লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
মিলি ক্রমাগত হলুদের স্পর্শের ঝঞ্ঝাটে একপ্রকার অতিষ্ঠ, যেন প্রতিটি হাতের আঘাত তার ধৈর্যের সীমারেখা ভেদ করে। বসে আছে স্থির দেহে, অথচ অন্তরের অভ্যন্তরে তোলপাড়। দুই ঘণ্টার অধিককাল ধরে এই নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার তাকে নিস্তেজ করে তুলছে।
--
ইকরাম আলী ও মোশারফ সাহেবের মধ্যে এক উত্তাল সাক্ষাতের শুরু । এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখের বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময়ের আবহাওয়া রুদ্ধশ্বাস, যেন এই নির্জন প্রাঙ্গণ প্রতিটি উত্তপ্ত শ্বাসকে শোষণ করছে । ইকরাম আলীর মুখে এক প্রকার কুটিল হাসির রেখা, অন্তরে প্রশ্ন—কেন এই আহ্বান?
মোশারফ সাহেব, নিজের গম্ভীর কণ্ঠে, বললেন,
——— "যা ঘটেছে, তা পিছে ফেলে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ করা উচিত।"
ইকরাম আলীর ভ্রু সংকুচিত হলো, ঠোঁটে বিদ্রূপাত্মক হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,
——— "কিসের কথা ভুলতে বলছিস?"
মোশারফ সাহেব ধৈর্যের বাঁধ টেনে বললেন,
——— "তুই বোকা না, ইকরাম। সব বুঝতে পারছিস।"
ইকরাম আলী মৃদু হাসির আড়ালে বললেন,
——— "সোজা কথা বল, কেন ডেকেছিস?"
মোশারফ সাহেবের কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল,
——— "আমার পুত্রের সাথে তোর কন্যার বিবাহের প্রস্তাব দিতে এসেছি।"
ইকরাম আলীর মুখমণ্ডলে এক মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের ছাপ পড়ল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে বাকা হেসে বললেন,
——— "তোর বোনকে কি আমার হাতে তুলে দিতে পারবি? ফিরিয়ে দিতে পারবি?? "
মোশারফ সাহেবের চোখ অ'গ্নি'ময় রাগে জ্বলে উঠল। তিনি বললেন,
——— "পুরোনো ইতিহাস টানিস না, ইকরাম! আজ সম্পর্ক ঠিক করার জন্যই এসেছি।"
ইকরাম আলী তার মুখে এক প্রহসনমূলক হাসি রেখে বললেন,
——— "সেদিন আমি তোর পায়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তুই আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিলি।"
মোশারফ সাহেব ক্রো'ধে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
——— "আর তুই আর তোর বাবা আমার পরিবারের গৌরব হরণ করেছিলি। আমার বাবা মৃ'ত্যুর কারণ ছিলি!! আমার বোনের সম্মান চূর্ণ করেছিলি!"
মুহূর্তের জন্য স্থির থেকে মোশারফ সাহেব বুঝলেন যে এই পুরোনো তর্ক টেনে লাভ নেই। তিনি প্রথমবারের মতো নিজের গর্ব ভেঙে বললেন,
——— "আমরা অতীত ফিরিয়ে আনতে পারব না, ইকরাম। তবে চল, বেয়াই হয়ে যাই। সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় শুরু করি।"
ইকরাম আলী গভীর চিন্তায় মুগ্ধের চরিত্র বিশ্লেষণ করলেন। যদিও অতীতের কিছু ক্ষোভ রয়ে গেছে, মুগ্ধ সেদিন পূর্বিকাকে বখাটেদের কবল থেকে উদ্ধার করেছিল। তিনি মনস্থির করে মোশারফ সাহেবের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
——— "আমি সম্মতি দিলাম।"
তবে উভয়ের মুখে এক তীর্যক হাসির রেখা রয়ে গেল। মনে মনে মোশারফ বললেন,
——— "তোর মেয়েকে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিবো? তবে যেন তার ভাগ্যও আমার বোনের মতো না হয়। তবেই বুঝবি বাড়ির মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা উঠলে কেমন অন্তর পুরে! "
ইকরাম আলীও নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করলেন,
——— "তুই কি ভেবেছিস? এত সহজে আমি হার মেনে নেবো? তোর ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো? তুই আমাকে এখনো চিনিস না।"
____
মিলি মঞ্চের একপ্রান্তে নিদ্রাকাতরভাবে আসীন, চারপাশে আনন্দময় উৎসবের প্রবাহ, নৃত্যের তাল-লয়ে মা'তা'ল এক প্রাঙ্গণ। অল্প কিছুক্ষণ পূর্বেই ফাহাদের সহিত তার কণ্ঠস্বরে মৃদু আলাপনের অবসান ঘটেছে। হঠাৎ হীরণ ধরণীতলে মিলির সম্মুখে উপস্থিত হল, আর মিলির মুখে করুণ হাসির এক ক্ষীণ রেখা ফুটে উঠল। হীরণ বহুক্ষণ ধরে মিলির নরম গোলাকার গাল স্পর্শের আশায় প্রতীক্ষায় ছিল, সেই প্রতীক্ষার প্রহর যেন এক অনন্তকাল নিয়ে এসেছে। কিন্তু অতিথিদের ক্রমাগত আগমন, হলুদের প্রলেপ দান, তাকে স্পর্শের সম্ভাবনাকে ক্রমশই বিলম্বিত করছে।
মিলি আর সহ্য করতে পারল না, উদ্দীপ্তস্বরে বলে উঠল,
——— "আর হলুদ লাগিও না ভাই, আমার বিরক্ত লাগছে!"
তার সমগ্র মুখশ্রীতে হলুদের লেপনের শুভ্র আভা, বাহুর প্রান্তেও সেই আভা ছড়িয়ে পড়েছে। এই বাক্য শুনতে হীরণের অন্তরে একদম উত্তপ্ত রো'ষের স্ফুলিঙ্গ প্রজ্জ্বলিত হল। এতক্ষণ তার যে স্পর্শের আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা যেন শূন্যে মিলাতে চাইল। তথাপি, সে মৃদুহাস্যে মুখে বলল,
——— "তোর গায়ে হলুদে আমি হলুদ লাগাব না; এমন তো কখনো হয় না!"
এই বলে বাটিতে অবশিষ্ট সামান্য হলুদের অংশ তুলে নিল। যদিও তার ইচ্ছা অন্য কিছু, তথাপি সে সুকৌশলে মিলির কোমল মুখমণ্ডলে স্পর্শ করল। তৎপর নিপুণভাবে মিলির হাতের উন্মুক্ত প্রান্তে স্পর্শ করে হস্তঘর্ষণ করল।।
কিন্তু মিলির অন্তরে ক্রমশ অসন্তোষের এক সুতীক্ষ্ণ কাঁটা বিঁধতে লাগল। সে এক আকস্মিক ঝাঁকুনিতে তার বাহু সরিয়ে নিয়ে বলল,
——— "হইছে ভাই, আর দেওয়া লাগবে না! "
হীরণ নিঃশব্দে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিন্তু কোনো বাক্য উচ্চারণ করলো না, স্থানও ত্যাগ করলো না; বসে রইল সেথায়। মিলির অন্তরে তখনই রো'ষের স্ফুরণ ঘটল যখন আঁখি ছুটে এসে পৌঁছল। মমতায় সাজিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল তাকে, কিন্তু গোটা অনুষ্ঠানজুড়ে সে একেবারেই অনুপস্থিত! আর এখন হাজির হয়েছে এক লম্বা গোলাকৃতির পোশাকে, শাড়ির কোন চিহ্ন নেই! মিলির মনে হলো, আঁখি ইচ্ছাকৃতভাবে আসেনি। অন্য সবাই হাসি-আনন্দে মেতে ছবি তুলেছে, কত সুন্দর ভিডিও বন্দি করেছে; অথচ তার প্রিয়তম সখী অনুপস্থিত ছিল! এই আক্ষেপ ও অভিমানে মিলি মুখ ফিরিয়ে নিল।
আঁখি বুঝল, মিলির অভিমান অতি স্বাভাবিক। এমন একটি মুহূর্তে সখীকে পাশে না পেলে হৃদয়ের গভীরে শূন্যতা জমে। কিন্তু সে ইচ্ছাকৃতভাবে আসেনি এমন নয়। গোসলের পর শাড়ি পরিষ্কার করতে করতে সময় কেটে গেছে, আর ভিড়ের মাঝে জায়গা না পাওয়ায় দেরি হয়েছে। তবুও, হয়তো কিছুটা ইচ্ছা করেই সে বিলম্ব করেছে; গোসলের মধ্য দিয়ে সমস্ত রা'গ ও অসন্তোষ ধুয়ে ফেলতে চেয়েছিল।
আঁখি শিশুর মতো কান ধরে মিষ্টি সুরে বলল,
——— "ভুল হয়ে গেছে বনু, মাপ করে দে!"
মিলি অবজ্ঞায় তাকিয়ে বলল,
——— "এখন এসে কোন মুখ দেখাচ্ছিস? যেখানে ছিলি, সেখানেই যা!"
আঁখি মিথ্যার আশ্রয় নিল,
——— "হঠাৎ শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিশ্বাস কর!"
——— "না, করব না! যা গিয়ে ঘুমা!"
——— "ঘুম তো শেষ! তাই এলাম!"
——— "বিয়ের পরেই না হয় আসতে পারতি! এখন তোর স্বামীর সামনে চেহারা দেখাতে এসেছিস?"
আঁখি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বুঝল এভাবে মিলির অভিমান ভাঙানো যাবে না। কৌশল প্রয়োগ করেই তবে কিছু হবে। একটুখানি দুষ্টুমি নিয়ে মিলির দিকে চাইল। মিলি এই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারল না। আঁখি হঠাৎ মিলির গায়ে আঙুল চালিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল,
——— "ভুল তো হয়েই গেছে, রাগ করিস কেন?"
মিলি বাধ্য হয়ে হেসে উঠল,
——— "আহ আঁখি! কী করছিস এসব?"
——— "না, আগে বল, আমাকে ক্ষমা করেছিস?"
হাসিতে ভেঙে পড়ে মিলি বলল,
——— "আচ্ছা, আচ্ছা, ছাড়! হয়েছে, ক্ষমা করলাম!"
তাদের এই কৌতুক মুহূর্ত হাসির উল্লাসে ভরে গেল, দুজনই অট্টহাস্যে মেতে উঠল। আঁখির দুষ্টামি বাড়তে থাকলে মিলি পেটে হাত দিয়ে হাসতে লাগল। আশেপাশের সবাই তাদের দিকে চেয়ে ছিল, যেন তাদের বন্ধুত্বের পবিত্রতা প্রতিফলিত হচ্ছে সবার চোখে।
মনে পড়ল, কাল থেকেই মিলি আর থাকবে না—শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবে। এই ভাবনায় অন্তরে আনন্দ ও বিষাদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ বাজল।
হিরা বিরক্তির চিহ্ন নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে এসব দেখছে । সে মুগ্ধকে খুঁজছে, কিন্তু এখনও দেখতে পায়নি। মুগ্ধ কি আদৌ এসেছে? এখন মনে হচ্ছে, তার ফোন নম্বরটা নেওয়া দরকার!
হীরণ সেই মুহূর্তে যেন এক দুষ্ট প্রবৃত্তির বশবর্তী, তার অন্তর্গত ক'লুষতা নিষ্করুণভাবে মিলিকে বাদ দিয়ে এবার আঁখির দিকে অগ্রসর হলো। এটাই তো সেই ক'চি মেয়েটা! হীরণের হারানো শিকার! পাশে বসে পড়লো সে। আঁখির অস্তিত্বের পার্শ্বে যখন তার হীরণের কালো ছায়ার আবেশ নিকটে এলো, আঁখি টেরই পায়নি! কিংবা এত পার্তা দেয় নি। আঁখির অবয়ব যেন মধুর কোমলতায় মোড়ানো, তপস্বিনীসুলভ শুচিতা তার সদ্য গোসল করা শরীরে বয়ে চলেছে, আর এই পূতিমাখা সুগন্ধ হীরণের মর্মে আগুন ধরাচ্ছিল। চোখ বুজেই শুষে নিচ্ছে সে ঘ্রাণ যেন না ধরা ছোয়ার বাইরে শুকে নিচ্ছে অঙ্গ-প্রতঙ্গ। তার দৃষ্টি তখন ধীরে ধীরে হিং'স্র শকটে রূপান্তরিত হতে লাগল, প্রতিটি ইন্দ্রিয় যেন আঁখির প্রতি পৈ'শা'চিক লা'ল'সা'র অতল গহ্বরে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আঁখি উঠে দাঁড়ায় সাথে মিলিও। এবার মিলিকে ঘিরে উৎসবমুখর জনতা, দাদি-নানিদের গোসলের আয়োজনের মধ্যে মগ্ন । সকলেই মিলিকে ধরে গীত গাইতে গাইতে নিয়ে গেলো।
কিন্তু এই উচ্ছ্বাসমুখর মুহূর্তের অন্তরালে, আঁখির মনের অস্থিরতা তখন আছিয়ার অদৃশ্য উপস্থিতি নিয়ে বিক্ষিপ্ত । আছিয়ার জন্যই এসব ঘটেছে!
ঠিক সেই মুহূর্তে হীরণের কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ ও নিষ্ঠুরভাবে আঁখির দিকে ধাবিত হলো, যেন কোনো হিংস্র প'শু'র নিঃশব্দ গর্জন,
——— "এই পিচ্ছি, শোনো!"
আঁখি থমকে দাঁড়াল, চোখে বিস্ময়ের রেখা, কাকে ডাকছে সে? হীরণ অম্লানভাবে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
——— "তোমাকেই তো ডাকছি!"
আঁখির মন শিহরিত হলো, 'পিচ্ছি' উপাধির অর্থ কী?? হীরণ আবার এক পদক্ষেপ এগিয়ে এলো, তার মুখে লো'লু'প হাসি,
——— "তোমার নাম কি?"
আঁখি ভেবে দেখল, এই লোকটি শুধু মিলির ফুফাতো ভাই, এর বাইরে সে কিছুই জানে না। তার উত্তর নরম স্বরে বেরিয়ে এলো,
——— "আঁখি।"
হীরণের মনে তখন এক কুৎ'সি'ত পরিকল্পনার বীজ অঙ্কুরিত হলো, তার চোখে শয়তানি ঝিলিক। মুখের কোণে একধরনের বিদ্রূপের ছাপ রেখে সে বলল,
——— "মিলি তো বলল, ওর কানের দুল হারিয়ে গেছে; ওর রুমেই বোধহয়! সবাই খুঁজছে, কেউই পাচ্ছে না। তুমি একটু সাহায্য করবে?"
আঁখি একটু অবাক হলো বটে। মিলি তো এ কথা কখনো বলেনি! হীরণ আবার কথার জালে আঁখিকে জড়াতে চাইল,
——— "মিলি আগেই বলেছিল তোমাকে বলতে। এতক্ষণ তো তুমি ছিলে না তাছাড়াও বিয়ে বাড়ি বুঝোই তো; জানাজানি হলে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। এখন বাড়িতে কোলাহল নেই ; গিয়ে খুজলে পেতে পারো! "
আঁখি অবিচলিতভাবে ভাবল, মিলির ভাই মিথ্যে বলবে না। সুতরাং, কিছুটা অস্বস্তি হলেও সে বিশ্বাস করে বলল,
——— "আচ্ছা, আমি খুঁজতে যাচ্ছি।"
ঠিক যখন আঁখি সরে যেতে চাইল, হীরণ তার কোমল হাতটা ধরে ফেলল। আঁখির চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক, তবে সঙ্গে সঙ্গেই ক্রোধে তার র'ক্ত টগবগিয়ে উঠল। কোনো কিছু বলার আগেই হীরণ হাসি চাপিয়ে বলল,
——— "সামনেই ইট ছিল, পায়ে লাগতে পারতো, তাই ধরেছি।"
এই কথা শুনে আঁখির চোখ কঠোর হয়ে গেল। সে তার হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলল,
——— "আমার চোখ আছে! দ্বিতীয়বার এমন ভুল করার সাহস করবেন না।"
এই বলেই আঁখি দ্রুত চলে গেল, চলায় এক দৃঢ় প্রত্যয়ের আভাস। হীরণ সেই দৃঢ়তাময় তেজ দেখে তীব্রভাবে মোহিত হলো, তার চোখে অন্ধকারের ঝিলিক। সে তার হাত শুঁকতে লাগল; যে হাতে সে আঁখিকে স্পর্শ করেছিল; যেন সেই ছোঁয়ায় মোহিত হয়ে গিয়েছে। তারপর, শয়তানি হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল।
——— "আহ্, এর শরীরের গন্ধ; যেন ম'দিরা (ম'দ)!"
তবে মুহূর্তেই তার মুখ কঠিন হলো, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, আর সেই কঠিন মুখে বিকৃত এক হাসি ঝিলিক মারল। ফিসফিস করে সে বলল,
——— "তেজ দেখাচ্ছো, শুধু হাত ধরার জন্য? অপেক্ষা করো, যখন রুমে ঢুকব, তখন আর কোনো ইঞ্চিও বাদ যাবে না! এমন কিছু করব, যে মুখ দেখানোর সাহসও থাকবে না!"
__
ইকরাম আলীর অন্তর ক্রো'ধের তপ্ত অগ্নিতে পুড়ে অঙ্গার। মিলির পিতার সহিত বিদায় বিনিময়ান্তে বাড়ির প্রাঙ্গণ অতিক্রম করার মুহূর্তে, তার দৃষ্টিগোচর হল বাড়ির কন্যা— আঁখি আজ যেন কারো— হীরণের ম্লান ক'ল'ঙ্কে'র আঁচড়ে বিভ্রান্ত। ইকরাম আলীর হৃদয়ে বিদ্যুতের মতো এক কঠোর প্রতিজ্ঞা ঝংকার তুলল— এই মেয়ে অবাধ্যতায় অধিক মাত্রায় বিপথগামী হয়েছে, এবং শাস্তির ন্যায়বিচারই এখন একমাত্র পথ। তার অভিপ্রায় দৃঢ় হল, তাকে যদি দণ্ডপ্রদান করা না হয়, তবে হীনতার দুর্বৃত্তি ক্রমেই বৃহত্তর হয়ে উঠবে, এবং সেই লজ্জার মুকুট পরিয়ে দেওয়া হবে ইকরাম আলীর মাথায়; যা ইকরাম আলী হতে দিবে না!
__________
হিরা শুষ্ক মরুর পিপাসিত পাখির ন্যায় সারাক্ষণ মুগ্ধর সন্ধানে নিজ চক্ষু ঘুরাচ্ছে। বিশাল জনস্রোতে মুগ্ধর দেহাবয়ব যেন একমাত্র চুম্বক, যার প্রতি তার আকর্ষণ অমোঘ ও অবিচল। ছবি তুলবার ক্রমাগত ব্যস্ততায় মুগ্ধর দেখা পায় নি, কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে, তার সমগ্র মনোযোগ সেই ব্যক্তির উপস্থিতির প্রতি নিবদ্ধ । যখন অবশেষে মুগ্ধের অস্তিত্ব খুঁজে পেল, তার দৃষ্টিগোচর হল এক বেদনাবিধুর দৃশ্য, যা তাকে স্তব্ধ করে দিল।
মুগ্ধ কঠোর মূর্তির ন্যায় চেয়ারে বসে আছে , পায়ের উপর পা তুলে , কঠিন মুখের রেখায় চোয়াল শক্ত করে । পাশেই রোহান, বিস্ময়চকিত দৃষ্টিতে সবকিছু প্রত্যক্ষ করছে। তাদের সম্মুখে আছিয়া, নির্ভীক চক্ষুতে করুণ জলধারা ভাসিয়ে, শাস্তির নীরব মূর্তি ধরে উঠবস করছে; কানে ধরা তার শাস্তি, আর তার অশ্রুধারা যেন একটি নির্জন ঝর্ণার মতো নিঃসীম নীরবতায় নত হচ্ছে।
——— "৯৭,,,,৯৮,,,৯৯,,১০০ …"
একশোবার পূর্ণ করে আছিয়া শাস্তির শেষ অধ্যায় সম্পন্ন করল। তখনই জীবন সেই স্থানতলে আগমন করল। আছিয়ার অশ্রু বিস্তৃত হল, তার চক্ষুতে জীবনের উপস্থিতি যেন অধিকতর বেদনার ছায়া বেষ্টন করল। কোনোরূপ বাক্য বিনিময় না করেই আছিয়া চুপিসারে দৌড়ে চলে গেল, অনবরত অশ্রু যেন কেবল শোকের মৌন প্রতীক।
রোহান বিস্ময়বোধে মুগ্ধের প্রতি দৃষ্টিপাত করে জিজ্ঞাসা করল,
——— “ভাই, এত নির্দয় কেন হলি? বাচ্চা মেয়েটারে দিয়ে ১০০ বার উঠবস করাইলি?”
মুগ্ধের কণ্ঠে তীক্ষ্ণ কঠোরতা প্রতিধ্বনিত হল,
——— “এই শাস্তি অনিবার্য ছিল।”
রোহান নির্বাক রইল, মুগ্ধের এই অননুভূতিমূলক কঠোরতা তার হৃদয়গ্রাহী হল না। জীবন মুগ্ধের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গম্ভীর সুরে প্রশ্ন করল,
——— “স্যার ডেকেছেন?”
মুগ্ধ তার দিকে তাকিয়ে একই রকম কঠিন স্বরে উত্তর দিল,
——— “হ্যাঁ।”
মুগ্ধ ধীরে দাঁড়ালো, যেন তার অন্তরে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত সংহত হয়েছে। তৎক্ষণাৎ তারা কিছু দূরবর্তী স্থানে গমন করে গোপন কথাবার্তায় নিমগ্ন হল। রোহান তখন লক্ষ্য করল, হিরা আড়ালে দাঁড়িয়ে, দৃষ্টির পলকহীন সুতীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণতায় মুগ্ধকে পর্যবেক্ষণ করছে। এই বিষয়টি রোহান আগেও লক্ষ করেছে! প্রথমদিন থেকেই মেয়েটা এমন চোরের মতো ঘুরঘুর করছে।
রোহান ধীর পদক্ষেপে উঠে হিরার দিকে অগ্রসর হল। পেছন হতে এসে কৌতুকপূর্ণ মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল,
——— “চুরি করার প্রয়াস হচ্ছে?”
হিরা সেই প্রশ্নে চমকিত হয়ে ফিরে তাকাল। তার চোখে ধিক্কার জ্বলে উঠল, কিন্তু মুখে অতি দ্রুত তার ধিক্কার প্রকাশ করার পূর্বেই রোহান লুঙ্গির প্রান্ত ধরে দাঁত বের করে হাসল। হিরা বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
——— “তাতে আপনার কি?”
রোহান বিদ্রূপে বলল,
——— “ওহ্হ্হ্, স্বীকার করছেন যে আপনি একজন চুন্নি?”
হিরার চোখে শিরা ফুঁড়ে উঠল ক্ষোভের রেখা, কণ্ঠে অগ্নি ঝরল,
——— “আজব তো! এমন কথা বলার সাহস কে দিল আপনাকে?”
রোহান হাস্যরতই বিদ্রূপ করে বলল,
——— “আরে ধুর, চোরের সাথে কথা বলতে সাহস লাগে নাকি! তবে শুনেন, চুন্নি; যা চুরি করার চেষ্টা করছেন, তা কিন্তু ইতোমধ্যেই চুরি হয়ে গিয়েছে... আসলে ডাকাতি হয়েছে! অযথা আপনার প্রচেষ্টা বৃথা। আপনি এক কাজ করেন, আপনার উপযুক্ত রিকশাওয়ালা অনেক পাবেন রাস্তায়, তাদের প্রতি নজর দিন।”
রোহানের এই তীক্ষ্ণ এবং অপমানজনক উক্তিতে হিরা রাগে কেঁপে উঠল। চোখ যেন জ্বলন্ত অ'গ্নিকুণ্ডে পরিণত হল, বলল,
——— “অসভ্য কোথাকার ! ভদ্রতা শিখেন নাই।”
রোহান ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি ছড়িয়ে উত্তর দিল,
——— “হ্যাঁ, হ্যাঁ , এখন চোরের মতো লুকিয়ে কাওকে দেখার চেষ্টা করা সেই মহিলা আমাকে ভদ্রতা শিখাতে আসছে! ওহহহ, মাই গড! এই জীবনে আর কতো আশ্চর্য দেখতে বাকি আছে?"
এ বলে মুগ্ধ বিদ্রূপের কুটিল হাস্যে পথ পরিবর্তন করল। হিরা রাগে ফুঁসতে লাগল, শরীরে রক্ত যেন ফুটছে।
____________
আঁখি যখন মিলির কক্ষের সন্নিকটে , হঠাৎ তার দৃষ্টির কোণ দিয়ে আরাফের চাহনির গভীর নিরবতা স্পষ্ট হয়ে উঠল। আজ আর আঁখির হৃদয়ে কোনো ক্রোধের আগুন দহন করল না; বরং এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা তার মনকে আলিঙ্গন করল। লোকটি তার জন্য ইলিশ এনেছিল, সে হোক ছোট বা বড় কিংবা যদিও হতো অন্য কিছু ; যেন কিছু এনে সে আঁখির অনুকম্পা অর্জন করতে চেয়েছে। ইলিশে তার অ্যালার্জি থাকলেও, অন্যভাবেও প্রত্যাখ্যান করা যেত! যেখানে স্বয়ং তার নিজের ভাই এমন নির্দয় কাজ করেছে সেখানে আঁখি কি করতে পারে? তবে প্রত্যাশার প্রতিদানে কষ্ট দেওয়া আঁখির স্বভাব নয়। সুতরাং সে মিলির রুমে প্রবেশ না করে ধীর পায়ে বাহিরের দিকে আরাফের দিকে অগ্রসর হল।
এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে হীরণের অন্তরের অ'গ্নিশিখা আরও প্রবল হয়ে উঠল। সেই কখন থেকে পিছু নিয়েছে; একবার কক্ষে প্রবেশ করলেই যেন তার উপর ঝাঁপাবে। এই নিস্তব্ধ বাড়িতে কেও নেই ; সবাই বাহিরে, হৈ-হুল্লোড়ে মত্ত।
আরাফ আঁখির আগমন উপলব্ধি করে মৃদু হাসির আবেশে ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম রেখা ফুটিয়ে তুলল। অনেক ক্ষনকালের পর তাকে দেখার সৌভাগ্য হল; এখন যেন অন্তরাত্মা মগ্ন হয়ে সেই দৃশ্যের স্বাদ গ্রহণ করছে। কিন্তু সেই হাসির আড়ালে ইলিশ মাছ আনার প্রসঙ্গটি নিয়ে তীব্র অনুতাপ বোধ করছে। বুকের মধ্যে উথাল-পাতাল অস্থিরতার ঢেউ উঠছে।
আঁখি আরাফের সম্মুখে দাঁড়িয়ে এক হালকা মমতাময় হাসিতে বলল,
——— "আপনাকে ধন্যবাদ ।"
আরাফ কিছু বিস্ময়ের সঙ্গে বলল,
——— "কিসের ধন্যবাদ, মেডাম?"
——— "আমার পছন্দের জিনিস এনেছিলেন, এইজন্যই স্যার।"
আরাফের অন্তরে বিষাদের ভার বাড়ল। ইশ, মেয়েটি ইলিশ খেতে পারে নি, তবে কপালের কল্যাণে কষ্ট হতে বেঁচে গিয়াছে ; কিংবা বাঁচিয়েছে তার ভাই! যেন আঁখি তার এই অন্তর্লীন যন্ত্রণা বুঝে নিল। গলা পরিষ্কার করে আঁখি বলল,
——— "ইলিশ তো বাড়িতে দেখি না, আপনার জন্যই এ সুযোগ হল; তাই লোভ টা বেসামাল হয়ে গিয়েছিল। খাওয়া বড় কথা নয়, আপনি এনেছিলেন, এইটুকুই অনেক। মন খারাপ করবেন না। যা ঘটে, তা সবই কল্যাণের জন্য ঘটে।"
আঁখির মমতাময় বাক্যগুলি শুনে আরাফের অন্তরে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি নামল, যেন তার গভীর ক্ষতে মৃদু শীতলতার প্রলেপ পড়ল। মুখে একটুকরো হাসি ফুটে উঠল।
তবে আঁখি হঠাৎ তার স্বর কঠিন করে বলল,
——— "তবে ভেবে বসবেন না যে আপনাকে কোনো প্রশ্রয় দিচ্ছি! আমার জন্য কেও মন খারাপ করলে তা আমার সহ্য হয় না, বুঝেছেন? সব ব্যথা আমি দূর করতে পারব না, কিন্তু যা পারব, তা করতে বাধ্য; যেমন এখন। বুঝেছেন?"
এ বলে আঁখি দ্রুতগতিতে যাওয়ার আগে পিছু ঘুরে ফের বলল,
——— "স্বেচ্ছায় নেওয়া বেদনার আরোগ্য আমার হাতে নেই, তা প্রশমনের শক্তি কোনো অমৃতেও নেই।"
দাড়ালো না আর! চলে গেলো দ্রুত গতিতে! আরাফ তার পিছুতুলিয়া মৃদু হেসে বলল,
——— " আপনার দানকৃত ব্যথাও আমার জন্য অমৃতের সমান মেডাম!"
আঁখির এই কঠোরতা সত্ত্বেও আরাফের অন্তরে এক অভূতপূর্ব প্রশান্তি বিরাজ করল, যেন সেই বেদনাবিধুর বাক্যগুলি তার হৃদয়ের গভীরতম ক্ষতে সুধার মত কাজ করছে। পেটে পড়েনি কিছু গতকাল হতে বিষাদের ছায়ায় গলা দিয়ে নামেনি! তবে এখন বেশ পেট পুড়ে খাবে সে! চলল আরাফ খুশিতে পেটপুরে আহার করতে!
______________
মুগ্ধ জীবনের সহিত কথোপকথন সমাপন করতেই পৃষ্ঠদেশের আড়ালে এক অজানা সত্ত্বা আবির্ভূত হবার পূর্বাভাস পেলো। ফিরে তাকাতে দেখল, হিরার সমুখে দাঁড়িয়ে ; লাবণ্যময়ি সৌন্দর্যের মোহাচ্ছন্ন একরূপিনী, মুখে লাজুক হাসির মৃদু স্পর্শ, অথচ দৃষ্টির গভীরে এক অদৃশ্য আকাঙ্ক্ষা বিরাজমান। হিরা মনের অন্দরে ভাবছে,
——— "এমন এক বলিষ্ঠ, সুদর্শন পুরুষের সন্ধানই তো চাচ্ছিলাম। দীর্ঘ নিঃসঙ্গতার অন্তে, হয়তো এইবারই এক সাথে পথ চলব দুজনে।"
কিন্তু মুগ্ধ তার দিকে একবারও তাকিয়ে দেখল না, বিরক্তির ছাপ এঁকে সরে যেতে উদ্যত হল। হিরার বিস্মিত দৃষ্টি তার দিকে স্থির থাকল, অবশেষে ডাক উঠল,
——— "এইযে, শুনুন!"
মুগ্ধ থেমে পেছনে ফিরে কণ্ঠের গাম্ভীর্য টেনে বলল,
——— "আমাকে ডাকছেন?"
হিরার মুখে স্নিগ্ধ স্বর,
———"এখানে আপনি ছাড়া আর কে আছে?"
মুগ্ধের চাহনি তির্যক হল। সে বলল,
——— "চোখ খুলে দেখুন, অনেকেই আছে চারিপাশে!"
হিরা তার নীরব তাচ্ছিল্যে কিছুটা ব্যথিত হলেও স্বভাবের নম্রতায় শাড়ির আঁচল আঙুলে প্যাঁচিয়ে লজ্জা-সংকোচ মেশানো স্বরে বলল,
——— "আপনার সাথে কিছু কথা বলার ছিল।"
মুগ্ধ বিরক্তির ভাঁজ রচে দাঁড়িয়ে রইল। হিরা অধোবদনে বলতে লাগল ,
——— "আসলে, আমি আপনার সাথে পরিচিত হতে চাচ্ছি মানে বন্ধুত্ব করতে চাচ্ছি। এখানে আসার পর আপনাকেই ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছে। যদি কিছু..."
——— "বেহায়াপনার মাত্রা কত??? সাহস তো দেখছি—আমার সাথে কথা বলতে আসে? মেয়ে হয়েও এমন আস্পর্ধা! বন্ধুত্ব করতে চায়? নাম্বার চায়? দুটো চড় দিয়ে দিব, তাহলে সব অহংকার মাটিতে মিশে যাবে! সাবধান করে দিস, আমার আশপাশে যেন আর না ঘোরে। যে সৌন্দর্যের গর্ব করে আমাকে দেখাচ্ছে, পেট্রোল দিয়ে আগুনে জ্বালিয়ে ছাই করে দিব; চিহ্নও থাকবে না তার!"
ফোনের অপরপ্রান্তে কাউকে উদ্দেশ্য করে একরূপ কটাক্ষের স্বরে বলল কথাগুলো মুগ্ধ। এরপর ফোনটি পকেটে রাখল এবং নির্লিপ্ত স্বরে হিরার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল,
——— "আপনি কি যেন বলছিলেন?"
হীরা ভীত-কাতরকণ্ঠে শুকনো গলায় বলল,
———"না, না, কিছু নয়... এমনি!"
এ বলেই দ্রুত গতিতে সেখান হতে প্রস্থান করল, অন্তরে ভাবল,
——— " ঘোড়ার ডিম একসাথে পথ চলব! এমন ভয়ানক মানুষের সাথে আমি নেই বাবা! আমি একলাই ভালো আছি! "
মুগ্ধ হিরার দূরে সরে যাবার প্রতি লক্ষ করে ঠোঁটের কোণে এক সূক্ষ্ম কুটিল হাসির রেখা এঁকে তুলল।
_______________
আঁখি মিলির কক্ষে প্রবেশ করলেই হীরণের দৃষ্টি এক লো'ভাতুর আগুনে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল, যেন তার ভেতরকার তৃষ্ণা এক অমোঘ চাহিদায় ধাবিত হচ্ছিল। সে ছুটে গিয়ে নিজেকে ঘরের অন্তরে প্রবেশ করাতে চাইল, কিন্তু হঠাৎ থমকে গেল। আলো ও ভোলা কোনো কিছুর ওপর তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত, দুজনেই যেন বিজয়ের জন্য দ্ব'ন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ। আঁখি শব্দ শুনে পুনরায় কক্ষ থেকে বাইরে এলো, এবং দেখল আলো ও ভোলা দৌড়াতে দৌড়াতে বাইরে চলে গেছে। তাদের পিছু পিছু আঁখিও ছুটে গেল, থামানোর চেষ্টায়।
এদিকে হীরণ ধীরে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নিজের কপাল ঠুকে চিৎকার করে উঠল। কত নারী এসেছে, কত শরীর ভো'গ করেছে সে, আবার প্রত্যেককে যেমন অনায়াসে ছেড়ে দিয়েছে, তেমনই আরেক নারী এসেছে। মেয়েরা তো তার সুদর্শন মুখাবয়বের জন্যই ধরা দেয়। বিশেষত কচি, অল্পবয়সী মেয়েদের প্রেমের ফাদে ফেলা যেন সবথেকে সহজ কাজ।। কিন্তু এই শ্যামবতী কচি মেয়ে যেন তার নাগালের বাইরে। প্রকৃতি যেন তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু এই প্রতিরোধই হীরণের লা'ল'সাকে আরও তীব্র করেছে। তার ইচ্ছা যেন দ্বিগুণ হলো—এই মেয়েটিকে ছুঁ'তে হবে, এই ঢেকে থাকা সৌন্দর্যকে উন্মুক্ত করতে হবে। ঢেকে থাকা জিনিসের প্রতি লোভ তো স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়!
________
ভোলার হাতে এক ফোয়ারি স্প্রে, এবং আলো সেটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টায় ক্রমাগত টানাটানি করছে। আঁখি দুজনকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
——— "তোরা দুজন এমন ষাড়-গরুর মতো কেন করছিস?"
ভোলা তাচ্ছিল্যভরে ঠোঁট উলটে বলল,
———"আপা, মোর এই ফেনার বোতল খান ওই আলুর বস্তা কাইড়া নিবার চাওছে!"
আলো বিদ্বেষপূর্ণ কণ্ঠে প্রতিবাদ করে বলল,
——— "না আপা, ওটা আমি আগে দেখছি! কিন্তু ভোলা নিয়ে নিছে!"
——— "মুই আগে নিছু! এইখান মোর!"
———"না আমি আগে দেখেছি, এটা আমার!"
——— "নাহ, মোর!"
——— "আমার!"
এবং তৎক্ষণাৎ দুজনই একে অপরের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হলো! আঁখি উভয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাদের পৃথক করে থামানোর চেষ্টা করল, এরপর রাগ প্রকাশ করে বলল,
——— "তোরা কি পাগল হয়েছিস? এগুলোর অভাব পরেছে নাকি! যা নাঈম ভাইয়ের কাছে গিয়ে চা, দিয়ে দিবে! "
আলো তবু নিজের জেদ ধরে বলল,
——— "আমার এটাই চাই!"
———"নাহ, কউছু না এইখান মোরে!"
আবার ঝগড়া শুরু হলো! শেষমেষ, আঁখি উভয়ের কান মুচড়ে ধরল, তারা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। আঁখি রাগী কণ্ঠে উপদেশ দিল,
——— "আমি কি তোদের এই শিক্ষা দিয়েছি? আমি বলেছিলাম না, কখনো কারো জিনিস কাড়তে নেই? আলো, তুই যেহেতু দেখছিস ভোলা আগে নিয়েছে, তোর কি উচিত ছিল না ওটাকে দিয়ে দেওয়া? আর ভোলা, তুই যদি দেখেছিস আলো এটাকে পছন্দ করছে, তুই কি আরেকটা নিতে পারতি না? ত্যাগের মর্ম শেখা প্রয়োজন! তোদের দুজনেরই দোষ! এখন চুপচাপ একে অপরের কাছে মাফ চা!"
আলো ও ভোলা মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আঁখি তাদের ওপর আবার চোখ রাঙানি দিলে ভোলা অনিচ্ছাকৃতভাবে বলল,
——— "আচ্ছা, তুই নে!"
——— "না, তুই নে! তোর ভালো লেগেছে।"
——— "না, আগত তুই দেখেছিত, তুই নে!"
——— "না, তুই নে!"
এইবার পর্যন্ত যে জিনিসটির জন্য তারা তুমুল ঝগড়া করছিল, এখন সেটি দেওয়ার জন্য তারা লড়াই শুরু করল। যেন পুরো ব্যাপারটাই প্রহসন! আঁখি স্প্রেটি নিয়ে বলল,
——— "ঠিক আছে, আমি নিচ্ছি!"
আঁখি দুজনকে শাসিয়ে ফিরে চলল নাঈমকে স্প্রে দেওয়ার উদ্দেশ্যে । আঁখি চলে যেতেই ভোলা গর্বের সুরে বলে উঠল,
——— "আপা মোক বেশি ভালোবাসে!"
——— "চুপ কর! আপা আমাকে বেশি আদর করে!"
——— "নাহ, মোক আদর করে!"
——— "না, আমাকে!"
——— "নাহ, মোক!"
এবার শুরু হলো নতুন ঝগড়া, কিন্তু এবারের বিষয় হলো, তাদের আপা কাকে বেশি ভালোবাসে! দুজনের বয়সের তফাৎ হলেও ; মনে মনে আলো ভোলার থেকেও যেন অবুঝ! ভোলা যেখানে পঞ্চম শ্রেণীর, সেখানে আলো অষ্টম শ্রেণিতে পড়েও ছোট্ট ভোলা কে হিংসে করে। না খারাপ কিছু উদ্দেশ্যে নয়। তার ভালোবাসায় ভাগ বসিয়েছে এ জন্য। তাদের মধ্যে যে চিরন্তন হিং'সা চলে আসছে, সেটাই এখন আবার তীব্র আকারে রূপ নিল।
_________
হীরণ এদিক ওদিক পায়চারি করছে। বিয়ের আসর মানেই তো মেয়েদের শাড়িতে মোড়ানো নরম শরীরের খেলা! এ ধরনের আয়োজন হীরণের জন্য আরেক রকমের আকর্ষণ—মেয়েরা যেন তাদের শরীরখানা মেলে ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। হঠাৎ তার দৃষ্টি গেল এক প্রাপ্তবয়স্ক নারীর দিকে, হাসতে হাসতে দু’জন সঙ্গিনীকে বিদায় দিয়ে সে একা একা হেঁটে যাচ্ছে। তার সুশোভিত দেহের প্রতিটি বাঁক যেন হীরণের চোখে এক অপরূপ সৌন্দর্যের ছবি আঁকছে। এত নিখুঁত শরীর কি কেউ কখনো দেখেছে?
নিখুঁত কোমর, ভরাট পেছনের অংশ। এমন শরীর বজায় রাখাটা বিয়ের পরে মেয়েদের জন্য সহজ নয়, তার মানে এখনো বিয়ে হয়নি! মনে মনে হাসলো হীরণ, যেন সে এমন কোনো জিনিস আবিষ্কার করেছে যা কারো দৃষ্টি এড়িয়েছে। কিন্তু হঠাৎ থামল সে। নারীটা এক বলিষ্ঠ, শক্তপোক্ত পুরুষের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বোধহয় প্রেমিক পুরুষ ; হীরণ ভাবলো এখানে কাজ নেই, ধীরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার জন্য পা ঘুরালো উলটো পথে, যেন তার শ্যামবতী তারই অপেক্ষায়।
-
— "মুগ্ধ?"
মুগ্ধ মোবাইলে কথা বলছিল, হঠাৎ তার পেছন থেকে একটি মৃদু মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলে পেছনে ফিরে তাকালো, তার ভ্রু কুঁচকে গেলো। পূর্বিকা সামান্য নার্ভাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কপালের ঘাম মুছে নিলো শাড়ির আঁচলে।
——— "কিছু বলবে?"
মুগ্ধর কণ্ঠে গাম্ভীর্য স্পষ্ট। পূর্বিকা ভয় আর দ্বিধায় জড়ানো কণ্ঠে বলল,
——— "একটু কথা ছিল।"
দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু নজরে পড়লো আফ্রিদির। তার মনের মধ্যে যেন আ'গুন ধরে গেলো! হাতের মুঠো শক্ত, আর চোয়াল কঠিন হয়ে উঠল। রাগের তীব্র স্রোতে সে প্রায় কাঁপছে। রোহানের কথা শুনে এসেছিল মুগ্ধর সাথে কথা বলতে, ভেবেছিল একবার সামনাসামনি কথা বলাই ভালো হবে। কিন্তু এখন? পূর্বিকা তার সামনে গিয়ে কথা বলছে, অথচ সে তো কথা দিয়েছিল মুগ্ধর সামনে কখনো যাবে না! এভাবে প্রতারণা করল পূর্বিকা তার অগোচরে.? ধকধক করে বুকের মধ্যে উঠা ক্রো'ধ নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো আফ্রিদি।
______________
আঁখি মৃদুমন্দ হাসিতে নাঈমের হাতে পার্টি স্প্রেটি সমর্পণ করে ফিরে এলো। নাঈম তখন শিশুদের সাথে নৃত্যে মত্ত, আনন্দের উচ্ছ্বাসে রত। আঁখি অন্তর্লীন মুগ্ধতায় ধীরে ঘরে প্রবেশ করল। কিন্তু এক অজানা বিষয়ে চিন্তা তার মন গ্রাস করল—দুল! কোথায় সেই দুল? হায়, কেমন দেখতে সে দুল, এ কথাটি তো কখনো তার স্মরণেই আসে নি। কাকে জিজ্ঞাসা করবে? ঘরের সকলেই যেন নিজ নিজ কাজে নিবিষ্ট। আঁখির একাগ্র দৃষ্টি ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি জায়গা মনোযোগ সহকারে অনুসন্ধানে লিপ্ত হল সে।
অবশেষে, খাটের নিচে নজর দিতেই তার চোখে পড়ল—একটি সোনালি বর্ণের গোলাকার দুল। মনে হয়, এটাই সেই হারানো অলংকার। আশার আলো ফুটল আঁখির মনে, যেন গোপন মণি সে আবিষ্কার করল। কিন্তু দুলটি খাটের নিচে রয়েছে, সেখানে পৌঁছানো সহজ নয়। কি আর করা যায়! ধীর পায়ে, কোমল দেহে সে খাটের তলে প্রবেশ করতে লাগলো ।
অন্যদিকে, হীরণ তখন আনন্দোৎসবের তালে হাততালি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, হৃদয়ের ভেতরে হিং'স্র শিকারের উত্তেজনা তীব্র । তার চোখের সামনে যেন মৃগয়া ফেঁসে গিয়েছে! সরাসরি রুমে প্রবেশ করল সে, আর তার দৃষ্টি আঁখির দিকে নিবদ্ধ হল—যে তখন খাটের নিচে প্রবেশ করছে। হীরণের শরীরে এক বিদ্যুৎ শিহরণ বয়ে গেল, যেন বিজয়ের পূর্বক্ষণ উপস্থিত। কুটিল হাসি মুখে ফুটল, আলতো হাতে সে দরজার ছিটকিনির দিকে হাত বাড়ালো, যেন সেই পথ রুদ্ধ করতে প্রস্তুত।
0 Comments