Ad Code

সেই তুমি (সিজন - ২) পর্ব - ১

লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা

 অতর্কিতে পিছন থেকে কেউ জরিয়ে ধরায় চমকে উঠলাম আমি। হাতে থাকা কাচের গ্লাসটা হাত থেকে পরে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। গ্লাস ভাঙার শব্দে আমি হুশ ফিরে পেলেও পিছনে দাড়িয়ে থাকা লোকটার কোনো হেলদুল নেই। লোকটা এখন আগের থেকেও বেশি শক্ত করে জরিয়ে ধরেছে আমাকে। আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি কিন্তু তার শক্তির সাথে পারছি না। লোকটার একটা হাত আমার শাড়ির ফাঁক দিয়ে আমার পেটে বিচরণ শুরু করছে। চরম অস্বস্তি বোধ হচ্ছে আমার। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। আমার গলা দিয়েও কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। আমার কিছু না করাই হয়তো লোকটার সাহস আরো বারিয়ে দিচ্ছে। তাই তো লোকটা আমার চুলে মুখ গুজে দিচ্ছে। না এবার আর চুপ থাকা যাবে না। দিনে দুপুরে একজনের বাড়িতে এসে এমন অসভ্যতামি করার সাহস পায় কি করে। আমি চিত্কার করতে যাবো তার আগেই তাফসি আপু পিছন থেকে "তুর্য" বলে চিল্লানি দিয়ে উঠলো।

Facebook

তাফসি আপুর গলা শুনে লোকটা আমাকে ছেড়ে দিলেন। লোকটা আমাকে ছাড়তেই তাফসি আপু তাকে জরিয়ে ধরলেন। এতোক্ষণে আমি তাকে চিনতে পেরেছি। ইনি আর কেউ নয় বরং তুর্য ভাইয়া, তাফসি আপুর বড় ভাই আর আমার চাচাতো ভাই। অনেক বছর পর ফিরেছেন লন্ডন থেকে। তাফসি আপু তুর্য ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে সন্দেহসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর আমি হ্যাবলা কান্তের মতো তুর্য ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তারা কথা বলতে শুরু করলেন।
আমি এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছি। লোকটা মাত্রারিক্ত সুদর্শন। লম্বায় মনে হয় ৬'২"! আস্ত একটা তাল গাছ! ফর্সা মুখখানায় চাপ দাড়ি আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে তাকে। কেনো যেনো আমি চোখ ফেরাতে পারছি না। মনে হচ্ছে তার উপর ক্রাশ খাচ্ছি। সত্যি বলতে এতো সুদর্শন পুরুষ আমি আগে দেখি নি। আর দেখবোই বা কি করে! আমি তো গার্লস্ কলেজে পড়েছি!
আমি পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তুর্য ভাইয়ার দিকে। বুঝতে পারি নি কখন সে আমার দিকে তাকিয়েছেন। আমার সামনে হঠাত তুরি বাজাতে আমার চোখে পলক পরলো। লজ্জায় আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এমন বেহায়ার মতো কিভাবে তাকিয়ে ছিলাম আমি! তুর্য আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন।
আমি জানতে চাই সে আমাকে এভাবে কেনো জরিয়ে ধরেছিল। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারছি না। ভীষণ লজ্জা করছে। লজ্জা জিনিস টা আমার মধ্যে খুব কম আছে কিন্তু আজ কোথা থেকে এলো কে জানে। তুর্য ভাইয়া তাফসি আপুকে বললেন,
-- এতো পিচ্ছি কাজের বুয়া কবে রেখেছিস? দেখে তো মনে হচ্ছে একটু পরেই মাথা ঘুরে পরে যাবে।
তুর্য ভাইয়ার কথাটা আমার ইগোতে লেগেছে। একেতো বুয়া বলছে আবার পিচ্ছি! আমি ছোট হয়েছি তো কি হয়েছে এভাবে বলতে পারে না।
-- আমি বুয়া নই। আমার নাম হীর। তাফসি আপু! চাচি আমাকে ঘরটা গুছিয়ে দিতে বলেছিল তাই এসেছিলাম। ঘর গুছানো হয়ে গেছে আমি যাচ্ছি।
তুর্য ভাইয়ার সাথে ভালো-মন্দ কোনো কথা না বলে চলে এলাম। ছোটো মানুষ হলেও আমার ইগো নামের একটা পাখি আছে। তার সাথে আর কথাই বলবো না। যদিও আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজায় আড়ি পেতে দাড়িয়ে আছি তার কথা শোনার জন্য।
তাফসি আপু বলতে শুরু করলেন,
-- তুই ওভাবে হীরকে জরিয়ে ধরেছিলি কেনো রে?
-- আমি কি আর হীরকে চিনি নাকি। পিচ্ছি মেয়ে মহিলাদের শাড়ি পরে আছে। তাই ভেবেছিলাম চাচি বা আম্মু হবে।
নাহ আর শুনতে পারবো না। আমাকে দেখতে চাচির মতো লাগে!! এই অপমান সহ্য করা যায় না। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখছি। সব তো ঠিকই আছে। তাহলে তুর্য ভাইয়া এ কথা কেনো বললো? আজকে আমার সব জামা ধুয়ে দেওয়াতে আম্মুর একটা শাড়ি পরেছিলাম। সেজন্যই এতোটুকু বয়সে বুড়ি বানিয়ে দিলো।
আমি হীর, বয়স ১৭ বছর। এইবার দ্বাদশ শ্রেণিতে আছি, এইচ.এসসি সামনে। জয়েন্ট ফ্যামিলির মেয়ে আমি। আমার বাবারা তিন ভাই এক বোন। তুর্য ভাইয়ার বাবা বড়, আমার বাবা মেঝো আর একজন ছোট চাচা। এদেরো আবার এক গাদা বাচ্চা আছে। এগুলোই চিন্তা করছিলাম হঠাত কেউ পিছন থেকে এসে মাথায় চাটি মারলো।
-- কিরে পেত্নি কি ভাবছিস?
কথাটা বললো হিয়া। আমার একমাত্র বড় বোন। এই পাটখড়িকে আল্লাহ কেনো যে আমার বড় বোন বানিয়েছেন বুঝি না। এই মেয়েটা আমার সবকিছুতে ভাগ বসায়। ওর কারণে আমার আর আম্মুর বনিবনা নেই। আম্মু এই শাকচুন্নিটাকেই আদর করে। আমি যেনো বানের জলে ভেসে এসেছিলাম।
একটা ডিপ্রেশন মিশ্রিত নিশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
তুর্য তার মা তমা বেগম আর আমজাদ সাহেবের সামনে দাড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। তমা বেগম ছেলেকে দেখে খুশি হলেও রেখে আছেন প্রচন্ড।
-- তুর্য তুই হঠাত করে দেশে কেনো ফিরে এলি? তোর তো আরো ৬ দিন পরে আসার কথা ছিল।
-- কেনো আম্মু আমি এসেছি বলে খুশি হও নি?
-- খুশি কেনো হবো না কিন্তু এভাবে না জানিয়ে!
তুর্য কিছু না বলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। সে জানে সে যাই বলুক তার এভাবে আসাতে কেউ খুশি না। তুর্য তাদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে তিন তলায় মেঝো চাচা আকরাম সাহেবের ফ্ল্যাটে ঢুকে পরলো। সেখানে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে হীরের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো।
জীবনের ১৭ টা বছর এমনে এমনেই চলে গেলো আমার। একটা প্রেম হলো না। আমার সব বান্ধবীরা যখন তাদের বয়ফ্রেন্ডদের কথা শুরু করে আমি তখন আস্তে করে কেটে পরি সেখান থেকে। আমার কষ্টগুলো আমার নিজের বোনও বোঝে না। সবসময় আম্মুর কাছে আমার নামে চুগলি করে। এই পুরো বিল্ডিং এ একমাত্র তাফসি আপুই আমার কষ্টগুলো বুঝে। এখন তো সেও থাকবে না। ৭ দিন পরেই তার বিয়ে। এক হিসেবে ভালোই হবে। তাফসি আপুর বিয়ের পরেই শাকচুন্নি হিয়ার বিয়ে দেবে। এই শাকচুন্নিটা বিদায় হলেই বাঁচি। তারপর চলবে আমার একার রাজত্ব।
হিয়ার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছিলাম আর গোসল করছিলাম। মাঝ পথে পানি বন্ধ হয়ে গেলো। এই পাইপ লাইনটাও হিয়ার মতো। শুধু শুধু জালায় আমাকে। উপায়ন্তর না পেয়ে টাওয়ালটা জরিয়ে নিলাম গায়ে, উদ্দেশ্য বাকি গোসলটা হিয়ার ওয়াশরুমেই সারবো। এমনিতেও এই সময় আম্মু ছাড়া আর কেউ বাসায় থাকে না।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সামনে তাকাতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। আমি চিত্কার দেবো কিন্তু মনে হচ্ছে আমি জমে গেছি। তুর্য ভাইয়া আমার ঠিক সামনে আমারি বিছানায় বসে আছেন। এই পরিস্থিতির জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। তুর্য ভাইয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। নিজেকে একহাত দিয়ে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করছি আর অন্য হাত দিয়ে ওয়াশরুমের দরজা টানছি খোলার জন্য। নাহ দরজা খুলছে না আর তুর্য ভাইয়াও মূর্তির ন্যায় বসে আছেন। ওয়াশরুমের দরজাটা কোনোরকম খুলতেই ভিতরে ঢুকে পরলাম। ভিতর থেকেই চেচিয়ে বললাম,
-- আপনি আমার ঘরে কি করছেন! লজ্জা নেই বুঝি! একটা মেয়ের ঘরে কেউ এভাবে আসে?
-- এই পুচকি একদম চেচাবি না। আমি কি জানতাম নাকি তুই এখনও বার্থডে ড্রেস পরে ঘুরিস।
-- এই একদম উল্টা পাল্টা বকবে না। আমার ঘরে আমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ঘুরবো তুমি কেনো আসবা!
-- এসেছি বেশ করেছি। এমনিতেও তুই একটা পুচকি। তোর মধ্যে আর ৬ বছরের বাচ্চার মধ্যে কোনো তফাত নেই।
এবারো আমার ইগো নামক পাখিটা আহত হয়েছে। কিন্তু এই বেহায়া লোকটাকে কিছুই বলা যাবে না। আরো অপমান করবে।
-- তুর্য ভাইয়া আপনি যান তো এখান থেকে।
-- না যাবো না। তুই তোর কাজ কর। আমি এখানেই বসে থাকবো তুই বের হবি তারপর কথা বলবো তোর সাথে।
আচ্ছা মুশকিল তো,, এই লোকটাকে কোন ধাতু দিয়ে বানানো হয়েছে কে জানে! আমি জামা কাপড় আনি নি। তার ওপর পাইপ লাইনও নষ্ট। এখন কি করবো!
-- তুর্য ভাইয়া! প্লিজ! একটু বাইরে যান না। আমি জামা আনি নি। আবার পাইপ লাইনেও সমস্যা হয়েছে। পানি আসছে না। প্লিজ!
-- দরজাটা একটু ফাঁকা কর আমি কাপড় দিচ্ছি।
তুর্য একটা টি শার্ট আর প্লাজু বের করে এনে ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিলো। হীর দরজাটা একটু খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো। হীরের ফর্সা ভেজা হাতের দিকে তুর্যর নজর পরতেই তুর্য চোখ সরিয়ে নিলো। কাপড়টা হীরের হাতে দিয়ে তুর্য মুচকি হেসে হীরের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর পাইপ লাইনে আবারো পানি চলে এলো। তবে পানি আসার কারণটা হীর বুঝতে পারছে না।
🍁
গোসলটা সেরে বের হয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতেই দুচোখে লজ্জা ভর করে নিলো। আয়নাতেও নিজের দিকে তাকাতে পারছি না। আজকেই প্রথম তুর্য ভাইয়ার সাথে দেখা হলো আর আজকেই এতো লজ্জা জনক পরিস্থিতিতে পরতে হলো। না জানি তুর্য ভাইয়া আমার সম্পর্কে কি ভাবছে। ইশশ!! তৈরি হয়ে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে ঘর থেকে বের হলাম।
বাইরে আসতেই দেখি তুর্য ভাইয়া আর এক গাদা বাচ্চা বসে আছে। একগাদা বাচ্চার মধ্যে আমার বোন হিয়া, ছোট চাচার দুইটা জমজ মেয়ে নিলি আর মিলি, আর বড় ছেলে নিলয় বসে আছে। এরা কেউ আমার আপন না। সবাই হিয়ার চামচে। আমার কলিজা তাফসি আপুকে দেখছি না। নিশ্চিত রায়ান ভাইয়ার সাথে তার লুতুপুতু প্রেমালাপ চলছে। আবারো একটা ডিপ্রেশন মিশ্রিত নিশ্বাস ফেলে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। পুরো কিচেনে চিরুনী অভিযান চালিয়েও খাবার পেলাম না। এই ডিপ্রেশন মিশ্রিত হাই তুলা আর যাবে না আমার জীবন থেকে।
সবার থেকে দূরে সোফায় বসে আছি। আর বাকি। সবাই লুডু খেলছে। আমার চোখ না চাইতেও বারবার তুর্য ভাইয়ার দিকে যাচ্ছে। তুর্য ভাইয়ার দিকে নজর পরতেই ওয়াশরুমের ঘটনা টা মনে পরছে। ইশশ কি লজ্জা! এমন টা হবে আমি ভাবতেও পারি নি। না চাইতেও এখন তুর্য ভাইয়ার সামনে যেতে লজ্জা করছে।
সবাই লুডু খেলায় মত্ত হয়ে আছে। আমিই একা পরে গেছি। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এলাম। এই বিল্ডিং এর পুরোটাই আমাদের। নিচ তলা খালি পরে আছে। দুইতলা বড় চাচার, তিনতলায় আমরা আর চারতলায় ছোট চাচা থাকেন। বড় চাচা ব্যবসায়ী, আর্থিক দিক দিয়েও বেশ সচ্ছল। তাই তো তুর্য ভাইয়া লন্ডন থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে এলেন। আমার অবশ্য মনে নেই কিন্তু হিয়া বলেছে আমি তখন খুব ছোট তখনি তুর্য ভাইয়াকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমার বাবা একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি করেন। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি এই বাড়িতে সবার মুখে তুর্য নামের মালা জপতে দেখেছি। তুর্য ভাইয়া শুধু বংশের বড় ছেলেই নয় বরং আদর্শ ছেলে। কিন্তু আজকে তার মধ্যে আদর্শের ছিটে ফোঁটাও আমি দেখলাম না।
ছাঁদে দাড়িয়ে এসব কথা ভাবছিলাম আচমকা কেউ পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো। তুর্য ভাইয়া শুরু টা করেছে কি! নাহ এবার এই লোকটাকে একটা উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। নিজেকে ছাড়িয়ে পিছন ঘুরে ঠাসস্ করে একটা চড় বসিয়ে দিলাম তার গালে।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu