Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৩৯

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
*
*
বর্ষার মাসের শেষে বিদায়ের পূর্বে উগ্রে দিচ্ছে সমস্ত সত্তাকে ধরণীর বুকে! নিস্তরঙ্গ গগনচুম্বী মেঘের অহংকার দিগন্তের নীরবতা ভেদ করে অরণ্যের হৃৎপিণ্ডে প্রবল পরাক্রমে আঘাত হানছে। প্রকৃতি— মত্ত এক ভুবন, তার সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে ঝড়ে, তুফানে কাঁপিয়ে দিচ্ছে জাগ্রত ভূমণ্ডল। এই উন্মাদনার মাঝে রোহান, এক অশান্ত আত্মা, দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার মধ্যভাগে; তার ক্ষীণ অথচ শৌর্যবান দেহ ভিজে চূর্ণ হচ্ছে বৃষ্টির রণতপ্ত ফোঁটায়। সে কি শুধু বৃষ্টিতে ভিজছে, নাকি নিজের ভেতরের অব্যক্ত অশ্রুকে আড়াল করতে চাইছে, তা তার অন্ধকারময় মুখাবয়ব থেকে অনুমান করা কঠিন।
তার পরনে সেই চিরপরিচিত লুঙ্গি, নির্লিপ্ত সাক্ষ্য বহন করছে যে কোনো ঝড়, কোনো প্রলয় তার বাহ্যিক দৃশ্যপটের চেয়ে শক্তিশালী নয়। রোহান এগিয়ে চলে বৃষ্টির শীতলতায়, কিন্তু তার অন্তর্গত তেজ, তার অন্তঃস্থ অগ্নি, কোনো কিছুতে তা দমানো যায় না। কোনো এক অনির্ণেয় শূন্যতার তাড়নায় সে পা বাড়ায় সেই ক্ষুদ্র টিনের চায়ের দোকানের দিকে, যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় তীব্র কষাটে চা আর কয়েকটা ভেজা বেঞ্চ।
চায়ের দোকানে বসে থাকা সেই ম্লান জলপাই রঙা শাড়ি পরিহিত নারী; অস্পষ্ট ঘোমটার আড়ালে; একদৃষ্টে দেখে যায় রোহানকে। তার জন্য এ দৃশ্য নতুন নয়; সে জানে, এই মানুষটি নিয়মিতই আসে, গরম, শীত, ঝড়-বাদল কিংবা খরায়ও সে অনুপস্থিত হয় না। কিন্তু কেন আসে? সে কি জানে? নাকি জানতে চেয়েও জানে না। তার হাতের কাজ নিরবচ্ছিন্ন চলে—রোহানের বরাদ্দকৃত চিনি ছাড়া চা, সেই স্বাদহীন অথচ কঠিন চা, যা রোহানের আত্মার নিরাভরণতার সঙ্গে মিলে যায়।
রোহান এক পলকও তাকায় না, কেবল হাত বাড়িয়ে নেয় সেই গাঢ় রঙের পানীয়। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো শব্দ নেই, শুধু এক নীরবতার মাঝেই এক অভিব্যক্তিহীন সংযোগ গড়ে ওঠে। চায়ের প্রতিটি চুমুকে লুকিয়ে থাকে অমোঘ পরিণতির প্রতীক্ষা। চা পান শেষে, বয়ামের ওপর টাকা রেখে রোহান চলে যায়, শব্দহীন, নজরহীন।
তবে তার মনের গহীনে একটি অব্যক্ত কিছু ছটফট করে; এক নিষিদ্ধ অনুভূতির ক্ষণিক ছোঁয়া, যা বৃষ্টি কিংবা বাতাসে ম্লান হতে পারে না। ঝড়ের মধ্যে ছুটতে ছুটতে সে হঠাৎই পথের কর্দমাক্ত মাটিতে বসে পড়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টির ধারায় রোহানের মুখমণ্ডল বিধ্বস্ত হয়, কিন্তু বুকের গভীরে জমে থাকা যন্ত্রণার তুলনায় তা সামান্যই।
সেই মুহূর্তে তার গভীর কণ্ঠ নিঃশব্দে প্রতিধ্বনিত করে এক অসীম প্রশ্ন,
——— "এ আগুন কিসে নেভাবে, কিসে শান্ত হবে অন্তরের এই অদম্য জ্বালা?"
——— "ভালোবাসা নয়, এটা যন্ত্রণাবাসা।"
তারপর নিজের ভগ্ন স্মৃতির ছায়ায় নিমজ্জিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল,
——— " এ কি আমার অন্তর্লীন সংশয়, নাকি নিয়তির নির্মম ইঙ্গিত? প্রেম, যা স্বর্গীয় বলে জানা যায়, আমার কাছে কেবল এক নিষিদ্ধ যন্ত্রণা। প্রতিটি শ্বাসে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত। এ কি সত্যিকারের ভালোবাসা, নাকি নিঃসঙ্গ দুঃখের অনন্ত সঙ্গী? আমি কি ভালোবাসার মরীচিকা ধরে ছুটছি, নাকি শূন্যতার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি?"
রুদ্র আর মহুয়া প্রায় ছিটকে পড়তে পড়তে থমকে উঠল, যখন তীব্র তীক্ষ্ণতায় গাড়ির চাকা আচমকা থেমে গেলো! চোখের কোণায় বিস্ময়ের ছাপ নিয়ে রুদ্র ধীর গলায় মুগ্ধকে প্রশ্ন করল,
——— "স্যার, হঠাৎ এভাবে গাড়ি থামালেন কেন?"
মুগ্ধ কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই ঝঞ্ঝার বেগে নেমে পড়ল বৃষ্টিময় বিকেলে! সামনের কাদামাখা পথে শায়িত রোহানের নিকট গিয়ে মাটিতে নতজানু হলো। দৃপ্ত হাতে রোহানকে ঝাঁকিয়ে তুলে কাঁপন ধরিয়ে বলল,
——— "বাড়ি চল!"
রোহানের মলিন দৃষ্টির কোণে আবছা চেতনার ছায়া ফুটে উঠল! মুগ্ধকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে এক অম্লান হাসির রেশ! মুগ্ধ শক্ত হাতে তাকে টেনে তুলল, নিঃশব্দে গোপন এক সম্বন্ধে বাঁধা। তারপর, গাড়ির দিকে ফিরে রুদ্রকে বলল,
——— "নেমে পেছনে বসো।"
রুদ্র কোনো প্রশ্ন না করেই গাড়ি থেকে নেমে এসে মহুয়ার পাশের আসনে আসন গ্রহণ করল। মুগ্ধ রোহানকে সামনের আসনে বসিয়ে নিজের আসনে ফিরল, ধীরে ধীরে সেফটি বেল্ট পরিয়ে দিলো রোহানের গায়ে, যেন নিস্তব্ধতায় আবদ্ধ করল তার দুর্বল শরীরটাকে। রোহান নির্বাক, নিরুপায়। তারপর মুগ্ধ সেই গাড়িটিকে পুনরায় জাগ্রত করল বন্য গতিতে এবং দ্রুত রোহানের গৃহের সম্মুখে থামাল! গাড়ি থেকে নামতেই মুগ্ধ শক্ত হাতে রোহানকে ধরে নামিয়ে আনল। তারপর মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে রুদ্রকে বলল,
——— "তোমরা যাও; আমি একটু পরে আসছি।"
এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই রোহানকে সহায়তা করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল মুগ্ধ। সেখানকার নিস্তব্ধতায় এক অশ্রুসিক্ত কান্নার নীরব ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো; রোহানের মা অনবরত কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তিনি আজ ছেলেকে বলেছিলেন যে এক আত্মীয়ের গৃহে তাঁকে নিমন্ত্রিত করা হয়েছে, কিন্তু এ ছিল নিছকই এক পরিহাসের নীল মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে, তাকে প্ররোচিত করেই এক প্রকার বলপূর্বক নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ও রোহানের বাবা, যদিও বাবার মধ্যে জোরাজুরির এমন আভাস ছিল না।
অতঃপর সেই নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানোর পর সমস্ত কিছুই যখন শান্ত ও স্বাভাবিক লাগছিল, ঠিক তখনই রোহানের ক্রু'দ্ধ দৃষ্টির অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হলো; কারণ, এক মুহূর্তেই তার সামনে উদ্ঘাটিত হলো সেই চতুর পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য, তাকে আনীত হয়েছিল এখানে মিথ্যা ছলনায়, এবং সে পাত্রীর মুখোমুখি হওয়ার নিমিত্ত। সেই সত্যের গহন আঘাতে তার ক্রোধের উত্তপ্ত স্রোত প্রবাহিত হয়ে উঠল, এবং কোনো এক সুপ্ত ঝড়ে উন্মত্ত সিংহের মতো রোহান উদ্দাম ক্রোধে আছড়ে পড়ল; পাত্রীর মুখ না দেখেই সেখানে উপস্থিত একঝাঁক মানুষের সামনে নিজের ক্ষুব্ধ আত্মমর্যাদা নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো!
--
রোহান সদ্য স্নান সেরে পোষাক পরিবর্তন করে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলো, মুগ্ধ তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, মাথা গামছার তলে রেখেই চুল শুকাচ্ছে। ইতিমধ্যেই মুগ্ধর নাসিকা লোহিতাভ বর্ণে রঞ্জিত। রোহান এক চোরা হাসি ছুঁড়ে প্রশ্ন করল,
——— তুই কিভাবে জানলি যে আমি ওখানে থাকতে পারি?
মুগ্ধ ঠান্ডা নির্লিপ্ত কন্ঠে উত্তর করল,
——— "তুই যে সেখানেই থাকবি, এটুকু আমার জ্ঞাত।"
রোহান হাস্যপল্লবে কৌতুক করল,
——— "অন্তর্গামী, সর্বজান্তা তুই?"
মুগ্ধে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। মুখাবয়বে একবিন্দু পরিবর্তন দেখা গেল না; তার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে জড়িত প্রশ্ন ধ্বনিত হলো যেন শীতল কণ্ঠে ধারালো অস্ত্র,
——— "তার নাম কী?"
রোহান স্তম্ভিত, নিঃশব্দে থেমে গেল। হাস্যচ্ছলে চেতনার প্রবাহ ম্লান হয়ে গেলো। মৃদু, তবু গভীর বেদনার গন্ধে সে বলল,
——— "ওর নাম জানতে চাস না; এই নাম উচ্চারিত হলে কলঙ্কের ছায়া বর্ষিত হবে।"
মুগ্ধ নির্বাক, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সূচনায় সবকিছু বুঝে নিল। হঠাৎ করেই রোহানের চোখে ভাসলো অশ্রু, টলোমলো দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে সে যেন নির্জন, নিঃসঙ্গ প্রলাপের অন্তিম পংক্তিগুলো উচ্চারণ করল,
——— " ভালোবাসা আমার, অশ্রুবিন্দু বিনষ্ট রজনীর একাকী সুর আমার, সীমাহীন শূন্যতার অন্তঃস্থ যন্ত্রণা আমার, বর্জিত স্বপ্নের গভীর ক্ষত আমার, চূর্ণ হৃদয়ের নীরব ক্রন্দন আমার; সকল কিছু আমারই, শুধু সে আমার নয়। তুই কেন জানতে চাস তার নাম? সেই নাম একান্তই আমার বক্ষের অন্তর্গূঢ় বেদনার স্বাক্ষর, অব্যক্ত কষ্টের কুয়াশার অন্তরালে লুক্কায়িত। এই নামের প্রতিটি হরফ আমার হৃদয়ের গহীনে নির্লিপ্ত প্রতিধ্বনি তোলে, ধরা পড়ে না পৃথিবীর কোনো স্থান, কোনো কালের প্রত্যুষে।"
মুগ্ধর বক্ষ বিদীর্ণ করে উদগত হলো এক দীর্ঘশ্বাস, এইতো পরিণাম, অতঃপর কিছুই আর করণীয় নেই! রোহান পুনরায় আর্তনাদে বলল,
——— "মিষ্টিকে মনে আছে? একসাথে পড়তাম। মনের অন্তঃস্থল কেঁপে উঠত তার জন্য! বলিনি কখনো; ভাবতাম, বড় হলে বলব! কিন্তু জানতাম কি, তার জীবন সংসার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে! চারটি বর্ষ অতিবাহিত; দু বছরের সন্তান আছে, দিন এনে দিন খায় এমন এক সত্তার সাথে ঘর বেঁধেছে! সংসারের ঝঞ্ঝাটময় বিকেলগুলো চায়ের দোকানে অতিবাহিত হয়। আমিও তো নিষিদ্ধ অনুরাগের বিষে বদ্ধ, তবু বিরহমগ্ন হৃদয়ের দাবিকে প্রতিনিয়ত সুধান্বিত করি চিনি ছাড়া এক কাপ তিক্ত চা পান করে। জীবনের সমস্ত মাধুর্য হারিয়েছি, তাই চোখ ফেরাইনা তার দিকে, কথাও বলি না; শুধু অনুভব করি; শুধু বাঁচার ব্যাকুলতা।"
এমতবস্থায় রোহানের কণ্ঠরুদ্ধ হলো। ভালোবাসা কি আদৌ বিধি মানে? মুগ্ধ এ সত্য জানে, বহুকাল আগে থেকেই যবে থেকে পড়াশোনা করেছিল একসাথে একই ক্লাসে তবে থেকে! প্রশ্নটা ইচ্ছে করেই করা কেননা বেদনাসিক্ত এ হৃদয়ের ভার কখনো কখনো উগরে ফেলতেই হয়! বেদনা কমবে না, তবে হয়তো এই গহীন চাপা ভারটুকু খানিকটা হ্রাস পাবে।
মুগ্ধ ধীরে ধীরে দাঁড়ালো, রোহানের কাছে গমন করল। তার চোখের লুক্কায়িত অশ্রু নিষ্ঠুর হাতের কঠোরতায় মুছে দিয়ে বলল,
——— "ভালোবাসার আগে দহনের যন্ত্রণা সইতে হয়, পাওয়ার আগে হারানোর ভয়কে বুকে চেপে রাখতে হয়। স্বপ্ন দেখার আগে ভাঙার প্রস্তুতি নিতে হয়, কাছে আসার আগে দূরে থাকার অভ্যাস গড়তে হয়।
বন্ধনের আগে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা বুঝতে হয়, হাসার আগে কাঁদার দুঃখ সইতে হয়। ছোঁয়ার আগে ফসকে যাওয়ার যন্ত্রণা মেনে নিতে হয়, একাকীত্বের অন্ধকারে ডুবে যেতে হয়।
যদি ভালোবাসতে চাও, তবে বেদনাকে আলিঙ্গন করে পোড়ার সাহসও থাকতে হয়।"
আর কথা রইল না মুগ্ধর! শ্বেতপাথরের প্রাচীর ভেদ করে ঝড়ো গতিতে বেরিয়ে গেলো সে রুম থেকে! সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা রোহানের মা নির্বাক; তার হৃদয় দহনরত অনলে পুড়ছে। তার হাস্যরসিক ছেলেটা এমন গভীর যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে রেখেছে? মায়ের চোখের পাতায় অশ্রুর স্রোত আছড়ে পড়ল।
--
মুগ্ধ ফের বৃষ্টির অবিরাম প্রবাহে নিজেকে সমর্পণ করল! তাকে জ্বর স্পর্শ করুক, তাতে তার কিছু যায় আসে না! হৃদয়পটে বয়ে চলেছে এক অবর্ণনীয় ঝড়। এমন শীতল, কঠোর ব্যক্তিত্বও কি এরূপ বিহ্বল হতে পারে? নিজের তিক্ত হাস্য নিয়ে বিদ্রূপ করল মুগ্ধ। এই মুহুর্তে সে কেবল এক বিশেষ ব্যক্তির সংস্পর্শের আকাঙ্ক্ষায় প্রবলভাবে তৃষ্ণার্ত! তবে এ অসম্ভব! এলোমেলো পায়ে হাটতে হাটতেই সে সিক্ত দেহে শীতল কণ্ঠে বলে উঠল,
——— "তুমি আমার প্রিয় জীবাণু! যাকে আমি সেচ্ছায় শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছি। তোমার হিংস্র বি'ষের প্রবাহেই ধীরে ধীরে মৃ'ত্যুর আবর্তে নিমজ্জিত হচ্ছি। কেননা তোমার মতো কীটেই আমি হৃদয়ের সমগ্র আরাধনা অর্পণ করেছি।"
______
রাত্রির দশটি প্রহর অতিক্রান্ত। ঝড়ের নির্ঘোষ থেমে গেছে, তবে প্রকৃতির নিস্তব্ধতায় অব্যক্ত এক প্রতীক্ষা বোধ করি। হাওয়া স্থির, নাঈমের প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায় একাকী বসে; কিসের আকর্ষণে এই স্থানে নিজের পায়ের গাঁট খুলে বসে থাকা, যদিও পিতামাতার সঙ্গে প্রস্থান করার অনুরোধ উপেক্ষা করেছিল। হাওয়ার বাবা ছ'দিন পূর্বে জানাজার নামাজ শেষে অন্তিমযাত্রা করেছিলেন, আর মা প্রস্থান ঘটেছে বিগত দিবসে।
নাঈমের বিষাদই হাওয়ার এখানে অবস্থানের নীরব প্রণোদনা। বোন হারানোর মর্মে ছেলেটি যেন এক বিষন্নতার অতলান্তে তলিয়ে গেছে, দৈহিক যত্নে অনাগ্রহী; শয্যায় দেহ রেখে তার চক্ষু অবিরত শূন্যে পথ চেয়ে থাকে। হাওয়া যদি কিঞ্চিৎ পরমায়ু বিলিয়ে দিতে পারে, হয়তো এ হৃদয়ের উপবাস কাটে। হোক না সে বিরাগের প্রাচীর তুলে! প্রিয়জনের এমন অবনতির দর্শন সহস্র কণ্টকের মতো তার অন্তরে বিধে যায়। এদিকে গৃহবাসী সকলেই রাত্রির কোলে আশ্রয় নিয়েছে; হাওয়া নির্জনপ্রান্তে বসে আছে, আঁখির গৃহকক্ষে এক প্রহর অতিবাহিত করে এসেছে। আঁখিও যেন নিজের শোকে পাথর, নীরব প্রস্তরসম জীবন ধারণ করছে। এ সকলের যন্ত্রণা কি অনন্তকালব্যাপী চলবে?
সোফায় বসে নিদ্রার আবেশে টলমল করতে করতে হাওয়া ক্লান্ত দৃষ্টিতে চারপাশের আধো আলো-আঁধারিতে ডুবে থাকে। রাতের গভীরে এতক্ষণ জেগে থাকা তার স্বাভাবিক অভ্যাস নয়; তবু, এই নীরবতার প্রান্তে, নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। ঘরের সকল বাতি নিভিয়ে রেখেছে সে; কেবলমাত্র এক বিন্দু ড্রিমলাইটের আবছা আলোর মায়া ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে।
তখনই সদর দরজার শব্দে সমগ্র স্থানের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল। হাওয়া তৎক্ষণাৎ ঘুরে তাকালো; নাঈম প্রবেশ করেছে। নাঈমের দৃষ্টিতে কিছু কঠোরতার ছাপ, এক অদৃশ্য জিজ্ঞাসার সুর, সে হাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
——— "ঘুমাস নি কেন?"
হাওয়া অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসায়, গভীর এক মনোযোগে মৃদুস্বরে উত্তর দিল,
——— "তুই না খেয়ে আছিস, আর তোকে রেখেই ঘুমোতে যাই কী করে বল? যা, গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়, খাবার টেবিলে উপর বাড়া আছে।"
অদ্ভুত এক বৈপরীত্যের ছায়া যেন নাঈমের মনে উদ্ভাসিত হলো—যেখানে মায়ের থাকা উচিত, সেখানে হাওয়া আছে, নিঃশব্দ এক উপস্থিতি হয়ে। তবে, এই মেয়েটির নিবিড় পরিচর্যা আর অবাধ্য ভালবাসা নাঈমের মনোজগতে ক্ষণিকের জন্য মাতৃস্নেহের পরশ অনুভব করালো। যদিও তার মায়ের অসুস্থতা তাকে এত রাত্রে জাগতে দেয় না; তিনি ঘুমের ঔষধের কারণে নির্ধারিত গভীর নিদ্রায় অচেতন। সুতরাং মায়ের প্রতি কোন অভিমান নেই; বরং হাওয়ার এই নিঃস্বার্থ প্রতীক্ষায়, রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে এক অম্লান সুরের মতো নাঈমের অন্তর্দ্বন্দ্বের কাহিনী ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে।
নাঈম ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, দৃষ্টিতে এক অভিব্যক্তিহীন প্রশান্তি ফুটে ওঠে, যা তার অন্তরস্থ দ্বিধা আর অজ্ঞাত আকর্ষণের মধ্যে এক অপূর্ব সেতুবন্ধন রচনা করে। হাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে, যেন তার চোখে এক অদৃশ্য বাঁধন বাঁধা—যতক্ষণ পলক না ফেলার ক্ষমতা থাকে, ততক্ষণ সে এ দৃষ্টিতে স্থির। হাওয়া, যে মেয়ে ছোট থেকেই তাকে অনুসরণ করে, নির্দ্বিধায় অবহেলা আর অপমান সহ্য করেও, অবিচল এক নিষ্কলঙ্ক ভালোবাসার প্রতীক হয়ে প্রতিবার ফিরে আসে তার কাছে।
এই মেয়েটার প্রতি কি আদৌ কোনো অনুভূতি নেই তার? নাঈম জানে না। এই যে মেয়েটা; যার হাসির সুর যেন বুকে ঝংকার তুলে, যার মায়াময় মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলে সমস্ত দুঃখ ম্লান হয়ে যায়, তার প্রতি কী এক গভীরতর আকর্ষণ নাঈমকে অদৃশ্যভাবে টানে। এমন দিন নেই, যখন তার হৃদয়ের গভীরে চায়নি মেয়েটার পায়ে দুনিয়ার সব সুখ ঢেলে দিতে।
কিন্তু নাঈমের মনের অন্তরালে এক প্রাচীর, এক কালো আবরণ, যাকে সে কোনো দুর্বলতা দিয়ে কলুষিত করতে চায় না। এই মেয়েটির জীবনের পথে নিজেকে এক বেদনার ছায়া হয়ে কখনো মিশতে দেয় না, কারণ সে জানে, এই মায়ার গাঢ় বন্ধন একদিন তার মনকে পূর্ণভাবে গ্রাস করতে পারে। তাই অবহেলাই তার একমাত্র অস্ত্র, অদৃশ্য দূরত্ব বজায় রেখে সে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে, আবার মেয়েটার জীবনটাকে বিশৃঙ্খল করতে চায় না।
কিন্তু আজ, এই গভীর রাত্রে, যখন সে দেখল, কেউ বসে আছে তার অপেক্ষায়, তার খাবার ঠিক রাখার প্রয়াসে, তার অবিশ্রান্ত হৃদয়ের মধ্যে অনির্বচনীয় প্রশান্তি খেলে গেল। যেন এই অন্ধকার জীবনের একমাত্র আলোকস্তম্ভ এই মেয়েটাই, তার অভিমানী মনকে এক ক্ষণিকের জন্য উষ্ণতার আস্বাদ দেয়।
নাঈমের গভীর দৃষ্টির আড়ালে হাওয়া নিজেকে অপ্রস্তুত অনুভব করে, তবু তার হৃদয়ে সুপ্ত আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। এই প্রথমবার, যেন নাঈম তাকে নিখাদ মনোযোগে দেখছে, অথচ এই মুহূর্তের অন্তর্গত আবেগে হাওয়ার বুকের অন্তর্গত লজ্জা ধীরে ধীরে তার চেহারায় ফুটে ওঠে। ঠিক তখনই, নাঈমের কণ্ঠ এক কোমল সুরে বেজে ওঠে,
——— "আর কত অপরাধী বানাবি আমায়! নিজেকে আর অপরাধী বানাতে পারব না।"
হাওয়া সামান্য থমকে দাঁড়িয়ে তার চোখের গভীরে অপূর্ব সাহস খুঁজে পায়। মৃদুস্বরে, গভীর এক আত্মসমর্পণের ছোঁয়ায় সে বলে,
——— "তুই ভালোবাসিস আর নাই বা বাসিস, এই মন তোকে দিয়েছি বহুকাল আগে। ভালোবাসা পেতেই হবে তার কি কোনো কারণ আছে? দরকার নেই তো! শুধু মাঝে মাঝে রাগের ছলে একটু কথা বলে নিস, তাতেই আমার হৃদয় খুশিতে ভরে যাবে।"
নাঈম কিছুক্ষণ নীরব থাকে, তার অভ্যন্তরে কী এক অজানা উথালপাথাল চিন্তা যেন ভেসে উঠতে থাকে। তার মনে এ আকস্মিক ভাবনা আসে, একটি মেয়ে এতটা অবহেলা সত্ত্বেও এত নিষ্কলঙ্ক ভালোবাসা নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, এতটা নিঃস্বার্থভাবে। সে গভীর এক হতাশার সুরে বলে,
——— "দুর্বলতা বারাস না! চলে যাবি এখান থেকে! আমার সামনে থেকে! আর আসবি না আমার সামনে!"
নাঈমের কণ্ঠে অনুচ্চারিত কাতরতার সুর হাওয়ার হৃদয়ে এক বিষাদঘন ভার সৃষ্টি করে। হাওয়া এক তীব্র ব্যথার অনুভব নিয়ে নিস্তরঙ্গভাবে বলে,
——— "দূর থেকেই দেখার সুযোগটা দে! কাছে টেনে নিতে হবে না! এতেই সন্তুষ্ট আমি।"
হাওয়ার চোখে টলমল করা জল দেখে নাঈমের হৃদয় এক মুহূর্তের জন্য অবশ হয়ে আসে। সে হাত বাড়িয়ে ধীরে অশ্রুবিন্দু মুছে দিয়ে বলে উঠল,
——— "এই নীরব অশ্রু অস্ত্র দিয়ে কি আমার হৃদয় জয় করতে চাস?"
নাঈম এ উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হল, কিন্তু আকস্মিকভাবে হাওয়া সোফা থেকে উঠে পেছন থেকে নাঈমের বলিষ্ঠ বাহুটি শক্ত করে জড়িয়ে নিল। নাঈম থমকে দাঁড়িয়ে গেল, যেন পুরো জগতটাই হঠাৎ স্থির হয়ে গেল তার চারপাশে। এটা কি সত্যিই ঘটছে তার সাথে? এই অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে তার মস্তিষ্ক তাকে সাবধান করছে, মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়াই বোধহয় উচিত, তবু কেন যেন তার হাত-পা একেবারে জমে গেল, এক রহস্যময় শক্তি তাকে স্থির করে রাখল।
হাওয়া ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করল, নাঈমের পেটের দিকে হাত দিয়ে তার শার্ট আঁকড়ে ধরে রেখেছে শক্ত করে। চোখের জল গড়িয়ে নাঈমের শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে, আর নাঈম দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মতো নীরব, নিঃশব্দে। তার হাত মুঠিবদ্ধ, দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল, নিজের অনুভূতির স্রোতকে দমিয়ে রাখার কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়েছে।
--
উপরতলায় দাঁড়িয়ে রেলিঙ ধরে শান্ত নির্ভার চোখে নীচের দৃশ্য দেখছে। সেখান থেকে পুরো ড্রয়িং রুমটি স্পষ্ট দেখা যায়, আর মুখে তার এক হাসির আভা। ঠোঁটের কোণায় সেই সুকৌশল হাসি ঝুলিয়ে শান্ত ফিসফিস করে বলল,
——— “ ভাইটা অবশেষে সেই অপ্রতিরোধ্য টানের কাছে পরাভূত হল!”
এই কথাটি বলেই হালকা হাসি দিয়ে শান্ত ধীর পায়ে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়াল। আফিয়া বেগম দরজা বন্ধ করেননি, চোখ বুজে শুয়ে আছেন, কিন্তু ঘুমের গভীরতায় ডুবে যাননি। শান্ত মায়ের মুখখানি একবার গভীরভাবে দেখে আবার পা বাড়াল নিজের ঘরের দিকে। যাওয়ার আগে, পা থামিয়ে আরেকবার নিচের দিকে তাকালো; সেই দৃশ্য, নাঈম ও হাওয়ার সেই নিস্তব্ধ আলিঙ্গন ।
__
আলো-আঁধারিতে ছায়ার মতো স্থির দাঁড়িয়ে শান্ত অবশেষে নিজের ঘরের দিকে ধীর পদক্ষেপে চলে গেল, মুখে সেই একই গূঢ় হাসির রেখা।
অন্য কাল, অন্য ক্ষণ, অন্য রাত্রিতে হয়তো শান্ত এখন কোনো নারীর সাহচর্যে নিজেকে মগ্ন করত। তার র'ক্তক্ষুধারূপী বাসনা তৃষ্ণার্ত হয়ে অপেক্ষা করত, উদ্দামতার খোলসে মোড়া এক নিষ্ঠুর লিপ্সায়। এ যেন প্রলাপমত্ত এক উন্মাদনা, যেখানে অন্য নারীর রক্ত-মাংসে সে তার বাসনার শেকড় বিস্তার করে।
কিন্তু আজ! আজ তার বোনের র'ক্তমাখা শীতল শরীরের স্মৃতি এতটাই গভীরে রেখাপাত করেছে যে, প্রতিটি নারীর শরীরের উপর ছায়া ফেলে গেছে সেই নিষ্প্রাণ চাহনি। গত ছয় দিন ধরে শান্ত নারীর সান্নিধ্য এড়িয়ে চলেছে, কারণ তার চোখে ভেসে উঠে মৃ'ত বোনের নিষ্পলক দৃষ্টি। প্রতিশোধের অগ্নিশিখায় দীপ্ত হয়ে উঠেছে শান্ত, যে আফ্রিদি তার বোনের জীবন কেড়ে নিয়েছে, তার শ্বাস-প্রশ্বাসে বিদ্রোহের বিষবাষ্প ছড়িয়ে রয়েছে; শান্ত তার পিশাচি হৃদয় নিয়ে কখনও সেই পিশাচকে ক্ষমা করবে না, বরং প্রতিশোধের বিষম দহনে দগ্ধ করে ছাড়বে।
কিন্তু তবুও, কালের প্রাচীন প্রান্তরে প্রশ্ন জাগে, শান্ত কি কখনো ভালোবাসাকে স্থান দিয়েছিল? তার অভিশপ্ত হৃদয়ে কি কোনো একদিন কোমলতার পরশ পড়েছিল? সেই নিষ্ঠুর চোখে কি কখনো সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি ফুটেছিল? কোনো নারীর হাসির প্রতিধ্বনি কি কখনো এই করাল হৃদয়েও তরঙ্গ তুলেছিল? শান্ত তিক্ত হাসি হেসে নিজের অন্ধকারে ডুবে যায়, জীবন তার জন্য এক অনিবার্য অন্ধকার, আর সে স্বেচ্ছায় সেই অন্ধকারেই নিজেকে বন্দি করে রাখবে।
নিজের কুঠুরিতে প্রবেশ করে, শীতল বিছানায় শুয়ে পড়ল শান্ত, দেহের চেয়েও তার হৃদয়ই অধিক ক্লান্ত; নিষ্ঠুর প্রতিজ্ঞায় সংকল্পবদ্ধ হয়ে সে স্থির শুয়ে রইল, দেহ, মন, ও আত্মা এক নিষ্প্রভ নিস্তব্ধতার সঙ্গেই চিরকালীন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে।
___________
সকালের প্রভাতে সিআইডি বিউরোর অভ্যন্তরে অপূর্ব কিন্তু শীতল পরিবেশ। মুগ্ধের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, লাল চোখ, আর ঠান্ডায় জমে যাওয়া খারা নাক প্রমাণ বহন করছে বৃষ্টিতে ভিজে কেটে যাওয়া দীর্ঘ যন্ত্রণাময় প্রহরের। বারংবার রুমালে মুখ ঢেকে হাঁচি দিচ্ছে সে; জ্বরের উত্তাপ তার শরীরে ছায়া ফেলেছে বটে, তবে কাজে বিরতি নেওয়ার উপায় নেই। মুগ্ধ এমনই এক ব্যক্তি, যে নিজের অসুস্থতা বা কষ্টকে কাজের পথে বাধা হতে দেয় না।
এসিপি মুযহাব সাহেবের চোখে উদ্বেগের রেখা, কথার সুরে একপ্রকার হতাশার শ্বাসের ছোঁয়া,
——— "আহা, কী জ্বর বাঁধালে! বৃষ্টিতে কেন ভিজতে গিয়েছিলে??"
মুগ্ধ কর্কশ হেসে বলে উঠল,
——— "এই বৃষ্টি যেন আমার ভাগ্যের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্যার! তবে এসব ক্ষুদ্র অস্বস্তি আমার পথে বাঁধা হতে পারবে না।"
এসিপি মুযহাব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তদন্তের গভীর আলাপচারিতায় প্রবেশ করেন,
——— "কতটুকু অনুসন্ধান করেছো?"
মুগ্ধ ধীরে গম্ভীর সুরে প্রতিউত্তর করল,
——— "শিকদার পরিবারের ব্যবসা বহিরঙ্গে যতোটা স্বচ্ছতার মুখোশে আচ্ছাদিত, অন্তঃস্থলে ততটাই অস্পষ্ট, সংকীর্ণ ও জটিল। তাদের ব্যবসার শেকড় শুধু দেশেই নয়, বহির্বিশ্বের বহু ক্লায়েন্টের মাঝে বিস্তৃত। ভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান খুলে, কূটকৌশলে ধূলিসাৎ করে রেখেছে আসল উদ্দেশ্যগুলো। তবে অত্যন্ত সূক্ষ্মতা ও সতর্কতার সাথে এই ঘন রহস্য উন্মোচন করতে হবে।"
এসিপি মুযহাব আরেকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ভ্রুকুটি ভাঁজ করে বলেন,
——— গুড়ো মরিচ বিষয়ে কী জেনেছো?
মুগ্ধ নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
——— "শিকদার বাড়ির রান্নায় ব্যবহৃত গুড়ো মশলা আর ইকরাম আলীর কাছে পাওয়া গুড়ো মরিচ - এ দুটো এক নয়। আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে ব্র্যান্ডের মশলা এরা সাধারণত ব্যবহৃত করে, সেটি এবার ব্যবহার করা হয়নি। আর যেটি ব্যবহার করত আগে সেটিই ইকরাম আলীর লা'শে পাওয়া গিয়েছে। এবারই ভিন্ন ধরনের মরিচের গুড়ো কেনার পিছনে নির্ঘাত কোনো অজানা কারণ লুকিয়ে আছে।"
এসিপি মুযহাব গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন, আবারও প্রশ্ন করলেন,
———" এবারই কেন এই পরিবর্তন? কোনো ধারণা করতে পেরেছো?"
মুগ্ধ গম্ভীর চোখে চেয়ে বলল,
——— "এই রহস্য কিছু সংকেত বহন করছে, তবে সেটি উন্মোচন করতে আমাদের শিকদার বাড়িতে যাতায়াত রাখতে হবে।"
ঠিক সেই মুহূর্তে মহুয়া একটি রিপোর্ট হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালো। তদন্তের সময় কিছু শ্রমিকের শরীরে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে সকলের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছে, এবং এই মুহূর্তে তার হাতে রয়েছে ডক্টর উজ্জ্বল সাহেবের করা সেই পরীক্ষার রিপোর্ট। মহুয়া উদ্বেগের সুরে বলল,
——— "স্যার, এই রিপোর্টগুলো দেখুন। এখানে সেইসব শ্রমিকদের মেডিকেল রিপোর্ট এর তালিকা দেওয়া আছে, যাদের প্রত্যেকের শরীর থেকে একটি করে কিডনি অনুপস্থিত। বিষয়টি আরও ভাবনার কারণ হলো, এরা কেউ-ই এ ব্যাপারে কিছুই জানে না।"
মুগ্ধ গভীর চিন্তামগ্ন কণ্ঠে বলল,
——— "এর পেছনে নিশ্চয়ই সেইসব হাসপাতালের কোনো না কোনো চিকিৎসক কিংবা স্টাফদের হাত রয়েছে, যাদের কাছে এ শ্রমিকরা চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। এবার খুঁজে বের করতে হবে, এরা ঠিক কোন কোন হাসপাতালে গিয়েছে, এবং কারা ছিল তাদের চিকিৎসক।"
রুদ্র প্রবেশ করতে করতে তার কণ্ঠে এক অদৃশ্য তীক্ষ্ণতার আভাস এনে বলল,
——— "শিকদারদের ব্যবসা কি শুধু ধানেই সীমাবদ্ধ? না, ওরা তো এক বিস্তৃত সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে—গরু, ছাগল, মাছ, শাকসবজি থেকে শুরু করে আসবাব, গয়নার শোরুম পর্যন্ত। প্রত্যেকটি শোরুম আলাদা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা, সম্পদের বৈভব দিয়ে চারপাশ ঘিরে ফেলা। কোথাও কেবল স্বর্ণালঙ্কার, কোথাও হীরা; কোথাও বিলাসবহুল কাপড়, আবার কোথাও গাড়ি-বাইকের জমকালো প্রদর্শনী।"
রুদ্রর চোখে রহস্যময় দৃষ্টির শিখা ফুটে ওঠে, সে বলল,
——— "এই সমস্ত জায়গায় গিয়ে তদন্ত করতে হবে। সত্য গোপনে কী কী মোড়ক আবৃত করে রেখেছে, তা এবার উন্মোচিত হোক।"
এসিপি মুযহাব গভীর মনোযোগে প্রতিটি শব্দ শুনলেন, চোয়ালে দৃঢ়তার ছাপ রেখে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
——— "আচ্ছা মুগ্ধ, শিকদার পরিবারের নামডাক সাধারণের মধ্যে কতটুকু প্রোথিত? আমি তো বেশ ভালোই শুনেছি!"
মুগ্ধ তখন ডেস্ক থেকে কফির মগটি তুলে নিলো, কর্মীর সদ্য বানানো সেই ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিয়ে গভীর কণ্ঠে বলল,
——— "সাধারণ মানুষ তো বরাবরই তুচ্ছ প্রণোদনায় তুষ্ট, স্যার! এদের বিনামূল্যে একটুখানি কেরোসিন দিলেই গুণগান করতে শুরু করে। বুদ্ধির অভাবে বিচারের ক্ষমতা শূন্য। প্রতি শীতে অল্প কিছু বস্ত্র বিতরণ, বছরে দুই ঈদে সামান্য খাবার-সামগ্রী সাথে কিছু বস্ত্র! আর কেউ অসুস্থ হলে হাতুড়ি ডাক্তার পর্যন্ত পাঠানোর সামান্য আনুকূল্যেই তাদের প্রশংসার জোয়ার। সাধারণের বুদ্ধি আজকের মতো না, সেই দিনের মতো সরলই রয়ে গেছে!"
মুযহাব সাহেব কফির মগে আরেক চুমুক দিয়ে গলা একটু পরিষ্কার করলেন, তারপর গভীর দৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন,
——— "তোমার বাবার বিষয়ে কি বলবে, মুগ্ধ? তোমাদের শাহারিয়াজ বাড়ি আর শিকদার বাড়ির শত্রুতা তো প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। এখনো সেই সম্পর্কের ছায়া টিকে আছে, তাই না?"
রুদ্র আর মহুয়াও কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে মুগ্ধের দিকে। মুগ্ধ কফিতে আরেকটি চুমুক দিয়ে হালকা বাঁকা হাসি হেসে বলল,
——— " প্রতিশোধের অগ্নিতে তারা যে এমন কাজ করেনি তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শিকদার বাড়ির উপরে যেমন আমার কড়া দৃষ্টি, তেমনি আমার নিজের বাড়িতেও । স্রেফ এটুকুই বলছি, খু'নি যদি আমার পরিবারের কেও হয়, তবে তাদেরও নিষ্কৃতি নেই।"
মুযহাব সাহেব মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন,
——— "হ্যাঁ, তোমার দৃঢ়তার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে।"
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
——— "আচ্ছা, তাহলে সবাই নিজেদের দায়িত্বে মনোযোগী হও। তদন্তের কাজ এগিয়ে নাও।"
কফির মগ খালি করে মুগ্ধ, রুদ্র, আর মহুয়া আবার তাদের তদন্তের পথে এগিয়ে যেতে লাগল। প্রস্থানপথে রুদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো মিথিলা, যেন মহীরুহের শাখা বিস্তার করে মুগ্ধের গতিকে বন্দি করলো সে। কোমল অথচ দৃঢ় হাসিতে রুদ্র আর মহুয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,
———" তোমরা বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো, আমার মুগ্ধর সাথে একান্ত কিছু বাক্য বিনিময় বাকি রয়ে গেছে।"
মুগ্ধের চোখ সংকীর্ণ, চাহনিতে যেন বজ্রের কঠিন কঠোরতা। কণ্ঠ গভীর, অক্ষরে প্রতিটি স্পন্দন একটি নিষ্ঠুর অগ্রাহ্যতা মিশ্রিত,
——— "কাজের বাইরে তোমার সাথে আমার আর কোনো সংলাপের প্রয়োজন নেই।'
মিথিলা মৃদু হাসিতে জবাব দিলো, হাসির প্রতিটি বাঁক দৃষ্টির অন্তরালে লুকায়িত গোপন বার্তার ভার বহন করছে,
——— "আরে, কাজের কথাই তো। রুদ্র, মহুয়া, বাইরে অপেক্ষায় থাকো। মুগ্ধ কিছুক্ষণ পর আসছে।"
মুগ্ধ মিথিলার তীক্ষ্ণ চাহনি আর অভিব্যক্তির ব্যাকরণ বিচারে নীরবে পর্যবেক্ষণ শেষে একটুখানি ইঙ্গিতে রুদ্রকে প্রস্থান করার আদেশ দিলো। রুদ্র এবং মহুয়া নীরব পদে বাহিরে দাঁড়াল, গাড়ির সম্মুখে। রুদ্র ঘড়িতে সময় দেখে ব্যস্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, আর মহুয়া যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে এক অমীমাংসিত প্রশ্নের জন্য। গলা পরিষ্কার করে একরকম সাহসের সঞ্চয়ে রুদ্রর কাছে নিবেদন করল,
——— "একটা কথা বলি?"
রুদ্রের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে অনুসন্ধান করলো, কণ্ঠে নির্জনতার স্পন্দন,
——— "কি বলো?"
——— "তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?"
রুদ্র মুহূর্তের বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলো মহুয়ার দিকে, আর মহুয়া সংকোচে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কোনো অপরাধবোধে বাঁধা পড়ে গেছে। রুদ্র অবশেষে নীরবতা ভাঙলো,
——— " হ্যাঁ, বাসি তো! "
মহুয়ার হৃদয়ের অন্তরালে আঘাতের মতো বাজলো সে উত্তর; মনে হলো কেউ তার হৃদয়পটে শাণিত অ'স্ত্রাঘাত করেছে। রুদ্র ঠোঁটের কোণে রহস্যমাখা হাসি মেলে বলল,
——— "আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। আর বর্তমান আমার পরিবার হলো আমার চাচা আর চাচি।"
মহুয়া এবার রুদ্রের দিকে রাগী চোখে তাকালো; চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। নিজেকে সামলে, রাগ মুঠোয় বন্দি রেখে বলল,
——— "আমি ওই ভালোবাসার কথা বলছি না!"
——— "তাহলে কোন ভালোবাসার কথা বলছ?"
একটুখানি ভ্রু নাচিয়ে যেন খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানাল রুদ্র। মহুয়া তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
———" আমার মাথা! গাধা!"
———" এটা তো জানিই, তোমার আর গাধার মাথার তফাৎ নেই! "
এটা শুনে রাগে গিজগিজ করতে করতে গাড়ির ভেতর গিয়ে এক প্রকার অভিমান আর ক্ষোভের মিশেলে মুখ ফুলিয়ে বসে রইল মহুয়া। মহুয়ার এমন রাগ মেশানো অভিমানে রুদ্রর মুখের হাসি চেপে রাখাটা যেন অসম্ভব হয়ে পড়ল। ঠোঁট কামড়ে হাসি সংবরণ করে কণ্ঠে ম্লানতা এনে বলল,
——— " ভালোবাসতে ভয় করি; যদি কখনো তা হারিয়ে ফেলি, যেমন হারিয়েছি অজস্র প্রিয়মুখ। তেমন নতুন করে ভালোবাসার সুরায় ডুব দেওয়ার সাহস যেন আর ফিরে আসে না।"
তৎক্ষণাৎ মুগ্ধ ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলো, মুখাবয়বে নিস্পৃহতার ছাপ; যেন অনুভূতিহীন পাথরের অবয়ব। রুদ্র তার দিকে তাকিয়ে পিঞ্জরিত কণ্ঠে বলল,
——— "স্যার, তদন্ত সম্পর্কিত কি কোনো নির্দেশ ছিলো? কি কাজের কথা বলল আপনাকে?"
মুগ্ধের ঠোঁটের কোণে এক বিদ্রূপাত্মক হাসির রেখা দেখা দিলো। এক নির্মোহ সুরে সে বলল,
———" না, তেমন কোনো গুরুতর বিষয় নয়। কিছু অস্থিরতা ছিল, সেটুকু প্রশমিত করে এসেছি। এসব ছেড়ে দাও! চল, যাই এখন।"
কথাগুলি বলেই মুগ্ধ নির্বিকারভাবে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে আসন গ্রহণ করল। রুদ্র মুগ্ধের কথার গূঢ় অর্থ বুঝতে পারল না, তবু অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হলো না; কারণ সে জানে, মিথিলা প্রায় বছরখানেক ধরে মুগ্ধের প্রতি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করছে। রুদ্র আর দ্বিধায় না থেকে গাড়িতে উঠে বসল, আর মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটি বায়ুর বেগে উধাও হয়ে গেল।
______
ডক্টর উজ্জ্বল ফরেনসিক ল্যাবে একাগ্রচিত্তে পরীক্ষার কাজ করছিলেন। তখন মিথিলা প্রবেশ করল। ডক্টর উজ্জ্বল ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালেন, যেন মুখে রচিত সমস্ত প্রশ্নই ভ্রুতে সঞ্চারিত হয়েছে। চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
——— "কি হয়েছে মিথিলা? তোমার মুখ এত লাল কেন? ঠোঁটের নিচে ক্ষত দেখছি?"
মিথিলার শুভ্র মুখমণ্ডল রক্তরাঙা গোলাপের মতো রক্তিম হয়ে উঠেছে, গোলাপি ঠোঁটের তলায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এক প্রকার বিদ্রূপ মিশ্রিত হাসি ঝুলিয়ে মিথিলা বলল,
——— "আহা স্যার, তেমন কিছুই নয়! প্রণয়ের অবগাহনে এই ক্ষত লাভ হয়েছে।"
শেষের বাক্যটি নিজের কাছে ফিসফিস করে বলল মিথিলা। ডক্টর উজ্জ্বল সামান্য মুচকি হেসে বললেন,
——— "হুম! চুল কিন্তু এমনি এমনি পাকেনি। অনেক কিছুই বুঝি।"
এ কথা বলেই তিনি আবারো তার কাজে মনোনিবেশ করলেন। মিথিলা দ্রুতপদে ওয়াশরুমের দিকে ছুটল, মুখ পরিষ্কারের জন্য। তার এমন তাড়না দেখে ডক্টর উজ্জ্বল আবারও এক ধরণের বিদ্রূপাত্মক হাসি হাসলেন।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu