Ad Code

অসমাপ্ত অনুভূতি পর্ব - ৩

লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত

 পর্বঃ ০৩

কলেজ শেষ করে সবেমাত্র ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েছে শ্রুতি। রিক্সা ডাকবে এমন সময় পরিচিত কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই পিছনে ফিরে তাকায় শ্রুতি। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে বিভোরের ফ্রেন্ড সায়ন।
সায়ন শ্রুতি কে দেখেই হাসিমুখে বলে উঠে, কেমন আছো ছোট আপু ?
~ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন।
~ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তো আপু আজ এতো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাচ্ছো যে। প্রতিদিন তো এই সময় যাও না। সায়নের কথায় শ্রুতি হাসিমুখে জবাব দেয় ,,,
~ আজ একটু তাড়া আছে বলেই শ্রুতি সায়ন ভাইয়ার থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
সায়ন ভাইয়ার সাথে প্রায় ই শ্রুতির দেখা হবে। নিয়মিত তার খোঁজ খবর নিবে। সায়ন ভাইয়া ছোট বোনের চোখেই দেখে শ্রুতিকে।
বিভোরের সাথে শ্রুতির সম্পর্কটা সব ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে জানাজানি ছিল। সবাই তাদের কে বেষ্ট কাপল হিসেবে দেখতে কিন্তু এভাবে তাদের বিচ্ছেদ হবে কেউ কখনো ভাবতে পারেনি।
অন্যদিকে
🍁
বিভোর অনেক দিন পর এই শহরে সে ফিরে এসেছে। এতো দিন সে রাগে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছিল । সবার মুখে তার ফিরে আসার আনন্দ বইলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
তাদের বিচ্ছেদে পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল । একটা মিষ্টি সম্পর্কের শেষ পরিনতি একটা করুন হবে কেউ হয়তো কল্পনাতেও ভাবেনি।
এতোটা ভালোবাসার পরেও মানুষ ছেড়ে যেতে পারে তাদের সম্পর্কের বিভোর সেইটা সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ‌। সেদিন থেকেই সবার মনে বিভোরের প্রতি একটা সুক্ষ্ম ঘৃনার জন্ম হয়েছিল ।
শ্রুতি বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে নেয়। দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছু সময়ের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
শ্রুতির ঘুম ভাঙ্গে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয় সে। লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে গাঁয়ে ওড়না জড়িয়ে ছাদের দিকে হাঁটা দেয়।
ঘুম থেকে উঠেই তার মনটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। অজানা কারনে তার ভীষণ মন খারাপ হয়ে আছে। তার মন খারাপের কারণ সে খুঁজে পায় না।
ছাদে এই সময় কোলাহল বিরাজ করছে। সচরাচর ছাদে এই সময় কেউ আসে না। মাঝে মাঝে ভাড়াটিয়ার ছোট ছোট বাচ্চা গুলো খেলা করে । তবে আজ কেউ নেই।
শ্রুতি একাই ছাদে বসে ছিল।ছাদের এক পাশে সে টবে ফুলের গাছ লাগিয়েছে। গাছগুলোতে থরে থরে ফুল ফুটেছে। শ্রুতি মিহি দৃষ্টিতে ফুলোগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
সচরাচর ফুল দেখলেই তার মন ভালো হয়ে যায় কিন্তু আজ ফুলের মতো পবিত্র বস্তুকেও তার বিষাক্ত লাগছে।
মনে যদি ঘোর অমাবস্যা থাকে, রংধনু টাও ফিকে লাগে। পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে পড়তেই একরাশ বিষন্নতা ভর করেছে তার মধ্যে। সে চাইছে না পুরোনো ঘা টা কাঁচা করতে। কিন্তু অবাধ্য মনটা বার বার ভুল পথেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।
শ্রুতি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে সিফান কে খুঁজতে থাকে কিন্তু তার দেখা নেই। সে মন মরা হয়ে ওভাবেই বসে থাকে। তার কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না এই সময়।
সিফান বাসার কাউকে না বলেই বিভোরদের বাসার ভিতরে প্রবেশ করে। তার দিদুন তাকে যাবার জন্য খবর পাঠিয়েছে‌ ।তাই সে স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সেই বাসায় চলে গিয়েছে।‌
বিভোর অনেকদিন পর সিফান কে দেখেই তাকে ডেকে নিয়ে যায় । তাকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে চলে যায়। সেখানে তার মেজ কাকা, ফুপীর ছেলে মেয়ে ছিল। যাদের মধ্যে কয়েকজন সিফানের সমবয়সী ছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা সেখানে খেলা করছিল ।
~ গতকাল এসেছি । কিন্তু এখনো তোদের কারোর দেখা পেলাম না । সহজেই ভুলে গেছিস আমাকে ( বিভোর )
~ কি যে বলো না ভাইয়া , তোমাকে ভুলে যাবো। আমি স্কুলে ছিলাম সেই জন্য আসতে পারিনি ।আজ এসেছি তো ( সিফান )
ছোট্ট সিফানের কথা শুনে বিভোরের মুখে কিঞ্চিত হাঁসি। সে ছোট বেলা থেকেই সব সময় বিভোরের সঙ্গে সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতো। আজ এতো বছর পর সে তাকে আবার পেয়ে খুশি।
~ তোর আপু কেমন আছে ? বিভোরের মুখে নিজের বোনের কথাটা শুনতেই চুপ হয়ে যায় সিফান। সে কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না।
~ আপু এতো দিন ভালোই ছিল কিন্তু তোমার আসার পর থেকে আপুর মুখটা কেমন চুপসে গেছে। জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে সিফান বিভোরকে প্রশ্ন টা করতেই বিভোর থমকে যায়। বিভোরের মনে যেটা চলছে শ্রুতির মনেও কি সেটাই চলছে..?
বিভোর প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে উঠে,,কাকিমনি কেমন আছে।আমার সাথে একবার ও দেখা করতে এলো না যে ?
বিভোরের কথায় সে আগের কথা ভুলে গিয়ে জবাব দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আম্মু কাজে ব্যস্ত ছিল তো সেই জন্য আসতে পারেনি ।তুমি যাবে আমাদের বাসায় বলো।
বিভোর সিফানের জোড়াজুড়ি তে যেতে রাজি হয় । সিফান বিভোরের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তার থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের বাসায় চলে যায়‌।
সিফান পুরো বাসা খুঁজে তার আপুর দেখা না পেয়ে ছাদে চলে যায়। সিফান ছাদে গিয়ে দেখতে পায় শ্রুতি দোলনায় চুপচাপ বসে রয়েছে। মুখটা কেমন উদাস লাগছে তার । সমস্ত মন খারাপ যেন তাকে ঘিরে রেখেছে।
~ আপু । সিফানের আচমকা ডাকে চমকে ওঠে অষ্টাদশী কন্যা শ্রুতি। শ্রুতি ভাইকে দেখে তার পাশে বসতে বলে। চুপচাপ সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভারী দীর্ঘ নিঃশ্বাস গুলো তার সমস্ত অভিযোগের কথা জানান দিচ্ছে। কোনো একজন তাকে প্রচন্ড ভালোবাসেও নিষ্ঠুর ভাবে ঠকিয়েছে।
সিফান চুপচাপ তার আপুকে পর্যবেক্ষণ করছে। এই মুহূর্তে তার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। তার আপুর কষ্ট যেন সে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারে না । সে সব সময় চেষ্টা করে তার আপুকে হাসিখুশি থাকতে।
তার বাবা চলে যাওয়ার পর তার আপু প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়েছিল । সেই সাথে বাবার মৃত্যুর জন্য শ্রুতিকে দায়ী করা আপনজনদের দেওয়া কষ্ট। কোনোটাই সে মেনে নিতে পারি নি।
তখন থেকেই সে তার আপুকে সামলে নিতে শিখেছে। তার আপু প্রচন্ড কড়া হওয়া সত্ত্বেও বাবার মৃত্যুর পর খুব করে ভেঙ্গেপড়েছিল । মেয়েদের মন যে, তুলোর মতো সিফান সেদিন ই প্রমান পেয়েছিল।
সিফান কখনো মেলাতে পারেনি তার প্রশ্নের জবাব, তার আপনজন গুলো কেন তার বাবার মৃত্যুর জন্য তার আপুকে দায়ী করে অথচ আপু আমার বাবার দ্বিতীয় মা হয়ে এসেছিল ।
বাবা আপুকে প্রচন্ড ভালোবাসতো , সে কখনো চায় নি তার রাজকন্যা কষ্ট পাক। অথচ বাবার মৃত্যুর পর সবাই আপুকে কষ্ট দেওয়া শুরু করেছিল। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সিফানের চোখে জ্বল এসে যায়।
আপুর হয়তো বাবার কথা খুব করে মনে পড়ছে সেই জন্য আপু তার মন খারাপ গুলো আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই কথা ভেবেই সিফান শ্রুতির মন ভালো করার জন্য সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
~ আপু আজকে সন্ধ্যার পর তোমাকে একজায়গায় নিয়ে যাবো‌। আমার সাথে যাবে তো । সিফানের কথায় শ্রুতি জিজ্ঞাসের দৃষ্টিতে তাকাতেই সিফান আবারো বলে উঠে, যাবে তো ।
শ্রুতি সিফানের দিকে তাকিয়ে মুখে কিঞ্চিত হাঁসি ফুটিয়ে হ্যা সম্মতি জানায়। শ্রুতির মন খারাপের সময় তার বাবার পরে এই ভাইকেই সে পেয়েছিল যে তার ছোট হওয়া সত্ত্বেও তাকে সমস্ত দুঃখ কষ্ট থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে।
~ তাহলে এখন ঘরে চলে বলেই সিফান হাত ধরে শ্রুতি নিয়ে যায়। শ্রুতি ও বাধ্য মেয়ের মতো ভাইয়ের সাথে চলে যায়।
সমস্ত কাজ সেরে সন্ধ্যার পর দুই ভাই বোন বেরিয়ে পরে বাসা থেকে। বাসার নিচে স্বল্প দূরত্বে ফুচকার দোকান। সিফান এবং শ্রুতি ফুচকা খাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
শ্রুতি সেখানে বিভোর কে দেখেই থমকে যায়। এখন তার মাঝে বিভোরের প্রতি ঘৃণা কাজ করছে না। সে চাইলেও বিভোরের প্রতি ঘৃণা তৈরি করতে পারছে না। সে চুপচাপ সিফানের হাত জাপটে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সিফান আগে থেকেই বিভোর কে বলে ছিল তাই বিভোর এখানে এসেছিল। বিভোরের উদ্দেশ্য ছিল শুধুই শ্রুতি কে দেখার। তারা একটা টেবিল বসে পড়ে। সিফানের পাশে শ্রুতি। শ্রুতি আর বিভোর সামনাসামনি হয়ে বসে রয়েছে।
বিভোর সবার আড়ালে শ্রুতিকে দেখার প্রচেষ্টা তার। কিছুক্ষণের মধ্যে ফুচকার প্লেট তাদের টেবিলে দিয়ে যাওয়া হয়। শ্রুতি বেশি ঝাল খেতে পারে না বলে তার জন্য সিফান বার বার তাদের কে একটা প্লেটে ঝাল কম দিতে বলেছে।
কিন্তু ভুলক্রমে একটা ঝালের প্লেট শ্রুতির কাছে চলে যায়। শ্রুতি ফুচকা মুখে দিতেই সে ঝাল অনুভব করে। তবুও সে কোনো সাড়াশব্দ না করে খেতে থাকে।
কয়েকটা ফুচকা পরপর খাওয়া শেষ করতেই ঝালের চোটে শ্রুতির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। শ্রুতি অস্ফুট আর্তনাদ করতেই বিভোর এবং সিফান একই সাথে তাকিয়ে দেখে শ্রুতি কান্না করছে।
বিভোর সঙ্গে সঙ্গে শ্রুতির দিকে পানি এগিয়ে দেয়। শ্রুতি বিভোরের হাত থেকে পানিটা নিয়েই এক ঢোকে সবটুকু পানি খেয়ে ফেলে। বিভোর একটা টিস্যু পেপার এগিয়ে দেয় শ্রুতির দিকে। শ্রুতি হাত বাড়িয়ে টিস্যু টা দিয়ে চোখের পানি মুছতে থাকে।
শ্রুতির অস্ফুট আর্তনাদে বিভোর আঁতকে উঠে। প্রিয়তমার কষ্ট গুলো সে কোনো ক্রমেই সহ্য করতে পারছে না। শ্রুতি নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ ভাইয়ের পাশে বসে থাকে।
বিভোর বিল পেয়ে করে ওদের দুইজনকে সাথে নিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। রাতের রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে তারা। শ্রুতি নিচের দিকে তাকিয়ে সিফানের হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছে কিন্তু বিভোর শ্রুতির দিকে তাকিয়ে তাকে দেখছে দৃষ্টি ভরে।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu