লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
সময়, নিঃশব্দে পলাতক চোরের মতো ফাঁকি দিয়ে কত দ্রুত যে বহে যায়, সে অন্তর্হিত কালের গর্ভে। এক মাস অপার স্রোতে মিশে বিলীন হয়ে গেছে। বর্ষার নীরব প্রস্থান, শরতের অনিমেষ সৌন্দর্যে একমাস পূর্ণ হলো। নীলিমার প্রাঙ্গণে মেঘেরা অলস আলিঙ্গনে লীন; তুলোর গাঁদার মতো আকাশের বিশালতাকে তারা ভরে রেখেছে। সেই স্নিগ্ধ বাতাস হৃদি-তন্ত্রীতে এক মর্মস্পর্শী সুর তুলছে, আর ক্ষণে ক্ষণে ঝরে পড়ছে নীরব বৃষ্টিধারা।
তবে এই ধীরগতি প্রবাহে থেমে নেই অনুসন্ধান। মুগ্ধ, রুদ্র আর মহুয়া সত্যের প্রতিমূর্তি খোঁজার এক অদম্য দৃঢ়তায় এগিয়ে চলেছে। এক কথার প্রচলন আছে, "কেঁচো খুড়তে গেলে সাপ বেরিয়ে আসে।" এই তদন্তের পথ যেন সেই একই রহস্যঘেরা! তাদের অনুসন্ধান অবশেষে অজানা সত্যের এক একাধিক সূত্র খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে। মুগ্ধ বলে উঠল,
——— "এখন তো শুধু প্রতারকের মুখোশ উন্মোচন, হাতে-নাতে ধরার পালা!"
এই বাক্য সেই নিশির ডাকের মতো, যা গভীর রাত্রির চাঁদকেও শঙ্কিত করে। পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছুটে চলল।
---YouTube
শরতের এক স্নিগ্ধ, নিস্তব্ধ বিকেল। প্রকৃতির শান্ততা বাগানের প্রসন্নতার সাথে মিশে গিয়েছে। এই একান্ত নির্জনতায় দাঁড়িয়ে আছে এক গম্ভীর, শ্যামাঙ্গী কন্যা। বিলের জলধ্বনি তার কানে মৃদুমন্দ সুরের মতো প্রবাহিত হচ্ছে—গভীর মায়াবী সুর, যা তার অন্তর্গত বেদনায় সঞ্চারিত হচ্ছে। বুক ভরে শুষে নিচ্ছে সেই স্নিগ্ধ বাতাসের মর্মর সুধা, যা তার হৃদয়কে অচেনা কল্পলোকের আহ্বানে দোলা দিচ্ছে। বাতাসের আঘাতে তার লম্বা কেশরাশি উড়ছে অনন্তের পথে, এই নির্জনতারও নিজস্ব ভাষা আছে। বিরাট শিউলি গাছের ছায়ায় সে দাঁড়িয়ে আছে, ফুলগুলো একে একে ঝরে পড়ছে মাটিতে, তার অস্তিত্বের সাথে মিশে একটি রুদ্ধস্বরের আর্তি জানাচ্ছে।
সে কতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে, সময়ের কোনো ভ্রান্তি সে গ্রাহ্য করে না। তার ডাগর ডাগর চোখে এক অপার নিরাবেগ দৃষ্টি, যা ঝরে পড়া ফুলগুলোর স্পর্শে এক অশ্রুর মতো মিশে আছে। অন্য মেয়েদের মতো সে ফুলগুলোকে কানে গুঁজে নেয় না, হাতে তুলে নিতেও তার কোনো প্রয়াস নেই; বরং সে সেই পবিত্রতাকে অনুভব করছে মনের মর্মে। দীর্ঘ এক নীরবতার পর আঁখি বলে উঠল,
——— "এত দ্রুত যে এই সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, আপনার সান্নিধ্যের আশায় আমি কি আনন্দিত হব, নাকি নিজেই অনন্তের মায়ায় দূরত্বে ভেসে যাবার দুঃখে মর্মবেদনায় বিদ্ধ হব?"
কতই না অদ্ভুত তার জীবন! যে বয়সে তার হৃদয়ে আনন্দের রঙ ফুটে ওঠার কথা ছিল, যে বয়সে তার শিরায় শিরায় উচ্ছ্বাসের মিষ্টি ঢেউ খেলবার কথা ছিল, সেই বয়সেই সমস্ত আবেগের বর্ণ তাকে এড়িয়ে গেছে। সেজে-গুজে, উচ্ছ্বাসে ভরে ওঠার সেই সাধারণ বয়স তার কাছে কোনো এক দূরবর্তী স্বপ্ন। সেই বয়সে যেখানে অন্য মেয়েরা হাসিখুশি মুখে রঙিন স্বপ্নের আলিঙ্গনে ডুবে থাকে, সে দাঁড়িয়ে আছে এক নিঃসঙ্গ অন্ধকারে, যেখানে কষ্টই তার জীবনের একমাত্র সঙ্গী। কোনো আবদারের জেদ নেই, নেই কোনো বেঁচে থাকার নির্ভরতা। না বুঝার বয়সেও বুঝতে হয়েছে বেশকিছু! জীবনের জটিলতা থেকে দূরে থাকার যে নির্ভেজাল অধিকার, সেটুকুও তার অধিকার নয়।
তার জীবন বাকি সাধারণ মেয়েদের থেকে আলাদা। ছোটবেলা থেকেই সে এক কালো অধ্যায়ের মধ্যে বসবাস করছে, যা দিনের আলোর কাছে অপার রহস্যময়। পৃথিবীর চোখে তার অতীত এবং বর্তমান সবই এক অন্ধকার গুহার মধ্যে হারিয়ে গেছে। কেউ জানে না তার জীবনের গোপনীয়তা, অজানা তার সমস্ত বেদনা। আঁখি অল্প বয়সেই হৃদয়হীন এক মানবীতে পরিণত হয়েছে। বয়সে সে এক কিশোরী, কিন্তু মনের গভীরতায় সে বহু পুড়ে-পাওয়া একজন নারী। তার হৃদয়ে কোনো আবেগ নেই, নেই কোনো আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছে—সব কিছুই এক শূন্যতার বিষাদময় স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে।
তবুও কোথাও কি অনুভূতি আছে?! তবে কেন সেই মানুষটির স্মৃতি এত গভীরে বাজে? কেন স্মৃতির আড়ালে এক অমোঘ ছায়া রেখে গেছে সে? হয়তো কারণ, সে ছিল প্রথম। প্রথমের সেই বিশেষত্ব হয়তো কখনো মুছে যায় না, তবুও সে জানে, এসব অনুভূতি তার জন্য নয়। ভালোবাসা মানেই আবেগের স্রোতে গা ভাসানো, এবং সেই আবেগের ছোঁয়া থেকে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর। নিজেকে রূপান্তরিত করেছে এক পাথরের মূর্তিতে—অভেদ্য, নিরাবেগ, নিষ্পৃহ।
তবুও, এই অনুভূতির নাম সে জানে না, এবং এ অনুভূতি তার জন্য নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ। নিজের পায়ের কাছে ঝরে পড়া শিউলি ফুলগুলো সে কঠোরভাবে মাড়িয়ে দেয়, ফুলগুলো তার সমস্ত নিষ্প্রভ আবেগের প্রতীক। যেন এই নিষিদ্ধতার ঘোষণা দিয়ে সে তাদের র'ক্তাক্ত করল। আর তারপর, এক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলে উঠল,
———" আপনি অনেক ভাগ্যবান!"
একটি তিক্ত হাসি লুকিয়ে তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে, এই কথার ভেতরেই ব্যঙ্গের সূক্ষ্ম স্পর্শ রয়েছে।
আঁখি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল বিলের স্থির জলাশয়ের প্রান্তে, তার একাকীত্বকে মিশিয়ে দিলো নীরব প্রকৃতির মাঝে। বিলের শীতল জলে পা ডুবিয়ে, সেই নিস্তব্ধতায় নিমগ্ন হলো, এবং তখনই তার ঠোঁটে রহস্যময় হাসির রেখা ফুটে উঠল, এক বিষাদমাখা তাচ্ছিল্যের হাসি। মৃদুস্বরে আত্মমগ্নতায় বলে উঠল,
——— "একদিন শাড়ি পরব, রক্তরঙা শাড়ি, শুধুই আপনার জন্য! সেদিনই প্রথম, সেদিনই শেষ। আপনার চোখে চোখ রেখে অপলক তাকাবো, অপেক্ষার দীর্ঘসূত্রতার অন্তে সে অধিকারটুকু তো আমার প্রাপ্য!। শক্ত হাত টা ধরে নিজের পাশে নিয়ে আসব, আর টুকরো টুকরো ললাটজুড়ে আমার চুম্বনের স্পর্শে আপনাকে ঢেকে দেব। সেদিন কোনো বাধা মানছি না। আপনার বুকের ওপর মাথা রেখে, শেষবারের মতো চোখ বুজে নেব—এক নিঃশেষ ঘুমে! দিবেন কি সেই অধিকার? বলুন তো, সেই শেষ অধিকারটি দিবেন?"
তারপর এক অপ্রত্যাশিত রোলানো হাসিতে নিজেই সেই কল্পনা থেকে মুক্তি পেলো। হাসতে হাসতে মুখে এক শয়তানি হাসির রেখা ফুটে উঠল। চোয়াল শক্ত করে, নিজের ভেতরের ইস্পাতের মতো কঠিন হৃদয়টাকে জাগিয়ে সে বলে উঠল,
——— "কেমন লাগলো আমার অভিনয়? কী ভাবলেন? এমন আবেগমথিত কথা আমি বলব? আহা! চিরকালীন আবেগের চমক কি কখনো আঁখির হৃদয়ে প্রবেশের অধিকার পেয়েছে? ইশ! না, না, এমন ক্ষীণমায়ার স্পর্শে আঁখি বিভ্রান্ত হয় না!"
চোখে অভেদ্য কঠিনতার ঝিলিক, জানিয়ে দিলো—সে হৃদয়শূন্য, নির্মম; পৃথিবীর সকল নশ্বর অনুভূতির ঊর্ধ্বে, পাথরবৎ অন্তরের প্রতীক, যা কখনো ভালোবাসার বন্দিশৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় না।
_____Instagram
শিকদার বাড়ির শূন্যতা বিদীর্ণ করে প্রলয়ের মতো ছুটে চলছে হাওয়া; প্রতিটি পদক্ষেপ প্রবল ঝংকার তোলে, দেওয়ালের পরতে পরতে প্রতিধ্বনি তুলে হাসির অদৃশ্য ফসল রোপণ করে। নুপুরের ক্ষীণ ধ্বনি—ঝুনুর ঝুনুর মূর্ছনা, কোনো ধ্বংসাবশেষের মাঝে হারানো সংগীতের ছায়া হয়ে ওঠে। সেই সংগীতের অনুরণনকে অনুসরণ করে হাওয়া দ্রুত দৌড়ে এসে ছাদের এক কোণে থমকে দাঁড়ায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের হিমশীতল তীব্রতা থেমে থেমে ধ্বনিত হয়।
তার শ্বাসের ঝড় থামার আগেই, নাঈম প্রবেশ করে, কপালে ঘামের রেখা এবং মুখে বিজয়ের কৌতুকময় বিদ্রূপ, সে আবেগের প্রতিকূলতায় জয়ী এক যোদ্ধা।
সেদিনের সেই স্তব্ধতার গভীরে জড়িয়ে ধরার পর, যেন পৃথিবীটাকে সম্পূর্ণ নতুন করে দেখেছে নাঈম। দুদিন পরেই চলে গিয়েছিল হাওয়া , অথচ সেই নিঃসঙ্গতা নাঈমের হৃদয়কে এমনভাবে উদ্ভাসিত করেছিল যে, সমস্ত অবাধ্য অনুভূতিগুলোর সামনে সে অবশেষে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। এখন আর হাওয়াকে সে অবজ্ঞা করতে পারে না, দূরেও সরিয়ে দিতে পারে না। কর্কশ কণ্ঠের কঠোরতাকে কোনো মায়াবী কোমলতা গলিয়ে দিয়েছে, অপমানের সেই কঠিন বাঁধনগুলো এক এক করে খুলে পড়েছে।
এ এক মাসে নাঈম ডুবে গেছে এমন ভালোবাসার অপার্থিব আনন্দে, যেখানে তার প্রতিটি ফোনকলে সে তৎক্ষণাৎ সাড়া দেয়, প্রতিটি মেসেজে উত্তর দেয় তৃষ্ণার্তের মতো। অন্ধকারের যে কুৎসিত ছায়ায় এতদিন সে নিজেকে বেঁধে রেখেছিল, সেই অন্ধকারের ছেঁড়া আবরণে এখন হাওয়ার নিঃশব্দ আলো এসে পড়েছে। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, তার অতীতের এই কদর্য অধ্যায় কখনো হাওয়ার শুভ্র জীবনের ধারেও আসবে না। তার অসীম প্রেমে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে; কিন্তু নিজের ভাঙাচোরা, কলুষিত পৃথিবী থেকে হাওয়াকে সযত্নে দূরে রাখবে সে, যেন কোনো কালো ছায়া এই আলোর কণাটি স্পর্শ করতে না পারে।
গতকালই হাওয়া এসেছে; ফিরেই আলোকচ্ছটায় ম্লান করে দিয়েছে নাঈমের ব্যগ্রতাকে, কিছু দুষ্টু বাক্যের সূক্ষ্ম শলাকায় বিদ্ধ করেছে তার হৃদয়। সেই দুষ্টামিরই প্রতিশোধে আজ এভাবে ছুটোছুটি! অবশেষে নাঈম এগিয়ে যায়, তার গভীর হাসির রেখা মুখে ফুটে ওঠে, যেন শিকার তার জালে ধরা পড়েছে। সামনে গিয়ে হাওয়ার দুই পাশে রেলিং ধরে, তার হাতের বেড়াজালে বন্দী করে ফেলে তাকে।
হাওয়া, স্নিগ্ধ গাম্ভীর্যে বলল,
——— " কাছে আসবি না।”
নাঈমের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো উত্তপ্ত প্রতিউত্তর,
——— “তুইই তো বাধ্য করেছিস!”
হাওয়া বিস্ময়ে প্রশ্ন তুলল,
——— “আমি কি তোকে জোর করেছি?”
নাঈম তার গভীর দৃষ্টিতে নির্ভুল সত্যের ছাপ ফেলে বলল,
——— “হ্যাঁ, জোর করেছিস! আমার অবাধ্য, অবিন্যস্ত হৃদয়কে তোর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিস, এমনই এক বন্ধনে বেঁধে ফেলেছিস, যার মোহ তীব্র ও চিরন্তন।”
হাওয়া মুখ ফিরিয়ে একরকম অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গি করতেই, নাঈম নিবিড় দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে প্রিয়তমাকে; দৃষ্টির গভীরে এক সূক্ষ্ম মমতার আলোক রেখা বিদ্যমান, যা বুঝে নিয়েছে তার চিরকালীন বালখিল্যতাকে। হাওয়ার প্রাণবন্ত শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু সর্বদাই এই পুরুষটি,!
সময়ের কোনো অদৃশ্য বেষ্টনীতে জড়িত তারা দু'জন, এক অশব্দ মিলনের গহ্বরের মধ্যে নিমজ্জিত, অনুক্ত কথার ভারে প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে আছে। হঠাৎই, নাঈম ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, তাকে ছুঁয়ে দেবার নীরব প্রতিজ্ঞায় আরও নিকটবর্তী হয়। হাওয়া বিস্ময়ে বড় বড় চোখ মেলে তাকায়, তার চিরকালীন দূরত্বের আড়াল ভেঙে যাওয়ার প্রতিচ্ছবি যেন প্রতিধ্বনিত হয়।
তাদের মধ্যে এতো সন্নিকট আসা এর আগে কখনোই ঘটেনি; এ যেন ভুবনজয়ী যুদ্ধের মতো বিজয়, যেখানে প্রতিপক্ষ তার নয়, বরং নাঈমের স্বয়ং অন্তর্জগত। সেদিন হাওয়া একটু সাহস করে পেছন থেকে জড়িয়ে ছিল, কিন্তু এই কঠিন পুরুষ তখন ছিল এক পাষাণ। অথচ আজ, সেই একই পাষাণ পুরুষ নিঃশব্দে তার হৃদয় উন্মোচন করে এগিয়ে এসেছে!
এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নাঈম, আর তার এই অপ্রত্যাশিত সন্নিকটে হাওয়ার বুকের ভেতর তুমুল উতালপাতাল ঢেউ উঠেছে; হৃদয় ধরাস ধরাস শব্দে বেজে উঠছে। সমস্ত শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে অদ্ভুত বিদ্যুতের ঝাঁকুনি বয়ে যাচ্ছে, যা তাকে মুহূর্তের জন্য নিশ্চল করে দিয়েছে।
নাঈম, তার ঘোরলাগা চোখে হাওয়ার মুখের সামনে এসে দাঁড়ায়; দুইয়ের নিঃশ্বাসের সামান্য ব্যবধান, আর তারই শব্দ ভাসছে নিস্তব্ধতায়। হাওয়া যেন ঠিক ধরেই রাখতে পারছে না নিজের ভারসাম্য—প্রেমিকের এতটা কাছে এসে, এই নিঃশব্দ আবেশে যেন সমগ্র সত্তা আলগোছে হারিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বছরের পর বছর, মাসের পর মাস, এই মুহূর্তের প্রতীক্ষায় যেন আকুল হয়ে থেকেছে সে; কিন্তু আজ, যখন এ ক্ষণ হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে, তার মনে হচ্ছে এই উত্তেজনায় সে হারিয়ে যাবে। চোখ ধীরে ধীরে বুজে আসে, অলীক নিবেদন তাকে আচ্ছন্ন করে, আর নাঈম মৃদু মুচকি হেসে দেখে, তার প্রিয়তমা সেই নিঃসীম আবেগের একেকটি শিহরণে বাঁধা পড়ছে।
নাঈমের গম্ভীর কণ্ঠে বাষ্পের মতো ছুটে এলো সতর্কবার্তাটি,
——— "আর যাই করিস, বিশ্বাসঘাতকতা করিস না। আমার পেছনে কিছু করলে আমি ঠিকই ধরে ফেলব। আর এমন কিছু ঘটলে ফলাফল ভয়ংকর হবে।"
হাওয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, চোখে একপ্রকার ক্ষোভের ঝিলিক। এমন আবেগঘন মুহূর্তে এত কঠোর বাক্য?
হাওয়া ক্রুদ্ধ কণ্ঠে পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানায়,
——— "তুই তো আসলেই আনরোমান্টিক ভাই! এই সময়ে এমন সিরিয়াস কথা বলার মানে কী?"
নাঈম মৃদু হাসির আভায় বলে,
——— "ভাই? হবু স্বামীকে ভাই বলা? আর কে আনরোমান্টিক? আমি?"
হাওয়া জিভ কেটে মুখ ফিরিয়ে নেয়,
———"তুই আমার ফুফাতো ভাই-স্বামী! আর আনরোমান্টিক না তো কি? এমন সময়ে এমন কথা বলার মানে কী?"
নাঈম ধীর, গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,
——— "কেমন সময়?"
হাওয়া এবার রাগে এবার গাল ফুলায়, নিজের অসন্তোষকে আর আড়াল করতে পারছে না। এই মানুষটি কি কখনো অনুভূতির স্পর্শ বোঝে? এমন সময়েও তার মনের মধ্যে কেবল প্রতারণার ভয়?
হঠাৎ, নাঈম তার প্রিয়তমার কোমর শক্ত হাতে আলিঙ্গন করে তার দিকে টেনে নেয়। তার সেই অটল, বলিষ্ঠ হাতে যেন এক অদ্ভুত শক্তি, যা হাওয়ার মনের গভীর ক্ষোভকে মুহূর্তে স্তব্ধ করে দেয়। নাঈম একদম নিকট থেকে কানে ফিসফিস করে বলে
——— "প্রতারণা করিস না।"
বলার সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদের ন্যায় হাওয়ার ওষ্ঠে আপন অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিলো নাঈম! দুটি তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠদ্বয়ের মিলনে সীমাহীন আবেগের এক মহাসমুদ্র প্রবাহিত হয়ে ওঠে। শ্বাসের প্রতিটি আদানপ্রদান এক অসীম আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ, যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসের স্পন্দনে গড়ে উঠছে নিকটতার এক অলঙ্ঘনীয় বন্ধন।
হাওয়া চোখ মুদে তার প্রিয়তমের উষ্ণ উপস্থিতিতে নিজেকে সমর্পণ করে। খামচে ধরে নাঈমের শার্ট! আর নাঈম, গভীর তৃষ্ণায় দহন হয়ে তার প্রেয়সীকে অন্তরে মিশিয়ে নেয়, যতটুকু তার সামর্থ্যে সম্ভব।
এই মুহূর্তে, তারা দুই নয়; এক, হৃদয়ের গভীর গূঢ় বোধের এক অতলান্ত সমুদ্রের দুই সমানুপ্রাণ স্রোত।
দীর্ঘ চুম্বনের অবসান ঘটিয়ে এক অশান্ত পদধ্বনিতে হাওয়ার আবেশ ভঙ্গ হলো। সহসা চক্ষু মেলল সে, নাঈমকে তীব্রভাবে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিলো, স্পর্শমুক্তির নিকটতম সম্ভাবনায় আছড়ে পড়ল নিজেকে। স্থির পদক্ষেপে শান্ত ছাদে প্রবেশ করল, তার উপস্থিতি যেনো কোনো নিষ্ঠুর প্রতাপের উদ্ঘাটন। হাওয়া এক মুহূর্তেরও বিলম্ব না করে রক্তিম লজ্জায় গলে গিয়ে ঝড়ের মতো শান্তকে পাশ কাটিয়ে নিমেষেই অন্তরালে মিলিয়ে গেল। শান্ত ভ্রূকুটি কপালে টেনে কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রহস্যময় তির্যক হাসিতে অধর ছুঁয়ে বলল,
——— "আহহা! ভুল সময়ে এলাম নাকি?"
নাঈমের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে জ্বলে উঠল প্রচণ্ড ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ। ঠোঁট থেকে বিলীয়মান উষ্ণ স্পর্শের স্মৃতি অপসৃত করল আঙুলের এক সজোর ঝাড়নে। শান্তের দিকে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাঈমের অব্যক্ত রোষ যেনো কোনো সুপ্ত সৃষ্টির নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি।
নাঈম দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
——— " তোর জন্য..."
কথাটা মাঝপথেই থেমে গেল। শান্তর সামনে কীইবা বলবে! তাই মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয় মনে করল। কিন্তু শান্ত কি এতই অন্ধ? কিছুই বুঝতে পারছে না? শান্ত এক প্রকার মুচকি হেসে বলল,
——— "এটাও কি শুধুই অভিনয় নাকি সত্যিই সত্যিই ?"
নাঈম কঠোর মুখাবয়ব নিয়ে দৃঢ়স্বরে উত্তর দিল,
——— "এই একটাই স্থান, যেখানে আমি আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্বের স্পন্দন খুঁজে পেয়েছি।"
শান্ত বিদ্রূপের সুরে বলল,
——— "মেয়েদের ওপর বিশ্বাস নেই, সতর্ক থাকিস।"
নাঈমের ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসি ফুটে উঠল। বলল,
——— "সাবধান করেছি, যদি তারপরও এমন কিছু ঘটে তবে..."
এক কঠোর অভিব্যক্তি নিয়ে সংযোজন করল,
——— "মা'রতে আমার হাত কাঁপবে না।"
শান্ত প্রীতির হাসি দিয়ে নাঈমের কাঁধে হাত রেখে বলল,
——— "এই তো আমার ভাইয়ের মতো কথা!"
তারপরই মুখাবয়ব গম্ভীর করে বলল,
———" চল নিচে, ওই সিআইডির কু'কুরগুলো আবার এসেছে।"
ওদের নাম শুনেই নাঈমের মুখে ঘৃ'ণার ছায়া পড়ল। বলল,
——— "তারা কি সব জেনে ফেলেছে?"
——— " তারাই ভালো জানে ।"
নাঈমের ঠোঁটের কোণে শীতল হাসি ফুটে উঠল। শান্ত বলল,
———" মুগ্ধ তোকে কেমন দুঃসাহসিক চাল চেলেছে বল? আঁখির বিশ্বাসের মর্মে আঘাত করেছিস। যেদিন আঁখি জানতে পারবে, তার নাঈম ভাই তারই অগোচরে এতসব করেছে, সেদিন কী হবে?
এ কথা বলেই শান্ত অশান্তির হাসি হেসে উঠল। নাঈম দৃঢ় চোয়ালে বলল,
——— "ওই মুগ্ধকে তো আমি ছাড়ব না। আর আঁখি? ওকে তুই কি ভাবিস, নিতান্তই সরল? সবই জানে ও।
শান্ত ভ্রু কুঁচকালো, আবার সেই রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
——— " সবথেকে এগিয়ে তো সেই!"
এই বলে দুই ভাই শব্দ করে হেসে উঠল, তাদের পরিকল্পনার সুর প্রতিধ্বনিত হলো চারপাশে। তারপর ছাদের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে তারা ধীরে ধীরে নিচের দিকে পা বাড়াল।
শেষ চালে যেন মঞ্চস্থ এই প্রহসনটি, যেখানে মুগ্ধ, রুদ্র আর মহুয়া ড্রয়িং রুমের প্রতিটি কোণায় বিচক্ষণ দৃষ্টিপাত করছে, প্রবল উত্তেজনা জমাট বাঁধছে! সংলাপ শেষ, সময় যেন গোধূলির আঁধারে মিশে গেছে। তবুও রুদ্রর অনুসন্ধানী দৃষ্টি অন্বেষণ করছে আঁখির উপস্থিতি—যে অনুপস্থিতি আরও গভীর রহস্য বুনে দিয়েছে। একটুখানি কাশি দিয়ে রুদ্র বলল,
——— "আপনাদের ছোট মেয়ে কোথায়? তাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না! অনুগ্রহপূর্বক তাকেও ডাকুন!"
রুদ্রর কণ্ঠের প্রত্যয় যেন মুগ্ধের র'ক্তকে উত্তপ্ত করে তুলল; কিন্তু নিঃশব্দে নিজেকে সংবরণ করল, অন্তর্নিহিত আগুনে শিখা চেপে রাখল। ওদিকে আজগর আলী তীক্ষ্ণ হাসি হেসে সপ্রতিভে বললেন,
———" বাহিরে প্রকৃতির হাওয়ায় মুক্তি খুঁজতে গিয়েছে সে! মন ভারাক্রান্ত থাকে সবসময়, তাই একটু মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে আরকি!"
কিন্তু তাঁর মনের গভীরে যেন উদ্ভিন্ন হলো এক ধ্বংসাত্মক সংকল্প, নিঃশব্দে বললেন তিনি,
——— "সাহস বেড়ে গেছে, পা কে'টে ফেলতে হবে!"
মুগ্ধ লক্ষ্য করছে, করে চলেছে, সে প্রথম দিন থেকে রুদ্রর অসংযত অস্থিরতা, এক অব্যক্ত চাঞ্চল্যে মুগ্ধ হাত কচলাচ্ছে, কিন্তু প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সংযত থাকছে। মহুয়া নিঃশব্দে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিল রুদ্রর দিকে; মনে পড়ে তাদের মধ্যেকার কথা, একটি সম্পর্কের জটিল আবর্তে বন্দী তারা, যেখানে হাসি-মজা, খুনসুটি আর তুমুল ঝগড়ায় তাদের সময় কাটে। মহুয়া টের পায়, রুদ্রও যেন তার প্রতি কিছুটা আকর্ষণ অনুভব করে, কিন্তু এ গৃহের পরিসরে পা রাখলেই যেন রুদ্র নিজেকে গুটিয়ে নেয়, যেন অন্য এক রহস্যময় সত্ত্বায় পরিণত হয়।
আর সেই রহস্যময়তার শেকড়টুকু বুঝতে বাকি নেই মহুয়ার; রুদ্রর দৃষ্টি প্রতিক্ষণে খুঁজে ফেরে আঁখিকে। ভালোবাসার অমোঘ তাড়না বুঝতে পারার মতো সংবেদনশীলতা মহুয়ার আছে; বুঝতে পারে, তার মনের মানুষটি অপর একজনের জন্য অস্থিরতায় কাঁপছে। বুকের মধ্যে তীব্র এক জ্বালাধ্বং'স অনুভূত হয় মহুয়ার, ভাবতে গা শিউরে ওঠে যে তার ভালোবাসার পুরুষের হৃদয় অন্য কারও জন্য এতটা উন্মুখ হতে পারে। আঁখি যদিও তার চেয়ে ছোট, তবু এই অপ্রাপ্ত বয়সী মেয়েটির জন্যই চেনা রুদ্র যেন এক অচেনা প্রতিচ্ছবিতে রূপান্তরিত হয়! মহুয়ার হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে তার আত্মাকে দ'গ্ধ করে, একটি শূন্যতার মধ্যেই সে ডুবে যেতে চায়, যেন এই বিরূপ ভালোবাসার বেদনাটি মুছে ফেলতে পারে।
রুদ্র বারবার দৃষ্টিপাত করছে দরজার দিকে, সেখানেই আঁখির এক আভাস পাওয়ার আশায় তৃষিত তার দৃষ্টি। সেই ছোট মেয়েটির মুখ দেখলেই তার মনে পড়ে তার হারানো পাখিকে, যে আজ থাকলে আঁখিরই বয়সী হতো। গভীর দীর্ঘশ্বাসে বুকের ভার লাঘব করতে চেষ্টা করে সে। আঁখির সেই বিশাল, ভাসা ভাসা ডাগর চোখ—যেন এক গভীর মায়ায় মোড়া অপার সাগর, যেখানে একবার ডুব দিলে আর ফিরে আসার আশা থাকে না। সেই চোখের নেশা হৃদয়ের গভীরে এক স্বপ্নময় শান্তির সুর বয়ে আনবে যে কারো। কিন্তু রুদ্রর মনে প্রেমের আবেশ নেই; কেননা সে স্থানের অধিকারিণী অলক্ষ্যে মহুয়া হয়ে উঠেছে।
রুদ্র কখনোই আঁখিকে প্রেয়সীর চোখে দেখেনি। তার চোখে আঁখি যেন তার পাখিরই প্রতিচ্ছবি, একটি স্নিগ্ধ প্রশান্তির প্রতীক। যখনই আঁখিকে দেখে, তার মনে হয় তার সেই হারানো পাখিটাই ফিরে এসেছে তার কাছে, একটি নতুন রূপে, আর তাই তাকে ঘিরে থাকে এক গভীর প্রশান্তির অনুভব, পুরানো ক্ষতগুলি মুহূর্তের জন্য হলেও সান্ত্বনা পায়। দুজনেরই বহুত মিল; এমনকি নামেরও! তবে, প্রেমের দাবিদার নয় আঁখি; সে স্থান মহুয়ার জন্যই সংরক্ষিত, হয়তো রুদ্রর অজান্তেই মহুয়া তার হৃদয়ের প্রতীক্ষিত একক আসনে বসে গেছে।
মুগ্ধ গলা খাকারি দিয়ে গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করল,
——— "রুদ্র, নিজের করণীয় কাজে মনোযোগ দাও, অবান্তর বিষয়ে নয়!"
কণ্ঠে নির্দেশের ছাপ, ভ্রষ্ট চিন্তার পথ থেকে রুদ্রকে ফেরাতেই তৎপর। তারপর, মুহূর্তের নিস্তব্ধতায় কথাগুলো যেন ফাঁকা বাতাসে মিলিয়ে যেতে যেতে মুগ্ধ যোগ করল,
——— "এবার তবে বিদায় নেওয়া যাক!"
কিন্তু রুদ্রের চোখে কোনো বিদায়ের ইঙ্গিত নেই; তার মনের জটিল আবর্তে কেবল একটিই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, আঁখি এখনো ফিরে আসেনি কেন? রাতের কালো আভা নেমে আসছে ক্রমশ, তার বুকের কোণে অশুভ শঙ্কা আছন্ন হয়ে ওঠে। উদ্বিগ্নভাবে সে ফিসফিস করে বলে উঠল,
——— "আঁখি তো এখনো ফিরলো না! আবার কিছু হয় নি তো?"
এই কথাগুলো যেন গৃহমণ্ডলের সব সদস্যের র'ক্ত জমিয়ে দিলো। মুহূর্তে সকলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, অথচ শান্ত ছিলো একা সেই নীরব হাস্যরত, আর নাঈমের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক ক্ষীণ তৃপ্তির হাসি। এদিকে আজগর আলী ও কুদ্দুস আলীর অভ্যন্তরে ক্রো'ধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ঝাঁজ উঠে, দহন করে তাদের র'ক্তকে। নারী সদস্যরা একপাশে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, হঠাৎ ঝড়ের পূর্বাভাসে নিস্তব্ধ প্রকৃতি। এমন সময় রিতু খালা ট্রেতে চায়ের পাত্র নিয়ে এসে টি টেবিলের ওপর রেখে দিলেন।
মুগ্ধর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, রুদ্রের ওপর বিদ্ধ হয়ে রয়েছে, চোখে অপ্রকাশিত তর্জনী, আর সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সাথে সংযমের এক চাপা বিরক্তি নিয়ে মুগ্ধ রুদ্রর কাঁধে হাত রাখল এবং রাগ সংযত করে বলল,
——— "ওর জন্য তোমার ভাবনা যেন একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে, লক্ষ্য করছি!"
মহুয়ার হৃদয় ক্ষ'তবি'ক্ষত হয়ে যাচ্ছে বারংবার। এই অচেনা রুদ্রকে দেখে তার মনে তীব্র দহন জেগে উঠেছে, যেন রুদ্রকে সে আর চিনে না। এমন সময়, আঁখি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল, তার আগমনেই যেন ঘরের বাতাসের ভার পরিবর্তিত হলো। আফিয়া বেগম মুখে হাসি এনে বললেন,
——— "ওই তো এসেছে আমাদের মেয়ে! তা কোথায় ছিলি মা?"
আঁখি নীরবে পা ফেলে এগিয়ে এসে রুদ্রের দিকে এক পলক চেয়ে আড়চোখে তাকাল, তারপর মাথা নিচু করে মিনমিনে কণ্ঠে বলল,
——— "একটু বিলের ধারে গিয়েছিলাম!"
আফিয়া বেগম হাসি ধরে রেখে বললেন,
——— "আচ্ছা, আচ্ছা, যা ঘরে যা! গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে কেমন!"
তবে আফিয়া বেগমের মুখের হাসির আড়ালে চাপা ক্রোধ দাউ দাউ করে জ্বলছে, এক নিঃশব্দ আগুনে ফুঁসছে তার ভেতর। এদিকে রুদ্রের চোখে ভেসে উঠল প্রশান্তির আভা; দীর্ঘশ্বাসে তার অস্থিরতা লাঘব হলো। মহুয়া সেসব লক্ষ করে মনেমনে ক্রোধের ঝড় সামলাতে থাকে, আর মুগ্ধও এক গভীর সন্দেহ নিয়ে সরু চোখে রুদ্রকে পর্যবেক্ষণ করে।
রুদ্র তার হাতের চায়ের কাপটি তুলে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
——— "চা শেষ করে যাই! স্যার, আপনিও খান না।"
মুগ্ধর চোয়াল শক্ত হলো, ক্রোধের প্রাবল্যে তার মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। এরপর রুদ্র এক দৃঢ় দৃষ্টিতে আঁখির দিকে তাকিয়ে বলল,
———" ছোট মানুষ, এতক্ষণ একা বাইরে থাকা মোটেও ঠিক না! বুঝেছো?"
রুদ্রের কণ্ঠে অদ্ভুত এক মায়া আর সুরক্ষা অনুভূত হয়, সে একটি নিষ্পাপ জীবনকে ছায়ায় আবৃত করতে চায়, অথচ সেই দৃষ্টির অমোঘ রহস্যের ভিতরে আরেক অনুভূতি মহুয়ার হৃদয়কে বারবার বিদ্ধ করতে থাকে।
ধড়মড়িয়ে মুগ্ধ সোফা হতে উঠে দাঁড়ালো। সকলে ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ হয়ে তাকালো তার প্রতি! মুখে ক্রোধের আগুন লুকিয়ে সোজাসুজি উচ্চারণ করলো,
——— "আমার আঁখির সাথে বিশেষ একান্ত কিছু আলাপ আছে!"
এ কথা শুনে কিছুটা চমকে উঠল সকলে!! রুদ্র স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ দৃঢ় পদক্ষেপে আঁখির সম্মুখে গিয়ে সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে বলল,
——— "চলো।"
আঁখি ভ্রু কুচকে তাকালো! শান্ত বিরক্তির আগুনে দগ্ধ হয়ে সুবৃহৎ আসন হতে দাঁড়িয়ে মুগ্ধর পথে এসে বলল,
——— "যা জিজ্ঞেসা করার সবার সামনে কর!
মুগ্ধ কঠিন চোয়াল শক্ত করে শান্তর দিকে বিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর করল,
——— "এটা আমার কাজের অন্তর্গত! বিঘ্ন সৃষ্টি করতে সাহস করিস না।"
শান্ত আরও এক পা এগিয়ে এসে বলল,
——— "এইতো, চলে যাবি বলছিলি, এখন আবার কেন এমন উদগ্রীব হলি?"
——— "তার কৈফিয়ত দেওয়ার দায়ভার আমার নেই!"
এরই মাঝে কুদ্দুস আলী শান্তকে সংযত কণ্ঠে বললেন,
——— "আহ শান্ত, এটা ওদের কাজ! করতে দে। আঁখি মা, যা তুই। মুগ্ধ তুমি তোমার জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারো! "
কুদ্দুস আলী যেন দৃঢ়তা দেখালেন কিন্তু অন্তর্গত মর্মে কুন্ডলী পাকাচ্ছে বিরক্তির অগ্নিশিখা। মুগ্ধর এই বেপরোয়া আচরণ তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শুধু সিআইডির সম্মানেই তাকে সহ্য করছেন; নইলে হয়তো ক'ষাঘা'তের আ'ঘাতে বাড়ি হতে বিতাড়িত করতেন!
——— "সেটা আপনারা না বললেও করব! "
মুগ্ধের হয়তো সুস্থ মস্তিষ্ক লোপ পেয়েছে, নাকি অজানা কিছুতে আচ্ছন্ন হয়েছে, তা বোঝা দায়। সকলের সামনে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে হঠাৎই আঁখির কোমল হাত লৌহকঠিন মুঠোয় চেপে ধরে, দৃঢ় পদক্ষেপে সকলের দৃষ্টির সীমারেখা ভেদ করে তাকে নিয়ে ঘরের অন্তস্থলে প্রবেশ করলো। একরাশ বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ালো সবাই।
নাঈমের চোখে রাগের রক্তিম অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। একসময় মুগ্ধের ছলনা তার বিশ্বাসকে নাড়া দিয়েছিল, কিন্তু আজ তার রুদ্র অবিশ্বাস মূর্ত হয়েছে ক্ষোভে! মুগ্ধ এবার প্রকাশ্যেই আঁখির সাথে এমন অদ্ভুত নাটক সাজিয়ে বসেছে। আর বিস্ময়ের পরিসর যেন আর তীব্র হলো, যখন মুগ্ধ প্রবল শব্দে ধাম করে দরজাটি বন্ধ করে দিল।
রুদ্র আর মহুয়া বিস্ময়াপন্ন দৃষ্টিতে স্থবির হয়ে রইলো; পরিকল্পনার কুটিল জাল রচনার সময় আঁখি তো তাদের ছকেই ছিল না! তবে হঠাৎই এই প্রগাঢ় গোপনীয়তার কারণ কি? শান্ত ক্রো'ধের বশে যেন স্বীয় সংযম হারিয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে উঠলো,
——— " এই ও দরজা কেন আটকে দিলো?"
কিন্তু কুদ্দুস আলী সংযম বজায় রেখে তীব্র কণ্ঠে শাসন করলেন,
——— "চুপ কর তুই!"
রাগে ফুলে ওঠা শান্ত দৃষ্টিপাত করল কুদ্দুস আলীর দিকে, দমনে বাধ্য হলেও তার মনে বিষণ্ণ অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত। সিআইডির উপস্থিতি না থাকলে, কুদ্দুস আলীর প্রতি নিক্ষেপিত ঘৃণার ঘু'ষি হয়তো আজ অবধারিত ছিল।
অন্যদিকে, আজগর আলী আর রোকেয়া বেগমের অন্তরে ভয়। আঁখি যদি মুগ্ধের সামনে সমস্ত কাহিনী উদঘাটিত করে ফেলে? রোকেয়া বেগমের চেহারায় ভয়ের কাঁপুনি, তিনি আঁচলের প্রান্ত দিয়ে কপালে জমে ওঠা ঘামের ফোঁটা মুছলেন; অন্তরে তীব্র শঙ্কার ভীষণ ঝড়, অজানা পরিণতির আশঙ্কায় স্তব্ধ হয়ে আছেন।
মহুয়ার ফোনটি হঠাৎই বেজে উঠল! প্যান্টের গহ্বর থেকে ফোনটি মেলে তুলে স্ক্রিনে নিরীক্ষণ করতেই চোখে পড়ল মিথিলার নামাঙ্কিত ইঙ্গিত। গ্রহণমাত্রই মিথিলার কণ্ঠস্বর ঝংকার তুলল,
——— "একটি প্রমাণের সন্ধান পেয়েছি! শীঘ্রই বিউরোতে আসো।"
বাক্য সমাপ্তির পরই সংযোগ বিচ্ছিন্ন। রুদ্র তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল,
——— "কে ফোন দিয়েছে?"
মহুয়া রুদ্রের প্রতি ক্ষণকাল দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
——— "মিথিলা মেডাম! কিছু প্রমাণের হদিস মিলেছে বলে জানালেন।"
---Threads
ফরেনসিক ল্যাবের নির্জন প্রকোষ্ঠে মিথিলা নিমগ্ন, সহকারী হিসেবে উজ্জ্বল সাহেবের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিপুণভাবে তদন্তে মগ্ন। তার অভিজ্ঞ হাতের স্পর্শে বিভিন্ন প্রমাণাদি সচেতন সাবধানে সংরক্ষিত হচ্ছে। হঠাৎই উজ্জ্বল সাহেব, গোপন গহ্বরে লুকিয়ে থাকা অজানা অনুভূতির ঝাঁপি খুলে দিয়ে আকস্মিকভাবে প্রশ্ন করলেন,
——— "মুগ্ধের সাথে কি কিছু হয়েছে তোমার?"
মিথিলার হাত স্থবির হয়ে গেল, কোনো অনির্বচনীয় অনুভূতির বীজ মনের মাটিতে অঙ্কুরিত হলো। উজ্জ্বল সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিথিলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কারণ, তিনি বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করেছেন, এক মাস ধরে মিথিলা আর মুগ্ধের সান্নিধ্যে আসে না। অথচ এই মেয়েটাই এককালে নিত্যই মুগ্ধের গল্পের স্রোতে উজ্জ্বল সাহেবের শ্রবণযন্ত্রকে আচ্ছন্ন করে রাখত। কোথাও এক ফাঁকে সুযোগ পেলেই চুপিসারে মুগ্ধকে দেখে নিতো, তার প্রতি অব্যক্ত মুগ্ধতা ঢেলে দিতো চোখের ইশারায়।
কিন্তু সেই উচ্ছলতা যেন কোনো গভীর শূন্যতার ছায়ায় ঢাকা পড়েছে। এখন আর উজ্জ্বল সাহেবের কানে মুগ্ধের বন্দনা ধ্বনিত হয় না; এই হাসিখুশি মেয়েটা কোনো অজানা বেদনার বন্দীতে আবদ্ধ।
মিথিলা ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির আভা এনে বলল,
——— "কখনো তো কিছু ছিল না, তবে হওয়ার প্রশ্নই বা আসে কেন?"
মহুয়ার কণ্ঠের ক্ষীণ ভাঙা সুর উজ্জ্বল সাহেবের অভিজ্ঞ নজর এড়াল না। সিআইডি ফরেনসিক ল্যাবের অভিজ্ঞ ডক্টর হিসেবে, জীবনের বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েছেন তিনি। নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বললেন,
——— "কখনো কখনো কিছু জিনিস থেকে গিয়েও যেন থাকে না, মিথিলা।"
মিথিলা উত্তর দিল, তবু নিজেরই জন্য একটি পর্দা টেনে রেখে,
——— "হয়তো থাকে না, তবে আমার কাছে কখনো কিছুই ছিল না।"
উজ্জ্বল সাহেব তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টিতে অনেক কিছুই উপলব্ধি করলেন। তিনি বললেন,
——— "তুমি একজন বিদ্বান, সদাশয় মেয়ে। জীবনের এমন তুচ্ছ ঘটনাগুলোয় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে নেই। জীবনে অনেক দুঃখ-বেদনা আসবে। কিন্তু তাদের চিরকালীন মনে করে মনকে ভারাক্রান্ত করলে চলে না! সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে, এই বেদনাগুলোকে মনের অবকাশ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।"
মিথিলা মৃদু হাসি মুখে চাপা রেখে বলল,
——— "আবেগের বশে মন দিলে হয়তো ভুলে ভেবে ভুলে যেতাম। তবে আমি এক প্রাপ্তবয়স্কা নারী, জীবনের অনেক দিক বুঝতে শিখেছি, মর্ম বুঝতে শিখেছি। যেখানে সব জেনে বুঝেও এই অনুভূতির প্রতিদানে কিছু পাই না, সেখানে এ বেদনাকে কাঁদা বলা চলে না। এ যেন নিঃশব্দে পাথর হয়ে যাওয়া।"
তারপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে, মিথিলা সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো। উজ্জ্বল সাহেব গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, তার দৃষ্টিতে স্নেহ আর উদ্বেগের ছাপ। মিথিলাকে তিনি নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন। মেয়েটার ভিতরে যে দহন চলছে, সেটি তার পিতৃতুল্য মনকে আঘাত করল।
মিথিলা দূরে দাঁড়িয়ে স্মৃতির পাতায় ফিরে গেল, সেই দিনের ঘটনাটি জ্বলজ্বল করে উঠল তার মনে। ঠিক এক মাস আগে ঘটে যাওয়া সেই মুহূর্ত, যখন সে মুগ্ধকে ডেকে এনেছিল, সমস্ত আবেগগুলো নিঃসংকোচে প্রকাশ করতে চেয়েছিল।
মুগ্ধ তাকে এক দৃষ্টে দেখে কেবল বলল,
——— "বলো, কী কাজের কথা?"
মুগ্ধের গম্ভীর কণ্ঠ তার মনের গভীরতা বুঝতে অনীহা প্রকাশ করছিল। মিথিলার চোখ মুগ্ধের দিকে তুলে তাকাতেও পারছিল না। মনের চাপা আবেগে তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠল। অনেক কষ্টে, শ্বাস চেপে, কাঁপা কণ্ঠে বলল,
——— "তুমি কি সত্যিই জানো না? নাকি সব বুঝেও না বোঝার ভান করছ?"
পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল,
——— "যা বলতে চাইছো সরাসরি বলো। এই ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে কথা বলা আমার ধাতে সয় না।"
মিথিলা নিঃশ্বাস চেপে নিজের আকাঙ্ক্ষার কথা স্পষ্ট করল, অন্তরাত্মা উজাড় করে দিল তার সামনে,
——— "তোমার সঙ্গেই ঘর বাঁধতে চাই। সংসারের বুননে নিজেকে হারাতে চাই তোমার পাশে। বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ আসছে। এমনকি, পাত্রও ঠিক করা আছে, কিন্তু আমি তাকে মনের গভীরতম অন্তরঙ্গতায় গ্রহণ করতে পারছি না। আমি কেবল তোমাকেই মন দিয়ে ফেলেছি। তাই দ্বিধাহীন ভাবে বলছি, বিয়ে করবে কি আমায়?"
মুগ্ধের নীরব ঠোঁটের উপর দিয়ে যাওয়া উদাসীন বাক্য,
——— "বাসা থেকে যে পাত্র নির্ধারণ করেছে, তার সাথেই সংসার পাতো।"
মুগ্ধের নির্বিকার, হৃদয়হীন এই কথাগুলি মিথিলার কল্পনা ভাঙিয়ে দিল এক মুহূর্তে। তার সমগ্র সত্তা ভেঙে গিয়ে অসংখ্য খণ্ডে বিছিয়ে পড়ল। এই কি ছিল তার প্রাপ্তি? এই কি ছিল সমস্ত গভীরতা আর মর্মজ্বালার উত্তর? তবুও সেই বেহায়া মন যেন হার মানতে নারাজ। বুকের গভীর থেকে উঠে এলো অনুনয়ের শেষ চেষ্টা, কণ্ঠ কেঁপে উঠল মিথিলার,
——— "আমাকে একবার সুযোগ দাও! তোমার মনের মতো হয়ে দেখাবো নিজেকে! আমার কোনো ত্রুটি থাকলে বলো, আমি সব বদলে ফেলতে প্রস্তুত।"
একটি দীর্ঘ বছরের পরম যত্নে ভালোবেসে ফেলেছিল সে মুগ্ধকে। প্রথমে মুগ্ধর সেই কঠোর ব্যক্তিত্ব যেন ছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তার ভালোলাগা, তার ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসা ক্রমশ মিথিলাকে এমন এক গভীরতা আর নিবেদন শেখাল, যা তার অস্তিত্বের প্রতিটি শিরায় বুনে গেছে।
ভালোবাসা না থাকলে বোঝা যায় না মানুষ কতটা বেহায়া হতে পারে প্রিয়জনের কাছে। মিথিলা যেন তার জীবনের প্রতিটি অনুচ্ছেদে এক এক করে মুগ্ধর জন্য বেহায়া হয়ে গেছে—অভিমান, আবেগ, আশা—সব একসাথে মিলে এক অনির্বচনীয় টানাপোড়েন।
মুগ্ধর সেই নীরস, কঠোর হৃদয়ের দরজায় নীরবে নক করেই যাচ্ছে মিথিলা।
মুগ্ধ গভীর এক দীর্ঘশ্বাসে তার বিবেকের ওজন ঝেড়ে ফেলে বলল,
——— "তোমার অনুভূতির প্রতি আমার পরম শ্রদ্ধা আছে, তবে নিজেকে এভাবে একতরফা ছ্যাছড়া বানিও না। তুমি একজন নারী! নারীর ব্যক্তিত্ব হতে হবে দৃঢ় আর অটল। নারীসমাজ পৃথিবীর পরম মূল্যবান সম্পদ; যা ছুঁতে গেলে আগে হাত পুড়ে যাওয়া উচিত, দৃষ্টিপাত করতে গেলে চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়াই কাম্য। আর তুমি, এই অমূল্য মর্যাদা আর গৌরবধন্য রমণী হয়ে, নিজ ব্যক্তিত্বের এমন অবমাননা কীভাবে করছো? যেখানে তুমি সিআইডিতে কাজ করছো, অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছ, সেখানে এহেন আত্মসমর্পণ কি তোমার আদর্শে মানায়? যেখানে অপর প্রান্তের মানুষটির অন্তর শূন্য তোমার জন্য, সেখানে নিজেকে এভাবে সমর্পণ করা কেবল অসম্মান নয়, আত্ম-অবমাননাও বটে।"
মুগ্ধর এমন কঠিন বাণী শুনে মিথিলার মন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। বুকের ভেতর আর্তনাদ উঠল, ঢলে পড়ল মুগ্ধর পায়ের কাছে, প্রার্থনার অর্ঘ্য হয়ে। এক ফোঁটা ভালোবাসার ভিক্ষা, যদি কোনোভাবে পাওয়া যায়। মুগ্ধর মুখ পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলো—চোয়ালে দৃঢ়তা, চোখে কঠোরতা, সে এই মর্মান্তিক দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে তার মর্যাদা আর আত্মমর্যাদার কদর শেখাচ্ছে। অথচ মিথিলা, এই ক্ষণিকের আত্মসমর্পণে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে উদ্যত।
মুগ্ধের কঠোর কণ্ঠে গর্জে উঠল এক আদেশ,
——— "মিথিলা, উঠো!!"
কিন্তু মিথিলার প্রতিক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তন এলো না; সে অবিচল, সমান তালে অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছে, অন্তর্গত গভীর যন্ত্রণা বাষ্পরূপে ছুটে আসছে তার দুচোখের ঝর্ণাধারা হয়ে। মুগ্ধর কাছে মিথিলা একজন প্রাজ্ঞ ডক্টর, কাজের নিখুঁততায় এক পরম্পরায় শ্রদ্ধাসিক্ত, যার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন সদা-পরিশুদ্ধতা আর কর্তব্যের সাক্ষী; এইভাবে তার হারিয়ে যাওয়া সহ্য করা তার পক্ষে সহজ নয়।
মুগ্ধের মনে জ্বলছে অগ্নি-শিখা; সে কি জানে না, বোঝে না ভালোবাসার আবেশ কতটা গ্রাসকারী? কিন্তু ভালোবাসা নামক এই আবেগ যে তাকে প্রতিনিয়ত তীব্র বেদনায় বিদ্ধ করছে, তা সে উপেক্ষা করেই চলেছে। মুগ্ধ ধীর গাম্ভীর্যে এক হাঁটু ভাঁজ করে ফ্লোরে বসে পড়ল, তীক্ষ্ণ অথচ সুনিপুণ কণ্ঠে মিথিলাকে বলল,
———" পুনরায় নিজেকে অপমানিত করো না! বহু পূর্বেই আমার হৃদয় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভ'স্মের স্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে আর কারো প্রবেশাধিকার নেই! সামান্য আ'ঘাতেই তুমি ভেঙে পড়ছো? যদি কখনো আমার বুকে জমে থাকা ক্ষতগুলোর প্রান্তে দৃষ্টি ফেলতে পারো, বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে! বহু শ্রমে, অম্লান হৃদয়ের সমস্ত ত্যাগে এক প্রিয়সঙ্গী গড়ে তুলেছি, যেন মরনের দ্বারে গিয়েও তার সান্নিধ্যে কিছু অন্তিম মুহূর্ত লুপ্ত হতে পারি। এই যে আজ তুমি স্বাধীন হৃদয়ে আমার সামনে ব্যথা তুলে ধরছো, তা তোমার সৌভাগ্য; আমি তো এক যুগ ধরে তার সামনেই গিয়ে দাঁড়াইনি! দহন বহুগুণে প্রবল আমার হৃদয়ে! এবার উঠে দাঁড়াও!"
মুগ্ধের তীক্ষ্ণতর বাক্যের গহ্বরে মিথিলার অন্তরাত্মা বিদ্ধ হলো না। বরং সে এক বেপরোয়া সাহসিকতায় এগিয়ে এসে মুগ্ধের কলার ধরে তার ঠোঁটের দিকে ঝুঁকতে উদ্যত হলো। কিন্তু মুগ্ধের দৃষ্টি সেই স্পর্ধাকে মুহূর্তেই থামিয়ে দিল। এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা ক্রোধ এবং ধৈর্যের সীমারেখা লেলিহান অগ্নিশিখার রূপ ধারণ করল। সারা শরীরের প্রচণ্ড শক্তি সংহত করে মুগ্ধের দুর্জয় মু'ষ্টি আ'ঘা'ত হানল মিথিলার মুখে।
মুগ্ধের শক্ত পুরুষালী প্রহার মিথিলাকে ছিটকে দেয়ালের গায়ে আছড়ে ফেলল। অধরের এক কোণে রক্তধারা নেমে এলো, মাথার মধ্যে অসহনীয় ঘূর্ণি নৃত্য করতে লাগল। মুগ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে কঠোর কণ্ঠে ঘোষণা করল,
——— “নারীদের প্রতি কাপুরুষের মতো আচরণ করি না; তবে যারা দু'শ্চরিত্রার মতো লেপ্টে আসে, তাদের প্রতি মারাত্মক প্রতিক্রিয়া জানাতে আমি দ্বিধা করিনা।”
মুগ্ধ গভীর শ্বাসে রাগের শিখাকে সামলে নিয়ে, নিজের অন্তর্দাহকে সংযত রেখে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলো। পেছনে, মিথিলা অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে রইল, এক নিঃশেষিত সন্ধ্যার শূন্যতা।
স্মৃতির প্রান্তে পৌঁছালেই মিথিলার বক্ষতলে এক অদ্ভুত শূন্যতার হাহাকার বেজে ওঠে। ভালোবাসার জন্য কতটা নীচে অবতরণ করেছিল সে; মুগ্ধের সম্মুখে দাঁড়ানোর কল্পনামাত্রই তার সত্তার প্রতিটি অঙ্গ লজ্জায় সংকুচিত হয়ে যায়। অপমানের গভীর অনুভূতি তার মুখের রেখাগুলিকে অসহায় করে তোলে। এখন বাবামায়ের আদর্শ পাত্রের সঙ্গে তার বিবাহের আয়োজন চলছে; অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো বিবাহের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন হয়ে যাবে। তবে যে চাওয়া পূরণ হয়নি, সেই অপূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা যেন অন্তরের গভীরে অমরত্ব লাভ করে বসে আছে, এক অদম্য বাসনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে।
0 Comments