লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
নিশীথ রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে জোনাকির ঝি ঝি শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। রুদ্র কর্মস্থল হতে গৃহাভিমুখে, কিন্তু গৃহদ্বারের সম্মুখে উপনীত হয়ে রুদ্রর দৃষ্টিপথ বিস্তৃত হলো! এ কী, গৃহের দ্বার কী জন্য উন্মুক্ত? সর্বাঙ্গে আলোকমালার দীপ্তি কেন ? রুদ্র তো একাকী বাস করে! তৎক্ষণাৎ রুদ্র সতর্ক হয়ে Sig Sauer পি'স্ত'ল বের করল। সতর্ক চরণে ধীরগতিতে গৃহদ্বার ঠেলে প্রবেশ করল রুদ্র। চারিপাশে নিরীক্ষণ করছে—বাড়িটা পূর্বাপেক্ষা অধিক সুশৃঙ্খল দেখাচ্ছে! খাবারের সুঘ্রাণ নাসা অভিমুখে ধাবমান! রান্নাশালার দিক হতে টুকটাক শব্দ আসছে। চো'র কি রন্ধনশিল্পী ? সিআইডির ন্যায় দুঃসাহসিকের বাড়ি এসে রান্না করছে নাকি? এইসব অদ্ভুত চিন্তায় নিজেকে ভ'র্ৎ'সনা করল রুদ্র। সোজা রান্নাঘরে গমন করে উচ্চস্বরে ঘোষণা করল,
——— "হ্যান্ডসআপ!"
সামনের দাঁড়ানো ব্যক্তিটি রুদ্রের পি'স্ত'ল তাক করা দেখে উভয় কর্ণে হাত দিয়ে শিরাচ্ছিন্নকারী এক চিৎকার দিয়ে উঠলো। মেয়েটাকে দেখে রুদ্রর দৃষ্টিতে বিস্ময়ের রেখা আঁকা, মহা বিস্ময়ের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে রুদ্র বলল,
——— "তুমি???"
চিৎকারের আওয়াজ শুনে হঠাৎই সেই শব্দে চমকিত হয়ে কোথা হতে যেন দৌড়ে আসলেন রুদ্রর চাচা জয়নাল সাহেব এবং চাচি ঊর্মিলা বেগম। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে রুদ্রর মুখোমুখি দাঁড়ালেন তারা। রুদ্র বিস্ময়ে আকাশ হতে যেন পতিত হল, বিক্ষিপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হল,
——— "তোমরা???"
ঊর্মিলা বেগম দৌড়ে ভীতসন্ত্রস্ত প্রিয়ার নিকট এসে তার ভয়ে সঙ্কুচিত দেহটিকে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হলেন। জয়নাল সাহেব রুদ্রর প্রতি কঠিন স্বরে বললেন,
——— "মেয়েটাকে কি করেছিস? আর এই পি'স্ত'ল কেন তুলেছিস? দেখছিস না, ভয় পেয়ে গিয়েছে? নামা পি'স্ত'ল!"
রুদ্র এতোটাই বিস্মিত যে প্রিয়ার দিকে পি'স্ত'ল লক্ষ্য করেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তৎক্ষণাৎ পি'স্ত'ল নামিয়ে নিলো সে হতভম্ব হয়ে বলল,
——— "তোমরা কখন এলে? আর এই মেয়েটা এখানে কি করছে?"
ঊর্মিলা বেগম কোমল স্বরে বললেন,
——— "তোকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই না জানিয়ে এসেছি।"
——— "হ্যাঁ, সবই বুঝলাম, কিন্তু এই মেয়েটা এখানে কেন?"
ঊর্মিলা বেগমের সরল জবাব,
——— "এখন থেকে ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে।"
রুদ্রর মনে যেন বাজ পতিত হল! এই মেয়েটা এখানে থাকবে? মস্তিষ্কে যেন ঝড় উঠল। গত দুই মাস ধরে যে মেয়েটি রুদ্রকে নানাভাবে বিরক্ত করে আসছে, সেই মেয়েটি তার বাড়িতে থাকবে? ত্বরিতে সোজাসুজি বলল,
——— "না, বাহিরের কাওকে আমি এইভাবে বাড়িতে স্থান দিব না।"
জয়নাল সাহেব বোঝাতে বললেন,
——— "আহহা! এভাবে বলিস না। মেয়েটার আপন বলতে কেও নেই। তোর চাচিও তো একাকী থাকে, কাজের জন্য মেয়েটাকে রেখেছে! তুই তো সারাদিন বাহিরে থাকিস। আমিও তো বাড়িতে থাকব না। কাজ করব! একজন কাজের লোকও পাওয়া গেল, আবার তোর চাচির গল্পের সঙ্গীও পাওয়া গেলো.!!
কঠিন স্বরে রুদ্র পুনঃ উচ্চারণ করল,
——— "আমি বাড়িতে থাকি না বলেই, অচেনা কাওকে বাড়িতে আশ্রয় দিব না! কাজের লোক আমি নিজে ঠিক করে দিবো! "
এই বলেই কাটকাট ভঙ্গিতে নিজ কক্ষে চলে গেল রুদ্র। ঊর্মিলা বেগম মৃদু হাসি দিয়ে প্রিয়ার থুতনিতে হাত রেখে সান্ত্বনাসূচক স্বরে বললেন,
——— "তুই কিছু মনে করিস না। জানিসই তো, ও এমন! "
লম্বা চওড়া গড়নের শীর্ণকায় দেহের রূপবতী প্রিয়া মৃদু হাসি দিয়ে তার প্রতি সায় জানালো।
--
রুদ্র গোসল সমাপন করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। সুশোভিত উন্মুক্ত শরীরে ফর্সা রঙের দীপ্তি, কেবল টাওয়াল ঘাড়ে ঝুলে আছে। ভেজা কেশসমূহ ব্যাকব্রাশ করে বিছানায় বসল । এমন সময় প্রিয়া, তার দুই চক্ষু দুখানি হাত দ্বারা ঢেকে রুমে আসতে আসতে বলল,
——— "ইমমম, আমি কিছু দেখি নি,, আমি কিছুই দেখি নি!"
রুদ্রের ক্রো'ধ তেতে উঠল। ত্বরিত ধমক দিয়ে বলল,
——— "আমার রুমে প্রবেশের অনুমতি তোমাকে কে দিয়েছে?"
প্রিয়া কিঞ্চিৎ থতমত খেয়ে দু হাতের ফাকে রুদ্রকে দেখে বলল,
——— "মা পাঠিয়েছে, খাওয়ার জন্য নিচে ডাকছে তোমাকে!"
রুদ্র বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তীব্র দৃষ্টিতে প্রিয়ার প্রতি চেয়ে থাকল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ,
——— "তোমার মা আবার কোথা থেকে এলো?"
প্রিয়া সরলভাবে উত্তর দিল,
——— "কেন, তোমার চাচিই তো আমার মা!"
রুদ্র গোল গোল চক্ষু বিস্ফারিত করে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবতে লাগল, জল তাহলে এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে! ধপ করে উঠে দাঁড়িয়ে ত্বরিত কণ্ঠে ধমকে বলল,
——— " বের হও আমার রুম থেকে!"
প্রিয়া এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। এতদিন রুদ্র প্রিয়ার বিষয়ে অনীহা প্রদর্শন করলেও, আজ তার মস্তিষ্কে চিন্তার গভীরতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মেয়ে তার পরিবারকেও হাত করে ফেলেছে! রুদ্র একবার নিজ পরিবার হারিয়েছে; এবার সে তার কোনো ভুল হতে দিবে না।
ডিরেক্ট বিছানায় রাখা ফোন তুলে নিল রুদ্র। কল করলে অপরপ্রান্তে রিসিভ হলে তখনই কঠোর স্বরে রুদ্র বলল,
——— "ওই মেয়েটা আমার বাড়ি অবধি এসে গিয়েছে, আমার পরিবারকেও বশ করেছে। আমি ওর সমস্ত তথ্য চাই! এমনকি একটি পিঁপড়ার সমান তথ্যও যেন বাদ না পড়ে!"
অনন্তর, রুদ্র তড়িৎ গতিতে ফোনটি কেটে বালিশে ছুড়ে মারল! কপাট রুদ্ধ করল। কিসের খাওয়া? প্রিয়ার সমস্ত বিবরণ জ্ঞাত না হলে নিদ্রাও নাহি আসবে! অতি রু'ষ্ট চিত্তে ঘাড়ে ঝুলানো টাওয়াল দূরে নিক্ষেপ করে শুয়ে পড়ল। জীবনের পরতে পরতে বহু হৃদয়বিদারক বিচ্ছেদ সহ্য করেছে সে! যথেষ্ট, আর নয়! ঐ মেয়েটা যদি কু-উদ্দেশ্যে আগমন করে থাকে, তাকে মা'রতেও রুদ্রের হাত কাঁপবে না। কিন্তু কী আশ্চর্য! প্রিয়া নামক কন্যাটি কেন জানি হৃদয়ের নিকটবর্তী বলে বোধ হয়! তথাপি, সে সমস্ত ভাবনায় দৃষ্টি দিতে চায় না! তদুপরি, শয়ন করে নেত্র নিমীলন করল, সমস্ত প্রিয়জনের মুখপট মনে জাগ্রত হতে লাগল; যারা তার জীবনপথে হতে বহুদূরে সরে গিয়েছে! কিন্তু একজন, হ্যাঁ, একজন আছে, রুদ্র নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে, সে জীবিত আছে! আকস্মিক ভাবেই চক্ষু মেলে দ্রুত উঠল রুদ্র, মানিব্যাগ হাতে নিয়ে পুনরায় শুয়ে পরল। সেই ছয় বছরের ক্ষুদ্র টাক্কুমতী কন্যা, যার অশ্রু নদীসম ধারা বইছে, তার ছবি দেখে রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
——— "আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুই কোথাও না কোথাও এখনো বিরাজমান! তুই এখনো জীবিত! এই কারণেই তো নিরন্তর খুজে ফিরি। এজন্যই তো আমি এই কাজে জয়েন হয়েছি, যাতে সকল স্থানে যেতে পারি! তদন্তের সুত্র ধরে একদিন না একদিন তোর সাথে আমার দেখা হবেই! এই একমাত্র আশাই তো আমার জীবনের প্রেরণা!"
------------
নাঈম মোবাইল স্ক্রিনের সামনে বসে, চোখ গেমের উপর নিবদ্ধ। তার আঙুলগুলো স্ক্রিনে দ্রুত গতিতে নড়ছে—পাবজি খেলছে। মিরামার ম্যাপ, লেভেল ৪৫, চারপাশে শত্রুরা ঘিরে আছে।
——— “কাভার দে!”
গম্ভীর স্বরে বলে, শত্রুর ফায়ার এড়িয়ে টিমমেটদের নির্দেশ দেয়। স্ক্রিনে নাঈমের চরিত্রটি হেডশটের জন্য শুয়ে পড়ে, তীক্ষ্ণ মনোযোগে শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে। হঠাৎ পশ্চাতে ভারী কিছু পতনের ধ্বনি মনোযোগের বাঁধন ছিন্ন করিয়া দিল। নাঈমের হাত মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল, পেছনে ফিরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিকে নিদারুণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল কিছুক্ষণ, অতঃপর বিরক্তির সূচনা সূচক শব্দ করে পুনর্বার গেমে নিমগ্ন হলো।
দ্বারে দাঁড়িয়ে রইল এক রূপবতী কন্যা! টমেটোর ন্যায় লালবর্ণের গাল ফুলিয়ে সে । নাঈমের উত্তর না পেয়ে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে উঠল সে! সজোরে রুমে প্রবেশ করে, হিং'স্রভাবে নাঈমের হস্ত হতে ফোনটি কেড়ে নিলো ! খেলার মাঝখানে এমন আচরণে নাঈমের ক্রো'ধ গর্জে উঠল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
——— "ফোন ফেরত দে!"
——— "তুই আমার মেসেজ কেন সিন করিস না? কল দিলেও ধরস না!"
——— "আমার এত ফাউল টাইম নাই, তুই ফোন দিবি?"
——— "না দিবো না!"
——— "তুই দিবি না, তোর বাপ সহ দিবে!"
এই বলেই নাঈম হাওয়ার কোমল দুই হাত কঠোরভাবে চেপে ধরল। হাওয়ার পক্ষে নাঈমের এই শক্তির মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য । তবে সে ধস্তাধস্তি করতে লাগল। নাঈম হাওয়ার এক হাত শক্ত করে ধরে আরেক হাত দিয়ে টেনে ফোনটি নিয়ে নিলো! বিরক্তিকর হয়ে বলল,
——— "এখন বিদায় হ !"
——— "তুই খুব খা'রা'প!"
——— "আমি ভালো কবে ছিলাম?"
ঘাড় ঘুড়িয়ে এক ভ্রু উচু করে নাঈম কথাটি উচ্চারণ করল। নাঈমের কথায় হাওয়ার রা'গে দুঃখে কান্না করতে ইচ্ছে হলো। সে যা ভাবল, তাই করেই কান্নার নিকটে নত মস্তক করে রুম হতে বের হয়ে গেল। নাঈম শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে পুনর্বার গেমে মনোনিবেশ করল।
হাওয়া নাঈমের মামাতো বোন! আজ মায়ের সহিত এখানে এসেছে! তথাপি, এখানে উপস্থিতি উপলক্ষে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে! বয়স একুশ বর্ষের সীমায় , পূর্বিকার সমবয়সী! পূর্বিকা ও হাওয়া সেম বেচ এর স্টুডেন্ট! হাওয়া কিশোরীকালেই হৃদয় সমর্পণ করেছে নাঈমের প্রতি! কিন্তু এই নাঈম সকলের সাথে মধুরালাপে মগ্ন থাকলেও, হাওয়ার প্রতি সে আদৌ পার্তা প্রদান করে না! বরং ধমকের স্বরে তার সহিত কথোপকথন চালায়! যেমন, আজও তার নিকট কোনো পার্তা আসল না!
এদিকে, নাঈম যখন খেলায় মগ্ন, হঠাৎ রুমে প্রবেশ করলেন কানিজ বেগম এবং নাঈমের কান মুলে ধরলেন।
——— "আরে মা! করছ কি ?"
——— "আমি কি করছি? তুই হাওয়া কে কেন মে'রে'ছিস?"
নাঈম বিস্মিত দৃষ্টিতে হাওয়ার দিকে তাকালো , যার নয়ন অশ্রুভারে লাল, গাল দুটি ফুলিয়ে রেখেছে! রাগান্বিত হয়ে কানিজ বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,
——— "মা, আমি কেন ওরে মা'রতে যাবো?"
——— "কেন মারতে যাবি? দেখ মেয়েটার হাত কি করেছিস! "
কানিজ বেগম নাঈমের কান ছেড়ে হাওয়ার লাল হয়ে যাওয়া দুই হাত নাঈমকে প্রদর্শন করলেন, নাঈম দৃঢ়ভাবে ধরার ফলে লালবর্ণ ধারণ করেছে। এমন সময় হাওয়ার মা রুবিনা বেগম রুমে প্রবেশ করে বললেন,
——— "ভাবি, আমার ছেলেকে কিছু বলবে না।"
——— "কি বলব না! আমার মেয়েকে কষ্ট দিবে আর আমি চুপ থাকবো?"
এমত কথোপকথনের পর দুই ননদ-ভাবি উভয়েই হাস্যরত হলেন! হাওয়া ঠোঁট উল্টিয়ে কানিজ বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
——— "ফুফুআম্মু, তুমি এই নাঈমের বাচ্চাকে মে'রে দাও।"
রাগান্বিত হয়ে নাঈম দাঁড়িয়ে চোখ মুখ কুচকে ব্যাঙ্গ করে বলল,
——— " এহহহ!! নাঈমের বাচ্চাকে মে'রে দাও ! ধা'ম'ড়ি কোথাকার!"
এই বলের হাওয়ার চুল টেনে দিয়ে ভো দৌড়ে রুম ত্যাগ করল নাঈম! তার বুঝা হয়ে গিয়েছে, বাড়িতে থাকলে তার আর গেম খেলা হবে না!
হাওয়া চিৎকার করে বলল,
——— "দেখলা ফুফুআম্মু, তোমার ছেলে আমায় কিভাবে মে'রে গেলো!"
কানিজ বেগম ও রুবিনা বেগম উভয়েই অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন! রুবিনা বেগম মেয়ের কাছে গিয়ে মাথায় গাট্টি মেরে ধমকের সূরে বললেন,
——— "তুই তো ছেলেটা কে আগে খে'পাস! "
হাওয়া ভেংচি কেটে বলল,
——— হুহহ, খে'পাবো খে'পাবো আরো বেশি করে খে'পাবো !"
----------------
সপ্তাহকাল কেটে গিয়েছে, মুগ্ধ সেই যে যে গেলো, আর ফিরে আসল না! তার কোনো সংবাদও মিলছে না। ছেলেটা কাওকে কিছু না বলে হুট করে কোথায় চলে গেলো?? কী করছে? কি খাচ্ছে ? ঠিক আছে তো ? ইদানীং গ্রামে যে খু'ন'খা'রাবি হচ্ছে, ছেলেটার কোনো অঘটন ঘটল না তো? এই সকল উদ্বেগে মাতৃহৃদয় ক্ষ'ত-বি'ক্ষ'ত হয়ে যাচ্ছে! সুহানা বেগম পুত্রশোক ও উদ্বেগে অশ্রুপাত করতে করতে রোগাক্রান্ত ! অনবরত তাঁর চেষ্টা, বারংবার ফোন করছেন, কিন্তু কোনো উত্তর নেই, ফোন বন্ধ । অন্যদিকে, আরাফ ও রোহান মিলে মুগ্ধকে খুঁজার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোথাও তার হদিস মিলছে না। মোশারফ সাহেব রু'ষ্ট—তার পুত্র এভাবে কাওকে কিছু না বলে কোথায় গায়েব হলো? এই ছেলের জন্যই বোধহয় তিনি মৃ'ত্যু'তেও শান্তি পাবেন না!
সুহানা বেগম কক্ষে শয্যায় শায়িত, এক নিঃজীব প্রাণীর ন্যায় নিস্তেজ। মোশারফ সাহেব কক্ষাভ্যন্তরে প্রবেশ করে স্ত্রীর এই অবস্থা আর সহ্য করতে পারলেন না। ক্রো'ধে বলতে লাগলেন,
——— "এই সব তোমার কারণেই! সবকিছুর জন্য দায়ী তুমি! আজ যদি তোমার নিজের ছেলে—"
হঠাৎই সুহানা বেগম উত্তপ্ত হয়ে ছটফটিয়ে উঠলেন, মোশারফ সাহেবকে ব্যথিত কণ্ঠে বাধা দিয়ে চেচিয়ে বললেন:
——— "আর একটা কথাও বলবে না আমার ছেলেকে নিয়ে! আমি ওর মা! ও আমার সন্তান! আমি ওকে কোলেপিঠে মানুষ করেছি! অসুস্থ হলে, আমি রাত জেগেছি! তুমি কী ভাবো, আমি বুঝতে পারি না, কেন তুমি ওকে সহ্য করতে পারো না? আমি সব বুঝি! তুমি ওর বাবা হও আর না হও, আমি মুগ্ধর মা! শুনছো তুমি? আমি মুগ্ধর মা! আমি, আমি, আমি!"
হাহাকারিয়া কেঁদে উঠলেন সুহানা বেগম! মোশারফ সাহেব নির্বাক রইলেন। তিনি এমন কিছু বলতে চান নি, তবে তার যে কথাটি, সেটা সম্পূর্ণ অসত্যও নয়। তিনি আর এক মুহূর্ত দণ্ডায়মান থাকলেন না, দ্রুত বাহিরে চলে গেলেন।
---
এদিকে কলেজ অনির্দিষ্টকাল বন্ধ থাকায় প্রধান শিক্ষকের মনে গভীর চিন্তার ভর । ইকরাম আলী সহিত পরামর্শ করে অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, কলেজের পার্শ্ববর্তী অর্ধসমাপ্ত চতুর্থ তলা ভবন, যার কেবলমাত্র চতুর্থ তলার কাজ সমাপ্ত হওয়া বাকি, সেটাও কলেজের অংশরূপে কাজ করবে। অস্থায়ীভাবে সেই ভবনেই পাঠদান সম্পন্ন হবে। সেই কারণেই আজ আঁখি, আছিয়া ও মিলি কলেজে এসেছে। দ্বিতীয় তলায় তাদের ব্যবসায় শিক্ষার ক্লাস । তারা দ্বিতীয় তলায় উঠতেই শ্রেণীকক্ষ হতে শোরগোলের প্রখর আওয়াজ আসতে লাগল। অত্যধিক কোলাহল, যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদে সকলে অতিশয় প্রীত । তিনজনে একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল । এমন কি ঘটেছে, যে এমন চিৎকার? তারা আরও এক ধাপ অগ্রসর হবে, ঠিক তখনি প্রধান শিক্ষক এক প্রসন্ন হাস্য সহিত বের হলেন। তিনজনে সম্মিলিতভাবে সালাম দিল। প্রধান শিক্ষক সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
——— "তোমাদের নতুন হিসাববিজ্ঞান শিক্ষক জয়েন করেছে! যাও যাও, ক্লাসে যাও!"
এই বলে তিনি প্রফুল্ল মুখে চলে গেলেন। তিনজনে বিস্ময়ে অভিভূত —নবীন শিক্ষক আসায় এমন উল্লাস! এমন চিৎকার! তারা দ্রুতপদে অগ্রসর হলো দেখবার জন্য, কে সেই শিক্ষক। শ্রেণীকক্ষের সম্মুখে দণ্ডায়মান হতেই দেখল লম্বা চওড়া এক ব্যক্তি কালো স্যুট পরিহিত অবস্থায় পৃষ্ঠদেশ ফিরে দাঁড়িয়ে , এবং সমস্ত ছাত্রীরা এমন উল্লাস প্রকাশ করছে যেন অচিরেই অজ্ঞান হবে। পৃষ্ঠদেশ হতে ব্যক্তিটিকে পরিচিত বলে বোধ হলো! মিলি উচ্চস্বরে বলল,
——— "স্যার, আসব???"
সঙ্গে সঙ্গেই সেই ব্যক্তি ফিরে দণ্ডায়মান হলো। তাকে দেখিয়া আঁখি, আছিয়া ও মিলি বিস্ফারিত নেত্রে অবলোকন করতে লাগল। মিলি ও আছিয়া বিস্ময়ে চোখ কচলে নিল। চরম আশ্চর্যের সীমানায় দাঁড়িয়ে আছিয়া বলল,
——— "ভাইয়া, তুই???"
আরাফ এক চপল হাসি সহকারে বলল,
——— " কল মি স্যার!!
আছিয়া কি বলবে তা বুঝতে পারল না! তার ভাই এই কলেজে? এখন আর সে পড়ায় ফাকি দিতে পারবে না! কিন্তু তার চেয়েও আশ্চর্য এই যে, আরাফ কিছুমাত্র ইঙ্গিত প্রদান করে নি! কালও বলে নি! আজও সকালে দেখা হলো তাও কিছু বলল না!! আরাফ সম্মুখে গমন করল, মুখে এক চপল হাসি সহিত আঁখির দিকে চাইল। আঁখির আর কিছু বুঝবার বাকি রইল না, আরাফের আসল উদ্দেশ্য কি ! আছিয়া, মিলি হতভম্ব হয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ক্লাসে প্রবেশ করল। আঁখি দণ্ডায়মান রইল দ্বারের সম্মুখে। আরাফের কার্যকলাপ দেখে তার হাসি আসছে। দু’জনার চোখাচোখির মধ্যে নিমেষেই কথা বিনিময় হয়ে গেল বিনা বাক্যে। আরাফ চপল হাসি সহকারে বলছে,
——— " বলেছিলাম না? তোমার পিছু ছাড়ছি না ম্যাডাম! "
আঁখি বিদ্রূপের হাসি সহকারে বলল,
——— "লাভ নেই, আমি আপনার ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে, স্যার!"
0 Comments