Ad Code

চারুলতা পর্ব - ৮

 লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত

চারু লতা গাড়িতে বসে গাড়ির গ্লাস টা নামিয়ে যতদূর চোখ যায় কাউকে খোঁজার চেষ্টা করলো। ছেলেটা যে কাব্য নয় চারু সেটা নিশ্চিত।কারন এই সময় কাব্য গাড়ি ড্রাইভিং এ ব্যস্ত।
চারুকে এদিক সেদিক খুঁজতে দেখেই তোহা বলে উঠে,,
~ কি হয়েছে।এমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে কি খুঁজছিস। তোহার কথায় কাব্যের কোনো ভ্রূক্ষেপ হয় না ও আপন মনে গাড়ি ড্রাইভিং এ ব্যস্ত।
~ কিছু না বলেই চারু আবার গাড়ির গ্লাস টা লাগিয়ে দেয়‌। গাড়িতে বসে চারু সারাক্ষণ তার শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা ভাবতে থাকে।
~ কে হতে পারে এই ছেলেটা। যে সব সময় আমার উপর নজর রাখছে। এই বাসায় কাব্য ছাড়া আর কোনো ছেলেও নেই । তাহলে বাহিরের কেউ। কে হতে পারে ছেলেটা। এসব চিন্তা সারাক্ষণ চারুর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
অবশেষে তারা বাসায় পৌঁছে যায়। চারু গাড়ি থেকে নেমে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। চারু ঘরের ভেতরে বসে আছে ঝিম মেরে।
তার মাথায় সারাক্ষণ তার কথায় ভাবছে কে সে। কেনই বা আর অগোচরে রয়েছে। কখনো কি তার দেখা হবে।
দেখতে দেখতে মেয়েকে ছাদনা তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। চারু মাথায় থেকে সব চিন্তা ভাবনা ঝেড়ে ফেলেছে। যার আসার কথা সে এমনি আসবে ।
এর মাঝে চারুর সাথে কাব্যের কয়েকবার দেখা হয়েছে । কিন্তু চোখাচোখি হতেই চারু চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। চারু সবার সাথে মিলে আনন্দে করতে ব্যস্ত।
কিন্তু সে ভুলেই যায় বিয়েতে আসা ছেলেগুলো তার দিকে কোন নজরে তাকাচ্ছে। হঠাৎ ই চারু হাত ধরে কেউ নিয়ে নিয়ে যেতেই চারুর হুশ ফিরে আসে।
কাব্য টানতে টানতে চারুকে তার ঘরে নিয়ে যায়। কাব্য অনেক রাগান্বিত হয়েই চারুর হাত শক্ত করে ধরেছে। চারুলতার চুড়িসহ হাত শক্ত করে ধরতেই চারুর হাতে ব্যাথা অনুভূত হয়।
কাব্য চারুর কোনো কথা না শুনেই তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় । তার ঘরে প্রবেশ করেই চারু কে বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে দেয়। দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে রক্তিম চোখে চারুলতার দিকে তাকিয়ে থাকে।
চারু এখনো বুঝতে পারছে না কাব্যের এমন আচরণের কারন। কেনই বা সে তার উপর এতোটা রেগে আছে। তার ভুলটাই বা কি । সে তো সবার সাথে বিয়েতে আনন্দ করছিল ।
চারুর ভাবনার মাঝেই কাব্য চারুর হাত ধরে তাকে শোয়া থেকে তুলে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ততক্ষনে চারু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কাব্যের দিকে।
কাব্য ঘৃনাভরা দৃষ্টি নিয়ে চারুর দুই গাল চেপে ধরে রাগী কন্ঠে বলে উঠে,,
~ মানুষ কে নিজের শরীর দেখানোর জন্য কাপড় পড়িস। যদি শরীরে দেখানোর ইচ্ছেই থাকে তাহলে বাসায় থাকিস কেন ওইসব নিষিদ্ধ স্থানে থাকলেই তো পারিস।
কাব্যের কথাটা কানে আসতেই চারুর চোখ দিয়ে পানি টপটপ করে পড়তে থাকে। কাব্যের কথা গুলো তার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলছে।
কাব্য তার সম্পর্কে এমন বাজে মন্তব্য করবে সে কখনো ভাবেনি। তার‌ হৃদয় চিরে র-ক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। হৃদয়ের ব্যাথা গুলো সে কাউকে দেখাতে পারছে না। ভেতরে ভেতরে সে পুড়ে মরছে।
চারু ঘৃনা ভরা দৃষ্টিতে কাব্যের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠে,,
~ ছাড়ুন আমাকে। আপনি এতোটা নোংরা চিন্তা ভাবনা কিভাবে করতে পারেন।‌
চারুর কন্ঠ কানে আসতেই কাব্য চারুকে নিজের সাথে চেপে ধরে রাগী কন্ঠে আবার ও বলে উঠে,,
~ তাহলে তোর পেট দেখা যাচ্ছে কেন। সবাইকে কি নিজের শরীর দেখিয়ে বেড়াতে চাইছিস । ৫ মিনিটের মধ্যে তুই ড্রেস চেঞ্জ করে আসবি । আমি দরজার বাহিরে অপেক্ষা করছি বলেই চারুকে বিছানায় আবার ছুঁড়ে ফেলে চলে যায়।
চারু নিজের শরীরে দিকে তাকিয়ে দেখে লেহেঙ্গার উড়না টা তার পেটের উপর থেকে একটু সরে গিয়েছিল । চারু বিছানায় ওভাবেই শুয়ে থেকে চোখের পানি ঝরছে।
আমি কি ইচ্ছে করে করেছি নাকি। অজান্তেই কাপড় সরে গিয়েছিল কাব্য ভাইয়া সেইটা ভালোভাবে বললেই পারতো । কাব্য ভাইয়া ও খুব কষ্ট দেয়।
এ পৃথিবীতে মা বাবা ছাড়া কেউ হয়তো ভালোবাসে না । সে তো কখনো কারো ভালোবাসা পায়নি । সবাই শুধু তাকে অবহেলাই করে ।চারু কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে কান্না করছে অবিরাম।
চোখের কোণে জমে থাকা কষ্ট গুলো মুক্তি পেলেও তার মনের কোণে জমে থাকা কষ্ট গুলো তাকে গভীর ভাবে আহত করছে। হঠাৎ ই কাব্যের কন্ঠ ভেসে আসতেই চারু কেঁপে উঠে।
~ তোর কি চেন্জ করা হয়েছে। কি করছিস তুই ভেতরে। কাব্যের কথায় চারু বিছানা ছেড়ে উঠে কাব্যের মুখের সামনে ঠাস করে দরজা টা লাগিয়ে দেয়।
~ আমি যাবো না কোথাও। আমাকে ঘরের ভেতরে থেকে বের করার চেষ্টা ও করবেন না । আপনি এখানে থেকে চলে যান ।আমি ঘরেই থাকতে পারবো ।
চারুর কথা কানে ভেসে আসতেই কাব্য রাগি কন্ঠে বলে উঠে,,
~ দেখ ভালো ভাবে বলছি ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে আয়। যদি আবার ও এই কথা বলতে হয় তাহলে তোর অবস্থা কি হবে ভেবে দেখেছিস।
~ যাবো না আমি । করবো না ড্রেস চেঞ্জ। কি করবেন আপনি ।
~দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকব ।তুই তো খুব ভালো করেই আমাকে চিনিস।
দরজার ওপাশে থেকে কাব্যের এমন জবাবে চমকে যায় চারু লতা। কাব্য ভাইয়া সত্যি এমন টা করবে না তো।
~ না না ।আপনার আসতে হবে না ।আমি ড্রেস চেঞ্জ করছি । অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চারু লেহেঙ্গা টা চেঞ্জ করে একটা থ্রি-পিস পড়ে নেয়।
থ্রি -পিস পরে চারুলতা ঘরের দরজা খুলতেই কাব্য তাকিয়ে দেখে চারু লতা একটা থ্রি পিস পড়েছে। সাধারণ সাজেও তাকে অসাধারণ লাগছে। লেহেঙ্গা পড়ে চারুর সৌন্দর্য উপভোগ করেছিল কাব্য কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ তার হজম হয় নি ।
কাব্য লক্ষ্য করলো চারুলতার মুখে হাঁসি নেই । বিয়ের এমন একটা দিনে সে না সেজে এমন অবস্থায় থাকবে তা ভাবতেই রাগ হচ্ছে কাব্যের উপর। লোকটা কখনো তার সুখ সহ্য করতে পারে না।
~ আমাকে মনে মনে গালি দিচ্ছিস নাকি। কাব্যের এমন কথায় ষোড়শী কন্যা কেঁপে উঠে।
~ না তো আমি কিছু বলিনি । বদের হাড্ডি,লোকটা আবার মনের কথাও বুঝতে পারে । মনে মনে চারুলতা কাব্যের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলে।
অনেক কান্নাকাটি করেছিস এখন ফ্রেশ হয়ে চোখের পানি সব মুছে আয়। চারু কাব্যের কথামত চোখের পানি মুছে চোখ মুখ পরিষ্কার করে আসে। কাব্য চারুকে সাথে করে বাহিরে নিয়ে আসে স্টেজ পর্যন্ত রেখে আবার নিজের কাজে চলে যায়।
তোহা চারু কে তার এই ড্রেসে কিছুটা অবাক হয়ে যায়। এর আবার কি হলো বিয়ে শেষ না হতেই ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলেছে। তোহা ভ্রু কুঁচকে চারু কে জিজ্ঞেস করতেই , কি ব্যাপার তুই ড্রেস চেঞ্জ করেছিস কেন ?
~ ড্রেসটা পরে খুব অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল তাই ভাবলাম ড্রেস টা চেঞ্জ করি ।
চারুকে জোরপূর্বক হাঁসি দিয়ে কথাটা বলতেই তোহা বলে উঠে,,
~ ঠিক আছে সব বুঝলাম কিন্তু তোর মুখটা ফ্যাকাসে লাগছে কেন।মুখে হাসির ছাপ নেই বিন্দুমাত্র। কোনো কারনে কি তোর মন খারাপ।
~ চারু তোহার কথাটা শোনামাত্র ই কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। না কিছু হয়নি - চারু জোরপূর্বক বলে উঠে।
~ ঠিক আছে আমার সাথে আয়। খাবার খাবো চল । বলেই তোহা চারুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়।
তোহা আপুও আমাকে বুঝতে পারলো কিন্তু ওই বদ লোকটাই শুধু আমাকে বোঝে না। তোর কপালে বউ জুটবে না। যদিও জুটে শাকচুন্নীর মতো বউ জুটবে। সেদিন বুঝতে পারবি আমাকে জ্বালানোর ফল । তোর জীবনটা সে ভাজা ভাজা করে খেয়ে ফেলবে।
দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে চারু দুনিয়ার সব বকা কাব্য কে দিতে থাকে।
~ কি হলো খাবার না খেয়ে এভাবে কি বিরবির করছিস - কেউ চারুর মাথায় টোকা দিয়ে কথাটা বলতেই চারু ফিরে তাকিয়ে দেখে তোহার ভাই তন্ময় কথাটা বলছে।
চারু তন্ময় কে দেখেই খুশি হয়ে আহ্লাদী সুরে বলে উঠে,,
~ভাইয়া তুমি কখন এসেছ। তুমি তো বললে না যে আসবে তুমি । হঠাৎ?
~ সারপ্রাইজ! হাসিমুখে তন্ময় চারুর উদ্দেশ্যে কথাটা বলে উঠে।‌
তন্ময় অনেক দিন পর এসেছে মামা বাড়িতে।‌ পড়াশোনার জন্য সে অন্য শহরে থাকা বলেই তার আসার সময় হয় না ।তবে আজ সে সবাইকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দিয়েছে।
সবাই তন্ময় কে দেখেই খুশি। তন্ময় কাব্য কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,,
~ একদম ভুলেই গেছো। কতদিন পর তোমার সাথে আমার দেখা । কাব্য ও তন্ময় এর সাথে কুশল বিনিময় করে।
তন্ময় সবার সাথে দেখা করে । সবার সাথে কুশল বিনিময় করে সে যায় চারুর কাছে। চারুকে সে ছোট বোনের চোখেই দেখে। সব সময় সে তাকে খুশি করার চেষ্টা করে।
সবকিছু সে তার মায়ের থেকেই শিখেছে। চারুকে কখনো যেন পরিবারের অভাব সে বুঝতে না পারে এই প্রচেষ্টায় তার খালামনির পরিবার।
~ চারু চোখ বন্ধ কর। তোর জন্য একটা ছোট্ট উপহার। চারু বাগানের পাশেই একটা বেঞ্চিতে বসে ছিল । তন্ময়ের কথা শুনে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
~ হাতটা পাত। চারু কাব্যের কথা মতো দু হাত পাতিয়ে সামনে রাখে তন্ময়ের।
কাব্য দূর থেকে সবটাই লক্ষ্য রাখছিল তন্ময় আর চারুর দুষ্টুমি । তার মুখে মৃদু হাঁসি। তন্ময় কতটা আগলে রেখেছে তার বোন কে। কত প্রচেষ্টা তাদের চারুকে খুশি রাখার।
এবার চোখ খোল। তন্ময়ের কথায় চারু চোখ খুলে তার হাতের মধ্যে আরশোলা দেখতে পেয়েই ভয় পেয়ে সেগুলো ছুড়ে ফেলে চিৎকার দিয়ে উঠে।
চারুর চিৎকার শুনে কাব্য বিচলিত পায়ে হেঁটে চারুর কাছে চলে আসে।
কাব্য তন্ময়ের দিকে জিজ্ঞেসের দৃষ্টিতে তাকায় । চারু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল । তবে তার চোখ মুখ চুপসে গেছে।
~ ভাইয়া ওকে আমি চকলেট দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও কেন যে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল তন্ময় কথাটা শেষ করতে পারলো না তার আগেই চারু বলে উঠে,,
~ একদম মিথ্যা কথা । তন্ময় ভাইয়া তো আমাকে আরশোলা দিয়েছিল । যেই জন্য আমি চিৎকার দিয়েছিলাম।‌
~ কাব্য শাসনের দৃষ্টিতে তন্ময়ের দিকে তাকাতেই তন্ময় মুখে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে প্যান্টের পকেটে থেকে হাত ভর্তি চকলেট বের করে বলে উঠে,,
~ দেখ বিশ্বাস না হলে । এগুলো আমি ওর জন্য ই নিয়ে এসেছিলাম। তন্ময় চারু কে চকলেট গুলো দিয়ে দেয়। কাব্যের কথামতো চারু নিজের ঘরে চলে যায় আর তন্ময় কাব্যের সাথে।
সবশেষে বিয়ে সম্পন্ন হয়। কনে বিদায় শেষে সবাই নিজেদের ঘরে চলে যায় ঘুমাতে অনেক রাত হয়েছে। চারু ব্যস্ততার মাঝে মেসেজ দেওয়া ব্যক্তির কথা ভুলেই যায়।
ও ফোনটা হাতে নিতেই দেখে কয়েক ঘন্টা আগের মেসেজ।
~ ওহে চারুলতা। তোমার সুশ্রী চেহারায় মলিনতার ছাপ। মুখটাও ফ্যাকাশে , তোমার ফিকে মুখটা আমার হৃদয়ে বিষন্নতা কে জাগিয়ে তুলছে।
রক্তিম ফুলের ন্যায় তোমার সব বিষন্নতা গুলো ঝড়ে যাক অক্টোবরের শীতের উষ্ণতায়!
মেসেজ টা দেখেই চারুর মুখে হাঁসি ফুটে ওঠে।‌সে যেন তার ই অপেক্ষা করেছিল । চারু ভাবনার মাঝেই ফোন স্ক্রিনে আবার মেসেজ ভেসে ওঠে,,
~ অপরুপা তোমার মায়াবী মুখখানির দর্শন করতে খুব ইচ্ছে জাগছে। মিলবে কি তোমার অপরুপার দর্শন।
বেলকোনিতে চলে এসে ।তোমার জন্য অপেক্ষায় এক ক্লান্ত পথিক। মেসেজ টা দেখতেই চারু বেলকনিতে দ্রুত পায়ে চলে যায়। কিন্তু আশেপাশে কাউকেই সে দেখতে পায় না ।
তার ফোনে আবার ও মেসেজ ভেসে আসে, আমি ধন্য তোমার ওই মুখখানির দর্শন পেয়ে...!


Post a Comment

0 Comments

Close Menu