Ad Code

১৯. আজাহেরের ছেলে বছির - ৪

লেখকঃ পল্লি কবি জসীম উদ্‌দীন

 ১৯.

সেদিন আজাহের হাটে যাইবে, ছেলে বছির বায়না ধরিল, “বাজান, আমিও হাটে যাব!”

–”তুই আটপার পারবি? কত দূরির পথ, আমার সুনা, আমার মানিক, তুমি বাড়ি থাহ।”

কিন্তু ছেলে কথা শুনে না–”না বাজান, আমি আটপার পারব।”

অগত্যা ছেলেকে সঙ্গে লইতে হইল। একটি ডালিতে দুই তিনখানা মৌমাছির চাক, সুপারী, কুমড়ার ফুল, কয়েকটা কলার মোচা সাজাইয়া আজাহের ছেলের মাথায় দিল। বাকের দুই ধারে আটকাইয়া সে কাঁধে করিয়া লইয়া চলিল কাঠের বোঝা।

এত দূরের পথ। মাথার উপর দুপুরের রৌদ্র খা খা করিতেছে। ছোট ছেলে বছির, চলিতে চলিতে পিছনে পড়িয়া থাকে। বাপ পথের মধ্যে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করে। এমনি করিয়া তাহারা বদরপুরের পাকা ইঁদারার কাছে আসিয়া বোঝা নামাইল। কয়া হইতে পানি তুলিয়া আজাহের নিজের চোখে মুখে দিল। ছেলেকে পানি খাওয়াইল। তারপর কিছুক্ষণ ঝাউ গাছের ঠাণ্ডা হাওয়ায় জিড়াইয়া আবার পথ চলিতে আরম্ভ করিল।

Facebook

শহরের নিকটে আসিতেই ছোট ছেলে বছির শুনিতে পাইল, কোথায় যেন ঝড় বৃষ্টি হইয়া গর্জন করিতেছে। বছির বাপকে জিজ্ঞাসা করে, “বাজান, এই শব্দ কিসির?”

বাপ বলে, “আমরা ফরাতপুরির আটের কাছে আইছি।”

অজানা রহস্যের আবেশে বছিরের বুক দুরু দুরু করিতে থাকে। বছির আরও জোরে জোরে হাঁটে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহারা শহরে আসিয়া উপস্থিত হইল। গোয়াল চামটের পুল পার হইয়া বামে ঘুরিয়া দুই পাশের মিষ্টির দোকানগুলি ছাড়াইয়া মেছো বাজারের দক্ষিণ দিকের রাস্তায় আজাহের কাঠের বাকটি নামাইল। বছিরের মাথা হইতেও বোঝাটি নামাইয়া দিল। বাপের কাছে কতবার বছির ফরিদপুরের হাটের গল্প শুনিয়াছে। আজ সেই হাটে সে নিজে আসিয়াছে। কত লোক এখানে জড় হইয়াছে। বছির এত লোক একস্থানে কোথাও দেখে নাই। তাহাদের তাম্বুলখানার হাট এতটুকু, এক দৌড়ে ঘুরিয়া আসা যায়। কিন্তু ফরিদপুরের হাটে কত লোক! বছির যে দিকে চাহে শুধু লোক আর লোক। তাহাদের গ্রামের জঙ্গলের মত এও যেন মানুষের জঙ্গল। ইহার যেন কোথাও শেষ নাই।

সাদা ধবধবে জামা কাপড় পরিয়া ভদ্রলোকেরা আসিয়া আজাহেরের কাঠের দাম জিজ্ঞাসা করে, “কিরে, তোর এই কাঠের দাম কত নিবি?”

YouTube

আজাহের বলে, “আজ্ঞা, পাঁচ সিহা।”

কাঠের বোঝা হইতে কাঠগুলি নাড়িয়া চাড়িয়া বলে, “এযে ভিজে লাকড়ীরে। আখায় দিলে জ্বলবেও না। এর দাম চাস পাঁচ সিকে? পাঁচ আনা পাবি।”

আজাহের বলে, “এমুন শুকনা খড়ি, আপনি ভিজা দেখলেন? পাঁচ আনায় দিব না কর্তা।”

“আচ্ছা তবে ছ’আনা নে। চল আমার বাড়িতে দিয়ে আসবি।”

আজাহের বলে, “আপনারা ঐলেন বড় লোক। আতখান ঝাড়া দিলি আমরা গরীবরা বাঁচতি পারি। হেই তাম্বুলখানা ঐতে আনছি এই খড়ি। কন ত কর্তা, আপনাগো চাকরেও যদি এই খড়ি বিনা পয়সায় আনত তার মায়না কত দিতেন?”

“তুই ত কথা জানসরে। আচ্ছা তবে সাত আনা নে।”

কর্তা আপনারা কি আমাগো না খায়া মরবার কন নাকি? আইজকা আধাদিন বইরা খড়ি কুড়াইছি। আধাদিন গ্যাল খড়ি আনতি। তাতে যদি সাত আনা দাম কন, আমরা গরীবরা বাঁচপ কেমন কইরা?”

আচ্ছা, যা। আট আনা দিব। নিয়ে চল খড়ি।”

আজাহের হাল ছাড়ে না।”আইচ্ছা বাবু আর একটু দাম বাড়ান।”

“আর এক পয়সাও দিব না।”

DailyMotion

“তয় পারলাম না কর্তা,” আজাহের বিনীত ভাবে বলে। লোকটি চলিয়া গেল। বছির ভাবে, এমন ধোপদোরস্ত কাপড়-পরা–এরাই ভদ্রলোক। এমন সুন্দর এদের মুখের কথা কিন্তু তার বাবাকে ইনি তুই বলিয়া সম্বোধন করিলেন কেন? তাদের তাম্বুলখানা গ্রামে । সবাই তাহার বাবাকে তুমি বলে। তাহার বাবাও তাহাদের তুমি বলিয়া সম্বোধন করে। কিন্তু এই লেখাপড়া জানা ধোপদোরস্ত কাপড় পরা ভদ্রলোক তার বাবাকে তুই বলিয়া সম্বোধন করিল! সে যদি ভদ্রলোক হইত–সে যদি এমনি বোপদোরস্ত কাপড় পরিয়া তারই মত বই-এর মত করিয়া কথা বলিতে পারিত? কিন্তু সে ভদ্রলোক হইলে তার বাপের বয়সী লোকদের এমনি তুচ্ছ করিয়া তুই বলিয়া সে সম্বোধন করিত না।

কতক্ষণ পরে আর একজন লাকড়ী কিনিতে আসিল। তাহার সঙ্গে দরাদরি করিতে বাপের উপস্থিত কথাবার্তায় প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় পাইয়া মনে মনে বছির বড়ই গৌরব অনুভব করিতে লাগিল।

TikTok

“আরে কর্তা! আমার শুকনা খড়ি কিন্যা নিয়া যান। বাড়িতি গেলি মা ঠাকুরনরা তারিফ করব্যানে। আর ওই দোকান ঐতে যদি বিজা খড়ি কিন্যা নেন, ঠাকুরনরা ওই খড়ি চুলায় দিয়া কানতি বসপি।”

শুনিয়া ভদ্রলোক খুশী হইয়া লাকড়ীর দাম বারো আনা বলিল। আজাহের বলে, “আপনারা বড়লোক মানুষ, আপনাগো কাছে খড়ির দাম কি চাব? মা ঠাকুরনরা খুশী হয়া যা দ্যান তাই নিবানি।”

“আচ্ছা চল তবে।” আজাহের বছিরকে বসাইয়া রাখিয়া লাকড়ী লইয়া ভদ্রলোকের সঙ্গে চলিল।

“বছির তুই বয়। আমি এহুনি আসপানি। ডেহিশাগ চাইর আঁটি কইরা পয়সায়। আর এই মধুর চাক সগল যদি কেউ নিবার চায় দ্যাড় টাহা চাবি। এক টাহা কইলি দিয়া দিস।”

যাইবার সময় আজাহের পাঁচ ছয় আঁটি চেঁকিশাক লইয়া গেল। এই বিরাট হাটের মধ্যে বসিয়া বছিরের যেন কেমন ভয় ভয় করিতে লাগিল। একজন আসিয়া শাকের দাম জিজ্ঞাসা করিল।

“কিরে ছোকরা! কয় আঁটি করে চেঁকিশাক?”

Threads

প্রায় কাঁদ কাঁদ হইয়া যাত্রাদলের নতুন অভিনেতার মত সে বলিল, “আমার শাকের দাম পয়সায় চাইর আঁটি।”

“বলিস কি, চার আঁটি পয়সায়? আট আঁটি করে দিবি নাকি?”

বছির বাপের মত করিয়া বলিতে চেষ্টা করিল, “না কর্তা! আট আঁটি কইরা দিব না।” কিন্তু কথার সুর বাপের মতন মুলাম হইল না।

লোকটি বলিল, “আচ্ছা, তবে ছয় আঁটি দে এক পয়সায়।” এ কথার জবাবে বছির কি বলিবে তাহা ভাবিয়া পায় না। এমন সময় তাহার বাপ আসিয়া উপস্থিত হইল।

“আসেন বাবু। এমন চেঁকিশাক বাজারে পাবেন না। দ্যাহেন না, পোলাপানের মতন ল্যাক ল্যাক করত্যাছে ইয়ার ডগাগুলান। পয়সায় চাইর আঁটির বেশী দিব না।”

লোকটি তখন আঁটিগুলি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া অনেকক্ষণ পরীক্ষা করিয়া সবগুলি শাক কিনিয়া লইল। লোকটি চলিয়া গেলে আজাহের ছেলেকে বলিল, “খড়ির সঙ্গে পাঁচ আঁটি চেঁকিশাক দিয়া আইলাম মা ঠারহ্যানরে। খুশী অয়া মা ঠারহ্যান আমারে আরো চাইর আনা বকশিস দিছে।”

বাপের এই সাফল্য দেখিয়া বছির মনে মনে গৌরব বোধ করিল। সুপারি আর কলার মোচা বেচিয়া আজাহের ছেলেকে লইয়া বেনে দোকানে যায়। বেনেরা মৌমাছির চাক কিনিয়া কলিকাতায় চালান দেয়। তাহারা বড়ই চতুর। অনেক ঠকিয়া আজাহের এখন কিছুটা তাহাদের চালাকি ধরিতে পারে। একই ব্যক্তি বিভিন্ন লোক দিয়া পাশাপাশি দুইটি দোকান দিয়া বসে। এক দোকান মৌচাকের দাম যাহা দিতে চাহে, পার্শ্ববর্তী অপর দোকানে গেলে তাহার চাইতে কম দাম বলে। আজাহের তাহা জানে। সেইজন্য সে দূরের দুরের দুই তিন দোকান যাচাই করিয়া তাহার মৌচাক বিক্রি করিল। কিন্তু দোকানদার মৌচাক মাপিতে হাত সাফাই করিয়া বেশী লইতে চাহে। আজাহের বলে, “সা’জী মশায়! রাইতরে দিন করবেন না। আমার চাক আমি মাইপ্যা আনছি।”

Instagram

দোকানী বলে, “গো-মাংস খাই, যদি বেশী লয়া থাকি। তোমার ওজনে ভুল ঐছে।”

আজাহের বড়ই শক্ত ব্যক্তি, “আমি ওজন কইরা আনছি দুই স্যার! যদি তাই স্বীকার কইরা লন তয় নিবার পারেন, তা না ঐলে দেন আমার মধুর চাক। আর এক দোকানে যাই।”

দোকানী তবু হাল ছাড়ে না, “আরে মিঞা! ওজন ত ঠিক কইরা দিবা। আমার ওজনে ঐল পৌনে দুই স্যার। আচ্ছা ওসব রাইখ্যা দাও। তোমার মৌচাকের দাম চৌদ্দ আনা ন্যাও।”

“তা অবি না কর্তা।” বলিয়া আজাহের মৌচাকের উপর হাত বাড়ায়।

“আরে মিঞা! রিয়াইত-মুরিতও তো করতি অয়; আচ্ছা পোনর আনা দাম।” বলিয়া দোকানী আজাহেরের হাতখানা ধরে।

এ যেন কত কালের ভিখারী!

চাইরটা পয়সা কম নাও বাই। দোকানী আজাহেরের হাতে একটা বিড়ি খুসিয়া দিল। “আরে বাই, অত নিষ্ঠুর ঐলা ক্যান? তামুক খাও।”

ArtWorks

আজাহেরকে চারটি পয়সা ছাড়িয়া দিতে হয়। বছির ভাবে এরা কত বড় লোক। চারটি পয়সার জন্য এদের কি কাঙালী-পনা! অথচ এই চারটি পয়সা যদি তার বাবা পাইত, তাহা দিয়া মাছ কিনিয়া লইয়া যাইয়া তাহারা কত আনন্দ করিয়া খাইত। তার বাবাকে। মিঠা কথায় ভুলাইয়া এই চারটি পয়সা রিয়াইত লইয়া ইহাদের কি এমন লাভ হইবে? বেনের দোকান হইতে পয়সা গণিতে গণিতে আজাহের একটি অচল সিকি পাইল। তাহা ফিরাইয়া দিতে দোকানী বলিল, “আরে মিঞা! এডা বাল সিকি। যদি কেওই না লয়, ফিরায়া দিয়া যাইও।”

আজাহের বলিল, “সা’জী মশায়! হেবার একটা অচল টাহা দিছিলেন ফিরায়া নিলেন । আইজ আবার আর একটা নিয়া কি করব? জানেন ত আমরা দিন আনি দিন খাই। এহনি পয়সা দিয়া ত্যাল, নুন কিনতি অবি। আমারে সিহিডা বদলাইয়া দেন।”

কোনদিক হইতেই আজাহেরকে না ঠকাইতে পারিয়া দোকানী বড়ই নিরাশ হইয়া তাহাকে সিকিটি ফিরাইয়া দিল।

রাস্তার দুইধারে নুনের দোকানদারেরা ছালার উপর নুন লইয়া বসিয়া আছে; আজাহের জানে একসের নুনে ইহারা পোনর ছটাক মাপিবেই। সেই কমটুকু সে ফাও চাহিয়া পূরণ করিবে। আজাহের নুন লইয়া দোকানীকে বলে, “একটু ফাউ দাও মিঞা বাই!” দোকানী তোলাখানেক নুন ফাউ দেয়।

আজাহের আবার বলে, “মিঞা বাই! আরও একটু দাও।” বিরক্ত হইয়া দোকানী আরও এক তোলা নুন তাকে দেয়।

ওধারে গুড়ের হাট। মৌমাছি গুনগুন করিতেছে! গুড়ের বেপারীরা খড়ের বুন্দা জ্বালাইয়া ধূয়া করিয়া মৌমাছিদের তাড়াইতেছে। গুড়ের বাজার বড়ই চড়া। সের প্রতি দুই আনার কমে কেহই গুড় দিতে চাহে না। গুড়ের টিন হইতে কানি আঙ্গুলে গুড় লাগাইয়া আজাহের ছেলের মুখে ধরে, “খায়া দেখ ত গুড় খাটা ঐছে কিনা।”

ছেলে গুড় মুখে দিয়া বলে, “না বাজান, খাটা না।”

WhatsApp

“তুই কি বোঝোস? আমি একটু মুহি দিয়া দেহি।” বলিয়া আজাহের আঙুলে আর একটু গুড় লইয়া চাখিয়া দেখে। দরে দোকানীর সঙ্গে আজাহেরের বনে না। দোকানী চায় দুই আনা। আজাহের বলে ছয় পয়সা সের। এইরূপে তিন চার দোকানের গুড় পরীক্ষা করে সে। আহা বেচারী ছেলেটা মিষ্টির মুখ দেখে না। চাখিয়া চাখিয়া খাক যতটা খাইতে পারে। এক দোকানী ধমকাইয়া বলে, “আরে মিঞা! গুড় ত নিবা এক সের। বাপ বেটায় চাখিয়াই ত এক তোলা খায়া ফ্যালো।” শুনিয়া বছিরের বড় অপমান বোধ হয়, কিন্তু বাপের মুখের দিকে চাহিয়া দেখে সেখানে কোনই রূপান্তর ঘটে নাই। এইরূপ অনেক যাচাই করিয়া আজাহের এক দোকানের গুড় ছয় পয়সা সের দরে ঠিক করে। এই গুড় সাধারণতঃ লোকে তামাক মাখাইবার জন্য কিনিয়া লয়। বছির চাখিয়া দেখিল, গুড়টি টকটক কিন্তু তার বাপ আঙুলে একটু গুড় মুখে দিয়া বলিল, “নারে বছির! বেশ মিঠা। তাছাড়া দামেও দুই পয়সা কম।” বাড়ি হইতে আজাহের গুড় কিনিবার জন্য খুটি লইয়া আসিয়াছিল। খুব ঠিক মত গুড়ের ওজন করাইয়া আরও কিছু ফাও লইয়া আজাহের কাপড়ের হাটে আসিল। কত রঙ-বেরঙের গামছা, শাড়ি লইয়া তাতিরা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া খদ্দেরদের ডাকিতেছে। অনেক খুঁজিয়া পাতিয়া আজাহের আসিয়া দাঁড়াইল রহিমদ্দী কারিকরের পাশে। “কেমুন আছ আজাহের?” রহিমদ্দী জিজ্ঞাসা করে।

Facebook

“তুমরা যেমুন দোয়া করছ চাচা।”

“এ কিডা? আমার মিঞা বাই নাহি? আরে আমার মিঞা বাই দেহি ডাঙর ঐছে? এবার তোমার সঙ্গে লড়ন লাগবি? দেখপ কার কত জোর।” বলিয়া দুই হাতের কাপড় এক হাতে লইয়া রহিমদ্দী বছিরের গায়ে মুখে হাত বুলায়।

“একদিন যাইও চাচা আমাগো তাম্বুলখানার আটে।”

“কয়াক মাস পরেই যাব।”

“মাতবর ক্যামুন আছে? ক্যাদাইরার মারে কইও আমাগো কতা।”

কাপড় দর করিতে খরিদ্দার আসে। রহিমদ্দী বলে, “আরেক আটে আইস আজাহের। অনেক কতা আছে!” বলিয়া রহিমদ্দী খরিদ্দারের সঙ্গে কথাবার্তায় মনোযোগ দেয়।



Post a Comment

0 Comments

Close Menu