Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ২০

লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
———" Welcome, রুদ্র! তোমাকে দেখে ভালো লাগলো। তবে শুরুতেই বলে রাখি, আমি দায়িত্বহীন, কাজের প্রতি অবহেলা করা লোক একেবারেই পছন্দ করি না। সিআইডি’র অর্থ নিশ্চয়ই জানো? যেকোনো মুহূর্তে ডাকা হতে পারে, তাই আত্মীয়-পরিজন, পরিবার; সবকিছু ভুলে শুধুমাত্র কাজে মনোনিবেশ করতে হবে।"
সামনে স্থিরতাপূর্ণ, প্রসন্ন হাস্যচ্ছটায় উজ্জ্বল, কালো স্যুট পরিহিত সুঠামদেহী সুদর্শন রুদ্র, হাত মিলিয়ে বলল,
——— ""এখানে জয়েন দেওয়ার পর থেকেই অদৃশ্য কাফনে নিজেকে আবৃত ভেবেই এসেছি, স্যার!"
রুদ্রের উক্তিতে মুগ্ধ হয়ে এসিপি মুযহাব বললেন,
——— "ভবিষ্যতে দেখা যাবে!"
অনন্তর, কুশল বিনিময় করে রুদ্র বের হওয়ার প্রাক্কালে হঠাৎ ফোনে শব্দ করে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো! অচেনা নম্বর দেখে রুদ্রের কপালের ভাজ পরলো!
——— "ইন্সপেক্টর রুদ্র বলছি।"
——— " জানি, কিন্তু তুমি সিম পরিবর্তন করলে কেন?"
———"তুমি? এই মেয়ে! এই নম্বর তুমি কোথায় পেয়েছো?"
——— " আহহাহা! ইটস সিকরেট! "
রুদ্র সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো। ক্রো'ধশান্ত্র প্রজ্বলিত হয়ে উঠল মুহুর্তেই.! কতবার নম্বর পরিবর্তন করেছে! তথাপি এই নারী কিভাবে যে তার নাম্বার পেয়ে যায় কে জানে? ব্যাস্ততার খাতিরে এসব পার্তাও দিচ্ছে না রুদ্র! কিন্তু এমন অদ্ভুত, রহস্যময় নারী রুদ্র পূর্বে কখনও দেখেনি! ফোন রেখে একবার পকেট হতে মানিব্যাগ বের করে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিলো রুদ্র। মানিব্যাগের অন্তর্গত বহুবর্ষের পুরাতন একটি ছবি; ছয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে, মাথার চুল কেটে দেওয়ার অশ্রুসিক্ত সে; সেই মুহূর্তেরই এক টুকরা স্মৃতি! রুদ্র দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আলোকচিত্র স্পর্শ করে বলল,
——— " আজ যদি তুই থাকতি পাখি!!"
ঠিক তখনই, হঠাৎ এক তরুণী কোথা হতে এসে তার সহিত ধাক্কা খেল! পড়িতে গেলে রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে হেচকা টান মেরে দাঁড় করাল। কিন্তু পরক্ষণেই দেখল মানিব্যাগটি মাটিতে পতিত হয়েছে! সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রের মস্তিষ্কে ক্রো'ধের শিখা প্রজ্বলিত হল! এই মেয়ের জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকত তবে হয়তো শক্ত হস্তে এক ঘু'ষি হানত! দাঁত পিষে বলল,
———" চোখে দেখেন না?"
——— "Sorry.…"
রা'গে উত্তপ্ত হয়ে মানিব্যাগ তুলে ভিতরের আলোকচিত্রটি আঙুলে মৃদু স্পর্শ করে পরিস্কার করল রুদ্র । মেয়েটির প্রতি একবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে, বিনা বাক্যব্যয়ে বহির্গমন করল। মনের অগ্নি এমনিতেই প্রশমিত নয়! রুদ্র গমন করলে মহুয়া বিদ্রূপমূলক ভঙ্গিতে বলল,
——— "হুঁহ! এটিটিউড???"
মহুয়ার পরিধানে ব্লাক লেডিস জিন্স, ফরমাল হোয়াইট শার্ট হাত দিয়ে ঝেড়ে নিলো! পিঠাবধি বাঁধিত ঝুটি করা কেশ পূণরায় ঠিক করে দম নিলো! এই মুহুর্তে মহুয়াকে দেখে মনে হচ্ছে শারদীয় শ্যামল ধরার সকল সৌন্দর্য বোধহয় তাকেই আবদ্ধ করেছে! তার শুভ্র মুখমণ্ডল ঘর্মাক্ত, অস্থির। অনন্তর, দ্রুত পদক্ষেপে এসিপি মহাশয়ের সমীপে গমন করে, গলধঃকরণ করে বলল,
———"May I come in sir?"
——— "প্রথম দিনেই দেরি? একজন সিআইডি অফিসার যদি এভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়, তাহলে আমাকে পদক্ষেপ নিতে হবে!"
——— "স…সরি স্যার !"
——— "অজুহাত দেওয়ার অপচেষ্টা করবে না! সময়জ্ঞান না থাকলে তোমাকে বরখাস্ত করা হবে। দায়িত্বহীন ব্যক্তিকে আমি তীব্রভাবে ঘৃ'ণা করি।"
রো'ষে এসিপি প্রস্থান করলেন। মহুয়া মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কেটে দিলো! এখানে কি সবাই এমন?? কিছু একটা ভাবতেই, তখনই মহুয়ার দৃষ্টি সতর্ক হয়ে উঠল! চারিপাশে নত দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করল, দেখলো কেও উপস্থিত আছে কি না। না, আপাদত নেই কেও। ফোন বের করে কাঙ্খিত নাম্বারে কল দিলো! দৃষ্টি এখনো চারিপাশে! শিকারীর ন্যায়! অতঃপর ফোন রিসিভ হতেই কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নিচু স্বরে বলল,
——— " আমি এখানে এসে গেছি!! বাকিটুকু আমার উপর ছেড়ে দাও! "
———--------
——— " বাবা, তুমি আমাকে ডেকেছো কেন?"
কুদ্দুস আলী পুত্রকে দেখেই ক্রো'ধে দন্তসমূহ শক্ত করে কিছু বুঝার পূর্বেই নাঈমের গাল স্পন্দমান করে দিলেন এক প্রচণ্ড চ'ড়। হতবাক স্তম্ভিত নাঈম গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে । ইকরাম আলী গম্ভীর হয়ে বরাদ্দকৃত তার নিজস্ব চেয়ারে বসে!! বাড়ির প্রত্যেকেই স্তম্ভিত চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে! পূর্বিকাও মাথা নত হয়ে দাঁড়িয়ে! আফিয়া বেগম বলতে লাগলেন,
——— "আহা ছেলেটাকে মা'রা'র কি দরকার ছিল? ভালোভাবে বললেই তো পারতে ভাই! "
——— "না না ভাবি এই চ'র আমার আরো আগে দেওয়া উচিৎ ছিল.! এই তোমাদের আদরে আদরে বাদর হয়েছে! "
এরপর নাঈমের দিকে চেয়ে কুদ্দুস আলী প্রচণ্ড স্বরে চিৎকার করে বললেন,
——— "তোরা থাকতে বাড়ির মেয়েরা বিপদে কিভাবে পরে???কেমন বড় ভাই হয়েছিস ছোট বোনের খেয়াল রাখতে পারিস না????? কেন ওই শ'ত্রু'র ছেলে মুগ্ধ এ বাড়ির মেয়েকে বাচাবে?? এখন কি এ বাড়ির মেয়েদের জন্য আলাদা বডিগার্ড রাখতে হবে??? দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে! "
নাঈমের নাক তো আগেই ফে'টেছে, এখন আবার বাবার চ'ড়ে'র আ'ঘা'তে গালও র'ক্ত'বর্ণে পরিণত হয়ে ফা'ট'ল! এত ঘটনার ভিড়ে পূর্বিকার বিষয়টি যেন কারো চিন্তাতেই ছিল না। ক্রো'ধ দৃষ্টিতে পূর্বিকার দিকে এক পলক দেখলো,! নাঈমের ক্রো'ধ যেন নীল আ'গ্নে'য়গিরির শিখায় পরিণত হল। বলতে লাগল,
——— "বাবা..."
———" চুপপপ!! আর একটা কথাও নয়!"
ইকরাম আলী গলা পরিষ্কার করে বললেন,
——— "এবার থাম, কুদ্দুস! এখনো আরেকজনের ভাগের চ'র বাকি আছে । আগে সে সুস্থ হোক! বাড়িতে দুই দুইটা বড় ভাই থাকতে কেন তাদের বোনকে বি'প'দের মুখোমুখি হতে হবে, এটার আমি নিখুঁত হিসাব নেব। আমার মেয়েকে উপদ্রব করার ফলাফল ওই ছেলেগুলো সহ ওদের পুরো পরিবারকেও বহন করতে হবে!"
এ বলে তিনি শান্তর দিকে আড়চোখে তাকালেন! শান্ত মাথা নিচু করে ফোস করে শ্বাস ফেলল! তবে শান্তর মনোলোকে এখন আরেকটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে! সে যে পুতুলটি আঁখির ঘরে রাখল, হঠাৎ তা কোথায় গায়েব হলো , তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না! আঁখির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! আঁখি মলিন মুখে বসে, নিঃসাড়, যেন কোনো এক দূরবর্তী শূন্যতার মাঝে নিমজ্জিত। নাঈম ক্রো'ধে ফুঁসতে ফুঁসতে বাহিরে চলে গেলো, আর বাকি সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে চলে গেলো। আঁখির মনে কিছুতেই স্বস্তি আসছে না, তার মনের কোণে একান্তে কাটানোর আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠেছে। যদি বাইরে গিয়ে একটু হাওয়া খেতে পারত! তাই কাউকে কিছু না বলেই বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো! তখনি শান্ত উজ্জীবিত হল,
——— " দাড়া! "
আঁখি তার প্রতি ত্বরা প্রদর্শন করিয়া, ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে । শান্ত গলা খাকরি দিয়া বলল,
——— "পুতুল কোথায় রেখেছিস?"
আঁখি ভ্রু কুচকে বলল,
——— "কিসের পুতুল?"
——— "তোর টেবিলের উপর ছিল!"
——— "আমি জানি না, তুমি কোন পুতুলের কথা বলছ! আর আমি এখন আর কোনো বাচ্চা নই যে পুতুল নিয়ে খেলা করব!"
শান্ত বুঝতে পারল—আঁখি পুতুল বিষয়ে কিছুই অবহিত নয়। আঁখি আবারও চলে যেতে উদ্যত হলে রোকেয়া বেগম তাঁকে ডাকলেন,
——— "আঁখি, আয় মা, চুলে তেল দিয়ে দিই!"
আঁখি স্থির হয়ে দাঁড়াল। শান্তের সামনে থেকে রোকেয়া বেগমের কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বলল,
———" আমার সব কিছু মনে পড়ে গেছে, মা!"
রোকেয়া বেগম আ'ত'ঙ্কিত বিস্ময়ে আঁখির দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালেন। তুতলাতে তুতলাতে বললেন,
———" মা,, মা,নে? "
আঁখি শব্দ করে হেসে বলল,
——— "আমি আগে ষরশের তেল চুলে দিতাম! কেন, তুমি কি ভেবেছো??
———" না…না, কি...ছু না! "
আঁখি ফের মুখমণ্ডল শক্ত করে বলল,
——— " আমি আসছি, মা!! "
বলেই আঁখি চলে গেল। রোকেয়া বেগম কিছু ক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন! চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। এরপর দেখলেন, শান্ত তার দিকেই তাকিয়ে। শান্তকে একটি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে তিনি দ্রুত সেখান থেকে সরে যেতে লাগলেন। শান্ত হাত-পা মুচড়ে বাকা হাসি দিয়ে বলল,
——— " মানতে হবে, বস! এত বছর অভিনয় করে যাচ্ছে, কেউ ধরতেও পারল না! "
-------------
---
——— "মিলির মা ! মিলির মা! ও মিলির মা! কোথায় গেলে??"
——— " কি হয়েছে? চিৎকার করছো কেন? "
——— " চিৎকার করব না? পাত্রপক্ষ আমাদের মেয়েকে পছন্দ করেছে! "
———" আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমার প্রার্থনা কবুল করেছেন!! তাহলে তো বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে!!
——— "আহহা! তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই! হাতে এক মাস সময় আছে! পাত্রপক্ষ বলেছে, আগামী মাসে বিয়ের তারিখ ঠিক করবে!!"
তখনি রুম হতে বাবা-মায়ের চেচামেচি শুনে মিলি বের হল! চোখমুখ ফুলে একাকার! মেয়েটির এই অবস্থায় জবেদা বেগম ও হাবিবুর সাহেব চুপসে গেলেন। যেদিন পাত্র মিলিকে দেখতে এসেছিল, সেদিন মিলি পাত্রকে খুব পছন্দ করেছিল! সে কি আনন্দ তার! যদি এখন মিলি জানতে পারে যে তাকে পছন্দ করেছে, তবে মিলি হয়তো আরো আনন্দিত হবে, এই চিন্তায় জবেদা বেগম মেয়ের কাছে গিয়ে মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে বললেন,
——— "ছেলের তোকে পছন্দ হয়েছে, মা!"
এই কথাটি শুনে মিলি একবার মায়ের দিকে, পরে বাবার দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো মিলি! বুকটা হুহু করে কেঁদে উঠছে! কত স্বপ্ন ছিল তার! যে চার বান্ধবীকে একসাথে বিয়ের খবর বলবে! আজ তার বিয়েও স্থির হয়ে গেল! অথচ রূপাকে জানাতে পারল না! তাহার আগে সে চিরবিদায় নিয়ে চলে গিয়েছে! ওপাশ হতে জবেদা বেগম দরজা ধাক্কাচ্ছেন! হাবিবুর সাহেব স্ত্রীকে বাধা দিয়ে বললেন,
———" একা থাকতে দাও মেয়েটাকে! কিছুদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে!!"
মধ্যবিত্ত পরিবারের পিতা, মাতা ও ছোট ভাইসহ মিলির ছোট্ট সুখের পরিবার! কিছুদিন পূর্বে পাত্রপক্ষ মিলিকে দেখে গিয়েছে ! মিলির বিয়ে নিয়ে সেই ছোট্টোটি হতেই অনেক স্বপ্ন! এইসব পড়াশোনা তার মোটেই পছন্দ নয়! বিয়ে করে স্বামী সন্তান নিয়ে একটি ছোট সংসার গঠন করে সুখি পরিবারে থাকবে এটাই তার ইচ্ছা ! সেদিন পাত্রপক্ষের পাত্রের নাম ফাহাদ! তার নিজস্ব ব্যবসা আছে! পূর্বে ফাহাদের বিবাহ হয়েছিল, কিন্তু স্ত্রী মৃত্যুবরণ করায় পিতামাতার চাপের কারণে পুনরায় বিবাহে রাজী হয়েছে ফাহাদ। একা কথা বলতে দিলে সেদিন মিলি বলেছিল,
——— "আমি মোটা বলে আপনার কোনো সমস্যা হবে না তো? আপনি চাইলে আমি খাওয়া কমিয়ে দিব! "
ফাহাদ মুচকি হেসে মিলির কানে ফিসফিস করে বলেছিল,
——— " তোমার খাওয়া কমানোর কোনো প্রয়োজন নেই! যতদিন আমি আছি, ততদিন আমার বউকে খাওয়া থেকে কে আটকাবে, আমিও দেখিব! তুমি যেমনই হও! আমার কাছে তুমিইই পৃথিবীর সকলের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দরী!
সেদিন মিলি পুরোদমে আনন্দিত হয়ে গিয়েছিল! এই কথাটি মিলির জানা ছিল যে ছেলেপক্ষ হতে হ্যাঁ আসবে! এদিকে মিলির মা জবেদা বেগম স্বামীর কাছে নিচুস্বরে বলছেন,
——— "হেগো, মেয়েটাকে কি সবকিছু জানাবো??"
——— " আরে না! এখন ভুলেও এমন কিছু করো না! আর তারা তো মিলির ব্যাপারে সবকিছু জেনে রাজি হয়েছে! বিয়ের পর মিলিও মানিয়ে নেবে!"
———" কিন্তু,,,"
——— "শশশশ!! এর চেয়ে ভালো পাত্র আর পাব না! আমাদের মেয়ের এত বড় সত্য জানার পরেও যে রাজি হয়েছে, সেটাই আমাদের ভাগ্য!"
------------
---
পশ্চাতে, বাড়ির বাগানে উদাসীন আছিয়া বসে আছে। আহার-বিহার সব বর্জন করে প্রায় অসুস্থ। গালে হাত রেখে চেয়ারে স্খলিত হয়ে রয়েছে। মুগ্ধ মায়ের কাছে এই সংবাদ শুনেছে, কিন্তু কিছু বলে নি। শাহারিয়াজ বাড়িতে কাচুমাচু হয়ে প্রবেশ করলো জীবন। জীবনকে দেখে মুগ্ধ এগিয়ে গেলো, বাড়ির বাইরের দিকে নিয়ে আসতে লাগল তাকে, জীবন জিজ্ঞেস করল,
——— “স্যার, কোনো বিশেষ প্রয়োজন তো হয়নি?”
মুগ্ধ সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল,
——— “বিনা প্রয়োজনে আমি কি কখনো ডাকি?”
——— “না স্যার! আসলে হঠাৎ করে বাড়িতে আসতে বললেন।”
——— “আমার বোন কিছু খাচ্ছে না ।”
——— “এটা অত্যন্ত দুঃখজনক! আপনার কথা শুনে আমার খুবই খারাপ লাগলো।”
মুগ্ধ জীবনের কাঁধে হাত দিয়ে র'ক্তিম নয়নে তাকিয়ে বলল,
——— “তুমি জানো তো, ও কার বোন?”
জীবন অতি নীচু গলায় বলল,
——— “জ্বী, স্যার!”
——— “ Don't cross your limit !”
জীবনকে সেখানেই রেখে মুগ্ধ হনহনিয়ে চলে গেলো। জীবন বেক্কলের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কেন মুগ্ধ তাকে ডাকলো? আর ডাকলে কেন বাড়ি থেকে বের করে আনল? আনল যখন, তখন এভাবে জীবনকে ধমকে রেখে কোথায় চলে গেলো? জীবন মাথা চুলকালো। এখানে তার কাজ শেষ। পা বাড়ানোর আগেই মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেলো,
——— “জীবন ভাই?”
পেছনে ঘুরে তাকালো জীবন। আছিয়া দেখতেই বুকের ভিতর ধক্ করে উঠল। মেয়েটির চেহারার কি করুণ দশা! কান্নার ফলস্বরূপ চোখমুখ লাল হয়ে গেছে, শরীরটা যেন শুকিয়ে গেছে। জীবনের মনে মায়া জাগলো। আছিয়া তাকিয়ে আছে জীবনের দিকে। জীবন কি বলবে বুঝতে না পেরে গম্ভীরমুখে বলল,
——— “শুনলাম, তুমি কিছু কিছু খাচ্ছো না। কেন খাচ্ছো না? এভাবে না খেয়ে থাকলে কি হবে? দেখো, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি জানি, তোমার কষ্ট অনুভূতি স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের যত্ন তো নিতে হবে। আজ যদি তোমার বান্ধবী তোমায় এই অবস্থায় দেখতো, তাহলে কি কষ্ট পেত না বলো?”
থামল জীবন। দেখলো, আছিয়ার চোখে পানি টলমল করছে। কাঁন্না করতে দিবে মনে হচ্ছে । জীবন আতকে উঠল। ভুল কিছু বলেছে কি? এখন মুগ্ধ যদি এসে দেখে তার বোন কাঁদছে, তবে জীবনের জীবন রেহাই মিলবে না। জীবন আছিয়াকে শান্ত করতে বলল,
——— “আরে তুমি কাঁদছো কেন? আমি তো তোমাকে কাঁদানোর জন্য কিছু বলিনি!”
——— “আমি ঠিকমতো খাচ্ছি না বলে আপনি টেনশন করছেন?”
কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল আছিয়া। এখন জীবন যদি না বলে দেয়, তাহলে কষ্ট পাবে। এর চেয়ে ভালো হ্যাঁ বলে দেওয়া। জীবন বলল,
——— “হ্যাঁ!”
আছিয়া এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। জীবন মহা জালায় পড়লো। এভাবে বাড়ির সামনে কাঁদছে! কেউ দেখলে জীবনের গ'র্দা'ন নিবে। জীবন তপ্ত শ্বাস ফেলে এবার শান্ত কণ্ঠে বলল,
——— “তুমি কি চাও, আমাকে এখন তোমার জন্য মা'র খেতে হোক?”
আছিয়া দুইদিকে মাথা ঝাকালো, অর্থাৎ না। জীবন এবার আদুরে কণ্ঠে বলল,
——— “তাহলে চুপ করো আর কাঁদো না!”
আছিয়া চোখের পানি মুছে কান্না থামিয়ে জীবনকে বলল,
——— “আপনি আমার জন্য এত ভাবেন?”
——— “হুম! ”
——— “আচ্ছা, আমি খাবো ! আপনি খেয়েছেন?”
——— “হুম!”
——— “ তাহলে আপনি কি আমায় পছন্দ করেন?”
——— “হুম!”
ছিটকে দূরে সরে গেলো জীবন। এটি কি বললো সে! হুম, হুম বলার চক্করে উল্টাপাল্টা উত্তর দিয়ে দিয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য আর এক মুহূর্তের জন্যও ঠিক হবে না। চলে যেতে যেতে বলল,
——— “তুমি খেয়ে নিও, আমি যাচ্ছি।”
নিরন্তর দুঃখের মাঝে আছিয়ার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল! জীবন যেতে যেতেই কাঙ্খিত নাম্বারে ফোন দিলো! ক্ষণিকের জন্যে চোখ-মুখের রঙ পরিবর্তিত হলো! বাকা হাসি দিয়ে বলল,
——— " কাজ হয়েছে!"
ফোন রেখে বা কাধের দিকে ঘাড় সামান্য ঘুরিয়ে বাকা হাসি সহকারে বলল,
———" বোকা মেয়ে! "
------------
আজ হাটতে হাটতে বহুদিন পর নদীর পাড়ে একাকিনী আঁখি! মাঝে মাঝে পাথরের গুল্লি জলরাশিতে নিক্ষেপ করছে। চিন্তার নানা ভাজে তার মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত। একাকী বসে ঠাণ্ডা বায়ুর স্পর্শে হালকা অনুভব করছে নিজেকে! হঠাৎ করেই সে উঠে দাঁড়ালো। কোনো ভাবভঙ্গিমা ব্যতিরেকে হেঁটে চললো। সোজা গিয়ে বৃহৎ গাছের পেছনে অবস্থানকারী আরাফকে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল,
——— "আপনি যা চান তা এই জন্মে সম্ভব নয়! "
আরাফ হকচকিয়ে গেল। কি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করা উচিত, সে বুঝতে পারছে না। এভাবে চোরের মতো ধরা পড়বে কস্মিনকালেও উপলব্ধি করেনি। আর আঁখি কি তাহলে এতকাল ধরে আরাফের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত ছিল? আরাফ শঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
——— "আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস হারিয়ে গেছে, সেজন্যই এদিক সেদিক খুঁজছিলাম।"
আঁখি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
———" মিথ্যা কাকে বলছেন?"
আরাফ তাজ্জব হয়ে যাচ্ছে! আঁখির অচেনা রূপে সে বিভ্রান্ত। মুহূর্তেই আঁখি বলল,
——— "আমাকে চিনেছেন কখন, যে অচেনা লাগবে?"
আরাফের মনে অস্পষ্ট শঙ্কা। আঁখি কি তার অন্তর্দ্বন্দ্ব শুনতে পেরেছে? যদি সে শুনে থাকে, তবে এতকাল ধরে থাকা ভালোবাসা, আর্তনাদ, অপেক্ষা—এসবও কি সে জানে? আরাফ মুখ খুলতে যাবে, তখন আঁখি হাত দেখিয়ে থামিয়ে বলল,
——— "আমি সব জানি! আপনি যা চাচ্ছেন, তা এই জন্মে সম্ভব নয়। ভুল মানুষের জন্য অপেক্ষা করে নিজের জীবন নষ্ট করবেন না।"
এত পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হলো, তা আরাফের মাথায় আসছে না। সে কি বলবে, ভেবে পাচ্ছে না। আঁখির দিকে তাকিয়ে এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
——— "আমার নিঃশ্বাসের শেষ কণাটুকু অবধি, তোমার ছায়ারও পিছু ছাড়ছি না।”
——— “আমার ছায়া কেবল মরীচিকা, কাছে গেলেই মিলিয়ে যাবে। তবুও পিছু নিলে শুধু শূন্যতা আর কষ্ট ছাড়া কিছুই জুটবে না, এটা জেনেও এগোবেন??? আমি যে পথ পেরোই সেখানে কোনো চিহ্ন থাকে না, আত্মাকে পোড়াতে এত আগ্রহ কেন আপনার?”
———" আত্মা পোড়াতে আমি প্রস্তুত, যদি কারণ তুমি হও! "
——— 'আমার জীবনে আবেগের কোনো স্থান নেই! "
——— " আমি সেই বিবেক হতে রাজি, যা তুমি বহন করো! "
আঁখি এক ভ্রু উঁচিয়ে বাকা হেসে বলল,
——-— “আপনার আসল উদ্দেশ্য আমি জানি!”
চমকে উঠল আরাফ। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আঁখির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে খেলে গেলো আরাফের মুখে অদ্ভুত শয়তানি হাসি। বলল,
——— “তাহলে আমার আর কষ্ট করতে হলো না লুকাতে!”
——— “ভুল জায়গায় নজর পড়েছে।”
——— “আমি ভুলকে ভালোবাসি!”
আঁখি এবার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলো। যেতে যেতে বলল,
——— “লাভ নেই!”
——— “লস তো আছে? আমি তোমার থেকে ওটাই চাই!”
এতক্ষণ এদের দুজনকে দেখছিল মিনহাজ। আঁখি চলে যাচ্ছে দেখেই মিনহাজ আরাফের কাঁধে হাত রাখল। এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
——— “এই প্রথমবার ওর সাথে এত কথা বলতে দেখলাম! কী এত কথা বললি?”
আরাফ বাকা হেসে বলল,
——— “যতটা বোকা মনে করেছি, তার চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ধুরন্ধর চালাক মেয়ে ও!”
——— “মানে?”
——— “আমার বিষয়ে জেনে গিয়েছে!”
একে অপরের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে মিনহাজের মুখে খেলে গেল হাসি। কাঁধে হাত রেখে বলল,
——— “তাহলে এবার খেলা জমবে!”
——————————
নিজের পিতার মুদির দোকানে পায়ের উপর পা তুলে আরামে বসে আছে রোহান। রোহানের পিতা কৃষি আবাদের পাশাপাশি একটি মুদির দোকানও পরিচালনা করেন। কর্মচারী নিযুক্ত থাকলেও রোহান মাঝে মাঝে সেখানে এসে সময় কাটায়। সে এখনো লুঙ্গি ও সাদা সেনটু গেঞ্জি পরে, মুখ ফুলিয়ে বসে রয়েছে। মুগ্ধের আক্রমণের স্মৃতি এখনও তার মনে উজ্জ্বল; অযথা তাকে মে'রে ঠোঁট ফা'টি'য়ে দিয়েছে।
ঠিক তখন একটি কর্কশ কণ্ঠস্বর কানে এল,
——— “এই একটা সিগারেট দে !”
রোহান চোখ তুলে দেখলো, মুগ্ধ গম্ভীরমুখে উপস্থিত। ভেঙচি কেটে মুখ সরিয়ে নিলো রোহান। আজ সে পণ করেছে কথা বলবে না। পাশে কর্মচারীকে গম্ভীর কণ্ঠে রোহান বলল,
——— “চাচা, যা চাচ্ছে, দিয়ে দিন!”
কথামতো সিগারেট ধরিয়ে দিল কর্মচারী। মুগ্ধ সিগারেট নিয়ে দোকানের সামনে ঝুলে থাকা মেচ জালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। উলটো দিকে ঘুরে যেতে যেতে শান্ত কণ্ঠে বলল,
——— “আমি তো চায়ের দোকানে যাওয়ার চিন্তা করছি।”
নড়েচড়ে উঠল রোহান। হতভম্ব হয়ে বলল,
——— “এই তুই কোন চায়ের দোকানে যাবি?”
——— “যেটার কথা ভাবছিস!”
লুঙ্গি ধরে দোকান থেকে বের হয়ে মুগ্ধের পিঠ চাপড়ে রোহান হেসে বলল,
——— “আহহাহাহা! যাহ তোকে ক্ষমা করে দিলাম! আমার সাথে মা'রা'মা'রি করতে এলে পরবর্তী বার তোর নাক ফা'টি'য়ে দেব, শা'লা!”
মুগ্ধ সিগারেট ফুঁক দিয়ে বাকা হেসে বলল,
——— “কাকে কিভাবে আয়ত্তে আনতে হয়, এটা আমার জানা।”
রোহান সেনটু গেঞ্জি পরেই হাঁটা দিলো। মুগ্ধ পাশে ফিরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
——— “কিছু তো পরে আয়!”
——— “ধুর! যা পরে আছি, এটাই যথেষ্ট! হাহ, নিজের এলাকা! আগে তো নেং''টা ঘুরে বেড়িয়েছি! এখন যে এই পোশাক পরে আছি, এটাই কত!”
——— "আগের আর এখনকার মধ্যে বিস্তার তফাৎ আছে!"
বলে মুগ্ধ তপ্ত শ্বাস ফেলল। রোহানের এহেন অদ্ভুত আচরণ সবসময়ই ঘটে। তবে রোহানের হাস্যোজ্জ্বল ও উন্মুক্ত মনের জন্যই তারা আজ বন্ধুত্বের বাঁধনে আবদ্ধ। দুজনের মধ্যে কোনো মিল নেই; একজন রা'গী, ব'দমে'জাজি, বেপ'রো'য়া জে'দি, অন্যজন খামখেয়ালি, উদ্ভট, হাস্যজ্জল, মিশুকে। বোধহয়, তাদের এই বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যই বন্ধুত্বের মূল ভিত্তি।
-----
রোহান চা পান করে নৃত্যকৌতুকে মগ্ন, পাশে মুগ্ধ বির'ক্ত'চিত্তে পকেট হাতগুজে নীরবে চলছে! কিছুক্ষণ পূর্বে রোহান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিল, মুগ্ধর সহিত কথোপকথন ত্যাজ্য; তথাপি তার চলনে কিছুমাত্র তদ্বিষয়ক ইঙ্গিত নেই। হঠাৎ করেই মুগ্ধর ফোন কর্কশস্বরে ধ্বনিত হলো। কানে তুলিবামাত্র চোয়াল কঠোর হলো, মুখমণ্ডল বর্ণহীন হয়ে ক্রো'ধা'নলে দগ্ধ , শিরা-উপশিরায় ক্রো'ধের তরঙ্গাবলীর বিস্তার ঘটল। কিছুমাত্র বাক্যব্যয় না করে দ্রুতগমনে অগ্রসর হতে লাগল মুগ্ধ।
রোহান উচ্চস্বরে ডেকে উঠল,
——— " কোথায় যাচ্ছিস মধুউউউ?"
মুগ্ধ পৃষ্ঠালোকন ব্যতীত, রা'গে কম্পমান কণ্ঠে উত্তর দিল,
——— "কাজ আছে! "
রোহান পুনরায় প্রশ্ন উচ্চারিল,
——— " এই, তুই কিসের কাজ করিস? আজ পর্যন্ত জানলাম না! বাড়িতেও থাকিস না, তোকে তো খুঁজেও পাওয়া যায় না! তোর কাজটা আসলে কী, বলবি আমায়?"
মুগ্ধ থেমে, র'ক্তা'ভ দৃষ্টিতে রোহানের প্রতি কঠোর দৃষ্টিপাত করল। ক্ষণকাল নীরবতা অবলম্বন করে দৃঢ়স্বরে বলল,
——— " শীঘ্রই জানবি.! "


Post a Comment

0 Comments

Close Menu