লেখিকাঃ তাহিনা আইরাত ইরা
ধরনীতে বৃষ্টি নেমেছে। ভারী বর্ষনে চারিপাশ মুখরিত হয়ে যাচ্ছে। দুতলা এক পুরনো বাড়িতে এক মোহময়ী নারী হাতে হুমায়ুন আহমেদ এর সেই ❝মৃন্ময়ী❞ বইটা নিয়ে বসে আছে। ক্ষনে ক্ষনে টেবিলের উপর রাখা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। পরনে সাদা শাড়ি ও প্রিন্টেড ব্লাউজ। আঁচল উচিয়ে রাখা। চুল গুলো সব খোপা করা হলেও পিছন থেকে কয়েকটা চুল বের হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ কোনো মনোহারিণী। মোহ এক পা এক পা করে জানালার দিকে এগিয়ে যায়। পুরনো কাঠের জানালাটা খোলা রাখায় বৃষ্টির ছাট ভিতরে আসছে। মোহ জানালার বাইরে হাত গলিয়ে দেয়। শ্রাবণীর পানি তার ওই কোমল হাত ভিজিয়ে নিচে পড়ছে। ঘরে হালকা হলুদাভ আলো..। এমন রূপে মোহ কে কোনো অপ্সরী থেকে কম কিছু লাগছিলো না। এ দৃশ্য ছিলো ভয়ংকর সুন্দর।...
মোহ নিজের শরীরের দিকে এক পলক তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। এই মোহিনী রুপ যেন কোনো বিষাক্ত অভিশাপের ঝলক। নিজের ভাগ্যের দিকে তাকাতে লজ্জা হয় তার। তার জীবন কী অন্য মেয়েদের মতো সুন্দর হোতে পারতো না?
আচ্ছা, তার সেই ছোট্ট বোন কেমন আছে? তার কথা মনে করে সে?
তটিনীর কথা স্মরণে আসতেই তার মোহ'র চোখ থেকে দুফোটা জল গড়িয় পড়ে।
আহা, এই সমাজ..। তারা কত কিছুই না ভাবে তাকে নিয়ে। তারা কী জানে? মোহ নামক এক যুবতীর মস্তিষ্কের আহাজারী, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ।
_____________YouTube
নিকোটিনের ধোয়া উড়িয়ে নিজের মন হালকা করার চেষ্টায় আছে এক যুবক। উষ্ণ, তাহরিব উষ্ণ। বিকালের সেই রুপসী নারীকে ভোলার সাধ্য নেই তার। তার বুকের ভিতর কী তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে তা তো শুধু সে তার সৃষ্টিকর্তাই জানে। এতো নারী থাকতে এই শ্যামবর্ণা, কোকড়া চুলের নারীটিই কেন এতো টানছে তাকে?
তার যে ভালোবাসার অধিকার নেই।
“ভালোবাসা? কয়েক ঘন্টার পরিচিত এক নারীকে নিয়ে কেন আমি ভালোবাসার কথা ভাববো?আমি না কাউকে ভালোবাসার যোগ্য, আর না কারোর ভালোবাসা পাওয়ার..। বেকার পুরুষ হলো আগাছার মতো, এরা কাউকে ভালবাসতে পারে না, আর না এদের কেউ ভালোবাসে”
খিলখিল করে হাসতে থাকে সে। হাসির মাঝেই ডুকরে কেঁদে ওঠে। অপরপৃষ্ঠের মানুষ টা কী জানে কেউ তার আকাশের মেঘ হতে চায়। তার জন্য কারো হৃদয়ে তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে।
______________
আরো একটি সুন্দর সকাল। উষ্ণ তৈরি হয়ে বেরোনোর জন্য উদ্যত হয়। আজ একটা অফিসে সে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে। উষ্ণ মনে এক পশলা আশা নিয়ে বের হয়।
রাতে ভারী বর্ষন হলেও সকালে রোদের তাপে তাকানো দায় হয়ে গেছে। উষ্ণ সেসব হজম করে অফিসে গিয়ে হাজির হয়।
কাচাঁ হলুদ রঙের একটা জামার সাথে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হেটে যাচ্ছে মোহ। তার গন্তব্য ভার্সিটি। আজকের আবহাওয়ার সাথে তার রুপ যেন ভীষন মানাচ্ছে।
ভার্সিটি তে ঢুকতেই শুরু হয় সিনিয়র দের উৎপাত। প্রতিদিন এসব উপেক্ষা করেই চলতে হয় মোহ'র। মাঝে মাঝে ভার্সিটি কাউন্সিলের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করে। যদিও তাতে তেমন কোনো লাভ হয় না।
ক্লাসরুমে প্রবেশ করতেই কিছু কিছু ছেলে মেয়েরা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি তে তাকায়। তাদের চোখে যেন মোহ ভূমিষ্ঠের চরম নোংড়া কিছু। মোহ গিয়ে বসে একদম জানালার পাশের বেঞ্চিতে। পরক্ষণেই তার পাশে এসে বসে তার'ই আরেক সহপাঠী প্রভা। তাতে মোহ'র ভঙিমার কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রভা মোহ'র দিকে তাকিয়ে একটা শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
৩ ঘন্টার পরীক্ষা দিয়ে অফিস থেকে বের হয় উষ্ণ। গরমে মাথা ফেটে যাচ্ছে। কপালের পাশ দিয়ে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। তবুও সেসব তোয়াক্কা না করে সে এগিয়ে যায় ভার্সিটির দিকে। গনিত বিভাগে মাস্টার্স করছে সে।
ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ক্লাসরুমে প্রবেশ করতেই কেউ কেউ তার দিকে নাক মুখ কুচঁকে তাকায়। উষ্ণের তাতে কোনো ভাবান্তর হয় না। সে নির্দিধায় গিয়ে শেষের বেঞ্চিতে বসে পড়ে।
ভার্সিটি শেষে মোহ ও প্রভা বের হয়।
“মোহ?”
মোহ নির্বাক।
“মোহ, শুনছো?”
“কিছু বলতে চাও?”
“তুমি এসব কীভাবে সহ্য করো?তোমার কষ্ট হয় না? আমি হলে তো এতদিনে আত্নহত্যা করে ফেলতাম।”
কণ্ঠে কঠিনত্ব ধরিয়ে মোহ বলে ওঠে,
“তারা তোমাকে কষ্ট তখনই দেবে যখন তারা তোমাকে কষ্টে দেখতে চাইবে। তারা তোমার সুখ সহ্য করতে পারবে না। আর তুমি বললে আত্নহত্যার কথা? আত্নহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয় প্রভা। তোমার জীবন একটাই। সবকিছু উপেক্ষা করে বাচতে শেখো। জীবন সুন্দর।”
প্রভা মাথা নিচু করে রাখে।
“তুমি সত্যিই অনেক কঠিন মোহ।”
মোহ আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ে। তার অক্ষিযুগল সামনে নিবদ্ধ। তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে প্রভা চমকায়।
“তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন মোহ?”
মোহ নির্লিপ্ত। প্রভা মোহ'র দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে দেখে তটিনী ছলছল চোখে এক দৃষ্টিতে মোহ'র দিকে তাকিয়ে আছে।....
0 Comments