লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত
চিঠিটা পড়েই চারু লতা বরফের মতো জমে যায়। আমার আশেপাশে আশা সবার ক্ষতি করবে মানে, কাব্য ভাইয়ার কোনো ক্ষতি করে বসবে না তো ...!
একই নিয়মে সবকিছু চলতে শুরু করে। দুজনেই নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে। একে অপরের সাথে কথা হয় না কারো । ভিতরে ভিতরে দুজনেই পুড়ে মরছে।
একে অপরের কথা না হলেও চারু সব সময় কাব্যের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করেছে। কাব্যের না চাইতেও সে সব সময় পাশে থাকার চেষ্টা করেছে । কাব্যের কোনো ক্ষতি করে বসবে না তো অচেনা ব্যাক্তি, এই ভয়েই সে কাব্যের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে ঘুর ঘুর করেছে ।
কিন্তু আশ্চর্যজনক কাব্যের উপর কোনো বিন্দু পরিমাণ আঁচ আসেনি। চারুর মাঝে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তার বার বার মনে হচ্ছে অচেনা ব্যাক্তি কাব্য ভাইয়া নয় তো। কিন্তু কাব্য ভাইয়াই বা হতে যাবে কেন।
সে তাকে ভালোবাসলে সামনাসামনি সব বলে দিতে পারবে তাহলে সে তার পরিচয় গোপন করছে কেন।কাব্যকে অতিরিক্ত ভালোবাসার ফলে তার অচেনা ব্যাক্তি কে হয়তো কাব্য মনে হচ্ছে। সব তার মনের ভুল, এটা ভেবেই চারু বিষয়টি নিয়ে আর কোনো চিন্তা করেনি ।
চারু কাব্য কে দেখে ইদানিং খুব বেশি অবাক হয়ে যাচ্ছে। চেহারায় কেমন বিষন্নতার ছাপ। শরীরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চেহারায় ফ্যাকাশের ছায়া পড়েছে। ঠোঁট গুলো কালো হয়ে গেছে ।
চারু কয়েকবার কাব্যকে স্মোক করতেও দেখেছে। কাব্যের এমন পরিবর্তন চারুকে বার বার ভাবাচ্ছে, তার সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন হওয়ার পর কাব্য কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন ।
তাহলে কি আমার জন্যই কাব্য ভাইয়া নিজের অবস্থা এমন করেছে। তিনি কি আমাকে ভালোবাসেন। যদি নাই ভালোবাসতেন তাহলে তো আমার সাথে দুরত্ব সৃষ্টির পর তার আনন্দে থাকার কথা ।তিনি তো আমাকে সহ্যই করতে পারতেন না । তাহলে তার শরীরের অবস্থা এমন কেন ?
আর যদি আমাকে ভালোবাসেন তাহলে আমার থেকে দুরত্ব কেন সৃষ্টি করলেন। আমার কাছে ফিরে কেন আসলেন না। আমি তো তার কাছে ফিরে যেতে চেয়েছি অনেক বার আমাকে কাছে টেনে নেওয়ার পরিবর্তে আমাকে আরো দূরে সরে কেন দিচ্ছেন।
তিনি কি আমার উপর অভিমানের পাহাড় জমিয়ে ফেলেছেন। আমি তো বার বার তার কাছেই ফিরে যেতে চাই আমাকে কেন বার বার দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা তার ।
চারু তার প্রশ্নের উত্তর কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। তার মন বলছে কাব্য তাকে ভালোবাসে কিন্তু কাব্যের আচরণ তাকে জানান দিচ্ছে কাব্য তাকে এক আকাশ পরিমাণ ঘৃনা করে ।
এসব ভাবতে ভাবতে চারু আনমনে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেছিল। হঠাৎ ই সে সিঁড়িতে পা রাখতে গিয়ে পড়ে যেতে নিলেই কেউ একজন তাকে নিজের বাহুডরে আগলে নেয়।
চারু কাব্যকে দেখেই তার দুই নয়ন ছলছল করে উঠে। কাব্যের স্পর্শ পেয়ে তার শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে যায়। কাব্য চারুকে এই সময় ইগনোর করতে পারছে না । সে চাইছে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে কিন্তু অপরুপার মায়া তাকে বার বার কাছে টানছে।
মায়াবতীর নেশায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছে সে বার বার। সৌন্দর্য কে উপেক্ষা করা যায় কিন্তু মায়া কে নয়। কাব্য চারুকে কোলে তুলে নিয়ে ছাদের দিকে হাঁটা দেয়।
চারুলতা খপ করে কাব্যের গলা জড়িয়ে নেয়। কাব্যের এতোটা কাছাকাছি আসাতে চারু লতার সারা শরীরে শিহরন বয়ে যাচ্ছে। চারুর গরম নিঃশ্বাস কাব্যের গলায় আছড়ে পড়ছে।
কাব্যকে চারুকে দোলনায় বসিয়ে চারুর পাশ ঘেঁষে বসে পড়ে সে। কাব্য আকাশপানে তাকিয়ে রয়েছে আর চারু কাব্যের চেহারার পানে।
কেয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে এই বাসায় খুব কমই আসে। বাসায় তেমন লোকজন না থাকার কারনে ছাদে কেউ যাওয়া আসা করে না বেশি ।
চারু প্রতিটি মুহুর্তকে সে অনুভব করছে। কাব্য কে সে যতই কাছে পাওয়ার চেষ্টা, ততটাই তাকে হারানোর ভয় তার ভেতর । কাব্য আকাশপানে তাকিয়ে তার সমস্ত অভিযোগ তুলে ধরছে । তার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস তারই জানান দিচ্ছে।
চারু আচমকা শিউড়ে উঠে কাব্য চারুর কাঁধে মুখ গুজে দিতেই। চারু শক্ত করে তার জামা আঁকড়ে ধরে। কাব্যের গরম নিঃশ্বাস গুলো তার কাঁধে আছড়ে পড়ছে । ও কাব্যের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও ছাড়িয়ে নেয়নি।
কেন জানিনা কাব্যের স্পর্শ তাকে অজানা নেশায় আসক্ত করেছে। চারু এতোক্ষণ সবটা অনুভব করলেও কাব্যের চোখের পানি ওর কাঁধে পড়তেই ও থমকে যায়।
কাব্য কান্না করছে ।চারু কখনো কাব্যকে কাঁদতে দেখেনি । সে কাব্যকে অনুভূতিহীন ভেবেছিল। কিন্তু এই কয়েকদিনে কাব্যের আচরণ তার সমস্ত ধারনা কে পাল্টে দিয়েছে। কাব্যের দুঃখ, কষ্ট গুলো সে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পেরেছে ।
পুরুষ মানুষ হয়তো এমনি , সে তার কান্না গুলো কে প্রকাশ করতে পারে না। নিজের ভিতরে চেপে রাখে তার সমস্ত দুঃখ কষ্ট গুলোকে। ভিতরে ভিতরে কষ্টের পাহাড় জমে গেলেও বাহিরে কাউকে বুঝতে দেয় না ।
চারু কাব্যকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে নিজের সাথে আগলে নেয়। কাব্যের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েই চলেছে। সে কিছু একটা হারানোর শঙ্কা তার ভিতরে ভয়ের সৃষ্টি করছে । চারুলতা কাব্যের হার্টবিট পরিমাপ করতে পারছে।
কাব্যের অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন চারুলতার মনকে বিচলিত করেছে। বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে তার জীবন।তার সমস্ত টা জুড়ে সে শুধু কাব্যকে ই চায়। সেই কাব্যের দুঃখ কষ্ট গুলো তাকেও গ্রাস করে ফেলেছে।
কিছু সময় কাটানোর পর কাব্য চারু কে রেখেই নিচে চলে যায়। চারু আটকানোর চেষ্টা করলেও বৃথা যায়।চারুর জীবনে আবার ও বিষাদের ছায়া নেমে আসে।
কয়েক দিন এভাবেই কেটে যায়। চারু ভেবেছিল হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু না কিচ্ছু টি ঠিক হয়নি। তাদের মাঝের দুরত্ব আরো বেড়ে গিয়েছে।
কয়েকদিন পর চারু ওর খালামনির সাথে ওদের বাসায় চলে যায়।সে কিছু দিন তার খালামুনির বাসায় থাকবে। তোহার সাথে ভালোই কাটছিল তার দিনগুলো। শুধু মাঝে মাঝে কাব্যের কথা মনে পড়তেই তার মনে বিষন্নতা ভর করে।
তবে সে কাব্যের আশা ছেড়ে দিয়েছে। পরিবারের অমতে সে কাব্য কে চায় না। প্রথম প্রথম চারু ভিষন কান্না করলেও আস্তে আস্তে সে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখা, কাব্যের থেকে নিজেকে দূরে রাখার সব প্রচেষ্টা ই সে চালিয়ে যাচ্ছে।
কাব্য ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে চারু লতাকে আপন করতে পারবে না বলেই সে তার সাথে সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে। আজকাল সে চারুর দিকে তাকানোর ও প্রয়োজন ও মনে করে না।
চারু তোহাদের বাসার ছাদে বসে একাকিত্ব উপভোগ করছিল । স্বভাবতই সে সব সময় চুপচাপ।তোহার ডাকে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে তোহা ফুলের তোড়া নিয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।
চারু কিছুটা অবাক হয়ে যায় অনেক গুলো ফুল একসাথে দেখে। তবে ফুলগুলো তার বিষন্নতা কে দূর করতে পারে নি। ও স্বাভাবিক ভাবে তোহাকে বলে উঠে,,
~ তুমি এগুলো কই পেয়েছো আপু ।
~ তোহা হাসতে হাসতে বলে উঠে, কাউকে বলবি না তো। আমাকে প্রমিস কর ।
~প্রমিস ( চারু )
~তোর ভাইয়া দিয়েছে বলেই তোহা মিটিমিটি হাসতে থাকে।
চারু তোহার সাথে জোরপূর্বক হেঁসে কথা বলার চেষ্টা করে। তোহা চারুকে নিয়ে বাসার ভিতরে যায়।
কয়েকদিন সময় কাটানোর পর চারু আবার নিজের বাসায় চলে যায়। বাসায় ফিরে আবার ও নিজেকে তার বোরিং ফিল হতে শুরু করে।
এই কয়েকদিনের ডিপ্রেশনে সে তার অচেনা ব্যাক্তির কথা মনে করেনি। ফোন স্ক্রিনে মেসেজ ভেসে ওঠে তার যেখানে লেখা ছিল ,,
~ আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। সেখানে লোকেশন এবং সময় দুটোই উল্লেখ ছিল ।
চারু যেন অচেনা ব্যাক্তির প্রতি সব ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছে। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে ছেলেটার সাথে দেখা করতে যায়। রেস্টুরেন্টে সে অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছে।
সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত এসেই গেল। একটা ছেলে হুডি পড়ে চারুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চারুর বুঝতে বাকী রইল না এই সেই ছেলে, যে তাকে মেসেজ দিত।
ছেলেটা চারুর সামনের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে। ধীরে ধীরে সে তার মুখচ্ছবি দেখিয়ে দেয় চারু লতা কে। সুদর্শন পুরুষ বটে ছেলেটা। ছেলেটা অনেকক্ষণ যাবৎ কথা বলেই যাচ্ছে কিন্তু চারুর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তার কথায়।
কথা বলার এক পর্যায়ে ছেলেটা চারুকে বলেই ফেললো,,
~ উইল ইউ ম্যারি মী চারু ?
চারুর কথাটা কানে আসতেই ও নির্দ্বিধায় বলে উঠে,,
~ না। আমি আপনাকে ভালোবাসি না, আমি শুধুই কাব্য ভাইয়াকে ভালোবাসি।
বলেই চারু তাড়াহুড়ো করে উঠে চলে যেতে নেয়। তার এখানে থাকতে রীতিমতো অসহ্য লাগছে । এই ছেলেটা কে সে মোটেও সহ্য করতে পারছে না।
ছেলেটা চারুর হাত ধরতেই, চারু আচমকা ছেলেটার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
~ ডোন্ট টাচ মী । ছেলেটা চারুর হাত ছেড়ে দেয় । ছেলেটা চারুর এমন কান্ডে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ছেলেটা চারুর চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়েছে। শান্ত স্বভাবের মেয়েটা হঠাৎ করে রেগে গেল কেন।
চারু বাসায় ফিরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আজ কেয়া এবং ওর হাজব্যান্ড এসেছে এই বাসায়। চারু সমস্ত কাজ শেষ করে বিছানায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল এমন সময় ওর নানুমনি আর মামীর আগমনে ও একটু অবাক হয়ে যায়।
তোমাকে কাল ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে । দেখতো ছেলেটাকে পছন্দ হয় কি না - চারুর দিকে একটা ছবি এগিয়ে দিতে দিতে কথাটা বলে রুপন্তী রহমান।
~ আপনাদের পছন্দই আমার পছন্দ। চারু স্বাভাবিক ভাবে জবাব দেয় তার মামী কে। তার মামী চারুর সম্মতি পেয়ে, "ঠিক আছে" বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
তারা চলে যেতেই চারু দু ফোঁটা চোখের পানি ফেলে।
পরেরদিন ছেলেপক্ষ চারুকে দেখতে আসে। কাব্য অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেখানে উপস্থিত থাকতে হয় । চারুকে দেখতে ছেলে, তার মা বাবা এবং বোন এসেছে।
চারুকে শাড়ি পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চারুকে দেখেই কিছুক্ষণ তারা তাকিয়ে থেকে তারপর ছেলের মা বলে উঠে,,
~ ভারী মিষ্টি দেখতে তুমি। তোমার নাম কি মা ?
~ চারুলতা চারু ।
ভারী মিষ্টি নাম। কিছুক্ষণ পর সব পাকা দেখা শেষ হলে তারা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলা হয়..!
0 Comments