লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


দীপ্রহরের রোদ্দুর তেজস্বী অন্তরিক্ষে আধিপত্য বজায় রেখে চারপাশে তীব্র গরমের আভাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাছপালা যেন গ্রীষ্মের তাপে নিঃশব্দে জরাজীর্ণ। পাখপাখালিরা গা ঢাকা দিয়েছে, মানুষেরাও বিশ্রামের খোঁজে গৃহমুখী। রাস্তাগুলো প্রায় শুনশান, কেবল গরম বাতাসের স্রোত ধুলোর কণা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমনি এক তাপমাত্রা যুক্ত বেলায় নিজের কাজ শেষ করে গোসল সেরে সবে মাত্রই নিজের কক্ষের বেলকনিতে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়েছিল রুদ্র। ভেজা চুল দিয়ে এখনো টপটপ পানি চুয়ে পরছে ঘাড় বেয়ে। সুঠাম গৌড় বর্ণের বলিষ্ঠ দেহের যুবক নিশ্চিত ভাবে সুদর্শনের খাতে তার নাম প্রথম স্তরের দিকে পরবে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বাহিরে অবস্থান করলেও মাথায় তার ছিল অন্য চিন্তা। সেই মুহূর্তে তার ফোনটা বেজে উঠল।
-"হ্যালো, CID অফিসার রুদ্র বলছি।... ওকে ইমিডিয়েটলি সব ব্যবস্থা করো কুইক। আমি সোজা এয়ারপোর্টে যাচ্ছি।"
জুনিয়র অফিসার জিসানের ফোন পেয়ে রুদ্র দ্রুত রেডি হতে লাগল পরবর্তী মিশনের জন্য। এরমধ্যেই কক্ষে প্রবেশ করেন জয়নাল সাহেব। রুদ্রকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে রেডি হতে দেখে ভ্রুযুগল কুচকে নেন তিনি। রুদ্র নিজের হাতে ব্লাক ঘড়ি পরতে পরতে তাকান জয়নাল সাহেবের দিকে।
জয়নাল সাহেব প্রশ্ন করেন,
- "কোথায় যাচ্ছিস? একটু আগেই না বাসায় ফিরলি??"
রুদ্র যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। জয়নাল সাহেবের পানে মুচকি হেসে বলল,
-"কাজ আছে চাচা! আমি আসি।"
বলেই গটগট করে কক্ষ ত্যাগ করতে নিলে জয়নাল সাহেব উত্তেজিত হয়ে থামিয়ে বলেন,
-"কিছু খেয়ে তো যা!!"
রুদ্র আর দাঁড়াল না। সামনের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,
-"ইমারজেন্সি কেস, যেতেই হবে চাচা। আমি বাহিরে খেয়ে নিব।"
গাড়িতে উঠে দ্রুত এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিল রুদ্র। মনের মধ্যে চিন্তা ঘূর্ণি চলছিল,হঠাৎ ফোনটা আবার বেজে উঠল, জিসানের ফোন। রুদ্র স্পীকারে রেখে ফোন রিসিভ করল।
- "হ্যাঁ, জিসান। কোনো আপডেট?"
-"স্যার, আমরা সিকিউরিটি ফুটেজগুলো সংগ্রহ করেছি, কিন্তু একজন ব্যক্তি মনে হয় পাসপোর্ট কন্ট্রোলে গ্যাপ দিয়ে পালিয়েছে। আমাদের সন্দেহ ওই আসল অপ'রাধী। আমরা এখনই ট্র্যাকিং শুরু করেছি, তবে সময়ের খুব প্রয়োজন, স্যার।"
-"আমি পৌঁছে যাচ্ছি। যা করার সব করো। একটাও খুঁটিনাটি বাদ দিবে না।"
-"ঠিক আছে, স্যার!"
ফোন কেটে দিয়ে রুদ্রের চোখে দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠল। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা তার কাছে কোনো নতুন বিষয় নয়। শহরের রাস্তাগুলো দ্রুত পেছনে ফেলে আসছিল, আর এয়ারপোর্টের কাছাকাছি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে রুদ্র নিজের মনের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য যু'দ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
---
জয়নাল সাহেব রুদ্রর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। রুদ্রকে তিনি সবসময় নিজের ছেলের মতোই দেখেছেন। সেই ছোট্টবেলা থেকেই বাবা-মাকে হারিয়েছে রুদ্র। রুদ্রর বাবা, রিয়াজুর রহমান, ছিলেন জয়নাল সাহেবের প্রাণপ্রিয় বন্ধু। তারা একই গ্রামের ছেলে হলেও, রিয়াজুর রহমান শহরে নিজের বাড়ি বানিয়ে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। তবে দুজনের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি; বরং, তা আরও গভীর হয়েছে।
রুদ্রর বাবা-মায়ের মৃ'ত্যুর পর আত্মীয়-স্বজনরা তাকে আশ্রয় দিতে প্রত্যাখ্যান করে। সেসময় জয়নাল সাহেব নিজেই রুদ্রকে তার নিজের ঘরে নিয়ে আসেন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা একজন বেড়ে হলো চারজন — জয়নাল সাহেব, তার স্ত্রী ঊর্মিলা বেগম, তাদের ছেলে প্রান্ত, এবং রুদ্র। তিনি রুদ্রকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন, কখনোই আলাদা চোখে দেখেননি। রুদ্রর সব খরচও তিনি নিজেই বহন করতেন।
রুদ্র এবং প্রান্ত ছিলো বেস্ট ফ্রেন্ড, একসঙ্গে বড় হয়েছে তারা, একই সাথে পড়াশোনা করেছে। তাদের ছোট্ট পরিবারটি ছিলো খুব সুখী। কিন্তু, জীবন তো আর শুধু সুখের গল্প নয়। কথায় আছে, "দুঃখী যায় সুখের কাছে, দুঃখ যায় দুঃখীর কাছে "। জয়নাল সাহেবের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। হঠাৎ গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রান্ত মা'রা গেল, সাথে অনেক টাকাও অবশ্য প্রান্তের সাথে থাকায় ওগুলোও জ'লেপু'রে ছাড় খার হয়ে যায়। জয়নাল সাহেবের ব্যবসাও ধ্বং'স হয়ে যায়। একসময়ের বড় ব্যবসায়ী সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে পড়েন। সব সম্পত্তি বিক্রি করে এখন শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুই তাদের একমাত্র সম্বল। তবে এতে তার কোনো আক্ষেপ নেই। "যেখানে সন্তানই নেই, সেখানে এত টাকা-পয়সা দিয়ে কী হবে?" এই প্রশ্নই তিনি নিজেকে বারবার করেন। রুদ্র এখন তার একমাত্র সম্বল, যে দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। নিজের ভেতরের য'ন্ত্রণা চেপে রাখে, সেও তো নিজের বন্ধুকে হারানোর য'ন্ত্রণা পাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করেনা কখনো, যাতে জয়নাল সাহেব এবং ঊর্মিলা বেগম আর না ভেঙে পড়েন।
প্রান্ত মা'রা যাওয়ার পর থেকে ঊর্মিলা বেগম ধীরে ধীরে বদলে যান। রুদ্রকে সহ্য করতে পারেন না তিনি। প্রান্তের কথা মনে পড়লেই যেন রুদ্রকে কটাক্ষ করে কথা বলেন। হয়তো রুদ্রকে দেখলে ছেলের কথা বেশি মনে পড়ে যায়। কিন্তু অন্যভাবেও তো হতে পারত; রুদ্রকে যদি ঠিক আগের মতোই সন্তান বলে আঁকড়ে ধরতেন, তাহলে হয়তো প্রান্তের শোক কিছুটা হলেও লাঘব হত। তবে মায়ের মন বোঝা যে বড় দায়!
---
জয়নাল সাহেব নিজের কক্ষে ফিরে যান। বিছানায় তার অ'সুস্থ স্ত্রীকে দেখতে পান, ছেলের ছবি বুকে নিয়ে ঘুমোচ্ছেন। আহ! আর দেখতে পারেন না তিনি। এই দৃশ্য দেখলেই তার পিতৃ হৃদয় দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে দরজা লাগিয়ে দেন। দরজা লাগানোর শব্দে কাঁচাঘুম ভেঙে যায় ঊর্মিলা বেগমের। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেন তিনি। হাতে নিজের পুত্রের ছবি, কিছুটা শান্ত হলেন তিনি। ছেলে মা'রা গেলেও মায়ের মমতা কি কখনো শেষ হয়? তার কাছে তার ছেলে আজও জীবিত।
ছবিটা ভালো করে আঁচল দিয়ে অতি স্নেহের সঙ্গে মুছে দেন তিনি। এরপর নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন। মনে হয়, তার ছেলে এখনো তার কাছে, তাকে জড়িয়ে আছে। এইতো ছেলের শরীরের ঘ্রাণ পরিষ্কার পাচ্ছেন তিনি। কে বলেছে তার ছেলে মা'রা গেছে? মা বেঁচে থাকতে কখনোই তার সন্তান মা'রা যেতে পারে না! ঊর্মিলা বেগমের চোখ দিয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলতে থাকেন,
-" তুই কেন এমন করলি বাবা?? তোর কি মায়ের কথা একবারো মনে পরে নি?? মা যে তোকে ছাড়া থাকতে পারে না, তুই না খেলে আমি মা ভাত খাই না, তুই না ঘুমালে মায়ের চোখেও ঘুম আসে না। বাবারে!! সেই মা এখন তোকে ছাড়া আমার খেতে হয়, ঘুমাতে হয়। বাবারে বিশ্বাস কর গলা দিয়ে ভাত নামে না, মনে হয় আমার ছেলেটা খেয়েছে তো?? ঘুমাতে পারি না, মনে হয় আমার ছেলে ঠিক আছে তো? শরীর খারাপ হয় নি তো .?? আমার ছেলে এখনো আসছে না কেন?? বাবারে আমি মা এখনও মনভুলা। এই যে তুই আর নেই, এটা আমার মনেই থাকে না। বাবারে একটা বার আমার কাছে আসতি ৷ তোর মা যে তোর মা ডাক শুনার জন্য কাতর হয়ে থাকে বাবা!! তোর কোন দোষ ছিল না বাবা !! মা তো তোর পাশেই ছিলাম, কেন এই মায়ের বুক খালি করে চলে গেলি?? আমার সোনামানিক, আমি কাকে বলে ডাকব?? বাবারে? তুই তো আমার হিরের টুকরো ছিলি। আমার কলিজার টুকরো তুই। কেন গেলি মাকে ছেড়ে?? "(কান্না মিশ্রিত কন্ঠে
কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে চলেন ঊর্মিলা বেগম।
পরমুহূর্তেই তিনি অশ্রুসিক্ত হয়ে চোখ মুখ শক্ত করে নেন। নেত্রপল্লবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে রাগে কিড়মিড় করে বলেন,
-"রুদ্র! তোর জন্য আমার ছেলে আজ বেঁচে নেই! এইসব কিছুর জন্য তুই দায়ী। আমার ছেলের মৃ'ত্যুর জন্য তুই দায়ী রুদ্র। এক মায়ের আ'র্তনাদ, চিৎকার, হা'হাকার তোকে কখনো সুখী হতে দিবে না রুদ্র। কখনো না!!!"
---Email
~ফ্লাসবেক
দিনাজপুরের পার্বতিপুর গ্রাম প্রকৃতির এক অনন্য নিদর্শন, যেখানে সবুজের সমারোহে ভরা মাঠ, পুকুরের স্বচ্ছ জল, এবং গাছপালা এক অপূর্ব দৃশ্যপট তৈরি করেছে। নদীর ধারে হাঁটলে মনে হয় প্রকৃতির নিবিড়তায় হারিয়ে যাচ্ছি। মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি আর মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি যেন ধর্মীয় সম্প্রীতির এক সুন্দর সুর তুলে ধরে। এই গ্রামে প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে একটি গভীর বন্ধন বিরাজমান, যা গ্রামটিকে শান্তি ও সৌন্দর্যের এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তবে আজ গ্রামের এই শান্ত পরিবেশে এক উত্তপ্ত উত্তেজনার আগমন ঘটেছে, কারণ এখানে এক মহতী সমাবেশের আয়োজন হয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান শিকদার ইকরাম আলী এবং সাবেক চেয়ারম্যান শাহারিয়াজ মোশারফ সাহেবের মধ্যে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হতে যাচ্ছে। বহু বছর ধরে শিকদার ও শাহারিয়াজ পরিবারের মধ্যে দ্ব'ন্দ্ব লেগে আছে, যার কারণ আজও অজ্ঞাত। কেন এই শ'ত্রুতা? কেও আসল কথা জানেন না। সকলের ধারণা রাজনৈতিক কারণেই হয়তো এই দ্ব'ন্দ তবে এর পেছনে রয়েছে এর থেকেও বড় কারণ। যা শুধু পরিবারের সদস্যরাই জানেন। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির এই লড়াই শুধু দুই পরিবারের পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, দুই পরিবারের নারীরা সবসময় এই বৈরিতা থেকে বিরত থাকেন।
সমাবেশের জন্য গ্রাম্য বটতলায় এক বিশাল মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বর্তমান চেয়ারম্যান শিকদার ইকরাম আলী তাঁর অনুগামীদের সাথে সাদা পাঞ্জাবি ও কালো চাদর পরিহিত অবস্থায় উপস্থিত হয়েছেন। অপরদিকে, শাহারিয়াজ মোশারফ সাহেব তাঁর সহচরদের সাথে সিল্কের পাঞ্জাবি পরিধান করে মঞ্চে উঠেছেন। উভয় পক্ষের সমর্থকরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
সমাবেশে যে উত্তেজনার সঞ্চার ঘটেছে, তা যেন পূর্বপুরুষের ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।
সমাবেশটি শুরু হলো শিকদার ইকরাম আলীর সংক্ষিপ্ত অথচ সুনিপুণ বক্তৃতার মাধ্যমে, যেখানে তিনি বেশ প্রীত মনে বললেন,
- "আমাদের গ্রাম আজ উন্নয়নের এক নূতন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। রাস্তাঘাট, পানির সরবরাহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোসহ আরও বহুবিধ উন্নয়ন আমাদের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা একত্রে এই গ্রামকে আরও সুদূরে অগ্রসর করতে পারব।”
শাহারিয়াজ মোশারফ সাহেব এই কথা শুনে কিছুটা ক্রু'দ্ধ স্বরে প্রতিতর্ক করলেন,
- "আপনারা উন্নয়ন করেছেন, কিন্তু সেই উন্নয়ন কতখানি স্থায়ী হবে? গ্রামের মানুষ আজও বেকারত্বের অভি'শাপে জর্জরিত, কৃষকরা তাদের ফসলের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। উন্নয়ন কেবল দেখানোর জন্য নয়, তা বাস্তবে টিকে থাকার মতো হতে হবে।"
শিকদার ইকরাম আলী বিদ্রূপের সুরে উত্তর করলেন,
- "আপনার সময়ে কেবল পরিকল্পনা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন কোথায় ছিল? আমরা এসে সেই অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করেছি, এবং আজ গ্রামবাসী তার সুফল ভোগ করছে।"
এই বাক্য মোশারফ সাহেবকে আরও ক্ষি'প্ত করে তুলল। তিনি উত্তপ্ত স্বরে বললেন,
- "আপনারা কেবল বড় বড় কথা বলেন। গ্রামবাসীর আসল সমস্যাগুলো আপনারা বুঝতে পারেন না। আমাদের সময়ে গ্রামে শান্তি ছিল, কোনো বিশৃঙ্খলা ছিল না। আজ গ্রামবাসীরা নিরুপায়, অসন্তুষ্ট।"
শিকদার ইকরাম আলী মৃদু হাসিতে বিদ্রূপ করে বললেন,
- "হ্যাঁ, শান্তি ছিল, কারণ আপনারা সবকিছু নিজেদের কু'ক্ষিগত করে রেখেছিলেন। গ্রামবাসীর কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছিল। আমরা এসেছি সেই নিস্তব্ধতাকে চূ'র্ণ করতে। আমরা এনেছি পরিবর্তন, যা আপনি নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন।"
শাহারিয়াজ মোশারফ সাহেবের মনে যেন আ'গুন দাউ দাউ করে জ্ব'লতে লাগল। নিজের রা'গ সংবরণ করতে করতে তিনি আসনে সামান্য এগিয়ে বসে বললেন,
- "আমাদের সময়ে এই গ্রামে প্রকৃত শান্তি ছিল, যে শান্তি আপনারা আনতে পারেননি। আপনারা কেবল উন্নয়নের কথা বলছেন, কিন্তু মানুষের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন।"
শিকদার ইকরাম আলী বিদ্রূপের মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,
- "মানুষের মন জয় করতে পেরেছি বলেই তারা আমাদের ভোট দিয়েছে, আমাদের উপর বিশ্বাস রেখেছে। আপনারা এখন অতীত, আমাদের কাছ থেকে শিখুন, কীভাবে মানুষের জন্য কাজ করতে হয়।"
এই কথাগুলো মোশারফ সাহেবকে আরোও রা'গিয়ে দেয়, তার মনে হয় এখনি ইকরামের মাথা ফা'টিয়ে তাকে শা'য়েস্তা করা উচিত, কিন্তু তিনি জনসমক্ষে এই কাজ করতে চান না। গ্রামের মানুষ তাকে এখনও সম্মান করে, এবং সেই সম্মান হারানোর আশঙ্কায় তিনি নিজেকে সংযত রাখেন। ইকরাম আলী তার দিকে মৃদু হাসি দিয়ে তাকায়, যেন এই বিতর্কে তিনিই জয়ী হয়েছেন।
এদিকে দু'পক্ষের সমর্থকরা ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। ইকরাম আলীর দলের একজন গর্জন করে বলে ওঠে,
- "আপনারাই ব্যর্থ, আমাদের চেয়ারম্যানই সেরা!"
মোশারফ সাহেবের দলের সমর্থকরা পাল্টা চিৎকার করে,
- "না, আমাদের চেয়ারম্যানই প্রকৃত নেতা!"
এইভাবে কথোপকথন ক্রমশ উত্তেজনার দিকে গড়ায়। গ্রামের মানুষও কিছুটা আত'ঙ্কিত হয়ে পড়ে। দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে ধীরে ধীরে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। লা'ঠিসোটা নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে কেউ কেউ, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঠটি র'ণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে শিকদার ইকরাম আলী দ্রুত মঞ্চ থেকে নেমে এসে দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলেন,
- "থামুন!"
তবু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করে না। তখন ইকরাম আলীর মাথায় আরেকটি বুদ্ধি আসে। তিনি তার সহকারী মুহাম্মদ আরিফ কে ডেকে কিছু বলেন। মোশারফ সাহেব তার দিকের তাকিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনার গভীরতা বুঝে নেন। মুহাম্মদ আরিফ ইকরাম আলীর কাছে একটি মাইক নিয়ে আসে। এবার ইকরাম আলী মাইকে আরও উচ্চস্বরে বলেন,
- "আপনারা সবাই থামুন!"
ইকরাম আলীর গর্জনে উভয় পক্ষের সমর্থক এবং গ্রামবাসী থেমে যায় এবং তার দিকে তাকায়। তিনি আবার গম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করেন,
- "এই গ্রাম আমাদের সবার। আমরা সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই। ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই। আমি চাই না আমাদের গ্রামে এই ধরনের বি'শৃঙ্খলা চলুক। আমরা সবসময় একে অপরকে সম্মান করতে শিখেছি।"
গ্রামবাসীরা তার কথায় মনোযোগ দেয়। ইকরাম আলী আরও বলেন,
- "আমি আপনাদের সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে গ্রামের উন্নয়নে মনোনিবেশ করি। এই গ্রাম আমাদের সবার, আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের ঐক্য এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর।"
শিকদার ইকরাম আলীর এই ভাষণ গ্রামবাসীদের হৃদয় স্পর্শ করে, এবং তাদের উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমে আসে। সাবেক চেয়ারম্যান শাহারিয়াজ মোশারফ সাহেবের মুখে ক্রো'ধের ছাপ স্পষ্ট, কারণ তিনি বুঝতে পারেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী নিপুণ কৌশলে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন এবং নিজেকে আরও শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছেন।
গ্রামবাসীরা এবার শিকদার ইকরাম আলীর প্রশংসা করতে থাকে, তার নেতৃত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। ইকরাম আলী মঞ্চে উঠে দাঁড়ান, তার মুখে বিজয়ের হাসি, আর তার পাশে তার ভাই কুদ্দুস আলী ও আজগর আলী উচ্ছ্বসিত মনে দাঁড়িয়ে থাকে। ইকরাম আলী মুচকি হেসে মোশারফ সাহেবের দিকে তাকায়, যার চোখে এখনো ক্রো'ধের আগুন জ্বলছে। ইকরাম আলী ধীরপদে মোশারফ সাহেবের কাছে এগিয়ে গেলেন। মোশারফ সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত দেখালেও ইকরামের মুখে ঠাণ্ডা, সংযত হাসির রেখা স্পষ্ট। ইকরাম আলী নীচু স্বরে, কিন্তু স্পষ্ট কণ্ঠে বলেন,
- "মনে আছে মোশারফ!!! আমি একদিন বলেছিলাম, একদিন তোর জায়গায় আমি হবো চেয়ারম্যান? আজ আমি সেই জায়গায় আছি। যে জায়গার জন্য তোর এত অহংকার ছিলো, আর তুই ভেবেছিলি আমি অযোগ্য, তার জন্যই তো তুই.... "
কথা বলতে গিয়ে ইকরাম আলী থেমে যান। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ায় তার মুখে কা'ঠিন্য ফুটে ওঠে। চোখ বন্ধ করে রা'গ দমানোর চেষ্টা করেন। তারপর আবারো বাকা হেসে বলেন,
- "কিন্তু দেখ, আজ এই অযোগ্য ব্যক্তিই তোর স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। আর তুই?? হাহাহাহা! তুই তো পুরনো জায়গাতেই রয়ে গেছিস, শুধু গদির নিচে জমে থাকা ধুলোর মতো।"
ইকরামের কথায় এক রহস্যময়তা প্রবাহিত হয়, যেন তিনি আরো কিছু বলবেন, কিন্তু বলেন না। তার চোখে অতীতের প্রতিজ্ঞার প্রতিফলন স্পষ্ট, যা আজ পূর্ণ হয়েছে। মোশারফ সাহেব রে'গে চুপ থেকে ইকরামের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর ধীর, কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলেন,
- "এটুকুতেই এত অহংকার? তুই গদির নিচে জমে থাকা ধুলোর কথা বলছিস, কিন্তু তুই নিজেই তো পুরনো জায়গায় ফিরে গেছিস। সেটাই তো প্রমাণ করে, আমি তোর যোগ্যতা সম্পর্কে সঠিক ছিলাম। তোর সাময়িক ক্ষমতা কিছুই প্রমাণ করে না। আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তখনই জানতাম তোর আসল যোগ্যতা কি। যোগ্যতা ক্ষমতার দ্বারা প্রমাণিত হয় না, ইকরাম। আজ তুই নিজেই সেটা প্রমাণ করছিস। তুই সেদিনও অযোগ্য ছিলি, আজও তেমনই অযোগ্য আছিস। তুই কি ভেবেছিস, তোর চেয়ারম্যান হওয়া আমার সিদ্ধান্তের প্রতি আফসোস করাবে? হাহাহা! এখনো বোকাই রয়ে গেছিস! আজকের দিনটা তোর, কিন্তু মনে রাখিস, আগামী দিনগুলো আমার হবে। সময় আসবে, সেই সময়ের অপেক্ষায় থাক। তুই যা দেখছিস, তা শেষ নয়, বরং শুরু। সামনের দিনগুলোতে কে কোথায় থাকবে, তা সময়ই বলবে।"
কথা শেষ করতেই পাশে দাঁড়ানো সাজ্জাদ সাহেব রেগে বলেন,
- "ভাই, তুমি এসব ফা'লতু মানুষের সাথে কেন কথা বলছো?"
ইকরাম আলী চোয়াল শক্ত করে তাকান। মোশারফ সাহেব নিজের রা'গ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না আশেপাশের লোকজনের মুখে ইকরামের জয়জয়কার শুনে। মাথায় যেন র'ক্ত উঠে যাচ্ছে। ফলে তিনি দ্রুত গন্তব্যের দিকে রওনা দেন, সাথে ভাই সাজ্জাদ সাহেব এবং সহকারী হাফিজুর রহমান। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে ফুল স্পিডে বাড়ির দিকে যেতে বলেন।
ইকরাম চোয়াল শক্ত করে হাসেন এবং বলেন,
- "আমার বুকে তুই যে আ'গুন জ্বালিয়েছিস, সেই আ'গুনে তোকে যদি না পো'ড়াই, তাহলে আমার নাম শিকদার ইকরাম আলী নয়!"
এরপর ইকরাম আলী তার ভাই, ছেলে এবং সহকারীসহ গাড়িতে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দেন। গ্রামের লোকজন একে একে তাদের কাজে ফিরে যান, কিছুক্ষণ পরেই মাঠ সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যায়।
----
শাহারিয়াজ ভবন, এক প্রাচীন স্থাপত্যের মহিমা ও আভিজাত্যের মেলবন্ধন। সুরম্য লোহার গেটের উপরে খোদিত রৌপ্যপাতে লেখা "শাহারিয়াজ ভবন" সমুজ্জ্বল আভা দূর থেকে চোখে পড়ে। প্রবেশদ্বার অতিক্রম করিলেই ডান দিকে বিরাট পার্কিং প্রাঙ্গণ, যেখানে একত্রে বহু গাড়ি রাখা সম্ভব। সামনের পাথর বিছানো পথখানি মূল ভবনের দিকে প্রসারিত, পথের দুই ধারে ক্ষুদ্র জলপ্রপাতের মৃদু ধ্বনি যেন প্রাকৃতিক সুরের মতো বেজে উঠে। বামে কাষ্ঠ নির্মিত গোলাকার প্যাভিলিয়ন, যার চারপাশে অর্কিডের ঝুলন্ত রূপ এস্তরিত। তারই পাশে শখ করে মাছ ধরার নিমিত্তে নির্মিত পুকুর, আর ডান দিকে এক বিস্তৃত সুইমিং পুল, আধুনিক কাঁচের প্যাভিলিয়ন দ্বারা আবৃত। সমগ্র ভবন প্রাঙ্গণে এক অনির্বচনীয় নান্দনিকতার আবহ বিরাজমান।
তখনই গৃহের প্রাঙ্গণে আগত পাঁচটি গাড়ি একত্রে থামল। সাথে সাথে কর্মচারিগণ সতর্ক হয়ে উঠলেন। মধ্যবয়সী একজন, যিনি গৃহের দ্বারোয়ান বলে প্রতীয়মান, দ্রুত দ্বার উন্মুক্ত করলেন। অন্য কর্মচারিগণ গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালেন। মোশারফ সাহেব ক্রু'দ্ধ মূর্তি ধারণ করে গাড়ি থেকে বের হলেন । ত্বরিত পদক্ষেপে গৃহের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করলেন, তার পিছে পিছে সাজ্জাদ সাহেব ও সহকারী হাফিজুর রহমানও প্রবেশ করলেন। সদর দ্বার অতিক্রম করতে না করতেই আছিয়ার দর্শন মিলল, যে তখন আনন্দমগ্ন হয়ে বিশাল অঙ্গনে নৃত্যে প্রবৃত্ত আছে। সাজ্জাদ সাহেব কন্যার এই নৃত্য দেখে রো'ষে ফুঁ'সিয়া উঠলেন। আছিয়া চোখ বুজে মনের আবেশে মত্ত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে দুলছে আর সুরে সুর মিলিয়ে গান গাইছে,
~ " আজ মন খুশি মন উর্বশী মন উর্মিলা
হবো সাত রঙে এই মন রাঙিয়ে রঙিলা,
আজ মন খুশি মন উর্বশী মন উর্মিলা
হবো সাত রঙে এই মন রাঙিয়ে রঙিলা।
উদাস পথে যাবো কোথায়
নেই দুজনার জানা।"
আছিয়া সুরে সুরে গাইতে গাইতে চোখ খুলেই দেখল, তাহার বাবা ও চাচা সমুখেই আসছেন! আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে আছিয়া লাফিয়ে দৌড়ে তাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান হল। সাজ্জাদ সাহেব বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
- "এই তুই সামনের দাঁড়িয়েছি কেন? সর! এমনিতেই মন-মেজাজ ভালো নাই, সর! যেতে দে!"
আছিয়া মুখ গোমড়া করে বাবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বড় চাচা মোশারফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাসে বলে উঠল,
- "জানো বড় আব্বু, কাল আমার কলেজের প্রথম দিন! আমি অনেক খুশি! আমি আঁখি, মিলি, সবাই কালকে কলেজে যাবো, অনুষ্ঠান আছে। আমি তো শাড়ি পরে যাবো, অনেক সেজে যাবো। হুম!"
আঁখির নাম শুনিতেই মোশারফ সাহেবের মুখাবয়ব কঠিন হয়ে গেল, মুষ্টি দৃঢ় করে রা'গে চোখ বুজলেন। কোন কথা না বলেই নিজের কক্ষে চলে যেতে লাগলেন তিনি। মোশারফ সাহেবের প্রস্থানপথে আছিয়া নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইল। কি হল? কিছু না বলেই এভাবে চলে গেলো কেন? হয়ত শরীর খারাপ করছে তাই চলে গিয়েছে, এই ভাবনায় আছিয়া আবারও সম্মুখে ফিরল। ঠিক সেই মুহূর্তে সাজ্জাদ সাহেব কঠিন মুখে দাঁত কিড়মিড় করে, কেও কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই, এগিয়ে গিয়ে মেয়ের গালে স্বজোরে ক'ষিয়ে চ'ড় মারলেন।
চ'ড়ের তীব্র আ'ঘাতে আছিয়া ধপাস করে উলটে পরে গেলো। ব্য'থায় চিৎকার করতে লাগল আছিয়া। তার চিৎকারে বাড়ির কাজের লোকসহ আছিয়ার মা নিসা বেগম ও বড় চাচী সুহানা বেগম দৌড়ে আসলেন। আছিয়া কিছু বুঝতে পারছে না, তাকে এমনভাবে পি'শাচের ন্যায় মা'রল কেন? মুখ চেপে কাঁদতে লাগল সে। মোশারফ সাহেব হতভম্ব হলেন ভাইয়ের এই আচরণে। রা'গ করেছিলেন ঠিক, কিন্তু এমন নি'র্দয়ভাবে মা'রার পন্থা তার সহ্য হল না।
সাজ্জাদ সাহেব ক্রো'ধে উন্মত্ত হয়ে বললেন,
- "শ*ত্রুর মেয়ের সাথে বান্ধুবি পেতেছিস?? ল'জ্জা করে না?? ওই বাড়ির লোকদের জন্য আমাদের প্রতিনিয়ত হে'নস্তা হতে হচ্ছে! আর তুই এ বাড়ির মেয়ে হয়ে, ওই বাড়ির মেয়ের সাথেই বন্ধুত্ত করিস?? তোর কলেজ যাওয়া বন্ধ! আজ থেকে এ বাড়ির গেইট পার করলে তোর পা কে*টে নদীতে ভাসিয়ে দিব। এই কাজটা আমার আরো আগে করা উচিৎ ছিল। তাহলে এত বাড় বাড়তি না তুই! "
আর অপেক্ষা করলেন না সাজ্জাদ সাহেব, হনহনিয়ে প্রস্থান করিলেন। মোশারফ সাহেবের মন নিদারুণ পীড়ায় ভরে উঠল। সোজা কক্ষে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন, এই মুহূর্তে নীরবতা ছাড়া ভিন্ন কিছুই ভালো লাগছে না তার।
এদিকে নিসা বেগম ও সুহানা বেগম দৌড়ে আসলেন আছিয়ার নিকট। আছিয়ার ফর্সা মুখশ্রীর উপর হাতের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, মুখ লাল হয়ে উঠেছে তার। আছিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল,
- "আমি কি করেছি? বাবা আমায় এমন এভাবে মারল কেন?"
সুহানা বেগম ও নিসা বেগম কিছুই বুঝতে পারছেন না, হঠাৎ এমন কি ঘটল যে মেয়েটিকে এমন করে মারতে হল? কিছু তো ঘটেছে। তখনই ঘর হতে বের হলেন আম্বিয়া বেগম। নাতনির এই অবস্থা দেখে তার র'ক্ত গরম হয়ে উঠল, দুই বউমাকে ব'কাঝকা করে বললেন,
- "ছইল টাক কায় ডাঙ্গাইছে (মেরেছে) হা!??? তোরা সারাদিন কি করিস?? কান্দোছে (কাঁদছে) কেন মোর নাতনি?
কেও সেদিকে কান না দিল না, সুহানা বেগম আছিয়াকে সোফায় বসিয়ে এক গ্লাস পানি দিলেন। আম্বিয়া বেগম কেবল চিৎকার করেই যাচ্ছেন। আছিয়া ক্রমাগত কেঁদেই যাচ্ছে; আজ তার গলা দিয়া আর কিছুই নামবে না। নিসা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, এতদিন এই দিনটির জন্যই ভীত ছিলেন তিনি। কবে যেন শ'ত্রুতার রো'ষে রা'গের বশে মেয়ের গায়ে হা'ত তুলে ফেলে। মেয়েকে হাজার বুঝিয়েও আঁখির সহিত বন্ধুত্ব করা হতে বিরত করতে পারেন নি তিনি। আর আজ তার ফল হল এই, মেয়েটির গায়ে হাত তুললেন অবশেষে । এইসব কিছু কেবল একজনই ঠিক করতে পারবে, যার কথায় এতদিন সব ঠিক ছিলো, এ বাড়ির বড় ছেলে।
-----
শিকদার বাড়ির সম্মুখে গাড়ি থামলে ইকরাম আলী সহ, কুদ্দুস আলী, আজগর আলী, শান্ত, একে একে প্রত্যেকে বের হয়ে আসলেন। প্রত্যেকের মুখে বিজয়ের হাসি, তারা এক একটি সিংহের মতো বুক ফুলিয়ে বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যে যার নির্দিষ্ট কক্ষে গমন করলেন, পরিচ্ছন্ন হবার নিমিত্তে।
শিকদার পরিবারে ইকরাম আলীরা তিন ভাই। ইকরাম আলী পরিবারের বড় পুত্র। গৃহমধ্যস্থ বৃদ্ধ পিতা পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইজড) হয়ে শয্যাশায়ী রয়েছেন। ইকরাম আলী, তার সহধর্মিণী আফিয়া বেগম, এবং তাদের জ্যেষ্ঠ (বড়) পুত্র শান্ত ও কনিষ্ঠ (ছোট) কন্যা পূর্বিকা। মেজ ভাই কুদ্দুস আলী, তার স্ত্রী কানিজ বেগম, এবং তাদের একমাত্র পুত্র নাঈম। সবার কনিষ্ঠ ভাই আজগর আলী, তাহার সহধর্মিণী রোকেয়া বেগম, এবং তাদের জ্যেষ্ঠ কন্যা আঁখি এবং কনিষ্ঠ কন্যা আলো।
গৃহের স্ত্রীলোকেরা রান্নাঘরে নিযুক্ত রয়েছেন; আফিয়া বেগম রান্নার দায়িত্ব পালন করছেন, আর তার পাশে দুই ভ্রাতৃবধূ হাতে হাতে সাহায্য করছেন। শিকদার বাড়ির রান্নাবান্নার সমস্ত কর্ম গৃহের বধূগণ করে থাকেন। কিন্তু রান্না করার প্রধান দায়িত্ব আফিয়া বেগমেরই। আফিয়া বেগম অন্য কাওকে রান্না করতে দেন না, এটা তার অপছন্দ। আফিয়া বেগম কড়াইয়ে তরকারি নাড়তে নাড়তে, তীব্র কণ্ঠে বললেন,
-"এত পড়াশোনা করলে মেয়ে আর মানুষ থাকবে না, অন্যকিছু হয়ে যাবে। "
এটা বলেই আফিয়া বেগম আড়চোখে রোকেয়া বেগমের দিকে তাকালেন । রোকেয়া বেগম বুঝতে দেরি করলেন না যে উক্ত বাক্যখানি তাকে লক্ষ্য করেই উচ্চারিত হয়েছে। আঁখির কলেজে যাওয়ার বিষয়টি যে আফিয়া বেগমের নিকট মোটেই গ্রাহ্য নয়, এটা গৃহের প্রত্যেকেরই জানা। রোকেয়া বেগম নিজ ক্রো'ধ সংবরণ করে, তির্যক হাসি সহ আফিয়া বেগমের পানে চেয়ে উচ্চস্বরে বললেন,
- "হ্যাঁ ভাবি একদম ঠিক বলেছেন। তাহলে পূর্বিকা কে কেন বিয়ে দিচ্ছেন না?? ও তো বাড়ির বড় মেয়ে, ওকে কেন পড়াশোনা করাচ্ছেন?? এমন তো না যে পূর্বিকা পড়াশোনা করে মানুষ থাকবে না, তাই না? "
আফিয়া বেগম উ'গ্র দৃষ্টিতে রোকেয়া বেগমের প্রতি চাইলেন। রোকেয়া বেগম পুনরায় হেসে বললেন,
- "আমার মেয়ের কথা আপনাকে চিন্তা করতে হবে না ভাবি! আপনি নিজের মেয়ের কথা ভাবুন!! "
আফিয়া বেগম আরো উ'ত্তপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি রোকেয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে, ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসি ফুটিয়ে বললেন,
- "এতো যে নিজের মেয়ে মেয়ে করছিস, তা ওটা তোর আসলেই নিজের মেয়ে তো?? "
আফিয়া বেগমের এই বাক্যশ্রবণে রোকেয়া বেগমের মুখে কালো ছায়া নেমে আসল। মুখমণ্ডল কালো করে কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করলেন। পাশ হতে কানিজ বেগম আফিয়া বেগমের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চুপ করতে অনুরোধ করলেন। আফিয়া বেগম মুখ বাকিয়ে নিলেন।
এই সমস্ত দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনতে পেল আঁখি; তার হৃদয় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। রান্নাঘরে প্রবেশ করেছিল যদি বা কোনো সাহায্য করতে পারে এই ভেবে। বসে বসে বিরক্ত বোধ করছিল, আর যখন নিজ বিষয়ে এই সমস্ত কথা শ্রবণ করল, পা দুটি আপনা-আপনি স্থবির হয়ে গেল তার । সেখানে আর এক মুহূর্তও থাকিলল না। সোজা নিজের কক্ষে দৌড়ে গেল আঁখি, চোখের জল অবাধে গড়াতে লাগল। বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করতে লাগল আঁখি। এখন আর কিছুই তার ভালো লাগছে না। কেন তার জীবনে এত জটিলতা? কেন? আল্লাহ ইচ্ছা করলে অন্যভাবেও তো রাখতে পারতেন। আলো বর্তমানে পূর্বিকার কাছে গিয়ে গল্প করছে, তাই সে কক্ষে উপস্থিত নেই।
এদিকে, শান্ত ধীরে ধীরে আঁখির ঘরের দরজার সামনে গিয়ে থেমে দাঁড়াল। মুখে শয়তানি হাসি খেলে যাচ্ছিল। দরজার ফাঁক দিয়ে চো'রের মতো দেখার চেষ্টা করতে লাগল। আঁখি কোথায় গেল? মেয়েটা কি করছে? শান্ত ভ্রু কুঁচকে আরো ভালো করে নজর দিল। হ্যাঁ, ওই তো শুয়ে আছে। কিন্তু বালিশে মুখ চেপে কেন শুয়ে আছে? মেয়েটা কি কাঁদছে? শান্ত হেসে মনে মনে বলল,
-“ভালোই তো! তুই আগেই শুরু করে দিয়েছিস? এখন আমি আরেকটু বেগটা বাড়িয়ে দিই।”
এসব চিন্তায় আর বিলম্ব না করে, শান্ত দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে দিল। হঠাৎ দরজার শব্দে আঁখি আঁতকে উঠে, তাড়াতাড়ি গায়ের ওড়না ঠিক করে মাথায় ওড়না দিল। শান্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাত কেলিয়ে হাসছে। ব্ল্যাক টি-শার্ট পরিহিত লম্বা চওড়া দেহ, ফর্সা মুখশ্রীতে সেই হাসি অপূর্ব দেখাচ্ছে। মাথার উপর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে রয়েছে, যা তাকে আরো সুদর্শন করে তুলছে। তবে সেদিকে খেয়াল নেই আঁখির। সে তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করল,
- "কিছু বলবে, ভাইয়া?"
শান্ত দুই হাত দরজার দু'পাশে রেখে, আঁখির কাচুমাচু ভাবের দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলল,
- “এদিকে আয়।”
- “আমি এখানেই ঠিক আছি! তুমি বলো, কি বলবে?”
আঁখি আস্তে আস্তে বলল।
- “বেশি বড় হয়ে গেছিস? মুখে মুখে তর্ক করিস? আসতে বলেছি আয়!”
শান্ত রাগান্বিত কণ্ঠে ধমক দিয়ে বলল।
আঁখি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধীর পায়ে শান্তর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শান্ত তাকে আরেকটু কাছে আসতে ইশারা করল এবং পকেট থেকে একটি ছোট্ট বাক্স বের করে বলল,
-“হাত পাত।”
-“কেন?”
আঁখি একটু দ্বিধান্বিতভাবে জিজ্ঞেস করল।
-“আবারো প্রশ্ন?”
শান্ত ধমক দিয়ে বলল।
আঁখি তার কথা শুনে হাত পেতে দিল। শান্ত ছোট্ট কাঠের বক্সটি খুলে একদম আঁখির হাতে দিয়ে মুখটা বন্ধ রাখল, যেন ভেতরের জিনিসটা বেরিয়ে না যেতে পারে। আঁখি ভ্রু কুঁচকে তাকাল শান্তর দিকে, আর ঠিক তখনই সঙ্গে সঙ্গে আঁখির হাতে যেন আ'গুন লেগে যায়। একটা তীব্র ব্য'থার অনুভূতি টের পেল তার হাতে, যেন সুঁচ ফোটানোর মতো তীক্ষ্ণ য'ন্ত্রণা মুহূর্তেই তার স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ল। সেই হুলের ছোট্ট জায়গাটিতে তীব্র জ্বা'লাপোড়া শুরু হলো, যেন সেখানে আ'গুনের আঁচ লেগেছে। ব্য'থার তীব্রতা এমন ছিল যে, আঁখির পুরো হাতটাই যেন সং'কুচিত হয়ে উঠল।। কিছুক্ষণের মাঝেই হাতের ওই অংশটি ফুলে উঠতে লাগল, আর চারপাশটা লাল হয়ে উঠতে শুরু করল।
ব্য'থায় কুকড়ে উঠে পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল আঁখির। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল, তা দেখে শান্ত তৃপ্তির হাসি হাসল। কণ্ঠ নিচুস্বরে বলল,
-“তোর জন্য স্পেশাল ভাবে আনিয়েছি।”
আঁখি ব্যথায় হাত সরিয়ে নিতে চাইলে শান্ত আরো শক্ত করে চেপে ধরে। আঁখি দাতে দাত চেপে পুরো ব্য'থা সহ্য করে নেয়। একটু পর শান্ত ছেড়ে দেয়। তখনই বক্স থেকে বেরিয়ে আসে তিনটি মধুমক্ষিকা, যেগুলো উড়ে ভনভন করে জানালার বাইরে চলে গেল। আঁখি তীব্র যন্ত্র'ণায় চোখের জল ছাড়ছে। শান্ত খিলখিল করে হাসতে লাগল। আঁখি তাকাল শান্তর পানে। হাসলে মানুষটাকে কত সুন্দর দেখায়। কিন্তু যে হাসির কারণ অন্যের কষ্ট, তখনো কি সুন্দর থাকে? আঁখি ভাঙা গলায় বলল,
-“আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি কি সুখ পাও ভাইয়া?”
-“তোকে য'ন্ত্রণা দিয়ে কাঁদাতে পারলে এই শান্ত, শান্তি অনুভব করে,”
শান্ত বলল, আর হাসতে হাসতে চলে গেল।
আঁখি সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কান্নারত অবস্থায় ডান হাতের দিকে তাকাল, যেটা একদম ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে। সাতাশ বছরের শান্ত, সতেরো বছর বয়সী আঁখিকে এভাবে ক'ষ্ট দিয়ে কেন এত শান্তি পায়, এটাই বুঝে আসে না আঁখির। এটা প্রথম বা নতুন কিছু নয়। এ যেন শান্তর প্রতিদিনের রুটিন। আঁখিকে কিভাবে কষ্ট দেওয়া যায়, এ নিয়েই যত কাজ শান্তর। কেন আঁখিকে কেউ দেখতে পারে না? কালো বলে? নাকি অন্য কিছু? কাঁদতে কাঁদতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় আঁখি। নিজের শ্যমবর্ণা মুখমণ্ডলের অবয়বের দিকে পলকহীন চেয়ে রইল। হয়তো ও কালো বলেই সবাই ওর সাথে এমন আচরণ করে। কিন্তু ও তো ইচ্ছে করে কালো হয় নি! আর এতে ওর বিন্দু পরিমাণ আফসোস নেই। কেও ওর গায়ের রঙ নিয়ে কিছু বললেও আঁখির যায় আসে না। সৃষ্টিকর্তা বানিয়েছে, নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি সুন্দর। তবে এই কথাটা মানুষ কেন বুঝে না? এসব কথা বোকা আঁখি কাউকে বলেও না। কাকে বলবে? এ বাড়ির বড় ছেলে শান্ত। যদি এসব বলেও দেয়, তাহলে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে দুবার ভাববে না। হয়তো এ-কারণেই বলে না। বা এর পিছনে অন্যকিছু হতে পারে, কি কারণ সেটা তো আঁখিই বলতে পারবে।
------YouTube
প্রতিদিনের মতো আজও মিলি আর রুপা পুকুর পারে বসে আছে, কিন্তু আজ আঁখি বা আছিয়া কেউই আসেনি। মিলি গালে হাত দিয়ে মন খারাপ করে পুকুরের পানিতে ঢিল ছুড়ছে, আর রুপার মুখও মলিন। মিলি রুপার দিকে তাকিয়ে বলল,
- "আজ ওরা আসছে না কেন? কিছু হয়েছে নাকি?"
রুপা বলল,
- "আমি কী করে বলব? তুই যেখানে, আমিও তো সেখানেই!"
মিলি ভেংচি কাটল,
- "দেখ, ফাজলামো করিস না! আমি সিরিয়াস। মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে! বাবার কাছ থেকে শুনলাম, আজ নাকি ইকরাম চাচা আর মোশারফ চাচা সমাবেশে বসেছিলেন। অনেক ঝামেলা হয়েছিল নাকি! এর জন্যই কি কিছু হয়েছে?"
রুপা বলল,
- "আরেহ, এতদিন কিছু হলো না, এখন কী হবে! অন্যকোনো সমস্যায় পড়েছে হয়তো! এসব উদ্ভট চিন্তা বাদ দে তো!"
-"তবুও,,, দু'জন একসাথে?"
রুপা চুপ করে যায়। তার মনেও সন্দেহ জেগেছে, কিন্তু খারাপ কিছু ভাবতে পারছে না। কিছুক্ষণ দু'জন চুপচাপ বসে থাকে। এরপর মিলি নিচুস্বরে বলল,
- "যদি আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে?"
রুপা মিলির মাথায় হাত দিয়ে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,
-"ফাটল ধরলে ধরুক, আমরা সেই ফাটল থেকে নতুন সেতু বানিয়ে ফেলব! কিন্তু মিলি, তুই এমন আজগুবি কথা বললে, সেই সেতুর নিচে তুই একাই ডুববি, আর আমরা এক ফুটবল ডুবে যেতে দেখতে থাকব!! হাহাহাহা!!"
রুপা খিলখিল করে হাসতে লাগল। মিলি মুখ গোমড়া করে থাকলেও একটু পর নিজেও হাসতে লাগল। তখনই চোখ পড়ল রুপার হাসিমাখা মুখের ওপর। রুপার মুখে কেমন যেন একটা অজানা বিষাদের ছাপ লেগে আছে। চোখের নিচে গাঢ় ক্লান্তির রেখা আর ত্বক মলিন ও রুক্ষ। ঠোঁটের একপাশ কালচে হয়ে গেছে। কেমন যেন প্রাণহীন দেখাচ্ছে, নিষ্প্রাণ সেই হাসি। একসময়ের প্রাণবন্ত মুখ এখন যেন কোনো অদেখা যন্ত্রণার ভারে নুয়ে পড়েছে। মিলি এতক্ষণ ঠিকমতো খেয়াল করেনি। এখন দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। রুপা হাসি থামিয়ে মিলির দিকে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকায়। মিলি রুপাকে জিজ্ঞেস করল,
- "তোর চোখমুখ এমন কেন দেখাচ্ছে?"
-"কই? ঠিকই তো আছে!"
মিলি হয়তো কিছু একটা বুঝতে পেরেছে। তাই রুপার কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে বলল,
"তুই কি পরীক্ষায় ফেল করার জন্য এত মন খারাপ করে আছিস?"
এইবার এসএসসির রেজাল্টে রুপা ফেল করেছে। এতে সবাই ওকে নানা ভাবে বুঝিয়েছে মন খারাপ না করতে। রুপা একটু হাসির আড়ালে বিষণ্নতা লুকিয়ে বলল,
- "মিলি, ফেইল করা তো শুধু ফলাফলের কথা নয়, বরং এটা এমন একটা অনুভূতি, যা ভিতর থেকে কুড়ে কুড়ে খায়। এমনও হয় যে, কিছু পরীক্ষায় ফেইল করলেই মানুষ ভিতর থেকে ম'রে যায়, বেঁচে থাকে ঠিকই, কিন্তু আসলে সে আর আগের মতো থাকে না।"
মিলি রাগ দেখিয়ে রুপাকে বুঝিয়ে বলল,
- "তুই জানিস, জীবন কখনো সরল পথে চলে না। পরীক্ষার ফল ভালো না হলে, সেটা তোর মেধা বা পরিশ্রমের মাপকাঠি করে না। বাস্তবে, সফলতার পথে এসব বাধা শুধু সাময়িক হয়। তোর অদম্য ইচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রমই তো তোর শক্তির মূল। মনে রাখবি, কঠিন সময়গুলোই আমাদের শক্তিশালী করে তোলে।"
রুপা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল,
- "তুই বলছিস, জীবন কেবল পরীক্ষার ফল না, কিন্তু কখনও কখনও, এই ফলাফল আর কষ্ট এমন কিছু হয় যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। কিছু যন্ত্রণার ধরন এমন, যা কোনো পরিশ্রম বা শক্তি দিয়ে দূর করা সম্ভব না। যতক্ষণ না নিজে সেই কষ্টে ডুবে যাস, ততক্ষণ পর্যন্ত তুই বুঝবি না, কতটা গভীর এবং অপার কষ্ট মানুষ বহন করতে পারে। কিছু কষ্ট শুধু নিজের ভেতরেই গাঢ় হয়ে থাকে।"
মুহূর্তের মধ্যেই যেন এক বিষণ্নতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মিলির একদমই ভালো লাগছে না। তার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। রুপা, যে সাধারণত সবাইকে হাসিতে মাতিয়ে রাখে এবং প্রাণবন্ত কথা বলে, তার মুখে এমন বড়দের মতো গুরুতর কথা একেবারেই মানাচ্ছে না। এরপর মিলি রুপাকে আরও বোঝাতে লাগল, কিন্তু রুপা শুধু মলিন হাসি দিল। কিছুক্ষণ পর তারা যে যার বাড়ির পথে রওনা দেয়। এদিকে দূরে গাছের ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুকের কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা যাবৎ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। দুশ্চিন্তা মাথায় চেপে বসেছে। কিছু একটা ভেবে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না, সোজা হাঁটা দেয় গন্তব্যের দিকে। এমন সময় পেছন থেকে এক অর্ধবয়স্ক লোকের ডাক শোনা যায়,
- "আরাফ বাপ না!! ভালো আছিস বাহে?"
আরাফের পা থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, দেখে এক অর্ধবয়স্ক লোক অর্ধপাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। লম্বা চওড়া উচ্চতার আরাফ, নেভি ব্লু শার্ট পরা সুদর্শন পুরুষ, যার কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। কপালে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে। চিন্তায় ফর্সা মুখমণ্ডল লাল হয়ে উঠেছে। এ মুহূর্তে কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আরাফের। তবে ভদ্রতার খাতিরে চিন্তাগ্রস্ত মুখেই বলে,
-"ভালো চাচা! আপনি ভালো তো?"
-"মুই আছু ভালোই।"
- "আচ্ছা চাচা, আমি আসি? আমার জরুরি একটা কাজ আছে! একটু তাড়ায় আছি!!"
বলেই ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায় আরাফ। অর্ধবয়স্ক লোকটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে আরাফের চলে যাওয়ার দিকে। এরপর তিনিও চলে যান নিজের কাজে। আরাফ চোয়াল শক্ত করে এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
0 Comments