খেতে যাবে? চলো যাই?"
এক গাল হাসি নিয়ে মুনিয়া বলল। আরাফ না তাকিয়েই ফাইলে মুখ গুজে দিয়ে বলে,
- "সরি, আমার মেয়েকে নিয়ে আজ শপিংমলে যাব। সময় হবে না।"
- "তাহলে চলো কালকে যাই?"
আরাফ এবার বিরক্ত হয়েই বলে ওঠে,
- "শুনুন, আমার একটা মেয়ে আছে, কথা বুঝেছেন? আপনি আমার কাছে যা আশা করছেন, তা কখনো সম্ভব নয়।"
মুনিয়ার চোখে মুখে আঁধার নেমে আসে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মায়াবী আঁখিদয়জুরে অশ্রু টলমল করছে। আরাফের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে,
-" ওই মেয়েটা তো তোমার নয়! তুমি তো বিয়েই করো নি! তুমি কি ভেবেছো আমি জানি না? প্লিজ আরাফ, আমি তোমার ভালোবাসার আ'গুনে পুড়ে খার খার হয়ে যাচ্ছি। ওই মেয়েটাকেও আমি মেনে নেব, তবুও আমাকে ফিরিয়ে দিও না আরাফ!"
রা'গে আরাফ এবার ঠাস করে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে মুনিয়াকে মা'রতে উদ্যত হয়ে চিৎকার দিয়ে বলে,
- মুনিয়ায়ায়া!!! (রেগে)
মুনিয়া চোখ-মুখ খিচে বন্ধ করে নেয়। অফিসের সবাই গোল গোল চোখে হা করে তাকিয়ে আছে। আরাফ নিজেকে সংযত করে হাত উঁচু করেই রাখে। এরপর হাত নামিয়ে রাগে ফুসফুস করতে থাকে। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগে মুনিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-" আমার ব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না! আর জানতেও আসবেন না। এর অধিকার আপনার নেই! আমি দিবও না।"
বলেই রা'গে ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায় আরাফ। অফিসের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে, আরাফের এমন আচরণ তারা কোনোদিন দেখে নি। আর আজ কিনা মুনিয়াকে মা'রতে উদ্যত হয়েছিল? বিষয়টা অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে দিচ্ছে সবাইকে। সবার দৃষ্টি এখন মুনিয়ার দিকে নিবদ্ধ, যে এখন অশ্রু বিস'র্জন দিচ্ছে। মুনিয়ার কাছে আলিজা এসে বলে,
-" এই, তুই ঠিক আছিস তো? তোকে এভাবে আরাফ মারতে গিয়েছিল কেন? কী হয়েছে বল?"
মুনিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। গলা আটকে গিয়েছে তার। কথা বের হতে চাইছে না। বুকের ভিতর অসহনীয় য'ন্ত্রণা। মুনিয়া কিছু বলছে না দেখে আলিজা বলে,
- "দেখ মুনিয়া, তোর জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। তোর মতো সুন্দরীর পিছনে হাজারটা ছেলে ঘুরে বেড়ায় আর তুই কিনা? একটা ছেলের জন্য নিজের মানসম্মান নিজেই শেষ করছিস? তুই বললেই হাজারটা ভালো ভালো ছেলে তোকে বিয়ে করতে লাইন লাগিয়ে দিবে। দেখ তোর ভালোর জন্য বলছি, তুই ওকে ভুলে যা! দেখলি তো কী অ'সভ্য ছেলে! এসব ছেলের পেছনে ঘুরে নিজের সময় বরবাদ করিস না!"
বলেই আলিজা স্থান ত্যাগ করে। মুনিয়া মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। অশ্রুরা আজ যেন বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। এতো কেন য'ন্ত্রণা? কেন এতো পু'ড়ছে ভেতরটা? ভালোবাসা কি অপরাধ? শুধু ভালোই তো বেসেছে! মুনিয়া চোখের জল মুছে বিড়বিড় করে বলে,
-" কী করে ভুলে যাই, আলিজা! ওর প্রতিটা হাসি, প্রতিটা কথা, প্রতিটা পদক্ষেপ আমার ভাঙা হৃদয়ের প্রতিটা ক্ষতকে আরও গভীর করে দেয়। ওর প্রতি আমার অনুভূতি এমন যে তা আমাকে ভেতর থেকে ছি'ন্ন-বি'চ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ওর প্রতিটা অবজ্ঞা, প্রতিটা উপেক্ষা আমাকে আরও বেশি ক্ষ'তবিক্ষ'ত করে। আমার হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন শুধু ওর নামেই বাঁধা। আমি তো হাজারটা ছেলে চাই না। আমি ওই একজনকে চাই! সুন্দর হলেই কি ভালোবাসা পাওয়া যায়? তাহলে ও কেন আমায় ভালোবাসলো না? ভালোবাসা কোনো যুক্তি মানে না, কোনো শর্ত মানে না। তাই তো আমি প্রতিটা বে'দনাকে সযত্নে বহন করি, কারণ আমার অন্তরের গভীরে শুধু ওর ছায়া বিরাজ করে।।"
0 Comments