লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


❝তোমরা ওসার করিয়া পারো বিছানা,,
ওহো দয়ার ভাগিনা,,
ওরে ভাগিনা গেইছে ধাপের হাট,,
কিনিয়া আনছে ভাগনা ছাপর খাট,
ওরে সেই না খাটতে হামার পা'ছা আটে না
ওহো দয়ার ভাগিনা ❞
রাত্রির গহীন অন্ধকার বিদীর্ণ করে প্রভাতের অরুণালোকে যখন ভুবন রঞ্জিত হলো, বিয়ের আয়োজন প্রগলভ হলো। মিলিদের প্রাঙ্গণে দাদী-নানীরা নৃত্য-গীতে মত্ত; শিশু-যুবা সকলেই মুগ্ধ হয়ে পরম আদরে সেই গীতালি দেখছে। বিশালাকার প্যান্ডেলের আয়োজন সম্পন্ন, স্টেজের সাজগোজও প্রায় চূড়ান্ত। কালকের গায়ে হলুদের জন্য ব্যস্ততায় মেতে উঠেছে পরিবার। কিন্তু মিলি এখনো নিদ্রার কোলে লুটিয়ে আছে। জবেদা বেগম মাঝে মাঝে তার কাজের ফাঁকে কন্যাকে সুধা শোনাচ্ছেন। কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে মায়ের জন্য বিশ্রাম কোথায়? গত রাত্রি ছিল মিলির জীবনের এক অপরূপ সন্ধিক্ষণ; নিজের অজানা সত্যের সম্মুখীন হয়ে যখন স্তম্ভিত সে। ফুলদানির অসতর্ক সংঘর্ষে যে শব্দ উঠল, তাতে মা জবেদা বেগম আর পিতা হাবিবুর রহমান জানতে পারলেন মিলির অন্তরের গভীর টানাপোড়েন। এরপরই মিলির বুকে ক্রন্দন ঝরল। পিতামাতার কোলের আশ্রয়ে মিলি রাতে শোবার সুযোগ পেল, যেমন ছোটবেলায় পেত। সারা রাত ধরে জবেদা বেগম আর হাবিবুর রহমান মেয়েকে তপ্ত বুকে আগলে রাখলেন, বুঝালেন সেই কঠিন সত্য যা মেনে নিতে তাকে শিখতে হবে।
শেষমেশ, কন্যা নিজ অন্তরের কোলাহল নিঃশেষ করল; যদি ফাহাদ, এক পুরুষ, সেই কঠিন বাস্তব মেনে নিতে পারে, তবে মিলি কেন পারবে না? ফাহাদ তো তাকে স্বরূপেই গ্রহণ করেছে, কেবল বাহ্যিক রূপে নয়। আঁখির সেই কথাগুলো মিলির মনে প্রতিধ্বনিত হলো—“যে ভালোবাসবে, সে মুগ্ধ হবে স্বরূপেই, বাহ্যিক রুপে নয়।” মিলি তো মোটা, সবকিছু ঠিকঠাক করতে পারে না, অথচ ফাহাদ তাকে তেমন করেই ভালোবেসেছে! তার মাতৃত্বের অক্ষমতা স্বীকার করেও তাকে গ্রহণ করেছে!
মিলি সারারাত অশ্রুক্ষরণে জেগে ছিল, আর প্রভাতে ঘুমে মগ্ন হলো, কিন্তু জবেদা বেগমের তো বিশ্রামের অবকাশ নেই। প্রভাতের মৃদু আলোর সঙ্গেই তিনি কাজে লেগে পরলেন। শাহারিয়াজ ও শিকদার পরিবারদের সহায়তা না থাকলে, কে জানে, মিলির বাবার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ থাকত কিনা! এরা যতই পরস্পরের মধ্যে বিরোধ রাখুক না কেন, সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের মনোভাব সর্বদাই মানবিক।
হিরা অনিচ্ছাকৃত বিরক্তি নিয়ে ধীর পদক্ষেপে মিলির ঘরের দ্বারে আসলো। তার মা তাকে পাঠিয়েছে মিলিকে ডাকতে, যদিও তা তার একেবারে মনঃপূত নয়। ২২ বছরের সুদর্শনী হিরার চোখে তার এই কাজ যেন একপ্রকার অপমান। অথচ তার আগে তার ছোটবোনের মিলির বিয়ের আয়োজন! মিলির গড়ন তার একেবারেই পছন্দ নয়—অস্থির মোটা এক ঢেমনা, সারাক্ষণ খেয়ে বেড়ায়। কেমন করে এর বিয়ে হতে পারে! অথচ হলোই। বিরক্তিতে অধীর হয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কাছে গিয়ে মিলিকে ঝাঁকিয়ে ডাক দিলো,
——— "এই মিলি, উঠবি না? যত্তসব! তুই পরে পরে ঘুমাচ্ছিস আর আমার জানের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছিস। উঠবি তুই?"
মিলির চোখ ক্লান্তিতে পিটপিট করতে করতে খুলল। সারারাত কেঁদে তার চোখমুখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। কিন্তু হিরার দৃষ্টিতে এসব ধরা পড়ে না। সে কেবল বিরক্ত স্বরে বলল,
——— "ধা'ম'রির মতো না ঘুমিয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে কিছু খা! আর আমাকে মুক্তি দে!"
এই বলে, হিরা একদম হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, যেন মুক্তি পেতে ব্যাকুল।
আঁখি ও আছিয়া মিলির গৃহমন্ডলে প্রবেশ করল মাত্রই আঁখির অন্তর্গত স্মৃতি পুনরাবৃত্তি করল—সেই ক্ষণ, যখন আফিয়া বেগম তার হাত দৃঢ়তর করে সকলের সম্মুখে বিধান দিয়েছিলেন,
——— "যা ঘটেছে তা কোনোমতেই যেন প্রকাশিত না হয়, নইলে ফলাফল আরও গভীরতর সংকটে নিপতিত হবে।
আঁখি কোনো প্রতিবাদ করল না; কেবল একটি রহস্যময় হাস্যে আপন সত্ত্বাকে প্রকাশ করল। কেন হাসল, তার গুপ্ত কারণ আঁখি ব্যতীত আর কারও অবগতি ছিল না।
তারা উভয়ে যখন মিলিকে সন্ধান করছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে মিলি সবে খাওয়া সমাপন করে উঠল। আঁখি ও আছিয়াকে দেখেই মিলির মুখমণ্ডলে এক প্রকার আলোকের মৃদু ঝলকানির ন্যায় আনন্দের প্রতিফলন ঘটল। কিন্তু আঁখি মিলির অভিমুখে সূক্ষ্মতর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগল; মিলিও তদ্রূপ আঁখির শরীর অভিমুখে।
আঁখির দৃক্শক্তির কারণ ছিল মিলির অতিশয় অস্বাভাবিকরূপে স্ফীত ও শূন্যতাপূর্ণ চক্ষু ও মুখমণ্ডল। অন্যদিকে, মিলির বিস্ময়কর দৃষ্টি আঁখির প্রতি ছিল এই কারণে যে, এই প্রখর উষ্ণতায়ও আঁখি নিজ দেহাবরণ সম্পূর্ণরূপে কণ্ঠাবদ্ধ করে রেখেছে, যেন তীব্র শৈত্যপ্রবাহে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। মিলির মনে অশান্তি সৃষ্টি হল। সে কিছু বলার পূর্বেই আঁখি প্রশ্ন করে উঠল,
——— “তোর এই চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?”
মিলি এড়িয়ে যাবার প্রয়াসে বলল,
——— “ওসব ছাড়, তুই এই গরমে কেন এমন ফুল হাতা জামা পরে মুড়িয়ে রেখেছিস? তোকে দেখে তো আমারই অসহনীয় গরম লাগছে!”
আঁখি হাসি নিক্ষেপ করে উত্তর করল,
——— “অবশ্যই কারণ আছে, তবে তা বলার জন্য নয়!”
আছিয়া সমীপে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
——— “ওফ্, বলিস না! এই বুনো বিড়ালটা কখন যে কি করে কবে, কেবল নিজেই জানে!"
হাস্যে জড়িত হলো ত্রয়ী, হঠাৎ করেই হাসির ঝিলিক ম্লান হলো। তিনজনের মুখাবয়ব হতাশার ছায়ায় ঢেকে গেল। যদি আজ রূপা থাকতো! সে বোধহয় এভাবেই হাসতো, সকলকে মাতিয়ে রাখতো। দীর্ঘশ্বাসের অশ্রুস্রোত বয়ে গেল তাদের মধ্যে।
যেমনি তারা বাহিরে পা রাখল, চারিদিকে তাদের চোখে ধরা পড়ল অগণিত কোলাহল, দস্যিপনা ও অমিত শিশুপ্রীতি। মিলির ভাই শুভ, একদল শিশুর সহিত প্রমত্ত খেলায় নিমগ্ন। বৃদ্ধারা গীতধ্বনি তুলেছে, সেই দৃশ্যই ত্রয়ীকে আকৃষ্ট করল। নীরবে গমন করল তারা, দাঁড়াল সেই স্থানে। হঠাৎ কোথা হতে আরাফ আঁখির পার্শ্বে উপস্থিত হয়ে বলল,
——— "মেডামের কি শীত করছে?"
আঁখি আরাফের কণ্ঠ শুনে চমকিত হয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল, মিলি ও আছিয়া তাকিয়ে রইল। আরাফের ঠোঁটের কোণে হাসি। পাশে দাঁড়িয়েছে মিনহাজ। আঁখি হাস্য করব বলল,
——— " তা তো বটেই, তবে আমার নাকি আপনার?"
এ বলেই আঁখি দূরে সরে দাড়ালো , কেননা আরাফ নিকটবর্ত্তী হয়ে তার সহিত বাক্যালাপ করছিল। আরাফ চুল ব্যাকব্রাশ করে মৃদু হাস্য করে বলল,
——— "তোমার সাথে কিছু কথা আছে।"
——— "বলে ফেলুন।"
——— "একটু ব্যাক্তিগত, বুঝলে?"
আঁখি ক্রুদ্ধ হল। চারিদিকে একবার তাকাল। এত বড় হয়েও এমন শিশুসুলভ আচরণ করে কীভাবে? মিলি ও আছিয়া বিস্ময়াভিভূত হয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইল। এমন আচরণ তারা কখনও প্রত্যক্ষ করে নি। মিনহাজের দিকে তাকালো তারা, সেও হাস্য করছে। আঁখি বলল,
——— "তোরা থাক, আমার কাজ আছে।"
এ বলেই আঁখি দ্রুত প্রস্থান করল। দৃষ্টির সীমায় মিলিয়ে গেল। আরাফ দূর হতে দৃশ্য অবলোকন করে নীরব হাস্য করল। আছিয়া আরাফের পেটে মৃদু ঘু'ষি দিয়ে বলল,
——— "আমার সাথে তো এমন মিষ্টভাবে কথা বলস না?"
——— "তোকে দেখলেই কান্না পায়। ড্রেন হতে তুলে এনেছিলাম যে সেই কারণে।"
মিনহাজ নীরবতা ভঙ্গ করে বলল,
——— "তোর বেদনা আমি বুঝি আরাফ, থাক, কী করবে আর?"
আছিয়া রাগে ফুঁসে উঠল। তাকে নিয়ে কি পরিহাস করছে উভয়েই? কণ্ঠ কঠিন করে বলল,
——— " কিইই?"
——— "তোমার নাকের ঘি।"
আছিয়ার ক্রো'ধ আরও বাড়ল। মিলি উল্লাসে ফেটে পড়ল, তার অট্টহাস্যে পরিবেশ আরও জীবন্ত হল। দুই ভাই বোনের খণ্ডযু'দ্ধ দৃশ্যমান। আরাফ আছিয়ার মস্তকে গাট্টি মেরে বলল,
——— "বেশি মাথা খাটিয়ে লাভ নেই, বুদ্ধি তো তোর হাঁটুর নিচে।"
এ বলেই আরাফ মিনহাজের কাঁধে হাত রেখে হাস্য করতে করতে দূর হয়ে গেল। কিন্তু আছিয়ার মনে সন্দেহের ছায়া রইল, কেন তার ভাই আঁখির সহিত এমনভাবে কথোপকথন করল? কিছুই সে বুঝতে পারল না।
--
দূর হতে সেই দৃশ্যের সূক্ষ্মতাকে অতি নিবিড় দৃষ্টিতে আত্মস্থ করে নিলো কেও এক জন। পাশেই রোহান মুগ্ধের গলা জড়িয়ে কণ্ঠে মজার সুরে বলল,
———, "দেখ দেখ, তোর চেয়ে ছোট ছোট পোলাপানের বিয়ে হচ্ছে, আর তুই? ইশ! আটাশ বর্ষের প্রৌঢ়, এখনও বিয়ে করতে পারলি না! হায় হায়! এত দুঃখের পরিসর কোথায় রাখব?"
মুগ্ধের চোয়াল কঠিন। উত্তর দিল সে,
——— "তোর বোধকষ্ট যদি এতই হয়, আয়, তোকে মে'রে ফেলি, সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যাবে!"
রোহান লজ্জার আভাসে মুগ্ধের বলিষ্ঠ বুকে এক কিল বসিয়ে বলল,
———"যাহহ দুষ্টু কোথাকার! আমায় কেন মারবি? মারবি তো বাসর রাতে তোর বউ...!"
মুগ্ধের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রোহানের দিকে যেতেই তার বাক্য স্তব্ধ হল। রোহান বুঝতে পারল না, হঠাৎ এমন পরিবর্তন কেন ঘটল? ক্ষণিক পূর্বে তো মুগ্ধ অতি স্বাভাবিক ছিল। তখন রোহানের দৃষ্টি ভ্রম করল গীত গাওয়া বৃদ্ধাদের দিকে, চোখে চকিত আনন্দের ছায়া ফুটিয়ে বলল,
——— "হেই লুক লুক! বুড়িসরা ডান্সিং করছে! লেটস লেটস, উই অলসো ডান্সিং!!"
এই বলে মুগ্ধকে ফেলেই লুঙ্গি ধরে দৌড়াল রোহান। সমস্ত ভিড় ঠেলে ঠেলে বৃদ্ধাদের আলয়ে পৌঁছে তাদের আঁচল ধরে লাফাতে লাগল। হঠাৎ করেই, যেন আকাশের কোল হতে বিকট শব্দের প্রতিধ্বনি ভেসে আসল; পাশের দু'টি বৃহৎ সাউন্ড বক্স হতে উদিত হল সুরের ঝঙ্কার,
——— "আম খাইয়ো জাম খাইয়ো তেঁতুল খাইয়ো না
অল্প বয়সে বিয়া কইরা প্রাণে ম'ই'রো না।
ও মাইয়া তুই বিয়া করিস না
কাঞ্চা বাঁশে ধরবো যে ঘুণ, তুমি বাঁচবা না....."
নাঈমের ঠোঁট কামরে হেসে দিলো। গান বাজানোর কাণ্ড কারখানা তারই। রোহান অট্টহাস্য চেপে নাঈমকে ইঙ্গিত করল। নাঈম আর স্থির রইল না। সেও অল্পক্ষণের মধ্যে গামছা গলায় ঝুলিয়ে ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করল। রোহানের মনে হঠাৎ উদয় হল, মুগ্ধকে তো পিছে ফেলে এসেছে! কিন্তু যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে গেলে নাঈম তার হাত শক্ত করে ধরল চিল্লিয়ে বলল,
——— " আরে আরে যাচ্ছ কোথায় মিয়া? নাচতে থাকো! দেখো দেখো, কেমন সকলে তোমার নৃত্য উপভোগ করছে। এমন নাচ যে তুমি করছ, এ গ্রামে তো দূরের কথা, সমগ্র দেশেও এমন কেউ নাই! বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীরা তো তোমার কাছেই শিখবে। তোমার নাম গিনিস বুকে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে,, তুমিই এই গ্রামের গৌরব! নাচো নাচো !"
নাঈমের এই মধুর প্রলেপে রোহান যেন আরও দিগ্বিজয়ী হয়ে উঠল। শুরু হল তাহার পাগল নৃত্য! মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে লয়ে মত্ত হল সে। মুগ্ধ যাক গোল্লায়! তার প্রতিভা আজ প্রকাশ করতে হবে। নাঈমও সেই নৃত্যরত অবস্থায় ইঙ্গিতে রোহানের সহিত কথার আদানপ্রদান করল। এই দুই মনের মিলন ঘটে যেন নৃত্যের তালে তালে, দুই বৃদ্ধাকে কোলে তুলে শুরু হল কাপল ডান্স। বৃদ্ধারা অট্টহাস্যে লুটিয়ে পড়ল, আর আশেপাশের জনতা উল্লাসে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল। শিশুরাও ঘিরে ধরল তাহাদিগকে। ভোলা ও আলোও সেই মত্ত নৃত্যে অংশ গ্রহণ করল।
এই নৃত্যের তালে তালে নাঈম মনে মনে বলতে লাগল,
——— "তুমি এখানে নাচো, আর তোমার বন্ধুকে কেও নাকে দরি দিয়ে নাচাক! আমার কি? আমিও নাচি!"
চারিদিকের লোকজন বুঝতে পারল না এই গানের তালে এমন উন্মত্ত নৃত্য কেন হচ্ছে। তবে সকলে এর মাধুর্য উপভোগ করছে বেশ।
এই মুহূর্তে মিলি প্রস্থান করতে উদ্যত হলো, আছিয়া দ্রুত তার কনিষ্ঠ অঙ্গুলী ধরে থামিয়ে বলল,
——— "কোথায় যাচ্ছিস?"
——— "আঁখি কোথায়, তা দেখতেই তো যাচ্ছি!"
——— "আহা! ও এখানেই আছে কোথাও এই ভিড়ের মাঝে। বস, ভাইয়াদের নাচ দেখ।"
তবুও, আশপাশের পিচ্চি পুলাপান ভোলা, শুভ, আলো মিলিকে পেছন থেকে জোর করেই টেনে নিল নাচের আসরে। শুরুতে আপত্তির ব্যুহে আটকে গেলেও, ক্রমে জোরের তোড়ে সে রাজি হল। সমস্ত বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলে, পা মেলাল নৃত্যের তাল লয়ে। আছিয়া হাততালিতে তাকে উৎসাহিত করল, আর তখনই, সেই দৃষ্টিতে আগুন নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল হীরণ, হিরার বড় ভাই। তার পা'পি'ষ্ঠ দৃষ্টি যেন ভ'স্ম করে দিচ্ছিল মিলির প্রতিটি নৃত্যগতি। নারী শরীরের প্রতিটি ভাঁজ তার দৃষ্টিতে লা'ল'সা'র বি'ষময় রসায়নে মুগ্ধ হয়ে উঠল। হীরণ এক প্রকার বক্র হাসি হেসে বলল,
——— "আহহা! তোর স্বামীর বড়ই সৌভাগ্য। তোর মতো মাং'সল, নরম নারী পাবে, যে রাতভর তাকে তৃ'প্তিতে ভাসিয়ে রাখবে! ইশ! একবার যদি সুযোগ পাই, তোকে ছাড়ছি না!"
এ কথা বলে হীরণ ঠোঁটের কোণে এক বিকৃত হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে গেল। তবে এত ভিড়ে এবং উষ্ণতায় তার অন্তরাত্মা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। এখন আর নারীদেহ দর্শনের ক্ষুধা তার মনকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে না। সে ধীর পদক্ষেপে বাড়ির পেছনের নির্জন বাঁশঝাড়ের দিকে অগ্রসর হল, যেখানে ধানক্ষেতের সম্মুখে ফাঁকা জায়গায় সামান্য বাতাসে শীতলতার স্পর্শ খোঁজার আশায়। তবে যাওয়ার আগে, একবার শেষবারের মতো নারীদের দেহের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে সে নির্জনতার দিকে মিলিয়ে গেল।
তবে হীরণের গমন পথের শেষ প্রান্তে গিয়ে তার দৃষ্টি আটকাল এক কচি কিশোরীকে দেখে, যাকে সে পূর্বেই ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে থাকতে দেখল। হীরণের ঠোঁটের কোণে কপট বিদ্রূপের আভাস, মৃদুস্বরে বলল,
——— "কিসের জন্য এভাবে বসে আছো, আমার জন্যে?"
তবে আশ্চর্য! মেয়ে, বয়ঃসন্ধির শ্যাম বর্ণে রঞ্জিত, যেন শরতের গভীর মেঘ। তথাপি, অদ্ভুত এক মোহময় আবরণ তাকে ঢেকে রেখেছে। এই তীব্র তাপে, সে কিনা ফুলহাতার পোশাক পরিধান করে, ওড়নায় মোড়া শরীর! যেন প্রতিটি ভাঁজে রহস্য জমে আছে। হীরণের দৃষ্টিতে আরও একবার কা'মনার অ'গ্নি প্রজ্বলিত হল। এত ঢাকার কী প্রয়োজন! এ শীত তো তার উত্তপ্ত স্পর্শেই ক্ষ'য় হবে। তৃ'ষ্ণার্ত শিকারির মতো এগিয়ে যেতে উদ্যত হীরণ।
কিন্তু হায়! পা আটকে গেল হঠাৎ। কারণ, অপর পাশে দাঁড়িয়ে গেছে বলিষ্ঠ এক পুরুষ, দীর্ঘদেহী, যেন রণাঙ্গনে অবিচল সৈনিক। মৃদু অথচ কঠোর দৃষ্টিতে তরুণীর পাশে প্রহরীর ন্যায় দাঁড়াল সে। হীরণের ভেতরে তীব্র বি'র'ক্তির বাষ্প জমল, অ'ক্ষম রোষে দাঁত ঘষল। সে বুঝল, এ মুহূর্তে সরে যাওয়াই উত্তম, কিন্তু বিয়ে বাড়িতে পুনরায় দেখা হবে। তখন কৌশলে সে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করেই ক্ষান্ত হবে।
--
মুগ্ধ কঠোর মুখে দাঁড়িয়ে রইল, যেন তার মুখাবয়ব পাথরের মতো স্থির। পকেটের গভীরে হাত ডুবিয়ে, নিম্নকণ্ঠে নিঃসৃত হলো তার বাক্য,
——— "সবার চোখে অশ্রু শোভনীয় নয় ।"
আঁখি ধীরে মাথা উঁচু করল, তার দৃষ্টি মুগ্ধর ওপর এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে পুনরায় নিচু হয়ে গেল। চোখের কোনায় জমে থাকা নীরব অশ্রু মুছে নিয়ে সে মৃদু স্বরে বলে উঠল,
——— "আগুন শোভনীয়?"
——— "হ্যাঁ, তোমার চোখে।"
——— "দেখেছেন?"
——— "দেখতে চাই।"
——— "শুধু এটুকুই?"
——— "তার চেয়েও অধিক!"
আঁখি নীরব হয়ে স্থির রইল, তার মন যেন কোনো গভীর ধ্যানে নিমজ্জিত। হয়তো সেদিন মুগ্ধর প্রতি সে অতিরিক্ত ক'ঠো'র হয়েছিল, এই উপলব্ধি তাকে চিন্তান্বিত করে তুলল। লোকটি বাহ্যত কঠোর হলেও, হয়তো তার অন্তরালীন কোমলতা সেই কঠোরতার আড়ালে লুক্কায়িত ছিল। আঁখির ঠোঁটের কোণে এক ক্ষীণ স্বর ভেসে উঠল,
——— "সেদিনের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী আমি!"
মুগ্ধ তবু নিস্তব্ধ, তার মুখের রেখায় কোনো পরিবর্তন এল না। তার চোখে এক অপার রহস্য লুকিয়ে রইল।
——— "বোধ হয় আরও ক্ষমা চাইতে হবে তোমাকে!"
——— "কী বলতে চান?"
——— "সবই তো স্পষ্ট, বুঝতে পারছো না?"
——— "সত্যিই কিছুই বুঝিনি!"
——— "বুঝবে, যদি সীমা ছাড়িয়ে যাও!"
আঁখির মনে সংশয় ঘনিয়ে উঠল। মুগ্ধর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ যেন তার কাছে অজানা রইল। সে এক অস্থির কণ্ঠে বলল,
——— "আপনার কথার বাঁক বড়ই দুরূহ!"
——— "তুমিই তো সবসময় জটিল পথ অবলম্বন করো!"
——— "আপনি কি তা পরিষ্কার করে বলবেন?"
——— "কিছু দিন অতিক্রান্ত হোক, উত্তর ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে!"
আঁখি নীরব রইল, যেন মুখ থেকে কোনো শব্দ ঝরে পড়ার সাহস খুঁজে পাচ্ছে না। তার অস্থির হৃদয়ের তোলপাড় মুগ্ধর কঠিন উপস্থিতির সামনে থমকে । মুগ্ধ কোনো কথা না বলে এক পলক আঁখির দিকে তাকিয়ে, একেবারে নিজেকে সংযত করে দূরত্ব রেখে বসল। তার চোখের দৃষ্টি অমোঘ, চোয়াল দৃঢ়। তারপর এক তীক্ষ্ণ স্বরে উচ্চারণ করল,
——— "অশ্রুজল বাঁচিয়ে রেখো।"
আঁখি এবার তার দিকে তাকালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন তাকে বিদ্ধ করছে। মুগ্ধর চোখে র'ক্তে'র মতো গাঢ় লাল আগুন জ্বলে উঠেছে। কিছুটা দ্বিধায় কেঁপে উঠলেও, সে নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে বলল,
——— "আগুনের সৃষ্টি কিন্তু পানি থেকেই !"
——— যেখানে সৃষ্টি, ধ্বং'সও সেখানেই নিহিত!
আঁখি ধীরগতিতে উঠে দাঁড়ালো, বলল,
——— "আপনি আমার থেকে বয়সে বড়, তর্কে জড়াতে ইচ্ছুক নই।"
এই কথাগুলো উচ্চারণ করেই সে পা বাড়ালো বাড়ির ভেতরের দিকে। মুগ্ধ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, যেন তার ভেতরে কোনো অজানা ক্লান্তি জমে উঠছে। তার ঠোঁটের কোণায় গাঢ় এক ব্যঙ্গের ছায়া দেখা দিল, নিম্নকণ্ঠে সে বলল,
——— "দাবার খেলায় বড় দান তো পরে আসে, আগে ছোট গুটিগুলোই চাল দিতে হয়।"
---
দুপুরের রোদ্দুর আকাশে প্রখর আলো ছড়াচ্ছে। ভিড়ের গুঞ্জনে ভরা বাড়ির পরিবেশ, তবু একটা অদ্ভুত নিরবতা চারপাশে। আঁখি বসে আছে নীরবে, যেন চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে বেদনাবাহী ক্লান্তিতে। বিয়ের ভিড়ে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তাকে আলো ভারাক্রান্ত তাই নাঈম মাত্রই তাকে বাড়িতে রেখে এসে দাঁড়িয়েছে। জবেদা বেগমের পক্ষে সকলকে এক এক করে খাবার বেরে দেওয়া কষ্টসাধ্য তাই সকলে নিজের দায়িত্বেই খাবার খেয়ে নিয়েছে, কিন্তু বিশেষ একটি পদ—ইলিশ মাছ—যা কিনে এনেছে আরাফ, ছিল অন্যরকম। এই মাছ আঁখির প্রিয়, আর তার মুখে সেই হাসি যা আরাফের প্রিয়। যেন এক প্রকার নিঃশব্দ প্রেমের উৎসর্গ।
ঘরের ভেতরে সবাই কিছুটা স্থির হয়ে বসেছে। আঁখি, আছিয়া, আর মিলি বসে আছে পাশাপাশি, তাদের সঙ্গে ভোলা। বাইরে থেকে মিলির ভাই শুভর বাজানো বক্সের সুর ভেসে আসছে। মিলি অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে বেরোয়নি, তাই তাদের খাওয়া দেরি হয়ে গেছে।
এদিকে, হীরণ সবার দিকেই লা'ল'সামাখা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তার চোখের লোভ, তার মনের অপবিত্রতা স্পষ্ট। কিন্তু হীরণের বোন হিরা এই মিডেক ক্লাস পরিবারের ছোট্ট বাড়ির গিজগিজ বিরক্ত লাগলেও দৃষ্টি আজ অন্যদিকে বাঁক নিয়েছে; মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধর শক্তিশালী শরীর, তার মুগ্ধকর উপস্থিতি যেন হিরার মনের জটিল ইচ্ছাকে প্ররোচিত করছে।
মুগ্ধ, আরাফ, নাঈম, রোহান একসাথেই বসে আলাপে মগ্ন.! আরাফ নিজের প্রতিজ্ঞায় স্থির, সে আঁখির জন্য এখানেই থাকবে। মুগ্ধও নিজের মনোবাসনা নিয়ে এখানে স্থির, তার অন্তরের গভীরে কিছু একটা তাকে বাধ্য করছে থেকে যেতে। মুগ্ধ যেখানে রোহান সেখানে! এদিকে নাঈম আঁখির জন্যই রয়েছে! নয়ত ওকে একা আসতে দেওয়া হতো না এখানে!
--
যখন আঁখির সামনে ইলিশ মাছের পদ আসল, তার মুখ আনন্দে দীপ্ত হলো। আরাফের মুখে দেখা গেল স্নিগ্ধ এক হাসি; যে হাসি আঁখির খুশি দেখে ফুটেছে। কিন্তু মুগ্ধের চোখে একধরনের স্ফু'লিঙ্গ জ্বলে উঠল। প্রথমে সে আরাফের দিকে তাকালো, তারপর আঁখির দিকে। আঁখি হাসছে, আর তার সামনে রাখা ইলিশ মাছের মাথা যেন মুগ্ধর মনের ক্রো'ধকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো।
হঠাৎ মুগ্ধ উঠে দাঁড়ালো। চোয়াল শক্ত হলো, ভেতরের তীব্র ক্ষো'ভ যেন তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এগিয়ে গেল হনহনিয়ে, যেন সময় আর থেমে নেই। আঁখি তখনই হাত বাড়াতে যাচ্ছিলো খাবারের দিকে, কিন্তু মুগ্ধ এসে গ্লাসের ঠান্ডা পানি ঢেলে দিল খাবারের পাতে।
সেই মুহূর্ত যেন নীরবতায় ঠাসা—পানি আর ধ্বং'স যেন সমার্থক হয়ে উঠল।
0 Comments