লেখিকাঃ তানজিল মীম
স্রোতের সাথে আমার পরিচয় আজ চার মাস হবে। সম্পর্কে সে আমার দূরসম্পর্কের এক বন্ধুর চাচার মেয়ে। খুবই দূরের সম্পর্ক। আমাদের দেখা হওয়াটা ছিল আকস্মিক। এক বিকেলে টানাপোড়া জীবন নিয়ে হাতে পাউরুটি নিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ চোখের সামনে একটা গাড়ি থামল। গাড়ি থেকে শ্যুট'বুট পরে নামল এক যুবক। দেখে তেমন চিনতে পারলাম না। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলাম। কিন্তু আচমকা যুবকটি হাত ধরে বলল,
“আরে রাহাত, কেমন আছিস? কতদিন পর তোকে দেখলাম?”
যুবকটির কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম। যুবকটি আমার নামও জানে। যুবকটি বেশ বিস্মিত কণ্ঠে শুধাল,“কিরে চিনতে পারিস নি? আমি আসিফ, আমরা প্রাইমারিতে একসাথে ছিলাম।”
আমি বিমুঢ় তার পানে চেয়ে। সেই কোনকালে প্রাইমারিতে ছিলাম সেকালের বন্ধু। শুরুতে ঠাহরে আনতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম এ আমার ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল না। আসিফ আবারও বলল,
“কিরে আমায় চিনতে পারিস নি?”
আসিফের প্রশ্নের উত্তর কি দিবো বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ বলাও যাচ্ছে না আবার না বলাটাও শোভা পাচ্ছে না। আমার অবস্থাটা বোধহয় আসিফ বুঝল। সে বলল,“আরে আমি সেই আসিফ যাকে তোরা মটু বলে ক্ষেপাতিশ। টিফিনের সময় হুটহাট বেধম মারতিস।”
কথাশুনে আসিফকে মনে করতে পারলেও এবার বেশ লজ্জিত লাগছে। ছিঃ ছোট বেলায় কত খারাপ ছিলাম আমি। অবশ্য এখন যে খুব একটা ভালো হয়েছি এমনটাও না। আসিফের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
“আরে শালা তুই? সেসময় তো মোটাগোটা ফার্মের মুরগীর মতো ছিলি এখন এমন সুদর্শন হয়ে গেলি ক্যামনে?”
আসিফ বোধহয় খানিকটা লজ্জা পেল। বলল,
“তেমন কিছু না তোদের থেকে মটু মটু শুনতে শুনতে আমি পণ করেছিলাম এবার শুকনা হয়ে দেখাবো। হাই স্কুলে উঠেও আমি আমার ভাড়ি স্বাস্থ্যের জন্য কথা শুনেছি। এরপরই সিদ্ধান্ত নেই নিজেকে বদলাবো। ব্যস এরপরই মিশন ছিল শুকনা হওয়ার। যার ফল এখন তোর সামনে।”
আসিফের কথা শুনে কি জবাব দিবো বুঝলাম না। তবে মনে হল মাঝে মাঝে মানুষকে টিটকারি দিয়ে কথা বললেও ভালো কিছু পাওয়া যায়। যেমনটা আসিফ পেল।'
সেদিনের বিকেলের অর্ধেক সময় আসিফের সাথে কাটল। আসিফ জোর করে শেষ বিকেলের দিকে তার চাচার বাড়ি নিয়ে ছুটল। ব্যস সেখানেই দেখা হল আমার স্রোতের সাথে। মেয়েটাকে দেখেই কেমন যেন ভালো লাগা কাজ করল। স্রোতের বাবা আব্দুল সাহেবও দারুণ ভালো মানুষ। তার সামনে বসলে এমনভাবে গল্প জুড়ে দিবেন যেন আমি তার আপন কোনো মানুষ। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য ঘুরছি দু'বছর পেরুচ্ছে অথচ চাকরির খবর নেই। হাতে গোনা ক'টা টিউশন পড়িয়ে দিনগুলো পাড় করছি কেবল। এই টানাপড়া জীবনে স্রোতের আগমন যেন ব্যাথার ওপর বিষফোড়া হওয়ার মতোন ছিল। মেয়েটার সাথে আমার প্রায়ই দেখা হয়। কখনো মোড়ের মুখে, বাসের ভিড়ে অথবা চায়ের দোকানে। এই তো সেদিন মিন্টু মিয়ার চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম। সেই সময় স্রোত হাজির। পাশে বসে দ্বিধাহীন জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছেন রাহাত সাহেব? চাকরিটা কি হয়েছে আপনার?”
উত্তরে আমি শুধু মলিন হাসতাম। এটাই বোধহয় স্রোতের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলেই শুধু জিজ্ঞেস করবে,“চাকরিটা কি হয়েছে রাহাত সাহেব?”
কিন্তু একবারও এই প্রশ্নের জবাবটা সন্তুষ্টজনক দিতে পারতাম না।'
আজ সোমবার। দিনের শেষ বিকেল চলছে। আমি গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি স্রোতেদের বাড়ির সামনে। ভিতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না ঠাহর করতে পারছি না। কে কি ভাব্বে বুঝতে পারছি না। আচমকা পিছন থেকে পিঠে হাত বুলালেন আব্দুল সাহেব। বললেন,“আরে রাহাত যে, এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
আমি হতভম্ব হয়ে বলে ফেললাম,“চাচা ওই স্রোতের থেকে একটা গল্পের বই নেয়ার ছিল।”
ডাহা মিথ্যে কথাটা বলে আমি তব্দা খেয়ে দাড়িয়ে রইলাম। আব্দুল সাহেব মৃদু হাসলেন। বললেন,“ওহ, তা বাহিরে কেন? ভিতরে আসো।”
আব্দুল সাহেব আমায় নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। পথেই দেখা হল স্রোতের সাথে। ফুলগাছে পানি দিচ্ছিল। স্রোতেদের বাড়ির উঠোনের এক কর্নারে রয়েছে বিশাল ফুলের বাগান। অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল সেই বাগানে রয়েছে শুধু কালো গোলাপ। পুরো গোলাকৃতির মাঠ সমান নিয়ে কালো গোলাপ। বাড়ির উঠোনে শুধুমাত্র কালো গোলাপ রাখাটা ঠিক কি না ধরতে পারছি না। সাহস করে কখনো জিজ্ঞেস করাও হয় নি। “উঠোনে শুধু কালো গোলাপ কেন রেখেছো স্রোত?– আজ ভাবলাম জিজ্ঞেস করা যাক। আব্দুল সাহেব ততক্ষণে ভিতরে ঢুকে গেলেন। স্রোতকে বোধহয় খেয়াল করেন নি। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। স্রোতই লক্ষ্য করল আগে। মিষ্টি হেঁসে জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছেন রাহাত সাহেব? চাকরিটা কি হয়েছে আপনার?”
পুরনো সেই একি প্রশ্নে আমি মলিন হাসলাম। স্রোত আর কিছু বলল না। ফুলগাছে পানি দিতে মনোযোগী হল। আমি কিছু সময় পর জিজ্ঞেস করলাম,“আচ্ছা স্রোত তোমায় একটা প্রশ্ন করি?"
স্রোতের দ্বিধাহীন উত্তর,
“জি বলুন।”
“তোমার ফুলবাগানে শুধুমাত্র কালো রঙেরই বাস কেন?”
স্রোত সরাসরি চাইল রাহাতের দিকে। মিষ্টি হেঁসে বলল,
“বলবো একদিন। তবে আজ নয়।”
“কেন আজ নয় কেন?”
স্রোত উত্তর দেয় না মিষ্টি হাসে। রাহাত আবার প্রশ্ন করে,
“তোমাদের বাড়িতে যখন প্রথম এসেছিলাম তখন কিন্তু কালো গোলাপ ছিল না।”
“তাতে কি? আমি কি পরে কিনে লাগাতে পারি না। আর তাছাড়া আপনার আসার সাথে আমার কালো গোলাপের কোনো সম্পর্ক আধোতেও আছে কি।”
আমি নিশ্চুপ বনে গেলাম। সত্যি তো আধোতেও এর সাথে আমার আসার সম্পর্ক নেই। আমার নিশ্চুপতায় স্রোত বলল,“আচ্ছা শুনুন আজ বাড়ি যাওয়ার পথে একটা সাদা গোলাপ কিনে নিয়ে যাবেন। আপনার ঘরের জানালার পাশে লাগিয়ে রাখবেন।”
আমি বড্ড অবাক হলাম স্রোতের কথা শুনে। তবে কিছু বলতে পারলাম না। আসার সময় স্রোতের থেকে বই নিয়ে আসলাম। খামোখাই এনেছি এই বই কি আমি ছুঁয়ে দেখব। অবশ্যই দেখব না। সে হয়তো আগামী সপ্তাহখানেক অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকবে আমার ভাঙাচোড়া ড্রয়ারে। আব্দুল সাহেবকে মিথ্যে বলার জন্যই এর আগমন। নয়তো আমি কোনো বইপ্রেমিক নই। আমি হলাম অবাধ্য মায়ের ব্যাচেলার বেসের চাকরিহীন এক বেকার যুবক। আর বেকার ছেলেদের বইপ্রেমীতে মানায় না। তাদের মানায় শুধু খবরের কাগজে, চাকরির বিজ্ঞাপনে।
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে সত্যি সত্যি একটা সাদা গোলাপ কিনে বাড়ি ফিরলাম। তাকে থাকার জন্য মাটির টব দিলাম। জানালার পাশে ঘুমানোর ঠাই দিলাম। রোজ খেতে পানি দিলাম। একটু একটু করে বাড়ছিল বেশ। দিন আমার চলছিল ভাঙাচোরার বেসে।'
তার ঠিক পনেরদিন পর আমার আবার স্রোতের সাথে দেখা। সেদিনও শেষ বিকেল চলছিল। আমি হতভম্ব হয়ে তার পানে তাকিয়ে ছিলাম। কারণ স্রোতের আঁখি ছিল ভাড়ি। আমি বিষম খেয়ে প্রশ্ন করলাম,“কি হয়েছে?”
রাহাতের হতাশার মুখ। লজ্জায় ভরা আঁখি। করুণ কণ্ঠস্বর,“হয় নি।”
স্রোত সেদিন আর কিছু বলল না। কেঁদে টেদে চলে গেল। দিয়ে গেল একরাশ বিষণ্ণের দীর্ঘশ্বাস। সেদিন রাতে আর ঘুম হল না আমি ধরতেই পারলাম না স্রোত হঠাৎ এসে কাঁদল কেন?
দিন চলছিল। নানান চাপে স্রোতেদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হল। চাকরি চাকরি করতে করতে জীবন শেষ তবুও চাকরির খোঁজ নেই। ক্লান্তিতে জীবন ভরপুর। একদিন সকালে উঠে দেখি আমার সাদার বাগানে ফুল ফুটেছে। কি সুন্দর ধবধবে সাদা রঙের গোলাপ। দেখেই স্রোতের কথা মনে পড়ে গেল। স্রোতও ধবধবে সাদা রঙের একটি মেয়ে। কি সুন্দর দুধে আলতা গায়ের রঙ। ফুটে ওঠা ফুলগুলো দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। ভাবলাম আজ একবার স্রোতেদের বাড়ি যাওয়া যাক। কতদিন হল স্রোতকে দেখি না। সেই যে কেঁদে কেটে গেল আর খোঁজ নেই। আমারও যাব যাব করে যাওয়া হল না।'
সারাদিনটা শুয়ে বসে কেটে বিকেল দিকে ছুটলাম স্রোতেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে আয়নায় নিজের মুখখানা একবার দেখলাম। আমি দেখতে আহামরি সুন্দর নই। আমার গায়ের রঙ কালো। অনেকে তো আমায় কানাচান বলে ডাকে। তবুও এ বিষয়ে আমার আফসোস নেই। আফসোস শুধু একটা বিষয়েই আমার চাকরি নেই।'
স্রোতেদের বাড়ি গিয়েই থমকে গেলাম। বাড়িতে মেহমান এসেছে। স্রোতের শশুর বাড়ির লোকজন। সঙ্গে স্রোতের স্বামীও আছে। আমি থমকে গেলাম এমন দৃশ্য দেখে। পরে জানলাম, মাস কয়েক আগে স্রোতের বিয়ে হয়ে গেছে। ঢাকা ভার্সিটির বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের এক টিচারের সঙ্গে। স্রোতের নজরে পড়তেই সে জিজ্ঞেস করল,“চাকরি টা কি হয়েছে রাহাত সাহেব?”
আজ আর উত্তর দিলাম না। প্রয়োজন মনে হল না। উল্টো জানালাম,“ভালো থেকো।”
বাড়ি থেকে বের হতেই আব্দুল সাহেব ধরলেন। বললেন,“আরে রাহাত যে আজও কি গল্পের বই নিতে এসেছো?”
আমি মিষ্টি হেঁসে বললাম,“রাহাতের গল্পের বই পছন্দ নয় চাচা। আপনাকে মিথ্যে বলার জন্য আমি দুঃখিত।”
কথা বলে বেরিয়ে আসলাম। আর ভালো লাগছে না। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। বাড়ির উঠোনে কালো গোলাপগুলোও আজ নেই। বোধহয় উপড়ে ফেলা হয়েছে। আমি বেরিয়ে আসলাম। হঠাৎ মনে হল বুকের ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তীব্র জ্বালাপোড়া করছে। পাত্তা দিলাম না। বেকার মানুষদের এমন ছোটখাটো ব্যাপারকে কখনোই পাত্তা দিতে নেই। পথে পথে দূর্বাঘাস জমেছে। প্রকৃতিতে শেষ বিকেল নেমেছে। হঠাৎ মনে হল, আমার যে কষ্ট হচ্ছে এটা আধোতেও বড় ব্যাপার না। এমন কতশত 'শেষ বিকেলের প্রেম' পথের ধারে দূর্বাঘাস হয়ে পড়ে থাকে মানুষ উঠায় না। আমার প্রেমটাও না হয় উঠালাম না। বাড়ির যাওয়ার পথে দুটো ঘুমের ট্যাবলেট কিনলাম। ভাবলাম আজ একটা দারুণ ঘুম দিব। প্রেম বিচ্ছেদের বিষাদী ঘুম। কারণ সবার গল্পের প্রেম সুন্দর হয় না। কারো কারো বিষাদীও হয়। তবুও মনে একটি প্রশ্ন রইল, স্রোত কেন একসময় কালো গোলাপে উঠোন ভরেছিল আমায় বললো না। আর বোধহয় বলবেও না। মাঝে মাঝে পৃথিবীতে এমন কিছু কথা থাকে যা আর বলা হয় না।'
0 Comments