লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
গভীর নিশীথের কালো প্রহরে, ঠিক দুটো পয়তাল্লিশে, মিলিদের বাড়িটা যেনো নিস্তব্ধতার অন্তরে ডুবে আছে। রাত একটার সময়ে বেহালার ঝংকার থেমেছে, গুরুজনের ধমক না এলে হয়তো সারা রজনীই তার সুরধ্বনি বয়ে যেত। চারিদিকে ঘুমের গাঢ় প্রলেপে মগ্ন সকলেই, আশেপাশের গাছপালায় কাক পক্ষিরও কোনো সাড়া নেই। মিলির শোবার ঘরে, মিলি আর আছিয়া এক খাটে শুয়ে নিদ্রিত। আঁখিও শুরুতে একই বিছানায় ছিল, কিন্তু মিলির অগোছালো ঘুমের চাপে সে মিলির ধাক্কায় বিছানা থেকে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যায়। ব্যথার হালকা শব্দে চুপিসারে নিচে শুয়ে পড়ে আঁখি। সবে মাত্রই চোখটা লেগে এসেছে তার। নিচে আরও কিছু আত্মীয়স্বজন এক লাইনে পাটি পেতে ঘুমিয়েছে, সেই সুতীব্র নিস্তব্ধতার মাঝে আঁখিও তাদের পাশে কোণ ধরে শুয়ে পড়েছে। ঘরের দরজা খোলাই রাখা হয়েছে, এত মানুষে দরজা বন্ধ করবার প্রয়োজন মনে হয়নি।
রাতের আঁধারে সবকিছু আবছা, কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। হঠাৎ, দরজা ক্রমে খুলে গেল, আর ভিতরে প্রবেশ করল কিছু একটার অস্তিত্ব। ধীরপায়ে এগিয়ে এল, আঁখির দিকে পা বাড়াল নিস্তব্ধতার মোড়কে। আঁখির পাশে নিঃশব্দে বসে রইল কিছুক্ষণ, অন্ধকারের বুক চিরে তার সত্তা আঁখির দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
এরপর, আঁখির কানের কাছে ঝুঁকে এসে সেই অজানা অস্তিত্ব গাঢ় ও কাঁপন জাগানো কণ্ঠে মৃদু ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
——— "আর অন্তরটারে দহন করিও না, প্রণীতা। তোমার প্রলয়বিহীন বিনাশ আমায় স্বয়ং ম'রণেও পীড়া দিবে।"
কানে গরম নিঃশ্বাসের স্পর্শে আঁখির চোখ সহসাই খুলে গেল। অন্ধকারের ভারে আচ্ছন্ন চারপাশে সে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো, কোনো কিছুর অস্তিত্বের ইঙ্গিত পেল না। নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো, বাতাস যেন আরও ঘনীভূত হলো তার চারপাশে। কিছুই নেই—কিন্তু যেনো কিছু ছিল, তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। অবশেষে চোখ বুজে নিলো আঁখি, তবে সেই নিদ্রা আর সহজে ফেরেনি। ঘুমের সমুদ্র রসাতলে ডুবে গেল, মন অস্থির হয়ে উঠল।
অন্ধকারের আড়ালে, দরজার ওপাশে সেই রহস্যময় ছায়া নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। তার দৃষ্টি আঁখির প্রতিটি নাড়া-চাড়া গভীর মনোযোগে গ্রাস করছিল। কোনো শব্দ নয়, শুধু অন্ধকারের অন্তরালে সেই নিকটস্থ সত্তা তীক্ষ্ণভাবে অবলোকন করে গেলো, যেনো এটাই ছিল তার আড়ালের সঙ্গী হওয়ার একমাত্র নীরব কৌশল।_________
সেই স্নিগ্ধ প্রভাতের আলো দিগন্তরেখায় মিশে যাবার মুহূর্তে, গায়ে হলুদের অনন্ত ঢেউ যেন এক মহাকালের স্রোতে গাঁথা। ঘরের অন্তঃস্থলে নারীরা সাজসজ্জায় লিপ্ত, তাদের হাসি-কোলাহলে যেন ছড়িয়ে পড়েছে এক অলৌকিক মায়াবী আভা। হলুদ শাড়ির নিস্তব্ধ স্রোত—প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্যের মৃদু আভায় তারা আচ্ছন্ন। প্রত্যেকটি ক্যামেরার ঝলক যেন বন্দি করে নতুন কাব্যের জন্ম দেয়। ঘরের প্রতিটি কোণে, প্রফুল্ল জীবনের চাঞ্চল্য বৃত্তাকার নৃত্যে প্রবাহিত—সুরবদ্ধ গানের কাব্যিক ছন্দের মত।
তবে সমস্ত আনন্দ ও কোলাহলের অন্তরালে আরাফের মন তিমিরঘন স্তব্ধতায় নিমজ্জিত। সে বসে আছে যেন এক অশরীরী শূন্যতায়। মানুষের কোলাহল, হাসি কিংবা নীরব হাহাকার তার চেতনার অগোচরে রয়ে গেছে। মনে ভাসছে গতকালের সেই বিচিত্র ঘটনা, যখন মুগ্ধ এক সহজ অথচ তীব্র বেদনাদায়ক কর্ম সম্পাদন করল। আঁখির খাবারের পাতে সে যখন নির্দ্বিধায় পানি ঢেলে দিল, ঘরের প্রতিটি কোণ যেন এক অব্যক্ত স্তব্ধতায় পরিণত হলো।
আঁখি সে অপমান সহ্য করতে অপারগ হয়ে মুখ ভার করে না খেয়েই দ্রুত রুমের অন্তঃস্থলে অন্তর্হিত হলো। মুগ্ধের অন্তরে তখন যেন এক অগ্নিঝড়া ঝড়ের প্রতিঘাত। সে আরাফের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, তার দৃষ্টিতে এক অপরিমেয় হতাশা আর ক্রোধের জ্যামিতিক রেখা। দৃঢ়স্বরে উচ্চারণ করল,
———" কাওকে কিছু দেওয়ার আগে জানতে হয়; সেটা তার জন্য ক্ষতিকর কিনা! "
মুগ্ধের চোয়াল দৃঢ় হলো, সে দ্রুত প্রস্থান করল, যেন তার অন্তরে এক গহ্বরের সৃষ্টি হল। নাঈম মৃদুস্বরে বলেছিল,
——— "আঁখির ইলিশে এলার্জি আছে।"
আরাফ সেই বাক্য শুনে এক মুহূর্তে স্থবির হল। তার অন্তরের অতল গহ্বরে এক অজানা বেদনার তরঙ্গ উঠল। সে ভেবে পেল না, কিসে তার অধিক দুঃখ—এই সত্যে যে আঁখির ইলিশে এলার্জি, না এই সত্যে যে তার বড় ভাই সেই তথ্য অবগত অথচ সে নিজ জানে না। এই প্রশ্ন তার হৃদয় গভীরে এক তীব্র কাঁ'টার মতো বিধল। বুকের অন্তঃস্থলে সেই বি'ষা'ক্ত ব্যথা এখনো বহমান; এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ তার মন।
আঁখি সেই সময় হতে রুমের সীমানায়, এক নিঃশব্দে লুপ্ত। বাহিরে কোলাহল, অন্তরে সেই গভীর অন্ধকার—যার সীমান্তে কোনো আলোক রশ্মি প্রবেশ করতে পারে না।
আরাফ একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার পর অধীর অপেক্ষায় নীরবে রইল।
——— "উফ, মেয়েটা এখনো বের হল না?"
মনে মনে এক গভীর অসহিষ্ণুতা জন্ম নেয়। চারিদিকে একে একে নারীগণ শাড়ি পরিহিত হয়ে সারিবদ্ধভাবে বের হয়ে আসছে। ক্যামেরায় প্রতিটিকে বন্দী করার জন্য তাদের হাতে ফল এবং মিষ্টির পাত্র তুলে দিয়ে নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার সঙ্গে স্টেজে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবই যেন পূর্বপরিকল্পিত দৃশ্যপটের মতো। মিলির সাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই আয়োজনের শুরু হবে না। অন্যদিকে, আফ্রিদি পূর্বিকাকে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। পূর্বিকা অস্থির হয়ে বলে উঠল,
——— "তুমি কী করছো আফ্রিদি? বাবা যদি দেখে ফেলে, তবে আর রক্ষা নেই!"
——— "চুপ কর, একদম চুপ! তুই শাড়ি কেন পরেছিস?"
——— "কি?!"
——— "একটি শব্দও না! কেন তুই শাড়ি পরেছিস? এত ছেলেদের ভিড়ে তুই এই শাড়ি পরে আসতে সাহস করলি? আল্লাহ! আমি তা সহ্য করতে পারবো না। তুই এখনই শাড়ি বদলে আসবি। এখনই!"
পূর্বিকা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। শাড়ি পাল্টাতে হবে, এখন? সে ধীরে, ঠান্ডা স্বরে বলল,
——— "একটা দিনের ব্যাপার সোনা, বুঝো। দেখো, আমি কতটা কষ্ট করে সেজেছি। তুমি যদি এমন কর, তাহলে আমার মন খারাপ হয়ে যাবে। প্লিজ সোনা!"
আফ্রিদি অসহায় দৃষ্টিতে পূর্বিকার দিকে তাকিয়ে থাকে; শাড়িতে তাকে যেন অসহ্য সুন্দর লাগছে। তীব্র ঈর্ষার বুদবুদ তার ভিতর ফুঁসে উঠছে। আশেপাশে ছেলেদের ভিড়, এবং তার মধ্যে মুগ্ধও আছে। যদি মুগ্ধ তাকে দেখে মোহিত হয়? আফ্রিদির ভেতরে ঈর্ষার য'ন্ত্রণা আর দম নেওয়ার মতো অবস্থা থাকে না। সে কঠিন দৃষ্টিতে পূর্বিকার দিকে তাকায়, তার কোমল ভঙ্গিমা, ঠোঁট উলটে তাকানো, সবই আফ্রিদির মধ্যে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু এভাবে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়, তার মনে হচ্ছে নজর কারার সম্ভাবনা বাড়ছে। তাই সে বিরক্ত মুখে বলে উঠল,
——— "তুই যা খুশি কর।"
এই বলে তীব্র ক্ষোভে হনহনিয়ে চলে গেল। পূর্বিকা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে, অধরা হাস্যে ঠোঁটের কোণে মৃদু ভাঁজ ফেলে বলে উঠল,
——— "হুহ, অধিক অভিমান দেখাও! যেন আমি বাতাসে মিলিয়ে যাব!"
--
অপরদিকে, আছিয়া তার রূপের পূর্ণ সাজে সজ্জিতা, একখানি শাড়ির অপরূপ আভরণে সেজেছে। তার দুই নয়ন উদগ্রীব, চাতক পাখির ন্যায় প্রত্যাশী, একান্ত তার প্রিয়তম পুরুষের দিকে। জীবন কোথায়? এ কী অনুপস্থিতি, আজ সে কি এলো না? অন্তরের অস্থিরতা ক্রমশ ঘনীভূত হয়, কারণ আজ এই শাড়ি কেবল তাকে দেখাবার জন্যই তার পরিধানে! অস্থির পদক্ষেপে সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, যেন তার হৃদয় এক তৃষ্ণার্ত মরুভূমি। বহুক্ষণ অন্বেষণের পর, তার জীবনকে চোখে পড়ে। শাড়ির কভাকিছু তুলে সে প্রলাপিত প্রেমে পায়ে পায়ে ছুটে চলে। কিন্তু হায়, অমনি থমকে দাঁড়াতে হয়! তার জীবন, তার আত্মার পুরুষ, অন্য এক রূপসীর সঙ্গতিতে, হাত ধরে প্রীতিময় হাস্যে মগ্ন! সেই নারী জীবনের হাত ধরেছে, দুজনেই হাস্যে নিমগ্ন। জীবন, তার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা, অপর এক নারীর সঙ্গে!
আছিয়ার হৃদয় যেন ব্যর্থ হাহাকারে ভেঙে পড়ল। বুকের গভীরে যেন বেদনাময় ঝড়ের তীব্র ঝাপটা লাগে। তার জীবন, তার একমাত্র, অপর নারীর সঙ্গলগ্নে? সে অশ্রু ভেজা চোখে তার দিকে ধীরপদে এগিয়ে গিয়ে কাতর কন্ঠে ফিসফিস করে বলে,
——— "জীবন ভাই..."
তার কণ্ঠে যেন বিষাদের গভীর ছায়া আর হৃদয়ের হাহাকার মিশে। জীবন আছিয়ার কণ্ঠ শুনেই সজাগ হয়ে তার দিকে ঘুরে তাকালো। এক মুহূর্তেই যেন পৃথিবী থমকে গেল, আছিয়ার শাড়িতে মোড়া অবয়ব দেখে জীবনের চক্ষু বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। অপলক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল—চাইলেও সে দৃষ্টি ফেরাতে পারল না। ছোট্ট মেয়েটি আজ যেন তার চেনা আছিয়া নয়, শাড়িতে সে যেন বড় হয়ে উঠেছে, এক অপরূপা নারীতে রূপান্তরিত, তার অশ্রুভেজা চোখের মধ্যে অসীম ব্যথার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে। কিন্তু এই অশ্রু কেন? কেন তার চোখে জল?
আছিয়া ঠোঁট উলটে কঠিন স্বরে বলে উঠল,
——— "আপনি আমার সঙ্গে এমন করতে পারলেন?"
এ কথা বলে, মূহুর্তের মধ্যে আছিয়া দৌড়ে পালিয়ে গেল। জীবনের ভেতরটা কেমন যেন ছটফট করতে লাগল। সে তাকিয়ে রইল মেয়েটার চলে যাওয়ার পথে, কিছু বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল। এই ফাঁকে জীবনের ভাবি তার কাঁধে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,
——— "এই পুচকি মেয়েটা তোকে কী বলে গেল রে?"
ধাক্কার পরেই যেন ধ্যান ভাঙল জীবনের। চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সে ভাবতে লাগল—আছিয়া কি ভুল বুঝল? তার ভাবির হাত তো তার হাত ধরে ছিল! নিজের বড় বোনের চেয়েও বেশি চাচাতো বড় ভাইয়ের বউ! আছিয়া কি ভেবেছে যে জীবন অন্য কারও সঙ্গে মজে আছে? বুকের মধ্যে কেমন যেন বেদনার এক চাপা ঝড় বয়ে গেল জীবনের। কিন্তু সে জানে, নিজের চিন্তায় এই মুহূর্তে ডুবে থাকলে ভুল হবে। আছিয়া যদি এই ভুল বুঝে তার থেকে দূরে সরে যায়, তবে হয়তো সেটাই আছিয়ার জন্য মঙ্গলকর।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জীবন শান্ত স্বরে বলল,
——— "না, কিছু না। বাদ দাও ভাবি!"
কথার মধ্যে এক নিঃশব্দ যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল, যা সে প্রকাশ করতে চাইল না।
--
ইকরাম আলী মোশারফ সাহেবের দুই পরিবারের সবার জন্য পৃথকভাবে আসন নির্ধারিত হয়েছে। সেখানেই কিছু সম্মানিত ব্যক্তিও অবস্থান করছে, যারা পরস্পরে খোশগল্পে লিপ্ত । তবে মোশারফ সাহেবের মস্তিষ্কে কেবলই ঘূর্ণায়মান মুগ্ধর শ্লেষাত্মক বচনসমূহ, যেনো তার হৃদয়বিদারক চিন্তার কণ্টক বিছানো ছায়া। আজ সে প্রতিজ্ঞা করেছে, যে করেই হউক ইকরাম আলীর সহিত তার মুখোমুখি কথা বলবে।
অপরদিকে, রোহান উদভ্রান্তের ন্যায় মুগ্ধকে খুঁজে ফিরছে। মুগ্ধর নিকট জমেছে অগণিত প্রশ্ন, আজ সে জবাব জানবেই, কিন্তু মুগ্ধ হঠাৎ করে উধাও হয়ে রয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে আফ্রিদির সহিত সম্মুখীন হল সে। দেখা মাত্র রোহান তেতে বলে উঠল,
——— "তোর এত ভাব কেন? মুগ্ধ তোকে আসার পর হতে কতবার ফোন দিয়েছে! ধরছিস না কেন? ফোন আবার বন্ধ রেখেছিস কেন?"
——— "ওর সাথে আমার কোনো কথা নেই!"
রোহান কপাল কুঁচকে আফ্রিদির প্রতি কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তার রাগ উগ্র হয়ে উঠল। এ আরেক পা'গল! কোনো কথাই শুনতে চায় না, সরাসরি উত্তেজনায় উত্তীর্ণ হয়ে উঠে। ভাগ্য করে পেয়েছে দুইটি বন্ধুকে; একদিকে এক জন ক্রোধান্বিত বদমেজাজি, আর অপরদিকে একদম পা'গ'লা ক্রোধান্বিত। চোয়াল শক্ত করে রোহান বলল,
——— "একটা অচেনা ব্যক্তিও যদি বারবার কথা বলতে চায়, মানুষ তবুও শুনে আসলে কি কথা!! আর এখানে মুগ্ধ, তোর বন্ধু, তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে! বিষয়টি যে গুরুতর, তা তুই বুঝছিস না?"
——— "দেখ, আমি জানি, ও কোন বিষয়ে কথা বলবে।"
———" আমার বা'ল জানোস, শালা বাইন***!"
আফ্রিদির মেজাজ আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠল। রাগে কণ্ঠে কঠোরতা ভেসে উঠল,
——— "দুইটি ঘু'ষি খেলেই ঠিক হবি!"
রোহান ক্রো'ধিতভাবে প্রতিউত্তরে বলল,
——— " দেখ আমার মনে হয়, পূর্বিকার প্রতি ওর ভালোবাসা আদৌ সত্য নয়! কিংবা তাকে বিয়ে করারো কোনো ইচ্ছা নেই ওর!
আফ্রিদির কপালে ভাঁজ পড়ল,
——— "মানে?"
——— "কাহিনী কিছু ভিন্নতর, পূর্বিকার ছোট বোনকে নিয়ে।"
আফ্রিদি চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কিছুক্ষণ স্থির থেকে বলল,
——— "আঁখি?"
———" হ্যাঁ।"
তখন রোহান আফ্রিদির নিকট সমস্ত ঘটনা উন্মোচন করে বলল, যা গতকাল ঘটেছে। আফ্রিদি বিস্মিত হয়ে শুনল; মুগ্ধ সত্যিই কি সেই কিশোরী আঁখির সহিত এমন কিছু করেছে? তবে কি আফ্রিদি তাকে ভুল বুঝল? তার মস্তিষ্কে হিসাব মিলছে না। আফ্রিদি বলল,
——— "আমাকে ভাবতে দে।"
——— "তুই ভাবতে ভাবতেই ম'র শালা!
এই কথা বলে রোহান আবারও মুগ্ধকে খুঁজতে চলল, আর আফ্রিদি গভীর চিন্তায় ডুবে রইল, সমস্ত ঘটনা মিলাবার চেষ্টায়!
--
এদিকে সকলেই ক্রো'ধে উন্মত্ত, চিৎকার-চেঁচামেচিতে মত্ত। আর কতক্ষণ এমন দাঁড়িয়ে থাকা যায়? মিলি এখনও আসল না কেন? জবেদা বেগম বারংবার তাকে তাড়া দিচ্ছেন! এত সাজগোজের কী প্রয়োজন? আছিয়া মুখ গোমড়া করে বসে ছিল হঠাৎ কিছু স্মরণে আসল! সাথে সাথেই জিভ কামড়িয়ে দ্রুত দৌড়াল বাড়ির অন্তঃপুরে! উন্মত্তের মতো প্রবেশ করল মিলির কক্ষে! দরজা বন্ধ! দরজা ধাক্কা দিতেই মিলি দরজা উন্মুক্ত করল। মিলিকে দেখেই আছিয়ার দৃষ্টিসুধা প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ হল; কাঁচা হলুদের শাড়িতে ফুলের অলঙ্কার দিয়া সুসজ্জিত তাহার দেহসৌষ্ঠব! স্বাস্থ্যবতী গোলাকৃতি মিলিকে দেখেই হৃদয় যেন আনন্দে পূর্ণ হল! যেন সে ফুলকুমারী! ধ্যান ভাঙ্গল আছিয়ার, দ্রুততরক হয়ে বলল,
——— আঁখি কোথায়??
মিলি তার হস্ত দৃঢ়তরভাবে ধরে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়ে নিল! পুনরায় কক্ষের দ্বার রুদ্ধ করল! আছিয়া উদ্বিগ্নভাবে বলছে,
——— "আরে কি করছিস! বাহিরে সকলেই তোর জন্য চেঁচাচ্ছে! কিন্তু আ..."
তার কণ্ঠ থেমে গেলো! বিছানায় ফোলা মুখে বসে আঁখি! কেবল এজন্য নয়! তাহার পরিধেয় শাড়ির জন্য! শ্যামবর্ণী আঁখির গায়ে শাড়ি? আছিয়া প্রথমবার দেখল! দৃষ্টিকে সরাতে পারছে না! এত অপরূপ লাগছে! মুখে কিছুমাত্র সাজ নাই, তবু এ কি অপরূপ সৌন্দর্য! দীর্ঘ ও ঘন কালো কেশরাশি সমুদয় বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে! আছিয়ার বক্ষ ধক করে উঠল, অজানা আতঙ্কে তার শরীর কাঁপছে! আঁখির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই বলল,
——— "ও কে...কে এই শাড়ি পরালো?"
——— "কে পরালো মানে? আমি পরিয়েছি! হুহহ, সে নাকি পরবে না, সুতরাং টেনে এনে আছাড় মেরে শাড়ি পরিয়ে দিলাম! এত দেরি এই কারণে হল! চল এখন চলি! সব কিছু এখন ঠিকঠাক আছে!
আছিয়া কষ্টে ঢোক গিলে বলল,
——— "এটা কি করেছিস? কেন করেছিস? আজকে আমার খবর আছে!"
এই বলেই আছিয়া আঁখির নিকটে গিয়ে বলল,
——— "বইন, যদি শাড়ি পরার ইচ্ছা না থাকে তবে খুলে ফেল! তোর শরীর খারাপ হতে পারে! "
আছিয়ার বাক্য শুনেই আঁখির মুখে একপ্রকার আনন্দের আলো ফুটে উঠল! বলল,
———" হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও তো তাই বলছি! কিন্তু এই ফুটবল আমাকে তুলে এনে শাড়ি পরিয়েছে!"
——— "থাক, আমি তোর জন্য তোর সেই ঘাঘরা এনে দিচ্ছি! ওটা শাড়ির থেকেও বেশি সুন্দর!"
মিলি তাদের বাক্য শুনে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল,
——— "কি বললি তোরা? তোদের এত সাহস! আমি নিজে বিয়ের কনে হয়ে সাজিয়ে দিলাম, আর তোরা সকল কিছু নষ্ট করতে চাচ্ছিস? তোদের দুইটাকে তুলে আ'ছাড় মে'রে বেগুন ভর্তা বানাবো আমি!"
আঁখি ও আছিয়া ভয়ে মিলির দিকে চাইল! তখনই দরজায় প্রবল ধাক্কা পড়ল! হিরা ক্রো'ধে কেপে চিৎকার করছে,
——— "এই মিলি, তুই কি করছিস? তোর সাজ শেষ হয়েছে এক ঘণ্টা আগেই, এখনো রুমে কী করছিস?"
হিরার চিৎকারে সাড়া দিয়ে মিলি দ্বার উন্মুক্ত করল। হিরা প্রবেশ করেই অগ্নিদৃষ্টিতে চাইল তার দিকে, শাড়ি পরে সজ্জিত হলেও, এই কন্যার কারণে সকল আয়োজন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে মিলির করতল ধরে বলল,
———" চল, তোর অপেক্ষায় সকলেই আছে!"
এই বলেই মিলিকে একরকম টেনেই বাহিরে নিয়ে গেল হিরা। মিলি যাবার পূর্বেই দৃষ্টির ইশারায় আছিয়া ও আঁখিকে আসারর আহ্বান জানিয়ে গেল। আছিয়া একবার আঁখির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, "এত কি করে রূপের প্রাচুর্য লাভ করল?" আসলেই, কথা যথার্থ ছিল। ইশ, আমার তো একটুও খেয়াল ছিল না! এরূপ কিছু অবান্তর চিন্তা করে আছিয়া আঁখিকে উদ্দেশ করে বলল,
——— "আয়!"
এখন আঁখি আর কিবা করতে পারে? বাল্যসখীর বিবাহ বলে কথা! যেতে তো হবেই! তথাপি, একটুখানি সময় নিয়ে হিজাব সংযোজন করল মস্তকে। আছিয়া তার হস্ত ধরে কোলাহলপূর্ণ গৃহ হতে পেছনের নীরব প্রান্তে আনল। আঁখি বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল,
——— "তুই আমাকে এখানে কেন আনলি?"
আছিয়া অশ্রুসিক্ত নয়ন ও বিহ্বল মুখে বলল,
——— "তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা বলার আছে!"
আকস্মাৎ আছিয়ার অশ্রুসিক্ত চক্ষু দেখে আঁখি চমকে উঠল। উত্তেজিত হয়ে বলল,
——— " কি হয়েছে, আমাকে বল?"
আছিয়া কিছু বলিবার পূর্বেই তার দৃষ্টি আঁখির উন্মুক্ত হাতের পৃষ্ঠদেশে গিয়ে স্থিত হল। হাতে কালো লম্বাকৃতি ক্ষত দাগ কেমন জমাট বেধে আছে! ভ্রু কুঁচকে আছিয়া বলল,
——— "তোর হাতে এই দাগ কিসের?"
আঁখি নিজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। শাড়ি পরার দরুণ ব্লাউস এর কনুই এর উপর পর্যন্ত হাতা! খোলা হাতে চাবুকের দাগ স্পষ্ট ! এই কারণেই শাড়ি পরতে চাচ্ছিল না; এত প্রশ্নের উত্তর দিবে না সে! এটা গোপন, এটা নাটক! তথাপি, আঁখি হেসে বলল,
——— "কিছুই না! পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিলাম। কিন্তু তুই বল, তোর কি হয়েছে?"
আছিয়া আঁখির কথায় সন্তুষ্ট না হলেও বিষয় টা পার্তা না দিয়ে বলল,
——— " এই তুই এখানে একটু থাক, আমার না বেশ জোরে প্রকৃতির ডাক পেয়েছে! ওয়াশরুম থেকে আসছি, থাকিস এখানে আচ্ছা?
আছিয়া দৌড়ে চলে গেলো! আজব মেয়ে! আঁখি প্রকারান্তরে স্থবির রইল। কেমন শাড়ি পরে গরম লাগছে! এসব পছন্দও নয় তার! হাশফাশ শুরু করলো আঁখি! করণীয় কী, এ অবশিষ্ট মনে না আসতেই সে প্রস্থান করার জন্য পদক্ষেপ করল। তার নৈঃশব্দ্যে হঠাৎ করেই প্রবেশ করল একশব্দিক কোলাহল—কতিপয় ক্ষুদ্রাকার, পিচ্চি-কণ্ঠের হাস্য-উল্লাস, যেন দিগন্ত বেয়ে তার দিকেই ধাবমান। আঁখির ভ্রু কুঁচিত হল। দৃশ্যতঃ শিশুর দল বালতি হাতে উন্মাদপ্রায় সেই মুহূর্তে তার সম্মুখে এসে উপস্থিত হল।
কোনো চিন্তাপ্রক্রিয়া বা প্রতিরোধের অবকাশ না দিয়েই একযোগে হুট করে, একদম হুট করেই, ধপাশ করে আঁখির গায়ে নিক্ষিপ্ত হল স্নিগ্ধ মাটির গন্ধময় জলধারা। বালতি বালতি সমেত কাদামিশ্রিত জল এক প্রবাহে তার দেহাবয়ব আচ্ছাদিত করে দিল। আঁখি নিস্তব্ধ, নিরব; কী হইল এটা??, সে বুঝতেও পারল না। শিশুগণ হাস্যকোলাহলে উদ্দীপ্ত অয়ে যেভাবে আসল, বালতি রেখে তেমনি দৌড়ে চলে গেলো।
আঁখি সেখানেই রোবটের মতো দাঁড়িয়ে, স্থাণু ন্যায়, সমগ্র শরীরে কাদার মাখামাখিতে আচ্ছন্ন। বাক্যহীন হয়ে, মনের মধ্যে একটি প্রশ্নমালার কুণ্ডলী পাকিয়ে চলল—এ কি ঘটল, কার জন্য ঘটল, আর কেন বা ঘটল? যেন কেও ব্যাঙ্গাত্তক করে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সূরের তালে গাইছে,
আঁখি নির্বাক, গায়ে কাদার স্রোত বইছে। সমস্ত শরীর কাদায় মাখামাখি, শাড়ির বর্ণ আর না বলাই শ্রেয়— হলুদের পরিবর্তে এখন যেন কফির কালো আভা। সে এক গভীর ভাবনাহীনতায় দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে, মুগ্ধ যেন অজানা দিক থেকে আবির্ভূত হলো। ঠোঁটের কোণে এক তাচ্ছিল্যের হাসি। মুগ্ধকে দেখেই আঁখির বোধ ফিরে এলো, সাথে সাথে গতদিনের স্মৃতিও মাথায় বিদ্যুতের মতো চমকে উঠল। রাগ যেন তার র'ক্তে জ্বলে উঠল। কালো পাঞ্জাবিতে বলিষ্ঠ মুগ্ধ, হাতে পাঞ্জাবির আস্তিন গুটিয়ে ধীরে ধীরে আঁখির দিকে এগিয়ে এলো। তার কাছে এসে সোজা ঝুকে কানের কাছে ঠোঁট এনে উত্তপ্ত শ্বাসে কন্ঠ খাদে এনে ফিসফিস করে বলল,
——— "আহা, কাদাবতী! প্রকৃতির কুশল-হীন হাত তোমার রূপকে কাদার বর্মে আবৃত করে দিয়েছে। বিশ্রীতায় তুমি আজ যেন কাদার রাজ্যে অধিষ্ঠিতা, যাকে দেখে পরিহাসেরও মুখ বেঁকে যায়!"
আঁখি তীব্র ক্ষোভে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো, মনের গভীরেও যেন মেঘ জমে উঠল। এই লোকটা কি কেবলই মজা করছে? রাগে ফুঁসে উঠে চলে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল, এমন সময় মুগ্ধর চোয়াল দৃঢ় হয়ে উঠল, কণ্ঠে অভিজাত শীতলতা,
——— দাঁড়াও, মেয়ে!
আঁখি থমকে দাঁড়াল। পেছন ফিরে তাকালো জ্বলন্ত দৃষ্টিতে, যেন চোখের লাল আভায় আগুন জ্বলে উঠেছে। মুগ্ধ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আবার আঁখির কাছাকাছি গিয়ে মৃদু ঝুঁকে বলল,
——— "এই শিখার দীপ্তিই তো আমি প্রত্যাশা করেছিলাম!"
——— " সাবধান! এ শিখা ছুঁতে গেলে আপনি নিজেই দগ্ধ হবেন। "
——— "তুমি কী তবে ছাইকে দহনের ভয় দেখাতে চাচ্ছো?"
——— " না, ফুঁয়ের স্পর্শে আমি একে বিলীন করে দেব।"
——— "হা হা, বোকা মেয়ে! একসূত্রে বাঁধাকে, তোমার ফুঁতে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছো?
——— "একতার বল জাগাতে যেন না পারে, বিচ্ছিন্ন করে তবেই পরাভূত করব! হা হা, বোকা পুরুষ, বুঝছেন না ?? "
——— "হাহাহা! চতুর! তবে জেনে রেখো, পৃথক করে ছড়ালে তা দ্বিগুণ শক্তিতে ফিরে আসে।"
——— "তিনগুণ আসুক!"
——— "মানো বা না মানো, সময়ের তীর ইতোমধ্যেই এসে দাঁড়িয়েছে।"
——— "ধরব কেন? বলছি তো, সে আগেই এসে উপস্থিত!"
——— "প্রস্তুত হও! এই পরিণতির বাণী আমার কলমেই রচিত হয়েছে। এ লিপি চিরন্তন, কোনো শক্তিই তা বদলাতে পারবে না— এমনকি এই গল্পের স্বয়ং রচয়িতাও নয়!"
আঁখির দৃষ্টি যেন অ'গ্নি বয়ে নিয়ে এল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মুগ্ধর দিকে নিবদ্ধ। মুগ্ধ ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে একবার চোখ বুলালো। বালতির দিকে নজর পড়ল, যেখানে কাদাপানির কিছু অংশ এখনও অবশিষ্ট । শিশুরা ঠিকমতো ছুড়তেও পারেনি, তাই সেই পানি এখনো বালতিতে অর্ধেক রয়ে গেছে। মুগ্ধর ঠোঁটে এক ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটে উঠল। হঠাৎ করে, কোনো হুঁশ ফিরতে না দিয়েই, সে বালতি তুলে নিল। এক মুহূর্তেই অবশিষ্ট কাদাপানি ঢেলে দিল আঁখির মাথায়। মুহূর্তেই হিজাব ভিজে গেল, কাদার গাঢ় স্রোত মুখ বেয়ে চুইয়ে পড়তে লাগল। আঁখি আরও একবার নিঃশব্দে চমকে উঠল মুগ্ধর আচরণে।
মুগ্ধ ফের বাকা হাসিতে আবারো আঁখির সামনে ঝুঁকল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সগর্বে আরো অবলোকন করলো সপ্তদশী শ্যামবতী কন্যার মুখশ্রী, যেখানে কাদার আস্তরণ ঠোঁট, গাল, নাসায় আছড়ে পড়েছে, যেন এক বিষণ্ণ চিত্রশিল্পীর শিল্পকর্ম। মুখশ্রীতে ছড়িয়ে পড়া কাদার বর্ণিল শোভা প্রতিটি রেখায় যেন জীবন সংগ্রামের গল্প বুনে চলেছে। কন্যার মায়াময়ী অক্ষিযুগল বারবার তার ঘন পাতা ঝাপটিয়ে নষ্ট করে দিচ্ছে সেই সিক্ত চিত্রাবলী। মুগ্ধ কানের কাছে তপ্ত শ্বাস ছুঁয়ে ফিসফিস করে ফের বলল,
——— " চুনোপুঁটির স্থান কাদায়ই সঙ্গত, মহাসাগরের গভীরে তার অস্তিত্ব কেবল তুচ্ছই বটে।"
জোড়ে শ্বাস ফেলে,
——— "ক্ষুদ্র জীবের সীমা কাদাতেই, সেখানেই তার সাম্রাজ্য— বড় জলে তো তার কেবল অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার শঙ্কা!"
মুগ্ধ, নির্বিকার ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নির্বিচারে এক নিঃশব্দ যাত্রা শুরু করল, যেন চারপাশে ঘটে চলা ঘটনার কোনো মূল্যই নেই তার কাছে। অন্যদিকে, আঁখির সমস্ত সত্তা রা'গের আ'গুনে জ্বলে উঠেছে, শরীরের প্রতিটি শিরা যেন উত্তপ্ত লাভার মতো ফুঁসে উঠছে। চোখ দুটি ছুটে গেল চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বালতিগুলোর দিকে, যেগুলোতে কাদাজল জমে আছে যেন তার প্রতিশোধের নিঃশব্দ সৈনিক। দ্রুত হাতে সেই বালতিগুলোর অবশিষ্ট কাদাজল একত্রিত করল, যেন আদি প্রতিশোধের অগ্নিবাণ প্রস্তুত করছে সে।
বালতি হাতে নিয়ে রাগে দিগন্তরেখা স্পর্শ করতে করতে চিৎকার করে উঠল, কণ্ঠ যেন বিদ্যুৎ ছিন্ন করতে চায়,
——— " থামুন! ওখানেই দাঁড়ান!"
কণ্ঠের বিস্ফোরণে মুগ্ধ থেমে গেল, ধীরে ধীরে ভ্রু কুঁচকে পেছনে ফিরে তাকাল। দৃষ্টিতে অবজ্ঞার নিঃশব্দ ছায়া। কিন্তু আঁখি থেমে থাকার নয়, ক্রো'ধে ফেনায়িত হয়ে সে বালতিভর্তি কাদাজল ছুঁড়ে দিল মুগ্ধর ফর্সা মুখমণ্ডলে। কাদার আঘাতে যেন ধুয়ে গেল মুগ্ধর মুখের অহংকার, ক্ষণিকের জন্য তার চোখদুটি যেন কাদার অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। হাত দিয়ে চোখ ডলতে লাগল মুগ্ধ, কাদা মাখানো মুখমণ্ডল, পাঞ্জাবির শুদ্ধতা যেন এক মুহূর্তে মলিন হয়ে গেল।
তবে এই অবমাননার প্রতিক্রিয়া যেন আ'গ্নেয়গিরির মতো ফুটে উঠল মুগ্ধর অভ্যন্তরে। চোয়াল শক্ত হলো, দৃষ্টি হয়ে উঠল কঠিন, নির্দয়, মুঠি শক্ত হয়ে ক্রো'ধের অতলস্পর্শী এক ঝড় যেন জমাট বাঁধল তার রক্তে।
আঁখির দিকে তাকিয়ে তার চোখের র'ক্তিমবর্ণ আগুন যেন স্পষ্ট বার্তা বহন করল,
0 Comments