লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


অবশেষে প্রতীক্ষার অমল ধূসর প্রহর শেষ হলো। মিলির বিবাহের শুভক্ষণ আজ। যেই মেয়ে এতকাল হাসিমুখে দিন কাটিয়েছে, আজ কেন যেন তার অন্তর যেন কোনো অজানা বেদনায় ফুঁপিয়ে উঠছে। তাকে প্রিয়তম জননী, পিতৃ, স্নেহের ভ্রাতা, আর দুই প্রাণসখাকে পিছনে ফেলে অনন্ত অচেনা পথের দিকে যাত্রা করতে হবে! মিলির মন যেন এই নির্মম সত্য মেনে নিতে পারছে না।
জবেদা বেগম, মিলির জননী, গৃহকর্মে নিজেকে নিমগ্ন রাখলেও চোখের কোণে লুকানো অশ্রুবিন্দু প্রবাহিত হচ্ছে। তার স্নেহের কন্যাটি আর এই প্রাঙ্গণে উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে রাখবে না! মায়ের কাছে খাবারের জন্য আবদার করবে না! তার ছোট ছোট অযাচিত বায়না আর শুনতে হবে না! হৃদয়ের গহীনে যেন ক্রমশ র'ক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে।
পিতা হাবিবুর রহমানের চোখেও র'ক্তিম আভা, অথচ দেহ-মনে কঠোর অবিচলতায় সকল কিছু ঠিকঠাক আছে কি না সেই নিশ্চিতকরণে ব্যস্ত রয়েছেন। সবার সাথে এক রকমের উদাসীন হাসিমুখে আলাপচারিতায় লিপ্ত রয়েছেন। কিন্তু এই সামান্য মুখচ্ছবির পেছনে তার অন্তরজগতে যে তীব্র হাহাকার উঠেছে, তা কারো কাছে ধরা পড়ে না! পিতৃদের ভালোবাসা প্রকাশিত হয় না, তার অস্তিত্ব থাকে গূঢ় গভীরতার অন্তরে। আজ তার হৃদয়ের রাজকন্যা বিদায় নেবে, সেই অনিবার্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও হাবিবুর রহমানের মুখে বজ্রকঠিন হাসির আভাস, কিন্তু হৃদয় তার র'ক্তা'ক্ত!
মিলিকে ধীরে ধীরে সাজানো হচ্ছে বধূরূপে। পার্লারের মেয়েরা এসে তন্ময় হয়ে তার সাজসজ্জায় ব্যস্ত। মোটা স্বাস্থ্যের অধিকারিণী মিলির গায়ে লাল শাড়ি, ফাহাদের পছন্দ করা শাড়ি! কাঁচা পলাশের মতো দ্যুতি তার শরীরে, কিন্তু মনের গহীনে জমাট বাঁধা কষ্ট। সকলের চোখ এখন মিলির ওপর নিবদ্ধ, কী অপূর্ব সুন্দরী লাগছে তাকে! অথচ চোখের কোণে জমে থাকা জলের কারণে কাজলটুকু ঠিক করে লাগাতে পারছে না পার্লারের মেয়েটি। মিষ্টিমধুর কণ্ঠে সে বলল,
——— "আপু, আর কেঁদো না, প্লিজ।"
কিন্তু মিলির গলা যেন বাষ্পে আটকে গেছে! চোখের জল কি এভাবে থামানো যায়? কথায় কি বাঁধ মানে বুকের আকুলতা?
এদিকে বিয়েবাড়ি উৎসবের সাজে জাকজমকপূর্ণ। কারো মুখে হাসি, কারো মুখে শ্লেষ— সকলেই এসেছে, উৎসবমুখর পরিবেশ। কোলাহলে ঘেরা প্রাঙ্গণ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। হৈ-হুল্লোড়, হাসি-তামাশার মধ্যে কেউ নেই যে ক্লান্ত। কিন্তু শান্ত? চোখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার মা তাকে ধরে বেধে তাকে নিয়ে এসেছে, আর না এসে উপায়ও ছিল না। চেয়ারম্যানের ছেলে হিসেবে বিয়েতে না এলে কতটা মানসম্মানের প্রশ্ন উঠত!
আরাফ? তার চোখ শুধু খুঁজছে তার প্রিয়তমাকে! কোথায় সে? আছিয়া সাজগোজও করেনি ঠিকভাবে, শুধু একখানি লেহেঙ্গা পরে বসে আছে মিলির সামনে । তার মুখে-মনে যেন এক মোচড়ের ছাপ। বিয়েতে এসে জমকালো পোশাকে নিজেকে মেলে ধরবে ভেবেছিল, কিন্তু কেন যেন অন্তরটা ভারী হয়ে আছে আজ।
পূর্বিকা আজ মেরুন শাড়িতে দ্যুতিময়, যা আফ্রিদি তার জন্য এনেছিল। যদিও আজ তার সাথে বেশ রাগারাগি হয়েছে, কথা বন্ধ হয়ে আছে দু’জনের মধ্যে, তাই হয়তো আফ্রিদির দেওয়া শাড়িটাই পরে এসেছে— নিঃশব্দ অভিমান!
এদিকে রোহান, নাঈম, মিনহাজ ব্যস্ত। তারা মিলে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে, সবার হাতে হাতে সাহায্য করে যাচ্ছে। বিয়ের এই উত্তাল আয়োজনের মাঝেও তাদের চোখে অদ্ভুত এক উচ্ছ্বাস— হয়তো মিলির জন্য, হয়তো নিজেদের মধ্যে এই মুহূর্তগুলো ভাগ করে নেওয়ার জন্য।
মিলির ছোট ভাই শুভ বারংবার দরজার কোণে উঁকি দিচ্ছে, তার চঞ্চল দৃষ্টি বোনের দিকে নিবদ্ধ। সারাটা দিন যে বোনকে খেপাতো, ছোট ছোট খুনসুটিতে লিপ্ত থাকতো, খাবার কেড়ে নিয়ে খেত— সেই বোন কি আজ সত্যিই তাকে ছেড়ে যাবে? মোটা বলে কাকে খেপাবে সে? মিলির চোখ পড়ল তার ভাইয়ের দিকে, যেন শেষবারের মতো প্রাণভরে ভাইটিকে দেখছে। স্নেহের নিঃশ্বাসে ডাক দিলো,
——— "এদিকে আয়!"
শুভ ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলো বোনের কাছে। মিলি তাকে দেখল যেন একান্ত আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে ভাইয়ের ছোট্ট হৃদয়টাকে। একসময় কতটা জ্বালাতন করেছে এই ভাইটাকে! তবু আজ সে নীরব, অনুভূতিহীন।
——— "এখন আর তোকে ভালোবাসায় ভাগ দিতে হবে না, সব একাই খাবি!"
মিলির কণ্ঠে স্নেহভরা মর্মার্থ। শুভ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে একরকম রাগে বলল,
——— "তুই তাড়াতাড়ি চলে যা ভুটকি! তুই গেলেই আমার শান্তি হবে!"
মিলি হেসে জবাব দিলো,
——— "হ্যাঁ যাবো তো! তখন বুঝবি এই ভুটকি বোন কী ছিল!"
কিন্তু ছোট্ট শুভর হৃদয় যেন চূর্ণ হয়ে গেল, এত আয়োজন, এত আয়োজনের উদ্দেশ্য কি সত্যিই তার বোনের বিদায়? এই কি সত্যিই তার শেষ দেখা? কষ্টে হাহাকার করে সে হঠাৎ কেঁদে উঠল, বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
——— "আপা, তুই আমাকে ছেড়ে যাস না! তুই যা বলবি আমি তাই করব, আপা! আর দুষ্টামি করব না, তোর খাবার কেড়ে নেব না! আমার সব খাবার তোকে দেব, তুই যাস না!"
শুভর আকুতি যেন মিলির হৃদয়ের প্রতিটি শিরায় শিরায় বয়ে গেল। নিজেকে সামলাতে না পেরে মিলি শব্দ করে কেঁদে উঠল, ভাইয়ের কপালে এক চুম্বন দিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
——— "কে বলেছে আমি চলে যাচ্ছি? আমার হাত থেকে তোর মুক্তি নেই! আমি তো আসবই! খাবার তুই না দিলেও, আমি কেড়ে নেব!"
দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু নিরব চোখে দেখছেন জবেদা বেগম, চোখের জল মুখের আঁচলে লুকিয়ে রাখছেন। কেমন যেন শরীরটা আর সহ্য করতে পারছে না, মাথাটা বেশ ঘুরছে। মেয়ের মুখটি দেখে বুকে এক অজানা শূন্যতার আঘাত!
___
পূর্বিকা অবশেষে দেখা পেলো তার শ্যামপুরুষ আফ্রিদির, কিন্তু কী অদ্ভুত দৃশ্য! তার প্রিয়তমের এই বেদনাহত চেহারা, এতটা ক্লান্ত, যেন দুঃখ আর হতাশা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। কেন এমন দেখাচ্ছে তাকে? চোখের গভীরে যেন এক সাগর বিষাদের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। পূর্বিকার মনে প্রশ্নের ঝড় উঠল— কি এমন ঘটেছে যা তার আফ্রিদির বুকের ভেতরে এত ব্যথার সঞ্চার করেছে? সে পেছন থেকে আহ্বান জানাল, চিরচেনা কণ্ঠে,
——— "আফ্রিদি?"
সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর, যা একসময় হৃদয়কে প্রশান্তি দিত, তা-ও আজ তার প্রিয়তমকে থামাতে পারল না। আফ্রিদি পেছন ফিরে তাকালো না, উত্তর দিলো না— সে নিঃশব্দে হনহনিয়ে চলে যেতে লাগল, যেন হৃদয়ের সমস্ত কষ্ট থেকে পালাচ্ছে।
পূর্বিকার চোখে তখন ধরা পড়লো তার নিজের পরিধানে থাকা সেই মেরুন শাড়ি— যার প্রতিটি ভাঁজে ছিল আফ্রিদির স্নেহ, তার ভালোবাসার স্পর্শ। অথচ সে দেখল না, একবারও না। তার বুকের ভেতর যেন ক্ষ'তবি'ক্ষ'ত আগুন জ্বলছে। আফ্রিদি ভুলতে পারছে না সেই অপরাধ— পূর্বিকা কথা দিয়েও কথা রাখেনি। বিশ্বাসের সেই সুতো যেন ছিঁড়ে গেছে।
আফ্রিদি আজ এখানে এসেছে মায়ের সঙ্গে, বাবার অনুরোধেই তাকে আসতে হয়েছে। সে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এমন আঘাতের পর আর কখনো এখানে আসবে না। তবু, সেই প্রতিশ্রুতি আর আঘাতের ভার তার হৃদয়ে যেন আরো গভীর ক্ষত রেখে গেছে।
পূর্বিকা হাল ছাড়ল না; আবারও পিছু নিলো। ব্যাকুল কণ্ঠে ডাক দিলো,
——— "কী হয়েছে তোমার? কেন তুমি কথা বলছো না? আমাকে বলো, কী হয়েছে?"
আফ্রিদির গতি থেমে গেল। ধীরে ফিরে তাকালো পূর্বিকার দিকে—অবাক! তার প্রিয় পূর্বি আজ পরেছে সেই অতি সাধারণ শাড়িটি, যেটি সে কিনে দিয়েছিল। কিন্তু এ বিস্ময়ের মাঝেও তার ভেতরে জ্বলছে রাগের অগ্নি, গোপনে তীব্র শিখায় দগ্ধ হচ্ছে সে। কিসের এমন ব্যর্থতা? কেন তার প্রেয়সী কথা রাখল না? আফ্রিদির চোখের আগুন এবার তীব্রতর হলো, দাত কটমটিয়ে ফিসফিস করে বলল,
——— "আমার পিছু নিবি না! তোকে আমি ঘৃণা করি! বুঝেছিস?"
শব্দগুলো যেন বিদ্যুৎসম হয়ে আঘাত করল পূর্বিকার হৃদয়ে, যেন সমস্ত অন্তরাত্মা শীতল ব্যথায় জমে গেল। সেই প্রিয়তম পুরুষ, যাকে সে ভালোবেসেছে গভীর আত্মনিবেদন দিয়ে—সেই পুরুষ আজ এমন কঠিন কথা উচ্চারণ করল? তারই প্রিয়তম তাকে ঘৃণা করে? পূর্বিকার দৃষ্টির আড়ালে নেমে এলো অশ্রুবিন্দু, কিন্তু সে পিছু হটল না।
শান্ত অনেকক্ষণ ধরে এই দৃশ্য নিরাবেগে পর্যবেক্ষণ করছিল। অবশেষে, চোয়াল শক্ত করে, এগিয়ে গেল দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে। পূর্বিকার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
——— "পূরু, এখান থেকে চলে যা!"
——— "কিন্তু..."
——— "এই মুহূর্তে চলে যা, নয়তো সবার সামনে চ'ড় খেয়ে লজ্জায় পড়তে হবে!"
পূর্বিকার চোখ ভিজে গেল, কিন্তু সে কিছু বলল না। মাথা নিচু করে, চোখের জল সংবরণ করে চলে গেলো সে। পূর্বিকার চলে যাওয়া দেখে শান্তর রক্তে ঘৃণা আর রাগ মিশে গেলো। সে এক প্রচণ্ড টানে আফ্রিদির কলার চেপে ধরল। তার চোখে অগ্নি ঝলকাচ্ছে, কণ্ঠে বিদ্বেষের ছাপ, বলল,
——— "ছোটলোক, ছোটলোকের মতো থাক! তোর সাহস কী করে হয় আমার বোনকে নিয়ে ফুর্তি করার কথা ভাবার ? কী যোগ্যতা আছে তোর? ছেড়া কাঁথায় শুয়ে স্বপ্ন দেখিস রাজকন্যার! আমার বোনের আশা ছেড়ে দে, নয়তো কীভাবে তোকে লাইনে আনতে হবে, তা আমি ভালো করেই জানি!
এক প্রচণ্ড ধাক্কায় ছেড়ে দিলো আফ্রিদির কলার, যেন তার সাথে বয়ে নিয়ে গেলো সমস্ত গৌরবহানি। আফ্রিদি নিঃশব্দে রাগে কম্পিত, তার দেহে প্রতিটি শিরা যেন প্রতিবাদে উত্তাল। চারপাশের প্রত্যেকটি চোখ তার দিকে নিবদ্ধ, সবার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, যেন প্রতিটি চাহনি তার গর্বের বুক চিরে ছুরির মতো বিদ্ধ করছে। অন্তরে এক অদৃশ্য আঘাত, রক্তবিন্দু ফুটে উঠছে আত্মসম্মানের ক্ষতবিক্ষত কণ্ঠ থেকে। হঠাৎই, একটি বিদ্রূপময় হাসির ঝঙ্কার ছড়িয়ে পড়ল তার ঠোঁটের কোণে।
শান্ত কি মিথ্যা বলেছে? সত্যিই কি সে যোগ্য? সে তো এক বেকার, এক অযোগ্য! হ্যাঁ, ছোটলোকই তো! বামুন হয়ে চাঁদ ধরতে গিয়েছিল সে—এক অসম্ভব, অবাস্তব প্রয়াস! আফ্রিদির অক্ষিকোটরে বেদনাবর্ষিত অশ্রু জমেছিল, যা দ্রুত মুছে ফেলল। আর এক মুহূর্তের জন্যও না দাঁড়িয়ে, বুকের ভেতরে রাগ আর হতাশার দহন নিয়ে, বিয়ে বাড়ির ভিড় থেকে নীরব পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলো আফ্রিদি, যেন নিজের স্বপ্নকে ভস্ম করে আগুনে ছাই ফেলে চলে যাচ্ছে এক শূন্যতায়।
পূর্বিকা সব দেখেছে, সমস্ত অপমান সহ্য করেছে নিঃশব্দে। কিন্তু এবার আর থেমে থাকল না। শান্তর সামনে এসে দাঁড়াল, চোখে কেঁদে ভেজা জলরেখা স্পষ্ট, এবং তীব্র রাগের সাথে উচ্চারণ করল,
——— "তোর সাহস কী করে হলো ওর সাথে এভাবে কথা বলার?"
শান্তর চোখ র'ক্তবর্ণ ধারণ করল, ভ্রু কুঁচকে যেন সে আগ্নেয়গিরির আগুন নিঃসৃত করছে। গর্জে উঠল,
——— "দাঁত চিরে ফেলব! ওই ছোটলোকের সাথে যেন তোকে আর কখনও দেখি না!"
পূর্বিকার র'ক্ত তপ্ত হলো, এবার সে তীব্র প্রতিজ্ঞায় ভরিয়ে দিলো গলা, অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
——— "আমি ওকে ভালোবাসি, বুঝেছিস তুই?"
শান্তর মাথার ভেতর যেন টগবগ করে উঠল ক্রো'ধ। ভরা জনতার থেকে দূরে শক্ত হাতে হিংস্র হয়ে টেনে হিচরে সাইডে এনে পূর্বিকার গালে কষিয়ে মারলো চর! পূর্বিকার হাত শক্ত করে ধরে শান্ত গর্জন করল,
——— "ভালোবাসা! ভালোবাসা বলতে কিছু নেই দুনিয়ায়! সব মায়া, সব মোহ, নাটক! লালসা আর শরীরের খেলা! আমি চাই না কেউ আমার বোনের দিকে লালসার নজরে তাকাক! ওর নাম যেন আর তোর মুখে না শুনি, নয়ত তোর জিভ কেটে ফেলব!"
পূর্বিকা ক্রো'ধে কাঁপতে লাগল, চোখে আগুনের ঝলকানি আর ব্যথার অশ্রু একসাথে ঝরতে লাগল। দাঁত চেপে রাগমাখা কণ্ঠে বলল,
——— "অন্যের মেয়েকে যখন ছুঁতে যাস, তখন মনে থাকে না যে সেও কারো বোন? নিজের বোনের বেলায় এত দরদ দেখাস কেন? আফ্রিদি তোর মতো নয়, সে মেয়েদের লালসার চোখে দেখে না! সে ভালোবাসতে জানে, বুঝেছিস তুই? আমি মরে গেলেও ওকে ছাড়ব না!"
পূর্বিকার প্রতিজ্ঞায় যেন ভেসে গেল চারপাশ। সে পা বাড়াল যাওয়ার জন্য, কিন্তু যাওয়ার আগে তীব্র ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
——— "তুই ভাই হওয়ার কোনো যোগ্যতা রাখিস না! আমার লজ্জা লাগে তোকে ভাই বলে পরিচয় দিতে! আমি ঘৃণা করি তোকে!"
শান্ত তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ল, চোয়াল শক্ত করে রক্তচক্ষু করে গর্জে উঠে বলল,
——— "একজন ভাইয়ের যা করা উচিত ছিল, আমি তাই করেছি। দরকার পরলে খু'ন করতেও আমি দুবার ভাববো না!
___________
আরাফ নিরন্তর খুঁজে চলেছে আঁখিকে, যেন প্রতিটি কোণেই তার প্রিয়তমার স্পর্শ রয়েছে, অথচ তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে, কি এক অজানা বোধের টানে বাড়ির পেছনের নির্জন প্রান্তে এসে উপস্থিত হলো সে। সেখানে, গভীর বিষাদের মধ্যে নিমজ্জিত আঁখি নিঃশব্দে বসে আছে। তাকে দেখে আরাফের হৃদয়ে একপ্রকার প্রশান্তি নেমে এলো, মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। পায়ের গতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ত্বরান্বিত হয়ে গেল, তবে সেও শালীন দূরত্ব রেখে ঘাসের উপর বসে পড়ল, যেন তার নৈঃশব্দ্যের মাঝে শরিক হতে চায়।
চোখ ফেরাতেই দেখল, পরনের লেহেঙ্গা কোনো সাজসজ্জার আভিজাত্য নেই আঁখির মুখে, তবু এই নিস্পৃহ, সাধারণ শ্যামকন্যাকে আজ যেন আকাশের সমস্ত রঙ একত্রে মিশে তার রূপকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু সেই চোখের জল—আহা! আরাফের মনে আর্তনাদ উঠল, সে জানে এই অশ্রুপ্রবাহ প্রিয় বান্ধবী মিলির চলে যাওয়ার শোকে। তার সহ্যের সীমা যেন ইতিমধ্যে লঙ্ঘিত হয়েছে। সেই গভীর বেদনা সহ্য করতে না পেরে গলা খাকারি দিয়ে বলল,
——— "একদিন তো সবাইকেই বাবার ঘর ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির অচেনা পথে যাত্রা করতে হয়। কান্না করো না আঁখি, মিলি তো আসবেই দেখা করতে!"
তার কণ্ঠে ছিল নীরব সমবেদনা, যা হয়তো আঁখির শোককে দূর করতে পারে না, কিন্তু আরাফের উপস্থিতি যেন তার বেদনাকে খানিকটা হলেও ভাগ করে নিল।
আঁখির মন কোনো কথোপকথনের জন্য প্রস্তুত নয়। এ মুহূর্তে, সে শুধু নিঃসঙ্গতা চায়, নিজের বিষাদে নিমজ্জিত থাকতে চায়। সে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, পা বাড়িয়ে নির্লিপ্তভাবে চলে যেতে উদ্যত হলো। আরাফের অন্তরে তখন এক ভীষণ আকুতি। কণ্ঠে একরাশ কাতরতা নিয়ে ডাক দিলো,
——— "কিছু কথা আছে, শুনবে কি?"
আঁখি থমকে দাঁড়ালো। চোখের কোণে অশ্রু জমে আছে, তবু সে সরে না গিয়ে আরাফের দিকে ফিরে তাকাল, কষ্ট জড়ানো কণ্ঠে বলল,
——— "কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার। আমাকে একটু একা থাকতে দিন, প্লিজ।"
আঁখির বিদ্রোহী নিঃশব্দতা যেন আরাফের বুকে তীক্ষ্ণ শূল বিঁধিয়ে গেল। তবু, সে পিছু হটে না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, আঁখির পেছনে এসে গভীর গলায় বলল,
——— "খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা, আঁখি। শুনতেই হবে!"
তার কণ্ঠের গাম্ভীর্য আঁখিকে স্থির করে দিল। আঁখি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
——— "কি বলতে চান আপনি?"
আরাফ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
——— "একটা নাম ঠিক করো।"
আঁখি কিছুটা হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
——— "নাম? কিসের নাম?"
——— "এক মেয়ের নাম দিতে হবে, সেই নামটাই বেছে নাও তুমি।"
আঁখি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
——— "কোন মেয়ে, কিসের নাম?"
আরাফ একটু মুচকি হেসে, যেন কথার গভীরতা লুকানোর চেষ্টা করল,
——— " একটা বাচ্চা মেয়ে হয়েছে, তুমি কেবল নামটা নির্ধারণ করো, খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোমার দেয়া নাম ছাড়া চলবে না!"
——— " কার বাচ্চা হয়েছে?"
আরাফ এবার তীক্ষ্ণ হয়ে বলল,
——— "কোনো প্রশ্ন নয়, এমন একটি নাম দাও যার শুরু আর শেষ দুটোতেই 'আ' উচ্চারিত থাকবে। মাঝখানের বর্ণ যেকোনো হতে পারে, কিন্তু 'আ' যেন প্রথম ও শেষ সুরে বাজে!"
আঁখি চমকে বলল,
——— "এটা আবার কেমন অদ্ভুত শর্ত!"
——— "যা বলেছি, তা-ই করো! এমন একটি নাম চাই। অন্তত বাচ্চা মেয়েটার জন্য?"
আঁখি এবার একটু ভেবে থেমে গেল। এরপর গভীর ধ্যানে ডুবে থেকে বলল,
——— "আচ্ছা, আমি ভাবছি..."
বেশকিছু ক্ষন ভেবে নীরবতা ভেঙে কিছুক্ষণ পর আঁখি নাম বলল,
——— "আরিয়া!"
আরাফ এবার প্রশান্তির হাসি হেসে বলল,
——— "অনবদ্য! অনিন্দ্য সুন্দর!"
আঁখি এবার বিস্ময় কাটিয়ে বলল,
——— "এখন বলবেন, কার মেয়ের নাম রাখতে বললেন?"
আরাফ এবার নিজের সিল্কি চুলে ব্যাকব্রাশ করে দুষ্টু হেসে কোমল স্বরে বলল,
——— "তোমার আর আমার ভবিষ্যৎ মেয়ের জন্য! আমি তো মেয়েই চাই, ঠিক তোমার মতো কোমল, মিষ্টি। প্রথম 'আ' তোমার নামের প্রারম্ভিক সুর, শেষের 'আ' আমার নামের শুরু থেকে নেওয়া। বাস্তবের মতো আমাদের নামের ধ্বনিতেও সে থাকবে আমাদের মধ্যে। আর সেই মধুর বন্ধনেই তার নাম হবে 'আরিয়া'! আই লাভ দিস নেইম মেডাম…!"
আঁখি বিস্ময়ে স্তব্ধ, তার চোখ দুটো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আরাফের দিকে নিবদ্ধ। আর আরাফ? ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা, যেন সে এক অভিনব রসিকতার রূপকার। কিন্তু আঁখির অন্তরে ক্রোধের জোয়ার প্রবাহিত, তার মেজাজ তুঙ্গে উঠেছে—এ ব্যক্তি এত নির্লজ্জ কী করে! ছোট বোনের বান্ধুবির সঙ্গে এমন আচরণ! ক্রোধে দেহটা কম্পিত, কোমরে হাত রেখে দৃপ্তস্বরে বলল:
———" আপনিই,,,"
আরাফ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে মধ্যপথে কথা কেড়ে নিল:
——— "তোমার স্বামী!"
তত্ক্ষণাৎ আঁখির চোখ রক্তবর্ণ হলো ক্রোধে। কিন্তু আরাফের ঠোঁটে হাসি আরও প্রসারিত, যেন এই প্রমত্ত ক্রোধই তার প্রত্যাশিত ফল। আঁখি ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে চলে গেলো, যেন তার পায়ের ভারও পৃথিবীকে কম্পিত করে তুলেছে। আর আরাফ? সে এবার আরও উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তার হাসি যেন বয়ে আনে এক অন্তর্নিহিত নিস্তব্ধতা, যেখানে বয়ে চলে নিঃশব্দ দুষ্টুমি।
আরাফেরও বা কী দোষ? বিয়ে বাড়ির পরিবেশে তার চঞ্চল মনটাও একটু খেলা করতে চেয়েছিল! বয়স তো কম হলো না—জীবনের পঁচিশতম বর্ষ এসে উপস্থিত; কতদিন আর এভাবে একাকিত্বের নিঃসঙ্গতায় বাঁচা!
_______________
মুগ্ধর হাতের মুঠোয় ধরে থাকা ইয়ামাহা R15 V4 বাইকটির গতি যেন আকাশ-বাতাসকে চিরে ছুটছে, পথের ধুলো উড়িয়ে। বাইকের তীব্র গর্জনে চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে যাচ্ছে। মুগ্ধর কপালের ওপরে ছড়িয়ে থাকা সিল্কি চুলগুলো বাতাসের বেগে উড়ে এসে কপালে আছড়ে পড়ছে, যেন সেই বিক্ষুব্ধ বাতাস তার সাথেই ক্রুদ্ধ প্রতিযোগিতায় মেতেছে। ফর্সা মুখমণ্ডলে খোচা খোচা দাড়ির আভা, চোয়ালটি স্বভাবসুলভ কঠিন—এক অদম্য সংকল্পের প্রতীক। তার পেছনে বসা জীবন, একইরকম গম্ভীর মুখ নিয়ে, নিশ্চুপে এগিয়ে চলেছে।
কোনো এক জরুরি কাজে গিয়েছিল তারা। ফিরে আসছে আবার সেই বিয়ের বাড়ির পথে, কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ মুগ্ধ ব্রেক কষল। জীবনের কপালে ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের রেখা এঁকে,
——— "কি হলো স্যার?"
মুগ্ধ কোনো কথা না বলে বাইক থেকে অবতরণ করল, তার সাথে জীবনও ধীর পায়ে নেমে এল। আকাশ ঘন কালো, কিন্তু তার চেয়েও গাঢ় হয়ে মুগ্ধর চোখের মধ্যে জমে থাকা এক অজানা ক্রোধ। কালো শার্টের পেছনে গুজে গোপনে রাখা Smith & Wesson M&P Shield পিস্তলটি দক্ষ হাতে বের করল। হাতের আঙ্গুলে নিপুণ ঘূর্ণিতে পিস্তলটি ঘুরিয়ে নিল, ঠোঁটে তেমন কোনো স্পর্শকাতর ভাবের ছাপ নেই। গম্ভীর আর নিষ্ঠুর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
——— "কেন মিথ্যা বলেছো?"
জীবন অবাক দৃষ্টিতে তাকাল, চোখের ভাষায় হতবাক বিস্ময়,
——— "মিথ্যা স্যার? আমি কী মিথ্যা বলেছি?"
——— "তোমার মা হাসপাতালে শয্যাশায়ী। সেটা বলোনি কেন?"
জীবনের কণ্ঠ নতজানু, শ্রদ্ধার স্পর্শে ভিজে গেল,
———" আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন, তাই অনেক, শুধু শুধু এটা বলে আপনার চিন্তা বাড়াতে চাই নি।"
মুগ্ধের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, চোখে এক অশান্ত আ'গুন। পিস্ত'ল তুলে নিয়ে ঠেকাল জীবনের কপালের মাঝ বরাবর, সেই ধাতব শীতলতা যেন মুহূর্তে জমে থাকা ক্রোধ প্রকাশ করল। মুগ্ধর কণ্ঠে যেন বজ্রপাতের মতো রাগ ঝরে পড়ল:
——— "তুমি কি বোঝ, আমার কাছ থেকে এমন কিছু লুকালে এই বুলেট তোমার কপাল ভেদ করে মস্তিষ্কের পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাবে?"
জীবন হেসে ফেলল,
——— "আপনি ছোট ভাইকে মারতে পারবেন না,, এটা আমি জানি।"
মুগ্ধ চোখ বন্ধ করল, যেন তার ভিতরে এক অজানা যুদ্ধ চলছে। পি'স্তলটা দৃঢ় হাতে কোমরের পেছনে গুঁজে নিল, শক্তভাবে শার্ট দিয়ে ঢেকে ফেলল, যেন তার অস্তিত্বে কারও চোখ না পড়ে। তার ভঙ্গি বলছে, এই অস্ত্র শুধু তার নিয়ন্ত্রণেই থাকবে, পৃথিবী যেন সেটির উপস্থিতি ভুলে যায়। তারপর জীবনের কাঁধে হাত রেখে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
———" যখন তুমি বড় ভাই হিসেবে আমাকে মানো, তখন কিছুই লুকিয়ো না। তোমার মা আমারও মা। আমি তোমার একাউন্টে টাকা পাঠিয়েছি। মায়ের সাথে দেখা করে এসো। আমি এখন যাই।"
এই বলে মুগ্ধ এক মুহূর্তও দেরি না করে বাইকে চেপে বসলো, তার চোয়াল কঠোর ও অনড়। বাইকটি ধুলো উড়িয়ে তীব্র গতিতে ছুটে গেল, আর জীবন একা দাঁড়িয়ে থেকে মৃদু হাসল,
——— আপনি সত্যিই অদ্ভুত, স্যার।
____________
আঁখি দ্রুত পদক্ষেপে চলমান, ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে সম্মুখে সাব্বির সহ আরও তিন-চারজনকে আবিষ্কার করল। সাব্বির এতক্ষণ ব্যস্ত হাস্যকৌতুকে, আঁখির উপস্থিতিতে মুহূর্তেই তার মুখাবয়ব কেমন যেন নিস্তেজ ও স্থবির হয়ে উঠল। তবে আঁখির বিস্ময় ছিল আরও গভীর, সাব্বিরের ডান হাতটি ব্যান্ডেজে আবৃত, কাঁধ থেকে ঝুলানো। আঁখিকে দেখে সাব্বিরের আচরণ আরও অস্বাভাবিক হলো, তাড়াহুড়ো করে সরে গেল, যেন উপস্থিতি এড়িয়ে পালাতে চাইছে। আঁখি কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, মনের গভীরে এক অজ্ঞাত প্রশ্ন জেগে উঠল— এ কেমন আচরণ? সেদিন কি সে কিছু বলতে চেয়েছিল? কিন্তু অতীতের ধোঁয়াশাময় স্মৃতিগুলো ত্যাগ করে, আঁখি নিজেকে প্রবোধ দিল, এ নিয়ে ভাবার সময় নেই তার!
_____
আঁখি মিলির গৃহপানে অগ্রসর হচ্ছিল, পথিমধ্যে এক আশ্চর্য দৃশ্য তার দৃষ্টিতে ধরা দিল। শিকদার পরিবারকে একটি পৃথক স্থানে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে, ঠিক তাদের বিপরীতে বসেছে শাহারিয়াজ পরিবার। তবে তার বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমা ছুঁয়ে গেল, যখন সে দেখতে পেল ইকরাম আলী ও মোশারফ আলী হেসে হেসে পরস্পরের সাথে কথোপকথনে লিপ্ত। আঁখি যেন এক ধ্যানমগ্ন চিত্তে সেই দৃশ্যের দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইল, মস্তিষ্কে একটিমাত্র প্রশ্ন— স্বপ্ন দেখছে কি সে? এরা তো চিরশ'ত্রু, যাদের মধ্যে স্রেফ বিরোধ আর শত্রুতার ছায়া! আজ তারা কথার মাধ্যমে যেন শত্রুতার প্রাচীর ভেঙে ফেলেছে! ইকরাম আলীর দৃষ্টি আঁখির বিস্মিত দৃষ্টির দিকে গেলেও, তিনি তা উপেক্ষা করলেন। এমনই মুহূর্তে রোকেয়া বেগম আঁখির নাম ধরে ডেকে পাঠালেন। আঁখি তাদের সন্নিকটে যাওয়া মাত্রই আকস্মিকভাবে এক বৃদ্ধ তার হাত আঁকড়ে ধরল।
আঁখি হঠাৎ হাতের স্পর্শে চমকে উঠে পাশেই তাকাল—এক বৃদ্ধ । তবে আঁখির বিস্ময় আরও গভীর হলো, যখন সে চিনতে পারল—এ তো সেই বৃদ্ধ, যে শাহারিয়াজ বাড়ির চৌহদ্দিতেও তাকে একবার অবরোধ করেছিল! তার হাতের দৃঢ় স্পর্শে আঁখির বুক কেঁপে উঠল।। সকলেই মুহূর্তের ভেতর ভ্রু কুঁচকে তাকাল, পরিবারের নিরব দৃষ্টি যেন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠল। এমনকি আফিয়া বেগমও স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হারিয়ে এক ধরনের অবাক দৃষ্টি ফেললেন বৃদ্ধের দিকে। আঁখি ধীরে ধীরে নিজেকে স্থির করে, নরমস্বরে বলল,
——— "দাদু, কিছু বলবেন?"
আঁখি বিস্ময়ে জড়সড় হয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল। কালো চাদরে মোড়া সেই বুড়ো লোকটি তার দৃষ্টির গভীরে একপ্রকার অদ্ভুত চাহনি রেখে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ যেন তার অতীতের এক অমোঘ রহস্যের সন্ধান করছে। হঠাৎ করেই বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে আঁখির গাল ছুঁতে উদ্যত হলো, যেন শতাব্দীর গভীরে লুকিয়ে থাকা কোনো স্মৃতি ফের স্পর্শ করতে চাইছে। মুহূর্তেই আফিয়া বেগম তপ্ত ক্রোধে বলে উঠলেন,
——— "এই, এই, এই, কি করছেন আপনি? কত বড় স্পর্ধা?"
কিন্তু বৃদ্ধের চেতনাবোধ যেন অন্যত্র বিলীন। তার অন্ধকারাচ্ছন্ন চোখ দুটি আঁখির দিকে নিবদ্ধ, যেন কোনো তেজস্বী স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে তার সামনে। বিস্মিত কণ্ঠে সে সেদিনের মতোই ফিসফিস করল,
——— "সেই চোখ... হয়, সেই আগুনমাখা চোখ!"
আঁখি কি করবে, ভেবে কূল পেলো না। বৃদ্ধের হাতটি যেন তার হাতে লোহালক্কড়ের মতো গেঁথে গেছে। ছাড়াতে চাইবে কি? কিন্তু তিনি তো বৃদ্ধ, দুর্বলও বটে। ইকরাম আলীর দৃষ্টি প্রথমে উপেক্ষা করলেও এখন তার মনোযোগ আকর্ষিত হলো। বৃদ্ধটি আবার বিড়বিড় করে বলল,
——— "তুই ওর বেটি, তুই! হয় হয়, তুই ওরই ছাওয়াল!"
শিকদার ও শাহারিয়াজ পরিবারের লোকজন একে একে তাকিয়ে রইল কপালে ভাঁজ ফেলে। রোকেয়া বেগম এবার স্নায়ুচাপ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
——— "আমার মেয়ের হাত ছাড়ুন, চাচা!"
বৃদ্ধ ধীরপায়ে রোকেয়া বেগমের দিকে তাকাল, তার চোখের অশ্রুত গল্পগুলো এক লহমায় ফুটে উঠল। বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর আবারও ফিসফিস করে উঠল,
——— "তুইও তো সেই! তুই ও না?"
রোকেয়া বেগমের মুখে এক মুহূর্তের নীরবতা, যেন অতীতের এক ভুতুড়ে ছায়া তাকে গ্রাস করে ফেলল। আজগর আলীর ক্রো'ধ ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সাজ্জাদ সাহেব মোশারফের কানে ফিসফিস করে কিছু বললেন, যেন তারা বৃদ্ধের প্রতিটি কথা বুঝে উঠতে চাইছেন। সুহানা, নিসা বেগম ভ্রু কুচকে চেয়ে! আম্বিয়া বেগম পান চিবুচ্ছে আর চেয়ে আছে! কানিস বেগম একবার চাইলেন রোকেয়া বেগমের মুখপানে! ইকরাম আলী অনড়, তার চোখে দৃঢ়তা।
ঠিক তখনই শান্ত সামনে এসে বৃদ্ধের হাত কঠিনভাবে ধরল, তার শক্ত করাল স্পর্শে বৃদ্ধকে মাটিতে ফেলে দিল। আঁখি ভয়ে কেঁপে উঠলেও বৃদ্ধকে ধরতে উদ্যত হলো, কিন্তু শান্ত তাকে থামিয়ে দিয়ে শক্ত হাতে আঁখির হাত চেপে ধরল। রাগে তার চোখ জ্বলছে, যেন আগুনের স্ফু'লিঙ্গ।
——— "তোর জন্য আমাদের মানসম্মান কি এবার ধুলোয় মিশবে?"
শান্তের কণ্ঠ কঠিন। আঁখি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
——— "আমি কিছু জানি না! আমি কিছু করিনি!"
শান্ত আরও কঠোরভাবে তার হাত চেপে ধরে বলল,
——— "কিছু করিস না তুই! ওইসব ভিখিরির নোংরা হাত তোকে স্পর্শ করার সাহস পায় কিভাবে? তুই ভিখিরির মতো চললেও আমাদের মান আছে! বুঝেছিস? মনে হচ্ছে চাবুকের কথাটা ভুলে গিয়েছিস! আবারো মনে করিয়ে দিতে হবে?? "
এই বলে শান্ত আঁখির হাত ছেড়ে দিল। আঁখির চোখে অশ্রু জমে উঠল, সে দৌড়ে পালিয়ে গেল মিলির ঘরের দিকে। শান্তর এমন আচরণে ইকরাম আলীর ঠোঁটের কোণে গোপন হাসি ফুটে উঠল। সে সন্তুষ্ট—ছেলেটা তার রক্তের ধারা বইছে। আজগর আলী আর কুদ্দুসের মুখেও অদ্ভুত এক হাসি।
বৃদ্ধ লোকটি ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়েও ভয়ে-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে চলে যেতে লাগল। তার কণ্ঠস্বর নিস্তেজ হয়ে হাওয়ায় ভাসল,
——— " ও ওরই বেটি... মুই ভুল করু নাই... ভুল করিবার পারু না।"
______________
প্রচলিত কথার গতি যেমন বাতাসের ন্যায় ছুটে চলে, তেমনি শত্রুতা আর দূরত্বও কখনো কখনো কথার গোপন খপ্পরে আবদ্ধ হয়। ইকরাম আলী আর মোশারফ আলীর মধ্যে বিদ্যমান বিরোধের সত্ত্বেও, এক নিরব কথা বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে, মুহুর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের অলিগলিতে, মানুষের মুখে মুখে। যেন এক গুপ্ত স্রোত যা কেবল গুজবের আড়ালে বিকশিত হয়েছে। এমন কি, কথার তপ্ত স্রোতে শোনা যাচ্ছে, মোশারফ আলীর পুত্রের সাথে ইকরাম আলীর কন্যার বিবাহোৎসবের সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠছে!
আফ্রিদি, দিগভ্রান্তের মতো উদভ্রান্তভাবে চলছিল, যেন নিজের ভেতরকার দ্বন্দ্বে হারিয়ে গেছে। কিন্তু আকস্মাৎ এক কথা তার মস্তিষ্কে আঘাত করলো—হঠাৎ যেন বেদনার শলাকা হয়ে প্রবেশ করলো মনে। পাশ দিয়ে চলমান লোকজনের মৃদু কথোপকথন তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছিল, আর তারা মুখর ছিল সেইই প্রচারিত কথার বীজ বপনে,
——— “চেয়ারম্যানের মাইয়ার লগে সাবেক চেয়ারম্যানের পোলার বিয়াও নাকি ঠিক হইছে!”
আফ্রিদির মন স্তব্ধ, যেনো কোনো দুর্বোধ্য বজ্রপাতের অশনি সংকেত ভেঙে পড়ল তার অস্তিত্বের উপর। দেহের প্রতিটি শিরা উপশিরায় যেনো বরফের মতো এক বিষাদাচ্ছন্ন ঠাণ্ডা জমাট বেঁধে গেছে। বিয়ে? পূর্বিকার বিয়ে? আর সে কিনা মুগ্ধর সাথে? এই অকস্মাৎ সংবাদ যেনো তার আত্মার মধ্যে এক মহাপ্রলয়ের আগমনী ধ্বনি বাজিয়ে দিলো। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নিজের চুলের মুঠো ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাতে লাগলো, মনে হলো যেনো তার চিন্তাধারার শেকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। হাসিতে রূপ নিলো সেই বেদনা—পাগলামির মতো এক অস্বাভাবিক হাসি। এই কি তবে সেই কারণ, যার জন্য পূর্বিকা তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে মুগ্ধর সাথে কথা বলেছিলো? কেন পূর্বিকা আফ্রিদিকে জানালো না? তবে কি সব সত্যিই শেষ হয়ে গেলো? পূর্বিকা কি তার জীবনের সব পথ রুদ্ধ করে দিয়ে গেলো, তার বেঁচে থাকার একমাত্র আকাঙ্ক্ষাটুকু নীরবে ছিনিয়ে নিলো?
--
পূর্বরাগে আচ্ছন্ন, অগ্নিশর্মা মুগ্ধ যখন সেই দ্রুতগামী রথের বেগে স্বপ্নালু পথ বেয়ে এগিয়ে চলছিল, হঠাৎ তার দৃষ্টিপথে প্রতিভাত হলো আফ্রিদির ছায়ামূর্তি, শান্ত ও অচঞ্চল। কাষ্ঠবৎ কঠিন মুখশ্রী, একটুও ভ্রুকুটি না করে, মুগ্ধ মুহূর্তে যেন পবনপুত্রের ন্যায় বাইকের লাগাম টেনে ধরল। ইস্পাত কঠিন ব্রেকের শব্দে পথ যেন কেঁপে উঠল, আর মুগ্ধ এক দুর্ধর্ষ গতিতে বাইক থেকে নেমে দৃপ্ত পদক্ষেপে আফ্রিদির দিকে এগিয়ে গেল।
মনের অমিত আগ্রহে বহুদিন অপেক্ষারত ছিল সে, কিন্তু আজ যেন তার অন্তরের উত্তপ্ত শিখা তীব্র হয়ে উঠেছে। বাল্যবন্ধুত্বের প্রাচীন সুত্রটিকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এতদিন সব রাগ গিলে ফেলেছিল, কিন্তু পৃথিবীটা এমন নিষ্ঠুর যে, শিষ্টাচারের কোনো মূল্যই যেন এখানে নেই! শিরদাঁড়া সোজা, দৃঢ় প্রত্যয়ে সে আফ্রিদির সামনে এসে দাঁড়াল, যেন বাতাস থেমে গেছে, সমস্ত আকাশ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সংঘাতের অপেক্ষায়।
মুগ্ধের চোয়াল শক্ত, চোখের পলকে না দেখে ওলটপালট করে দিতে প্রস্তুত সে, আজ আর কোনো সংযমের বাধা রইবে না।
তবে আফ্রিদিকে দেখেই মুগ্ধর ভ্রুকুটি গভীরতর হলো। ধ্বংসস্তূপের মতো বিমর্ষ দেখাচ্ছে আফ্রিদিকে। মুগ্ধর আকস্মিক আগমন যেন নিভে যাওয়া একটুখানি আগুনকে পুনরায় শিখার শিখরে জ্বালিয়ে তুলল আফ্রিদির মনে । রোহানের কথাগুলো মিথ্যার বেসাতি ছাড়া আর কিছুই নয়—এই সত্যটি বুঝে আফ্রিদির অন্তর এক বিদ্রোহে ফেটে পড়ল। তার ইচ্ছে হলো মুগ্ধর তুষারধবল মসৃণ গালে এমন এক ঘুষি বসিয়ে দেয় যেন গালটি রক্তিমাভায় জ্বলে উঠুক। কিন্তু রাগের আগুনে জ্বলে ওঠা সত্ত্বেও আফ্রিদি দ্রুত পিছিয়ে যেতে উদ্যত হলো। আর ঠিক তখনই মুগ্ধর গর্জন যেন বজ্রধ্বনির মতো আকাশ বিদীর্ণ করে উঠল,
———" তুই আমার কথা শোনার জন্য বাধ্য!"
আফ্রিদি রাগে টগবগ করে ফুটতে ফুটতে পিছন না ফিরেই বলল,
——— "তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই!"
মুগ্ধর এবার এমন ক্ষোভ জন্মালো যে ইচ্ছা হলো আফ্রিদির মাথায় গু'লি চালিয়ে মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন করে দেয়! কিন্তু সম্ভবত ছোটবেলার বন্ধুত্বের স্মৃতি তাকে স্তব্ধ করে রেখেছে। আজ আফ্রিদির জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, মুগ্ধের হাত কাঁপত না, সিদ্ধান্তে এক বিন্দু দ্বিধা থাকত না। কিন্তু কোথাও তার অন্তরের গভীরে একটি কোমলতর স্থান রয়ে গেছে, যা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেখানে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। এতদিনের বন্ধু হঠাৎ বদলে গেলে হৃদয়ের গভীরে জ্বলন্ত দাবানলের মতো ক্ষোভের আ'গুন ছড়িয়ে পড়ে!
মুগ্ধ রাগে আফ্রিদির সামনে এসে তার কলার চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে ফুঁসিয়ে উঠল,
——— "আমার কথাই শেষ কথা!"
আফ্রিদিও সেই একই ক্রোধে গর্জে উঠে মুগ্ধর কলার চেপে ধরে পাল্টা বলল,
——— "এই কারণেই তো তুই সবকিছু কেড়ে নিয়েছিস, আমায় শূন্য করে দিয়েছিস!"
এই বলে আফ্রিদি মুগ্ধর কলার ছেড়ে নিজেকে মুক্ত করে দৃঢ় পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে গেলো। মুগ্ধর রাগ যেন আগুনের শিখা হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। মুহূর্তেই সে পি'স্তলে হাত রেখে আফ্রিদিকে এখানেই শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছে করলো। কিন্তু সহসা তার হাত থেমে গেলো! চোখ বুজে, বুকের গভীর থেকে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে সংযত করল। ফের ক্রোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে আফ্রিদির সম্মুখে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ উচ্চারণ করল,
——— "আমি পূর্বিকাকে..."
কিন্তু বাক্যের মাঝপথেই মুগ্ধর অধরোন্মুখে আঘাতের কঠিন শিলাস্তম্ভ হয়ে দাঁড়াল আফ্রিদির মুষ্টিযুগল! প্রচণ্ড আ'ঘা'তে মুগ্ধর মুখ বাঁ দিকে ছিটকে গেল; তার ব্রাউন ওষ্ঠদ্বয় ভেদ করে স্রোতের মতো র'ক্তধারা প্রবাহিত হলো। সেই র'ক্তা'ক্ত আঘাতেই মুগ্ধর সমস্ত চেতনা র'ক্তিম রাগের অতলান্তিক গর্জনে পর্যবসিত হলো। শিরায় শিরায় উত্তপ্ত ক্রোধের শিখায় জ্বলে ওঠা মুগ্ধ, মুহূর্তের মধ্যে আফ্রিদির চোয়ালে একের পর এক ঘু'ষির বজ্রাঘাত বর্ষণ করল! গর্জে উঠল মুগ্ধের কঠিন স্বর,
——— "আমার উদারতার মর্মে আঘাত করছিস! এ তোকে ভুল প্রমাণ করবে! এখন দেখ, মুগ্ধ আসলে কি জিনিস!"
মুগ্ধ নির্দ্বিধায় আফ্রিদির উদরের মধ্যে এক তীব্র মুষ্টির আঘাত হেনে তাকে ছিটকে দূরে ফেলে দিল। আফ্রিদির অন্তরে ক্রো'ধের আগুন এতটাই প্রজ্বলিত যে, সে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে একাগ্রভাবে কেবল একটি চিন্তায় আচ্ছন্ন— মুগ্ধ আর পূর্বিকার বিবাহ! পুনরায় উঠে দাঁড়িয়ে সে মুগ্ধকে ঘু'ষি মারার জন্য তেড়ে এল, কিন্তু মুগ্ধ শক্ত হাতে আফ্রিদির আক্রমণ প্রতিহত করল। এরপর প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলে ওঠা মুগ্ধের মুষ্টির প্রচণ্ড আঘাত আফ্রিদির নাসায় এসে পড়ল— নাক ফেটে সেখান থেকে গাঢ় র'ক্তধারা বয়ে যেতে লাগল!
আফ্রিদি ব্যথার সঙ্গে ক্রো'ধের মিশেলে চিৎকার করে উঠল,
——— "তোকে আমি শেষ করে ফেলব!"
দুজনের সংঘর্ষের মাঝখানে হঠাৎ করেই দূরাগত এক গভীর, পরিচিত কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হলো। আফ্রিদির পিতার তীব্র ডাক ক্রমশ নিকটবর্তী হচ্ছে। বিয়ে বাড়ির কোলাহলে ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে যখন উৎকণ্ঠিত পিতা জানতে পারলেন যে, তার সন্তান এই পথে এসেছে, তখন তাঁর উদ্বেগ ভরা মন কণ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে উঠল। এক আশঙ্কামিশ্রিত আবেগে তিনি ছুটে চললেন, ডাকতে ডাকতে।
মুগ্ধ তখনও প্রতিশোধের লেলিহান শিখায় উত্তপ্ত, আরও এক প্রবল আ'ঘাতের জন্য মুষ্টি তুলেছিল, যা তার আফ্রিদির দাঁত ছিন্ন করতে সক্ষম হত। কিন্তু সেই প্রতাপশালী পিতৃকণ্ঠের ডাক তাঁর কানে পৌঁছালে, সে মুহূর্তেই থমকে গেল, হাত নামিয়ে নিজের ক্রো'ধকে কিছুটা দমন করল। তারপর ক্রো'ধের ছটায় আফ্রিদির কলার ধরে, নির্দয়ভাবে তাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলল।
আফ্রিদি এই র'ক্তা'ক্ত মুখ নিয়ে পিতার সম্মুখে দাঁড়ানো এখন অসম্ভব! তার নাসা আর ঠোঁটে র'ক্তের ছড়াছড়ি!
তখন আফ্রিদির পিতা তাদের কাছে গিয়ে পেছন থেকে কঠোরতা ভরে তীব্র গর্জন করলেন,
———" তোর মায়ের কাছে থাকতে বলেছিলাম, তুই এখানে এসে আড্ডা দিচ্ছিস?
আফ্রিদি দৃঢ় চোয়ালে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে রইল, যেন তার ভেতরে জ্বলন্ত আগুন আরও ঘন হয়ে উঠছে। অন্যদিকে মুগ্ধর চেহারা রাগে উত্তপ্ত, চোখ-মুখ লাল হয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, কিন্তু সে পিতৃসাম্মুখে নিজেকে স্থির রেখেছে, যেন এক প্রবল ঝড়ের মুখে অবিচল এক প্রাচীর। আফ্রিদি ক্রো'ধে গিজগিজ করলেও বাবার সামনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে না, আর এতেই রায়হান সাহেবের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। তিনি তীব্র স্বরে বললেন,
——— " এখন কেন এদিকে ফিরছিস না? বাবার সামনে এমন ধৃষ্টতা করার সাহস হয় কিভাবে?"
আফ্রিদির কণ্ঠ যেন নিচু হলেও আগ্নেয়গিরির গর্জনের মতো শোনাল,
——-— " আমার খুব জরুরি কাজ আছে! পরে আসছি!"
এই বলে সে মুগ্ধর দিকে এক ঝলক চোখ ফেলেই দ্রুত পায়ে চলে গেল। রায়হান সাহেব বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে রইলেন। এতক্ষণে মুগ্ধর মুখের দিকে ভালোমতো তাকানোর সময় পাননি, কিন্তু যখন দেখলেন মুগ্ধর ফর্সা মুখমণ্ডল লালে লালে মাখামাখি, তার উঁচু নাকও রক্তিম লাল, ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে—তখনই আঁতকে উঠলেন। অবাক হয়ে বললেন,
——— "কিরে বাপ, তোর মুখ এমন লাল কেন? ঠোঁট কাটল কিভাবে?"
মুগ্ধ গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল,
——— "কিছু না চাচা, একটু কুস্তি লড়তে গিয়ে এমন হয়েছে।"
রায়হান সাহেব গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলেন, তারপর হেসে ফেললেন,
——— "তোরা যে কি করিস,, আমরাও যখন তোদের বয়সী ছিলাম তখন কত কুস্তি, বক্সিং করেছি! কিন্তু নিজেদের খেয়াল রাখতে হবে বুঝেছিস? এগুলো মজার ছলেই ঠিক আছে এর থেকে বেশি হলে সমস্যা! এই যে কেমন ঠোঁট টা কাটিয়েছিস! "
এরপর মুঠো ফোনে সময় দেখে বললেন,
——— "আচ্ছা বাপ, আমি যাই। তোর চাচি ওদিকে তার বাদর ছেলেকে খুঁজে অজ্ঞান হয়ে আছে। গিয়ে জানাই, তার বাদর ছেলে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে!"
মুগ্ধ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না, শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল, তার শরীর এখন রাগের আগুনে জমাট বাঁধা। রায়হান সাহেব ফিরে যেতে লাগলেন, আর মুগ্ধ আফ্রিদির উদ্দেশ্যে দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলল,
———— তুই পস্তাবি, তোর এই ধৈর্যহীন স্বভাবের জন্য ভয়ংকরভাবে পস্তাবি! আর এমনভাবে পস্তাবি যে সেদিন পালানোর পথও খুঁজে পাবি না!
0 Comments