Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ১০

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
*
*
প্রবল বায়ুর গর্জনে আকাশ ঘন মেঘে আবৃত হয়ে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েছে। বৃক্ষগুলো এতই তীব্রভাবে দুলছে যে মনে হয় তারা শীঘ্রই উড়ে যাবে। মহাশূন্যে এক ভয়'ঙ্কর ঝড়ের পূর্বাভাস যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আঁখি নিস্তব্ধভাবে মাটিতে বসে, মস্তক উঁচু করে আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার রেশম-সদৃশ কালো কেশরাজি মাটিতে এলিয়ে রয়েছে, কিন্তু সে তা খেয়ালই করছে না। খেয়াল করলে হয়তো আগেই মাথায় কাপড় টেনে নিত।
মুগ্ধ, চোয়াল দৃঢ় করে নিচে বসা আঁখির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে । মুগ্ধর পরিধানে কালো টিশার্ট, যা তার দেহের শুভ্রতা এবং সুগঠিত মাংসপেশীকে আরও স্পষ্ট করেছে। কপালের চুলগুলো প্রবল বায়ুর বেগে উড়ছে, আর আঁখি একদৃষ্টে তাকিয়ে, মনের অন্তর্গত ভাবনায় নিমজ্জিত- কেন বারংবার এই পুরুষের সম্মুখেই এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তাকে? তখনও এবং এখনও- পরিস্থিতি যেন একই রকম। আছিয়ার ভাই কী ভাববে তাকে নিয়ে, যে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাও করতে পারে না? ল'জ্জায় মুখ নত করে আঁখি নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করছে। মুগ্ধ, বিরক্তির ছায়া নিয়ে, নির্বিকারভাবে তার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে থাকে। আঁখি বিস্ময়ে হতবাক হয়; মুগ্ধ একটি শব্দও উচ্চারণ করল না! ছোট বোন ভেবে হলেও তো সে জিজ্ঞেস করতে পারত! পরবর্তীতে মাথা ঝাঁকিয়ে আঁখি নিজেই নিজেকে তিরস্কার করে বলে,
- "আমি এসব কী অবাস্তব চিন্তা করছি? আজকাল কাছের মানুষের কাছেই যেখানে প্রত্যাশা অর্থহীন, আর উনি তো আমাকে কেবল শত্রুর মেয়ে বলেই চিনেন । ধুরর,, আমার কিহহ!"
মুগ্ধ, পথ চলতে চলতে হঠাৎ থেমে যায়। কৌতূহলের বশে একবার পেছনে ফিরে তাকায়। দেখে, মেয়েটি এখনো সেই স্থানে বসে আছে। চারিদিকে ঝড়ের পূর্বাভাস, আকাশে প্রলয়ের সঙ্কেত, অথচ মেয়েটি নির্বিকারভাবে বসে আছে? এত উদাসীন মানুষ কেমন করে হয়? মুগ্ধ তার দিকে অগ্রসর হয়ে, চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
- "তোমার common sense নেই?"
মুগ্ধর কঠোর কণ্ঠে আঁখি পেছনে ফিরে তাকায়, ভ্রু কুঁচকে তার কথার মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করে। মুগ্ধ এবার ক্রোধে ধমক দিয়ে বলে ওঠে,
-" ওঠো!!!! "
আঁখি হঠাৎ ধমকে উঠে দাঁড়ায়, উঠতে গিয়ে বুঝতে পারে তার পায়ে ক্ষীণ ব্যথা রয়েছে। তবুও সে তা উপেক্ষা করে, কারণ এমন ক্ষত তার জন্য তুচ্ছ বিষয়।
সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের আগমন ঘটে। আকাশের কালো মেঘ ঘনীভূত হয়ে প্রকৃতির গাঢ় তেজ ছড়িয়ে দেয়, আর বৃষ্টির প্রথম কণাগুলি মাটিতে পতিত হয়। ভারী বৃষ্টির ফোঁটাগুলি মাটির বুকে পড়েই এক অপ্রত্যাশিত উষ্ণতা ও ঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয়। প্রতিটি ফোঁটার সাথে ধূলির স'ঙ্গম ঘটে, বাতাসে ঝড়ের তীব্রতা প্রকৃতির সবকিছু ত'ছনছ করে দিচ্ছে। বৃক্ষগুলো থরথর করে কাঁপতে থাকে, আর বৃষ্টির ধারায় পৃথিবী যেন এক মুহূর্তেই সম্পূর্ণরূপে ভিজে ওঠে।
আঁখি মাথায় হাত দিয়ে দৌড়ে সামনের বিশাল গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ইশ, আজ নিজের বোকামির জন্য এমন হলো। গাধার মতো বসে না থাকলে এতক্ষনে বাড়ি পৌঁছে যেতো। ধুর, এখন তো ভিজেই যাবে। আজকের দিনটি তার জন্য এক দুঃখজনক পরিণতি বয়ে এনেছে। বাড়িতে গেলে নিশ্চয়ই তাকে সাবান ছাড়া ধোলাই করা হবে। তখন আঁখি উপলব্ধি করল যে তার মাথার কাপড় স্থানচ্যুত হয়ে গেছে। বিষয়টি উপলব্ধি করেই তৎক্ষণাৎ হাত খোপা করে টেনে কাপড়টি মাথায় আবার ঠিক করে পরলো। মুগ্ধের কথা মনে পড়ল, সে কোথায়? এই চিন্তায় সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল, মুগ্ধ বৃষ্টির জলে সিক্ত হয়ে, চোয়াল শক্ত করে তার দিকে ভস্মধরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এই দৃশ্য দেখে আঁখি একবার গলার ভেতর ঢোক গিলল। মুগ্ধ কি এখন এই পরিস্থিতির জন্য তাকে দায়ী ভাবছে? আরেকবার নিবিষ্ট দৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকাল।
বৃষ্টির স্রোতে সম্পূর্ণরূপে ভিজে গিয়েছে মুগ্ধ। তার সুদর্শন মুখমণ্ডল থেকে জল টপটপ করে ঝরছে। কপালে ঢেউ খেলানো চুল থেকে গড়িয়ে পড়া জল তার লম্বা সুগঠিত নাক, ফর্সা মুখশ্রী ও ব্রাউন ঠোঁটকে স্পর্শ করছে। টিশার্ট ভিজে পাথরের মতো খোদিত দেহের রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শকুনের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে, সে আঁখির দিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন একমুহূর্তে তাকে ধ্বংস করে ফেলবে।
আঁখি পুনরায় গভীরভাবে শ্বাস টেনে নেয়। এমন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করার কী কারণ? সে কি বৃষ্টিকে কোনো নির্দেশনা দিয়েছিল, যে সঙ্গে সঙ্গে নামতে হবে? আর তিনি তো চলেই যাচ্ছিলেন, তবে কেন সহানুভূতি প্রদর্শন করে ফিরে এলেন? তাকে কী অনুরোধ জানিয়েছিল আঁখি? তখন আঁখি লক্ষ্য করলো মুগ্ধ পরনের ব্লাক টিশার্ট! একটু আগেও না ধূসর বর্নের শার্ট পরে ছিল? এই লোক মিনিটে মিনিটে পোশাক বদলায় নাকি?
আঁখি দৃশ্যমান করল মুগ্ধ তার দিকেই গমন করছে। মনে মনে আঁখি উচ্চারণ করল,
-"আশ্চর্য, এদিকে কেন আসছে? ভিজেই তো গিয়েছে, বাড়িতে গেলেই তো পারে!"
মুগ্ধ কঠোর মুখে বৃক্ষের নিম্নে আঁখির নিকট এসে দণ্ডায়মান হলো। তার দৃষ্টিপাত আঁখির প্রতি স্থির হয়ে থাকল, পাথরের ন্যায় শক্ত চোয়াল আঁখির উপর নিষ্পলক নিবদ্ধ রয়েছে। মুগ্ধর এই রূপ আচরণে আঁখির অন্তঃস্থলে উদ্বেগের সঞ্চার হলো। এইরূপে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখবার অর্থ কি? কথা উচ্চারণ করছে না, অথচ পাষাণ হৃদয়ের দানবের ন্যায় দৃষ্টি অগ্নিতে তার প্রতি নিভৃতভাবে পল্লবিত করেছে। ঝড় ও বৃষ্টির প্রকোপ, চারিদিকে নিকষ কালো ছায়া নেমে এসেছে, সন্ধ্যার আলোকও বিলীন হতে চলছে। চারপাশে কেউই নেই। হে আল্লাহ! মনে হচ্ছে এখানেই প্রাণ বিসর্জন দিলে শান্ত হবে আঁখি। আজ আঁখির সকল কিছুই বিপরীত পথে গমন করছে। আজ যে কার মুখ দেখে উঠেছিল সে!! যদিও তার ভাগ্যে সৌভাগ্য কখনোই অধিক ছিল না, কিন্তু আজকের ন্যায় এমন শোচনীয় অভিজ্ঞতা তার কাছে বেশ অদ্ভুতই লাগছে।
আঁখি তৎক্ষণাৎ বিপরীতদিকে ঘুরে গেল।
- "উফফফ! কতক্ষণ আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব?"
আঁখির মনের মধ্যে এই চিন্তাধারা চলতে লাগল।
-"নাহ, এইবার বর্ষার প্রাবল্যে ভিজেই বাড়ি যাব। "
আঁখি ভাবছে গৃহে ফিরলে তিরস্কার শুনতে হলে শুনবে এটা তো কোন নতুন ব্যাপার নয়। তথাপি এই নিদারুণ অসহিষ্ণুতা হতে মুক্তি লাভ করবার জন্য যেকোন মূল্যে গৃহে পৌঁছাতে হবে। এই মনস্থির করে, আঁখি আরেকবার সহসা পেছনে ঘুরে দাঁড়াল, তার চোখ দু’টি বিস্ময়ে গোলাকার হয়ে উঠল।
আঁখি দেখিল মুগ্ধ ধুপধাপ পা ফেলে চলে যাচ্ছে। আঁখির ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো, মুখে বিড়বিড় করে বলল,
-"এই লোকটা এমন অদ্ভুত কেন? একবার যেতে যেতে ফিরে এলো , আর এখন আবার চলে যাচ্ছে! ধমক দেওয়া ছাড়া বোধহয় কার কোনো কথা তার জানা নেই!! আজব! উনি সত্যিই কি আছিয়ার ভাই??
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভাবছে এখন আঁখি আর কি করবে? মুগ্ধ যখন চলে যাচ্ছে, এখন চলে যাওয়া ব্যতীত আর কিছু করতে পারবে না। বৃষ্টির তেজও তো বেড়েছে নিরন্তর। বাতাসের প্রবলতায় বৃষ্টির ফোঁটা আঁখির গায়ে এসেই পড়ছে, শরীর তো অর্ধেক ভিজেছেই । এই অবস্থায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকা আর উচিত হবে না। আঁখি পা বাড়াইতেই নিবে, ঠিক তক্ষুনি পেছন হতে এক গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ তার কর্ণকুহরে ধ্বনিত হল,
-"দাঁড়াও।"
আঁখি সঙ্গেসঙ্গেই দাঁড়িয়ে পড়ে। ধীরপায়ে উলটো দিকে ঘুরে দেখে মুগ্ধ, হাতে বিশাল এক কচুপাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আঁখি ভ্রু কুঁচকে তাকায়! আবার ফিরে এসেছে? কিন্তু হাতে এত বড় কচুপাতা কেন? মাত্র এক্ষুনি তো গিয়েছিল! এত দ্রুত আনল কীভাবে? রোবট নাকি তিনি? আর মুখে সেই আগের গাম্ভীর্যের ছাপ, কেন এমন? সুদর্শন পুরুষেরা কি এমনই গম্ভীর হয়? না, না, মোটেই না! এই লোকটাই এমন অদ্ভুত!
আঁখির ভাবনার মাঝেই মুগ্ধ হাতে থাকা কচুপাতাটা ছুঁড়ে আঁখির দিকে ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-"ধরো!"
আঁখি কোনোমতে পাতাটা ধরে ফেলে! এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারছে না কিছুই। মুগ্ধ আর একটাও কথা না বলে ধপধপ পা ফেলে চলে গেল। আঁখি বোকার মতো তাকিয়ে রইল তার চলে যাওয়ার দিকে। মনে মনে বলল,
- "আবারো কি ফিরে আসবে?"
এরপর নিজেই নিজের মাথায় বারি দিয়ে বলে,
- "তাতে তোর কি! তুই বাড়ি যা!!"
এরপর সে হাতে থাকা বিশাল কচুপাতার দিকে তাকিয়ে রইল। এটা দিয়ে কি করবে? তখনই মাথায় বুদ্ধি আসলো আর হেসেই বলল,
- "আরে বোকা, এটা তো মাথায় দিয়ে গেলে পুরোপুরি না ভিজলেও কিছুটা বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে! আমিও না! মাথা গিয়েছে! ধ্যাত!"
অভিধানের দৃষ্টিতে, আঁখি কচুপাতা মাথায় ধারণ করে বাড়ির পথে বৃষ্টির আঘাতের মুখোমুখি হয়ে এলোপাতাড়ি দৌড়াতে শুরু করল।
সজাগ চোখে দূর থেকে এক আকর্ষণীয় সুন্দরী রমনী তাদের তদারকি করছিল, যার গায়ে লাল-সাদা শাড়ি, মাথায় লাল টকটকে সিদুর এবং হাতে শাখা-পলা। বৃষ্টির জল তার স্নিগ্ধ রূপকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছে। সে দৃষ্টিতে ভেজা আবছা অন্ধকারে আঁখি ও মুগ্ধের সান্নিধ্য পর্যবেক্ষণ করছিল, আর এখন মনে মনে বেদনাদায়ক কণ্ঠে স্বপ্নলোভী কথাটি উচ্চারণ করল,
- "যদি আমি ওই মেয়েটির জায়গায় হতাম, তবে হয়তো এভাবে তোমার সান্নিধ্যে এমন সৌন্দর্যময় মুহূর্ত লাভ করতে পারতাম মুগ্ধ!!! "
***************
গোটা রাত ধরে দুরন্ত ঝঞ্ঝাবাত্যা কেটে প্রভাতে আকাশ নির্মল ও সুস্পষ্ট রূপে উদ্ভাসিত হলো। গতকাল সন্ধ্যা বেলা গৃহে প্রত্যাবর্তনের ক্ষণে আঁখি দেখল, আবাসস্থলে কোনও কলরবের লেশমাত্রও নেই, সর্বত্রই নীরবতা বিরাজমান। এই সুযোগে সকলের অগোচরে সে অন্দরমহলে প্রবেশ করেছিল।
পূর্বে শাহারিয়াজ ভবনে গমনের প্রয়োজন পড়লো , পরবর্তীতে মোবারকের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হলো। মোবারক ছিল ইকরাম আলীর ঘনিষ্ঠ অনুচর, এবং ইকরাম আলীই মদনের কন্যার সহিত তার বিবাহের আয়োজন করেছিলেন। এক দিবসেই এতসব ঘটনাপ্রবাহ ঘটায় গতকালের গৃহকোণ এক প্রকারের স্থবিরতায় আচ্ছন্ন ছিল।
- "মুগ্ধ তোমায় বিয়ে করতে চাইছে পূর্বি!!!!"
আফ্রিদি অস্থির চিত্তে বাক্যটি উচ্চারণ করল। পূর্বিকা বিস্ময়াভিভূত হয়ে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলল,
- "এই তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো?? এই সত্যি করে বলো তো কিছু উলটা পালটা খাও নি তো??? "
পূর্বিকা বর্তমানে অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। অন্যদিকে, আফ্রিদি পড়াশোনা সমাপন করে বর্তমানে কর্মহীনভাবে দিনযাপন করছে। ভার্সিটির নাম করে পূর্বিকা তার সাথে সাক্ষাতের অভিপ্রায়ে এখানে এসেছে। তাদের প্রেমের বয়স এক বৎসর। প্রতিদিনের ন্যায় আজও পূর্বিকা আফ্রিদির সাথে দেখা করবার উদ্দেশ্যে এসেছে। এক বৃহৎ বৃক্ষের নিচে উপবেশন করে অপেক্ষা করছিল সে, যখন হঠাৎ আফ্রিদি অস্থিরচিত্তে সেখানে উপস্থিত হল। কোনো প্রকার প্রস্তাবনা না দিয়েই, সে একেবারে এমন অদ্ভুত কথাবার্তা বলে উঠল। আফ্রদি পূনরায় বলল,
- "তুমি বুঝছো না কেন?? ওই মুগ্ধ তোমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে!! "
- "তোমায় কে বলেছে? "
- "কে আবার মুগ্ধ বলেছে!! "
- "তাহলে তো ভালোই ওকেই বিয়ে করব.!! তুমি এভাবেই বেকার ঘুরো!! আর মুগ্ধ এসে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাক!! তুমি দাওয়াত খেতে এসো কেমন???"
পূর্বিকার কথাটি শুনেই আফ্রিদির অন্তরের গভীরে এক প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল। মনে হলো যেন কেও তার হৃদয়টা ছিঁড়ে ফেলছে। একবার কাতর নয়নে তাকাল পূর্বিকার দিকে। পূর্বিকা কতই না সুন্দর! ফর্সা মুখশ্রীতে ডাগর ডাগর নয়ন যেন প্রলুব্ধকারী তীর, যা সহজেই হৃদয় বিদ্ধ করতে সমর্থ। যে কেও প্রথম দর্শনেই তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাবে। এর কারণেই তো আফ্রিদি সর্বদা পূর্বিকাকে কোথাও গেলে মুখ ঢেকে যেতে বলে। আফ্রিদি নিজেই তো প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। আর আজ? তার ভালোবাসার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, নিজের যোগ্যতা অপেক্ষা অধিক পেয়েছে! আর এখন কি ঘটল? আফ্রিদির শৈশবের বন্ধু এখন তার প্রিয়তমাকে বিবাহ করবার বাসনা প্রকাশ করছে! এই গভীর দুঃখ কাকে বুঝাবে?
আফ্রিদি বিদীর্ণ কণ্ঠে পূর্বিকার দিকে চেয়ে বলল
- "তুমি কি সত্যিই এই কথা মানো, পূর্বিকা? যে ভালোবাসা ছিলো আমাদের মধ্যে, তা কি এভাবে বিনাশ হতে পারে?"
পূর্বিকা এবার গভীর মনোযোগ সহকারে আফ্রিদির দিকে চাইলো। কথাগুলো রাগের আবেশে উচ্চারণিত হলেও, আফ্রিদির অভিব্যক্তি এবং ভাঙা গলার করুণ সুর শুনে পূর্বিকার হৃদয় চরমভাবে দংশিত হলো। আফ্রিদি পূর্বিকাকে সদা "পূর্বি" বলে ডাকে, আজ কতদিন পর তার পূর্ণ নাম উচ্চারণ করল। পূর্বিকা উপলব্ধি করল যে, সে নিজেও আফ্রিদির প্রতি অনুরাগে নিমজ্জিত। যেই আফ্রিদিকে প্রারম্ভিক কালে উপেক্ষা করত, আজ সেই আফ্রিদির প্রতি সমস্ত হৃদয় দান করে বসে আছে। পূর্বিকা তাকাল সামনে বসা সুদর্শন শ্যামপুরুষ আফ্রিদির পানে যার চোখে জড়িত অশ্রু, যা প্রণয়না সহকারে কষ্টে পূর্ণ। পূর্বিকা অনুভব করল যে, যদি তার উপস্থিতি না থাকত, তবে আফ্রিদির স্নিগ্ধ অশ্রু ঢালিত হতো এতক্ষণে। পূর্বিকা আফ্রিদির হাত শক্ত করে ধরে বলল,
- "তোমার স্পর্শ ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের সংস্পর্শে আমি মরতে প্রস্তুত, কারণ আমার সবকিছুই শুধুমাত্র তোমার জন্য নিবেদিত। "
- "সত্যি তো? "
- "প্রেমিক পুরুষেরা বুঝি বোকা হয়??"
- "বোকা হয় কিনা জানি না, তবে পাগল নিশ্চয়ই হয়! "
- " সত্যিই ভালোবাসা কি অদ্ভুত তাই না? যে সহজ বিষয়গুলো আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিতে সহজেই ধরা পড়ে, ভালোবাসার প্রভাবে সেগুলোও আমাদের বুঝতে অনেক সময় লাগে । "
আফ্রিদি পূর্বিকার হাত শক্ত করে চেপে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
- "মানে"
- "মানে প্রেমিক মশাই!! ও বাড়ির সাথে যে আমাদের বাড়ির ঝা'মেলা আছে তা কি জানেন না?? নাকি নতুন করে জানাতে হবে?? আপনার বন্ধু বললেই হলো?? "
- "মুগ্ধ যা বলে ও তাই করেই ছাড়ে! অনেক জেদি ছেলে । ছোট থেকে দেখে আসছি! খুব ভালো করেই চিনি ওকে! "
পুর্বিকা আফ্রিদির হাত ছেড়ে দিয়ে কোমড়ে হাত রেখে রাগান্বিত হয়ে বলে,
- "যা বলে তাই করে হুম ??? তুমি কি বসে বসে আঙ্গুল চু'ষবে হ্যাঁ??? এর জন্য তোমার সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে হয় না! থাকো তুমি!! গেলাম আমি তোমার ওই মুগ্ধর কাছে!! "
এটা বলেই পূর্বিকা চলে যেতে নিলে আফ্রিদি দ্রুত পূর্বিকার হাত ধরে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে,
- "আমি থাকতে তুমি অন্য কারো কাছে যেতে পারবে না। মেরে ফেলবো একদম!! আমি বেঁচে থাকতে , তোমাকে অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারবে না! যদি কেউ তোমার প্রতি নজর দেয়, আমি তাকে কোনো দ্বিধা ছাড়াই প্রতিরোধ করব। সে আমার পুরনো বন্ধুই হোক না কেন- আমার যায় আসে না। তুমি শুধু আমার পূর্বি।"
- "ভাষণ দেওয়া বাদ দিয়ে আগে একটা চাকরির ব্যাবস্থা করুন মহাশয় "
বলেই পূর্বিকা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আফ্রিদি পূর্বিকার থুতনি ধরে নিজের দিকে মুখ উঁচিয়ে বলল,
-“ভালোবাসি, পূর্বি।”
********
-"ভাইয়ার অনেক জ্বর এসেছে! কাল সন্ধ্যা বেলা ভিজে একদম যাচ্ছেতাই অবস্থা! ঝড়ের মাঝেই ডক্টর বাড়িতে আনতে হয়েছিলো।"
বক্তব্যটি কর্ণকুহরে প্রবাহিত হতেই আঁখির চক্ষু বিস্ময়ে প্রসারিত হলো। কলেজের শ্রেণিকক্ষে তিন বান্ধুবিই উপস্থিত । ইংরেজি শিক্ষক বোর্ডে লেখন করে সকলকে নোট গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে অনুসারে, সকলেই খাতায় লেখছিল। ইংরেজি শিক্ষক জরুরি কল আসায় বাহিরে যান কথা বলতে, তখন মিলি যখন আছিয়াকে মুগ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল, তখন আছিয়ার মুখে কথাটি শুনে এক বিপুল অপরাধবোধ তাকে আচ্ছন্ন করল। প্রবল খারাপ লাগা কাজ করছে অন্তরের অন্তস্তলে। মনটা তিরস্কার করে বলে উঠছে তাকে,
- " তোর জন্যই এমন অনিষ্ট ঘটেছে! যদি তখন গাধার মতো বসে না থেকে চলে যেতি, তবে উনার আগমন নাকুলিত হতো, ভিজতে হতো না, জ্বরও আসতো না! সেই ব্যক্তি যদিও গোমড়া মুখের অধিকারী, তবুও তোর সাহায্য করেছিল।
জবাবে আঁখি মনে মনে নিজেকেই বলল,
-"এইসব আমার জন্য কি করে হতে পারে? আমি কি তাকে সাহায্য করতে বলেছিলাম?"
এরপর, অন্তর্নিহিত দ্বৈত মন বলে ওঠে,
-"কেন নয়? যখন সে চলে যাচ্ছিল, তুই কি আশা করিসনি যে উনি তোর সাহায্যে আসবে?"
আঁখি পুনরায় জবাব দেয়,
-" প্রথমে ভেবেছিলাম, কিন্তু পরবর্তীতে তো বলেছিলাম যে অন্য কারো কাছ থেকে আশা করা নির্বোধের কাজ। "
দ্বিতীয় মন তাচ্ছিল্য করে বলে উঠে,
-"অথচ, তুই নিজেই তাকে সাহায্য করতে প্ররোচিত করেছিলি, এখনো মনে মনে তুই জানিস তোর জন্যই এমন হয়েছে আর এখন অস্বিকার করার চেষ্টায় রয়েছিস।"
-" আঁখিইই!!!! "
স্যারের ক্ষিপ্ত বাণীর আওয়াজে আঁখি তাঁর চিন্তা ও চিন্তন থেকে মুক্ত হলো। দেখলো স্যার ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, আশপাশে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো সকলের দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ। স্যার যখন ক্লাসে প্রবেশ করেন, তখন আঁখির দিকে তাঁর নজর পড়ে, যে লেখার প্রতি উদাসীন হয়ে বাহিরের দিকে অবলোকন করছিল। স্যার তিনবার ডাক দিয়েও আঁখির মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হন। আছিয়া, মিলি ফিসফিসিয়ে নীরবে আঁখিকে ডাকলেও, তাঁর মনোনিবেশ ফিরে আসে না। ইংরেজি স্যার, যিনি কলেজের সর্বাধিক কঠোর শিক্ষক, তাঁর ক্লাসে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। স্যার ধমক দিয়ে বললেন,
- Stand up!!
আঁখি ঠাস করে দাঁড়িয়ে পড়লো। স্যার বলল,
- খাতা নিয়ে এদিকে এসো!!
এইরে আঁখি তো কিছুই লিখে নি। এবার কি দেখাবে?
- কি হলো?? নিয়ে আসো!!
স্যারের ধমকে আঁখি কাচুমাচু হয়ে নিজের খাতা না নিয়ে, মিলির খাতা না দেখেই নিলো। ভেবেছে মিলি তো লিখেছে। গিয়ে সোজা স্যারের হাতে দিয়ে দিলো। খাতা পর্যালোচনার পর স্যারের মুখ রাগে অগ্নিশিখা হয়ে উঠল। আঁখি তা দেখে না বুঝার ভঙ্গিতে ভ্রু কুচকালো। স্যার ক্ষিপ্তভাবে বললেন,
- "বাহির হও এই ক্লাস থেকে! দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কানে ধরে দাড়াও!"
স্যারের এই নির্দেশে আঁখি হতবাক হয়ে গেল। চমকে ওঠে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্যারের সামনে, কিছুই বুঝতে পারছে না কি হয়েছে !! আঁখি নিচুস্বরে মিনমিনিয়ে বলল,
-" কিন্তু স্যার,,,"
স্যার ধমকে আবারও বললেন,
- "তুমি চেয়ারম্যানের ভাতিজি হও কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নাতনি হও, আমার ক্লাসে এই ধরনের বেয়াদবি বরদাশত করা হবে না। যাও, কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো।"
আঁখি একপলক সবার দিকে তাকালো, সবাই মিটিমিটি মুখ চেপে হাসছে। মিলি কপালে হাত দিয়ে আঁখি কে রেগে কিছু একটা বলছে ইশারা করে। আছিয়া হা করে আছে। অপমানে, লজ্জায় আঁখির মাথা যেন মাটির ভিতরে প্রবেশ করতে চাইছে। তার ইচ্ছা হচ্ছে, যেন ভূমি তাকে আত্মগোপনের সুযোগ দেয়। মাথা নিচু করে, লজ্জায় মুখ ঢেকে, আঁখি দরজার সম্মুখে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। আশেপাশে সবাই তার এই অবস্থায় হাস্যরস করছে। আঁখির বুকের গভীরে কান্নার তীব্র ঢেউ উথাল-পাথাল করছে, চোখের কোণ থেকে অশ্রু নিরন্তর প্রবাহিত হচ্ছে।
অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে খাতাটা টেবিলের উপর সশব্দে নিক্ষেপ করলেন ইংরেজি শিক্ষক লতিফুর রহমান, মনে যেন প্রবল বিরক্তির বিস্ফোরণ ঘটল। হেথায় তখন প্রবেশ করলেন একাউন্টিং শিক্ষক রাসেল সাহেব, যার পরবর্তী ক্লাসের সময় খানিকক্ষণ বাদে। আঁখির করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে রাসেল স্যার, এক রকমের গাল ভরে হাসি ছড়িয়ে, লতিফুর রহমানকে বললেন,
- "আরে, আরে! কি করেছেন কি স্যার! এই মেয়েটাকে কানে ধরিয়েছেন কেন? মেয়েটা কেঁদে দিয়েছে তোহ।"
লতিফুর রহমানের কণ্ঠ তার নামের মতোই কঠোর, ঝাঁঝালো সুরে বললেন,
- "এ যুগের ছাত্র-ছাত্রী একেবারেই অসভ্য! শিক্ষকের প্রতিই তাদের বিন্দুমাত্র সম্মান নেই। কই, আগেকার ছেলেমেয়েরা কত সুন্দর ব্যবহার করত! তারা শিক্ষকদের পিতা তুল্য মর্যাদা দিত, আর আমরাও তাদের সন্তানের ন্যায় স্নেহ করতাম। কিন্তু এখনকার যুগে দেখুন, শিক্ষকদের পিছে শুধু কুৎসা রটিয়ে বেড়ায়!"
একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে লতিফুর রহমান পুনরায় মৌন হলেন। রাসেল স্যার এক পলক আঁখির দিকে তাকিয়ে মুখের কোণে এক গোপন হাসির রেখা টেনে বললেন,
- "না না,, বেয়াদবি করা তো ঠিক না!"
আঁখির অন্তঃকরণে তীব্র যন্ত্রণার স্রোত বইতে লাগল, কোনো অপরাধ না করেও তার প্রতি এহেন আচরণ! রাসেল স্যার আঁখির দিকে তাকিয়ে কৌতূহল ভরে প্রশ্ন করলেন,
- "তুমি কোন বিভাগের ছাত্রী?"
আঁখির গলায় নেমে আসল বিষাদের ছায়া, কন্ঠাভি করে বলল,
-"ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের।"
এটা শুনে রাসেল স্যারের হাসির উদ্ভাস আরো বিস্তৃত হলো, তিনি লতিফুর রহমানকে উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললেন,
- "স্যার, ছেড়ে দিন, বাচ্চা মানুষ, বুঝতে পারে নাই!"
লতিফুর রহমান তার ভ্রু কুঁচকে কঠোর স্বরে বললেন,
- "হুঁ, আপনার ছাত্রী বলেই তো বলছেন! যদি মানবিক বা বিজ্ঞান বিভাগের হতো, তবে কি এটা বলতেন?"
রাসেল স্যার সপ্রতিভভাবে বলিলেন,
-"আরে স্যার, কি যে কন! সবাই আমার চোখে সমান!"
এই বলে রাসেল স্যার আঁখির পিঠে হাত রেখে বললেন,
-"তাই না? তা, তোমার নাম কী?"
আঁখি যেন শরীরের মধ্যে এক প্রকার অস্বস্তি অনুভব করতে লাগল, সে একটুখানি পিছু হেটে কান ধরেই মেকি হেসে বলল,
- "আ...আঁখি।"
-"আঁখি, বাহ, বাহ! অপূর্ব নাম!"
রাসেল স্যারের চোখে যেন এক অশুভ দীপ্তি জ্বলে উঠল। লতিফুর রহমান গম্ভীর কণ্ঠে মন্তব্য করলেন,
- "চেয়ারম্যানের ভাতিজি !"
এটা শুনে রাসেল স্যারের হাসির গমগমানি আরো প্রবল হলো। তিনি আঁখির দেহের উপরে এক লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন, তার চোখে যেন কামনার অশ্রাব্য অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হলো । মনে মনে রাসেল স্যার কল্পনা করতে লাগলেন,
- “ইশ্‌, এই শ্যামবর্ণা মেয়েটির নগ্ন দেহে কেমন দেখাবে? আহা! যদি এই কচি কান্তার মাধুর্য ভোগ করতে পারতাম, তবে এটাই হতো জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য! তার উপর বড়লোকের মেয়ে!! ”
রাসেল স্যারের অন্তরে জাগল কুৎসিত অভিসন্ধি, তার কামনার দৃষ্টিপাত যেন হিংস্র লালসায় আঁখির দেহের উপর প্রবাহিত হতে লাগল। তিনি গালে হাত ঘষতে ঘষতে এক বিশ্রী হাসিতে মুখ বিকৃত করলেন, তার দৃষ্টি আঁখির পা থেকে মাথা পর্যন্ত লোলুপভাবে ভ্রমণ করল। তার চোখ যেনো আঁখির শরীরের প্রতিটি ভাঁজ কল্পনায় স্পর্শ করল, এই কচি শরীরের কামনা মনে জাগ্রত হল। বুকের গভীরে উত্তেজনার ঢেউ উঠল, অন্তরে লালসার আগুন জ্বলে উঠল। আঁখির শ্যামবর্ণ মায়াবতী রূপ, তার সৌন্দর্য যেনো রাসেল স্যারের অন্তর পুড়িয়ে দিল। এই মেয়েটাকে যেভাবেই হোক পেতে হবে, এমনই এক স্থির সংকল্প তার অন্তরে গেঁথে গেল। তার চোখ আঁখির কোমরের দিকে ঘুরল, সুগঠিত কোমর যেনো হাতের স্পর্শ কামনা করছে। হাতকে যেনো আর কন্ট্রোল করা কষ্টকর হয়ে উঠেছে, তার লালসা আর আকাঙ্ক্ষা যেনো সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
আঁখির চোখে স্পষ্ট পড়ল স্যারের দৃষ্টির অপ্রীতিকর হিংস্রতা। তার অন্তরে অস্বস্তি আরও তীব্র হয়ে উঠল। সে দ্রুত কানে ধরা হাতগুলো সরিয়ে জামাকাপড় ঠিক করতে শুরু করল, গায়ের ওড়নাটি টেনে শরীরকে আরও আড়াল করল। কিন্তু আঁখি কি জানে, তার এই প্রতিরক্ষামূলক চেষ্টা রাসেল স্যারের আকাঙ্ক্ষার আগুন নিভিয়ে দেবে না? স্যারের কামনা তো বাস্তবের পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। তার চোখের লোলুপ দৃষ্টি এড়িয়ে, কল্পনার জগতে সে ইতিমধ্যেই আঁখির জামাকাপড় উন্মোচন করে তার নগ্ন দেহের প্রতিটি রেখা মনে গভীরভাবে অঙ্কিত করে রেখেছে। তার লালসা আকাশছোঁয়া, এবং এই কল্পনায় সে নিজেকে আনন্দিত করেই চলেছে।
ইংরেজি ক্লাস শেষ হতে আর মাত্র দু’মিনিট বাকি। রাসেল স্যারের ভেতরে এক অস্থিরতা দানা বাঁধছিল, আরেকবার সেই নরম দেহটি ছুঁয়ে দেখার। তার হাতটা নিজ অজান্তেই বাড়িয়ে দিল আঁখির দিকে। ঠিক তখনই একটি তীব্র ধ্বনি প্রকম্পিত হলো, যেন কিছু লুটিয়ে পড়ার শব্দ। আঁখি চোখ তুলে দেখল রাসেল স্যার তার দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে সে আরও সরে গেল। হঠাৎ ওই বিকট শব্দে রাসেল স্যার চমকে উঠলেন এবং হাত থামিয়ে দিলেন। লতিফুর রহমান শব্দ শুনে ক্লাসের বাইরে এসে উপস্থিত হলেন। ক্লাসের সকল ছাত্র-ছাত্রী বাহিরের বারান্দায় দৃষ্টিপাত করল, শব্দের উৎস কোথায়? আছিয়া ও মিলি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে দেখে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
- " মুগ্ধ ভাইয়া?"
মুগ্ধ রক্তচক্ষু উগরে দিয়ে দৃপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে রেখেছে। তার চোখ এমন আগুনে দাউ দাউ করছে যে, দেখতেই আত্মা কেঁপে উঠছে। কিন্তু আশেপাশে ছাত্রীরা তার দিকে চেয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। সকলেই বিমোহিত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা বলিষ্ঠ, উচ্চলম্বা ও সুদর্শন পুরুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। বারান্দায় বসার জন্য তিন-চারটি বেঞ্চ সাজানো ছিল, যা এখন নিচে পড়েছে। মুগ্ধকে দেখে লতিফুর রহমান হাসিমুখে এগিয়ে এসে তার চওড়া কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-" আরে বাবা, তুই কখন এলি? আর এই বেঞ্চগুলো পড়ে গেলো কিভাবে?"
ওদিকে আঁখি লজ্জায় বিহ্বল ও বিস্মিত! হায় আল্লাহ ! পুনরায় এই ব্যক্তি? আবারও কেন, কেন, কেন, কেন এমন ঘটল? আল্লাহ! আঁখি যবে অপ্রীতিকর অবস্থায় উপস্থিত হয়, সেই মুহূর্তেই কেন মুগ্ধ প্রাঙ্গণে আগমন করে? আঁখিকে কি ভাবছে মুগ্ধ যে, সে অতিশয় দুর্বৃত্ত? এই জন্য কি সে কানে ধরে দাঁড়াইয়াছে? আঁখির অন্তরে লজ্জা ও অপমানের অগ্নি প্রজ্বলিত, তথাপি মুগ্ধ এক পলকও সম্মুখে আঁখির পানে তাকায় নি! ক্লাসের সময় তো শেষ, তাই আঁখি ধীরে ধীরে কর্ণগৃহ থেকে করধৃত করল, পাদক্ষেপ করে প্রবেশ করল শ্রেণিকক্ষে। সেখানে সে আগে খাতাটি কৌতূহলে নিল তার অন্তর্নিহিত রহস্য উদ্ঘাটনের অভিপ্রায়ে। খাতা দেখে চক্ষু বিস্ফারিত হল আঁখির । কী দেখল তাতে! খাতার অন্তরালে কাগজের উপর অঙ্কিত আছেন লতিফুর স্যারের এক ব্যঙ্গচিত্র। তার বৃহৎ উদর, মুণ্ডমুণ্ডিত শীর্ষে তিনটি দীর্ঘ কেশ, এবং মুখাগ্র হা করিয়া তিনটি পোকামাখা দন্ত উন্মুক্ত।
এতক্ষণে আঁখির বোধোদয় হলো যে, কেন স্যার এত ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন তার প্রতি। মিলির এই অপকর্মের ফলেই সবকিছু ঘটেছে। হায়! এ কী করল মিলি!
আঁখি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মিলির দিকে এগিয়ে গেল। তার মন তখন ক্ষোভে টগবগ করছে। কিন্তু হঠাৎ সে লক্ষ্য করল, ক্লাসের মেয়েরা সবাই বারান্দায় মুখ বাড়িয়ে বাহিরে মুগ্ধের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে! আঁখির মাথায় রক্ত চড়ে গেল,
-"এই আজকালকার মেয়েদের আর যাই হোক এই একটা সমস্যা, সুন্দর চেহারার কোনো পুরুষ দেখলেই বেহায়ার মতো এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে। একেক সময় একেক জনকে পছন্দ করে, তারপরে আবার পছন্দ বদলে ফেলে। উফফ, বিরক্তিকর!"
মিলির কাছে এসে আঁখি দাঁড়ালো, তখন মিলি আছিয়াকে ঠাস করে বলল,
-"তুই না বলেছিলি মুগ্ধ ভাই অসুস্থ, জ্বর এসেছে। তাহলে এখানে কি করে?"
আছিয়া ভ্রু কুঁচকে জবাব দিল,
- "আমি তো নিজেও সেটাই ভাবছিলাম! সকালে তো জ্বরেই ছিল। কীভাবে এর মধ্যেই সুস্থ হয়ে গেল?"
রাসেল সাহেব কিছু বলতে যাবেন এমন সময় মুগ্ধ তাঁকে থামিয়ে বলল, "আপনি তো আর কোনো ক্লাস নিতে পারবেন না, স্যার।"
রাসেল সাহেব ভ্রু কুঁচকে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, এমন ঘোষণা শুনে স্পষ্টই অবাক হয়েছেন।
মুগ্ধ বাকা হেসে বলল,
- "আজ আমি এই কলেজের সকল শিক্ষককে আমার তরফ থেকে খাওয়াবো। আর এক্ষুনি খাওয়াবো।"
লতিফুর রহমান মুগ্ধের কাঁধে হাত রেখে হেসে বললেন,
- "কালই তো পুরো গ্রামকে দাওয়াত করলি আর আজই আমাদের খাওয়াতে এসেছিস! দেখেছেন রাসেল স্যার, এজন্যই বলেছিলাম আগেকার স্টুডেন্ট গুলো পিতার মত সম্মান দিত। এই মুগ্ধ আমার সব থেকে প্রিয় ছাত্র। পড়ালেখায় কোনদিনই দ্বিতীয় হয়নি, সবসময় প্রথম হয়েছে। জীবনে অনেক স্টুডেন্ট পড়িয়েছি, কিন্তু মুগ্ধর মতো কাউকেই পাইনি। I'm proud of you my boy! "
মুগ্ধ রাসেল সাহেবের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-"চলুন তাহলে।"
মুগ্ধ প্রিন্সিপাল মহাশয়কে পূর্বেই জানিয়ে রেখেছে ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়ার জন্য। পিয়নও নির্দেশ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। এদিকে আঁখি ক্রোধে ফুঁসে মিলির দিকে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
- "ওই তুই এসব কি একেছিস? স্যারকে কি কেউ এমন করে আঁকে? তোর জন্য আজ আমার কী দুর্দশাই না হলো!"
মিলি ভীতভাবে কানে হাত দিয়ে উত্তর দিল,
- " সরি রে বনু, ওই টা'কালা ভুরি ওয়ালা স্যার সবসময় হাঁসের মতো পেকপেক করে, তাই এঁকেছিলাম। আমি কি জানতাম তুই সেটা নিয়ে যাবি!"
আঁখি আর কিছু বলল না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। তার মনে তখনও রাসেল স্যারের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। সে কু-ভাবনায় তার পিঠে স্পর্শ করেছিল। একটি নারীর অন্তরেই রয়েছে সেই গভীর বোধশক্তি, যা ভালো স্পর্শ আর খারাপ স্পর্শের তফাৎ বুঝতে সক্ষম।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu