লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত
চারুলতা এদিকে সেদিকে তাকিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিকে খুঁজে চলেছে । সে ঘূর্ণির মতো ঘুরে ঘুরে চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই অচেনা ব্যাক্তি টা কাব্য নয়তো , চারুর মনে তীক্ষ্ণ সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু কাব্য স্যার তো কাজে। তার ফোন চাপার সময় কই। তাহলে সেই কাঙ্খিত ব্যাক্তি টা কেই বা হতে পারে। যে সব সময় আমার উপর নজর রাখছে।
সবকিছু কেমন যেন চারুর ঘোলাটে লাগছে। তার সব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু কোনো উত্তর নেই তার। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে কাব্যের সাথে ধাক্কা লেগে যায় চারুর।
~ এভাবে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? কী খুঁজে বেড়াচ্ছিস তুই ? ভ্রূ কুঁচকে কথা টা কাব্য চারুকে জিজ্ঞেস করতেই ,,
~ না কিছু না বলেই চারু দ্রুত কাব্যের সামনে থেকে দ্রুত চলে যায়। কাব্যের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে চারুর অসস্তিবোধ হয়।
আর যদি এই অচেনা ব্যাক্তির কথাটা কাব্য জানতে পারে তাহলে তার রক্ষা নেই। ভয়েই চারু চুপ করে রয়েছে।
চারু গিয়ে তোহা আপুর কাছে বসে পড়ে। তোহা চারুকে ছোট বোনের চোখেই দেখে। সব সময় তার সাথে লেপ্টে থাকলেও তোহা তাকে কখনো মানা করবে না। বরং চারুকে সব সময় আগলে রাখার চেষ্টা করেছে সে।
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয় কিছু মুহূর্ত পর। একে একে সবাই কেয়াকে হলুদ মাখানো শুরু করে। কাব্য কেয়াকে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে। তার চোখের কোণে পানি জমে গেছে। আদরে মানুষ করা বোন অন্যের ঘরে চলে যাচ্ছে।
এর মাঝে চারুর চোখ আটকে যায় কাব্যের দিকে তাকিয়ে। সাদা পাঞ্জাবি, হাতে ব্রান্ডের ঘড়ি, চুলগুলোতে জেল দেওয়া, ফর্সা গড়ন , লম্বা চওড়া দেহ, । তাকে পুরো প্রিন্স লাগছে।
চারু যেন কাব্য কে নিয়ে কল্পনার জগতে বিরাজ করছে। নিজের অজান্তেই চারুর মনের কোণে কাব্যের প্রতি সুক্ষ্ম ভালোবাসার জন্ম হয়েছে।
চারু কিছু সময় এভাবেই তাকিয়ে রয়েছে কাব্যের দিকে। তার ভাবনার ছেদ ঘটে তোহার ধাক্কায়। তোহা এবং চারু অনুষ্ঠান চলাকালীন সেখানে থেকে একটু বাহিরে নিরিবিলি জায়গায় চলে আসে।
কাব্যদের বাসার পাশেই একটা নিরিবিলি জায়গা তোহা এবং চারু বসে কথা বলছে। চারু এদিক টাই খুব ই কম আসে। জায়গা টা কেমন নিস্তব্ধ। বেশি কেউ যাওয়া আসা না করায় দিনের বেলাতেও আস্তে ভয় পায় চারু।
চারু চারিপাশ টা ঘুরে ঘুরে দেখছে। এর মাঝে তোহার ডাক পড়তেই তোহা চারুকে চলে আসার জন্য বলে কিন্তু চারুর কানে সেটা বোধগম্য হয় না ।
তাই তোহা চলে গেলেও চারু যে তার পিছনে পিছনে যেতে পারেনি সেটা তোহার বোধগম্য হয় নি। তোহা কাজের চাপে চারুর কথা আর মনে করতে পারেনি।
হঠাৎ পিছনে থেকে পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসতেই চারু অনেক ভয় পেয়ে যায়। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে তোহা আপু কোথাও নেই।
শুধু সেখানে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। যারা সম্ভবত ছেলে পক্ষ থেকে এসেছে। তারা চারুকে দেখে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে।
~ সুন্দরী এখানে একা একা বসে আছেন যে। আমরাও আসবো নাকি সঙ্গী হতে । ছেলেগুলোর কথা শুনে চারুর এদেরকে মোটেও সুবিধার লাগছে না ।
ও অনেক ভয় পেয়ে যায়। চারুকে ভয় পেতে দেখেই ছেলেগুলো আবার বলে উঠে,,
~ আরে ভয় পাচ্ছেন কেন।আমরা থাকতে আপনি ভয় পাচ্ছেন। মনে তো হচ্ছে পরী রাজ্য থেকে কোনো পরী এখানে এসে বিরাজ করেছে। আর পরী টা কি না আমাদের কে ভয় পাচ্ছে। আসুন আমরা সবাই মিলে বসে আপার সাথে গল্প করি । তাহলে আপনার ভয় টাও কেটে যাবে।
বলেই ছেলেগুলো সয়তানি হাঁসি দিয়ে চারুর দিকে এগোতে থাকে। চারুর রীতিমতো হাত পা কাঁপছে। ভয়ে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করছে।
ছেলেগুলো যতোই এগোচ্ছে চারু ততই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। চারু পিছাতে পিছাতে কারো সাথে ধাক্কা লেগেই ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে।
পিছনে ফিরে কাব্য কে দেখেই ভয়ে জড়িয়ে ধরে চারু। কাব্য চারুকে বুকের সাথে আলতো করে জড়িয়ে নেয় দুই হাত দিয়ে ।
চারু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কাব্যের বুকে মাথা রেখে। তার শরীর কাঁপছে ভয়ে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম।
কাব্য সবটা বুঝতে পেরে ও বিচলিত হয়ে চারু কে জিজ্ঞেস করে ,,
~ কি হয়েছে তোর। কাঁদছিস কেন, ওরা কি তোকে কিছু বলেছে।
কিন্তু চারুর থেকে কোনো জবাব আসে না কাব্যের প্রশ্নে। বরং চারুর কান্নার বেগ আরো বেশি বেড়ে যায়। ভয় পেয়ে কাব্য কে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে চারু। কান্না করতে করতে কাব্যের বুকের পাশটায় ভিজে একাকার।
কাব্য বুঝতে পারে চারু খুব বেশি ভয় পেয়ে গেছে । যার জন্য সে অবিরাম কান্না করছে। তার মুখে কোনো সাড়াশব্দ নেই। কাব্য চারুকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ছেলেগুলো দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ।
কাব্য ছেলেগুলোর সাথে কোনো ঝামেলা না করেই চারুকে নিয়ে সেখানে থেকে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। ছেলেগুলো কাব্য কে নানা কথা বলে রাগিয়ে দিলেও সে কিছু না বলেই সেখানে থেকে চলে আসে।
তোহা চারুকে কান্নারত অবস্থায় দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে। চারু যে একটুতেই ভয় পেয়ে কান্না করে সেটা তোহা জানে কিন্তু আজ চারুকে এমন কান্নারত অবস্থায় দেখে একটু ভয় পেয়ে যায়।
~ কি হয়েছে চারু তোর । এভাবে কান্না করছিস যে, তোহা বিচলিত কন্ঠে চারুকে প্রশ্ন করতেই কাব্য বলে উঠে,,
~ একটু ভয় পেয়ে গেছে। তুমি ওকে ঘরে নিয়ে যাও। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে । আর তুই ভয় পাস না ওরা তোর কিচ্ছু করতে পারবে না, আমি আছি তো কাব্য চারুকে কথা বলেই সেখানে থেকে স্থান ত্যাগ করে।
তোহা কাব্যের কথা মতো চারুকে ঘরে নিয়ে যায়।তোহা চারুকে পানি দিতেই চারু এক ঢোকে পানিটা খেয়ে নেয়। বিছানায় বসে কিছু সময় চুপ করে থেকে তোহা চারুর ভয় পাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই চারু তোহাকে জড়িয়ে ধরে।
তারপর সব ঘটনা খুলে বলতেই তোহা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। সত্যি তো কাব্য আজ ঠিক সময় সেখানে পৌঁছে ছিল । চারুকে তার একা ফেলে আসা উচিত হয়নি। চারুকে আর সে কখনো একা ছাড়বে না।
~ কিছুই হবে না। তুই এতো চিন্তা করিস না কাব্য ভাইয়া আছে সে সব ঠিক করে দিবে। তোহা চারুকে শান্তনা দিয়ে চারুকে চুপ করায়।
অন্যদিকে কাব্য চারুকে রেখে ছেলেগুলোর কাছে চলে যায়। ছেলেগুলো সেখানে বসেই হাসাহাসি করছিল। হঠাৎ কাব্যের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদের একজন বলে উঠে
~ এসে গেছে হিরো । নায়কা কে উদ্ধার করে এখন আমাদের সাথে লড়াই করে হিরো সাজার চেষ্টা করবে।
কাব্যের কানে কথাটা আসতেই কাব্য পাঞ্জাবির হাতাটা একটু উপরে ভাঁজ করে রাখে। ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে একজন এসে কাব্যের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে ।
মুহুর্তের মধ্যে বাকী ছেলে গুলো চমকে উঠে কাব্যের কলার চেপে ধরা ছেলেটাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে। ছেলেটার নাক মুখ দিয়ে র-ক্ত পড়ছে । তারা স্পষ্ট বুঝতে পারে কাব্য তার মুখে ঘুষি মেরেছে।
ছেলেটার অবস্থা দেখে বাকী ছেলেগুলো ভয় পেয়ে যায়। তবুও একজন সাহস করে কাব্যকে মারতে এসে তার অবস্থাও নাজেহাল । একে একে সবার ই অবস্থা খারাপ করে ফেলে কাব্য।
একজন পালাতে গেলে পাশে পড়ে থাকা লাঠিটা তার দিকে ছুড়ে মারতেই ছেলেটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কাব্য ছেলেটার শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে মুখে ঘুষি মারতেই ছেলেটার মুখ দিয়ে গড়িয়ে র-ক্ত পড়া শুরু হয় ।
কাব্য ছেলেগুলোকে পাগলের মতো মার মারছে।
~ তোদের সাহস কি করে হয় আমার অপরুপার উপর কু নজর দেওয়ার বলেই ছেলেগুলো কে বেধম মার মারে। তোদের কে যদি কখনো আমার কলিজার ত্রিসীমানায় দেখি তাহলে তোকে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।
কাব্য সেখানে থেকে চলে আসে। ছেলেগুলো ও প্রান নিয়ে বাসার থেকে বেরিয়ে যায়।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই মেহেদীর প্রোগ্রাম শুরু হয়। একে একে সবাই মেহেদী পড়ছে। চারু ও মেহেদী পড়েছে । দুহাত মেহেদী রাঙা তার। খুশিতে সে খুব আহ্লাদি হয়ে উঠেছে। কাব্য কে অনেক জোড়া জোড়ি করার পর ও কেউ মেহেদী পড়াতে পারে নি।
চারু দু হাত ভরে মেহেদী দিয়ে তার ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। সিঁড়ির দিকে আনমনে পা বাড়াতেই একটা ছেলে চারুকে ধরতে যাবে সেই মূহূর্তেই ছেলেটাকে কেউ সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় তার অবস্থান থেকে। আর সেই মুহূর্তে চারুকে ধরে নেয় কাব্য।
কাব্য রাগি দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চারুকে কোলে তুলে তার ঘরে নিয়ে যায়। ছেলেটা কাব্যের এমন কান্ডে অবাক হয়ে যায়।
আমি তো মেয়েটাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম আর এদিকে আমাকেই ফেলে দিল এই ছেলেটা। ছেলেটার আম্মু কাব্যের মায়ের ফ্রেন্ড। সেই সুবাধে বিয়েতে আসা। ছেলেটা পড়ে যাওয়া থেকে উঠে গা ঝাড়া দেয়।
চারুর পা টা মচকে যাওয়ায় সে পায়ে ব্যাথা অনুভব করতে থাকে। কাব্য চারুকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। শাড়িটা পা থেকে একটু উপরে উঠাতেই চারু খপ করে কাব্যের হাতটা ধরে নেয় ।
কাব্য চারুর অসহায় চাহনি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। আলতো করে পা টা ধরে একটু জোরে টান দিতেই চারুর মচকে যাওয়া পায়ের ব্যাথা কমে যায়। কাব্য চারুর দিকে তাকিয়ে একটা হাঁসি দিয়ে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
কাব্যের চারুর প্রতি ছোট ছোট খেয়াল গুলো মনে এক বিশাল জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। এতোকিছুর মাঝে চারু সেই অচেনা ব্যাক্তি অর্থাৎ তার শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা সে ভুলেও গেল ।
অবশেষে সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত এসেই গেল । চারু ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘড়ির কাঁটায় অনেক বেজে গেছে। বিয়ের দিনে সে এতো বেলা ঘুমালো কি করে ।আর কেউ তাকে ডাক পর্যন্ত দেয়নি ।
চারু তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। সকালের নাস্তা শেষ করে সে তার বিছানায় মন খারাপ করে বসে আছে।সবাই পার্লারে চলে গেছে। শুধু সে বাদে। সবাই তাকে রেখে চলে গেল কিভাবে।আর সবাই গেলেও তোহা আপু ও তাকে রেখে চলে গেল।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ই হঠাৎ চারুর কানে তোহার কথা ভেসে আসে তার কানে। চারু শোয়া থেকে উঠে বসে আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠে,
~ আপু তুমি পার্লারে যাও নি ?
~ না যাইনি ।তোকে রেখে যাই কিভাবে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলি তাই ভাবলাম তোকে ডেকে তোর ঘুম নষ্ট না করি । তারাতাড়ি রেডি হয়ে নে পার্লারে যাবো ।
চারু খুশিতে আর কোনো প্রশ্ন না করে রেডি হয়ে নেয়। কাব্য চারু এবং তোহাকে নিয়ে গাড়িতে করে পার্লারের উদ্দেশ্য রওনা দেয়।

কয়েক ঘন্টা পর চারু এবং তোহা দুজনেই পার্লার থেকে বেরিয়ে পড়ে। কাব্য ওদের জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছিল । ওরা দুজনে গাড়ির পিছনে সিটে গিয়ে বসে পড়ে।
কাব্য আপন মনে গাড়ি ড্রাইভিং করছে। চারু ফোনটা হাতে নিতেই তার ফোন স্কিনে তার শুভাকাঙ্ক্ষীর মেসেজ ভেসে ওঠে,,
আজ লেহেঙ্গা পরিধানে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। মায়াবতীর থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া কষ্টসাধ্য ।
~ ওহে চারুলতা তোমার অপরুপ চাহনীর প্রেমে আবার ও পড়তে বাধ্য হলাম । তোমার ওই চাহনী বার বার আমাকে কাছে টানে । আমি বার বার তোমার প্রেমে পড়তে চাই। ভুল করে হলেও তোমার প্রেমে পড়তে চাই।
0 Comments