লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
ভায়োলেন্স যুক্ত পর্ব! প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত!
*
*
আছিয়া শয্যার ওপর থেকে ধপাস করে পতিত হয়ে নাসারন্ধ্রে প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ব্যথার তীব্রতা শীতের কর্কশ শাসনকর্তার চাবুকের মতো তীক্ষ্ণ অনুভব করছে। নাসিকা স্থানে কৃত্রিম হাতাহাতি চলছে, যেন নাসার অঙ্গটি হারিয়ে গেছে! ভোরের প্রভা ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে, আর আছিয়া সারারাত ব্যথাতুর ক্রন্দন শেষে সবেমাত্র ফজরের নামাজ আদায় করে বিশ্রামের জন্য গিয়েছিল। ক্লান্ত দৃষ্টিজুড়ে নিদ্রার আবরণ নামতে না নামতেই হঠাৎ ফোনের তীব্র আওয়াজ কাঁচা নিদ্রার শৃঙ্খল ছিন্ন করে দেয়। মেজাজ ক্রুদ্ধ অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত হলো!
কিন্তু যখন সে ফোনটি তুলে ধরল, মনে হলো কলিজা বুকের প্রকোষ্ঠ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো। বিস্ময়ে দুচোখ ডলল কয়েকবার, যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না; ভুল দেখছে কি না! নাকি অন্ধ হয়ে গেছে আচমকা? অথচ স্ক্রিনে জলজল করছে একটি নাম, যা তাঁর অস্তিত্বের শিকড়ে বজ্রপাতের মতো আঘাত হানে: “জীবন ভাই”! চক্ষু বিস্ফারিত অবস্থায় তাকিয়েই ছিল সে, এমনকি যখন কলটি কেটে গেল, তবেই যেন চেতনা ফিরল তার। উতলা হয়ে শ্বাস নিতে লাগল! এই শীতল ভোরে জীবন ভাই কেন কল দিলেন? এ কোন দুর্বোধ্য রহস্য লুকিয়ে আছে!
বরফের মতো সারা শরীর জমে গেলো আছিয়ার। কিছুক্ষণ পর হাত-পা ছড়িয়ে, শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করল। প্রথমবারের মতো জীবন ভাইয়ের কল! অথচ সে ধরতে পারল না? নিজের মূর্খতার জন্য কাতরাতে কাতরাতে অঝোর কান্না ভাঙল। ঠিক সেই মুহূর্তেই আবারো ফোনের রিং বাজল। কান্নার ঢল থামিয়ে অস্থির হাতে রিসিভ করতেই জীবনের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
——— “ফুলবাড়িতে এসো!”
কল কেটে গেল। এই কী বলল জীবন? আছিয়া নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না! এমন হিমশীতল প্রভাতের প্রতিকূলতায় জীবন ভাই তাকে ডাকছে? খুশিতে বিছানায় উল্টে গড়াগড়ি দিতে গিয়েই হঠাৎ তীব্র উচ্ছ্বাসের ধাক্কায় শয্যা থেকে পড়ে গিয়ে নাসিকার সম্মুখে মেঝেতে শক্ত আঘাত খেল!
না, না, এ সকল ব্যথা বিলাসিতা করে মানা চলবে না! জীবন ভাই ডেকেছে; এই প্রথমবার! যত অবহেলা, যত সহ্যক্লেশ সয়ে এসেছে এতকাল, আজ প্রথমবার তাঁর আহ্বান শোনা গেল! এই সুযোগ তো কোনোভাবেই হারানো যায় না। আছিয়ার অন্তঃস্থল বিদীর্ণ করেও সে এই আহ্বানে সাড়া দিতে পারে। উত্তেজনায় তড়িঘড়ি করে পরনের মলিন পোশাক বদলে সে আকাশি বর্ণের দীর্ঘ কুর্তি পরিধান করল, উপরে গায়ে জড়িয়ে নিল শীতনিবারণী চাদর। আয়নায় একবার নিজেকে নিরীক্ষণ করতেই কপালে ভাঁজ পড়ল; ইশ, চোখের নিচে ক্লান্তির কালি দেখা যাচ্ছে!
আবারো দ্রুতপদে ছুটল বাথরুমের দিকে, সেখানে শীতের করালগ্রাস উপেক্ষা করে শীতল জলে মুখটিকে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করল ফেসওয়াশ দিয়ে। সজল দেহে ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে সাবলীলভাবে মাখল স্নিগ্ধতা-প্রদায়ক ক্রিম। গোলাপি অধরে সযত্নে প্রয়োগ করল লিপজেল, এবং শুষ্ক হস্ত ও পদে নিবিড়ভাবে লোশন মেখে সজ্জিত হলো নববধূর মতো। প্রস্থান করার পূর্বে পুনরায় আয়নায় একবার চক্ষুদ্বয় নিবদ্ধ করল, নিজেকে সম্যক নিরীক্ষণ করে নিশ্চিত হলো সৌন্দর্যের যথাযথ পরিপূর্ণতা নিয়ে।
আবারো দ্রুতপদে ফিরে এসে আঁখিপল্লবে সযত্নে কাজলের রেখা আঁকল। এমনই উচ্ছ্বাসে বিভোর, যেন মধুমত্ত উন্মাদিনী! অথচ এই সকল সজ্জা-আলঙ্কারের বিপুল প্রয়াসে যে সময় তার হাত ফসকে নিঃশব্দে গড়িয়ে গেছে, তার খবরই নেই। মোবাইলের পর্দায় সময় দেখামাত্র বিস্ময়ে জিভে কামড় দিল! ত্রিশটি মূল্যবান মিনিট কীভাবে উধাও হলো? আল্লাহ! তাঁর জীবন ভাই কি ত্রিশটি অমূল্য ক্ষণ অপেক্ষার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন?
মাথায় হাত রেখে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে ঘর থেকে নির্গত হলো। এদিকে মা ও চাচি নামাজের পর গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন, পুরো বাড়ি আঁধারের আবরণে ঢাকা। বাড়ির পেছনের দরজায় চোরের মতো নিঃশব্দে এসে সেটি খোলে, আবার সাবধানতার সাথে লাগিয়ে বেরিয়ে এলো। সতর্ক পদক্ষেপে পেছনের বাগানঘেরা প্রান্তের দ্বিতীয় স্টিলের গেট খুলে বেরিয়ে, আর তৎক্ষণাৎ পুনরায় সেটি আবদ্ধ করল। এরপর শীতের কনকনে হিমেল হাওয়ায় গায়ে কাঁটা দিয়ে দিলো এক দৌড়, শীতল প্রকৃতির করাল ছোবল উপেক্ষা করেও জীবন ভাইয়ের ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রতিজ্ঞা অটুট রাখে।
ফুলবাড়ি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমৃতভূমি, যেখানে শীতকালীন পুষ্পরাজির অপরূপ সমারোহ সুবিন্যস্ত শৃঙ্খলায় বিস্তৃত মহৎ প্রান্তর জুড়ে সুশোভিত। এই বাগানে পর্যটকরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে সৌন্দর্যের মাদকতায় বিভোর হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এক প্রান্তে লাল-কমলাভ ভাট ফুলের বাহার, অন্য প্রান্তে শুভ্র কাশফুলের মর্যাদাবাহী শোভা; কোথাও রঙিন ডালিয়া পুষ্পের মঞ্জরি, আবার কোথাও স্বর্ণালি গাঁদার ঘ্রাণমাখা উপস্থিতি সহ নানান ধরণের ফুলে ফুলে মোড়ানো । এ দৃশ্য একেবারে চোখ ধাঁধানো, মন পুলকিত হয়ে ওঠে অপার শ্রীমায়ায়। শাহারিয়াজ বাড়ি থেকে সেখানে যেতে দশ মিনিট সময় লাগলেও, আছিয়ার যে পলায়নী গতিতে ছুটেছে, তিন মিনিটেই পৌঁছানোর সম্ভাবনা অদ্বিতীয়!
ভোরের কালো আঁধারি এখনো আকাশের প্রান্তর ছেঁকে রেখেছে; শীতল বাতাস ধারালো কাঁচের মতো বয়ে চলেছে। আহ! কী প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ! তবুও, আছিয়ার মনে ভালোবাসার যে উত্তাপ জ্বলে, এই পৃথিবীর কোন শীতলতাই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না! কতখানি যন্ত্রণা সয়েছে মেয়েটা, কত নিদারুণ কষ্ট বুকে পুষে রেখেছে! আর আজ যেন সে সোনার খনি পেয়ে গেছে! জীবনের গভীরতম আকাঙ্ক্ষা পূরণের আনন্দে বিভোর হয়ে দৌড়ে এসে পৌছালো ফুলবাড়িতে—বুকের ভেতর হৃদস্পন্দনের ঢেউ, চোখে স্বপ্নের অপার মায়া!
ভোরের আবছায়ায় শীতের কুয়াশায় লুপ্ত সব দৃশ্যপট, নিঃশব্দে সবকিছু এক মায়াবী অন্তরালে হারিয়ে গেছে। চারিদিকে নির্জনতার গাঢ় অন্ধকার; কিছুই চক্ষে ভাসে না! মেয়েটি, অদ্ভুত সরলতায়, একটি মাত্র আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে এসেছে। এমন উদাসীনতায় কেও ইচ্ছা করলেই তাকে অপহরণ করতে পারে, কেবল তার জীবন ভাইয়ের নাম উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট! একে একে পথ চলতে চলতে, নিজেই নৃত্যময় ছন্দে সম্মোহিত হয়ে গন্তব্যে গিয়েছে। হায়! প্রেমের এমনই মায়াজাল!
আছিয়া দিকবিদিক খুঁজছে, চোখের বিষণ্ণতায় অন্বেষণ ভর করেছে। সে খুঁজে পাচ্ছে না তার পরিচিত মুখ, জীবন ভাই কোথায়? অন্ধকারের মধ্যে ক্ষীণকণ্ঠে ডাক দেয়,
———" জীবন ভাই! ও জীবন ভাই! আপনি কোথায় আছেন? আমি এসে গেছি, জীবন ভাই!"
তবুও জীবন ভাইয়ের দেখা না পেয়ে, চিন্তার ঝাঁঝালো তাপ মাথায় যেন কিলবিল করে উঠল! অধীর প্রত্যাশায় পুনর্বার ডাকল,
——— " জীবন ভাই? জীবন ভাই? কোথায় আপনি? আপনি তো আমাকে এখানে আসতে বলেছিলেন! তবে কোথায় আপনি?"
এই কথাটুকু বলতেই গলায় যেন কাঁটার ঝাঁক বাধল, কান্না এসে গলায় উথলে উঠল, অব্যক্ত বেদনার এক তীক্ষ্ণ অনুরণন! ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো এক গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠস্বর, নিঃশব্দকে বিদীর্ণ করে,
—— "আছিয়া!"
আছিয়া পেছনে ফিরে তাকাল। তার সম্মুখে, কুয়াশার আবরণে লুকানো সেই সুদীর্ঘ শ্যাম পুরুষের অবয়ব! তার প্রতীক্ষিত জীবন ভাই। কিন্তু ঠিক তখনই জীবনের ফোনে একটি মেসেজের টুং টাং শব্দে তন্দ্রা ভাঙল। নোটিফিকেশনে চোখ বুলাতেই দেখা গেলো মুগ্ধের কঠোর হুঁশিয়ারি,
——— "আমি কথা বলতে বলেছি! কথা বলে নেবে। সুযোগের অসৎব্যবহার করলে হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে পৌঁছে দিব! গট ইট?"
জীবনের বক্ষ থেকে এক গভীর, দহনময় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, যেন কোনো অলঙ্ঘনীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। দূরের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে, আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অটল পুরুষের অবয়ব, দৃঢ় ও দুর্বিনীত পিলারের মতো দৃশ্যমান না হলেও, জীবন ভালো করেই জানে মুগ্ধ ঠিক সেখানেই আছে। বোনকে একা ছেড়ে সে কখনোই দূরে সরে যাবে না!
আছিয়ার চোখে অশ্রুর ক্ষীণ আভা, বেদনাবিধুর সিক্ত দৃষ্টি এতকাল পরে প্রথমবার জীবনের সুরক্ষিত ছায়ায় আবার প্রত্যাবর্তন করেছে। জীবন ধীর, দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এলো আছিয়ার দিকে, স্থিতধী সরলতায় তার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলার স্বর গম্ভীরভাবে পরিষ্কার করে বলল,
——— "কেমন আছো?"
আছিয়ার চোখের টলমল আভায় আনন্দের আলোকধারা, সেই কোমল কণ্ঠে প্রশ্ন উচ্চারিত হলো,
——— "অনেক ভালো! আপনি ভালো আছেন?"
——— "হুঁ!"
——— "খেয়েছেন?"
——— "হুঁ!"
——— "আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন?"
——— "হুঁ!"
——— "তাহলে বলুন?"
আছিয়ার মুখে উচ্ছ্বাসের হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু জীবন যেন মহাসংকটে পতিত! এই ‘হুঁ হুঁ’ ছাড়িয়ে আর কী বলবে সে! ওদিকে মুগ্ধর সিংহদৃষ্টি ঠিক তার দিকেই নিবদ্ধ; যেন পাহারার অদৃশ্য কারাগারে আবদ্ধ। হবু বধূর সামনে প্রেমালাপ কি করা যায় এমন দৃঢ় চিত্তের অভিভাবক তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সর্পদংশনের মতো তাড়না দিয়ে থাকে? এই অকূল পরিস্থিতিতে জীবনের ফোনে হঠাৎ মেসেজের টুং শব্দে খানিক মুক্তির প্রশ্বাস এল,
——— "আমি সরে যাচ্ছি! কথা বলে নাও। তবে মনে রেখো, শুধু কথা! আমি আড়ালেই রয়েছি!"
আহা, পরম প্রশান্তি! শা'লার অবশিষ্টায়ন শেষে, জীবন গভীর প্রশ্বাসে বক্ষ ভরে তুলল এবং সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট পরির মায়াময় চেহারায় এক দৃষ্টিতে নিবদ্ধ করল। বুকের অন্তস্থলে অসহনীয় এক বেদনাবোধ প্রবাহিত হলো, এই কোমল প্রাণটিকে কত অবহেলা, কত যন্ত্রণায় ভরিয়ে রেখেছে সে! একটি অমলিন হাসি ছড়িয়ে বলল জীবন,
——— "আমার উপরে এখনও রেগে আছো?"
আছিয়া তার ভিজে চোখে মৃদুভাবে জবাব দিলো,
——— "না! হ্যাঁ! তবে সামান্যই! এইটুকুন!"
আঙুলের কণা দিয়ে তার রাগের পরিমাণ মেপে দেখালো। জীবনের ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটল। বলল,
——— "ক্ষমা করবে আমায়?"
আছিয়া নির্ভরতায় মগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
——— "ক্ষমা করলে কি ভালোবাসবেন?"
জীবনের গভীর দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিশে গেল; আছিয়া চোখে অশ্রুজলে উদ্ভাসিত। জীবন ধীরে আছিয়ার দিকে ঝুঁকে, কণ্ঠে অতল কোমলতায় বলল,
——— "রাণী করে রাখবো তোমায়! ভালোবাসার আবরণে চিরকাল ঘিরে রাখবো! হবে কি তুমি এই গরিবের রাণী?"
আছিয়া হঠাৎই শব্দ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল, তার ভে ভে কান্নার ধ্বনি সমগ্র নীরবতাকে বিদীর্ণ করে তুলল। জীবন বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল; এখানে কান্নার কী কারণ! সে কি আঘাত করেছে? কিংবা কটু বাক্য উচ্চারণ করেছে? হায় আল্লাহ! মুগ্ধ যদি এ দৃশ্য জানতে পারে, তার বোনকে এইভাবে ক্রন্দনে নিমগ্ন দেখে জীবনের কোনো দন্ত আর আস্ত থাকবে না! আর কোন উপায় না দেখে জীবনের হাত দিয়ে আছিয়ার মুখের উপর স্থির হলো, মুখটি চাপা দিয়ে অসহায় স্বরে বলল,
——— "কেন কাঁদছো? আমাকে পরপারে পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা করছো নাকি? আমার কথাগুলো কি ভালো লাগে নি?"
আছিয়া তখনও চোখের জল ছলছল করে, জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল, তার হৃদয় গভীরতর আনন্দে ভরে উঠেছে, তার খুবই ভালো লেগেছে!
আছিয়া জীবনের শক্তপোক্ত বাহুতে নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে আকস্মিকভাবে জাপটে ধরে কাঁপতে কাঁপতে ফুঁপিয়ে উঠল,
——— "কতবার যে কল করেছি, কতবার যে শপিং মলের সেই দোকানে গিয়েছি, আপনার বাড়ির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু আপনি! অবহেলার ঘোরপাকে আমাকে রেখে দিলেন! একবারও ফিরেও তাকালেন না!"
জীবন আর কুণ্ঠিত হল না; কঠোরভাবে আছিয়ার ক্ষুদ্র অথচ অনির্বাণ আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ দেহটিকে বুকের গভীরে টেনে নিল। এই হিমপ্রবাহে যুঝে আছিয়ার কোমল সত্তা কত বিরহ, কত অভিমান গোপনে পুঞ্জীভূত করেছে, সে জানে। আজ আছিয়া যা বলতে চায়, তা বলা তার অধিকার, আর জীবনের শুনা প্রিয় কর্তব্যও বটে।
আছিয়া কান্নায় গলা বুজে আসা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
——— "বিলাসবহুল জীবনের মোহে আবদ্ধ আর আমি নই, জীবন ভাই! আমি এখন জীবনের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবন করেছি! রান্নার পাঠ নিয়েছি, শাকসবজির স্বাদ, নুন ভাতের স্বাদ শিখেছি। সোনালি পোশাকের প্রাচুর্য ত্যাগ করেছি; এখন সাধারণ জামাকাপড়ে আমার সত্তাকে ধারণ করি। জীবন ভাই, আমাকে আর ফেলে যাবেন না! আমাকে দূরে ঠেলে দেবেন না! আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়, অসহনীয় বেদনায় জর্জরিত হয়ে পড়ি! আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি, জীবন ভাই!"
জীবন সমস্ত মমতায় আছিয়ার দুর্দম কষ্টে ক্লান্ত, অথচ নিষ্পাপ দেহটিকে কঠোর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। কতটুকু বেদনা সে তার ক্ষুদ্র পরিটাকে দিয়ে এসেছে, এই অনুশোচনার ভার তার অন্তর্নিহিত হৃদয়কে অবশ করে তুলল। মাথায় গভীর একটি চুম্বন এঁকে দিয়ে কাতর কণ্ঠে বলল,
——— "অসীম দুঃখের সাগরে তোমাকে নিমজ্জিত করেছি, তাই নয় কি? অবজ্ঞার কঠিন শীতলতা দিয়েছি তোমায়, প্রিয়তমা? আমাকে ক্ষমা করো, আমার হৃদয়েশ্বরী! প্রতিজ্ঞা করছি, আর কোনোদিন তোমায় বেদনার প্রান্তে দাঁড়াতে দেবো না। তোমার এই স্বল্পবসনা জীবনে আর কখনো অশ্রুর রুধির গড়িয়ে পড়তে দেবো না।
এই নিরানন্দ জীবনে তোমার স্থান তো ছিলই, প্রিয়তমা। শুধুই ভয়ের গিঁট ছিল বুকে; আজ সে ভয়ের অবসান হয়েছে। যতদিন আমার শিরায় রক্ত প্রবাহিত হবে, আমার দেহে প্রাণের স্পন্দন থাকবে, তোমার প্রতি ব্যথার ছায়াও পড়তে দেবো না। ভালোবাসি তোমায়! সেই ভালোবাসার গভীরতা তোমার কল্পনার অতীত! তোমায় দূরে সরিয়ে দিয়ে বুকের গভীরে যে অসহনীয় যন্ত্রণা ছিল, তার অভিব্যক্তি তোমার অনুমেয় নয়! জানো কি, এক পলকের জন্য তোমায় দেখার তৃষ্ণায় পাগল হয়ে উঠতাম!
বলো, আমার হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী হবে তুমি? এই গরিবের ঘরে রাণী হয়ে এসে স্থাপিত করবে তোমার অভিজ্ঞান? বলো বিয়ে করবে কি আমায়.? "
আছিয়া চোখ মুছে ফুপিয়ে উঠে বলল,
——— "করবো তো! শতবার করবো! আমার বাপ সহ করবো!"
জীবন একটু হাসল, কণ্ঠে মৃদু রসিকতা মিশিয়ে বলল,
———" না, পরি! আমার দরকার শুধুই তোমাকে। তোমার বাবাকে শুধু শ্বশুর হিসেবেই পেলেই হবে!"
জীবন লক্ষ্য করল আছিয়ার দেহে এক ধরনের রহস্যময় কম্পন বইছে। কপালে রেখার ছায়া ফেলল তার ভ্রু, বুক থেকে মাথা তুলে নিল মেয়েটির কোমল অথচ ক্লান্ত দুই গাল ঠান্ডা হাতে আলতো চেপে ধরে। কুয়াশায় আচ্ছন্ন এ শীতল রজনীতেও আছিয়ার কপাল ঘামে ভিজে উঠেছে। এর কারণই বা কি? জীবনের প্রথম স্পর্শে এক অনন্য অনুভবে আক্রান্ত সে; কোনো পুরুষের এত কাছে আসার এ যেন প্রথম অভিজ্ঞতা! আর এই পুরুষই সেই একক পূজিত দেবতা, যাকে সে আপন ধ্যানজ্ঞান মেনেছে। সে আজ তার ঠিক পাশে, স্নেহে তাকে আঁকড়ে ধরেছে, মনের গভীরতম ভালোবাসায় তার হৃদয়কে গ্রহণ করেছে। এ রকম অবস্থায় আছিয়া আর কিইবা করতে পারে? তার নিস্তব্ধতা যেন বিস্ময়ের আর্তি হয়ে ফেটে পড়েছে। অচেতন হয়নি— সেটাই বা কত ভাগ্যের বিষয়!
জীবন, গভীর মায়াভরা গলায় বলল,
——— "ভালোবাসি, পরি।"
এ কথা বলেই তার ঠোঁটের কোমল স্পর্শে আছিয়ার গালে এক অনাবিল চুম্বন এঁকে দিল। কিন্তু আছিয়া আর সহ্য করতে পারল না! এতোদিনের জমে থাকা দুঃখ, বঞ্চনা, যন্ত্রণার বিপরীতে এত অতলান্ত ভালোবাসার তরঙ্গ তার কোমল হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করল। তার শরীরের সমস্ত শক্তি অবসন্ন হয়ে গেল, হাত-পা শিথিল হয়ে জীবনকে আঁকড়ে ধরে যেন তার হৃদয়ে মিলিয়ে গেল। চোখের পাতা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এলো; অতিরিক্ত সুখের ভারে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল, যেন আবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলে জীবনপথে ভাসিয়ে দিল।
জীবন বিস্ময়ে গোল গোল চোখে আছিয়ার অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে রইল! এতটুকুতেই অজ্ঞান হয়ে গেল মেয়েটা? হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল, যদি মুগ্ধ দেখে ফেলে, তবে কী হবে! তার এই বোন অজ্ঞান হয়ে গেছে, মুগ্ধ কি জীবনের গলা ছাড়বে? আহা, জীবন তো কিছুই করেনি! ততক্ষণে আবছা আলোয় চারদিকে কুয়াশার দিগন্তরেখা নেমে এসেছে, সবকিছু ধোঁয়ার আস্তরণে আচ্ছাদিত।
এমন সময়, সেই কুয়াশা ভেদ করে দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিদৃষ্টিতে মুগ্ধ এসে দাঁড়াল জীবনের সম্মুখে। আছিয়ার ক্ষীণ দেহটি জীবন শক্ত করে আগলে রেখেছে যেন মাটিতে না পড়ে। ঠিক এ সময়ই মুগ্ধ হাজির! ইশ, কী লজ্জা! এরকম পরিস্থিতিতে মুগ্ধের সামনে? আল্লাহ মালুম, মুগ্ধ কী ভাবছে! মুগ্ধ একটুও কথা না বলে দৃঢ়তর চোয়ালে জীবনের দিকে ক্রোধময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার শক্ত বাহু থেকে আছিয়াকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে কোলে তুলে নিল।
জীবন সামান্য হাসির ছটা মিশিয়ে বলল,
——— "হে হে স্যার! আমি সত্যিই কিছু করিনি! সে নিজেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে!"
মুগ্ধ দন্ত দৃঢ়তর করে, কণ্ঠে তীব্র হুঁশিয়ারি মিশিয়ে বলল,
——— "হাসপাতালগুলো এখন বেশ উন্নত হয়েছে! ভাবছি তোমাকে একবার সেখানে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো!"
এ কথা বলে মুগ্ধ দ্রুত পদক্ষেপে আছিয়াকে নিয়ে চলে গেল। জীবন চুপচাপ অসহায় দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল, যেন এক নির্জন সৈনিক পরাভূত হয়ে! কী শা'স্তি! শালা নাকি হিটলার! উফফ, শান্তিতে প্রেম করতেও দিল না!
_______
কনকনে শীতের নির্মম স্পর্শে মাটিতে নিষ্প্রাণভাবে নিথর পড়ে প্রিয়ার অচেতন দেহ। হিমশীতল বাতাসের তীক্ষ্ণ ধারায় থরথর কাঁপছে নিষ্ঠুর নিস্তব্ধতা। তার হাত-পা শক্ত রজ্জুতে অবশ, মুখে আঁটসাঁট বন্ধনে জড়িত দুঃসহ নিস্পন্দন। হঠাৎ, এক অস্থির নড়নে সামান্য চেতনার সঞ্চার হলো প্রিয়ার অঙ্গে; সারা দেহ অদম্য সংকোচে মোচড় দিয়ে উঠল। কেবল তখনই, আতঙ্কিত বিস্ময়ে চোখ দুটি হঠাৎ বিদীর্ণ হয়ে খোলে।
অপলক চেয়ে দেখে নিজেকে, এ এক বিভীষিকাময় বন্দিত্ব, এক অশুভ দুর্বিপাকের প্রকোপ! চারপাশে ঘন অন্ধকারের ভয়াল আবরণ, ভয়াবহ শূন্যতার কালো থাবা। প্রিয়া হতবিহ্বল, মরণভীত শিহরণে ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসে অস্ফুট গোঙানির ধ্বনি, আ... উ... উ...
এমন মুহূর্তেই, নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝখান থেকে ভেসে এল এক নারীর গম্ভীর, অনিবার্য, অশ্রুতপূর্ব তেজস্বী কণ্ঠস্বর,
——— "ঘুম ভাঙল?"
শব্দের উৎস সন্ধানে ক্রমশ কুয়াশাচ্ছন্ন দৃষ্টি মেলে প্রিয়া মাথা তুলে তাকাল। চোখের পলক ভারী, ঝাপসা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে অপ্রাকৃত অচেনা বিভ্রম। মাথা ঝিম ধরে ঘোরের আবর্তে ঘুরতে লাগল, এবং ধীরে ধীরে এপাশ-ওপাশ নাড়তে থাকা তার চোখ আরও আতঙ্কে স্থির হয়ে গেল।
হঠাৎই, ধীর অগ্রগতিতে পরিস্কার হলো দৃশ্য, আর সেই মুহূর্তে কলিজা শিউরে উঠল ভয়ে! বারবার পলক ফেলেও নিজের চোখের সাক্ষ্যকে বিশ্বাস করতে পারল না প্রিয়া।
চারদিকে ভিড় করে রয়েছে বিভীষিকাময় সব অবয়ব, অলৌকিক দৈত্যকায় মনুষ্যমূর্তি, রাক্ষসের মতো বিশালকায় দেহের প্রকাণ্ড উপস্থিতি অন্ধকারকেও গ্রাস করতে উদ্যত। প্রতিটি মুখে অশুভ ছায়ার ছাপ, অদ্ভুতভাবে বিকৃত, দুর্বোধ্য। আর তাদের মাঝখানে, এক নারীর অবয়ব, যেন অহংকারের রাজপ্রাসাদে অভিষিক্ত রাজকন্যা।
সে বসে আছে পায়ের ওপর পা তুলে, মুখে নিঃস্পৃহ অনাদরের হাসি, চোখে অন্ধকার ছেদ করা ঝকঝকে সানগ্লাস। পরনের বিলাসবহুল কোটের কলার থেকে ধূলি ঝেড়ে ফেলার সামান্যতম আলকাতরা স্বভাবে, মনে হলো এই হিমশীতল প্রকৃতিও তার দম্ভের চক্রব্যুহে হার মানতে বাধ্য। সেই নারী, চেহারায় প্রাকৃতিক তেজ, অহংকারে দীপ্তিমান; তার কপালের মুকুটে বন্দী রয়েছে সম্রাটের সমস্ত অহমিকা, যা প্রতিটি পলকে চারপাশে বিষম উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে!
প্রিয়া ছটফট করতে লাগল মুক্ত কণ্ঠে চিৎকার করার আকুলতায়, কিন্তু দুর্মর বাঁধনে বন্দী হাত-পা আর মুখ তার প্রতিটি প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করল। নিঃসাড় শরীর অসহনীয় নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন; গলা থেকে নিঃসৃত হওয়ার আগেই প্রতিটি শব্দ শ্বাসের বদ্ধ গুহায় বন্দী হয়ে গেল। সামনের দৃষ্টিনিবদ্ধতায় সে দেখল বিশাল সিংহাসনের মতো রাজকীয় আসনে জাঁকিয়ে বসে থাকা মেয়েটি, যার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে অহংকারের পরাকাষ্ঠা ঝরে পড়ছে।
মেয়েটির চোখের এক সূক্ষ্ম ইশারায় সময় থমকে দাঁড়াল। মুহূর্তেই, একজন দৈত্যাকৃতির অতিকায় পুরুষ, যার প্রতিটি পদক্ষেপ মাটি কাঁপিয়ে ওঠে, প্রিয়ার কাছে এগিয়ে এসে মুখের বন্ধন খুলে দিল। মুক্ত হওয়া মাত্রই প্রিয়া হাঁপাতে লাগল, দ্রুত শ্বাসে বুক উঠানামা করতে লাগল, দম বন্ধের পীড়নে প্রাণপণ চেষ্টা করছে জীবনের হাওয়া টেনে নিতে।
তারপর, এক অভাবিত বিস্ময় চিত্তকে আঘাত করল। চোখ বিস্ফারিত হলো, অবাকের পাহাড় মাথায় চাপিয়ে বলল,
——— "তুই?"
সামনে বসে থাকা মেয়েটি ঠোঁটের কোণে এক বিদ্রুপমিশ্রিত হাসি ছড়িয়ে দিল, অবজ্ঞার শীতল শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। দানবীয় অবয়বের সেই দুর্দান্ত দেহরক্ষী হঠাৎ প্রিয়ার ঘাড় শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল এবং নির্মমভাবে টেনে নিয়ে গিয়ে মেয়েটির পায়ের কাছে নতজানু করে ফেলল। মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া প্রিয়ার দেহ মাটির সঙ্গে ধাক্কা খেল, ব্যথার যন্ত্রণায় তার মর্মযাতনা অনর্গল ফেটে বেরোল।
মেয়েটি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে নাক সিটকালো, অবজ্ঞাসূচক স্বরে বলল,
——— "এই... ওকে দূরে রাখ! ওর দেহ থেকে দুর্গ'ন্ধ আসছে, একদম সহ্য হয় না!"
আদেশ পেয়েই দানবাকৃতি পুরুষটি প্রিয়াকে আবারও নিষ্ঠুরতার সাথে টেনে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। ব্যথার দহন ছড়িয়ে গেল প্রিয়ার শরীরের প্রতিটি অঙ্গে; সে কাতরাতে লাগল, তীব্র বেদনায় ও ক্রোধে মুখ তুলে ক্ষিপ্র উচ্চারণে বলে উঠল,
——— "তুই? তুই এমনটা করেছিস? এটা... এটা তুই? এই তুই আমাকে এখানে এনেছিস কেন?"
মেয়েটির মুখে এক ছলনাময়, নির্দয় প্রশান্তি; শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
——— "তোর সাহস হয়েছে আমাকে প্রশ্ন করার? এই সাহস আমি তোকে দিইনি!"
এই কথা বলে সে পাশের ডান পাশের যুবকটির হাত থেকে একটি চকচকে ছু'রি তুলে নিয়ে নিপুণ দক্ষতায় ছুড়ে মারল। ছু'রিটি মৃ'ত্যুর তীক্ষ্ণ হুমকি হয়ে প্রিয়ার কানের পাশ দিয়ে শোঁ-শোঁ করে চলে গেল, শীতল আতঙ্কে কেঁপে উঠল প্রিয়া। মেয়েটি আবারও হেসে উঠল, শান্ত অথচ বিপজ্জনক কণ্ঠে বলল,
——— "ইচ্ছে করেই ভুল করেছি। আবার যদি এমন দুঃসাহস দেখাস, ছু'রিটা তখন সরাসরি তোর জিভে চালানো হবে!"
প্রিয়া আতঙ্কে কেঁপে উঠল; কণ্ঠ ভয় এবং নিরুপায়তার কম্পনে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। কাপা কাপা স্বরে বলল,
——— "আ-আমাকে কেন এভাবে ধরে এনেছিস?"
মেয়েটি শীতল অথচ অতল গভীরতায় নিমজ্জিত কণ্ঠে আদেশ করল,
——— "ওর পিছু ছেড়ে দে।"
প্রিয়ার দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হলো বিস্ময়ের মেঘ, কৌতূহলী জিজ্ঞাসায় উচ্চারণ করল,
——— "কার?"
মেয়েটির চোখে বি'ষাক্ত দৃষ্টি ফুটে উঠল, আর নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর এল,
——— "যার জন্য তুই এই অধঃপতিত, নোং'রা কাজ করেছিস তার!"
প্রিয়ার বুকের মধ্যে র'ক্ত জ্বলে উঠল। ক্ষোভে ফুঁসে উঠে বলল,
——— "আমি রুদ্রের পিছু কোনোদিন ছাড়ব না! তাকে আমি সেই শৈশব থেকে ভালোবাসি!"
মেয়েটি তাচ্ছিল্যে নাক সিটকালো, মুখের প্রতিটি শব্দ বিষের চেয়েও তীব্র,
——— "ছিঃ! কেউ এর মুখে কে'রোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দাও! ব'মি আসছে আমার! তার মুখের দু'র্গন্ধ এখান পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে!"
মেয়েটির আদেশে দু’জন দানবীয় লোক ছুটে গিয়ে কে'রোসিন আনার জন্য প্রস্তুত হলো। এই দৃশ্য দেখে প্রিয়া ভয়ে আতকে উঠল, হাউমাউ করে কেঁদে উঠল,
——— "তুই কি আমাকে মা'রার জন্য এখানে এনেছিস?"
মেয়েটি হাসল, সেই হাসি শীতল, নিঃসঙ্গ পাহাড়ি হাওয়ার মতো নির্মম। শান্ত অথচ কর্কশ কণ্ঠে বলল,
——— "তোর প্রাণনাশের ইচ্ছা থাকলে কি তোর মতো নগণ্যকে বসিয়ে রেখে তোর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতাম? তোকে সাবধান করতে এনেছি! রুদ্রের কাছে আর যাবি না। তোর মতো নোং'রা আত্মা ওর স্পর্শ পাওয়ার যোগ্য নয়!"
প্রিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে বলল,
——— "আমি ওকে ভালোবাসি!"
সামনে বসে থাকা মেয়েটি উপহাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
——— "ভালোবাসার মতো পবিত্র শব্দ তোর মতো অপবিত্র, কলুষিত মুখে উচ্চারিত হতে লজ্জিত হয়।"
প্রিয়া বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে গেল। তার কণ্ঠ কাঁপতে কাঁপতে প্রশ্ন করল,
——— " ক-কিন্তু ত-তুই ক-কীভাবে জানলি?"
মেয়েটির ঠোঁটে ছলনাময় এক হাসির রেখা ফুটে উঠল। চোখের কোণ থেকে নীচে অবজ্ঞার ছায়া নেমে এল, আর এক মর্মান্তিক সত্য উচ্চারণ করল,
——— "তুই সবাইকে বোকা বানাতে পারলেও আমাকে পারবি না! তোর গলায় সেই জন্মদাগ দেখেই প্রথম সন্দেহ হয়েছিল। আর তারপর তোর পিছু লোক লাগিয়ে দেয়ার পর আমি জানলাম তোর প্রকৃত, নিকৃষ্ট রূপ। প্লাস্টিক সার্জারি দিয়ে মুখ যতই বদলাস, চরিত্র? চরিত্র মরা কাদার মতো, তা কখনও বদলায় না!"
প্রিয়া মুহূর্তে থমকে গেল, এক শীতল বজ্র তার স্নায়ুতে আঘাত হানল। মেয়েটির বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বলিষ্ঠ, পাথর-কঠিন মুখের লোকটি বিরক্তি নিয়ে গর্জে উঠল,
——— "শুধু কথার মারপ্যাঁচে কী হবে? শেষ করে দে!"
ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন কুৎসিত হাসি ফোটাল ঠোঁটের কোণে। কুৎসিত বিদ্রূপে বলল,
——— "না না, যতই হোক না কেন, সে তো রুদ্রর আদরের বন্ধু! মা'রলে রুদ্র যে ব্যথা পাবে!"
এ কথা বলেই সবার কণ্ঠে অট্টহাসির বজ্রধ্বনি প্রতিধ্বনিত হল, গভীর অন্ধকারকে আরও ভয়াল করে তুলল। প্রিয়ার চোখে জল ছলছল করল; বেদনায়, অপমানে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চিৎকার করে বলল,
——— "তুই আমাকে ভয় দেখাস? আমিও তোর আসল চেহারা রুদ্রকে বলে দেব!"
প্রিয়ার এই ঘোষণা যেন হাসির আগুনে আরো তেল ঢেলে দিল। খেকখেক করে তীক্ষ্ণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সকলে, নিষ্ঠুরতার পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠেছে। মেয়েটি মৃদু অথচ শীতল হাসি হেসে বলল,
——— "আমার পরিচয় জানতে হলে আগে নিজের পরিচয় দিতে হবে, বুঝলি? তুই যদি নিজেকে প্রকাশ করতে পারিস, তবে আমার পরিচয়ও দিবি!"
সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, যেন অশুভ ছায়া জেগে উঠল। দু'পাশে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে গেল তার সঙ্গী দুটি। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল; বাম পাশের ছেলেটি তৎক্ষণাৎ এক তীক্ষ্ণ কাঁচি তার হাতে তুলে দিল। মেয়েটি হেসে হেসে এগিয়ে এলো, তার সঙ্গে দুই পাশের ছেলেগুলো মৃ'ত্যুর দূত হয়ে তার পাশে দাঁড়াল।
তাদের ক্রমাগত এগিয়ে আসা দেখে প্রিয়া আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল, শরীর শিউরে উঠল। সে ছটফট করতে লাগল, মরিয়া হয়ে মুক্তির জন্য লড়াই করতে লাগল, কিন্তু সেই শীতল ভয় তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে তোলার জন্য প্রস্তুত।
যতই ধীরপদে এগিয়ে আসছে, মেয়েটির মুখের কোমলতা স্রেফ শুষে গিয়ে দণ্ডায়মান পাথরের ন্যায় কঠোর হয়ে উঠছে। তার দু'পাশে অবিচল পাহাড়প্রতিম দুই পুরুষের মুখেও ভয়ানক বিকৃতি, ক্রোধ ও হিংস্রতার আঁধারে তারা নিমজ্জিত। চারপাশের উন্মত্ত জনতা মত্ত হাসির বিষাক্ত বায়ুতে গুমরে উঠছে। প্রিয়া সন্ত্রাসে আর্তনাদ করে উঠল; তার চাহনিতে মৃ'ত্যু ভয়ের ছায়া।
মেয়েটি ধীরপদে এসে প্রিয়ার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল, চোয়ালের শিরায় লুকায়িত নিষ্ঠুর সংযম। পাশে দাঁড়ানো দু’জন, দু'দিক থেকে নাক চেপে দাঁড়িয়ে প্রিয়ার দুর্দশা দেখায় আসক্তি প্রকাশ করল। মেয়েটি রক্তিম আভায় ঝলসানো কাঁচির তীক্ষ্ণ ফলায় কুচকুচ আওয়াজ তুলল, আর বিষাক্ত বাক্যে প্রিয়ার দিকে তীব্র দৃষ্টিপাতে বলল,
——— “সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টিতে কলঙ্ক আরোপ করেছিস তুই! সৃষ্টির ঐশ্বর্যকে হেয় করেছিস, লজ্জায় ফেলেছিস!”
প্রিয়া ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠল,
——— "আ-আমি সব করেছি রুদ্রর জন্য! ও-ওর ভালোবাসা অর্জন ক-করতে চেয়েছি আমি!"
মেয়েটি মুখ বিকৃত করে, গভীর এক ক্রোধে অগ্নিবর্ষণ করে উঠল,
——— "এই কেরোসিনের বোতল এখনও এলো না কেন?"
কিছুক্ষণের মধ্যেই কেরোসিনের বোতল হাতে নিয়ে কয়েকজন এসে উপস্থিত হলো। প্রিয়া আতঙ্কিত হয়ে কিন্তু নিজেকে দৃঢ় রাখতে চেষ্টা করে ফিসফিসিয়ে বলল,
——— "তুই কি ভাবিস, এইসব করে আমাকে ভয় পাইয়ে দিবি? তুই কি ভাবিস রুদ্র তোকে ভালোবাসে? ওকে আমায় ভালোবাসতেই হবে!"
মেয়েটি ঠোঁটের কোণে এক তিক্ত হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,
——— "হ্যাঁ, সে আমাকে ভালোবাসে! তাকে বলে পবিত্র ভালোবাসা, যা কোনো নোংরামির ছায়ায় কলঙ্কিত নয়! সে তো তোকেও ভালোবেসেছে বন্ধুর মতো। তুই কীভাবে সেই বিশ্বাসকে কলঙ্কিত করতে পারলি? কীভাবে বন্ধুত্বের পবিত্রতায় কলুষ ঢালতে পারলি?"
এ কথা বলে সে কেরোসিনের বোতল হাতে তুলে নেয়। তার পাশে দাঁড়ানো দুজন প্রিয়ার মুখ চেপে ধরে তাকে বাধ্য করে মুখ খুলতে। মেয়েটি কাঁচি নিচে রেখে ধীর অথচ কঠিন পদক্ষেপে উঠে দাঁড়ায়। ঠাণ্ডা অথচ নির্মম ক্রোধে কেরোসিন ঢেলে দেয় প্রিয়ার মুখে। প্রিয়ার নাক, মুখ ভিজে ওঠে, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। আতঙ্কে আর যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে প্রিয়া, তার মুখে জীবনের শেষ আর্তনাদ ফুটে ওঠে।
পুরো কেরোসিনের বোতল প্রিয়ার মুখে ঢেলে দিল সে; অশুভ তরলের বিষাক্ত স্রোতে প্রিয়ার সমস্ত দেহ জড়িয়ে উঠল এক ভয়ানক আবরণে। মূহুর্তেই ছেলেগুলো তাকে ছেড়ে দূরে সরে গেল, ডানপাশের জন থু থু ফেলে নাক সিটকে বলল,
——— “ছিঃ! অগণন জীবন নিঃশেষ করেছি, তবু এতো তীব্র ঘৃ'ণা কখনও অনুভব করিনি! একে স্পর্শ করতেই যেন সমস্ত রন্ধ্রে অশুচি প্রবেশ করছে।”
এ কথা বলে সে মুখ চেপে ধরে, যেন ভেতরে অজস্র ক্লেদ উঠে আসছে। প্রিয়া কেরোসিনের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে, বিষাক্ত ঝাঁজে বিপর্যস্ত হয়ে ছটফট করতে লাগল, প্রতিটি শ্বাসে বি'ষের আঁচ।
মেয়েটি সেই দৃশ্য দেখে অশুভ হাসি হাসল, এবং কাঁচি তুলে সে তা কুচকুচ শব্দ তুলে প্রিয়ার গালের কাছে এনে রাখল। নির্দয় ঠোঁটের কোণে এক ব্যঙ্গের হাসি খেলল, বাম পাশে দাঁড়ানো পুরুষটি ঠাণ্ডা অথচ গভীর কঠোরতায় বলল,
——— "ওর গলায় চেপে ধর।"
মেয়েটি ব্যঙ্গমিশ্রিত নরম স্বরে বলে উঠল,
——— “আরে না! যতই হোক, আমার হৃদয়ের গভীরে এর জন্য অল্প হলেও এক নরম কোণ রয়ে গেছে! ব্যথা পাব আমি, তাই আদর করে, পরম যত্নে দিচ্ছি এটি! তাই না?”
এই বলে সে কাঁচি নিয়ে প্রিয়ার গালের ওপর ভয়ংকর এক আঁ'চড় কাটল, সমস্ত শক্তি দিয়ে তা গভীরতর করল। দন্ত-নখর চেপে ধরল, এমন শক্তিতে যে প্রিয়ার সত্ত্বাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। প্রিয়া অসহায় আর্তনাদে “আল্লাহ!” বলে চিৎকার করে ওঠে, গলা কাটা পাখির মতো শেষ আর্তনাদ তার কণ্ঠ ছাপিয়ে প্রকৃতিকে কাঁপিয়ে তুলল।
প্রিয়ার বিক্ষুব্ধ দেহ তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল, দুই হাতে-পায়ে বাঁধা থাকলেও প্রচণ্ড প্রতিরোধের আগুন দপ করে জ্বলে উঠল। তবু তেজস্বিনী সে, প্রতিটি চেষ্টায় শরীরকে ছুটিয়ে কাঁপিয়ে তুলল। যখন তার ধবধবে শুভ্র গাল থেকে মাং'সের টু'করো ছিঁ'ড়ে আলগা হয়ে পড়ল, মেয়েটির মুখে এক নির্মম তৃপ্তির আভা ফুটে উঠল, প্রতিটি র'ক্তকণা তার কাছে বিজয়ের স্বাদ এনে দিল।
র'ক্তে ভেজা কাঁচিটি টপাটপ শব্দে ফেলে দিয়ে মেয়েটি নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার পাশে পাহাড়সম বলিষ্ঠ দেহধারী দীর্ঘকায় পুরুষটি প্রসন্ন মুখে প্রশংসা জানিয়ে বলল,
——— “সাব্বাস! এবার শিক্ষা হয়েছে!”
কিন্তু তার বাম পাশে দাঁড়ানো অন্যজন বিরক্তিভরে তির্যক হাসি হেসে বলল,
——— “ধুর! মাথা করেছে! গলার ন'লটাই না কে'টে বাইরে আনলে কীসের শিক্ষা!”
মেয়েটি এক নির্মম হাসিতে তার কথার উত্তরে সাড়া দিল। ইতিমধ্যে কয়েকজন দানবপ্রতিম পুরুষ প্রিয়ার মুখ শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে, যেন তার শেষ আর্তনাদও নিঃশব্দে গুমরে ম'রে। অন্ধকারে সে কেবল ছটফট করছে, দেহের প্রতিটি কণিকা ভয়ে কাঁপছে, মৃ'ত্যুভয় তার প্রতিটি শ্বাসের মাঝে লুকিয়ে।
মেয়েটি আবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, ঠান্ডার মধ্যে প্রিয়ার কা'টা গাল থেকে ঝরতে থাকা র'ক্তের দৃশ্যে তৃপ্তি নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে প্রিয়ার মাথার চুল শক্ত করে চেপে ধরে, ঠোঁট কানের কাছে এনে বিষাক্ত হিসহিস আওয়াজে বলে উঠল,
——— “সর্বপ্রথম কী বলে আর্তনাদ করেছিস? ‘আল্লাহ’ বলে? অথচ আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টির ব্যঙ্গ করতে, কলুষিত করতে তোর বুক কাঁপল না? বল দেখি, এই পা'পের ভয় কি তোর অন্তরে একটুও জাগেনি?”
মুহূর্তেই প্রিয়াকে ছিটকে ফেলে দিল সেই নিষ্ঠুর শক্তি, যেন নিঃস্পৃহ অঙ্গুলি দিয়ে এক অপ্রয়োজনীয় খেলনার মতো তাকে দূরে সরিয়ে দিল। মেয়েটি দাঁড়িয়ে, সম্মুখের লোকগুলোর দিকে এক রকম অধিকারী ভঙ্গিতে নির্দেশ করল,
——— "এই, একে হাসপাতালের সম্মুখে ফেলে দিয়ে আয়।"
বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালকায় যুবক বিরক্ত ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকাল, এই আদেশ তার সহ্যসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে,
——— "এভাবে ছেড়ে দেওয়া সঙ্গত কি হবে?"
মেয়েটি মৃদু হাসল, ঠোঁটের কোণে বিষের ফুল ফুটল। শান্ত অথচ অটল কণ্ঠে বলল,
——— "সুযোগ মাত্র দিচ্ছি, ছেড়ে দিচ্ছি না। যা, ফেলে দিয়ে আয়!"
সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়াকে বেঁধে টেনে নিয়ে যেতে লাগল তারা। ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বলিষ্ঠ পুরুষটি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করল,
——— "আর হ্যাঁ! ওর ওপর নজর রাখবি। এরপর যদি সাহস দেখাতে চায়, শেষ করে দিবি! কিন্তু মরা দেহ যেন পড়ে না থাকে, ফিরিয়ে আনবি। রক্ত বের করে জুস বানাবো!"
আদেশের পর এক সম্মিলিত সম্মতি জানিয়ে সেই নিষ্ঠুর বাহিনী প্রিয়াকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল। তিনজন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল, তারা ক্ষমতার অলক্ষ্যে অদৃশ্য সুতোর পুতুল। আশেপাশে আরও দাঁড়িয়ে রইল দানবিক চেহারার গার্ড, সবার হাসি ফেটে পড়ল অশুভ সুরে। মেয়েটি ঠোঁটের কোণে এক শীতল হাসি ছড়িয়ে বলল,
——— "এসেছে ভালোবাসা পেতে! কুৎসিত মানুষ!"
________________
রুদ্র মুগ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাকুলভাবে ছটফট করছে; ঠোঁটের কিনারে কিছু কথা উন্মোচনের জন্য উতলা হয়ে আছে, অথচ কোনো এক অদৃশ্য বাঁধনে বন্দী হয়ে অসহায় রূপে স্থবির। মুগ্ধ, নিরাবরণ গম্ভীরতায় নিমগ্ন, এসিপি মুযহাবের পাশে দৃঢ় কণ্ঠে বলছে,
——— "আমরা ইকরাম আলীর সমস্ত বাণিজ্যিক ক্লায়েন্ট, অনুচর, এবং সহকারীদের সাক্ষাৎকার সম্পন্ন করেছি, স্যার। স্পষ্টতই ভেতরে কিছু অন্ধকার রহস্য ঢেকে রাখছে! যা যা প্রকাশিত হয়েছে, ওদের পাপের সাম্রাজ্যে এর চাইতেও অতলস্পর্শী কিছু বিরাজ করছে, আমার দৃঢ় ধারণা।"
এসিপি মুযহাব কপালে দুই আঙুল বুলিয়ে, চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে চোখ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
——— "তাহলে খু'নি কাকে বলে সন্দেহ করছো?"
মুগ্ধ নিচুস্বরে কিছু উচ্চারণ করল, যা বদ্ধ ঘরেও স্পষ্ট শোনা গেল না। মুযহাব চোখের ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
——— "তাহলে তুমি সত্যিই এমনটাই মনে করো?"
——— "হ্যাঁ, স্যার। প্রতিটি সূত্র সেই দিকেই নির্দেশ করছে।"
মুযহাবের ঠোঁটের কোণে এক ছায়াময় হাসি উদয় হলো; গভীর নিস্তব্ধতার পর বললেন:
——— "তাহলে সুযোগ বুঝে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খপ করে ধরো! এবং সেই ব্যাবসার প্রতিটি পদক্ষেপ গভীর নজরে রেখো। কী এমন লুকোচ্ছে, আবিষ্কার করো!"
তবে এসিপি মুযহাবের সূক্ষ্ম নজর এড়ালো না মহুয়ার অনুপস্থিতি। কপালের ভাঁজ গভীর হয়ে উঠল; তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন,
——— “এই পটপটানি মেয়ে কোথায় গেল?”
রুদ্র দ্রুত জবাব দিলো, সপ্রতিভ ভঙ্গিতে,
——— “ওর চাচা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, স্যার। হাসপাতালে গিয়েছে। তাই আসতে খানিক দেরি হচ্ছে।”
মুযহাবের চোখে কটাক্ষের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল; মুগ্ধও একরকম সন্দিগ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল রুদ্রর দিকে। রুদ্র পলকের চঞ্চলতায় এদিক-ওদিক তাকিয়ে ম্লান হাসি হেসে সংযত কণ্ঠে বলল,
——— “কল করে জানালো অল্প কিছুক্ষণ আগেই, স্যার।”
মুযহাবের চোয়াল শক্ত হলো ক্রোধে। গর্জে উঠলেন,
——— “এটা কি তার মামার বাড়ি? যখন খুশি আসবে-যাবে? এই জায়গায় জয়েন করার পূর্বে প্রত্যেককে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়, একজন সিআইডি অফিসারের কোনো পরিবার থাকতে নেই। আর সে কি না হাসপাতালে গিয়েছে অসুস্থ চাচাকে দেখতে? যখন এত্তো বড়ো একটি জটিল কেসের ভার আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে!”
রুদ্রর অন্তর যেন বিদ্রোহ করে উঠল; প্রেমিকার নামে এমন কঠোর উক্তি শোনে হৃদয় আনচান করে উঠল। বিরক্তিতে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। মনে মনে চাপা ক্ষোভে বলল,
——— “এই মেয়েটা না একেবারে ব্যতিক্রম! জানে যে এসিপি স্যার তাকে বিশেষ একটা পছন্দ করেন না। অথচ, কোথায় কাজ করে মন জিতবে! তা নয়, এমন কাণ্ড ঘটিয়ে স্যারের রাগে রক্তজ্বালা ধরিয়ে দেয়!”
মুহূর্তেই মহুয়া, হাপাতে হাপাতে ছুটে এসে কপালে হাত ঠুকল। তড়িৎ সেলাম জানিয়ে ঘোষণা করল,
——— “আমি এসে গিয়েছি, স্যার!”
এসিপি মুযহাব ভ্রুকুটি করে, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
——— “তাহলে কি আমরাও নাচতে শুরু করব?”
মহুয়ার মুখচাপা হয়ে গেল। মুযহাবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবার রুদ্র ও মুগ্ধর দিকে ঘুরল। কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন:
——— “তোমরা এই কাজে চোরা মেয়েটাকে কেমন করে সামলাও?”
অপমানের গরম লহরায় মহুয়ার মুখ আরও নিচু হয়ে এল। মুযহাব এরপর মুগ্ধকে শীতল নির্দেশ দিলেন,
——— “মুগ্ধ, আমি বলে দিচ্ছি, আমি যদি দ্বিতীয়বার এমন দায়িত্বে ফাঁকি দেখি, তবে এই মেয়েকে কাজ থেকে ছেঁটে ফেলব!”
চোখে রাগের আগুন ঝরিয়ে মুযহাব সরে গেলেন। মহুয়া অপমানিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষোভের অগ্নি জ্বলতে লাগল। মুযহাব স্যারের বিদায় হতেই মনে মনে শত গালি দিয়ে জিভ বের করল। পরে এক ঝলক রুদ্রর দিকে তাকিয়ে, আরেকবার মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে, এক চপল হাসিতে বলল,
——— “সরি স্যার! একটু দেরি হয়ে গিয়েছে।”
মুগ্ধ গম্ভীর কণ্ঠে সতর্ক করে বলল,
——— “পরিবারের অজুহাত যদি দ্বিতীয়বার দাও, তবে পরিবারের কাছেই থেকো। এখানে আর আসার প্রয়োজন নেই!”
মহুয়ার চোখে অসহায়তা ফুটে উঠল, আর সে অস্থির দৃষ্টিতে রুদ্রের দিকে তাকাল। রুদ্র গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনোবেদনার ভার লাঘব করল। মহুয়া নিজেও বিভ্রান্ত, মাঝে মাঝে সত্যিই ভাবে, মুযহাব সাহেব আর মুগ্ধ স্যার কি তবে বাপ-ছেলে? ধমকের ধাক্কায় প্রাণ যেন দম ফেলার ফুরসত পায় না!
মহুয়া হতাশায় মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইল, আর পাশে দাঁড়ানো রুদ্র বারবার কিছু ইশারা করতে লাগল। মহুয়া তার সেই সংকেতের কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। রুদ্র বিরক্তির চরমে পৌঁছে কপাল চাপড়ে মাথা ঠুকল, মুগ্ধ স্যারের দিকে ইঙ্গিত করল।
মুগ্ধ তখন কম্পিউটারের স্ক্রিনে গভীর মনোযোগ দিয়ে তদন্তের তথ্য পর্যালোচনা করছে। মহুয়া হাত দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল। রুদ্র আবারও মাথা চাপড়ে যেন বলল,
———"এত সহজ ইশারাও বুঝতে পারিস না!"
একটু পর হঠাৎই মহুয়ার মাথায় বিষয়টা আসতেই সশব্দে হেসে উঠল, সেই হাসি ঘর কাঁপিয়ে তুলল। মুগ্ধ তৎক্ষণাৎ ভ্রু কুঁচকে মহুয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মহুয়া অপ্রস্তুত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। রুদ্র এক পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্তিতে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, যেন মনে মনে ভাবছে,
——— "এই মেয়েটার মাথায় কখন কী ঢোকে!"
মুগ্ধ কটমট করে তাকিয়ে বলল,
——— "এখানে কী চলছে? এটা কি কোনো হাস্যরসের মঞ্চ ভাবছো?"
মহুয়া চটজলদি জবাব দিল,
——— "না না, স্যার! ভুল হয়ে গেছে!"
এরপর রুদ্রকে চোখ টিপ দিয়ে সাহস যোগাতে চুপিচুপি এগিয়ে গেল মুগ্ধর দিকে। চোখে দুষ্টুমি ফুটিয়ে ইশারায় বোঝাল,
——— "আমি সামলে নেব, চিন্তা করো না!"
রুদ্র এবার হালকা এক স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। ভাবল,
———"অবশেষে সিআইডি-র এই গাধি অফিসার সবকিছু বুঝতে পেরেছে!"
তখন রুদ্রর ফোনটা বেজে উঠতেই বিরক্তিতে চোখ সরু করে তাকাল। চাচির ফোন, এ নিয়ে বিংশতম বার, আর কথাও একটাই! ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে রুদ্র সরে গিয়ে ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো ঊর্মিলা বেগমের কান্নাভেজা কণ্ঠ, ভেঙে পড়া ভীত কণ্ঠস্বরে বলল,
———“বাবা, প্রিয়া এখনো আসল না! দু’ঘণ্টা হয়ে গেল! মেয়েটা এতক্ষণ বাইরে থাকে না, কোথাও গেলে সবসময় বলে যায়! সেই দোকানে পাঠিয়েছিলাম চা পাতা আনতে, গেল আর আসল না! তোর সিআইডিদের পাঠিয়ে ওকে খুঁজে আন! কিছু একটা হয়ে গেল নাকি, বাবা?”
রুদ্র এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, বুঝল, চাচির উদ্বেগ কতটা প্রকট। এখন চাচি'কে কে বুঝাবে সিআইডিদের এমন ছোটখাটো কাজে লাগানোর সুযোগ নেই! ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ধীর গলায় বলল,
———“চাচি, চিন্তা কোরো না। কিছু হবে না, এসে পড়বে। তুমি আর কেঁদো না, আমি বাড়ি আসি আগে। তারপর সব দেখি, ঠিক আছে?”
ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতেই রুদ্রর মুখে বিরক্তির ছাপ আরও স্পষ্ট হলো। এই মেয়েটা আবার কোথায় অদৃশ্য হলো? অদৃশ্যতার রহস্যময় প্রলোভন নিয়ে খেলছে তার সঙ্গে! অথচ ঊর্মিলা বেগম এমনভাবে প্রিয়াকে চোখে হারায় যেন ঐ মেয়ে তার পৃথিবীর একমাত্র প্রাচুর্য!
রুদ্র কঠিন চোয়ালে স্থির হয়ে ইনফর্মারের নাম্বারে দ্রুত কল সংযোগ দিল। যে দুই সিআইডি অফিসারকে আগেই তার বাড়িতে রেখেছিল, প্রিয়ার কর্মকাণ্ডের উপর নজর রাখতে, তারা জানিয়েছে সন্দেহজনক কিছু দেখেনি। কিন্তু রুদ্র জানে, এই মেয়ের মধ্যে নিশ্চয়ই গভীর রহস্য ছায়া ফেলে আছে! প্রিয়া তার জীবনের অনেক গোপন কাহিনী জানে; এ কারণেই রুদ্র অফিসারদের ধন্যবাদ জানিয়েও ইনফর্মার পেছনে রেখে গেছে, যেন প্রয়োজনমতো খবর পাওয়া যায়।
ফোন রিসিভ হতেই রুদ্র তার গলার কঠোর রাগ সংযত করে বলল,
——— "প্রিয়া কোথায়?"
ওপাশ থেকে নতকণ্ঠে উত্তর এলো,
——— "স্যার, মেয়েটা কেমন যেন দৃষ্টির পলকে উধাও হয়ে গেলো । আমি তো দেখলাম, দোকানেই ছিল। পরে মাথার ভারী যন্ত্রণা সামলাতে একটু মলম কিনছিলাম। ফিরে দেখি মেয়েটা নেই!"
রুদ্রর মুঠি শক্ত হলো, চোয়াল নিঃশব্দে দৃঢ় হলো। দাঁত চেপে বিষণ্ণতার সঙ্গে বলল,
——— "ওকে খুঁজে আমাকে অবিলম্বে সংবাদ দাও! আর তোমার মলম লাগানোর শখ আমি বের করছি!"
কথাটি বলেই রুদ্র তীক্ষ্ণভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল, ক্রোধের তীব্রতা তার ফোনকেও ভস্মে পরিণত করতে উদ্যত!
__
মহুয়ার শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত ঝঞ্ঝার মতো উথালপাতাল উঠানামা করছে, ঠোঁটের কোণে সেই বোকাসুলভ হাসি। মুগ্ধ বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার মনের অস্থিরতার অগ্নিকুণ্ড লক্ষ করছিল, যদিও মুখে কিছু উচ্চারণ করেনি। রুদ্ররও এই তৎপরতা লক্ষ্য করেছে; তবু সে এই পর্যন্ত নীরবতায়ই পার করেছে সময়। এখন আবার মহুয়ার বোকা হাসি দেখে বিরক্তির ভাঁজ চেপে বলল,
——— “মনে যা ঘুরপাক খাচ্ছে, সে কথা স্পষ্ট করে বলো!”
রুদ্র তখন এসে উপস্থিত। মহুয়া একবার রুদ্রের দিকে তাকিয়ে একটি হাসি উপহার দিল। তারপর মুগ্ধর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,
——— “স্যার, একটিই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়...”
মুগ্ধ ধৈর্যের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কঠোর গলায় জিজ্ঞাসা করল,
——— “বলবে, না কি আমার ধৈর্য পরীক্ষা করছো?”
মহুয়া হাসতে হাসতে বলল,
——— “আসলে...”
হঠাৎই তার ফোনের রিংটোন বাজল, যেন এক অপ্রত্যাশিত ব্যাঘাত। মহুয়া তাড়াতাড়ি বলল,
——— “এক মিনিট স্যার, এক মিনিট! এক্ষুণি ফিরে আসছি।”
এ কথা বলেই সে দ্রুত পলায়ন করল, যেন জরুরি সংকেত পাওয়া সৈনিকের মতো। রুদ্র বিরক্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ মেয়ের কাছ থেকে আদৌ কিছু হবে কি না, তা নিয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান। মুগ্ধ বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় কাজে মন দিল।
--
মহুয়া নির্জন এক কোণে গিয়ে ফোনটি ধরতেই তার মুখাবয়ব কঠোর হলো। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, চোখে ক্রোধের অগ্নিশিখা ঝলসে উঠল। নিচু হয়ে, স্বরকে হিমশীতল রেখে সে ফিসফিস করে বলল,
——— “কতবার বলেছি, এখানে থাকলে আমাকে ফোন দেবে না! তা সত্ত্বেও বারবার ফোন করার সাহস হচ্ছে কেন?”
ওপাশ থেকে বিদ্রূপাত্মক হাসির মৃদু ধ্বনি শোনা গেল। তারপর অপরিচিত সেই কণ্ঠ কিছু বলে উঠল। মহুয়া ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,
——— “সন্দেহের ছায়া সঠিক পথে পা বাড়ায়নি, নিশ্চিন্ত থাকো। সমস্ত প্রমাণ মুছে দিয়েছি আমি। আর শোন, এবার ফোন রাখছি। দ্বিতীয়বার ফোন দেবে না, আমি নিজেই জানাব! মাইন্ড ইট!”
0 Comments