লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত
পর্বঃ ০৪
শ্রুতি নিচের দিকে তাকিয়ে সিফানের হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছে কিন্তু বিভোর শ্রুতির দিকে তাকিয়ে তাকে দেখছে দৃষ্টি ভরে। তার এই মুহূর্তকে উপভোগ করার পাশাপাশি তার অতীতের কথাগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে।
কোনো এক শীতের রাতে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছে বিভোর শ্রুতি। শ্রুতির গাল ভর্তি হাঁসি। চারিদিকে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভরপুর।
রাতে খোলা আকাশের নিচে প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে হাঁটা হয়তো পৃথিবীর সুন্দরতম অনুভূতির একটি। রাতের আকাশে তারাগুলো ঝলমল করছে। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ। চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারিপাশ।
শ্রতি আকাশের পানে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করছে। বিভোর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে প্রিয়তমার পানে।
"চাঁদের আলোয় মাখা এই রাত, স্বপ্নগুলো যেনো মিশে যায় তার স্নিগ্ধতায়। দূর থেকে চেয়ে থাকা চাঁদের মতো আমার একটা গন্তব্য ছিল, তুমি...!
তোমারও গন্তব্য আছে তাই
বারবার তোমাকে হারাই....!
ভুল পথে ক্লান্ত হই, নিজের অজ্ঞাতে বার বার নিজের দরজায় এসে দাঁড়াই, এবং আমার একটাই গন্তব্য থাকে, তুমি.....!
বিভোর শ্রুতির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথাটা বলতেই শ্রুতির মুখে হাঁসি ফুটে ওঠে।
ভাইয়া আমাদের সাথে তুমিও বাসায় চলো । সিফান এর কথায় বিভোর অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে।
~ আজকে যাবো না অন্য একদিন যাবো। সিফানের কথায় বিভোর কথাটা বলে উঠে।
~ঠিক আছে ভাইয়া ( সিফান )
বিভোর এর থেকে বিদায় নিয়ে সিফান এবং শ্রুতি তাদের বাসার ভিতরে চলে যায়। এতোক্ষণ যাবৎ বিভোর শ্রুতির দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু শ্রুতি একবার ও তার দিকে তাকায় নি।
শ্রুতির ইচ্ছে হলেও তার মনটা সায় দেই নি তার ইচ্ছেকে। বিভোরের প্রতি এক রাশ ঘৃনা জমে আছে তার মনে। সেই জন্য হয়তো তার মনটা এখন আর তার দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন পড়ে না।
বিভোরের প্রতি তার অনুভূতি এখন শূন্য। সময়ের ব্যবধানে অভিযোগ গুলো অভিমানে পরিনত হয়েছে।সেই অভিমানের পাহাড় জমে তা জেদে পরিনত হয়েছে। সেই জেদের করুন পরিনতি বিভোরের প্রতি একরাশ ঘৃণা।
শ্রুতি বাসার ভিতরে প্রবেশ করে সিফানের হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের রুমের মধ্যে প্রবেশ করে সজোরে দরজা লাগিয়ে দেয়। সিফান শ্রুতির রাগের কারণ বুঝতে পেরেছে, তাকে বাহিরে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঠিক ছিল কিন্তু বিভোর ভাইয়ার উপস্থিতি শ্রুতি আশা করেনি।
সিফান নিজেকে বাঁচিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায়। সে ভয়ে তার আপুর মুখোমুখি হয়নি। তখন মন খারাপ করে থাকলেও তার বোন যে এখন রেগে আগুন হয়ে আছে। সে সামনে গেলেই তার উপর রাগ গুলো ঝাড়বে।
শুধু যে রাগ ঝাড়বে তা নয় সঙ্গে ঘরের জিনিসপত্র গুলোও ছুঁড়ে ভাঙচুর করবে। সিফান চুপচাপ নিজের ঘরে টেবিলে পড়তে বসেছে। পড়ার অজুহাতে সে অন্তত বেঁচে যাবে।
খাবার টেবিলে বসে আছে শ্রুতির আম্মু। সিফান চুপচাপ খাবার টেবিলে বসে পড়লো। তার আম্মু তাকে খাবার বেড়ে দেয়। সিফান অনেকক্ষণ যাবৎ টেবিলে বসে আছে কিন্তু খাবার খাচ্ছে না।
তার আম্মু তার চুপ থাকার কারণ জানতে চাইলে সিফান স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে " আপু কে দেখছি না তো"
তোমার আপু খাবে না। তার নাকি খিদে নেই। তুমি চুপচাপ খেয়ে নাও। আপু খাইনি তাহলে আমিও খাবো না বলেই সিফান খাবার টেবিলে থেকে উঠে চলে যায়।
সোহানা ইসলাম এর চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি। ছেলেমেয়ে গুলো হয়েছে একরকম। তাদের কে সামাল দিতেই তার হয়েছে যত জ্বালা।
সিফান গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আর শ্রুতি অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আজ দখিনের জানালাটা খুলতেই
এক ঝাপটা উড়ে চলা মেঘ এসে বলে গেলো,
বাতাস আর আঙিনায়
ঝরে পড়া ফুলের কানে কানে,
যেন এই কথাটা পৌঁছিয়ে দেয় তারা আমার কাছে
তুমি ভালো নেই, তোমার ভীষণ মন খারাপ।
সত্যি কি তাই,,?
যা বলে গেল
উড়ে চলা মেঘ বাতােস ঝরে যাওয়া ফুল?
বিভোর তার রুমের বেলকোনিতে বসে গিটার বাজিয়ে কবিতা আবৃত্তি করছে। সেই কবিতার প্রতিটি ছন্দকে সে অনুভব করছে। তার জীবন টা চাইলেই অন্য রকম হতে পারতো।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ দুইজনের পথ আলাদা। ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক জোড়া লাগলেও ভেঙ্গে যাওয়া মন কখনো হয়তো জোড়া লাগবে না ঠিক ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচের টুকরো গুলো যেমন কখনো জোড়া লাগে না তেমন।
নতুন শহরে কতশত রাত কাটিয়ে দিয়েছে না ঘুমিয়ে। নতুন শহর, প্রিয় মানুষ কে হারানোর বেদনা , তার হৃদয়ের হাহাকার। সবমিলিয়ে জীবন পেরিয়েছে সে। অপেক্ষা করেছে সুদিনের অপেক্ষায়।
নতুন শহরে ফেরার আনন্দ, প্রিয় মানুষ কে পাবার আশা সবটা নিয়েই সে ফিরেছিল এই নতুন শহরে কিন্তু পুরোনো শহরে ফিরেও সে নিরাশ।
তার পুরোনো আঘাতের ক্ষত আবারও জেগে উঠেছে। পুরোনো স্মৃতি গুলো তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে মারছে। না পাওয়ার আক্ষেপ তার হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলছে।
এসব চিন্তা ভাবনা সারাক্ষণ বিভোরের মস্তিষ্কে ঘুরছে। হৃদয়ে তার র-ক্ত ক্ষরণ হচ্ছে তবুও তার হৃদয়ের ব্যাথা কাউকে দেখাতে পারছে না।
শরীরের আঘাত ঔষধে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু মনের আঘাত সেটা কিভাবে ঠিক করবে। যার জন্য পড়া শেষ করেই ছটফট করতে করতে এই শহরে ফিরে আসা। সে কখনো ভাবতে পারেনি তার মনে তার জন্য শুধুই ঘৃনা।
বিভোর সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে।
বিভোর প্রতিদিন কারের মতো জিমে বেরিয়েছে। কিন্তু শ্রুতির দেখা কোথাও মেলে না তার । তার সাথে দেখা না হওয়ার জন্য হয়তো আর সে সকালে হাঁটতে বের হয় না ।
হ্যা বিভোরের ধারনা ই ঠিক। বিভোরের সামনে যেন না পড়তে হয় সেই জন্যই সে আর সকালে হাঁটতে বের হয় নি। শ্রুতি সচরাচর ভোরেই ঘুম থেকে উঠে। শ্রুতি কফির মগ হাতে নিয়ে ছাদের দিকে হাঁটা দেয়।
আজ শুক্রবার স্কুল, কোচিং সবকিছু বন্ধ বিধায় সিফান এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
শ্রুতি ছাদে বসে কফির মগে চুমুক দিতেই তার মন থেকে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সুন্দর সকালে চারিদিকের বিস্ময়কর সৌন্দর্য। তার মন প্রান সতেজ হয়ে গেছে ভোরের সৌন্দর্যে ।
সূর্যি মামা হালকা আলো ছড়িয়েছে। তার লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবী জুড়ে। মানুষ তাদের নিত্যদিনের কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে । ছুটছে সবাই আপন মনে।
শ্রুতি ছাদে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নানান রঙের মানুষদের দেখছে। তাদের ছুটে চলার গতি, নতুন দিনে নতুন কিছু করার চেষ্টা। সবকিছুই মনোমুগ্ধকর।
শ্রুতির চোখে মুখে হাসির রেখা। তবে তা ক্ষনস্থায়ী । রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বিভোরের চোখে চোখ পড়তেই শ্রুতির চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। বিভোর এখনো ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দেখে শ্রুতি ছাদ থেকে নেমে পড়ে । নিজের ঘরে চলে যায়।
সকালের নাস্তা সেরে শ্রুতি নিজের ঘরে চলে যায়। দরজা লাগিয়ে সে ঘরেই বসে থাকে। অন্যদিন গুলোতে সে ভাড়াটিয়াদের সাথে বসে গল্প করলেও আজ সে নিরবতা কেই বেছে নিয়েছে। বাহিরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না ।
প্রায় দুপুর হয়ে গেছে । অনেকক্ষন ঘরে বসে তার বোরিং লাগছে । এই তপ্ত রোদে সে ছাদেও যেতে পারবে না । নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে তার আম্মুর কাছে আসে।
সে ড্রয়িংরুমে এসে একটু চমকে যায়। সোফায় বিভোর এবং তার দিদুন বসে আছে। বিভোর কে দেখে তার চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে উঠলেও তার দিদুন কে দেখে তা প্রকাশ করে না ।
শ্রুতি গিয়ে তার দিদুনের পাশে বসে পড়ে । দিদুনের সাথে অনেক্ষণ যাবৎ কথা বলে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। রান্না ঘরে তার আম্মু রান্না করছে আর তাকে হেল্প করছে সিফান।
আজ অতিথিদের উদ্দেশ্যে অনেক কিছুর আয়োজন করছে তার আম্মু। বিভোরের পছন্দের সব খাবার রান্না করা হয়েছে। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় তার আম্মু বিভোর কে একটু বেশিই ভালোবাসেন।
শ্রুতি গুটিগুটি পায়ে চুলার দিকে এগিয়ে যায়। চারিদিকে নজর বুলিয়ে নেয়। শ্রুতির আম্মু সবকিছু টেবিলে গুছিয়ে রাখছে। শ্রুতির আম্মু সোফায় বসে বিভোরের সাথে কথা বলছে এর মাঝে রান্নাঘর থেকে কিছু পড়ার শব্দ শুনেই সোহানা ইসলাম তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে এগিয়ে যায়।
শ্রুতি আর সিফান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মেঝেতে পড়ে আছে কাঁচের বাটি। যেটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। শ্রুতি এবং সিফান মারামারি করতে গিয়ে বাটিটা যে ভেঙ্গে ফেলেছে তার আম্মুর বুঝতে সময় লাগলো না ।
~ তোরা কি মানুষ হবি না কখনো । আর তুই ছোট হয়ে ওর সাথে মারামারি করতে লজ্জা করে না । কম বড় হয়েছিস দুজনে। এখনো দুইজনের সব সময় মারামারি লেগেই থাকে।
সিফান কে বকা দিতেই শ্রুতি মুখ টিপে হাঁসতে থাকে। সিফান দাঁত কটমট করতে করতে ওর আম্মু কে অভিযোগের সুরে বলে উঠে,,
~ আম্মু তুমি সব সময় আমাকেই বকো। সব সময় আমার দোষ ধরো। আপুকে কিছুই বলো না কখনো তুমি।
~ ওকে কি বলবো। বড়টার থেকেই তো সবকিছু শিখেছে ছোট টা। মায়ের কথায় শ্রুতির হাঁসি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। মুখে মলিনতার ছাপ।
শ্রুতির আম্মু কথাটা বলেই আবার ড্রয়িং রুমে চলে যায়। দুপুরের খাবার খেতে বসেছে সবাই মিলে। দুপুরের খাবার খেয়ে বিভোর রুমে চলে যায়।
শ্রুতি তার মায়ের কাজে হেল্প করছে । সবকিছু গুছিয়ে রেখে নিজের ঘরে যেতেই থমকে যায় সে। বিভোর তার বিছানায় শুয়ে আছে। শ্রুতি কে দেখেই বিভোর শোয়া থেকে উঠে বসে।
শ্রুতি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বিভোরের কথায় থেমে যায়,,,,,,
~ আমাকে ইগনোর করছো কেন ? বিভোরের প্রশ্নে শ্রুতি পিছনে তার দিকে ফিরে তাকায়।
~ আমার ঘরে এসেছেন কেন ? কার অনুমতি নিয়ে আমার ঘরে এসেছেন ?
শ্রুতির প্রশ্নে বিভোর তাচ্ছিল্যের হাঁসি হেঁসে শ্রুতির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,,,
~ কেন ? এই ঘরে আসতে কি আমার কারো অনুমতি লাগবে ।
~ হ্যা লাগবে ( শ্রুতির স্ট্রেট জবাব )
~ আগেও তো আসতাম ।কখনো তো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে নি তাহলে আজ অনুমতি লাগবে কেন ? ( বিভোর )
~ কারন ঘরটা আমার । আমি ডিসাইড করবো কে এই ঘরে আসতে পারবে আর কে আসতে পারবে না ( শ্রুতি )
শ্রুতির কথায় বিভোর রেগে গিয়ে শ্রুতিকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে রাগী কন্ঠে বলে উঠে,,,
~ তুমি আমাকে ইগনোর করছো রীতিমতো। আগে তো এমন ছিলে না । আমাকে চোখের আড়াল হতে দিতে না কখনো তাহলে আজ বার বার সামনে আসা সত্ত্বেও দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা কেন ?
বিভোরের কথায় শ্রুতি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠে,,,
~ ইগনোর করছি , তবুও আবার আপনাকে। আপনাকে তো মনেই রাখিনি তাহলে ইগনোর কেন করবো। যে মনেই নেই তার প্রতি কিসের অনুভূতি।
0 Comments